Aal-i-Imraan • BN-TAFSEER-IBN-E-KASEER
﴿ ۞ قُلْ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيْرٍۢ مِّن ذَٰلِكُمْ ۚ لِلَّذِينَ ٱتَّقَوْا۟ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّٰتٌۭ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَٰجٌۭ مُّطَهَّرَةٌۭ وَرِضْوَٰنٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ ۗ وَٱللَّهُ بَصِيرٌۢ بِٱلْعِبَادِ ﴾
“Say: "Shall I tell you of better things than those [earthly joys]? For the God-conscious there are, with their Sustainer, gardens through which running waters flow, therein to abide, and spouses pure, and God's goodly acceptance." And God sees all that is in [the hearts of] His servants -”
১৪-১৫ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা'আলা বর্ণনা করছেন যে, পার্থিব জীবনকে বিভিন্ন প্রকারের উপভোগ্য (বস্তু) দ্বারা সুশোভিত করা হয়েছে। এ সমুদয় জিনিসের মধ্যে সর্বপ্রথম নারীদের কথা বর্ণনা করেছেন, কেননা তাদের অনিষ্ট সবচেয়ে বড়। বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি আমার পরে পুরুষদের উপর স্ত্রীদের চেয়ে বেশী ক্ষতিকর ও ফিত্না ছেড়ে গেলাম না। হ্যা, তবে যখন বিবাহ দ্বারা কোন লোকের উদ্দেশ্য হবে ব্যভিচার হতে রক্ষা পাওয়া ও সন্তানাদির আধিক্য তখন নিঃসন্দেহে ওটা উত্তম কাজ হবে। শরীয়ত বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে এবং বিয়ে করা এমনকি বহু বিয়ে করার ফযীলতের অনেক হাদীসও এসেছে এবং এ উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে অধিক স্ত্রীর অধিকারী। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘দুনিয়া একটি উপকারের বস্তু এবং ওর সর্বোত্তম উপকারী জিনিস হচ্ছে সতী সাধ্বী পত্নী। স্বামী যদি তার দিকে। দৃষ্টিপাত করে তবে সে তাকে সন্তুষ্ট করে, যদি নির্দেশ দেয় তবে পালন করে। আর যদি সে স্ত্রী হতে অনুপস্থিত থাকে তবে সে নিজের জীবনের ও স্বামীর ধন-মালের রক্ষণাবেক্ষণ করে। অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘আমার নিকট নারী ও সুগন্ধি অত্যন্ত পছন্দনীয় এবং আমার চক্ষু ঠাণ্ডাকারী হচ্ছে নামায। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ছিল নারীগণ, তবে তিনি ঘোড়াও খুব পছন্দ করতেন। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তার খুব চাহিদার জিনিস ঘোড়া ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। হ্যা, তবে শুধুমাত্র নারীরা ছিল। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, স্ত্রীদেরকে ভালবাসার মধ্যে মঙ্গলও রয়েছে এবং অমঙ্গলও রয়েছে। অনুরূপভাবে অন্যদের উপর অহংকার প্রকাশ করার জন্যে যদি অধিক সন্তান লাভ কামনা করে তবে তা নিন্দনীয়। কিন্তু যদি এর দ্বারা বংশ বৃদ্ধি ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর উম্মতের মধ্যে একত্ববাদী মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। হাদীস শরীফে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘ভালবাসা স্থাপনকারিণী ও অধিক সন্তান প্রসবকারিণী নারীদেরকে তোমরা বিয়ে কর, কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের সংখ্যার আধিক্যের কারণে অন্যান্য উম্মতবর্গের উপর গর্ববোধ করবো।' মাল-ধনের ব্যাপারেও একই কথা। যদি ওর প্রতি ভালবাসার উদ্দেশ্য হয় দুর্বলদের ঘৃণা করা ও দরিদ্রের উপর অহংকার প্রকাশ করা, তবে তা অতি জঘন্য। আর যদি মালের চাহিদার উদ্দেশ্য হয় নিকটের ও দূরের আত্মীয়দের উপর খরচ করা, সকার্যাবলী সম্পাদন করা এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করা তবে তা শরীয়ত সম্মত ও খুবই উত্তম। (আরবী)-এর পরিমাণের ব্যাপারে তাফসীর কারকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মোটকথা এই যে, অত্যধিক মালকে (আরবী) বলা হয়। যেমন হযরত যন্হাকের উক্তি রয়েছে। আরও বহু উক্তি রয়েছে, যেমন এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা, বারো হাজার, চল্লিশ হাজার, ষাট হাজার, সত্তর হাজার, আশি হাজার ইত্যাদি। মুসনাদ-ই-আহমাদের একটি মারফু হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘বারো হাজার আওকিয়ায় এক কিনতার হয় এবং প্রত্যেক আওকিয়া পৃথিবী ও আকাশ হতে উত্তম। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে এ রকমই একটি মাওকুফ হাদীসও বর্ণিত আছে এবং এটাই সর্বাপেক্ষা সঠিক। হযরত ইবনে জারীর (রঃ), হযরত মু'আয ইবনে জাবাল (রাঃ) এবং হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতেও এটা বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাতিম (রঃ)-এর গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বারো আওকিয়া’য় এক কিনতার হয়। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘বারোশ আওকিয়া’য় এক কিনতার হয়। কিন্তু এ হাদীসটি ‘মুনকার'। সম্ভবতঃ এটা হযরত উবাই ইবনে কাবের উক্তি। যেমন অন্যান্য সাহাবীরও (রাঃ) এই উক্তি রয়েছে। ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) হযরত আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি একশ আয়াত পাঠ করবে তার নাম উদাসীনদের মধ্যে লেখা হবে না এবং যে ব্যক্তি এক হাজার পর্যন্ত পাঠ করবে তাকে এক কিনতার পুণ্য দেয়া হবে। আর কিনতার হচ্ছে বড় পাহাড়ের সমান।' মুসতাদরিক-ইহাকিম’ গ্রন্থে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ শব্দটির ভাবার্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “দু'হাজার আওকিয়া।' ইমাম হাকিম (রঃ) হাদীসটিকে ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ)-এর শর্তের উপর সঠিক বলেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) হাদীসটি আনেননি। তাবরানী প্রভৃতি মনীষীর হাদীস গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে যে, কিনতার হচ্ছে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা। হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতে মাওকুফ’ বা ‘মুরসাল’ রূপে বর্ণিত আছে যে, কিনতার হচ্ছে বারোশ স্বর্ণমুদ্রা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এটাই বর্ণিত আছে। হযরত যহহাক (রঃ) বলেন যে, কোন কোন আরববাসী কিনতারকে বারোশ বলে থাকেন আবার কেউ কেউ বারো হাজার বলেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, বলদের গাত্র-চর্ম পূর্ণ হয়ে যায় এই পরিমাণ স্বর্ণকে কিনতার বলা হয়। এটা মারফু রূপেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর মাওকুফ হওয়াই অধিকতর সঠিক।অশ্বের প্রতি প্রেম তিন প্রকারের। প্রথম হচ্ছে ঐসব লোক যারা অশ্বের উপর আরোহণ করে আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্যে তা লালন-পালন করে। তাদের জন্য এ ঘোড়া পুণ্য ও সওয়াবের কারণ। দ্বিতীয় হচ্ছে তারাই যারা গর্ব ও অহংকার প্রকাশের উদ্দেশ্যে অশ্ব পালন করে থাকে। এদের জন্য শাস্তি রয়েছে। তৃতীয় হচ্ছে ওরাই যারা ভিক্ষাবৃত্তি হতে রক্ষা পাওয়া এবং ওর বংশ রক্ষার উদ্দেশ্যে অশ্ব পালন করে এবং আল্লাহ তা'আলার প্রাপ্য বিস্মরণ হয় না। এদের জন্যে পুণ্য বা শাস্তি কোনটাই নেই। এ বিষয়ের (আরবী) হাদীস (৮:৬০) -এ আয়াতের তাফসীরে ইনশাআল্লাহ আসবে।(আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে চিহ্নিত এবং কপালে ও চার পায়ে সাদা চিহ্নযুক্ত ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “প্রত্যেক আরবী অশ্ব ফজরের সময় আল্লাহ তাআলার অনুমতিক্রমে দু'টি প্রার্থনা করে থাকে। সে বলেঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যার অধিকারে রেখেছেন তার অন্তরে আমার ভালবাসা তার মাল ও পরিবার অপেক্ষা বেশী করে দিন। (আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে উট, ছাগল ও গরু। (আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে ঐ ভূমি যা ফসলের বীজ বপন বা বৃক্ষরোপণের জন্যে তৈরী করা হয়। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যে হাদীস রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মানুষের উত্তম মাল হচ্ছে অধিক বংশ বিশিষ্ট ঘোড়া এবং অধিক ফলবান বৃক্ষ হচ্ছে খেজুর বৃক্ষ।' অতঃপর বলা হচ্ছেঃ ‘এগুলো পার্থিব জীবনের লোভনীয় সম্পদ। অর্থাৎ এগুলো ইহলৌকিক জীবনের লোভনীয় বস্তু, এগুলো সবই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং শ্রেষ্ঠতম অবস্থান স্থল ও উত্তম বিনিময় প্রাপ্তির জায়গা মহান আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যে রয়েছে যে, যখন (আরবী) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি যখন আমাদের জন্যে এটাকে সুশোভিত করেছেন তাহলে এখন'? তখন পরবর্তী আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলা হয়ঃ (হে নবী সঃ)! তুমি বলে দাও আমি তোমাদেরকে এসব অপেক্ষা উত্তম জিনিসের সংবাদ দিচ্ছি। এ পার্থিব জিনিসগুলো তো একদিন না একদিন ধ্বংস হবেই। কিন্তু আমি তোমাদেরকে যেসব জিনিসের কথা বলছি সেগুলো অস্থায়ী নয় বরং চিরস্থায়ী। জেনে রেখো যে, যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্যে তাদের প্রভুর নিকট এমন সুখময় জান্নাত রয়েছে যার ধারে ধারে ও যার বৃক্ষাদির মধ্যস্থলে বিভিন্ন প্রকারের স্রোতস্বিনী সমূহ বয়ে যাচ্ছে। কোন স্থানে রয়েছে মধুর নদী, কোন জায়গায় রয়েছে দুধের নদী, কোথাও বা রয়েছে সুরার স্রোতস্বিনী এবং কোন স্থলে রয়েছে স্বচ্ছ পানির প্রস্রবণ। আরও এমন এমন সুখ-সম্পদ রয়েছে যা না শ্রবণ করেছে কোন কর্ণ, না দর্শন করেছে কোন চক্ষু, ধারণা করেছে কেন অন্তর। এরূপ সুখময় ও আরামদায়ক স্থানে মুত্তাকী লোকেরা চিরকাল অবস্থান করবে। তথা হতে তাদেরকে বের করে দেয়া হবে। না, তাদেরকে প্রদত্ত নিয়ামতরাজী কমে যাবে না এবং ধ্বংসও হবে না। অতঃপর তথায় এমন সহধর্মিণী পাওয়া যাবে যারা ময়লা মালিন্য, অপবিত্রতা, ঋতুরক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকবে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রকারের পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা বিরাজ করবে। সর্বোপরি খুশীর কারণ এই যে, মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন। এর পরেও আল্লাহর অসন্তুষ্টির কোন ভয় থাকবে না। এজন্যেই সূরা-ই-বারাআতের নিম্নের আয়াতে বলা হয়েছে (আরবী) অর্থাৎ ‘এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই খুব বড় জিনিস'। (২:৭২) অর্থাৎ নিয়ামত সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছে প্রভুর সন্তুষ্টি লাভ। সমস্ত বান্দাই আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টির মধ্যে রয়েছে। কে তাঁর অনুগ্রহ লাভের যোগ্য এবং কে যোগ্য নয় তা তিনিই ভাল জানেন।