🕋 تفسير سورة لقمان
(Luqman) • المصدر: BN-TAFISR-FATHUL-MAJID
وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ ۚ وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ ۖ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
📘 ১২ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতে লুকমান (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিকমাত বা প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। বিশিষ্ট তাবেয়ী কাতাদাহ (رحمه الله) বলেন: লুকমান (عليه السلام)-কে প্রদত্ত হিকমত ছিল দীনের সঠিক বুঝ। তিনি নাবী ছিলেন না এবং তাঁর কাছে ওয়াহী করা হয়নি। ইবনু কাসীর (رحمه الله) বলেন: তাঁর হিকমতটা ছিল জ্ঞান, সঠিক বুঝ ও স্বপ্নের তাবীর। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
একদা তাকে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি এ জ্ঞান-বুদ্ধি কিভাবে অর্জন করলেন? তিনি উত্তরে বলেলেন: সদ্ব্যবহার করে, আমানত রক্ষা করে, বাজে কথা থেকে দূরে থেকে এবং নীরবতা অবলম্বন করে। তাঁর প্রজ্ঞা ও হিকমতপূর্ণ একটি ঘটনা সম্পর্কে এরকমও প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি একজন দাস ছিলেন। একদা তাঁকে তাঁর মালিক বললেন: ছাগল জবেহ করে তার মধ্য হতে সর্বোৎকৃষ্ট দুই টুকরো গোশ্ত কেটে নিয়ে এস। সুতরাং তিনি জিভ ও হৃৎপিন্ড নিয়ে আসলেন। অন্য একদিন তাঁর মালিক তাঁকে ছাগল জবেহ করে তার মধ্য হতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু টুকরো গোশ্ত নিয়ে আসার আদেশ করলে তিনি পুনরায় জিভ ও হৃদপিন্ড নিয়ে আসলেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বললেন: জিভ ও হৃদপিন্ড যদি ঠিক থাকে তাহলে তা সর্বোৎকৃষ্ট জীব। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার চেয়ে নিকৃষ্ট জীব আর কিছু হতে পারে না। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যেহেতু হিকমত দান করেছেন সেজন্য তিনি আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেন। কেননা যারা শুকরিয়া আদায় করে তারা মূলত তা নিজেদের কল্যাণের জন্যই করে। আর যদি কেউ অকৃতজ্ঞ হয় তাহলে অকৃতজ্ঞতার পরিণাম নিজের ওপরেই বর্তাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُه۫ ج وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِأَنْفُسِهِمْ يَمْهَدُوْنَ)
“যে ব্যক্তি কুফরী করে, তারই ওপর পড়বে তার কুফরীর ফল। আর যে ব্যক্তি নেক কাজ করে, তারা নিজেদেরই জন্য সুখের ঠিকানা করে নিচ্ছে।” (সূরা রূম ৩০:৪৪)
সুতরাং মানুষ যে কাজই করুক না কেন তার ভাল মন্দ ফলাফল নিজের ওপরই বর্তাবে। এতে আল্লাহ তা‘আলার কোন লাভ বা ক্ষতি হবে না। কেননা আল্লাহ মানুষের মুখাপেক্ষী নন। আর এটাও বুঝা যাচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিত। লুকমান (عليه السلام) সম্পর্কে সালাফগণ দুটি মত প্রকাশ করেছেন, কেউ বলেছেন তিনি নাবী ছিলেন, আবার কেউ বলেছেন; তিনি শুধুমাত্র সৎ ব্যক্তি ছিলেন। অধিকাংশরাই দ্বিতীয় মত পোষণ করেছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. লুকমান হাকীম ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি, তিনি নাবী ছিলেন না।
২. মানুষের কৃতকর্মের ফল তার নিজের ওপরই বর্তাবে। কেউ ভাল কাজ করলে তা তার আবার কেউ খারাপ কাজ করলে তাও তারই।
৩. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সকল জিনিস থেকে অমুখাপেক্ষী।
৪. যারা আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করে দেন।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا ۚ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ
📘 ৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে তাঁর নির্দেশ পালন ও নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাক্বওয়াবান হওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করছেন এবং কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তের ভয় প্রদর্শন করে বলছেন: সেদিন একমাত্র তাক্বওয়া ও সৎ আমল ব্যতীত সন্তান পিতার কোন উপকারে আসবে না এবং পিতাও সন্তানের কোনই উপকারে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(یَوْمَ یَفِرُّ الْمَرْئُ مِنْ اَخِیْھِﭱﺫ وَاُمِّھ۪ وَاَبِیْھِﭲﺫ وَصَاحِبَتِھ۪ وَبَنِیْھِﭳﺚ لِکُلِّ امْرِیٍٔ مِّنْھُمْ یَوْمَئِذٍ شَاْنٌ یُّغْنِیْھِﭴ)
“সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তাঁর নিজের ভাই হতে, এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান হতে, তাদের প্রত্যেকের সেদিন এমন গুরুতর অবস্থা হবে যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।” (সূরা আবাসা ৮০:৩৪-৩৭) এখানে ঐ শ্রেণির পিতা-পুত্রকে বুঝানো হয়েছে যাদের মধ্যে একজন মু’মিন, অপরজন কাফির। কেননা মু’মিন পিতা কিংবা পুত্র স্বীয় কাফির পুত্রের কিংবা পিতার শাস্তি বিন্দুমাত্রও হ্রাস করতে পারবে না। তবে যদি উভয়ে মু’মিন হয় তাহলে পিতা-মাতা সন্তানের জন্য এবং সন্তান পিতা-মাতার জন্য সুপারিশ করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيْمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَآ أَلَتْنٰهُمْ مِّنْ عَمَلِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ ط كُلُّ امْرِئٍۭ بِمَا كَسَبَ رَهِيْنٌ)
“এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততিও ঈমানে তাদের অনুসারী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং আমি তাদের কর্মফলের ঘাটতি করব না, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী।” (সূরা তুর ৫২:২১)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে নসীহত করেছেন যে, দুনিয়ার চাকচিক্যময় জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। তোমরা দুনিয়ার চাক্যচিক্যে পড়ে আখিরাতকে ভুলে যেও না। তোমরা শয়তানের প্রতারণায় পড়ো না। শয়তান শুধু ধোঁকা দিতেই জানে, সে কখনো কারো উপকার করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيْهِمْ ط وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطٰنُ إِلَّا غُرُوْرًا)
“(শয়তান) সে তাদেরকে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে; আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্র“তি দেয় তা ছলনামাত্র।” (সূরা নিসা ৪:১২০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করতে হবে।
২. পার্থিব মোহে পড়ে পরকালকে ভোলা যাবে না।
৩. কিয়ামতের দিন কেউ কারো কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারবে না।
إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
📘 ৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এমন পাঁচটি জিনিসের বর্ণনা দিচ্ছেন যেগুলো সম্পর্কে একমাত্র তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। আর এগুলোই হল সেই গায়েবের চাবিকাঠি যেগুলো সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৫৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এ পাঁচটি বিষয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই জ্ঞানায়ত্ব। হাদীসে এসেছে:
ইবনু উমার (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি। যেগুলো আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ জানে না।
১. কিয়ামতের জ্ঞান
২. বৃষ্টি বর্ষণ করা, তথা কখন কোথায় বৃষ্টি বর্ষণ হবে তা তিনিই জানেন।
৩. মাতৃগর্ভে যা আছে
৪. আগামীকাল মানুষ কী উপার্জন করবে।
৫. এবং কার কোথায় মৃত্যু হবে।
(সহীহ বুখারী হা: ৪৬২৭, ৪৭৭৮, ৭৩৭৯)
ইমাম বুখারী (رحمه الله) এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে¬খ করেছেন যে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জনগণের মাজলিসে বসেছিলেন, এমন সময় তাঁর নিকট জনৈক লোক এসে তাঁকে ঈমান, ইসলাম ও ইহসান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর বলল: কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? তিনি উত্তর দিলেন, এটা প্রশ্নকারীর চেয়ে উত্তরদাতা বেশি জানে না। তবে আমি তোমাকে এর কতগুলো নিদর্শনের কথা বলছি। যখন দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে এবং যখন উলঙ্গ পা ও উলঙ্গ দেহবিশিষ্ট লোক যারা ছাগল চরাতো তারা বড় বড় অট্টালিকা তৈরী করে প্রতিযোগিতা করবে। এগুলো হল কিয়ামতের নিদর্শন। পাঁচটি বিষয় যা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ জানেন না। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৭, সহীহ মুসলিম হা: ১০০৯)
এ সম্পর্কে আরো তাফসীর সূরা আন‘আমের ৫৯ নং আয়াতে করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অদৃশ্যের চাবিকাঠি পাঁচটি।
২. অদৃশ্যের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা রাখেন, অন্য কেউ নয়।