🕋 تفسير سورة الملك
(Al-Mulk) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
📘 মহা মহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর হাতে[১] এবং তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
[১] تَبَارَكَ শব্দটি بَرَكة থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হল বর্ধনশীল ও বেশী হওয়া। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, সৃষ্টিকুলের গুণাবলীর বহু ঊর্ধ্বে ও উচ্চে। تَفَاعل এর স্বীগা (আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী) অনেক ও আধিক্য বুঝাতে ব্যবহার হয়। "সর্বময় কর্তৃত্ব বা রাজত্ব যাঁর হাতে" অর্থাৎ, সব রকমের শক্তি এবং আধিপত্য তাঁরই। তিনি যেভাবে চান বিশ্বজাহান পরিচালনা করেন। তাঁর কাজে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি ভিখারীকে বাদশাহ, আর বাদশাহকে ভিখারী, ধনীকে গরীব এবং গরীবকে ধনী বানান। তাঁর কৌশল ও ইচ্ছায় কারো হস্তক্ষেপ চলে না।
وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ
📘 এবং তারা আরো বলবে, ‘যদি আমরা শুনতাম অথবা জ্ঞান করতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামীদের দলভুক্ত হতাম না।’[১]
[১] অর্থাৎ, যদি আমরা মনোযোগ সহকারে তাঁদের কথা শুনতাম এবং তাঁদের উপদেশ গ্রহণ করতাম, অনুরূপ আল্লাহর দেওয়া বিবেক-বুদ্ধি দিয়েও যদি চিন্তা ও বুঝার চেষ্টা করতাম, তাহলে আজ আমরা জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না।
فَاعْتَرَفُوا بِذَنْبِهِمْ فَسُحْقًا لِأَصْحَابِ السَّعِيرِ
📘 তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে।[১] সুতরাং জাহান্নামীরা (আল্লাহর রহমত হতে) দূর হোক![২]
[১] যার কারণে শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হয়েছে; আর তা হল, কুফরী করা এবং নবীদেরকে মিথ্যা ভাবা।
[২] অর্থাৎ, তারা এখন আল্লাহ এবং তাঁর রহমত থেকে বহু দূরে সরে যাবে। কেউ কেউ বলেন, سُحْقٌ 'সুহ্ক্ব' জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম।
إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ
📘 যারা না দেখেও তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।[১]
[১] অবিশ্বাসী ও মিথ্যাজ্ঞানকারী কাফেরদের মোকাবেলায় এখন এখানে ঈমানদারদের এবং তাদের সেই নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, যা তাঁরা কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর নিকট লাভ করবেন। بِالْغَيْبِ (না দেখে, অদৃশ্যভাবে) এর একটি অর্থ এই যে, তারা আল্লাহকে তো দেখেনি, কিন্তু নবীদের কথায় বিশ্বাস করে তারা আল্লাহর আযাবকে ভয় করে। দ্বিতীয় অর্থ এও হতে পারে যে, লোকদের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য থেকে। অর্থাৎ, নির্জনেও তারা প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে।
وَأَسِرُّوا قَوْلَكُمْ أَوِ اجْهَرُوا بِهِ ۖ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
📘 তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে,[১] নিশ্চয় তিনি অন্তর্যামী।[২]
[১] এখানে আবারও কাফেরদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তোমরা রসূল (সাঃ)-এর ব্যাপারে গোপনে কথা বল অথবা প্রকাশ্যে, সব কিছুই আল্লাহ অবগত আছেন। কোন কথাই তাঁর কাছে গোপন থাকে না।
[২] এখানে তাঁর গোপনীয় ও প্রকাশ্য বিষয় জানার কারণ বর্ণনা করে বলা হচ্ছে যে, তিনি তো মনের ও অন্তরের গুপ্ত রহস্যসমূহের ব্যাপারেও অবহিত। অতএব তোমাদের কথাসমূহ কিভাবে তাঁর কাছে গোপন থাকতে পারে?
أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ
📘 যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না?[১] তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত। [২]
[১] অর্থাৎ, মন ও অন্তর এবং তাতে উদিত যাবতীয় খেয়ালের সৃষ্টিকর্তা তো মহান আল্লাহই। তিনি কি নিজ সৃষ্টি সম্বন্ধে অনবহিত থাকতে পারেন? এখানে প্রশ্নবাচক শব্দ অস্বীকৃতি সূচক। অর্থাৎ, তিনি অনবহিত নন; তিনি সব জানেন।
[২] لَطِيْفٌ এর অর্থ হল সূক্ষ্মদর্শী। الَّذِيْ لَطُفَ عِلْمُهُ بِمَا فِي الْقُلُوْبِ অর্থাৎ, যিনি হৃদয়ের যাবতীয় খবর ও অবস্থা সূক্ষ্মভাবে জানেন ও দেখেন।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوا فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُوا مِنْ رِزْقِهِ ۖ وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
📘 তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন;[১] অতএব তোমরা ওর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর[২] এবং তাঁর দেওয়া রুযী হতে আহার্য গ্রহণ কর। [৩] আর পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট।
[১] ذَلُوْلٌ শব্দের অর্থ হল, এমন অনুগত, যে সামনে অবনত হয়ে যায় এবং কোন প্রকার অবাধ্যতা করে না। অর্থাৎ, যমীনকে তোমাদের জন্য নরম ও মোলায়েম করে দেওয়া হয়েছে। তাকে এমন শক্ত বানানো হয়নি যে, তাতে তোমাদের বসবাস ও চলা-ফেরা কষ্টকর হতে পারে।
[২] مَنَاكِبَ শব্দটি مَنْكِبٌ এর বহুবচন। এর অর্থ, দিক। এখানে এর অর্থ হল, যমীনের রাস্তা ও তার দিক-দিগন্ত। এখানে আদেশ 'মুবাহ' তথা বৈধ অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, তার রাস্তায় বিচরণ কর।
[৩] যমীনের উৎপন্ন ফসলাদি আহার কর।
أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ
📘 তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন, তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধসিয়ে দেবেন না? আর ওটা আকস্মিকভাবে কেঁপে উঠবে। [১]
[১] অর্থাৎ, মহান আল্লাহ যিনি আসমান অর্থাৎ, আরশের উপর সমাসীন। এখানে কাফেরদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে যে, আসমানের সেই সত্তা যখন ইচ্ছা তখনই তোমাদেরকে যমীনে ধসিয়ে দিতে পারেন। অর্থাৎ, যে যমীন তোমাদের বাসস্থান এবং তোমাদের রুযীর উৎস ও ভান্ডার, সেই শান্ত ও স্থির যমীনের মধ্যে মহান আল্লাহ কম্পন সৃষ্টি করে তা তোমাদের ধ্বংসের কারণ বানাতে পারেন।
أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا ۖ فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ
📘 অথবা তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, আকাশে যিনি রয়েছেন, তিনি তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝড় প্রেরণ করবেন না?[১] তখন তোমরা জানতে পারবে, কিরূপ ছিল আমার সতর্কবাণী! [২]
[১] যেমন তিনি লূত সম্প্রদায় এবং হস্তীবাহিনীর (আবরাহার হাতি এবং তার সৈন্যের) উপর পাথর বর্ষণ করেছেন। পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন।
[২] কিন্তু সে সময় এই জ্ঞান কোন উপকারে আসবে না।
وَلَقَدْ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ
📘 অবশ্যই এদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যাজ্ঞান করেছিল; ফলে কেমন (ভয়ঙ্কর) ছিল আমার প্রতিকার (শাস্তি)!
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ صَافَّاتٍ وَيَقْبِضْنَ ۚ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا الرَّحْمَٰنُ ۚ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِيرٌ
📘 তারা কি লক্ষ্য করে না তাদের ঊর্ধ্বদেশে পক্ষীকুলের প্রতি, যারা ডানা বিস্তার করে ও সংকুচিত করে?[১] পরম দয়াময়ই তাদেরকে স্থির রাখেন।[২] নিশ্চয় তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা।
[১] পাখীরা যখন হাওয়াতে উড়তে থাকে, তখন তারা পাখা মেলে দেয়। কখনো আবার উড়ন্ত অবস্থায় নিজের পাখা গুটিয়ে নেয়। এই পাখা মেলাকে صفّ আর গুটিয়ে নেওয়াকে قَبض বলা হয়।
[২] অর্থাৎ, কোন্ সত্তা এই উড়ন্ত পাখীকে (আকাশে) স্থির রাখেন, তাকে যমীনে পড়তে দেন না? এটা দয়াবান আল্লাহর মহাশক্তির এক নিদর্শন।
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
📘 যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্য; কে তোমাদের মধ্যে কর্মে সর্বোত্তম?[১] আর তিনি পরাক্রমশালী, বড় ক্ষমাশীল।
[১] روح (আত্মা) একটি এমন অদৃশ্যমান বস্তু যে, যে দেহের সাথে তার সম্পর্ক বহাল থাকে, তাকে জীবিত বলা হয়। আর যে দেহ হতে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, তাকে মৃত্যুর শিকার হতে হয়। জীবনের পর রয়েছে মৃত্যু। আল্লাহ তাআলা ক্ষণস্থায়ী এই জীবনের ব্যবস্থা এই জন্য করেছেন, যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন যে, এই জীবনের সদ্ব্যবহার কে করে? যে এ জীবনকে ঈমান ও আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান এবং যে এর অন্যথা করবে, তার জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
أَمَّنْ هَٰذَا الَّذِي هُوَ جُنْدٌ لَكُمْ يَنْصُرُكُمْ مِنْ دُونِ الرَّحْمَٰنِ ۚ إِنِ الْكَافِرُونَ إِلَّا فِي غُرُورٍ
📘 পরম দয়াময় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের এমন কোন সৈন্যবাহিনী আছে কি, যারা তোমাদের সাহায্য করবে?[১] অবিশ্বাসীরা তো ধোকায় রয়েছে। [২]
[১] প্রশ্নবাচক এই উক্তি এখানে ধমকের জন্য এসেছে। جُنْدٌ এর অর্থ হল সৈন্যদল, গোষ্ঠী। অর্থাৎ, কোন সৈন্যদল বা গোষ্ঠী এমন নেই, যে তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে।
[২] যে ধোঁকায় শয়তান তাদেরকে ফেলে রেখেছে।
أَمَّنْ هَٰذَا الَّذِي يَرْزُقُكُمْ إِنْ أَمْسَكَ رِزْقَهُ ۚ بَلْ لَجُّوا فِي عُتُوٍّ وَنُفُورٍ
📘 এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে রুযী দান করবে, তিনি যদি তাঁর রুযী বন্ধ করে দেন? [১] বস্তুতঃ তারা অবাধ্যতা ও সত্য বিমুখতায় অবিচল রয়েছে। [২]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহ যদি বৃষ্টি বর্ষণ না করেন অথবা যমীনকেই যদি ফসলাদি উৎপন্ন করতে নিষেধ করে দেন কিংবা যদি পাকা ফসলকে নষ্ট করে দেন; যেমন কখনো কখনো তিনি এইরূপ করে থাকেন, যার কারণে তোমাদের জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, যদি মহান আল্লাহ এইরূপ করে দেন তাহলে বল, আর এমন কে আছে, যে আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত তোমাদের জন্য রুযীর ব্যবস্থা করে দেবে?
[২] তাদের উপর ওয়ায-নসীহতের এই কথাগুলোর কোন প্রভাব পড়ে না, বরং তারা সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করেই যাচ্ছে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভ্রষ্টতার দিকে আগে বাড়তেই আছে। না তারা উপদেশ গ্রহণ করে, আর না তারা চিন্তা-ভাবনা করে।
أَفَمَنْ يَمْشِي مُكِبًّا عَلَىٰ وَجْهِهِ أَهْدَىٰ أَمَّنْ يَمْشِي سَوِيًّا عَلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
📘 যে ব্যক্তি মুখে ভর দিয়ে চলে, সেই কি অধিক পথপ্রাপ্ত,[১] নাকি সেই ব্যক্তি, যে সোজা হয়ে সরল পথে চলে? [২]
[১] মুখে ভর দিয়ে যে চলে সে ডানে-বামে, আগে-পিছে কিছুই দেখে না এবং সে হোঁচট খাওয়া থেকেও রক্ষা পায় না। এমন মানুষ কি নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে? অবশ্যই না। অনুরূপ দুনিয়ায় আল্লাহর নাফরমানীতে ডুবে থাকা ব্যক্তি পরকালে সাফল্য লাভ করা হতে বঞ্চিত থাকবে।[২] যে পথে কোন বক্রতা নেই ও ভ্রষ্টতার আশঙ্কা নেই এবং সে সামনে ও ডানে-বামে দেখতেও পায়। নিশ্চিত যে, এমন ব্যক্তি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ, আল্লাহর আনুগত্যের সরল পথ অবলম্বনকারী আখেরাতে বড়ই সৌভাগ্যবান হবে। কেউ কেউ বলেন যে, এটা মুমিন ও কাফের উভয়ের সেই অবস্থার বিবরণ, যা কিয়ামতে তাদের হবে। কাফেরদেরকে মুখের উপর ভর করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আর মুমিনরা সোজা হয়ে নিজের পায়ে হেঁটে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যেমন, কাফেরদের ব্যাপারে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, {وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ} "আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় সমবেত করব "
(সূরা বানী ইস্রাঈল ১৭:৯৭ আয়াত)
قُلْ هُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ ۖ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ
📘 বল, ‘তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন[১] এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ।[২] তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।’[৩]
[১] অর্থাৎ, প্রথমবার সৃষ্টিকারী হলেন আল্লাহই।
[২] যা দিয়ে তোমরা শুনতে পার, দেখতে পার এবং আল্লাহর সৃষ্টিকুল সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পার। মহান আল্লাহ তিনটি (ইন্দ্রিয়) শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন; যার দ্বারা মানুষ শ্রাব্য, দৃশ্য ও অনুভবযোগ্য সকল বস্তুর জ্ঞান লাভ করতে পারে। এতে এক দিক দিয়ে হুজ্জত কায়েম করাও হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত এই নিয়ামতগুলোর উপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করার নিন্দাও করা হয়েছে। এই জন্য আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, "তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।"
[৩] অর্থাৎ, অল্প পরিমাণ অথবা অল্প সময়ব্যাপী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক। কিংবা কৃতজ্ঞতার স্বল্পতা উল্লেখ করে তাদের তরফ থেকে পূর্ণ কৃতঘ্নতাকেই বুঝানো হয়েছে।
قُلْ هُوَ الَّذِي ذَرَأَكُمْ فِي الْأَرْضِ وَإِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
📘 বল, ‘তিনিই পৃথিবীতে তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।’ [১]
[১] অর্থাৎ, মানুষকে সৃষ্টি করে তিনিই তাদেরকে যমীনে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন সকলকেই তাঁরই নিকট উপস্থিত হতে হবে, অন্য কারো নিকট নয়।
وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هَٰذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
📘 তারা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে বল, এই প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?’ [১]
[১] এ কথা কাফেররা ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করে এবং কিয়ামতকে বহু দূর মনে করে বলত।
قُلْ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُبِينٌ
📘 তুমি বল, ‘এর জ্ঞান শুধু আল্লাহরই নিকট আছে; [১] আর আমি তো স্পষ্ট সকর্তকারী মাত্র।’ [২]
[১] তিনি ব্যতীত তা কেউ জানে না। অন্যত্র তিনি বলেন, {قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي} (لأعراف: ৭:১৮৭) "তুমি বলে দাও, এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে।"
(সূরা আরাফ ৭:১৮৭ আয়াত)
[২] অর্থাৎ, আমার কাজ হল সেই (মন্দ) পরিণাম থেকে তোমাদেরকে সতর্ক করা, যা আমাকে মিথ্যা ভাবার কারণে তোমরা প্রাপ্ত হবে। ভিন্ন কথায়, আমার কাজ তো ভীতি প্রদর্শন করা, অদৃশ্যের খবর বলা নয়। তবে যে ব্যাপারে আল্লাহ নিজে থেকেই আমাকে বলে দেন (তার কথা ভিন্ন)।
فَلَمَّا رَأَوْهُ زُلْفَةً سِيئَتْ وُجُوهُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَقِيلَ هَٰذَا الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تَدَّعُونَ
📘 যখন ওটা[১] আসন্ন দেখবে তখন অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডল মলিন হয়ে যাবে[২] এবং বলা হবে, ‘এটাই তো সেই জিনিস, যা তোমরা দাবি করছিলে।’ [৩]
[১] رَأَوْهُ এর মধ্যে هُ সর্বনাম (ওটা) থেকে অধিকাংশ মুফাসসিরগণ 'প্রতিশ্রুতি' (কিয়ামতের আযাব)এর প্রতি ইঙ্গিত বুঝিয়েছেন।[২] অর্থাৎ, লাঞ্ছনা, ভয়াবহতা এবং আতঙ্কের কারণে তাদের মুখমন্ডল মলিন হয়ে যাবে। এ কথাকে অন্যত্র মুখমন্ডল কালো হয়ে যাবে বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
(সূরা আলে ইমরান ৩:১০৬ আয়াত)
[৩] অর্থাৎ, এই আযাব যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ, তা তো সেই আযাবই, যা তোমরা পৃথিবীতে দ্রুত দেখতে চাচ্ছিলে। যেমন, সূরা স্বাদের ৩৮:১৬ নং আয়াতে এবং সূরা আনফালের ৮:৩২ নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে।
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَهْلَكَنِيَ اللَّهُ وَمَنْ مَعِيَ أَوْ رَحِمَنَا فَمَنْ يُجِيرُ الْكَافِرِينَ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
📘 বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গীদেরকে ধ্বংস করেন অথবা আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন, তাহলে অবিশ্বাসীদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি হতে কে রক্ষা করবে?’ [১]
[১] অর্থাৎ, চাহে রসূল ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদেরকে আল্লাহ মৃত্যু অথবা হত্যা দ্বারা ধ্বংস করে দেন কিংবা তাদেরকে অবকাশ দেন; কিন্তু এই কাফেরদের জন্য তো আল্লাহর আযাব থেকে কোন রক্ষাকারী নেই। অথবা এর অর্থ হল, আমরা ঈমান আনা সত্ত্বেও ভয় ও আশার মধ্যে চিন্তাগ্রস্ত, তাহলে কুফরী করলে তোমাদেরকে আযাব থেকে কে বাঁচাতে পারবে?
قُلْ هُوَ الرَّحْمَٰنُ آمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا ۖ فَسَتَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
📘 বল, ‘তিনি পরম দয়াময়, আমরা তাতে বিশ্বাস করি[১] ও তাঁরই উপর নির্ভর করি।[২] সুতরাং শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’[৩]
[১] অর্থাৎ, তাঁর একত্ববাদের উপর। এই জন্য তাঁর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করি না।
[২] অন্য কারোর উপর নয়। আমি আমার যাবতীয় ব্যাপার তাঁকেই সোপর্দ করি, অন্য কাউকে নয়। যেমন মুশরিকরা অন্যকে করে থাকে।
[৩] তোমরা, নাকি আমরা? এতে কাফেরদের প্রতি কঠোর ধমক রয়েছে।
الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَٰنِ مِنْ تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِنْ فُطُورٍ
📘 তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না;[১] আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি?[২]
[১] অর্থাৎ, তাতে কোন অসামঞ্জস্য, কোন বক্রতা এবং কোন ত্রুটি ও খুঁত নেই। বরং তাকে একেবারে সোজা ও সমতল বানানো হয়েছে; যা এ কথা প্রমাণ করে যে, এ সবের সৃষ্টিকর্তা হলেন কেবল একজন, একাধিক নয়।
[২] কখনো কখনো এমন হয় যে, দ্বিতীয়বার ভালভাবে লক্ষ্য করলে কোন ঘাটতি বা দোষ-ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। তাই মহান আল্লাহ আহবান করছেন যে, তোমরা বারবার দৃষ্টিপাত করে দেখ, তাতে কোন ছিদ্র বা ফাটল পাও কি না?
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَنْ يَأْتِيكُمْ بِمَاءٍ مَعِينٍ
📘 বল, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে কে তোমাদেরকে এনে দেবে প্রবহমান পানি?’ [১]
[১] غَوْرٌ শব্দের অর্থ হল শুকিয়ে যাওয়া অথবা পানির এত গভীরে চলে যাওয়া যে, সেখান হতে তা বের করা অসম্ভব হয়। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা যদি পানি শুকিয়ে দিয়ে তার অস্তিত্বই শেষ করে দেন অথবা মাটির এত গভীরে করে দেন, যেখান থেকে পানি বের করতে সর্বপ্রকার যন্ত্র ব্যর্থ সাব্যস্ত হয়, তাহলে বল, কে আছে এমন, যে তোমাদের জন্য প্রবহমান ও নির্মল পানির ব্যবস্থা করে দেবে? অর্থাৎ, কেউ নেই। এটা মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ যে, তোমাদের অবাধ্যতা সত্ত্বেও তিনি তোমাদেরকে পানি থেকে বঞ্চিত করেননি।
ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ
📘 অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে। [১]
[১] এখানে আবার তাকীদ করার উদ্দেশ্য হল, নিজের মহাশক্তি এবং একত্বকে আরো বেশী স্পষ্ট করা।
وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَجَعَلْنَاهَا رُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ ۖ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيرِ
📘 আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং ওগুলোকে করেছি শয়তানদের প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র স্বরূপ[১] এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি।
[১] এখানে নক্ষত্র সৃষ্টির দু'টি উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমতঃ আসমানের সৌন্দর্যবর্ধন। কেননা, তা প্রদীপের মত দীপ্তিমান সুন্দর দেখা যায়। দ্বিতীয়তঃ শয়তানদল যখন আসমানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন একে উল্কারূপে তাদের উপর নিক্ষেপ করা হয়। এর তৃতীয় উদ্দেশ্য যেটাকে অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে তা হল, তার দ্বারা সমুদ্রে ও স্থলে পথ ও দিক নির্ণয় করা হয়।
وَلِلَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
📘 আর যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি, আর তা বড় নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!
إِذَا أُلْقُوا فِيهَا سَمِعُوا لَهَا شَهِيقًا وَهِيَ تَفُورُ
📘 যখন তারা তাতে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন জাহান্নামের গর্জন শুনবে, আর তা উদ্বেলিত হবে। [১]
[১] شَهِيْقٌ সেই শব্দকে বলা হয়, যা গাধার মুখ থেকে সর্বপ্রথম বের হয়। এটা বড়ই বিদঘুটে আওয়াজ। কিয়ামতের দিন জাহান্নামও গাধার মত চিৎকার করবে এবং আগুনের উপর রাখা ফুটন্ত হাঁড়ির মত উদ্বেলিত হতে থাকবে।
تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ ۖ كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيرٌ
📘 রোষে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে,[১] যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে তার রক্ষীরা জিজ্ঞাসা করবে, ‘তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি?’[২]
[১] ক্রোধে ও রাগে তার একাংশ অন্যাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এ জাহান্নাম কাফেরদেরকে দেখে বড় ক্রোধান্বিত হবে। (ক্রোধান্বিত হওয়ার) এই অনুভূতি মহান আল্লাহ তার মধ্যে সৃষ্টি করে দেবেন। আর এ কাজ তাঁর জন্য কঠিন নয়।
[২] যার কারণে তোমাদেরকে আজ জাহান্নামের আস্বাদ গ্রহণ করতে হল?
قَالُوا بَلَىٰ قَدْ جَاءَنَا نَذِيرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا فِي ضَلَالٍ كَبِيرٍ
📘 তারা বলবে, ‘অবশ্যই আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, কিন্তু আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলাম, আল্লাহ কিছুই অবতীর্ণ করেননি, তোমরা তো মহা বিভ্রান্তিতে রয়েছ।’[১]
[১] অর্থাৎ, আমরা পয়গম্বরদেরকে সত্যজ্ঞান করার পরিবর্তে তাঁদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিলাম। আসমানী কিতাবসমূহকে একেবারে অস্বীকার করেছিলাম। এমনকি আল্লাহর পয়গম্বরদেরকে আমরা বলেছিলাম যে, তোমরা বড়ই ভ্রষ্টতার মধ্যে আছ।