Al-Anfaal • BN-TAFSEER-IBN-E-KASEER
﴿ وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ۚ لَوْ أَنفَقْتَ مَا فِى ٱلْأَرْضِ جَمِيعًۭا مَّآ أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّهُۥ عَزِيزٌ حَكِيمٌۭ ﴾
“whose hearts He has brought together: [for,] if thou hadst expended all that is on earth, thou couldst not have brought their hearts together [by thyself]: but God did bring them together. Verily, He is almighty, wise.”
৬১-৬৩ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলছেনঃ “হে নবী! যদি তোমার মুশরিক ও কাফিরদের খিয়ানতের ভয় হয় তবে সমতা রক্ষা করে তাদেরকে চুক্তি ও সন্ধিপত্র বাতিল করে দেয়ার সংবাদ অবহিত করতঃ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দাও। অতঃপর তারা যদি যুদ্ধের প্রতি উত্তেজনা প্রকাশ করে তবে আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করতঃ যুদ্ধ শুরু করে দাও। আর যদি আবার তারা সন্ধির প্রস্তাব দেয় তবে পুনরায় সন্ধি করে নাও।” এই আয়াতের উপর আমল করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুদায়বিয়ায় মক্কার কুরায়েশদের সাথে কয়েকটি শর্তের উপর নয় বছরের মেয়াদে সন্ধি করেন। আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সত্বরই মতভেদ সৃষ্টি হবে বা অন্য কোন ব্যাপার ঘটবে। সুতরাং পারলে সন্ধিই করে নাও।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে রয়েছে)মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি বানু কুরাইযার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু এতে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, এ সমুদয় হচ্ছে বদরের ঘটনা। ইবনে আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ), আতা খুরাসানী (রঃ), ইকরামা (রাঃ), হাসান (রাঃ) এবং কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি সূরায়ে বারাআতের সাঈফ'-এর (আরবী) (৯:২৯) এই আয়াত দ্বারা মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু এটাও চিন্তার বিষয়। কেননা, এই আয়াতে শক্তি ও সাধ্যের উপর জিহাদের হুকুম রয়েছে। কিন্তু শক্রদের সংখ্যাধিক্যের সময় তাদের সাথে সন্ধি করে নেয়া নিঃসন্দেহে জায়েয, যেমন এই আয়াতে কারীমায় রয়েছে এবং যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুদায়বিয়ার দিন করেছিলেন। সুতরাং কোন বৈপরীত্য, কোন বিশেষত্ব এবং কোন রহিতকরণ নেই। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী, আল্লাহর উপর ভরসা কর, তিনিই তোমার জন্যে যথেষ্ট। তিনিই তোমার সাহায্যকারী। যদি এ মুশরিকরা তোমার সাথে প্রতারণা করে এই সন্ধির মধ্যে নিজেদের শান শওকত ও যুদ্ধাস্ত্র বৃদ্ধি করে তবে তুমি নিশ্চিন্ত থাকবে। আল্লাহ তোমার পক্ষ অবলম্বন করবেন। তোমার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কেউই নেই।”এরপর আল্লাহ তা'আলা নিজের বড় নিয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন- “আমি স্বীয় ফল ও করমে মুহাজির ও আনসারদের মাধ্যমে তোমার সাহায্য করেছি। তাদেরকে তোমার প্রতি ঈমান আনার ও তোমার আনুগত্য করার তাওফীক দান করেছি। তুমি যদি সারা দুনিয়ার ধন ভাণ্ডারও ব্যয় করে দিতে তবুও তাদের মধ্যে সেই প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করতে পারতে না যা আল্লাহ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের পুরাতন শক্রতা দূর করে দিয়েছেন। আউস ও খাযরাজ নামক আনসারদের দু'টি গোত্রের মধ্যে অজ্ঞতার যুগে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো। তারা সবসময় কাটাকাটি মারামারি করতো। ঈমানের আলো তাদের সেই শক্রতাকে বন্ধুত্বে পরিণত করে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ “তোমরা আল্লাহর ঐ নিয়ামতের কথা স্মরণ কর যা তোমাদের উপর রয়েছে, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গিয়েছে, আর তোমরা জাহান্নামের গর্তের তীরে ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন, এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় বিধানসমূহ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে থাকেন, যেন তোমরা (সঠিক) পথে থাকো।”সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, হুনায়েনের যুদ্ধলব্ধ মাল বন্টন করার সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আনসারদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে আনসারের দল! আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়ে আল্লাহর অনুগ্রহে। সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করিনি? তোমরা দরিদ্র ছিলে, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ কি তোমাদেরকে সম্পদশালী করেননি? তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলে, তারপর আমার মাধ্যমে কি আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মিলন ঘটাননি? “এভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে আনসারগণ বলতেছিলেনঃ “নিশ্চয়ই আমাদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর ইহসান এর চেয়েও বেশী রয়েছে। মোটকথা, আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইনআ'ম ও ইকরামের বর্ণনা দেয়ার পর তাঁর মর্যাদা ও নৈপুণ্যের বর্ণনা দিয়েছেন যে, তিনি মহান ও সর্বোচ্চ এবং যে ব্যক্তি তার রহমতের আশা রাখে সে নিরাশ হয় না। যে তাঁর উপর ভরসা করে তার ইহজীবন ও পরজীবন সুখময় হয়। তিনি স্বীয় কাজেকর্মে ও হুকুম দানে মহাজ্ঞানী ও বিজ্ঞানময়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হয় এবং নিয়ামতের প্রতিও কৃতঘ্নতা দেখা যায়, কিন্তু অন্তরের মিল মহব্বতের মত আর কিছুই দেখা যায়নি। আল্লাহ পাক বলেনঃ “হে নবী! তুমি যদি দুনিয়ার ধনভাণ্ডারও শেষ করতে তবুও তোমার এ শক্তি ছিল না যে, তুমি তাদের অন্তরে প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসা সৃষ্টি করবে।” কবি বলেনঃ “তোমাকে প্রতারণাকারী এবং তোমার প্রতি অশ্রুক্ষেপকারী তোমার আত্মীয় নয়, বরং তোমার প্রকৃত আত্মীয় হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে তোমার আহ্বানে সাভা দেয় এবং তোমার শত্রুকে দমন করার কাজে তোমাকে সহায়তা করে।” অনুরূপভাবে অন্য এক কবি বলেনঃ “আমি লোকদের সাথে মেলামেশা করে তাদেরকে পরীক্ষা করেছি এবং বুঝেছি যে, অন্তরের মিল আত্মীয়তার চেয়েও বড়।” ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেনঃ “এসব উক্তি ইবনে আব্বাসেরই (রাঃ) না কি তাঁর পরবর্তী অন্য কোন বর্ণনাকারীর তা আমার জানা নেই।” ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, তাদের এ মহব্বত ছিল আল্লাহর পথে এবং সেটা ছিল তাওহীদ ও সুন্নাহর ভিত্তির উপর। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইহসানেরও না শুকরী করা হয়, কিন্তু আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অন্তরকে যে মিলিয়ে দেয়া হয় তা কেউই পৃথক করতে পারে না। অতঃপর তিনি .... (আরবী)-এই আয়াতটি পাঠ করেন।আবদা ইবনে আবি লুবাবা (রঃ) বলেন, একদা মুজাহিদ (রঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমার সাথে মুসাফাহা (কর মর্দন) করে বলেনঃ “আল্লাহর পথে মহব্বতকারী দু'টি লোক যখন পরস্পর মিলিত হয় এবং হাসিমুখে একে অপরের হাতে হাত মিলায়, তখন গাছের শুষ্ক পাতা ঝরে পড়ার মত তাদের উভয়ের পাপরাশি ঝরে পড়ে। তার এ কথা শুনে আমি বললাম, এটা তো খুবই সহজ কাজ। তখন তিনি বললেন, এ কথা বলো না। এটা হচ্ছে সেই মহব্বত যে সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেনঃ “(হে নবী)! তুমি যদি সারা দুনিয়ার ধন ভাণ্ডারও খরচ করে দাও তবুও তোমার সাধ্য নেই যে, তুমি তাদের অন্তরে মহব্বত বা প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করতে পার।” তাঁর এ কথা শুনে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে, তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধিমান। ওয়ালীদ ইবনে আবি মুগীস (রঃ) বলেনঃ “আমি মুজাহিদ (রঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, যখন দু’জন মুসলমান পরস্পর মিলিত হয় ও মুসাফাহা করে তখন তাদের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি- শুধু মুসাফাহা করলেই কি? তিনি উত্তরে বলেনঃ “তুমি কি আল্লাহর এই কথা শুননি?” অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন। তখন আমি বলি, আপনি আমার চেয়ে বড় আলেম। উমাইর ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, মানুষের মধ্য থেকে প্রথম যে জিনিস উঠে যাবে তা হচ্ছে মহব্বত বা ভালবাসা। তিবরানী (রঃ)-এর হাদীস গ্রন্থে সালমান ফারসী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন কোন মুসলমান তার কোন মুসলমান ভাইয়ের সাথে মিলিত হয়, অতঃপর তার সাথে মুসাফাহা করে তখন তাদের দুজনের গুনাহ এমনভাবে ঝরে পড়ে যেমনভাবে প্রবল বাতাসের দিনে গাছের শুষ্ক পাতাগুলো ঝরে যায়। তাদের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হয় যদিও তা সমুদ্রের ফেনার সমানও হয়।”