🕋 تفسير سورة النحل
(An-Nahl) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ أَتَىٰ أَمْرُ اللَّهِ فَلَا تَسْتَعْجِلُوهُ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
📘 আল্লাহর আদেশ আসবেই;[১] সুতরাং তোমরা তা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না। তিনি মহিমার্নিত এবং ওরা যাকে অংশী করে তিনি তার উর্ধে।
[১] আদেশ বলতে কিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে, অর্থ কিয়ামত নিকটবর্তী যাকে তোমরা দূর মনে কর। অতএব তোমরা এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করো না। অথবা সেই আযাবকে বুঝানো হয়েছে যা মুশরিকরা চাইত। এ কথাটি ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়ার পরিবর্তে অতীতকালের ক্রিয়া দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে, যেহেতু তার আগমনে কোন সন্দেহ নেই।
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً ۖ لَكُمْ مِنْهُ شَرَابٌ وَمِنْهُ شَجَرٌ فِيهِ تُسِيمُونَ
📘 তিনিই আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, ওতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে (জন্মায়) উদ্ভিদ; যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাক।
إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ
📘 তার আধিপত্য শুধু তাদেরই উপর, যারা তাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর অংশী করে।
وَإِذَا بَدَّلْنَا آيَةً مَكَانَ آيَةٍ ۙ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يُنَزِّلُ قَالُوا إِنَّمَا أَنْتَ مُفْتَرٍ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
📘 আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত অবতীর্ণ করি -- আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন, তা তিনিই ভাল জানেন -- তখন তারা বলে, ‘তুমি তো শুধু একজন মিথ্যা উদ্ভাবনকারী।’ কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। [১]
[১] একটি বিধান রহিত করার পর অন্য একটি অবতীর্ণ করেন। যার হিকমত, যৌক্তিকতা ও কারণ আল্লাহই জানেন এবং তিনি সেই অনুসারে বিধানের মধ্যে পরিবর্তন আনেন। তা শুনে কাফেররা বলে, হে মুহাম্মাদ! এই বাণী তোমার নিজস্ব রচনা। কারণ আল্লাহ এ রকম রদবদল করতে পারেন না। মহান আল্লাহ বলেন, যাদের অধিকাংশই অজ্ঞ, তারা রহিত করার যুক্তি ও মর্ম কি বুঝবে।
(আরো দেখুন সূরা বাক্বারাহ ২:১০৬ নং আয়াতের টীকা।)
قُلْ نَزَّلَهُ رُوحُ الْقُدُسِ مِنْ رَبِّكَ بِالْحَقِّ لِيُثَبِّتَ الَّذِينَ آمَنُوا وَهُدًى وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ
📘 তুমি বল, ‘তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে জিবরীল সত্যসহ কুরআন অবতীর্ণ করেছে,[১] যারা বিশ্বাসী তাদেরকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য[২] এবং তা আত্মসমর্পণকারীদের জন্য পথনির্দেশ ও সুসংবাদ স্বরূপ।’ [৩]
[১] অর্থাৎ, এই কুরআন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর রচনা নয়। বরং তা জিবরীল (আঃ)-এর মত পবিত্র সত্তা সত্যসহ রবের নিকট হতে তা অবতীর্ণ করেছেন। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে {نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَى قَلْبِكَ} এ (কুরআন)-কে রূহুল আমীন (বিশ্বস্ত রূহ) জিবরীল তোমার অন্তরে অবতীর্ণ করেছে।
(সূরা শুআরা ২৬:১৯৩-১৯৪)
[২] এই জন্য যে, তারা বলে নাসেখ-মানসূখ (রহিত ও রহিতকারী) উভয় বিধানই আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ ছাড়া রহিত করণের উপকারিতা যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়, তখন তাদের হৃদয়ে দৃঢ়তা ও ঈমানী মজবুতি সৃষ্টি হয়।
[৩] আর এই কুরআন মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশ ও সুসংবাদ স্বরূপ। কারণ কুরআন বৃষ্টির মত যার দ্বারা কিছু কিছু মাটি প্রচুর ফসল উৎপন্ন করে। পক্ষান্তরে কিছু মাটি কাঁটাগাছ ও আগাছা ছাড়া কিছুই উৎপন্ন করে না। মুমিনের অন্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যা কুরআনের বর্কতে এবং ঈমানের আলোকে আলোকিত হয়। আর কাফেরের অন্তর লবণাক্ত মাটির মত যা কুফর ও ভ্রষ্টতার অন্ধকারে ডুবে থাকে, যেখানে কুরআনের বৃষ্টি ও আলো কোন কাজে লাগে না।
وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ ۗ لِسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُبِينٌ
📘 আমি তো জানিই, তারা বলে, ‘তাকে শিক্ষা দেয় এক মানুষ।’[১] তারা যার প্রতি এটা আরোপ করে তার ভাষা তো আরবী নয়; আর এ তো স্পষ্ট আরবী ভাষা। [২]
[১] কিছু (গোলাম) দাস ছিল, যারা তওরাত ও ইঞ্জীল সর্ম্পকে অবগত ছিল। প্রথমে তারা খ্রিষ্টান বা ইয়াহুদী ছিল, পরে মুসলমান হয়ে যায়। তাদের ভাষাও ছিল অশুদ্ধ। মক্কার কাফেররা এদের প্রতিই ইঙ্গিত করে বলত যে, অমুক দাস মুহাম্মাদকে কুরআন শিক্ষা দেয়![২] মহান আল্লাহ উত্তরে বললেন, এরা যাদের কথা বলে, তারা তো শুদ্ধভাবে আরবীও বলতে পারে না, অথচ কুরআন এমন বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট আরবী ভাষায়, যার সাহিত্যশৈলী সুউচ্চ এবং যার অলৌকিকতা অতুলনীয়। চ্যালেঞ্জের পরও আজ পর্যন্ত তার মত একটি সূরা কেউ আনতে সক্ষম হয়নি। পৃথিবীর সকল সাহিত্যিক মিলেও এর সমতুল বাণী রচনা করতে অক্ষম। কেউ বিশুদ্ধ আরবী বলতে না পারলে আরবের লোকেরা তাকে বোবা বলত এবং অনারবীকেও বোবা বলত। যেহেতু অলংকার ও শব্দ স্বাচ্ছন্দ্যে অন্যান্য ভাষা আরবী ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম নয়।
إِنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ لَا يَهْدِيهِمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
📘 যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না, তাদেরকে আল্লাহ পথনির্দেশ করেন না এবং তাদের জন্য আছে বেদনাদায়ক শাস্তি।
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
📘 যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না, তারাই শুধু মিথ্যা উদ্ভাবন করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী। [১]
[১] আমার নবী ঈমানদার লোকেদের সর্দার ও নেতা। সে কেমন করে আল্লাহর উপর মিথ্যা রচনা করতে পারে যে, এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ হতে তার উপর অবতীর্ণ হয়নি অথচ সে বলবে যে, এই কিতাব আমার উপর আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব আমার নবী মিথ্যাবাদী নয়; বরং মিথ্যুক তারাই, যারা কুরআনকে আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অস্বীকার করে।
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَٰكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
📘 কেউ বিশ্বাস করার পরে আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং অবিশ্বাসের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি;[১] তবে তার জন্য নয়, যাকে অবিশ্বাসে বাধ্য করা হয়েছে, অথচ তার চিত্ত বিশ্বাসে অবিচল।[২]
[১] এ হল মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হওয়ার শাস্তি; সে আল্লাহর গযব ও মহাশাস্তির উপযুক্ত হবে। আর (শাসকের নিকট) তার পার্থিব শাস্তি হল হত্যা। যেমন হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।
(বিস্তারিত দেখুনঃ সূরা বাক্বারাহ ২:২১৭ ও ২:২৫৬ নং আয়াতের টীকায়।)
[২] উলামাগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যে ব্যক্তিকে কুফরের জন্য বাধ্য করা হয়েছে সে যদি জীবন বাঁচানোর জন্য কুফরী কোন বাক্য বলে ফেলে বা কর্ম করে বসে অথচ তার অন্তর ঈমানে অবিচল, তাহলে সে কাফের বলে গণ্য হবে না। না তার স্ত্রী তার জন্য হারাম হবে, আর না তার উপর কুফরীর অন্য কোন বিধান প্রয়োগ হবে।
(এ উক্তি কুরত্বুবীর, ফাতহুল কাদীর)
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
📘 এটা এ জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং এই জন্য যে, আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।[১]
[১] এটি ঈমান আনার পর কাফির (মুরতাদ) হয়ে যাওয়ার কারণ। প্রথমতঃ তারা ইহকালকে পরকালের উপর প্রাধান্য দেয়, দ্বিতীয়তঃ তারা আল্লাহর নিকট হিদায়াত পাবার যোগ্যই নয়।
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
📘 ওরাই তারা; আল্লাহ যাদের অন্তর, কর্ণ ও চক্ষু মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই উদাসীন।[১]
[১] অতএব তারা না ওয়ায-নসীহতের কথা শোনে, না তা বুঝে। না ঐ সকল নিদর্শন তারা দেখে, যা তাদের সত্যের পথ দেখাতে পারে। তারা এমন ঔদাস্যের শিকার, যা তাদের হিদায়াতের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
لَا جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الْآخِرَةِ هُمُ الْخَاسِرُونَ
📘 নিঃসন্দেহে তারা পরকালে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
يُنْبِتُ لَكُمْ بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
📘 ওর দ্বারা তিনি তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন শস্য, যায়তুন, খর্জুর বৃক্ষ, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল; অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।[১]
[১] এতে বৃষ্টির উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে, যা প্রত্যেক মানুষের নিকট বিদিত ও পরীক্ষিত, যা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া এর উল্লেখ পূর্বেও হয়েছে।
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ هَاجَرُوا مِنْ بَعْدِ مَا فُتِنُوا ثُمَّ جَاهَدُوا وَصَبَرُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 যারা নির্যাতিত হবার পর হিজরত করে, পরে জিহাদ (ধর্মের জন্য দেশত্যাগ ও যুদ্ধ) করে এবং ধৈর্যধারণ করে; তোমার প্রতিপালক এই সবের পর, তাদের প্রতি অবশ্যই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[১]
[১] এখানে মক্কার ঐ সকল মুসলিমদের কথা বলা হয়েছে, যাঁরা ছিলেন দুর্বল এবং ইসলাম গ্রহণ করার জন্য কাফেরদের অত্যাচারের শিকার। অবশেষে তাঁদেরকে হিজরত করার আদেশ দেওয়া হল, আর তাঁরা আত্মীয়-স্বজন, প্রিয় মাতৃভূমি, ধন সম্পদ, ঘর বাড়ি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে হাবশা বা মদীনা চলে গেলেন। আবার যখন কাফেরদের সাথে যুদ্ধের অবকাশ এল তখন শৌর্য-বীর্য সহকারে তাঁরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেন। তারপর তাঁর রাস্তায় নির্যাতন ও কষ্ট ধৈর্য সহকারে বরণ করে নিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, এ সবের পর তোমার প্রতিপালক তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া পাওয়ার জন্য ঈমান ও সৎকর্মের প্রয়োজন। যেমন উক্ত মুহাজিরগণ ঈমান ও সৎকর্মের সুন্দর নমুনা পেশ করলেন, ফলে তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ায় পুরস্কৃত হলেন। رضي الله عنهم ورضوا عنه
۞ يَوْمَ تَأْتِي كُلُّ نَفْسٍ تُجَادِلُ عَنْ نَفْسِهَا وَتُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
📘 (স্মরণ কর,) যে দিন প্রত্যেক ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি উপস্থিত করতে আসবে[১] এবং প্রত্যেকের তার কৃতকর্মের পূর্ণ ফল দেওয়া হবে এবং তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। [২]
[১] অর্থাৎ, কেউ অপরের সমর্থনে সামনে আসবে না। না পিতা, না ভাই, না স্ত্রী, না পুত্র আর না অন্য কেউ। বরং একে অন্য হতে পলায়ন করবে। ভাই ভাই হতে, পুত্র মাতা-পিতা হতে, স্বামী স্ত্রী হতে পলায়ন করবে। প্রত্যেক ব্যক্তি শুধু নিজের চিন্তাই করবে, যা তাকে অন্য থেকে ব্যস্ত রাখবে।{لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ} অর্থাৎ, সেদিন প্রত্যেকের এমন গুরুতর অবস্থা হবে যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।
(সূরা আবাসা ৮০:৩৭)
[২] অর্থাৎ, নেকীর প্রতিদান কম করা হবে ও পাপের বদলা বেশী দেওয়া হবে --এ রকম হবে না। কারো উপর বিন্দুমাত্র অত্যাচার করা হবে না। পাপের প্রতিদান পাপ সমতুল্য দেওয়া হবে। অবশ্য নেকীর বদলা মহান আল্লাহ খুব বেশি বেশি দিবেন। আর এটি হবে তাঁর দয়ার প্রকাশ যা পরকালে শুধুমাত্র মু'মিনদের জন্য হবে। جعلنا الله منهم
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
📘 আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, যেথায় আসতো সর্বদিক হতে প্রচুর জীবনোপকরণ; অতঃপর তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করল; ফলে তারা যা করত, তার জন্য আল্লাহ তাদেরকে আস্বাদন করালেন ক্ষুধা ও ভীতির স্বাদ।[১]
[১] অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারীগণ এই জনপদ বা শহর বলতে মক্কা বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, এই আয়াতে মক্কা ও মক্কাবাসীদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আর তা ঐ সময় ঘটেছিল যখন আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাদের জন্য অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, اللهم اشدد وطأتك على مضر واجعلها عليهم سنين كسني يوسف অর্থাৎ, হে আল্লাহ মুযার গোত্রকে কঠিনভাবে ধর এবং তাদের উপর এমন অনাবৃষ্টি এনে দাও যেমন ইউসুফ (আঃ)-এর যুগে মিসরে হয়েছিল।
(বুখারী ৪৮২১, মুসলিম ২১৫৬নং)
অতএব মহান আল্লাহ তাদের নিরাপত্তাকে ভয় এবং সুখকে ক্ষুধা দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। এমন কি তাদের অবস্থা এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা হাড় ও গাছের পাতা খেয়ে দিন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। কিছু ব্যাখ্যাকারীর মতে এই জনপদ কোন নির্দিষ্ট গ্রাম নয়। বরং এটি উপমা স্বরূপ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, অকৃতজ্ঞ লোকেদের এই পরিণাম হবে। তাতে তারা যে স্থানের বা যে কালেরই হোক না কেন। এই ব্যাপকতাকে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ অস্বীকার করেন না। যদিও এর অবতীর্ণ হবার বিশেষ কারণ আছে।العبرة بعموم اللفظ، لا بخصوص السبب
وَلَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْهُمْ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمُ الْعَذَابُ وَهُمْ ظَالِمُونَ
📘 তাদের নিকট তো এসেছিল এক রসূল তাদের মধ্য হতে, কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল; ফলে সীমালংঘন করা অবস্থায় শাস্তি[১] তাদেরকে গ্রাস করল।
[১] এই শাস্তি বা আযাব বলতে ক্ষুধা ও নিরাপত্তাহীনতার আযাব যা পূর্বের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অথবা এর অর্থ মুসলিমদের হাতে বদরপ্রান্তে কাফেরদের হত্যা হওয়া।
فَكُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ حَلَالًا طَيِّبًا وَاشْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
📘 আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তার মধ্যে যা বৈধ ও পবিত্র, তা তোমরা আহার কর এবং তোমরা যদি শুধু আল্লাহরই ইবাদত কর, তবে তাঁর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [১]
[১] এর অর্থ এই যে হালাল ও পবিত্র জিনিস অতিক্রম করে হারাম ও অপবিত্র জিনিস ব্যবহার করা এবং আল্লাহর খেয়ে-পরে তিনি ছাড়া অন্যের ইবাদত করা। এটিই হল আল্লাহর অনুগ্রহের অকৃতজ্ঞতা।
إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 আল্লাহ তো শুধু মৃত, রক্ত, শূকরের গোশত এবং যার যবেহকালে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের নাম নেওয়া হয়েছে তা-ই তোমাদের জন্য অবৈধ করেছেন; কিন্তু কেউ অন্যায়কারী কিংবা সীমালংঘনকারী না হয়ে (তা খেতে) অনন্যোপায় হলে নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [১]
[১] এই আয়াত এর পূর্বে আরো তিনবার উল্লিখিত হয়েছে। সূরা বাক্বারাহ ২:১৭৩ নং, সূরা মায়িদা ৫:৩ নং এবং সূরা আনআম ৬:১৪৫ নং আয়াতে। চতুর্থবার মহান আল্লাহ আবার আয়াতটি উল্লেখ করেছেন। এখানে إنما হাসর (সীমিতকরণ)এর জন্য। কিন্তু এখানে 'হাসরে হাকিকী' (প্রকৃত সীমিতকরণ উদ্দিষ্ট) নয়; বরং 'হাসরে ইযাফী' (তূলনামূলক সীমিতকরণ উদ্দিষ্ট)। অর্থাৎ সম্বোধিত ব্যক্তিদের আকীদা ও বিশ্বাসকে সামনে রেখে সীমিতকরণ করা হয়েছে। নচেৎ আরো অন্যান্য জীবজন্তুও হারাম। অবশ্য এই আয়াতে এ কথা স্পষ্ট যে, এখানে যে চারটি হারাম জিনিসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে মহান আল্লাহ তা থেকে মুসলিমদেরকে তাকীদের সাথে বাঁচাতে চান। যার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। তবে এখানে {وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّهِ بِهِ} (যার যবেহ কালে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের নাম নেওয়া হয়েছে) এই চতুর্থ নম্বরের অর্থে দুর্বল ও দূর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে শিরকের চোরা দরজা খোলার চেষ্টা করা হয়। এই জন্য এখানে এর অধিক আলোকপাত প্রয়োজন। যে পশু আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়, তার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে। (ক) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকট্য ও সন্তুষ্টির জন্য কোন পশু যবেহ করা এবং যবেহ করার সময় তারই নাম নেওয়া। (খ) উদ্দেশ্য আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকট্য লাভ করা কিন্তু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া, যেমন কবর পূজারীদের নিকট প্রচলিত। তারা বুযুর্গদের নামে পশু নির্দিষ্ট করে রাখে; যেমন এই মোরগ বা খাসিটি অমুক পীর বা মাযারের জন্য বা এই গরু অমুক পীরের জন্য বা এই পশু আব্দুল কাদের জীলানীর জন্য ইত্যাদি। তারা তা 'বিসমিল্লাহ' বলেই যবেহ করে। সেই জন্য তারা বলে, প্রথমটি নিঃসন্দেহে হারাম; কিন্তু এই দ্বিতীয়টি হারাম নয়; বরং তা হালাল। কারণ তা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে যবেহ করা হয়নি। আর এভাবে শিরকের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে; যদিও ফকীহগণ দ্বিতীয় অবস্থাকেও হারাম বলে গণ্য করেছেন। যেহেতু এটাও {وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ} এর অর্ন্তভুক্ত। তাফসীর বায়যাবীর টিকায় রয়েছে যে, যে পশু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয় তা হারাম; যদিও সেটি আল্লাহর নামেই যবেহ করা হয়। উলামাগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যদি কোন মুসলমান গায়রুল্লাহর নামে পশু যবেহ করে, তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যায় এবং তার যবেহকৃত পশু মুর্তাদের যবেহ বলে গণ্য হয়। হানাফী ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ দুর্রে মুখতারে রয়েছে, কোন রাজা বা অন্য কোন বুযুর্গ ব্যক্তির আগমনে (সৌজন্য বা মেহমান-নেওয়াযীর উদ্দেশে নয় বরং তার সন্তুষ্টি বা তা'যীমের জন্য) পশু যবেহ করা হারাম। কারণ তা {وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ} এরই পর্যায়ভুক্ত; যদিও তা আল্লাহর নামেই যবেহ করা হয়। আল্লামা শামী এর সমর্থন করেছেন। (কিতাবুয যাবায়েহ ১২৭৭ হিজরী পুরাতন ছাপা, ২৭৭পৃঃ, ফাতওয়া শামী ৫/২০৩ মায়মানা প্রেস মিসর।) অবশ্য কিছু ফুকহা দ্বিতীয় অবস্থাকে {وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ} এর উদ্দিষ্ট অর্থ বা তার পর্যায়ভুক্ত গণ্য করেন না। কিন্তু তাতে একই হেতু (আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকট্যলাভ) থাকার জন্য হারাম মনে করেন। অতএব হারাম গণ্য করায় কোন মতভেদ নাই। শুধু দলীল গ্রহণের ধরন ভিন্ন। তাছাড়া এটি {وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ} (যা দেবীর নামে বা আস্তানায় বলি দেওয়া হয়েছে) এর অন্তর্ভুক্ত। যাকে সুরা মায়িদায় হারাম ও নিষিদ্ধ বস্তুসমূহের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস থেকেও বুঝা যায় যে, আস্তানা, থান ও মাযারে যবেহ করা পশু হারাম। কারণ সেখানে যবেহ করা বা সেখানে নিয়ে গিয়ে বিলির উদ্দেশ্য আল্লাহ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টি অর্জন করাই হয়ে থাকে। একটি হাদীসে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি এসে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন, 'আমি বুওয়ানা নামক জায়গায় উট যবাই করার মানত করেছি।' নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, "সেখানে জাহেলিয়াতের যুগে কোন দেব-দেবী ছিল কি, যার পূজা করা হত?" সাহাবীগণ বললেন, 'না।' তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, "সেখানে তাদের কোন ঈদ-অনুষ্ঠান পালন করা হতো কি?" তাঁরা বললেন, 'না।' তখন নবী (সাঃ) প্রশ্নকারীকে মানত পূরণ করার অনুমতি দিলেন। (আবূ দাঊদঃ কসম ও নযর অধ্যায়) এখান হতে বুঝা গেল যে, দেব-দেবী সরিয়ে নেওয়ার পরও অনাবাদ আস্তানায় পশু যবেহ করা বৈধ নয়। তাহলে ঐ সকল আস্তানায় ও মাযারে গিয়ে পশু যবেহ করা কিভাবে বৈধ হতে পারে, যা পূজা ও নযর-নিয়াযের আড্ডায় পরিণত? أعاذنا الله منه
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَٰذَا حَلَالٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ
📘 তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা আরোপ করে বলে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবার জন্য তোমরা বলো না, ‘এটা হালাল এবং এটা হারাম।’[১] যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে, তারা সফলকাম হবে না।
(১) এখানে ঐ সকল পশুর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা দেব-দেবীর নামে উৎসর্গ করে নিজেদের জন্য হারাম মনে করত। যেমন বাহীরা, সায়েবা, ওয়াসিলা এবং হাম ইত্যাদি। সূরা মায়িদাহ ৫:১০৩ এবং সূরা আনআম ৬:১৩৯-১৪০ নং আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।
مَتَاعٌ قَلِيلٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
📘 (ইহকালে) তাদের সামান্য সুখ-সম্ভোগ রয়েছে এবং (পরকালে) তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।
وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا مَا قَصَصْنَا عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ ۖ وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَٰكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
📘 ইয়াহুদীদের জন্য আমি তো শুধু তাই নিষিদ্ধ করেছিলাম, যা তোমার নিকট আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি[১] এবং আমি তাদের উপর কোন যুলুম করিনি; বরং তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করত।
[১] সূরা আনআম ৬:১৪৬ নং আয়াতের টীকা দেখুন। সুরা নিসার ৪:১৬০ নং আয়াতের টীকায়ও এর বর্ণনা রয়েছে।
ثُمَّ إِنَّ رَبَّكَ لِلَّذِينَ عَمِلُوا السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِ ذَٰلِكَ وَأَصْلَحُوا إِنَّ رَبَّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 যারা অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কর্ম করে, তারা পরে তওবা করলে ও নিজেদেরকে সংশোধন করলে তাদের জন্য তোমার প্রতিপালক অবশ্যই অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
📘 তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রজনী, দিবস, সূর্য এবং চন্দ্রকে; আর নক্ষত্ররাজিও অধীন রয়েছে তাঁরই বিধানের; অবশ্যই এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।[১]
[১] কিভাবে দিনরাত্রি ছোট বড় হয়, চন্দ্র-সূর্য কিভাবে নিজ নিজ কক্ষপথে আসা-যাওয়া করে, অথচ এর মধ্যে কোন পার্থক্য সূচিত হয় না, নক্ষত্রমালা কিভাবে আকাশের সৌন্দর্য বর্ধন করে এবং রাত্রের অন্ধকারে পথভোলা পথিকের পথ বলে দেয়। এ সকল আল্লাহর পরিপূর্ণ শক্তি ও সার্বভৌমত্বের প্রমাণ বহন করে।
إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
📘 নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিল একজন ইমাম।[১] আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে ছিল না অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।
[১] أمة এর অর্থ ইমাম, নেতা। আর أمة উম্মাত জাতি অর্থেও ব্যবহার হয়। এই অর্থে ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন একাই একটি জাতির সমান। (উম্মতের অর্থ সূরা হূদের ১১:৮ নং আয়াতের টীকায় দেখুন।)
شَاكِرًا لِأَنْعُمِهِ ۚ اجْتَبَاهُ وَهَدَاهُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
📘 সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ; আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে পরিচালিত করেছিলেন সরল পথে।
وَآتَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً ۖ وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ
📘 আমি তাকে ইহকালে দিয়েছিলাম মঙ্গল এবং নিশ্চয়ই পরকালেও সে হবে সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম।
ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
📘 অতঃপর আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর;[১] সে অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
[১] ملة এমন ধর্ম যা কোন নবী দ্বারা মানুষের জন্য বিধিবদ্ধ বা আবশ্যিক করা হয়েছে। নবী (সাঃ) সকল আম্বিয়া সহ সকল মানুষের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি মিল্লাতে ইবরাহীমের অনুসরণ করতে আদিষ্ট হয়েছেন। যাতে ইবরাহীম (আঃ)-এর বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান স্পষ্ট হয়। অবশ্য নীতিগত দিক দিয়ে সকল নবীর শরীয়ত ও দ্বীন একই ছিল। যাতে রিসালাত সহ তাওহীদ ও পরকাল ছিল মৌলিক বিষয়।
إِنَّمَا جُعِلَ السَّبْتُ عَلَى الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ ۚ وَإِنَّ رَبَّكَ لَيَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ
📘 শনিবার পালন তো শুধু তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, যারা এ বিষয়ে মতভেদ করত।[১] তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত, তোমার প্রতিপালক অবশ্যই কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মাঝে বিচার-ফায়সালা করে দেবেন।
[১] এই মতভেদ কি ছিল? এর ব্যাখ্যায় মতানৈক্য রয়েছে। কেউ বলেন, মূসা (আঃ) তাদের জন্য শুক্রবার দিন নিদিষ্ট করেছিলেন; কিন্তু বানী ইস্রাঈলগণ তার বিরোধিতা করে শনিবারকে সম্মান ও ইবাদতের জন্য বেছে নেয়। মহান আল্লাহ বলেছিলেন, হে মূসা তারা যে দিন বেছে নিয়েছে তাই তাদের জন্য থাকতে দাও। আবার কেউ বলেন, মহান আল্লাহ তাদেরকে সপ্তাহে একটি দিন সম্মানের জন্য বেছে নিতে বলেন। দিনটি নির্দিষ্ট করায় তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। অতঃপর ইয়াহুদীরা শনিবার ও খ্রিষ্টানরা রবিবার দিনকে বেছে নেয়। আর জুমআর দিনকে মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট করেন। আবার কিছু উলামা বলেন, খ্রিষ্টানরা রবিবারকে ইয়াহুদীদের বিরোধিতায় নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করে, অনুরূপ ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে ইয়াহুদীদের থেকে আলাদা রাখার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাসের পাথরের পূর্ব প্রান্তকে কিবলা হিসাবে বেছে নেয়। জুমআর দিনকে আল্লাহ কর্তৃক মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট করার কথা হাদীসে বর্ণিত আছে। (দেখুন বুখারীঃ জুমআহ অধ্যায়)
ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ ۖ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ
📘 তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সদ্ভাবে।[১] নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং কে সৎপথে আছে, তাও সবিশেষ অবহিত। [২]
[১] এখানে ইসলাম প্রচার ও তাবলীগের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, তা হবে হিকমত, সদুপদেশ ও নম্রতার উপর ভিত্তিশীল এবং আলোচনার সময় সদ্ভাব বজায় রাখা, কঠোরতা পরিহার করা ও নম্রতার পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
[২] অর্থাৎ, তাঁর কাজ উল্লিখিত নীতি অনুসারে উপদেশ ও প্রচার করা। হিদায়াতের রাস্তায় পরিচালিত করা আল্লাহর আয়ত্তাধীন। আর তিনিই জানেন যে, কে হিদায়াত গ্রহণকারী, আর কে তা গ্রহণকারী নয়?
وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ ۖ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ
📘 যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তাহলে ঠিক ততখানি করবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর, তাহলে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের জন্য সেটাই উত্তম। [১]
[১] এর মধ্যে যদিও সীমা অতিক্রম না করে সমান সমান প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমতি রয়েছে। সীমা অতিক্রম করলে সেও যালেম বলে গণ্য হবে। তবে ক্ষমা করে দেওয়া ও ধৈর্য ধারণ করা অতি উত্তম।
وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلَّا بِاللَّهِ ۚ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلَا تَكُ فِي ضَيْقٍ مِمَّا يَمْكُرُونَ
📘 তুমি ধৈর্যধারণ কর; আর তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহরই সাহায্যে। তাদের (অবিশ্বাসের) জন্য তুমি দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না। [১]
[১] কারণ মহান আল্লাহ তাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে মু'মিন, পরহেযগার ও সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। আর আল্লাহ যাদের সঙ্গে থাকেন পৃথিবীর লোকেদের চক্রান্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। যেমন পরের আয়াতে তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُحْسِنُونَ
📘 নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরই সঙ্গে থাকেন, যারা সংযম অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ।
وَمَا ذَرَأَ لَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ
📘 আর যে নানা রঙের বস্তু তোমাদের জন্য পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন (তাও তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন); এতে সেই সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা উপদেশ গ্রহণ করে।[১]
[১] অর্থাৎ, পৃথিবীতে যে সব খনিজ সম্পদ, গাছপালা, জড়পদার্থ ও জীবজন্তু এবং এদের মধ্যে যে সব উপকারিতা সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য রয়েছে নির্দশন।
وَهُوَ الَّذِي سَخَّرَ الْبَحْرَ لِتَأْكُلُوا مِنْهُ لَحْمًا طَرِيًّا وَتَسْتَخْرِجُوا مِنْهُ حِلْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الْفُلْكَ مَوَاخِرَ فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
📘 তিনিই সমুদ্রকে অধীন করেছেন; যাতে তোমরা তা হতে তাজা গোশত (মাছ) আহার করতে পার এবং যাতে তা হতে বের করতে পার নিজেদের পরিধেয় অলংকার। এবং তোমরা দেখতে পাও, ওর বুক চিরে নৌযান চলাচল করে। আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।[১]
[১] এখানে সমুদ্রের পাহাড় সমান ঢেউকে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়েছে এ কথা বলার পর সমুদ্রের তিনটি উপকারিতার কথাও উল্লেখ করেছেন। একঃ তোমরা তাজা মাছ তা থেকে সংগ্রহ করে থাক। (মাছ মারা গেলেও তা হালাল, তাছাড়া এহরাম অবস্থায় তা শিকার করা বৈধ।) দুইঃ তার থেকে মণিমুক্তা ও মূল্যবান পাথর বের কর; যার দ্বারা তোমরা অলংকার তৈরী কর। তিনঃ তোমরা সমুদ্রের বুকে নৌকা ও জলজাহাজ চালিয়ে থাক, যার দ্বারা তোমরা এক দেশ হতে অন্য দেশে যাতায়াত কর, বাণিজ্যিক মালপত্র আমদানি-রপ্তানি কর, যার ফলে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে থাক। আর এর জন্য তোমাদের উচিত, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা করা।
وَأَلْقَىٰ فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهَارًا وَسُبُلًا لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
📘 আর তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদেরকে নিয়ে আন্দোলিত না হয়[১] এবং স্থাপন করেছেন নদ-নদী ও পথ, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার। [২]
[১] এখানে পাহাড়ের উপকারিতা এবং আল্লাহর এক বিশাল অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে। কেননা পৃথিবী নড়তে থাকলে বসবাস করা সম্ভব ছিল না। এর অনুমান ভূমিকম্প দিয়ে করা যেতে পারে, যা কয়েক সেকেন্ড্ ও ক্ষণিকের মধ্যে বিশাল বিশাল মজবুত ঘর-বাড়িকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়, শহর ও গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।
[২] নদ-নদীর সৃষ্টিও বড় আশ্চর্য, কোথায় শুরু হয়ে, কোথায় কোথায়, ডানে বামে, উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিককেই সিঞ্চিত করে। অনুরূপ তিনি রাস্তাও বানিয়েছেন, যার দ্বারা তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার।
وَعَلَامَاتٍ ۚ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ
📘 আর (স্থাপন করেছেন) পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহও; এবং ওরা নক্ষত্রের সাহায্যেও পথের নির্দেশ পায়।
أَفَمَنْ يَخْلُقُ كَمَنْ لَا يَخْلُقُ ۗ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
📘 সুতরাং যিনি সৃষ্টি করেন, তিনি কি তারই মত, যে সৃষ্টি করে না? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? [১]
[১] এই সকল অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে তওহীদের গুরুতত্ত্বকে উজ্জ্বল করা হয়েছে যে, আল্লাহই এই সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাকে ছেড়ে যাদের তোমরা ইবাদত করছ, তারা কি কিছু সৃষ্টি করেছে? অবশ্যই না, বরং তারাই আল্লাহর সৃষ্টি। অতএব স্রষ্টা ও সৃষ্টি কিভাবে এক সমান হতে পারে? অথচ তোমরা তাদেরকে আল্লাহর সমতুল্য করে রেখেছ, তোমরা কি একটুও চিন্তা কর না?
وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا ۗ إِنَّ اللَّهَ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে ওর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না; আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।
وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعْلِنُونَ
📘 তোমরা যা গোপন রাখো এবং যা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা জানেন।[১]
[১] আর সেই হিসাবে তিনি কিয়ামত দিবসে পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন। সৎশীলকে সৎকর্মের পুরস্কার এবং অসৎশীলকে তার অসৎকর্মের শাস্তি।
يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ أَنْ أَنْذِرُوا أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاتَّقُونِ
📘 তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা[১] স্বীয় নির্দেশে অহী (প্রত্যাদেশ)[২] সহ ফিরিশতা অবতীর্ণ করেন, এই মর্মে সতর্ক করবার জন্য যে, আমি ছাড়া কোন (সত্য) উপাস্য নেই; সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় কর।
[১] অর্থাৎ, নবী রসূলগণ, যাঁদের উপর অহী অবতীর্ণ হত। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,{اللهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ} নবুঅতের দায়িত্ব কাকে দেবেন তা আল্লাহ ভালভাবেই জানেন।
(সূরা আনআম ৬:১২৪)
{يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَن يَشَاء مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ} তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা অহী করেন স্বীয় আদেশসহ, যাতে সে সতর্ক করতে পারে কিয়ামত দিন সর্ম্পকে।
(সূরা মু'মিন ৪০:১৫)
[২] এখানে الروح বলতে অহী (প্রত্যাদেশ)। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে,{وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا مَا كُنتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ} অর্থাৎ, এভাবে আমি নিজ নির্দেশে তোমার প্রতি অহী (প্রত্যাদেশ) করেছি রূহ। তুমি তো জানতে না গ্রন্থ কি, ঈমান (বিশ্বাস) কি।
(সূরা শূরা ৪২:৫২)
وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ
📘 যারা আল্লাহ ছাড়া অপরকে আহবান করে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়।[১]
[১] অন্যন্য আয়াতের তুলনায় এই আয়াতে গায়রুল্লাহর একটি অতিরিক্ত গুণের কথা বলা হয়েছে; তারা সৃষ্টিকর্তা নয় -- এ কথা খন্ডন করার সাথে সাথে তারা নিজেরাই যে সৃষ্ট, সে কথা সাব্যস্ত করা হয়েছে।
(ফাতহুল কাদীর)
أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَاءٍ ۖ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
📘 তারা নিষ্প্রাণ, নির্জীব[১] এবং পুনরুত্থান কবে হবে, সে বিষয়ে তাদের কোন চেতনা (বোধ) নেই।[২]
[১] মৃত বলতে প্রাণহীন ও চেতনাহীন জড় (পাথর)ও বটে এবং মৃত সৎলোকও বটে। কারণ মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের কথা বলা (যে ব্যাপারে তাদের কোন বোধ নেই) জড় ব্যতীত সৎলোকেদের জন্যই বেশী সঙ্গত বলে মনে হয়। তাদেরকে শুধু মৃতই বলা হয়নি; বরং জীবিত নয় বলে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যাতে কবর পূজার স্পষ্ট খন্ডন হচ্ছে। যারা বলে কবরে দাফন হওয়া ব্যক্তি মৃত নয়, জীবিত। আর আমরা জীবিতদেরকেই ডাকি। আল্লাহর এই কথার পর জানা গেল মৃত্যু এসে যাওয়ার পর পার্থিব জীবন কেউ পেতে পারে না, আর না পৃথিবীর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকে।
[২] তাহলে তাদের থেকে উপকার বা মঙ্গল কামনা কেমন করে করা যেতে পারে?
إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۚ فَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ قُلُوبُهُمْ مُنْكِرَةٌ وَهُمْ مُسْتَكْبِرُونَ
📘 তোমাদের উপাস্য একক উপাস্য; সুতরাং যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সত্য বিমুখ এবং তারা অহংকারী। [১]
[১] অর্থাৎ, এক আল্লাহকে মেনে নেওয়া অস্বীকারকারী মুশরিকদের জন্য বড়ই কঠিন। তারা বলে, {أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ} অর্থাৎ, সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে একটিমাত্র উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।
(সূরা স্বা-দ ৩৮:৫)
অন্যত্র আরো বলেন, {وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ} অর্থাৎ, এক আল্লাহর কথা বলা হলে যারা পরকালে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদের দেবতাদের কথা উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।
(সুরা যুমার ৩৯:৪৫)
لَا جَرَمَ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعْلِنُونَ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ
📘 এটা নিঃসন্দেহ যে, আল্লাহ জানেন যা তারা গোপন করে এবং যা তারা প্রকাশ করে; তিনি অহংকারীকে অবশ্যই পছন্দ করেন না। [১]
[১] استكبار এর (অহংকার বা বড়াই) এর অর্থ হল নিজেকে বড় মনে করে সত্য ও হককে অস্বীকার করা এবং অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করা। হাদীসে অহংকারের এই সংজ্ঞাই বর্ণিত হয়েছে। (মুসলিমঃ ঈমান অধ্যায়) অহংকার ও গর্ব আল্লাহর নিকট অত্যন্ত ঘৃণিত। হাদীসে আছে যে, "যে ব্যক্তির অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
(সুরা যুমার ৪৫)
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ مَاذَا أَنْزَلَ رَبُّكُمْ ۙ قَالُوا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ
📘 যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমাদের প্রতিপালক কি অবতীর্ণ করেছেন?’ উত্তরে তারা বলে, ‘পূর্ববর্তীদের উপকথা।’[১]
[১] বৈমুখ্য ও বিদ্রূপ প্রকাশ করে মিথ্যায়নকারীরা উত্তরে বলত, আল্লাহ তাআলা কিছুই অবতীর্ণ করেননি। আর মুহাম্মাদ যা কিছু পাঠ করে তা হল পূর্ববর্তীদের উপকথা; যা অপরের নিকট থেকে শুনে বর্ণনা করে।
لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۙ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ
📘 ফলে কিয়ামত দিবসে তারা বহন করবে তাদের পাপভার পূর্ণমাত্রায় এবং তাদেরও পাপভার যাদেরকে তারা অজ্ঞতা হেতু বিভ্রান্ত করেছে। দেখ, তারা যা বহন করবে তা কতই না নিকৃষ্ট। [১]
[১] অর্থাৎ, মহান আল্লাহ তাদের মুখ দিয়ে এ কথা বের করালেন, যাতে তারা নিজেদের পাপভারের সাথে অপরের পাপভারও বহন করে। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সাঃ) বলেছেন, যে মানুষকে সৎপথ দেখায়, সে ঐ সকল লোকেদের নেকী পেতে থাকে, যারা তার কথামত সৎপথ অবলম্বন করে। আর যে অসৎ পথ দেখায়, সে ঐ সকল লোকেদের পাপভার বহন করে, যারা তার কথা অনুযায়ী অসৎ পথ অবলম্বন করে।
(আবূ দাঊদঃ সুন্নাহ অধ্যায়)
قَدْ مَكَرَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَأَتَى اللَّهُ بُنْيَانَهُمْ مِنَ الْقَوَاعِدِ فَخَرَّ عَلَيْهِمُ السَّقْفُ مِنْ فَوْقِهِمْ وَأَتَاهُمُ الْعَذَابُ مِنْ حَيْثُ لَا يَشْعُرُونَ
📘 নিশ্চয় তাদের পূর্ববর্তীগণ চক্রান্ত করেছিল; আল্লাহ তাদের ইমারতের ভিত্তিমূলে আঘাত করলেন; ফলে ইমারতের ছাদ তাদের উপর ধসে পড়ল[১] এবং এমন দিক হতে তাদের উপর শাস্তি এল, যা ছিল তাদের ধারণার বাইরে। [২]
[১] কিছু মুফাসসির ইসরাঈলী বর্ণনার উপর ভিত্তি করে বলেন, এখানে উদ্দেশ্য নমরূদ বা বুখতে নাসর। সে কোনভাবে আকাশে চড়ে আল্লাহর বিরূদ্ধে চক্রান্ত করেছিল। কিন্তু তাতে সে অসফল হয়ে ফিরে আসে। কারো কারো মতে এটি একটি উপমা মাত্র। যার উদ্দেশ্য এ কথা বলা যে, আল্লাহর সাথে কুফরী ও শিরককারীদের আমল ঐভাবেই ধ্বংস হবে, যেভাবে কোন ব্যক্তির ঘরের ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং ছাদসহ ধসে ভূমিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু সঠিক কথা হল ঐ সকল জাতির পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করা, যারা নবীদেরকে মিথ্যার পর মিথ্যা মনে করে। আর শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আযাবে তারা তাদের ঘর সহ ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আদ জাতি, লূত-সম্প্রদায় প্রভৃতি।
[২] যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,{فَأَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا} "সুতরাং আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর এমন এক জায়গা হতে এল, যা ছিল তাদের ধারণার বাইরে।" (সূরা হাশর ৫৯:২ আয়াত)
ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُخْزِيهِمْ وَيَقُولُ أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنْتُمْ تُشَاقُّونَ فِيهِمْ ۚ قَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ إِنَّ الْخِزْيَ الْيَوْمَ وَالسُّوءَ عَلَى الْكَافِرِينَ
📘 পরে কিয়ামতের দিনে তিনি তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং বলবেন, ‘কোথায় আমার সে সব অংশী যাদের সম্বন্ধে তোমরা বিতন্ডা করতে?’[১] যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছিল[২] তারা বলবে, ‘নিশ্চয় আজ লাঞ্ছনা ও অমঙ্গল অবিশ্বাসীদের জন্য।’
[১] এ ছিল পৃথিবীর আযাব। আর কিয়ামতে মহান আল্লাহ এমনভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবেন যে, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, যাদেরকে আমার সাথে শরীক করতে এবং যাদের জন্য তোমরা মু'মিনদের সঙ্গে ঝগড়া করতে, তারা আজ কোথায়?
[২] অর্থাৎ, যাদের দ্বীনী জ্ঞান ছিল, যারা দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তারা উত্তর দেবে।
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ ۖ فَأَلْقَوُا السَّلَمَ مَا كُنَّا نَعْمَلُ مِنْ سُوءٍ ۚ بَلَىٰ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
📘 নিজেদের প্রতি যুলুম করতে থাকা অবস্থায় ফিরিশতাগণ যাদের প্রাণ হরণ করে, তারা আত্মসমর্পণ করে বলবে, ‘আমরা কোন মন্দ কর্ম করতাম না।’[১] অবশ্যই! তোমরা যা করতে সে বিষয়ে নিশ্চয় আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। [২]
[১] এখানে মুশরিক যালিমদের মৃত্যুর সময়ের অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে। যখন ফিরিশতা তাদের রূহ ছিনিয়ে নেন, তখন তারা আত্মসমর্পণ করে মিনতি সহকারে বলে, আমরা কোন মন্দ কাজ করতাম না। যেমন তারা হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে মিথ্যা শপথ করে বলবে,{وَاللهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِينَ} অর্থাৎ, আল্লাহর শপথ! আমরা মুশরিক ছিলাম না।
(সূরা আনআম ৬:২৩)
অন্যত্র বলেন, যেদিন আল্লাহ তাদের পুনরুত্থিত করবেন, সেদিন তারা আল্লাহর সামনে সেই ভাবেই মিথ্যা শপথ করবে, যেভাবে তোমার সামনে করে।
(সূরা মুজাদালাহ ৫৮:১৮)
[২] ফিরিশতা উত্তরে বলবেন, কেন নয়? তোমরা মিথ্যা বলছ। তোমাদের পুরো জীবন মন্দ কাজেই কেটেছে। আর আল্লাহর নিকট তোমাদের সকল কাজের রেকর্ড জমা রয়েছে। তোমাদের অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
فَادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ فَلَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ
📘 সুতরাং তোমরা জাহান্নামের দরজাগুলিতে প্রবেশ কর সেথায় চিরস্থায়ী থাকার জন্য।[১] দেখ অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।
[১] ইমাম ইবনে কাসীর বলেন, তাদের মৃত্যুর পর পরই তাদের রূহগুলো জাহান্নামে চলে যায়। আর তাদের দেহগুলো কবরে পড়ে থাকে। (যেখানে আল্লাহ নিজ কুদরতে শরীর ও রূহের মধ্যে দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও এক ধরণের সম্পর্ক সৃষ্টি করে শাস্তি দেন। সকাল-সন্ধ্যা তাদের সামনে আগুন পেশ করা হয়।) অতঃপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, তখন তাদের রূহগুলো তাদের নিজ নিজ (নতুন) দেহে ফিরে আসবে এবং চিরকালের জন্য তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۚ تَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
📘 তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন;[১] তারা যাকে অংশী করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
[১] অর্থাৎ, শুধু অযথা খেল-তামাশার জন্য সৃষ্টি করিনি, বরং এক লক্ষ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে, আর তা হল পুণ্যের প্রতিদান ও পাপের শাস্তিদান; যেমন পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হল।
۞ وَقِيلَ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا مَاذَا أَنْزَلَ رَبُّكُمْ ۚ قَالُوا خَيْرًا ۗ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ ۚ وَلَدَارُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ ۚ وَلَنِعْمَ دَارُ الْمُتَّقِينَ
📘 আর যারা সাবধানী ছিল তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমাদের প্রতিপালক কি অবতীর্ণ করেছিলেন?’ তারা বলবে, ‘মহাকল্যাণ।’ যারা এই দুনিয়ায় সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে মঙ্গল এবং পরকালের আবাস আরো উৎকৃষ্টতর; আর সাবধানীদের আবাসস্থল কত উত্তম!
جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ لَهُمْ فِيهَا مَا يَشَاءُونَ ۚ كَذَٰلِكَ يَجْزِي اللَّهُ الْمُتَّقِينَ
📘 ওটা স্থায়ী জান্নাত যাতে তারা প্রবেশ করবে; ওর নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; তারা যা কিছু কামনা করবে তাতে তাদের জন্য তাই থাকবে; এভাবেই আল্লাহ সাবধানীদেরকে পুরস্কৃত করেন।
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ ۙ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
📘 যাদের পবিত্র থাকা অবস্থায় ফিরিশতাগণ প্রাণ হরণ করে; ফিরিশতাগণ (তাদেরকে) বলে, ‘তোমাদের প্রতি শান্তি![১] তোমরা যা করতে তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর।’ [২]
[১] এই আয়াতগুলিতে যালেম মুশরিকদের বিপরীতে ঈমানদার ও মুত্তাকীদের চরিত্র এবং তাদের উত্তম পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের দলভুক্ত করুন। আমীন।[২] সূরা আ'রাফের ৭:৪৩ নং আয়াতের টীকায় এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি নিজ আমলের জোরে জান্নাতে যেতে পারবে না, যতক্ষণ তার প্রতি আল্লাহর দয়া না হবে। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে যে, তোমরা নিজ আমলের বিনিময়ে বা ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর। আসলে এর মধ্যে কোন পরস্পর-বিরোধিতা নেই। কারণ আল্লাহর রহমত ও দয়া পেতে হলে সৎকর্ম একান্ত জরুরী। সৎকর্ম আল্লাহর রহমত পাওয়ার একমাত্র উপায়। অতএব আমলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আমল ছাড়া পরকালে আল্লাহর রহমত কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সুতরাং উক্ত হাদীসের অর্থ নিজ জায়গায় সঠিক এবং আমলের প্রয়োজনীয়তাও স্বস্থানে বহাল। সেই কারণে অন্য এক হাদীসে বলেছেন, "নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আকার-আকৃতি ও ধন-সম্পদ দেখবেন না, বরং তিনি দেখবেন তোমাদের হৃদয় ও কর্ম।"
(মুসলিমঃ কিতাবুল বির্র)
هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمُ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ أَمْرُ رَبِّكَ ۚ كَذَٰلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۚ وَمَا ظَلَمَهُمُ اللَّهُ وَلَٰكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
📘 তারা শুধু প্রতীক্ষা করে তাদের কাছে ফিরিশতা আগমনের অথবা তোমার প্রতিপালকের নির্দেশ আগমনের।[১] ওদের পূর্ববর্তিগণও এরূপ করেছে।[২] আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেননি,[৩] বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করত। [৪]
[১] অর্থাৎ এরাও কি ফিরিশতা এসে রূহ ছিনিয়ে নেওয়ার সময়ের অথবা তোমার প্রতিপালকের আদেশ (আযাব বা কিয়ামত) আসার প্রতীক্ষা করছে?
[২] অর্থাৎ পূর্বের লোকেরাও অনুরূপ অবাধ্যতা ও পাপের পথ ধরেছে, যার ফলে তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে এসেছে।
[৩] মহান আল্লাহ তাদের জন্য কোন ওযর-অজুহাতের সুযোগ রাখেননি, রসূল পাঠিয়ে ও কিতাব অবতীর্ণ করে তা শেষ করে দিয়েছেন।
[৪] রসূলদের বিরোধিতা ও তাঁদেরকে মিথ্যা মনে করে তারা নিজেরা নিজেদের উপরই যুলুম করেছিল।
فَأَصَابَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا عَمِلُوا وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
📘 সুতরাং তাদের প্রতি আপতিত হয়েছিল তাদেরই মন্দ কর্মের শাস্তি এবং তাদেরকে পরিবেষ্টন করেছিল তাই, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। [১]
[১] যখন রসূল তাদের বলতেন যে, 'যদি তোমরা ঈমান আনয়ন না কর, তাহলে আল্লাহর আযাব এসে পড়বে।' তখন তারা বিদ্রূপ করে বলত, 'যাও! তোমার আল্লাহকে বল, আযাব দিয়ে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিক।' সুতরাং সেই আযাবই তাদেরকে ঘিরে ফেলল, যে আযাবের জন্য তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত এবং তাদের বাঁচার কোন পথই থাকল না।
وَقَالَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا عَبَدْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ نَحْنُ وَلَا آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ ۚ كَذَٰلِكَ فَعَلَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۚ فَهَلْ عَلَى الرُّسُلِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
📘 অংশীবাদীরা বলবে, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা ও আমরা তিনি ব্যতীত অপর কোন কিছুর উপাসনা করতাম না এবং তাঁর নির্দেশ ব্যতীত আমরা কোন কিছু নিষিদ্ধ করতাম না।’ ওদের পূর্ববর্তিগণও এরূপ করেছে। সুতরাং রসূলদের কর্তব্য সুস্পষ্ট বাণী প্রচার করা ছাড়া আর কি? [১]
[১] এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুশরিকদের একটি ভুল ধারণা দূর করেছেন, তারা বলত, 'আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করি, বা তাঁর আদেশ ছাড়াই কিছু জিনিসকে আমরা অবৈধ করে নিই, যদি আমাদের এ সকল কাজ ভুল হয়, তাহলে মহান আল্লাহ তাঁর পরিপূর্ণ কুদরত দিয়ে আমাদেরকে বাধা দেন না কেন? তিনি চাইলে আমরা এ কাজ করতেই পারতাম না। আর যদি বাধা না দেন, তাহলে এর অর্থ এই যে, আমরা যা কিছু করছি সবই তাঁর ইচ্ছায় করছি।' মহান আল্লাহ তাদের উক্ত সন্দেহ এই বলে দূর করেছেন যে, রসূলদের কাজ শুধু পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ, তোমাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল যে, আল্লাহ তোমাদেরকে বাধা দেননি। মহান আল্লাহ তোমাদেরকে শিরকী কর্মকান্ড হতে কঠিনভাবে বাধা দিয়েছেন। সেই কারণে তিনি প্রত্যেক জাতির নিকট রসূল ও কিতাব পাঠিয়েছেন, আর প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে প্রথমে শিরক হতে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। যার পরিষ্কার অর্থ হল, আল্লাহ কখনই পছন্দ করেন না যে, মানুষ শিরক করুক। যদি তিনি একাজ পছন্দ করতেন, তাহলে এর প্রতিবাদে রসূল পাঠাতেন কেন? কিন্তু এর পরও যদি তোমরা রসূলদেরকে মিথ্যা মনে করে শিরকের রাস্তা অবলম্বন কর, আর আল্লাহ যদি নিজ ইচ্ছায় তোমাদেরকে বাধা না দিয়ে থাকেন, তাহলে এটা তাঁর হিকমতের এক অংশ। যেহেতু তিনি মানুষকে ইচ্ছা প্রয়োগের পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেছেন। কেননা এ ছাড়া তাদের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব ছিল না। (আল্লাহ বলেন,) আমার রসূলগণ আমার বাণী তোমাদের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেছে যে, তোমরা এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করো না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে তা ব্যবহার কর। রসূলদের যা করণীয় তারা তাই করেছে। আর তোমরা শিরক করে স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছ, যার শাস্তি হল চিরস্থায়ী আযাব।
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ۖ فَمِنْهُمْ مَنْ هَدَى اللَّهُ وَمِنْهُمْ مَنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلَالَةُ ۚ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
📘 অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও তাগূত থেকে দূরে থাক। অতঃপর তাদের কতককে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তাদের কতকের উপর ভ্রষ্টতা অবধারিত হয়।[১] সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে দেখ, যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে, তাদের পরিণাম কি হয়েছে।
[১] উক্ত সন্দেহ দূরীকরণের উদ্দেশ্যে তিনি আরো বলেন যে, আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রসূল প্রেরণ করেছি ও তাদের দ্বারা আমার এই বাণী তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি যে, শুধু এক আল্লাহর ইবাদত কর। কিন্তু যাদের উপর ভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তারা এর পরোয়াই করেনি।
إِنْ تَحْرِصْ عَلَىٰ هُدَاهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ يُضِلُّ ۖ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ
📘 তুমি তাদের পথপ্রাপ্তির ব্যাপারে আগ্রহী হলেও আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেছেন তাকে নিশ্চয় তিনি সৎপথে পরিচালিত করবেন না এবং তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।[১]
[১] এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন যে, হে নবী! তোমার ইচ্ছা এরা সকলেই হেদায়তের পথ অবলম্বন করুক। কিন্তু আল্লাহর রীতি অনুসারে যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তুমি তাদেরকে হিদায়াতের পথে চালাতে পারো না। এরা অবশ্যই শেষ পরিণতিতে পৌঁছবে, যেখানে তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।
وَأَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ ۙ لَا يَبْعَثُ اللَّهُ مَنْ يَمُوتُ ۚ بَلَىٰ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
📘 তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর শপথ করে বলে, যার মৃত্যু হয় আল্লাহ তাকে পুনর্জীবিত করবেন না।[১] অবশ্যই! তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেনই; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা অবগত নয়। [২]
[১] কারণ, মাটিতে মিশে যাওয়ার পর পুনর্জীবিত হওয়া ছিল তাদের নিকট অসম্ভব ও ধারণাতীত ব্যাপার। সেই কারণে যখন রসূল তাদেরকে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হওয়ার কথা বলতেন, তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী ভাবত, সত্যবাদী মনে করত না। বরং এর বিপরীত পুনর্জীবিত না হওয়ার ব্যাপারে বড় দৃঢ়তার সাথে তারা শপথ করত!
[২] এই অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণেই রসূলদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করে ও তাঁদের বিরোধিতা করে কুফরীর সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে।
لِيُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي يَخْتَلِفُونَ فِيهِ وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّهُمْ كَانُوا كَاذِبِينَ
📘 তিনি (পুনর্জীবিত করবেন) যাতে তাদের বিতর্কিত বিষয় তাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন এবং যাতে অবিশ্বাসীরা জানতে পারে যে, তারাই ছিল মিথ্যাবাদী।[১]
[১] এখানে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার হিকমত ও কারণ উল্লেখ করা হচ্ছে যে, সেদিন মহান আল্লাহ সেই সকল বিষয়ে ফায়সালা করবেন, যে সকল বিষয়ে তাদের মাঝে মতানৈক্য ছিল। হকপন্থী ও পরহেযগারদেরকে উত্তম প্রতিদান দেবেন এবং কাফের ও পাপীদেরকে তাদের পাপকাজের শাস্তি দেবেন। তাছাড়া সে দিন কাফেরদের নিকট এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, কিয়ামত হওয়ার ব্যাপারে যে শপথ তারা করত, তাতে তারা মিথ্যাবাদী ছিল।
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ
📘 তিনি মানুষকে বীর্য হতে সৃষ্টি করেছেন; পরে সে প্রকাশ্য বিতন্ডাকারী হয়ে বসল! [১]
[১] অর্থাৎ, এক জড়পদার্থ হতে যা জীবন্ত দেহ থেকে নির্গত হয়, যাকে বীর্য বলা হয়। তাকে বিভিন্ন পর্যায়ে পার করার পর এক পূর্ণ আকার দান করা হয়। তারপর তাতে (রূহ, বিশেষ) জীবন দান করা হয়। এরপর মায়ের পেট হতে পৃথিবীতে আনা হয়। পৃথিবীতে সে জীবন যাপন করতে করতে যখন জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়, তখন সে তার প্রতিপালক আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে, তাঁকে অস্বীকার করে বা তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে।
إِنَّمَا قَوْلُنَا لِشَيْءٍ إِذَا أَرَدْنَاهُ أَنْ نَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ
📘 আমি কোন কিছু করার ইচ্ছা করলে সে বিষয়ে আমার কথা শুধু এই যে, আমি বলি, ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়। [১]
[১] অর্থাৎ, মানুষের নিকট কিয়ামত সংঘটিত হওয়া যতই কঠিন ও অসম্ভব মনে হোক না কেন, আল্লাহর নিকট তা অতি সহজ। পৃথিবী ও আকাশ ধ্বংস করার জন্য তাঁর শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, মিস্ত্রী বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই। তাঁর জন্য শুধু كُن (হও বা হয়ে যাও) শব্দই যথেষ্ট। তাঁর 'হও' শব্দ দ্বারা চোখের পলকের মধ্যে কিয়ামত সংঘটিত হবে। {وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلاَّ كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ} আর কিয়ামতের ব্যাপার তো চক্ষুর পলকের ন্যায়, বরং তার চেয়েও সত্ত্বর।
(সূরা নাহল ১৬:৭৭)
وَالَّذِينَ هَاجَرُوا فِي اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مَا ظُلِمُوا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً ۖ وَلَأَجْرُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
📘 যারা অত্যাচারিত হবার পর আল্লাহর পথে হিজরত (স্বদেশ ত্যাগ) করেছে,[১] আমি অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়ায় উত্তম আবাস প্রদান করব।[২] আর পরকালের পুরস্কারই অধিক বড়;[৩] যদি তারা জানত!
[১] হিজরতের অর্থ হল আল্লাহর দ্বীনের জন্য, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজ মাতৃভূমি, আত্মীয়-সজন, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে এমন স্থানে চলে যাওয়া, যেখানে সহজেই আল্লাহর দ্বীন পালন করা যেতে পারে। এই আয়াতে ঐ সকল মুহাজিরদের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতটি সাধারণ, যা প্রত্যেক মুহাজির ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। আবার এটিও হতে পারে যে, এই আয়াত ঐ সকল মুহাজিরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, যাঁরা নিজ জাতির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাবশায় (ইথিউপিয়া) হিজরত করেছিলেন। যাঁদের সংখ্যা ছিল মহিলা সহ এক শত বা তার কিছু বেশি। যাঁদের মধ্যে উসমান গনী ও তাঁর স্ত্রী নবীকন্যা রুক্বাইয়্যা (রায্বিয়াল্লাহু আনহুমা)ও ছিলেন।
[২] حسنة থেকে পবিত্র জীবিকা আবার কেউ কেউ মদীনা অর্থ নিয়েছেন, যা পরবর্তীতে মুসলিমদের কেন্দ্রস্থল হল। ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন, উক্ত দুই কথার মাঝে কোন বিরোধ নেই। কারণ যাঁরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-বাড়ি ছেড়ে হিজরত করেছিলেন, মহান আল্লাহ তাঁদেরকে পৃথিবীতেই উত্তম প্রতিদান দিয়েছিলেন। পবিত্র জীবিকাও দান করেছিলেন এবং পুরো আরবের উপর শাসন-ক্ষমতাও দিয়েছিলেন।
[৩] উমার (রাঃ) যখন মুহাজির ও আনসারদের ভাতা নির্ধারিত করলেন, তখন প্রত্যেক মুহাজিরকে ভাতা দিতে গিয়ে বলতেন, এ হল তাই, যার প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ পৃথিবীতে দিয়েছেন। আর পরকালে যা জমা রেখেছেন তা এর চেয়ে অনেক উত্তম।
(ইবনে কাসীর)
الَّذِينَ صَبَرُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
📘 যারা ধৈর্য ধারণ করেছে এবং নিজেদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে।
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ ۚ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
📘 তোমার পূর্বে পুরুষদেরকেই আমি (রসূলরূপে) প্রেরণ করেছি; যাদের নিকট আমি অহী পাঠাতাম। তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর; [১]
[১] أهل الذكر (জ্ঞানী) বলতে আহলে কিতাবদের বুঝানো হয়েছে, যারা পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও তাঁদের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিল। উদ্দেশ্য হল, আমি যত রসূল পাঠিয়েছি, তারা সকলেই মানুষ ছিল। অতএব যদি মুহাম্মাদও মানুষ হয়, তাহলে এটা কোন নতুন কথা নয় যে, তোমরা তার মানুষ হওয়ার কারণে তার রিসালতকেই অস্বীকার করবে। যদি তোমাদের সন্দেহ হয়, তাহলে আহলে কিতাবদের জিজ্ঞাসা কর যে, পূর্ববর্তী নবীগণ মানুষ ছিল, না ফিরিশতা? যদি তারা ফিরিশতা ছিল, তাহলে অবশ্যই অস্বীকার করো। আর যদি তারাও সকলে মানুষ ছিল, তাহলে মুহাম্মদের মানুষ হওয়ার কারণে তার রিসালাতকে অস্বীকার কেন?
بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ۗ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
📘 স্পষ্ট প্রমাণ ও গ্রন্থসহ। আর তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে।
أَفَأَمِنَ الَّذِينَ مَكَرُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ يَخْسِفَ اللَّهُ بِهِمُ الْأَرْضَ أَوْ يَأْتِيَهُمُ الْعَذَابُ مِنْ حَيْثُ لَا يَشْعُرُونَ
📘 যারা জঘন্য ষড়যন্ত্র করে, তারা কি এ বিষয়ে নিশ্চিত আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে ভূগর্ভে ধসিয়ে দেবেন না অথবা এমন দিক হতে শাস্তি আসবে না, যার তারা টেরও পাবে না?
أَوْ يَأْخُذَهُمْ فِي تَقَلُّبِهِمْ فَمَا هُمْ بِمُعْجِزِينَ
📘 অথবা চলাফেরা করতে থাকাকালে তিনি তাদেরকে পাকড়াও করবেন না; [১] অতঃপর তারা তা ব্যর্থ করতে পারবে না?
[১] 'চলাফেরা করতে থাকাকালে'র কয়েকটি অর্থ হতে পারে। যেমন একঃ যখন তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাইরে যাও। দুইঃ যখন তোমরা ব্যবসার উন্নতিকল্পে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন কর। তিনঃ রাত্রে আরাম করার জন্য বিছানায় যাও। এগুলি تقلب এর বিভিন্ন অর্থ। আল্লাহ যখন চাইবেন, যে কোন অবস্থাতেই তোমাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন।
أَوْ يَأْخُذَهُمْ عَلَىٰ تَخَوُّفٍ فَإِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ
📘 অথবা তাদেরকে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় পাকড়াও করবেন না?[১] তোমাদের প্রতিপালক তো অবশ্যই অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু। [২]
[১] تخوف এর এ অর্থও হতে পারে যে, পূর্ব থেকেই অন্তরে আযাব ও পাকড়াও-এর ভয় বিদ্যমান থাকে। যেমন কোন সময় মানুষ বড় ধরনের কোন পাপ করে ফেলে, অতঃপর সে ভয় করে যে, যেন আল্লাহ আমাকে ধরে না ফেলেন। কোন কোন সময় এ ধরনের পাকড়াও হয়ে থাকে।
[২] তিনি পাপের পর পরই ধরে ফেলেন না; বরং অবকাশ দেন। আর এই অবকাশে অধিকাংশ মানুষ তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ লাভ করে থাকে।
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ يَتَفَيَّأُ ظِلَالُهُ عَنِ الْيَمِينِ وَالشَّمَائِلِ سُجَّدًا لِلَّهِ وَهُمْ دَاخِرُونَ
📘 তারা কি লক্ষ্য করে না আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর প্রতি, যার ছায়া বিনীতভাবে আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয়ে ডানে ও বামে ঢলে পড়ে? [১]
[১] এখানে আল্লাহর বড়ত্ত্ব, মহত্ত ও মর্যাদার উল্লেখ হচ্ছে যে, প্রত্যেক জিনিসই তাঁর সামনে অবনত-মস্তক। জড়পদার্থ হোক বা জীবজন্তু, জীন হোক বা মানুষ বা ফিরিশতা। প্রত্যেক ছায়াবিশিষ্ট বস্তু যখন তার ছায়া ডানে বামে ঢলে পড়ে, তখন সকাল-সন্ধ্যায় সে বস্তু নিজ ছায়ার সঙ্গে আল্লাহকে সিজদা করে। ইমাম মুজাহিদ বলেন, যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে, তখন প্রত্যেকটি জিনিস আল্লাহর সামনে সিজদাবনত হয়।
وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ دَابَّةٍ وَالْمَلَائِكَةُ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ
📘 আল্লাহকেই সিজদা করে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল জীব-জন্তু এবং ফিরিশতাগণও। আর তারা অহংকার করে না।
وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا ۗ لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ
📘 তিনি চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন; তোমাদের জন্য ওতে শীত নিবারক উপকরণ ও বহু উপকার রয়েছে;[১] আর তা হতে তোমরা আহার্য পেয়ে থাক।
[১] মহান আল্লাহ উক্ত অনুগ্রহের সাথে অন্য এক অনুগ্রহের কথা ব্যক্ত করছেন যে, চতুষ্পদ জন্তু (উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি) তিনিই সৃষ্টি করেছেন, যার লোম ও পশম হতে তোমরা গরম কাপড় তৈরী করে নিজেদেরকে শীত থেকে রক্ষা কর। অনুরূপ তাদের মাধ্যমে অন্যান্য উপকারও লাভ করে থাক, যেমন তাদের দুধ পান করা, তাদেরকে বাহনরূপে ব্যবহার করা, তাদের মাধ্যমে মালপত্র বহন করা, চাষ করা ইত্যাদি।
يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ۩
📘 তারা ভয় করে তাদের উপরে তাদের প্রতিপালককে[১] এবং তারা তা করে, যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। [২] (সাজদাহ-৩)
[১] আল্লাহর ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকে।[২] আল্লাহর আদেশের অন্যথা করে না বরং যা আদেশ করা হয়, তারা তাই করে। আর যা থেকে নিষেধ করা হয়, তা থেকে তারা দূরে থাকে। (এই আয়াত পাঠ করার পর সিজদা করা মুস্তাহাব। সিজদার আহকাম জানতে সূরা আ'রাফের শেষ আয়াতের ৭:২০৬ টীকা দেখুন।)
۞ وَقَالَ اللَّهُ لَا تَتَّخِذُوا إِلَٰهَيْنِ اثْنَيْنِ ۖ إِنَّمَا هُوَ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ فَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ
📘 আল্লাহ বললেন, তোমরা দুইজন উপাস্য গ্রহণ কর না; তিনিই তো একমাত্র উপাস্য।[১] সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় কর।
[১] কারণ আল্লাহ ছাড়া কোন (সত্যিকার) উপাস্যই নেই। যদি পৃথিবী ও আকাশে দুই উপাস্য থাকত, তাহলে বিশ্ব-জাহানের নিয়ম-শৃঙ্খলা লন্ডভন্ড হয়ে যেত এবং উভয়ই ধ্বংসের শিকার হত।
{لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا} (سورة الأنبياء : ২২) এই কারণে দুই ঈশ্বরে বিশ্বাস যা অগ্নিপূজকদের মতবাদ বা বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস যা অধিকাংশ মুশরিকদের ধারণা; এই সকল বিশ্বাসই ভ্রান্ত ও বাতিল। পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা যখন এক, তিনিই যখন বিনা কারো অংশিদারিত্বে পৃথিবীর সব কিছু পরিচালনা করেন, তখন উপাসনার যোগ্যও একমাত্র তিনিই। যিনি একক, দুই বা দুয়ের অধিক নয়।
وَلَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَهُ الدِّينُ وَاصِبًا ۚ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَتَّقُونَ
📘 আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সেসব তো তাঁরই এবং নিরবচ্ছিন্ন আনুগত্য তাঁরই প্রাপ্য;[১] তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ভয় করবে?
[১] তাঁরই নিরবচ্ছিন্ন ইবাদত ও আনুগত্য আবশ্যকীয়। واصب এর অর্থ অবিরাম। যেমন অন্যত্র এসেছে,{وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ} তাদের জন্য রয়েছে অবিরাম আযাব।
(সূরা সাফফাত ৩৭:৯)
আর আয়াতের মর্মার্থ তাই, যা অন্যত্র বলা হয়েছে,{فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ، أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ} সুতরাং আল্লাহর ইবাদত কর তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। জেনে রেখো, খাঁটি আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য।
(সূরা যুমার ৩৯:২-৩)
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ۖ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ
📘 তোমাদের মাঝে যেসব সম্পদ রয়েছে তা তো আল্লাহরই নিকট হতে;[১] আবার যখন দুঃখ-দৈন্য তোমাদেরকে স্পর্শ করে, তখন তোমরা তাঁকেই ব্যাকুলভাবে আহবান কর। [২]
[১] যখন সমস্ত নিয়ামত ও সম্পদ দাতা একমাত্র আল্লাহ, তখন ইবাদত অন্যের কোন দাবিতে?
[২] এর অর্থ এই যে, তারা যখন চতুর্দিক থেকে নিরাশ হয়ে পড়ে, তখন তাদের অন্তরের অন্তস্তলে লুকিয়ে থাকা আল্লাহর বিশ্বাস তাদের সামনে এসে পড়ে।
ثُمَّ إِذَا كَشَفَ الضُّرَّ عَنْكُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْكُمْ بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ
📘 আবার যখন আল্লাহ তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূরীভূত করেন, তখন তোমাদের একদল তাদের প্রতিপালকের সাথে অংশী করে।
لِيَكْفُرُوا بِمَا آتَيْنَاهُمْ ۚ فَتَمَتَّعُوا ۖ فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ
📘 যাতে আমি তাদেরকে যা দান করেছি তা অস্বীকার করে;[১] সুতরাং তোমরা ভোগ করে নাও, অচিরেই জানতে পারবে। [২]
[১] কিন্তু মানুষ এতই অকৃতজ্ঞ যে, দুঃখ-কষ্ট (অসুখ, দরিদ্রতা, ক্ষতি ইত্যাদি) দূর হলেই আবার আল্লাহর সাথে শিরক করতে শুরু করে।[২] এটি অনুরূপ যেমন পূর্বে বলেছেন,{قُلْ تَمَتَّعُواْ فَإِنَّ مَصِيرَكُمْ إِلَى النَّارِ} তুমি বল, ভোগ করে নাও, পরিণামে জাহান্নামই তোমাদের ঠিকানা।
(সূরা ইবরাহীম ১৪:৩০)
وَيَجْعَلُونَ لِمَا لَا يَعْلَمُونَ نَصِيبًا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ ۗ تَاللَّهِ لَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَفْتَرُونَ
📘 আমি তাদেরকে যে জীবিকা দান করি, তারা তার এক অংশ নির্ধারিত করে তাদের (বাতিল উপাস্যদের) জন্য, যাদের সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না।[১] শপথ আল্লাহর! তোমরা যে মিথ্যা উদ্ভাবন কর, সে সম্বন্ধে তোমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে। [২]
[১] অর্থাৎ, যাদেরকে এরা বিপত্তারণ, সমস্যা দূরকারী, মা'বুদ মনে করে তারা তো মাটি বা পাথরের মূর্তি, জীন বা শয়তান, তাদের প্রকৃতত্বের জ্ঞান তাদের নেই। অনুরূপ কবরে শায়িত ব্যক্তির প্রকৃতত্বও কারো জানা নয় যে, তার সাথে কবরে কি আচরণ করা হচ্ছে? সে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকাভুক্ত, নাকি অপ্রিয় বান্দাদের? এ সব কথা কেউ জানে না। কিন্তু এই যালেমরা তাদের প্রকৃতত্ব না জানা সত্ত্বেও (কেবল ধারণাবশে ঐশ্বরিক মর্যাদা দিয়ে) তাদেরকে আল্লাহর শরীক করে রেখেছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের (নযর-নিয়াযের মাধ্যমে) কিছু অংশ তাদের জন্য ধার্য করে থাকে। বরং আল্লাহর অংশ বাকী থাকলে অসুবিধা নাই; কিন্তু তাদের অংশ কম করা চলবে না। যেমন সূরা আনআমের ৬:১৩৬ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[২] তোমরা আল্লাহর উপরে যে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ যে, তাঁর এক বা একাধিক শরীক আছে --এ সম্পর্কে তোমরা কিয়ামতে জিজ্ঞাসিত হবে।
وَيَجْعَلُونَ لِلَّهِ الْبَنَاتِ سُبْحَانَهُ ۙ وَلَهُمْ مَا يَشْتَهُونَ
📘 তারা নির্ধারিত করে আল্লাহর জন্য কন্যা-সন্তান অথচ তিনি পবিত্র; আর তাদের জন্য তাই যা তারা কামনা করে! [১]
[১] আরবের কয়েকটি গোত্র (খুযাআহ ও কিনানাহ) ফিরিশতার ইবাদত করত এবং তারা বলত, ফিরিশতারা আল্লাহর কন্যা। তাদের প্রথম অপরাধ হল, তারা আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করল; যদিও তাঁর কোন সন্তান নেই। আর করল তা আবার কন্যা সন্তান, যা তারা নিজেরাই পছন্দ করত না, তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করল। যেটিকে অন্যত্র এভাবে বলেছেন,{أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنثَى، تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيزَى} পুত্র সন্তান কি তোমাদের জন্য, আর কন্যা সন্তান তাঁর জন্য? এই প্রকার বণ্টন তো অসঙ্গত।
(সূরা নাজম ৫৩:২১-২২)
এখানে বললেন, তোমাদের কামনা পুত্রই হোক, কন্যা একটিও না হোক।
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ
📘 তাদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কাল হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়।
يَتَوَارَىٰ مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ ۚ أَيُمْسِكُهُ عَلَىٰ هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ ۗ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
📘 তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে। সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে, তা কতই না নিকৃষ্ট। [১]
[১] কন্যা জন্মের সংবাদ শুনে তাদের এই অবস্থা হয়, যা বর্ণিত হয়েছে, অথচ আল্লাহর জন্য তারা কন্যা নির্ধারণ করে। তাদের সিদ্ধান্ত কতই না অসঙ্গত। অবশ্য এখানে এটা ভাবা উচিত নয় যে, মহান আল্লাহও পুত্রের তুলনায় কন্যাকে তুচ্ছ মনে করেন। না, আল্লাহর নিকট পুত্র-কন্যার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, আর না লিঙ্গ বা জাতিভেদের দিক দিয়ে তুচ্ছ বা মর্যাদাসম্পন্ন করার কোন ব্যাপার আছে। এখানে শুধুমাত্র আরবদের একটি অন্যায় ও গর্হিত রীতিকে স্পষ্ট করাই আসল উদ্দেশ্য। যা তারা আল্লাহর ব্যাপারে পোষণ করত; যদিও তারাও আল্লাহর সম্মান ও বড়ত্ত্বকে স্বীকার করত। যার যুক্তিসঙ্গত ফল এই ছিল যে, যে জিনিস তারা নিজেদের জন্য পছন্দ করে না, সেটিকে আল্লাহর জন্যও নির্ধারণ করবে না। কিন্তু তারা তার বিপরীত করল। এখানে শুধু এই অন্যায় আচরণকেই স্পষ্ট করা হয়েছে।
وَلَكُمْ فِيهَا جَمَالٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُونَ
📘 আর যখন তোমরা সন্ধ্যায় ওদেরকে চারণভূমি হতে গৃহে নিয়ে আস এবং প্রভাতে যখন ওদেরকে চারণ ভূমিতে নিয়ে যাও, তখন তোমরা ওর সৌন্দর্য উপভোগ কর। [১]
[১] تريحون যখন সন্ধ্যায় চারণভূমি থেকে বাড়িতে নিয়ে এসো, تسرحون যখন সকালে চারণ ভূমিতে নিয়ে যাও। এই দুই সময় তারা মানুষের চোখে পড়ে, যাতে তোমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। উক্ত দুই সময় ছাড়া তারা দৃষ্টির আড়ালে থাকে বা আস্তাবলে বদ্ধ থাকে।
لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ مَثَلُ السَّوْءِ ۖ وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
📘 যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের জন্য নিকৃষ্ট গুণ।[১] আর আল্লাহর জন্য রয়েছে উৎকৃষ্টতম গুণ এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।[২]
[১] অর্থাৎ, যে কাফেরদের অসৎ কর্ম বর্ণিত হল, তাদের জন্যই নিকৃষ্ট উদাহরণ বা অসদগুণ, অর্থাৎ অজ্ঞতা ও কুফরীর খারাপ গুণ। অথবা এর অর্থ এই যে, আল্লাহর জন্য স্ত্রী ও সন্তান স্থির করা নিকৃষ্ট উদাহরণ, যা পরকালে অবিশ্বাসীরা আল্লাহর জন্য ব্যক্ত করে।
[২] অর্থাৎ, তাঁর প্রত্যেক গুণ সৃষ্টির গুণের তুলনায় মহত্তর। যেমন তাঁর জ্ঞান অপরিসীম, তাঁর শক্তি অতুলনীয়, তাঁর দানশীলতা দৃষ্টান্তবিহীন, অনুরূপ সকল গুণাবলী। অথবা এর অর্থ হল, তিনি শক্তিশালী, সৃষ্টিকর্তা, রুযীদাতা, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ইত্যাদি (তিনি সর্বগুণনিধি।)
(ফাতহুল কাদীর)
অথবা নিকৃষ্ট উপমা বলতে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসম্পূর্ণতা, আর উৎকৃষ্টতম উপমা বলতে সর্বতোমুখী পরিপূর্ণতা সর্বদিক দিয়ে আল্লাহর জন্যই।
(ইবনে কাসীর)
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَٰكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى ۖ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
📘 আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালংঘনের জন্য শাস্তি দিতেন, তাহলে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না,[১] কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন;[২] অতঃপর যখন তাদের সময় আসে, তখন তারা মুহূর্তকালও বিলম্ব অথবা অগ্রগামী করতে পারে না।
[১] এটি মহান আল্লাহর সহনশীলতা এবং তাঁর হিকমত ও সুকৌশলের দাবী যে, তিনি পাপ করতে দেখেও নিজ অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেন না অথবা সত্ত্বর পাকড়াও করেন না। পক্ষান্তরে যদি তিনি পাপ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও শুরু করেন, তাহলে যুলুম, পাপ, কুফরী ও শিরক পৃথিবীতে এত ব্যাপক হয়ে গেছে যে, কোন জীবই অবশিষ্ট থাকত না। কারণ যখন পাপ ব্যাপক হয়ে পড়ে, তখন আযাবে সৎ লোকদেরকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তবে তারা পরকালে আল্লাহর নিকট পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
(দ্রঃ বুখারী ২১১৮, মুসলিম ২২০৬, ২২১০নং)
[২] এটি সেই হিকমত ও যৌক্তিকতার বিবরণ, যার কারণে এক বিশেষ সময় পর্যন্ত অপরাধীকে অবকাশ দেওয়া হয়, প্রথমতঃ যাতে তাদের কোন ওযর-আপত্তি না থেকে যায়। আর দ্বিতীয়তঃ যাতে তাদের সন্তানদের মধ্যে কিছু ঈমানদার ও সৎশীল হতে পারে।
وَيَجْعَلُونَ لِلَّهِ مَا يَكْرَهُونَ وَتَصِفُ أَلْسِنَتُهُمُ الْكَذِبَ أَنَّ لَهُمُ الْحُسْنَىٰ ۖ لَا جَرَمَ أَنَّ لَهُمُ النَّارَ وَأَنَّهُمْ مُفْرَطُونَ
📘 যা তারা অপছন্দ করে তাই তারা আল্লাহর প্রতি আরোপ করে;[১] তাদের জিহ্বা মিথ্যা বর্ণনা করে (বলে) যে, ‘মঙ্গল তাদেরই জন্য।’[২] স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, নিশ্চয়ই তাদের জন্য আছে দোযখ এবং তারাই সর্বাগ্রে তাতে নিক্ষিপ্ত হবে। [৩]
[১] অর্থাৎ, কন্যা-সন্তান। আর এ পুনরাবৃত্তি তাকীদের জন্য।
[২] এটি তাদের অন্য এক দুষ্কর্মের বর্ণনা যে, তারা আল্লাহর সাথে অন্যায় আচরণ করে। তারা মিথ্যা বলে যে, তাদের পরিণাম হবে উত্তম, তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ এবং ইহকালের মত তাদের পরকালও হবে মঙ্গলময়।
[৩] অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে তাদের পরিণাম হবে 'উত্তম' আর তা হল জাহান্নামের আগুন। জাহান্নামে তারাই হবে অগ্রগামী। فرط এর এই অর্থই হাদীসে প্রমাণিত। নবী (সাঃ) বলেছেন أنا فرطكم على الحوض অর্থাৎ, আমি হাওযে কাওসারে তোমাদের অগ্রবর্তী হব।
(বুখারী ৬৫৮৪, মুসলিম ১৭৯৩নং)
مفرطون এর অন্য এক অর্থ এই করা হয়েছে 'বিস্মৃত', অর্থাৎ, জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পর তাদেরকে ভুলে যাওয়া হবে।
تَاللَّهِ لَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَىٰ أُمَمٍ مِنْ قَبْلِكَ فَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَهُوَ وَلِيُّهُمُ الْيَوْمَ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
📘 শপথ আল্লাহর! আমি তোমার পূর্বেও বহু জাতির নিকট রসূল প্রেরণ করেছি; কিন্তু শয়তান ঐ সব জাতির কার্যকলাপ তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল;[১] সুতরাং সে আজও তাদের অভিভাবক[২] এবং তাদেরই জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি।
[১] যার কারণে তারা নবীদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল; যেমন হে নবী! তোমাকে কুরাইশরা মিথ্যাজ্ঞান করছে।
[২] اليوم (আজ) বলতে পার্থিব সময়কে বুঝানো হয়েছে। যেমন অনুবাদে তা সুস্পষ্ট। অথবা 'আজ' বলতে পরকাল বুঝানো হয়েছে। কারণ সেখানেও সে তাদের অভিভাবক ও সঙ্গী হবে। وليهم এর هم (তাদের) বলতে মক্কার কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ শয়তান যেমন পূর্বের জাতিসমূহকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তেমনি আজও সে মক্কার কাফেরদের বন্ধু, যে তাদেরকে রিসালতকে মিথ্যা ভাবতে বাধ্য করছে।
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ ۙ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
📘 আমি তো তোমার প্রতি গ্রন্থ এ জন্যই অবতীর্ণ করেছি; যাতে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তাদেরকে তুমি তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পার[১] এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া স্বরূপ।
[১] এতে নবী (সাঃ)-এর দায়িত্ব বিবৃত হয়েছে যে, বিশ্বাস ও শরীয়তের বিধি-বিধানের ব্যাপারে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের মাঝে, অনুরূপ অগ্নিপূজক ও মুশরিকদের মাঝে এবং অনান্য ধর্মাবলম্বী লোকেদের মাঝে যে সব মতপার্থক্য রয়েছে, তা এমনভাবে আলোচনা কর, যাতে ন্যায়-অন্যায় ও হক-বাতিল স্পষ্ট হয়ে যায়। যাতে মানুষ হককে গ্রহণ করতে ও বাতিলকে বর্জন করতে পারে।
وَاللَّهُ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَسْمَعُونَ
📘 আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। অতঃপর তার দ্বারা তিনি ভূমিকে ওর মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন; অবশ্যই এতে নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা শ্রবণ করে।
وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً ۖ نُسْقِيكُمْ مِمَّا فِي بُطُونِهِ مِنْ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَبَنًا خَالِصًا سَائِغًا لِلشَّارِبِينَ
📘 অবশ্যই (গৃহপালিত) চতুষ্পদ জন্তুর[১] মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে; ওগুলির উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য হতে তোমাদেরকে আমি পান করাই বিশুদ্ধ দুধ; যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।[২]
[১] أنعام (গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু) বলতে উট, গরু, ছাগল ও ভেঁড়াকে বুঝানো হয়েছে।
[২] এই চতুষ্পদ জন্তুরা যা কিছু খায় তা পেটে যায়, আর তা থেকে দুধ, রক্ত, গোবর ও প্রস্রাব তৈরী হয়। রক্ত শিরা-উপশিরায়, দুধ স্তনে, অনুরূপ গোবর ও প্রস্রাব নিজ নিজ জায়গায় পৌঁছে যায়। দুধে না রক্তের মিশ্রণ থাকে, আর না গোবর ও প্রস্রাবের দুর্গন্ধ; বরং তা নির্মল সাদা ও পরিষ্কার হয়ে বের হয় এবং তা পানকারীর জন্য হয় সুস্বাদু।
وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
📘 আর খেজুর ও আঙ্গুর ফল হতে তোমরা মদ[১] ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক, এতে অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।
[১] এই আয়াত তখন অবতীর্ণ হয় যখন মদ হারাম হয়নি, সেই জন্য হালাল (পবিত্র) জিনিসের সাথে তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এতে سكرا এর পর رزقا حسنا এসেছে যার মধ্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে মদ উত্তম খাদ্য নয়। তাছাড়া এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। যার মধ্যে মদ অপছন্দনীয় পানীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে মদীনায় অবতীর্ণ সূরাগুলিতে ধীরে ধীরে তা হারাম করা হয়েছে।
وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ
📘 তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে প্রত্যাদেশ[১] করেছেন যে, তুমি গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।
[১]وحي থেকে এখানে ইলহাম (অন্তরে প্রক্ষেপণ) বা এমন জ্ঞান-বুদ্ধি যা নিজ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্য প্রত্যেক জীবকে দান করা হয়েছে।
ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا ۚ يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
📘 এরপর প্রত্যেক ফল হতে আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ কর;[১] ওর উদর হতে নির্গত হয় নানা রঙের পানীয়;[২] যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগমুক্তি।[৩] অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
[১] মৌমাছি প্রথমে পাহাড়ে, গাছে, মানুষের ঘরের উঁচু ছাদে এমনভাবে মৌচাক তৈরী করে যে, মাঝে কোথাও ফাঁক থাকে না। তারপর বাগান, জঙ্গল, পাহাড় ও উপত্যকায় (অনুরূপ ফুলে ভরা শস্যক্ষেতে) ঘুরে বেড়ায় এবং প্রত্যেক ফুল-ফলের মধু ও রস আহরণ করে পেটে জমা করে। আর যে রাস্তায় যায় সেই রাস্তায় ফিরে এসে মৌচাকে গিয়ে বসে। যেখানে তার মুখ দিয়ে মধু উগরে দেয়, যাকে মহান আল্লাহ পানীয় বলে উল্লেখ করেছেন।
[২] লাল, সাদা, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের। যে ধরনের ফুল-ফল ও ক্ষেত থেকে তারা মধু সংগ্রহ করে, সেই হিসাবে তার রঙ ও স্বাদ বিভিন্ন হয়ে থাকে।
[৩] شفاء (রোগমুক্তি) অনির্দিষ্ট বাহুল্য বর্ণনার জন্য। অর্থাৎ, মধুতে বহু রোগের আরোগ্য রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, এটি সকল রোগের ঔষধ। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, মধু অবশ্যই আরোগ্য দানকারী আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক এক পানীয়, তবে বিশেষ বিশেষ রোগের জন্য; সকল রোগের জন্য নয়। হাদীসে বর্ণিত, নবী (সাঃ) মিষ্টি জিনিস ও মধু পছন্দ করতেন। (বুখারীঃ পানীয় অধ্যায়) অন্য এক বর্ণনায় আছে তিনি (সাঃ) বলেছেন, "তিনটি জিনিসে আরোগ্য রয়েছে; শিঙ্গা লাগানোতে, মধু পান করাতে ও দাগানোতে। তবে আমি আমার উম্মতকে দাগাতে নিষেধ করছি।" (বুখারীঃ মধু দ্বারা চিকিৎসা পরিচ্ছেদ) হাদীসে একটি ঘটনাও এসেছে। নবী (সাঃ) পাতলা পায়খানার এক রোগীকে মধু পান করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তাতে তার রোগ আরো বেড়ে গেল। তিনি দ্বিতীয়বার আবার মধু পান করার পরামর্শ দিলেন। যাতে রোগীর পুরাতন মল বেরিয়ে আসতে লাগল। রোগীর বাড়ির লোকেরা ভাবল যে, রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার এক ভাই আবার নবী (সাঃ)-এর নিকট এল। তখন তিনি বললেন, "আল্লাহ সত্য, তোমার ভায়ের পেট মিথ্যা। যাও, তাকে আবারো মধু পান করাও।" অতঃপর তৃতীয়বার মধু পান করালে সে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
(বুখারী, মুসলিম)
وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَىٰ بَلَدٍ لَمْ تَكُونُوا بَالِغِيهِ إِلَّا بِشِقِّ الْأَنْفُسِ ۚ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ
📘 আর ওরা তোমাদের ভার বহন করে নিয়ে যায় দূর দেশে; যেথায় প্রাণান্তকর কষ্ট ব্যতীত তোমরা পৌঁছতে পারতে না; তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই চরম স্নেহশীল, পরম দয়ালু।
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ ثُمَّ يَتَوَفَّاكُمْ ۚ وَمِنْكُمْ مَنْ يُرَدُّ إِلَىٰ أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْ لَا يَعْلَمَ بَعْدَ عِلْمٍ شَيْئًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ قَدِيرٌ
📘 আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে উপনীত করা হয় নিকৃষ্টতম বয়সে; ফলে সে যা কিছু জানত সে সম্বন্ধে সজ্ঞান থাকে না;[১] আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।
[১] যখন মানুষের স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যায়, তখন তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন কি কখনো কখনো স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পায়, ফলে সে এক শিশুতে পরিণত হয়। এটিই হল أرذل العمر (স্থবিরতা) যা হতে নবী (সাঃ)ও আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
وَاللَّهُ فَضَّلَ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ فِي الرِّزْقِ ۚ فَمَا الَّذِينَ فُضِّلُوا بِرَادِّي رِزْقِهِمْ عَلَىٰ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَهُمْ فِيهِ سَوَاءٌ ۚ أَفَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ
📘 আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ হতে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়; [১] তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করে? [২]
[১] যখন তোমরা নিজ দাসদেরকে এত সম্পদ ও জীবনোপকরণ দাও না, যাতে তারা তোমাদের সমান হয়ে যায়, তখন আল্লাহ কিভাবে পছন্দ করতে পারেন যে, তাঁরই কিছু দাসকে তাঁর শরীক করে তাঁর সমতুল্য করে দাও। এই আয়াতে এটিও প্রমাণিত হল যে, আর্থিক বিষয়ে মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়, তা আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসারী। পৃথিবীর কোন মানব-রচিত সংবিধান তাকে আইনের বলে দূর করতে পারে না, যেমন সমাজতন্ত্রে তা বিদ্যমান। জীবিকা বন্টনের সমতা প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপচেষ্টা না করে বরং প্রত্যেককেই জীবিকা সন্ধানের সমান সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
[২] আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ হতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে নযর-নিয়ায বের করে, আর এভাবে তারা আল্লাহর (নিয়ামতের) অনুগ্রহের অকৃতজ্ঞতা করে।
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ۚ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُونَ وَبِنِعْمَتِ اللَّهِ هُمْ يَكْفُرُونَ
📘 আর আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের যুগল হতে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্র সৃষ্টি করেছেন এবং উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন; তবুও কি তারা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে[১] এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?
[১] অর্থাৎ, মহান আল্লাহ আয়াতে বর্ণিত নিজ নিয়ামতের কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন যে, সব কিছুর দাতা মহান আল্লাহ; কিন্তু তবুও কি তারা তাঁকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করবে ও অন্যের কথাই মানবে?
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَمْلِكُ لَهُمْ رِزْقًا مِنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ شَيْئًا وَلَا يَسْتَطِيعُونَ
📘 তারা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা করে, তারা তাদের জন্য আকাশমন্ডলী অথবা পৃথিবী হতে কোন জীবনোপকরণ সরবরাহ করার শক্তি রাখে না এবং তারা কিছুই করতে সক্ষম নয়। [১]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহকে ছেড়ে তারা এমন কিছুর ইবাদত করে, যাদের কোন জিনিসের উপর কোন ক্ষমতাই নেই।
فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
📘 সুতরাং তোমরা আল্লাহর সদৃশাবলী স্থির করো না।[১] নিশ্চয় আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।
[১] যেমন, মুশরিকরা উদাহরণ দিয়ে থাকে যে, যদি রাজার সাথে সাক্ষাৎ করতে হয় বা তাঁর নিকট থেকে কোন কাজ নিতে হয়, তাহলে রাজার নিকট সরাসরি যাওয়া যায় না; বরং তাঁর নিকটতম লোকেদের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ করতে হয়, (উকিল ধরতে হয়,) তবেই রাজার নিকট পৌছনো সম্ভব হয়। অনুরূপ আল্লাহ অত্যন্ত মহান ও বিশাল রাজা। তাঁর নিকট পৌছনোর জন্য আমরা এই সব উপাস্যদের উপাসনা করি বা বুযুর্গদেরকে অসীলা ও মাধ্যমরূপে ব্যবহার করি। মহান আল্লাহ এর উত্তরে বলেন, তোমরা আল্লাহকে নিজেদের উপর অনুমান করো না এবং তাঁর জন্য কোন উপমা, দৃষ্টান্ত বা সদৃশ পেশ করো না। কারণ তিনি অনুপম; তাঁর কোন উপমা নেই। তিনি একক; তাঁর কোন সদৃশ নেই। তারপর মানুষ রাজা না গায়বী খবর জানে, আর না সে সব সময় সবার নিকট উপস্থিত, না সে সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা যে, বিনা কোন মাধ্যমে প্রজাদের অবস্থা ও তাদের প্রয়োজন জানতে সক্ষম। অন্যথা মহান আল্লাহ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, দৃশ্য-অদৃশ্য প্রত্যেক বস্তুর খবর রাখেন। রাত্রির অন্ধকারে সংঘটিত কর্মও তিনি দেখতে পান। প্রত্যেকের অভাব-অভিযোগও জানতে-শুনতে সক্ষম। অতএব কিভাবে একজন পার্থিব রাজা ও শাসকের সাথে মহান রাজা আল্লাহর তুলনা ও সাদৃশ্য হতে পারে?
۞ ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا عَبْدًا مَمْلُوكًا لَا يَقْدِرُ عَلَىٰ شَيْءٍ وَمَنْ رَزَقْنَاهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا فَهُوَ يُنْفِقُ مِنْهُ سِرًّا وَجَهْرًا ۖ هَلْ يَسْتَوُونَ ۚ الْحَمْدُ لِلَّهِ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
📘 আল্লাহ উপমা দিচ্ছেন অপরের অধিকারভুক্ত এক দাসের যে কোন কিছুর উপর শক্তি রাখে না এবং এমন এক ব্যক্তির যাকে আমি নিজের পক্ষ হতে উত্তম জীবিকা দান করেছি এবং সে তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে; তারা কি একে অপরের সমান?[১] সকল প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।
[১] কেউ কেউ বলেন, এটি পরাধীন দাস ও স্বাধীন মানুষের উপমা; প্রথমজন দাস ও দ্বিতীয়জন স্বাধীন। এরা দুজনই সমান নয়। আবার কেউ বলেন, এটি মু'মিন ও কাফেরের উপমা; প্রথমটি কাফের আর দ্বিতীয়টি মু'মিনের। এরাও সমান নয়। কেউ বলেন, এটি আল্লাহ ও গায়রুল্লাহ (দেবদেবীর) উদাহরণ; প্রথমটিতে আল্লাহ ও দ্বিতীয়টিতে দেবদেবীকে বুঝানো হয়েছে। এরা পরস্পর সমান নয়। অর্থ এই যে, একজন দাস ও অপরজন স্বাধীন; যদিও তারা দু'জনই মানুষ, দু'জনই আল্লাহর সৃষ্ট, অনেক জিনিস দু'জনের মধ্যে সমানভাবে বিদ্যমান, তা সত্ত্বেও মর্যাদা ও সম্মানে তাদেরকে তোমরা সমান সমান মনে কর না। তাহলে মহান আল্লাহ ও পাথরের মূর্তি বা কবর কিভাবে সমান হতে পারে?
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلَيْنِ أَحَدُهُمَا أَبْكَمُ لَا يَقْدِرُ عَلَىٰ شَيْءٍ وَهُوَ كَلٌّ عَلَىٰ مَوْلَاهُ أَيْنَمَا يُوَجِّهْهُ لَا يَأْتِ بِخَيْرٍ ۖ هَلْ يَسْتَوِي هُوَ وَمَنْ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ ۙ وَهُوَ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
📘 আল্লাহ আরো উপমা দিচ্ছেন দুই ব্যক্তির;[১] ওদের একজন বোবা, সে কোন কিছুরই শক্তি রাখে না এবং সে তার প্রভুর উপর বোঝা স্বরূপ; তাকে যেখানেই পাঠানো হোক না কেন, সে ভাল কিছুই করে আসতে পারে না; সে কি সমান হবে ঐ ব্যক্তির যে ন্যায়ের নির্দেশ দেয়[২] এবং যে আছে সরল পথে?
[১] এটি আরো একটি উপমা যা প্রথমটির চেয়ে স্পষ্টতর।
[২] আর প্রত্যেক কাজে সক্ষম। কেননা, সে সব কথা বলতে ও বুঝতে পারে এবং সে সরল পথে চলমান। অর্থাৎ এমন রাস্তায় চলে যাতে কোন অতিরঞ্জন, গোঁড়ামি ও বাড়াবাড়ি নেই। যেমন তাতে কোন প্রকার বক্রতা, অবহেলা ও ত্রুটিও নেই। এই ব্যক্তি এবং সেই ব্যক্তি যে বোবা, যে কোন কিছুরই শক্তি রাখে না এবং যে তার প্রভুর উপর বোঝা স্বরূপ, যেরূপ এরা উভয়ে এক সমান নয়, অনুরূপ মহান আল্লাহ এবং যাদেরকে এরা তাঁর সাথে শরীক করে, তারাও সমান নয়।
وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلَّا كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
📘 আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহরই[১] এবং কিয়ামতের ব্যাপার তো চক্ষুর পলকের ন্যায়; বরং তার চেয়েও সত্বর। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।[২]
[১] অর্থাৎ, আকাশ ও পৃথিবীতে অসংখ্য অদৃশ্য ও গায়বী জিনিস ও জ্ঞান আছে, যার মধ্যে কিয়ামত কখন হবে তার জ্ঞান অন্যতম। এ সকলের জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। এই কারণে ইবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই, ঐ সব মূর্তিরা বা মৃত ব্যক্তিরা নয়, যাদের কোন জ্ঞানই নেই এবং কারো লাভ-ক্ষতি করার ক্ষমতাও নেই।
[২] মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ ক্ষমতার একটি প্রমাণ যে, এত বিশাল পৃথিবী তাঁর আদেশে চোখের পলকে বা তার চেয়েও কম সময়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি অতিরঞ্জিত কথা নয়; বরং বাস্তব সত্য। কারণ তাঁর ক্ষমতা অপরিসীম। যার অনুমান আমরা করতেই পারি না। তিনি যা চান كُن (হও) শব্দ দিয়ে তা হয়ে যায়। কিয়ামতও তাঁর كُن বলাতেই সংঘটিত হবে।
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ ۙ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
📘 আর আল্লাহ তোমাদেরকে নির্গত করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না[১] এবং তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়; [২] যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [৩]
[১] شيئا অনির্দিষ্ট। অর্থাৎ, তোমরা কিছুই জানতে না। না ভাল-মন্দ, আর না লাভ-নোকসান।
[২] যাতে কান দ্বারা তোমরা শব্দ শুনতে পারো, চোখ দ্বারা সকল জিনিস দেখতে পারো। আর অন্তর অর্থাৎ, জ্ঞান (কেননা অন্তর জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল) দান করেছেন, যাতে নানা জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে পারো, লাভ-ক্ষতি বুঝতে পারো। মানুষ ধীরে ধীরে যত বড় হয়, তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও শক্তি বাড়তে থাকে। এমন কি যখন সে পূর্ণ বয়সে (পূর্ণ যৌবনে) পদার্পণ করে, তখন তার ঐ সকল শক্তিও পরিপূর্ণতা লাভ করে।
[৩] এই সকল শক্তি মহান আল্লাহ এই জন্য দান করেছেন, যাতে মানুষ এই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনভাবে ব্যবহার করবে, যাতে আল্লাহ খুশি হন। তা দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করবে। এটিই হল আল্লাহর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত, মহান আল্লাহ বলেন, "আমার বান্দা যে সব জিনিস দিয়ে আমার নৈকট্য লাভ করে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হল আমি যা তাদের উপর ফরয করেছি। তাছাড়া নফল ইবাদত দ্বারাও সে আমার অধিক নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হয়। পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করি। আর যখন আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে, তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে চাইলে তাকে দান করি, আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিই।" (বুখারীঃ কিতাবুর রিক্বাক) কিছু লোক এই হাদীসের ভুল অর্থ নিয়ে আল্লাহর অলীদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত শক্তির মালিক বলে মনে করে। অথচ হাদীসের স্পষ্ট অর্থ হল যে, যখন বান্দা আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে নিষ্ঠাবান হয়। তখন তার প্রতিটি কর্ম আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে। সে তার কান দিয়ে ঐ কথাই শোনে, চোখ দিয়ে ঐ জিনিসই দেখে, যাতে আল্লাহর অনুমতি আছে। যে জিনিস হাত দিয়ে ধরে বা যে পথে চলে, তা শরীয়ত সমর্থিত। আল্লাহর অবাধ্যতায় তা ব্যবহার করে না; বরং তা একমাত্র তাঁর আনুগত্যে ব্যবহার করে।
أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا اللَّهُ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
📘 তারা কি লক্ষ্য করে না আকাশের শূন্যগর্ভে নিয়ন্ত্রণাধীন পাখিদের প্রতি? আল্লাহই ওদেরকে স্থির রাখেন।[১] অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।
[১] তিনি তো আল্লাহই, যিনি পক্ষীকুলকে এভাবে উড়ার এবং বাতাসকে তাদের ভাসিয়ে রাখার শক্তি দান করেছেন।
وَالْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً ۚ وَيَخْلُقُ مَا لَا تَعْلَمُونَ
📘 তোমাদের আরোহণের জন্য ও শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা।[১] আর তিনি সৃষ্টি করেন এমন অনেক কিছু যা তোমরা অবগত নও। [২]
[১] অর্থাৎ, তাদের সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য ও উপকারিতা তাদেরকে বাহনরূপে ব্যবহার করা। তা সত্ত্বেও সেসব সৌন্দর্যের কারণও বটে। ঘোড়া, খচ্চর ও গাধাকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার কারণে কোন কোন ফকীহ প্রমাণ করেছেন যে, ঘোড়াও হারাম যেমন গাধা ও খচ্চর হারাম। তাছাড়া খাদ্যরূপে ব্যবহার্য পশুর উল্লেখ প্রথমেই এসে গেছে। সেই কারণে এই আয়াতে যে সব পশুর উল্লেখ রয়েছে তা শুধু বাহনের জন্য। কিন্তু তাঁদের এই দলীল সঠিক নয়, কারণ সহীহ হাদীসে ঘোড়ার গোশত হালাল হওয়ার কথা প্রমাণিত। জাবের (রাঃ) বলেন নবী (সাঃ) ঘোড়ার গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। (বুখারীঃ যবেহ অধ্যায়, মুসলিম শিকার অধ্যায়) তাছাড়া সাহাবায়ে কিরামগণ নবী (সাঃ) এর উপস্থিতিতে খাইবার ও মদীনায় ঘোড়া যবেহ করে গোশত রান্না করেছেন ও খেয়েছেন। আর নবী (সাঃ) নিষেধ করেননি।
(দেখুন মুসলিম উক্ত অধ্যায়, আহমাদ ৩/৩৫৬, আবু দাউদঃ খাদ্য অধ্যায়)
এই কারণে অধিকাংশ উলামা ঘোড়ার গোশত হালাল বলেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর) এখানে ঘোড়ার উল্লেখ শুধু বাহনরূপে করা হয়েছে। কারণ তার অধিক ব্যবহার এই উদ্দেশেই হয়ে থাকে এবং তা পৃথিবীতে সর্বযুগে এত বেশি মূল্যবান ও দামী থেকেছে যে তাকে খাবারের জন্য খুব কম ব্যবহার করা হয়েছে। ছাগল-ভেড়ার মত তা সাধারণতঃ যবেহ করে ভক্ষণ করা হয় না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বিনা স্পষ্ট প্রমাণে তাকে হারাম সাব্যস্ত করা যেতে পারে।
[২] ভূগর্ভে, সমুদ্রে, মরুভূমিতে এবং জঙ্গলে মহান আল্লাহ অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টি করে থাকেন, যার জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। এর সঙ্গে নব আবিষ্কৃত সকল বাহনও এসে যায়, যা আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান ও যোগ্যতা প্রয়োগ করে তাঁরই সৃষ্ট বস্তুকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে মানুষ তৈরী করেছে। যেমন বাস, ট্টেন, রেলগাড়ি, জলজাহাজ ও বিমান ইত্যাদি অসংখ্য যানবাহন এবং আরো অনেক কিছু, যা ভবিষ্যতে আশা করা যায়।
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُّونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ ۙ وَمِنْ أَصْوَافِهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَىٰ حِينٍ
📘 আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেছেন তোমাদের আবাসস্থল এবং তিনি তোমাদের জন্য পশু-চর্মের তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন; যা তোমরা ভ্রমণকালে ও অবস্থানকালে সহজে বহন করে থাক।[১] আর তিনি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ওদের পশম, লোম ও কেশ হতে কিছু কালের গৃহসামগ্রী ও ব্যবহার্য উপকরণ।[২]
[১] অর্থাৎ চামড়ার তৈরী তাঁবু যা তোমরা সফরে সহজেই বহন করতে পারো এবং প্রয়োজনমত তাকে ব্যবহার করে ঠান্ডা ও গরম হতে নিজেদেরকে রক্ষা কর।
[২] أصواف শব্দটি صوف এর বহুবচন, ভেড়ার লোমকে বুঝায়, أوبار শব্দটি وبر এর বহুবচন, উটের পশম أشعار শব্দটি شعر এর বহুবচন দুম্বা-ছাগলের লোমকে বুঝায়। এ সব দ্বারা বিভিন্ন জিনিস তৈরী হয়। যার দ্বারা মানুষ উপার্জন করে ও এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত উপকৃতও হয়।
وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ
📘 আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা হতে তিনি তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন[১] এবং তোমাদের জন্য পাহাড়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন এবং তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পরিধেয় বস্ত্রের; যা তোমাদেরকে তাপ হতে রক্ষা করে এবং তিনি ব্যবস্থা করেছেন তোমাদের জন্য বর্মের, ওটা তোমাদের যুদ্ধে রক্ষা করে।[২] এইভাবে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন, যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর।
[১] অর্থাৎ, গাছ সৃষ্টি করেছেন; যার থেকে ছায়া পাওয়া যায়।
[২] অর্থাৎ, উল ও সুতোর পোশাক যা সাধারণতঃ ব্যবহার করা হয় এবং লোহার বর্ম, শিরস্ত্রাণ; যা যুদ্ধে পরা হয়।
فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
📘 অতঃপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তোমার কর্তব্য তো শুধু স্পষ্টভাবে বাণী পৌঁছিয়ে দেওয়া।
يَعْرِفُونَ نِعْمَتَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
📘 তারা আল্লাহর অনুগ্রহ চিনে নেয়, অতঃপর তা অস্বীকার করে। আর তাদের অধিকাংশই অবিশ্বাসী।[১]
[১] অর্থাৎ, তারা এ কথা জানে ও বুঝে যে, এই সকল নিয়ামতের সৃষ্টিকর্তা ও তা ব্যবহারযোগ্য করার মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ, তবুও তারা তাঁকে অস্বীকার করে আর অধিকাংশ অকৃতজ্ঞতা করে, অর্থাৎ আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের ইবাদত করে।
وَيَوْمَ نَبْعَثُ مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا ثُمَّ لَا يُؤْذَنُ لِلَّذِينَ كَفَرُوا وَلَا هُمْ يُسْتَعْتَبُونَ
📘 যেদিন আমি প্রত্যেক জাতি হতে এক একজন সাক্ষী দাঁড় করাব।[১] অতঃপর সেদিন অবিশ্বাসীদেরকে (ওযর পেশ করার) অনুমতি দেওয়া হবে না এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সুযোগও দেওয়া হবে না।
[১] অর্থাৎ, প্রত্যেক নবী তাঁর জাতির জন্য সাক্ষ্য দেবেন যে, তিনি তাদের নিকট আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা অগ্রাহ্য করেছিল। ঐ সকল কাফেরদেরকে অজুহাত পেশ করার কোন সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ তাদের নিকট কোন অজুহাতই থাকবে না। আর না তাদেরকে প্রত্যাবর্তন বা অসন্তোষ দূর করার সময় দেওয়া হবে। কারণ তার প্রয়োজন তখন হয়, যখন কাউকে সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে। لاَ يُستَعتَبُون এর অন্য এক অর্থ হল, তাদেরকে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কোন সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ সে সুযোগ তাদের পৃথিবীতে দেওয়া হয়েছিল; যা ছিল কর্মস্থল। পরকাল কর্মস্থল নয়; বরং প্রতিদান দেওয়ার দিন। সেখানে মানুষ পৃথিবীতে যা করেছে, তার প্রতিদান পাবে। সেখানে কারো কিছু আমল করার সুযোগ থাকবে না।
وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ ظَلَمُوا الْعَذَابَ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ وَلَا هُمْ يُنْظَرُونَ
📘 যখন সীমালংঘনকারীরা তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে কোন ঢিল দেওয়াও হবে না। [১]
[১] শাস্তি লঘু বা কম না করার অর্থ, মাঝে কোন বিরতি দেওয়া হবে না; বরং অবিরাম শাস্তি হতে থাকবে। যেমন তাদেরকে কোন ঢিল বা অবকাশও দেওয়া হবে না; বরং তাদেরকে তৎক্ষণাৎ লাগাম দিয়ে ধরে লোহার শিকলে বেঁধে জাহান্নামে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হবে। অথবা তওবা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। কারণ পরকাল কর্মস্থল নয়; প্রতিদান দিবস।
وَإِذَا رَأَى الَّذِينَ أَشْرَكُوا شُرَكَاءَهُمْ قَالُوا رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ شُرَكَاؤُنَا الَّذِينَ كُنَّا نَدْعُو مِنْ دُونِكَ ۖ فَأَلْقَوْا إِلَيْهِمُ الْقَوْلَ إِنَّكُمْ لَكَاذِبُونَ
📘 অংশীবাদীরা যাদেরকে আল্লাহর অংশী করেছিল, তাদেরকে যখন দেখবে তখন বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদের অংশী, যাদেরকে আমরা তোমার পরিবর্তে আহবান করতাম।’ অতঃপর প্রত্যুত্তরে তারা তাদেরকে বলবে, ‘তোমরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।’ [১]
[১] আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতকারীরা তো নিজেদের এই দাবিতে মিথ্যাবাদী হবে না, কিংবা যাদেরকে তারা আল্লাহর শরীক করত, তারা বলবে যে, এরা মিথ্যাবাদী। অথবা এখানে তাদের শিরক করার কথা খন্ডন করা হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদেরকে আল্লাহর শরীক করার ব্যাপারে এরা মিথ্যাবাদী; আল্লাহর শরীক কি কেউ হতে পারে? অথবা এই কারণে তারা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলবে যে, তারা তাদের শিরক, ইবাদত ও পূজা সম্পর্কে অবগতই ছিল না। যেমন কুরআন কারীম এ কথাটিকে বহু জায়গায় উল্লেখ করেছে। যেমন, {فَكَفَى بِاللّهِ شَهِيدًا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِن كُنَّا عَنْ عِبَادَتِكُمْ لَغَافِلِينَ} অর্থাৎ, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহই সাক্ষীর জন্য যথেষ্ট যে, আমরা তোমাদের ইবাদত সম্বন্ধে অবগত ছিলাম না।
(সূরা ইউনুস ১০:২৯)
আরো দেখুনঃ সূরা আহক্বাফ ৪৬:৫-৬, সূরা মারয়্যাম ১৯:৮১-৮২, সূরা আনকাবূত ২৯:২৫, সূরা কাহ্ফ ১৮:৫২ নং ইত্যাদি আয়াত। এর একটি অর্থ এও হতে পারে যে, আমরা তোমাদেরকে আমাদের ইবাদত করতে কখনও বলিনি। সেই জন্য তোমরাই মিথ্যাবাদী। আল্লাহর সাথে কৃত উক্ত শরীকরা যদি পাথর বা গাছপালা হয়, তাহলে মহান আল্লাহ তাদের বাকশক্তি দান করবেন। আর জীন-শয়তান হলে তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। আর যদি শরীক আল্লাহর নেক বান্দা হয়ে থাকেন, যেমন বহু নেক, পরহেযগার ও বুযুর্গ আল্লাহর ওলীদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকা হয়, তাঁদের নামে নযর মানত করা হয়, তাঁদের কবরে গিয়ে এমন তা'যীম করা হয়, যেমন ভয় ও আশার সাথে কোন দেবদেবীর করা হয়, মহান আল্লাহ তাঁদেরকে হাশরের মাঠে নির্দোষ ঘোষণা করবেন। আর যারা তাঁদের ইবাদত করত, তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দেওয়া হবে। যেমন ঈসা (আঃ)-এর সাথে আল্লাহর প্রশ্নোত্তর সূরা মায়েদার শেষের দিকে (৫:১১৬-১১৮নং আয়াতে) বর্ণিত হয়েছে।
وَأَلْقَوْا إِلَى اللَّهِ يَوْمَئِذٍ السَّلَمَ ۖ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ
📘 সেদিন তারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং তারা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করত, তা তাদের নিকট হতে উধাও হয়ে যাবে।
الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يُفْسِدُونَ
📘 আমি অবিশ্বাসীদের ও আল্লাহর পথে বাধাদানকারীদের শাস্তির উপর শাস্তি বৃদ্ধি করব;[১] কারণ তারা অশান্তি সৃষ্টি করত।
[১] যেমন জান্নাতে জান্নাতবাসীদের মর্যাদা ভিন্ন ভিন্ন হবে, অনুরূপ জাহান্নামে কাফেরদের আযাবও বিভিন্ন ধরনের হবে। যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হওয়ার সাথে সাথে অপরকে পথভ্রষ্ট করার কারণ হয়েছিল, তাদের আযাব অন্যের তুলনায় কঠিনতর হবে।
وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْفُسِهِمْ ۖ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَىٰ هَٰؤُلَاءِ ۚ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ
📘 সেদিন প্রত্যেক জাতিতে তাদেরই মধ্য হতে তাদেরই বিপক্ষে এক একজন সাক্ষী দাঁড় করাব এবং ওদের বিষয়ে তোমাকে আমি আনব সাক্ষীরূপে।[১] আর আমি তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ[২] এবং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)দের জন্য, পথনির্দেশ, করুণা ও সুসংবাদ স্বরূপ।
[১] অর্থাৎ, প্রত্যেক নবী তাঁর জাতির জন্য সাক্ষ্য দেবে এবং নবী (সাঃ) ও তাঁর উম্মত অন্যান্য সকল নবীদের ব্যাপারে সাক্ষী দেবেন যে, তাঁরা সত্যবাদী; তাঁরা অবশ্যই তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন।
(বুখারীঃ তফসীর সূরা নিসা)
[২] 'গ্রন্থ' বলতে আল্লাহর কিতাব ও নবী (সাঃ)-এর ব্যাখ্যা অর্থাৎ হাদীসকে বুঝানো হয়েছে। মহানবী (সাঃ) নিজ হাদীসকেও 'আল্লাহর কিতাব' বলে ঘোষণা করেছেন। যেমন এক চাকরের প্রভু-পত্নীর সাথে ব্যভিচারের ঘটনা ইত্যাদিতে উল্লিখিত।
(দেখুনঃ বুখারীঃ কিতাবুল মুহারেবীন, কিতাবুস সালাত প্রভৃতি)
আর 'প্রত্যেক বিষয়' বলতে অতীত ও ভবিষ্যতের এমন সংবাদ যার জ্ঞান রাখা উপকারী ও আব্যশিক। অনুরূপ হালাল হারামের বিস্তারিত আলোচনা এবং দ্বীন ও দুনিয়ার এমন সব কথা বা ইহকাল ও পরকালের এমন সব ব্যাপার যা মানুষের জানা প্রয়োজন; কুরআন ও হাদীস উভয়েই সে সব পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে।
وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ ۚ وَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ
📘 সরল পথের নির্দেশ করা আল্লাহর দায়িত্ব।[১] আর পথগুলির মধ্যে বক্রপথও আছে; তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকেই সৎপথে পরিচালিত করতেন। [২]
[১] অর্থাৎ, সরল পথ প্রদর্শন করা আল্লাহর দায়িত্ব এবং তিনি তা করেছেন। সুতরাং তিনি হিদায়াত ও ভ্রষ্টতা দু'টিকেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সেই কারণে পরে বলছেন যে, কিছু পথ হল বক্র, অর্থাৎ বাঁকা ও ভ্রষ্ট।
[২] কিন্তু যেহেতু তাতে মানুষকে বাধ্য করে দেওয়া হত, পরীক্ষা নেওয়ার কোন অর্থ থাকত না, সেই কারণে আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় সকলকে বাধ্য করেননি, বরং দুই রাস্তার জ্ঞানদান করে মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দান করেছেন।
۞ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ ۚ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ
📘 নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালংঘন করা হতে নিষেধ করেন।[১] তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন; যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।
[১] عدل এর প্রসিদ্ধ অর্থ ন্যায়পরায়ণতা (সুবিচার)। অর্থাৎ, ঘর-পর সকলের ব্যাপারে সুবিচার করা। কারো সাথে শত্রুতা, ঝগড়া, ভালবাসা বা আত্মীয়তার কারণে সুবিচার যেন প্রভাবিত না হয়। এর দ্বিতীয় অর্থ মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা এবং কোন ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা, এমন কি দ্বীনের ব্যাপারেও। কেননা, দ্বীনের মধ্যে إفراط এর পরিণাম সীমা অতিক্রম বা অতিরঞ্জন করা যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। পক্ষান্তরে এর বিপরীত تفريط এর অর্থ দ্বীনের মধ্যে অলসতা করা; আর এটিও অপছন্দনীয়।إحسان এর একটি অর্থ সদাচরণ, ক্ষমা ও মাফ করা। দ্বিতীয় অর্থ এহসানি বা অনুগ্রহ করা; ওয়াজিব (প্রাপ্য) অধিকারের চেয়ে বেশি দেওয়া বা ওয়াজেব (কর্তব্য) কাজের অধিক করা। যেমন কোন শ্রমিকের পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছে এক শত টাকা, কিন্তু দেওয়ার সময় একশত দশ বা বিশ টাকা দেওয়া। এক শত টাকা দেওয়া এটি ওয়াজেব (প্রাপ্য) অধিকার, আর এটাই সুবিচার, আর দশ বিশ টাকা বেশি দেওয়া এটাই হল এহসান বা অনুগ্রহ। সুবিচার দ্বারা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সদাচরণ ও অনুগ্রহ প্রদর্শন দ্বারা সমাজে অধিক সৌন্দর্য, সৌহার্দ্য ত্যাগ-তিতিক্ষার স্পৃহা সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে ফরয কাজ সম্পাদন করার সাথে সাথে নফল কাজে আগ্রহী হওয়া কর্তব্যের চাইতে বেশি আমল। যার দ্বারা আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ হয়। এহসানের তৃতীয় অর্থঃ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা ও তা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা। যার হাদীসে أن تعبد الله كأنك تراه (আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ) বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। إيتاء ذي القربى আত্মীয়-স্বজনের অধিকার আদায় করা, অর্থাৎ, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। এটাকেই হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা বলা হয়েছে এবং তার প্রচুর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সুবিচার, সদাচরণ অনুগ্রহের পর এর পৃথকভাবে উল্লেখ জ্ঞাতি-বন্ধন বজায় রাখার গুরুত্বকে আরো অধিকরূপে বাড়িয়ে তোলে। فحشاء অশ্লীল কাজ, আজকাল অশ্লীলতা এত ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, তার নামই সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ও শিল্পকলা হয়ে গেছে! অথবা চিত্ত-বিনোদন বা মনোরঞ্জনের নামে তাকে বৈধ করে নেওয়া হয়েছে। তবে সুন্দর লেবেল লাগালে কোন জিনিসের আসলত্ব পাল্টে যায় না। অনুরূপ ইসলাম ব্যভিচার ও তার সকল ছিদ্রপথ; নাচ, পর্দাহীনতা, ফ্যাশন-প্রবণতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং অনুরূপ লজ্জাহীনতা প্রদর্শনকে অশ্লীলতা বলে অভিহিত করেছে। তার নাম যত সুন্দরই হোক না কেন; পাশ্চাত্য হতে আমদানীকৃত নোংরামি কোন মতেই বৈধ হতে পারে না। منكر (গর্হিত) প্রত্যেক সেই কাজ, যা শরীয়তে অবৈধ। بغي অর্থ অত্যাচার ও সীমালংঘন করা। একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ও অত্যাচার করা এই দুই পাপ মহান আল্লাহর নিকট এত ঘৃণিত যে, আল্লাহর পক্ষ হতে পরকাল ছাড়া পৃথিবীতেই তার তৎক্ষণাৎ শাস্তির আশংকা থেকে যায়।
(ইবনে মাজাহ কিতাবুয যুহদ)
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللَّهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلَا تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا وَقَدْ جَعَلْتُمُ اللَّهَ عَلَيْكُمْ كَفِيلًا ۚ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ
📘 তোমরা যখন পরস্পর অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর অঙ্গীকার পূরণ করো এবং আল্লাহকে তোমাদের যামিন করে শপথ দৃঢ় করবার পর তোমরা তা ভঙ্গ করো না;[১] তোমরা যা কর, অবশ্যই আল্লাহ তা জানেন।
[১] এক প্রকার কসম বা শপথ হল, যা কোন কথা; অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা বা চুক্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য করা হয়। আর দ্বিতীয় হল, যা অনেকে কোন সময় কসম করে বলে থাকে, 'আমি এই কাজ করব বা আমি এই কাজ করব না।' এখানে প্রথম অর্থে ব্যবহার হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, তোমরা শপথ করে আল্লাহকে যামিন করেছ, অতএব এখন তা ভঙ্গ করো না। বরং সে অঙ্গীকার পূরণ কর, যার জন্য তুমি শপথ করেছ। কারণ, দ্বিতীয় শপথের ব্যাপারে হাদীসে আদেশ করা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি কোন কাজের জন্য শপথ করে সে যদি বুঝে যে বিপরীত করলে তার মঙ্গল হবে, তাহলে তার উচিত, যাতে মঙ্গল রয়েছে সে যেন সেই কাজ করে এবং শপথের কাফফারা দিয়ে দেয়।
(মুসলিম ১২৭২নং)
নবী (সাঃ)-এর আমলও অনুরূপ ছিল।
(বুখারী ৬৬২৩, মুসলিম ১২৬৯নং)
وَلَا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا تَتَّخِذُونَ أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ أَنْ تَكُونَ أُمَّةٌ هِيَ أَرْبَىٰ مِنْ أُمَّةٍ ۚ إِنَّمَا يَبْلُوكُمُ اللَّهُ بِهِ ۚ وَلَيُبَيِّنَنَّ لَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
📘 তোমরা সে নারীর মত হয়ো না, যে তার সুতা মজবুত করে পাকাবার পর ওর পাক খুলে নষ্ট করে দেয়;[১] তোমরা পরস্পরের মাঝে ধোঁকা স্বরূপ তোমাদের শপথকে ব্যবহার করে থাক;[২] যাতে একদল অন্যদল অপেক্ষা অধিক লাভবান হয়;[৩] আল্লাহ তো এটা দ্বারা শুধু তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন। আর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করতে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তা নিশ্চয়ই স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দেবেন।
[১] শপথ দ্বারা সুদৃঢ়কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এমন, যেমন কোন নারী সুতা মজবুত করে পাকাবার পর তার পাক খুলে নষ্ট করে। এটি একটি উপমা মাত্র।
[২] ধোঁকা ও প্রবঞ্চনা দেওয়ার জন্য ব্যবহার কর।
[৩] أربى অর্থ অধিকতর। অর্থাৎ যখন তোমরা মনে কর যে, তোমাদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে, আর এর কারণে তোমরা শপথ ভঙ্গ করে ফেল; যদিও শপথ ও প্রতিশ্রুতির সময় প্রতিপক্ষ দুর্বল ছিল। কিন্তু দুর্বল থাকা সত্ত্বেও তারা নিশ্চিন্ত ছিল যে, প্রতিশ্রুতি বা চুক্তির কারণে আমাদের কোন ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু তোমরা বাহানা ও চুক্তিভঙ্গ করে ক্ষতি কর। জাহেলিয়াতের যুগে চারিত্রিক অবক্ষয়ের কারণে এরূপ চুক্তি ভঙ্গ করা ছিল সাধারণ ব্যাপার। মুসলিমদেরকে এই শ্রেণীর চারিত্রিক অবনতি থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَٰكِنْ يُضِلُّ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ ۚ وَلَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
📘 যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহলে তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন; কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। আর তোমরা যা কর, সে বিষয়ে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।
وَلَا تَتَّخِذُوا أَيْمَانَكُمْ دَخَلًا بَيْنَكُمْ فَتَزِلَّ قَدَمٌ بَعْدَ ثُبُوتِهَا وَتَذُوقُوا السُّوءَ بِمَا صَدَدْتُمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَلَكُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
📘 তোমরা পরস্পরের মাঝে ধোঁকা স্বরূপ তোমাদের শপথকে ব্যবহার করো না; করলে পা স্থির হওয়ার পর পিছলিয়ে যাবে এবং আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার কারণে তোমরা শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করবে। আর তোমাদের জন্য থাকবে মহাশাস্তি। [১]
[১] মুসলিমদেরকে আবার অঙ্গীকার ভঙ্গ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। যাতে চারিত্রিক দুর্বলতার কারণে কারো পা পিছলে না যায়। আর তোমাদের এ পরিস্থিতি দেখে যেন কোন কাফের ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত না হয়। আর তার ফলে তোমরা মানুষকে আল্লাহর পথে বাধা দেওয়ার পাপের শাস্তির উপযুক্ত না হয়ে পড়। কোন কোন মুফাসসির বলেন, أيمان শব্দটি يمين এর বহুবচন; যার অর্থ রসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে বায়আত করা। অর্থাৎ, বায়আত করার পর যেন কেউ মুরতাদ (ইসলাম-ত্যাগী) না হয়ে যায়। কারণ তোমাদের মুরতাদ হওয়া দেখে অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করা হতে বিরত থাকবে। আর এভাবে তোমরা দ্বিগুণ শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যাবে।
(ফাতহুল কাদীর)
وَلَا تَشْتَرُوا بِعَهْدِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۚ إِنَّمَا عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
📘 তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করো না। আল্লাহর কাছে তা উত্তম; যদি তোমরা জানতে।
مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ ۖ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ ۗ وَلَنَجْزِيَنَّ الَّذِينَ صَبَرُوا أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
📘 তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে তা চিরস্থায়ী থাকবে। যারা ধৈর্য ধারণ করে, আমি নিশ্চয়ই তাদেরকে তাদের কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
📘 পুরুষ ও নারী যে কেউই বিশ্বাসী হয়ে সৎকর্ম করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই সুখী জীবন দান করব[১] এবং তাদেরকে তাদের কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।
[১] حياة طيبة সুখী জীবন বলতে পৃথিবীর জীবন, কারণ পরকালের জীবনের কথা পরের আয়াতে বলা হয়েছে। যার সারমর্ম হল একজন চরিত্রবান মু'মিন সৎ ও ধর্মভীরু জীবন যাপনে, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত ও অল্পে তুষ্ট হওয়াতে যে পরম সুখ-স্বাদ অনুভব করে, তা কোন কাফের ও পাপী ব্যক্তি পৃথিবীর সকল সুখ ভোগ করলেও সে সুখ-স্বাদ পায় না। বরং সে এক ধরনের মানসিক অশান্তি ভোগ করে। মহান আল্লাহ বলেন,{وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا} যে আমার স্মরণে বিমুখ হবে, তার জীবন হবে সংকুচিত।
(সূরা তহা ২০:১২৪)
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
📘 যখন তুমি কুরআন পাঠ (করার ইচ্ছা) করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। [১]
[১] যদিও সম্বোধন নবী (সাঃ)-কে করা হয়েছে; কিন্তু উদ্দেশ্য সকল উম্মত। অর্থাৎ কুরআন পাঠের পূর্বে أَعُوذُْ بِاللّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ পাঠ কর।
إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
📘 নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করেছে ও তাদের প্রতিপালকের উপরই নির্ভর করে তাদের উপর তার কোন আধিপত্য নেই।