Al-Ahzaab • BN-TAFSEER-IBN-E-KASEER
﴿ وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِىٓ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَٱتَّقِ ٱللَّهَ وَتُخْفِى فِى نَفْسِكَ مَا ٱللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى ٱلنَّاسَ وَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَىٰهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌۭ مِّنْهَا وَطَرًۭا زَوَّجْنَٰكَهَا لِكَىْ لَا يَكُونَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌۭ فِىٓ أَزْوَٰجِ أَدْعِيَآئِهِمْ إِذَا قَضَوْا۟ مِنْهُنَّ وَطَرًۭا ۚ وَكَانَ أَمْرُ ٱللَّهِ مَفْعُولًۭا ﴾
“AND LO, [O Muhammad,] thou didst say unto the one to whom God had shown favour and to whom thou hadst shown favour, “Hold on to thy wife, and remain conscious of God!” And [thus] wouldst thou hide within thyself something that God was about to bring to light for thou didst stand in awe of [what] people [might think], whereas it was God alone of whom thou shouldst have stood in awe! [But] then, when Zayd had come to the end of his union with her, We gave her to thee in marriage, so that [in future] no blame should attach to the believers for [marrying] the spouses of their adopted children when the latter have come to the end of their union with them. And [thus] God’s will was done.”
আল্লাহ তা'আলা খবর দিচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় আযাদকৃত গোলাম হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-কে বিশেষভাবে বুঝিয়েছেন। তার উপর আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহেরবানী ছিল। তাঁকে তিনি ইসলাম ও নবী (সঃ)-এর অনুসরণ করার তাওফীক দান করেছিলেন। তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁকে তিনি গোলামী হতে মুক্তি দান করেছিলেন। তিনি বড়ই জাঁকজমকপূর্ণ লোক ছিলেন। তিনি(আরবি) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। এমন কি সমস্ত মুসলমান তাঁকে রাসূলের প্রিয়’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর পুত্র হযরত উসামা (রাঃ)-কে (আরবি) ‘প্রিয়ের প্রিয়’ নামে সবাই সম্বোধন করতেন। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, কোন স্থানে সৈন্য পাঠালে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকেই দলের নেতা মনোনীত করতেন। যদি তিনি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন তবে তাকেই হয়তো তিনি তাঁর খলীফা নিযুক্ত করে যেতেন।হযরত উসামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি এক সময় মসজিদে অবস্থান করছিলাম এমন সময় আমার কাছে হযরত আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) আসলেন ও বললেনঃ “যান, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে আমাদের জন্যে অনুমতি নিয়ে আসেন।” আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ খবর দিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কি জন্যে এসেছে তা তুমি জান কি?" আমি উত্তর দিলামঃ জ্বি না। তখন তিনি বললেনঃ “আমি কিন্তু জানি। যাও, তাদেরকে ডেকে আনো।” তাঁরা এলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! বলুন তো, আপনার পরিবারে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? তিনি জবাবে বললেনঃ “আমার কন্যা ফাতিমা (রাঃ)। তাঁরা বললেনঃ “আমরা হযরত ফাতিমা (রাঃ) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করিনি।” তখন তিনি বললেনঃ “উসামা ইবনে যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ), যাকে আল্লাহ তাআলা পুরস্কৃত করেছেন এবং আমিও যার প্রতি স্নেহশীল।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় ফুফু উমাইমা বিনতে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ)-এর কন্যা হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ আসাদিয়্যা (রাঃ)-এর সাথে তাঁর (যায়েদ রাঃ -এর) বিয়ে দিয়েছিলেন। মোহর হিসেবে দশ দীনার (স্বর্ণ মুদ্রা) ও সাত দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) প্রদান করেছিলেন। আর দিয়েছিলেন একখানা শাড়ী, একখানা চাদর এবং একটি জামা। আরো দিয়েছিলেন পঞ্চাশ মুদ্দ (ওযন বিশেষ) শস্য ও দশ মুদ্দ খেজুর। এক বছর অথবা তা থেকে কিছু কম-বেশী সময়ের মধ্যে নিজ সংসার তিনি গুছিয়ে নিয়েছিলেন। পরে তাদের মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। হযরত যায়েদ (রাঃ) গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অভিযোগ করেন। তিনি তাকে বুঝিয়ে বললেনঃ “সংসার ভেঙ্গে দিয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।” এই জায়গায় ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) সঠিক নয় এরূপ বহু আসার বর্ণনা করেছেন, যেগুলো বর্ণনা করা উচিত নয় মনে করে আমরা ছেড়ে দিলাম। কেননা ওগুলোর মধ্যে একটিও প্রমাণিত ও সঠিক নয়। মুসনাদে আহমাদেও হযরত আনাস (রাঃ) হতে একটি রিওয়াইয়াত রয়েছে। কিন্তু তাতেও বড়ই অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। এ জন্যে আমরা ওটাও বর্ণনা করলাম না। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, এ আয়াতটি হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) ও হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণী হবেন একথা পূর্বে আল্লাহ তাকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথাটি প্রকাশ করেননি। তিনি হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে বুঝিয়ে বলেছিলেনঃ “তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় কর।” তাই আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ “তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন।”হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যদি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর উপর অহীকৃত কিতাবুল্লাহর কোন আয়াত গোপন করতেন তবে অবশ্যই (আরবি)-এ আয়াতটিই গোপন করতেন।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)(আরবি) শব্দের অর্থ হলো প্রয়োজন। ভাবার্থ হচ্ছেঃ যখন হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর মন ভেঙ্গে গেল এবং বহু বুঝানোর পরেও তাদের মনোমালিন্য কাটলো না, বরং তালাক হয়ে গেল তখন আল্লাহ তা'আলা হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে স্বীয় নবী (সঃ)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। এজন্যে অলী, প্রস্তাব-সমর্থন, মহর এবং সাক্ষীদের কোন প্রয়োজন থাকলো না। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যখন হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি যাও এবং তাকে আমার বিবাহের পয়গাম পৌঁছিয়ে দাও।" হযরত যায়েদ (রাঃ) গেলেন। ঐ সময় হযরত যয়নাব (রাঃ) আটা ঠাসছিলেন। হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা এমনভাবে ছেয়ে গেল যে, সামনে থেকে তার সাথে কথা বলতে পারলেন না। বরং তিনি মুখ ফিরিয়ে বসে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর প্রস্তাব শুনিয়ে দিলেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তখন তাকে বললেনঃ “থামুন, আমি আল্লাহ তাআলার নিকট ইসতিখারা (লক্ষণ দ্বারা শুভাশুভ বিচার) করে নিই।” অতঃপর তিনি দাড়িয়ে নামায পড়তে শুরু করলেন। আর এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অহী অবতীর্ণ হলো এবং তাকে বলা হলো: “আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করলাম।” সুতরাং নবী (সঃ) কোন খবর না দিয়ে সেখানে চলে গেলেন। ওলীমার দাওয়াতে তিনি সাহাবীদেরকে গোশত ও রুটি খাওয়ালেন। সব লোক খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে গেলেন। কতিপয় লোক সেখানে বসে থেকে খোশ-গল্পে মত্ত হয়ে পড়লো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বের হয়ে তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের নিকট গেলেন। তিনি তাদেরকে সালাম দিচ্ছিলেন। তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! বলুন, আপনি আপনার স্ত্রীকে (যয়নাব রাঃ-কে) কিরূপ পেয়েছেন?" বর্ণনাকারী হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “লোকেরা তার বাড়ী হতে চলে গেছে এ খবর আমি তাঁকে দিলাম কি অন্য কারো মাধ্যমে তাঁকে এ খবর দেয়া হলো তা আমার জানা নেই। এরপর তিনি তাঁর বাড়ীতে গেলেন। আমিও তার সাথে ছিলাম। আমি তার সাথে তার বাড়ীতে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু তিনি পর্দা ফেলেদিলেন। ফলে আমার ও তাঁর মধ্যে আড় হয়ে গেল। ঐ সময় পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হলো এবং তিনি সাহাবীদের যা উপদেশ দেয়ার তা দিলেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা নবী (সঃ)-এর বাড়ীতে তাঁর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করো।” (৩৩:৫৩) (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত যয়নাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে গর্ব করে বলতেনঃ “তোমাদের বিয়ে দিয়েছেন তোমাদের অভিভাবক ও ওয়ারিশরা। আর আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা সপ্তম আকাশের উপর।” (এটা ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)সূরায়ে নূরের তাফসীরে আমরা এ রিওয়াইয়াতটি বর্ণনা করেছি যে, হযরত যয়নাব (রাঃ) বলেছিলেনঃ “আমার বিবাহ আকাশ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।” তাঁর একথার জবাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমার নিষ্কলুষতা ও সতীত্বের আয়াতগুলো আকাশ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।” হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁর একথা স্বীকার করে নেন।হযরত শা’বী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত যয়নাব (রাঃ) নবী (সঃ)-কে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমার মধ্যে তিনটি বিশেষত্ব রেখেছেন যা আপনার অন্যান্য স্ত্রীদের মধ্যে নেই। প্রথম এই যে, আমার নানা ও আপনার দাদা একই ব্যক্তি। দ্বিতীয় এই যে, আপনার সাথে আমার বিবাহ আল্লাহ তা'আলা আকাশে পড়িয়েছেন। আর তৃতীয় হলো এই যে, আমাদের মাঝে সংবাদবাহক ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ) (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তার সাথে তোমার বিবাহ বৈধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলেই সেই সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আরবে এ প্রথা চালু ছিল যে, পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদের বিয়ে করা বৈধ নয়। এ আয়াত দ্বারা তাদের ঐ কু-প্রথাকে উঠিয়ে দেয়া হলো। কারণ আরব দেশে এ ধরনের পুত্র বহু বাড়ীতে বিদ্যমান ছিল। হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর জন্যে এ গৌরব প্রথম থেকেই আল্লাহর ইলমে নির্ধারিত ছিল যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র ও সতী-সাধ্বী স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।