🕋 تفسير سورة الأنفال
(Al-Anfal) • المصدر: BN-TAFISR-FATHUL-MAJID
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ ۖ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
📘 নামকরণ ও প্রাসঙ্গিক কথা:
الْاَنْفَالُ শব্দটি نَفْلٌ এর বহুবচন, অর্থ অতিরিক্ত। আনফাল ঐ সম্পদকে বলা হয় যা কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করে মুসলিমদের হস্তগত হয়। একে গনীমতের মালও বলা হয়। তবে একে আনফাল বলা হয় এ জন্য যে, যুদ্ধলব্ধ মাল পূর্ববর্তী জাতিদের জন্য হারাম ছিল, শুধু এ উম্মাতের জন্য তা হালাল করা হয়েছে তাই একে অতিরিক্ত হালাল বলা হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
(وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ وَلَمْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِيْ)
আমার জন্য গনীমত হালাল করে দেয়া হয়েছে, অথচ আমার পূর্বে কারো জন্য তা হালাল ছিল না। এ সূরার প্রথম আয়াতে আনফাল শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সূরাটিতে আনফালের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বলে এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাকে সূরা বদরও বলা হয়। (ফাতহুল কাদীর, ২/৩৫৯)
এ সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ। তবে ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সাতটি আয়াত ব্যতীত। তা হল ...
(وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا)
থেকে পরবর্তী সাত আয়াত (৩০-৩৭) পর্যন্ত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের সালাতে এ সূরা তেলাওয়াত করতেন। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ, ২/১১৮, সহীহ, ফাতহুল কাদীর, ২/৩৫৯)
সাঈদ বিন যুবাইর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে সূরা আনফালের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বলেন: এটা বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৪৫)
শানে নুযূল:
সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: বদরের দিন আমার ভাইকে হত্যা করা হয়। ফলে তার বদলে আমি সাঈদ বিন আসকে হত্যা করলাম। অতঃপর তার তরবারী নিয়ে নাবী (সাঃ)-এর নিকট আসলাম। নাবী (সাঃ) বললেন: যাও, এটা যেখান থেকে এনেছ সেখানে রেখে দাও! আমি ফিরে আসলাম কিন্তু আমার ভাইকে হত্যা ও আমার পাওয়া তরবারী নিয়ে নেয়ার কারণে আমার যে অবস্থা হয়েছিল তা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ জানে না। কিছু জায়গা অতিক্রম করার পরেই সূরা আনফাল অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদ আহমাদ ১/৪৮০, সনদ সহীহ)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে: সা‘দ (রাঃ) বলেন: বদরের দিন আমি একটি তরবারী নিয়ে আসলাম এবং বললাম, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ)! আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের থেকে আমার অন্তরকে মুক্ত করেছেন, সুতরাং আমাকে এ তরবারীখানা দিয়ে দিন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন: এটা তোমারও না, আমারও না। আমি বললাম: সম্ভবত আমার মত কষ্টের সম্মুখিন হয়নি এমন কাউকে দিয়ে দেয়া হবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাঃ) আমার কাছে আসলেন এবং বললেন: তুমি যখন তরবারী চেয়েছিলে তখন তার মালিক আমি ছিলাম না, এখন আমার হয়েছে তাই আমি তা তোমাকে দিয়ে দিলাম। তখন এ সূরা নাযিল হয়। (তিরমিযী হা: ৩০৭৯, আবূ দাঊদ হা: ২৭৪০ হাদীসটির মূল সহীহ মুসলিমে বিদ্যমান।)
এ ছাড়াও আরো শানে নুযূল পাওয়া যায়। (বিস্তারিত দ্র: তাফসীর ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু।
১ নং আয়াতের তাফসীরঃ
শানে নুযূল:
এ আয়াতের কয়েকটি শানে নুযূল পাওয়া যায় তার মধ্যে দুটি উল্লেখ করা হল:
১. ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী (সাঃ) বলেছেন: যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করবে তার জন্য এই এই রয়েছে। যে ব্যক্তি কাউকে বন্দি করবে তার জন্য এই এই রয়েছে। তখন বৃদ্ধরা ঝাণ্ডা নিয়ে বসে রইল আর যুবকরা গনীমতের আশায় হত্যা করার জন্য দ্রুত ধাবিত হল। তখন বৃদ্ধরা যুবকদের বলতে লাগল: তোমাদের সাথে আমাদেরকেও শরীক করিও। কেননা আমরাও তোমাদের পিছনে ছিলাম। তোমাদের কেউ ক্ষত-বিক্ষত হলে আমাদের কাছে এসেছ। অতঃপর তারা এ বিবাদ নিয়ে নাবী (সাঃ)-এর নিকট আগমন করল। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আবূ দাঊদ হা: ২৭৩৭, সহীহ)
২. সা‘দ বিন মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি বদরের দিন একটি তরবারী নিয়ে এসে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আজ আমার অন্তরকে মুশরিকদের থেকে পরিচ্ছন্ন করেছেন। এ তরবারী খানা আমাকে দিন। তিনি (সাঃ) বললেন: এ তরবারী তোমারও না আমারও না। আমি বললাম: হয়তো এ তরবারী এমন কাউকে দেয়া হবে যে আমার মত বিপদের সম্মুখীন হয়নি। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার কাছে আসলেন এবং বললেন: তুমি আমার কাছে এ তরবারীটি চেয়েছিলে কিন্তু তখন সেটা আমার ছিল না; এখন এটা আমার হয়েছে তাই তোমাকে তা দিয়ে দিলাম। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭৪৮, তিরমিযী হা: ৩০৭৯, আবূ দাঊদ হা: ২৭৪০, সহীহ)
আনফাল দ্বারা উদ্দেশ্য কী এ ব্যাপারে আলিমদের পাঁচটি উক্তি পাওয়া যায়। এ পাচঁটি উক্তি আল্লামা শানক্বীতি (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করার পর বলেন: আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য কথা হল যা ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে জমহুরদের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন:
(وَاعْلَمُوْآ أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِّنْ شَيْءٍ)
এ আয়াত দ্বারা
(يَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ)
এ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে। তবে আবূ উবায়দা (রাঃ) বলেছেন যে, বদরের গনীমত পাঁচ ভাগ করা হয়নি। কেননা আয়াতটি বদরের গনীমত বণ্টনের পর অবতীর্ণ হয়েছে এ কথা সঠিক নয়। কারণ আলী (রাঃ) হতে প্রমাণিত যে, তিনি বলেন: বদরের গনীমতের মাল থেকে প্রাপ্য অংশ হিসেবে আমার একটি উটনী ছিল। রাসূলুল্লাহ (রাঃ) সেদিন আমাকে গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ থেকে উটনীটি দিয়েছিলেন। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৭৯)
মোটকথা (وَاعْلَمُوْآ أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِّنْ شَيْءٍ)
৪১ নং আয়াতটি প্রমাণ করছে আয়াতের শুরুতে যে গনীমতের মাল রাসূলের (সাঃ) ব্যাপারে বলা হয়েছে তা শুধু রাসূলের (সাঃ) সাথে সীমাবদ্ধ নয়; বরং পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাসূলের (সাঃ) এর জন্য আর বাকি চার ভাগ যোদ্ধাদের জন্য। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চারটি পদ্ধতিতে সাহাবীদের মাঝে গনীমতের মাল বন্টন করে দিতেন।
১. এ কথা ঘোষণা করে দেয়া যে, যে ব্যক্তি কোন বিরোধী শত্রুকে হত্যা করবে- নিহত ব্যক্তির সামগ্রী যা তার সাথে থাকবে সেগুলো হত্যাকারী পাবে। এসব সামগ্রী গনীমতের সাধারণ মালের সাথে জমা হবে না। ২. বড় কোন সৈন্যদল থেকে কোন দলকে পৃথক করে কোন বিশেষ দিকে জিহাদ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া এবং এমন নির্দেশ দেয়া যে, এদিক থেকে যেসব গনীমত আসবে সেগুলো উল্লিখিত বিশেষ দলের জন্য নির্দিষ্ট হবে যারা সে অভিযানে অংশগ্রহণ করবে। তবে এতে শুধু এতটুকু করতে হবে যে, সমস্ত মালামাল থেকে এক পঞ্চমাংশ সাধারণ মুসলিমদের প্রয়োজনে বায়তুল মালে জমা দিতে হবে। ৩. বায়তুল মালে গনীমতের যে এক পঞ্চমাংশ জমা করা হয়, তা থেকে কোন বিশেষ যোদ্ধাকে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য প্রতিদান হিসেবে আমীরের কল্যাণ বিবেচনা অনুযায়ী কিছু দান করা। ৪. গনীমতের সমস্ত মাল থেকে কিছু অংশ পৃথক করে নিয়ে সেবক লোকেদের মধ্যে পুরস্কারস্বরূপ দান করা, যারা মুজাহিদ বা সৈনিকদের ঘোড়া প্রভৃতির দেখাশুনা করে এবং তাদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। (তাফসীর ইবনু কাসীর)
পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা, নিজেদের মাঝে সদভাব স্থাপন এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
নিজেদের মাঝে সদভাব স্থাপনের অন্যতম উপায় হল: পরস্পর ভাল ব্যবহার করা, কারো দ্বারা মন্দ কিছু ঘটে গেলে ক্ষমা করে দেয়া, অপরের দোষত্র“টি না খোঁজা ও পরনিন্দা না করা ইত্যাদি। আর আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করার ব্যাপারটি তো ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোন মু’মিন আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের বাইরে যেতে পারে না। এটাই ঈমানের পরিচয়। সুতরাং সকল মু’মিনের উচিত দীনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণে কোন কাজ করবে না এবং তাদের নির্দেশ বহির্ভূত কোন আমল করবে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গনীমতের সম্পদ পূর্ববর্তী সকল উম্মাতের জন্য হারাম ছিল, যা আমাদের জন্য হালাল; তাই তাকে গনীমত বলা হয়।
২. নিজেদের মাঝে সদভাব স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হল: পরস্পর ভাল ব্যবহার করা ও অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটে গেলে ক্ষমা করে দেয়া।
৩. তাক্বওয়া বা আল্লাহ তা‘আলা ভীতি সৌহার্দ্য ও ঐক্যের প্রতীক।
۞ وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
📘 ৪১ নং আয়াতের তাফসীরঃ
এ আয়াতে গনীমতের মাল বণ্টন পদ্ধতির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। গনীমত ও ফাঈ এর মধ্যে ফকিহগণ পার্থক্য করেছেন। এখানে গনীমতের সম্পদ বণ্টন পদ্ধতি উল্লেখ করা হল। ফাঈ এর আলোচনা সূরা হাশরে আসবে- ইনশা-আল্লাহ।
গনীমত হল যা শত্রুদের থেকে যুদ্ধ শেষে প্রাপ্ত হয়। এ সম্পদ পাঁচভাগে ভাগ করা হবে। চার ভাগ মুজাহিদদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিতে হবে। তাতে পদাতিক বাহিনীকে একভাগ আর অশ্বারোহী বাহিনীকে তিন ভাগ দিতে হবে। একভাগ তার, আর দুইভাগ ঘোড়ার।
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘোড়ার দুই অংশ ও মালিকের জন্য এক অংশ নির্ধারণ করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৬৩)
আর পাঁচভাগের একভাগ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য। এ এক ভাগকে আবার পাঁচভাগে ভাগ করা হবে।
প্রথমভাগ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য। এ সম্পদ মুসলিমদের কল্যাণকর কাজে ব্যয় করা হবে।
দ্বিতীয়ভাগ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটাত্মীয়দের জন্য। তারা হল বানী হাশেম ও বানী মুত্তালিব। যাদের জন্য যাকাতের মাল হারাম।
তৃতীয়ভাগ ইয়াতীমদের জন্য। চতুর্থভাগ মিসকিনদের জন্য যারা গরীব দুঃখী অসহায়।
পঞ্চমভাগ: পথিকদের জন্য। একথাই নাবী (সাঃ) বলেছেন: একপঞ্চমাংশ তোমাদের মধ্যে ফেরত দেয়া হবে। (সহীহ নাসাঈ হা: ৪১৪৯, সহীহ।)
(يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَي الْجَمْعَانِ)
‘মীমাংসার দিনে, যেদিন উভয় সেনা দল মুখোমুখি হয়েছিল’“ফায়সালার দিন”বলতে হক বাতিলের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালার দিন, আর সে দিন হল বদর যুদ্ধের দিন। কারণ মুসলিম ও কাফিরদের মাঝে এটাই প্রথম ধর্মযুদ্ধ যাতে ইসলাম বিজয়ী হয়েছিল এবং ইসলাম ও কুফরীর মাঝে প্রকাশ্যে ফায়সালা হয়ে গিয়েছিল।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. গনীমতের সম্পদ বণ্টন নীতি জানলাম।
২. বদরের দিনকে ফায়সালার দিন বলার কারণ অবগত হলাম।