Al-Israa • BN-TAFSEER-IBN-E-KASEER
﴿ تُسَبِّحُ لَهُ ٱلسَّمَٰوَٰتُ ٱلسَّبْعُ وَٱلْأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ ۚ وَإِن مِّن شَىْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِۦ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًۭا ﴾
“The seven heavens extol His limitless glory, and the earth, and all that they contain; and there is not a single thing but extols His limitless glory and praise: but you [O men] fail to grasp the manner of their glorifying Him! Verily, He is forbearing, much-forgiving!”
সাত আকাশ, যমীন ও এগুলির অন্তর্বর্তী সমস্ত মাখলুক আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা, মহিমা এবং শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে থাকে। মুশরিকরা যে আল্লাহ তাআলার সত্তাকে বাজে ও মিথ্যা বিশেষণে বিশেষিত করছে, এর থেকে সমস্ত মাখলুক নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করছে এবং তিনি যে মা’রূদ ও প্রতিপালক এটা তারা অকপটে স্বীকার করছে। তারা এটাও স্বীকার করছে যে, তিনি এক, তার কোন অংশীদার নেই। অস্তিত্ব বিশিষ্ট সব কিছু আল্লাহর একত্বের জীবন্ত সাক্ষী। এই নালায়েক, অযোগ্যও অপদার্থ লোকদের আল্লাহ সম্পর্কে জঘন্য উক্তিতে সারা মাখলুক কষ্টবোধ করছে। অচিরেই যেন আকাশ ফেটে যাবে, পাহাড় ভেঙে পড়বে এবং যমীন ধ্বসে যাবে।ইমাম তিবরানীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, মিরাজের রাত্রে হযরত জিবরাঈল (আঃ) ও হযরত মীকাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মাকামে ইবরাহীম ও যমযম কূপের মধ্যবর্তী স্থান হতে নিয়ে যান। হযরত জিবরাঈল (আঃ) ছিলেন ডান দিকে এবং হযরত মীকাঈল (আঃ) ছিলেন বাম দিকে। তাঁরা তাঁকে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন। তিনি বলেনঃ “আমি উচ্চাকাশে বহু তাসবীহ এর সাথে নিম্নের তাসবীহও শুনেছিঃ (আরবি) অর্থাৎ “ভয় ও প্রেমপ্রীতির পাত্র, মহান ও সর্বোচ্চ আল্লাহর পবিত্রতা, মহিমা এবং শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে উচ্চাকাশ সমূহ।”মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ মাখলুকের মধ্যে সমস্ত কিছু তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা ও প্রশংসা কীর্তণ করে থাকে। কিন্তু হে মাবন মণ্ডলী! তোমরা তাদের তদ্বীহ্ বুঝতে পার না। কেননা, তাদের ভাষা তোমাদের জানা নেই। প্রাণী, উদ্ভিদ এবং জড় পদার্থ সবকিছুই আল্লাহর তাসবীহ্ পাঠেরত রয়েছে।হযরত ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যুগে তারা খাদ্য খাওয়ার সময় খাদ্যের তাসবীহ শুনতে পেতেন। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে) হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হস্তের মুষ্টির মধ্যে কয়েকটি পাথর নেন। আমি শুনতে পাই যে, ওগুলি মৌমাছির মত ভন্ করে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছে। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকরের (রাঃ) হাতে, হযরত উমারের (রাঃ) হাতে এবং হযরত উছমানের (রাঃ) হাতেও।” (এ হাদীসটি সহীহ ও মুসনাদগ্রন্থ সমূহে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে) রাসূলুল্লাহ (সঃ) কতকগুলি লোককে দেখেন যে, তারা তাদের উষ্ট্রী ও জন্তুগুলির উপর আরোহণরত অবস্থায় ওগুলিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এদেখে। তিনি তাদেরকে বলেনঃ “সওয়ারী শান্তির সাথে গ্রহণ কর এবং উত্তমরূপে ছেড়ে দাও। ওগুলিকে পথে ও বাজারের লোকদের সাথে কথা বলার চেয়ার বানিয়ে রেখো না। জেনে রেখো যে, অনেক সওয়ারী তাদের সওয়ার চেয়েও উত্তম হয়ে থাকে।” বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ব্যাঙকে মারতে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' এই কালেমাটি পাঠের পরেই কারো পূণ্যের কাজ গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। (মুসনাদে আহমাদে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে)“আলহামদু লিল্লাহ’ হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশক কালেমা। যে এটা পাঠ করে না সে আল্লাহ তাআলার অকৃতজ্ঞ বান্দা। ‘আল্লাহু আকবর’ যমীন ও আসমানের মধ্যবর্তী শূন্য স্থান পূর্ণ করে থাকে। ‘সুবহানাল্লাহ’ হচ্ছে মাখলুকের তাসবীহ! যখন কেউ (আরবি) পাঠ করে তখন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার বান্দা আমার অনুগত হয়েছে। এবং আমাকে সবকিছু সমর্পণ করেছে।” বর্ণিত আছে যে, একজন বেদুইন রেশমী হাত ও রেশমী বোস্তামী বিশিষ্ট তায়ালিসী জুব্বা পরিধান করে রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট আগমন করে এবং বলতে শুরু করেঃ “এই ব্যক্তির (রাসূলুল্লাহর (সাঃ) উদ্দেশ্য এটা ছাড়া অন্য কিছু নয় যে, তিনি রাখালদের ছেলেদেরকে সমুন্নত করবেন এবং নেতাদের ছেলেদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।” তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তার অঞ্চল টেনে ধরে বলেনঃ “আমি তোমাকে জন্তুর পোষাক পরিহিত দেখছি না তো?” তারপর তিনি ফিরে আসেন এবং বসে পড়ে বলতে শুরু করেনঃ “হযরত নূহ (আঃ) তাঁর মৃত্যুর সময় নিজের ছেলেদের ডেকে নিয়ে বলেনঃ “আমি তোমাদেরকে অসিয়ত হিসেবে দু’টো কাজের হুকুম করছি এবং দু'টো কাজ থেকে নিষেধ করছি। নিষিদ্ধ কাজ দু’টি এই যে, তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবে না এবং অহংকার করবে না। আর আমি তোমাদেরকে হুকুম করছি এই যে, তোমরা (আরবি) পাঠ করতে থাকবে। কেননা, আসমান যমীন এবং এতোদুভয়ের অন্তর্বর্তী যত কিছু রয়েছে সব গুলোকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয় এবং অন্য পাল্লায় শুধু এই কালেমাটি রাখা হয় তবে, এই কালেমাটির পাল্লাই ভারী হয়ে যাবে। জেনে রেখো, যদি সমস্ত আকাশ ও যমীনকে একটা বৃত্ত বানানো হয় এবং এই কালেমাটি ওর উপর রাখা হয় এটা ওকে টুকরা টুকরা করে ফেলবে। দ্বিতীয় হুকুম এই যে, তোমরা (আরবি) পাঠ করতে থাকবে। কেননা, এটা হচ্ছে প্রত্যেক জিনিসের নামায। আর এর কারণেই প্রত্যেককে রিযক দেয়া হয়ে থাকে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণনা করা হয়েছে) তাফসীরের ইবনু জারীরে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এসো, হযরত নূহ (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে যে হুকুম করেছিলেন তা আমি তোমাদের নিকট বর্ণনা করি। তিনি বলেছিলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎসগণ! আমি তোমাদেরকে হুকুম করছি যে, তোমরা ‘সবুহানাল্লাহ’ বলতে থাকবে। এটা সমস্ত মাখলুকের তাসবীহ এবং এরই মাধ্যমে তাদেরকে রিযক দেয়া হয়।। আল্লাহ তাআলা বলেন যে, সমস্ত জিনিস তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে থাকে।” (বর্ণনাকারী যানদীর কারণে এই হাদীসটির ইসনাদ দুর্বল)ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, স্তম্ভ, গাছ-পালা, পানির খড়খড় শব্দ এ সব কিছুই আল্লাহর তাসবীহ।আল্লাহ তাআলা বলেন যে, সমস্ত জিনিস আল্লাহর প্রশংসা পাঠ ও গুণকীর্তণে নিমগ্ন রয়েছে। ইবরাহীম (রাঃ) বলেন যে, খাদ্য ও তাসবীহ পাঠ করে থাকে। সূরায়ে হাজ্জের আয়াতও এর সাক্ষ্য প্রদান করে। মুফাসসিরগণ বলেন যে, আত্মা বিশিষ্ট সব কিছুই আল্লাহর তাসবীহ পাঠে রত রয়েছে। যেমন প্রাণীসমূহ ও গাছ-পালা। একবার হযরত হাসানের (রাঃ) কাছে খাদ্যের খাঞ্চা আসলে হযরত আবু ইয়াযীদ রাকাশী (রঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আবু সাঈদ (রঃ)! খাঞ্চাও কি তাসবীহ পাঠকারী?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “হাঁ, তাই ছিল।” ভাবার্থ এই যে, যেই পর্যন্ত ওটা কাঁচা কাঠের আকারে ছিল সেই পর্যন্ত তাসবীহ পাঠকারী ছিল। কিন্তু যখন ওটাকে কেটে নেয়ার পর ওটা শুকিয়ে গেছে তখন তাসবীহ পাঠও শেষ হয়ে গেছে। এই উক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় নিম্নের হাদীসটিও উল্লেখযোগ্য। একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু’টি কবরের পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় বলেনঃ “এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে বড় পাপের কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। তাদের একজন প্রসাব করার সময় পর্দার প্রতি খেয়াল রাখতো না। অপরজন ছিল পরোক্ষ নিন্দাকারী!” অতঃপর তিনি একটি কাঁচা ডাল নিয়ে ওকে দুভাগ করতঃ দুই কবরের উপর গেড়ে দিলেন। অতঃপর বললেনঃ “সম্ভবতঃ যতক্ষণ এটা শুষ্ক না হবে ততক্ষণ এদের শাস্তি হাল্কা থাকবে।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)এজন্যেই কোন কোন আলেম বলেছেন, যে যতক্ষণ এটা কাঁচা থাকবে ততক্ষণ তাসবীহ পড়বে এবং যখন শুকিয়ে যাবে তখন তাসবীহ পাঠও বন্ধ। হয়ে যাবে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।আল্লাহ তাআলা বিজ্ঞানময় ও ক্ষমাশীল। তিনি তাঁর পাপী বান্দাদেরকে শাস্তি দানে তাড়াতাড়ি করেন না, বরং বিলম্ব করেন এবং অবকাশ দেন। কিন্তু এরপরেও যদি সে কুফরী ও পাপাচারে লিপ্ত থেকে যায় তখন অনন্যোপায় হয়ে তাকে পাকড়াও করেন।সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা অত্যাচারীকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছেড়ে দেন না।” মহামহিমান্বিত আল্লাহ কুরআনপাকে বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা যখন কোন জনপদকে তাদের অত্যাচার-অবিচারের কারণে পাকড়াও করেন, তখন এরূপই পাকড়াও হয়ে থাকে (শেষ পর্যন্ত)।” অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “বহু গ্রামবাসীকে আমি তাদের যুলুমরত অবস্থায় ধ্বংস করে দিয়েছি।” (২২:৪৫) হাঁ, তবে যারা পাপকার্য থেকে ফিরে আসে এবং তাওবা করে নেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করে থাকেন। যেমন এক জায়গায় রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি অসৎ কাজ করে এবং নিজের নফসের উপর জুলুম করে, অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহ তাআলাকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে।” সূরায়ে ফাতিরের শেষের আয়াতগুলিতেও এই বর্ণনাই রয়েছে।