🕋 تفسير سورة الأحزاب
(Al-Ahzab) • المصدر: BN-TAFSEER-IBN-E-KASEER
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللَّهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
📘 Please check ayah 33:3 for complete tafsir.
إِذْ جَاءُوكُمْ مِنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا
📘 ৯-১০ নং আয়াতের তাফসীর
পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে। আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের উপর যে দয়া ও অনুগ্রহ করেছিলেন এখানে তিনি তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। যখন মুশরিকরা মুসলমানদেরকে দুনিয়া হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে পূর্ণ শক্তিসহ বিরাট বাহিনী নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করেছিল। কেউ কেউ বলেন যে, খন্দকের যুদ্ধ চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের ঘটনা এই যে, বানু নাযীরের ইয়াহুদী নেতৃবর্গ, যাদের মধ্যে সালাম ইবনে আবি হাকীক, সালাম ইবনে মুশকাম, কিনানাহ, ইবনে রাবী প্রমুখ ছিল, মক্কায় এসে পূর্ব হতেই প্রস্তুত কুরায়েশদেরকে যুদ্ধের জন্যে উত্তেজিত করলো এবং তাদের সাথে অঙ্গীকার করলো যে, তারা তাদের অধীনস্থ লোকদেরকে সাথে নিয়ে তাদের দলে যোগদান করবে। সেখানে তাদের সাথে কথা শেষ করে তারা গাতফান গোত্রের লোকদের নিকট গমন করলো এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলে তাদেরকেও তাদের সাথে মিলিত করলো। কুরায়েশরাও এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে সারা আরবে আলোড়ন সৃষ্টি করলো এবং আরো কিছু লোক যোগাড় করে নিলো। এসবের সরদার নির্বাচিত হলেন আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব এবং গাতফান গোত্রের নেতা নির্বাচিত হলো উয়াইনা ইবনে হাসান ইবনে বদর। এভাবে চেষ্টা তদবীর চালিয়ে তারা দশ হাজার যোদ্ধা একত্রিত করলো এবং মদীনার দিকে ধাওয়া করলো। এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সংবাদ পেয়ে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমে, মদীনার পূর্ব দিকে খন্দক খনন করতে শুরু করলেন। সমস্ত মুহাজির ও আনসার এ খনন কার্যে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেও একাজে অংশ নিলেন। স্বয়ং তিনি কাদা-মাটি বহন করতে লাগলেন। মুশরিকদের সেনাবাহিনী বিনা বাধায় মদীনা পর্যন্ত পৌঁছে গেল এবং মদীনার পূর্বাংশে উহুদ পাহাড় সংলগ্ন স্থানে নিজেদের শিবির স্থাপন করলো। এটা ছিল মদীনার নিম্নাংশ। মদীনার উপরাংশে তারা এক বিরাট সৈন্য দল পাঠিয়ে দিলো যারা মদীনার উঁচু অংশে শিবির স্থাপন করলো এবং নীচে ও উপরের দিক থেকে মুলমানদেরকে অবরোধ করে ফেললো। মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা তিন হাজারেরও কম ছিল। কোন কোন রিওয়াইয়াতে শুধু সাতশ’ বলা হয়েছে। এই অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুকাবিলার জন্যে আসলেন। তিনি সালা পাহাড়কে পিছনের দিকে করলেন। শত্রুদের দিকে মুখ করে তিনি সৈন্য সমাবেশ করলেন। যে খন্দক তিনি খনন করেছিলেন তাতে পানি ইত্যাদি ছিল না। তা শুধু একটি গর্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) শিশু ও মহিলাদেরকে মদীনার একটি মহল্লায় একত্রিত করে রেখে দেন। মদীনায় বানু কুরায়যা নামক ইয়াহুদীদের একটি গোত্র বসবাস করতো। তাদের মহল্লা ছিল মদীনার পূর্ব দিকে। নবী (সঃ)-এর সাথে তাদের দৃঢ় সন্ধিচুক্তি ছিল। তাদেরও বিরাট দল ছিল। প্রায় আটশ’ জন বীর যোদ্ধা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মুশরিক ও ইয়াহূদীরা তাদের কাছে হুয়াই ইবনে আখতাব নারীকে পাঠিয়ে দিলো। সে তাদেরকে নানা প্রকারের লোভ-লালসা দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে করে নিলো। তারাও ঠিক সময়ে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং প্রকাশ্যভাবে সন্ধি ভেঙ্গে দিলো। বাইরে দশহাজার শত্রু সৈন্য ছাউনি ফেলে বসে আছে। এদিকে ইয়াহূদীদের এই বিশ্বাসঘাতকতা যেন বগলে ফোড়া বের হওয়া। বত্রিশ দাঁতের মধ্যে জিহ্বা অথবা আটার মধ্যে লবণের মত মুসলমানদের অবস্থা হয়ে গেল। এ সাতশ জন লোক কি-ই বা করতে পারে? এটা ছিল ঐ সময় যার চিত্র কুরআন কারীম অংকন করেছে যে, তখন মুমিনরা পরীক্ষিত হয়েছিল এবং তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। শত্রুরা একমাস ধরে অবরোধ অব্যাহত রাখলো। যদিও মুশরিকরা খন্দক অতিক্রম করতে মক্ষম হলো না। তবে তারা মাসাধিককাল ধরে মুসলমাদেরকে ঘিরে বসে থাকলো। এতে মুসলমানরা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো। আমর ইবনে আবদে অদ্দ, যে ছিল আরবের বিখ্যাত বীর পুরুষ, সেনাপতিত্ব বিষয়ে যে ছিল অদ্বিতীয়, একবার সে নিজের সাথে কয়েকজন দুঃসাহসী বীরপুরুষকে নিয়ে সাহস করে অশ্বচালনা করলো এবং খন্দক পার হয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় অশ্বারোহীদের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। কিন্তু বলা হয় যে, তাদেরকে তিনি প্রস্তুত না পেয়ে হযরত আলী (রাঃ)-কে তাদের মুকাবিলা করার নির্দেশ দিলেন। অল্পক্ষণ ধরে উভয় পক্ষের বীরপুরুষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহর সিংহ হযরত আলী (রাঃ) শত্রুদেরকে তরবারীর আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। এতে মুসলমানরা খুবই খুশী হলেন এবং তাঁদের সাহস ও উৎসাহ বেড়ে গেল। তারা বুঝে নিলেন যে, তাদের জয় সুনিশ্চিত। অতঃপর আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে ভীষণ বেগে ঝড় তুফান ও ঘূর্ণিবার্তা প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এর ফলে কাফিরদের সমস্ত তাঁবু মূলোৎপাটিত হলো। কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। অগ্নি জ্বালানো কঠিন হয়ে গেল। কোন আশ্রয়স্থল তাদের দৃষ্টিগোচর হলো না। পরিশেষে তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গেল। এরই বর্ণনা কুরআন কারীমে দেয়া হয়েছে এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম ঝঞাবায়ু। এ আয়াতে যে বায়ুর কথা বলা হয়েছে হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এর মতে ওটা ছিল পূবালী হাওয়া। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিম্নের উক্তিও এর পৃষ্ঠপোষকতা করে। তিনি বলেনঃ “পূবালী বায়ু দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে এবং আ’দ সম্প্রদায়কে দাৰূর’ দ্বারা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।”ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, দক্ষিণা হাওয়া উত্তরা হাওয়াকে আহযাবের যুদ্ধের সময় বলেঃ “চল, আমরা উভয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সাহায্য করি।” তখন উত্তরা হাওয়া জবাবে বলেঃ “রাত্রে গরম বা প্রখরতা চলে না।” অতঃপর পূবালী হাওয়া প্রবাহিত হলো। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমার মামা হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধের রাত্রে কঠিন শীত ও প্রচণ্ড বাতাসের সময় খাদ্য ও লেপ আনার জন্যে আমাকে মদীনায় প্রেরণ করেন। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে অনুমতি প্রদান করেন। তিনি আমাকে বলেনঃ “আমার কোন সাহাবীর সাথে তোমার দেখা হলে তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে।” আমি চললাম। ভীষণ জোরে বাতাস বইতে ছিল। যে সাহাবীর সাথে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছিল আমি তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম পৌছিয়ে দিচ্ছিলাম। যিনি পয়গাম শুনছিলেন তিনিই তৎক্ষণাৎ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দিকে চলে আসছিলেন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ পিছন ফিরেও দেখছিলো না। বাতাস আমার ঢালে ধাক্কা দিচ্ছিল এবং আমি তাতে আঘাত পাচ্ছিলাম। এমনকি ওর লোহা আমার পায়ে পড়ে গেল। আমি ওটাকে নীচে ফেলে দিলাম। (এটাও ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি এমন এক বাহিনী প্রেরণ করেছিলাম যা তোমরা দেখোনি।” তাঁরা ছিলেন ফেরেশতা। তাঁরা মুশরিকদের অন্তর ও বক্ষ ভয়, সন্ত্রাস এবং প্রভাব দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাদের সমস্ত নেতা তাদের অধীনস্থ সৈন্যদেরকে কাছে ডেকে ডেকে বলেছিলঃ “তোমরা মুক্তির পথ অন্বেষণ কর, বাঁচার পথ বের করে নাও।” এটা ছিল ফেরেশতাদের নিক্ষিপ্ত ভয় ও প্রভাব এবং তারাই ছিলেন ঐ সেনাবাহিনী যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।কুফার অধিবাসী একজন নব্যযুবক হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে আবু আবদিল্লাহ (রাঃ)! আপনি বড়ই ভাগ্যবান যে, আপনি আল্লাহর নবী (সঃ)-কে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং তাঁর মজলিসে বসেছেন। বলুন তো, তখন আপনি কি করতেন?” হযরত হুযাইফা (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি তখন জীবন দানে প্রস্তুত থাকতাম।”এ কথা শুনে যুবকটি বলেনঃ “শুনুন চাচা! যদি আমরা নবী (সঃ)-এর যামানা পেতাম তবে আল্লাহর শপথ! আমরা তাঁর পা মাটিতে পড়তে দিতাম না। তাঁকে আমরা নিজেদের ঘাড়ে উঠিয়ে নিয়ে ফিরতাম।” তিনি তখন বললেনঃ “হে আমার প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র! তাহলে একটি ঘটনা বলি, শুননা। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) গভীর রাত্রি পর্যন্ত নামায পড়ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি বললেনঃ “কাফিরদের খবরাখবর আনতে পারে এমন কেউ তোমাদের মধ্যে আছে কি? আল্লাহর নবী (সঃ) তার সাথে শৰ্ত করছেন যে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” তাঁর এ কথায় কেউই দাঁড়ালো না। কেননা সবারই ভয়, ক্ষুধা ও ঠাণ্ডা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আবার তিনি অনেকক্ষণ ধরে নামায পড়লেন। তারপর পুনরায় বললেনঃ “যে। ব্যক্তি বিপক্ষ দলের খবর নিয়ে আসবে, আমি তাকে অভয় দিচ্ছি যে, সে অবশ্যই (অক্ষত ও নিরাপদ অবস্থায়) ফিরে আসবে। আমি দু'আ করি যে, তাকে যেন আল্লাহ জান্নাতে আমার বন্ধু হিসেবে স্থান দেন।” এবারও কেউ দাঁড়ালো না। আর দাঁড়াবেই বা কি করে? ক্ষুধার জ্বালায় তাদের পেট কোমরের সাথে লেগে গিয়েছিল এবং ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁতে বাজতে শুরু করেছিল। ভয়ে তাদের রক্ত পানি হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। আমার তো তখন আর তার ডাকে সাড়া দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকলো না। তিনি বললেনঃ “হুযাইফা (রাঃ) তুমি যাও এবং দেখে এসো তারা কি করছে। দেখো, তুমি যে পর্যন্ত আমার কাছে ফিরে না আসো সে পর্যন্ত নতুন কোন কাজ করে বসো না।” আমি খুব আচ্ছা’ বলে আমার পথ ধরলাম। সাহস করে আমি শত্রুর মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সেখানে গিয়ে বিস্ময়কর অবস্থা দেখলাম। তা এই যে, আল্লাহ তা'আলার অদৃশ্য সৈন্যরা আনন্দের সাথে নিজেদের কাজ করতে রয়েছে। বাতাস চুলার উপর হতে ডেকচিগুলোকে উল্টিয়ে ফেলেছে। তাঁবুর খুঁটি উৎপাটিত হয়েছে। তারা আগুন জ্বালাতে পারছে না। কোন কিছুই সজ্জিত অবস্থায় নেই। ঐ সময় আবু সুফিয়ান দাড়িয়ে উচ্চ স্বরে সকলকে সম্বোধন করে বললেনঃ “হে কুরায়েশরা! তোমরা নিজ নিজ সঙ্গী হতে সতর্ক হয়ে যাও। নিজ সাথীদের দেখা শোনা কর। এমন যেন না হয় যে, অন্য কেউ তোমাদের পাশে দাড়িয়ে তোমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে।” আমি কথাগুলো শুনার সাথে সাথে আমার পাশে যে কুরায়েশী দাঁড়িয়েছিল তার হাত ধরে ফেললাম এবং তাকে। বললামঃ কে তুমি? সে উত্তরে বললো: “আমি অমুকের পুত্র অমুক।” আমি বললামঃ এখন থেকে সতর্ক থাকবে। আবু সুফিয়ান বললেনঃ “হে কুরায়েশের দল! আল্লাহর কসম, আমাদের আর কোথাও দাঁড়াবার স্থান নেই। আমাদের গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুগুলো এবং আমাদের উটগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বানু কুরাইযা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা আমাদেরকে খুব কষ্ট দিয়েছে। অতঃপর এই ঝড়ো হাওয়া আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। আমরা রান্না করে খেতে পারছি না। তবু ও থাকার স্থান আমরা ঠিক রাখতে পারছি না। তোমরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। আমি তো ফিরে যাবার কথা চিন্তা করছি। আমি তোমাদের সকলকেই ফিরে যাবার নির্দেশ দিচ্ছি।” এ কথা বলেই পাশে যে উটটি বসিয়ে রাখা হয়েছিল তার উপর তিনি উঠে বসলেন। উটকে মার দিতেই সে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। সে সময় আমার এমন সুযোগ হয়েছিল যে, আমি ইচ্ছা করলে আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে একটি তীরের আঘাতেই খতম করে দিতে পারতাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশ ছিল যে, আমি যেন নতুন কোন কাজ না করে বসি। তাই আমি এ কাজ হতে বিরত থাকলাম। এখন আমি ফিরে চললাম এবং আমার সৈন্যদলের মধ্যে পৌছে গেলাম। আমি যখন পৌঁছি তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি চাদর গায়ে দিয়ে নামায পড়ছিলেন। চাদরটি ছিল তাঁর কোন এক পত্নীর। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি আমাকে তাঁর দুই পায়ের মাঝে বসিয়ে নিলেন এবং তাঁর ঐ চাদর দ্বারা আমাকে আবৃত করলেন। অতঃপর তিনি রুকু সিজদা করলেন। আর আমি সেখানেই চাদরমুড়ি দিয়ে বসে থাকলাম। তাঁর নামায পড়া শেষ হলে আমি তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। গাতফান গোত্র যখন কুরায়েশদের ফিরে যাবার কথা শুনলো তখন তারাও নিজেদের তলপি-তলপা বেঁধে নিয়ে ফিরে চললো।”অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর কসম! ককনে শীত সত্ত্বেও আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন কোন গরম হাম্মাম খানায় রয়েছি। ঐ সময় আবু সুফিয়ান (রাঃ) আগুন জ্বেলে তাপ গ্রহণ করছিল। আমি তাকে দেখে চিনে ফেললাম। সাথে সাথে আমি কামানে তীর যোজন করলাম। মনে করলাম যে, তীর ছুঁড়ে দিই। তিনি আমার তীরের আওতার মধ্যেই ছিলেন। আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কোন কারণই ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কথা আমার স্মরণ হয়ে গেল যে, আমি যেন এমন কোন নতুন কাজ করে না বসি যার ফলে শত্রুরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমি আমার বাসনা পরিত্যাগ করলাম। যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে আসলাম তার পূর্ব পর্যন্ত আমি কোন ঠাণ্ডা অনুভব করিনি। আমার মনে হচ্ছিল যে, যেন আমি গরম হাম্মাম খানায় আছি। তবে যখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট পৌছলাম তখন খুবই ঠাণ্ডা অনুভূত হতে লাগলো। আমি ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিলেন। আমি সকাল পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমালাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে এ বলে জাগালেনঃ “হে নিদিত ব্যক্তি! জেগে ওঠো।অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, যখন ঐ তাবেয়ী বলেনঃ “হায়! যদি আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখতাম এবং তাঁর যুগটা পেতাম।” তখন হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “হায়! যদি তোমার মত আমার ঈমান হতো। তাকে না দেখেই তুমি তাঁর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছো! তবে হে আমার প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র! তুমি যে আকাক্ষা করছে তা শুধু আকাঙ্ক্ষাই মাত্র। সেই সময় থাকলে তুমি কি করতে তা তুমি জানো না। আমাদের উপর দিয়ে কত কঠিন সময় গত হয়েছে!” অতঃপর তিনি তাঁর সামনে উপরোল্লিখিত ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তাতে তিনি একথাও বললেনঃ “ঝড় তুফানের সাথে সাথে বৃষ্টিও বর্ষিত হচ্ছিল।”আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথের ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন তখন মজলিসে যারা উপস্থিত ছিলেন। তারা বললেনঃ “আমরা যদি সে সময় উপস্থিত থাকতাম তবে এই করতাম, ঐ করতাম।” তাঁদের একথা শুনে হযরত হুযাইফা (রাঃ) ঘটনাটি বর্ণনা করেনঃ ‘বাহির হতে তো দশ হাজার সৈন্য আমাদেরকে ঘিরে বসে আছে, আর ভিতর হতে বানু কুরাইযার আটশ' জন ইয়াহূদী বিদ্রোহী হয়ে গেছে এবং শিশুরা ও নারীরা মদীনায় পড়ে আছে। এভাবে সবদিক দিয়েই বিপদ লেগে আছে। যদি বানু কুরাইযা গোত্র এদিকে লক্ষ্য করে তাহলে ক্ষণেকের মধ্যে শিশু ও নারীদের ফায়সালা করে দিবে। আল্লাহর শপথ! এ রাত্রের মত ভীতি-বিহ্বল অবস্থা আমার আর কখনো হয়নি। এর উপর ঝড় বইছে, তুফান সমানভাবে চলতেই আছে, চতুর্দিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, মেঘ গর্জন করছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সবই মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর ইচ্ছেতেই হচ্ছে। সাথীদেরকে কোথায় দেখা যাবে? নিজের হাতের অঙ্গুলীও দেখা যায় না। মুনাফিকরা বাহানা করতে শুরু করে দিয়েছে যে, তাদের ছেলে মেয়ে, স্ত্রী পরিবারকে দেখবার কেউ নেই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) যেন তাদেরকে ফিরে যাবার অনুমতি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাউকেও ফিরে যেতে বাধা দিলেন না। যেই অনুমিত চায় তাকেই তিনি বলেনঃ “যাও, আগ্রহের সাথেই যাও।” সুতরাং তারা এক এক করে সরে পড়ে। আমরা শুধু প্রায় তিনশর মত রয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এসে আমাদেরকে এক এক করে দেখলেন। আমার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আমার কাছে শত্রুর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার না ছিল কোন অস্ত্র এবং ঠাণ্ডা হতে বাঁচবার না ছিল কোন ব্যবস্থা। শুধু আমার স্ত্রীর ছোট একটি চাদর ছিল যা আমার হাঁটু পর্যন্ত পৌছেনি। যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আসলেন তখন আমি আমার হাঁটুতে মাথা লাগিয়ে কাঁপছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “এটা কে?" আমি উত্তরে বললামঃ আমি হুযাইফা। তিনি তখন বললেনঃ “হে হুযাইফা (রাঃ)! শুন।” তাঁর একথা শুনে আল্লাহর কসম! পৃথিবী আমার উপর সংকুচিত হয়ে গেল যে, না জানি হয়তো তিনি আমাকে দাঁড়াতে বলবেন। আর দাঁড়ালে তো আমার দুর্গতির কোন সীমা থাকবে না। কিন্তু করি কি? আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নির্দেশ তো? বাধ্য হয়ে বললামঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আপনার আদেশ পালন করতে প্রস্তুত আছি।” তিনি বললেনঃ “শত্রুদের মধ্যে এক নতুন ব্যাপার শুরু হয়ে গেছে। যাও, এর খবর নাও।” আল্লাহর কসম! ঐ সময় আমার চেয়ে অধিক না কারো ভয়-ভীতি ছিল, না আমার চেয়ে বেশী কাউকেও ঠাণ্ডা লাগছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আদেশ শোনা মাত্রই আমি রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার জন্যে দু'আ করছেন। এটা আমার কানে আসলো। তিনি দু'আ করছিলেনঃ “হে আল্লাহ! তার সামনে হতে, পিছন হতে, ডান দিক হতে, বাম দিক হতে, উপর হতে এবং নীচ হতে তাকে হিফাযত করুন।” তার দু'আর সাথে সাথে আমার অন্তর হতে ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ডেকে বললেনঃ “শুন হে হুযাইফা (রাঃ)! সেখান হতে আমার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত নতুন কিছু করে বসো না।” এ রিওয়াইয়াতে এও আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “ইতিপূর্বে আমি আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে চিনতাম না। ওখানে গিয়ে আমি এ শব্দই শুনতে পেলামঃ “চল, ফিরে চল।” একটি আশ্চর্য ব্যাপার এও দেখলাম যে, ঐ ভয়াবহ বাতাস যা ডেকচিগুলোকে উল্টিয়ে দিচ্ছিল তা শুধু তাদের সেনাবাহিনীর অবস্থানস্থল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আল্লাহর শপথ! তা থেকে অর্ধ হাতও বাইরে যায়নি। আমি দেখলাম যে, পাথর উড়ে উড়ে তাদের উপর পড়ছিল। যখন আমি ফিরে আসলাম তখন দেখলাম যে, পাগড়ি পরিহিত প্রায় ২০ জন অশ্বারোহী রয়েছেন যারা আমাকে বললেনঃ “যাও, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সংবাদ দাও যে, আল্লাহ তা'আলা তাঁর জন্যে যথেষ্ট হয়েছেন এবং তাঁর শত্রুদেরকে তিনি পরাজিত ও লাঞ্ছিত করেছেন।” এই বর্ণনায় এও উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল, যখন তিনি কোন বিপদের সম্মুখীন হতেন তখন নামায পড়া শুরু করে দিতেন। এতে আরো রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ খবর পৌছানো হয় তখনই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। সুতরাং এ আয়াতে নিম্ন অঞ্চল হতে আগমনকারী দ্বারা বানু কুরাইযাকে বুঝানো হয়েছে।মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের চক্ষু বিস্ফারিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত এবং তোমরা আল্লাহ সম্বন্ধে নানাবিধ ধারণা পোষণ করছিলে। এমনকি কোন কোন মুনাফিক তো এটা মনে করে নিয়েছিল যে, এ যুদ্ধে কাফিররাই জয়যুক্ত হবে। সাধারণ মুনাফিকদের কথা তো দূরে থাক, এমনকি মুতাব ইবনে কুশায়ের বলতে শুরু করলো: “রাসূলুল্লাহ (সঃ) তো আমাদেরকে বলেছিলেন যে, আমরা নাকি কাইসার ও কিসরার ধন-সম্পদের মালিক হয়ে যাবো, অথচ এখানকার অবস্থা এই যে, পায়খানায় যাওয়াও আমাদের জন্যে কষ্টকর হয়ে পড়েছে।” এ রকম বিভিন্ন লোকের ধারণা বিভিন্ন ছিল। তবে মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাঁদের জয় সুনিশ্চিত।হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “খন্দকের যুদ্ধের দিন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের প্রাণ তো হয়েছে কণ্ঠাগত, এখন আমাদের বলার কিছু আছে কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, তোমরা বলো (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মর্যাদা রক্ষা করুন এবং আমাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করুন।” এদিকে মুসলমানদের এ দু'আ উচ্চারিত হচ্ছিল, আর ঐ দিকে আল্লাহর সৈন্য বাতাসের রূপ ধারণ করে এসে পড়ে এবং কাফিরদের দুর্গতি চরম সীমায় পৌঁছিয়ে দেয়। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُونَ وَزُلْزِلُوا زِلْزَالًا شَدِيدًا
📘 Please check ayah 33:13 for complete tafsir.
وَإِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ إِلَّا غُرُورًا
📘 Please check ayah 33:13 for complete tafsir.
وَإِذْ قَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوا ۚ وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيقٌ مِنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُولُونَ إِنَّ بُيُوتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ ۖ إِنْ يُرِيدُونَ إِلَّا فِرَارًا
📘 ১১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর
আহযাবের যুদ্ধে মুসলমানরা যে ভীতি-বিহ্বলতা ও উদ্বেগপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। বাহির হতে আগত শত্রুরা পূর্ণ শক্তি ও বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর ভিতরে শহরের মধ্যে বিদ্রোহের অগ্নি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। ইয়াহূদীরা হঠাৎ করে সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে দিয়েছে। মুসলমানরা খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে পতিত হয়েছে। মুনাফিকরা প্রকাশ্যভাবে পৃথক হয়ে গেছে। দুর্বল মনের লোকেরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে শুরু করেছে। তারা একে অপরকে বলছেঃ “পাগল হয়েছো না কি? দেখতে পাচ্ছ না যে, অতি অল্পক্ষণের মধ্যে পট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? চলো, পালিয়ে যাই।” ইয়াসরিব দ্বারা মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। যেমন সহীহ হাদীসে এসেছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “স্বপ্নে আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। তা দু’টি কংকরময় ভূমির মধ্যস্থলে অবস্থিত। প্রথম আমার ধারণা হয়েছিল যে, ওটা বোধহয় হিজর হবে। কিন্তু না, তা ইয়াসরিব।” আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ঐ স্থানটি হলো মদীনা। অবশ্য একটি দুর্বল রিওয়াইয়াতে আছে যে, যে ব্যক্তি মদীনাকে ইয়াসরিব বলে সে যেন তা হতে তাওবা করে। মদীনা তো হলো তাবা, ওটা তাবা। (এ হাদীসটি শুধু মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। এর ইসনাদে দুর্বলতা রয়েছে)বর্ণিত আছে যে, আমালীকের মধ্যে যে লোকটি এখানে এসে অবস্থান করেছিল তার নাম ছিল ইয়াসরিব ইবনে আবীদ ইবনে মাহবীল ইবনে আউস ইবনে আমলাক ইবনে লাআয ইবনে ইরাম ইবনে সাম ইবনে নূহ (আঃ)। তার নামানুসারেই এ শহরটিও ইয়াসরিব নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। একটি উক্তি এও আছে যে, তাওরাত শরীফে এর এগারোটি নাম রয়েছে। ওগুলো হলো: মদীনা, তাবা, তায়্যেবাহ্, সাকীনা, জাবিরাহ, মুহিব্বাহ, মাহবুবাহ, কাসিমাহ, মাজরূরাহ, আযরা এবং মারহ্মাহ্।কা’ব আহ্বার (রঃ) বলেন, আমরা তাওরাতে একথাগুলো পেয়েছি যে, আল্লাহ তা'আলা মদীনা শরীফকে বলেনঃ “হে তাইয়্যেবা, হে তাবা এবং হে মাসকীনা! ধন-ভাণ্ডারে জড়িত হয়ে পড়ো না। সমস্ত জনপদের মধ্যে তোমার মর্যাদা সমুন্নত হবে। কিছু লোক খন্দকের যুদ্ধের সময় বলেছিলঃ “হে ইয়াসরিববাসী! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল।' বানু হারিসা গোত্র বলতে শুরু করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের বাড়ীতে চুরি হওয়ার আশংকা রয়েছে। ওগুলো জনহীন অবস্থায় পড়ে আছে। সুতরাং আমাদেরকে বাড়ী ফিরে যাবার অনুমতি দিন।” আউস ইবনে কায়সী বলেছিলঃ “আমাদের বাড়ীতে শত্রুদের ঢুকে পড়ার ভয় রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে বাড়ী ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হালে।” আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরের কথা বলে দিলেন যে, আসলে পলায়ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য, তাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত ছিল না।
وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَيْهِمْ مِنْ أَقْطَارِهَا ثُمَّ سُئِلُوا الْفِتْنَةَ لَآتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوا بِهَا إِلَّا يَسِيرًا
📘 Please check ayah 33:17 for complete tafsir.
وَلَقَدْ كَانُوا عَاهَدُوا اللَّهَ مِنْ قَبْلُ لَا يُوَلُّونَ الْأَدْبَارَ ۚ وَكَانَ عَهْدُ اللَّهِ مَسْئُولًا
📘 Please check ayah 33:17 for complete tafsir.
قُلْ لَنْ يَنْفَعَكُمُ الْفِرَارُ إِنْ فَرَرْتُمْ مِنَ الْمَوْتِ أَوِ الْقَتْلِ وَإِذًا لَا تُمَتَّعُونَ إِلَّا قَلِيلًا
📘 Please check ayah 33:17 for complete tafsir.
قُلْ مَنْ ذَا الَّذِي يَعْصِمُكُمْ مِنَ اللَّهِ إِنْ أَرَادَ بِكُمْ سُوءًا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ رَحْمَةً ۚ وَلَا يَجِدُونَ لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
📘 ১৪-১৭ নং আয়াতের তাফসীর
যারা ওযর করে জিহাদ হতে পালিয়ে যাচ্ছিল যে, তাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, যার বর্ণনা উপরে দেয়া হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ যদি শত্রুরা নগরীর বিভিন্ন দিক হতে প্রবেশ করে তাদেরকে কুফরীর মধ্যে প্রবেশের জন্যে প্ররোচিত করতো তবে তারা অবশ্যই কোন চিন্তা-ভাবনা না করে কুফরীকে ককূল করে নিতো। তারা সামান্য ভয়-ভীতির কারণে ঈমানের কোন হিফাযত করতো না ও ঈমানকে আঁকড়ে ধরে থাকতো না। এভাবে মহান আল্লাহ তাদের নিন্দে করেছেন।এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এরা তো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করবে না। তারা জানে না যে, আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্বন্ধে অবশ্যই তারা জিজ্ঞাসিত হবে।অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এভাবে মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে কোন লাভ হবে না, এতে তোমাদের প্রাণ রক্ষা পেতে পারে না। বরং হতে পারে যে, এর কারণে অকস্মাৎ আল্লাহর পাকড়াও এসে যাবে এবংদুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে। দুনিয়া তো চিরস্থায়ী আখিরাতের তুলনায় অতি নগণ্য ও তুচ্ছ জিনিস।। এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ আল্লাহ তা'আলা যদি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন। তবে এমন কেউ নেই যে তোমাদেরকে আল্লাহ হতে রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে, তিনি যদি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছা করেন তবে এমন কেউ নেই যে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে। তোমরা আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।
۞ قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنْكُمْ وَالْقَائِلِينَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا ۖ وَلَا يَأْتُونَ الْبَأْسَ إِلَّا قَلِيلًا
📘 Please check ayah 33:19 for complete tafsir.
أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ۖ فَإِذَا جَاءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُونَ إِلَيْكَ تَدُورُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِي يُغْشَىٰ عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ۖ فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَى الْخَيْرِ ۚ أُولَٰئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوا فَأَحْبَطَ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا
📘 ১৮-১৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তার ব্যাপক ও প্রশস্ত জ্ঞানের দ্বারা ঐ লোকদের ভালরূপেই অবগত আছেন যারা অন্যদেরকেও জিহাদে গমন হতে বাধা দেয় এবং নিজেদের সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে এবং আত্মীয়-স্বজনকে বলেঃ “তোমরাও আমাদের সঙ্গেই থাকো এবং নিজেদের ঘরবাড়ী, আরাম-আয়েশ, জমি-জমা ও পরিবারবর্গকে পরিত্যাগ করে জিহাদে যোগদান করো না। তারা নিজেরাও জিহাদে অংশগ্রহণ করে না। কোন কোন সময় তারা মুখ দেখিয়ে যায় এবং নাম লিখিয়ে দেয় সেটা অন্যকথা।মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ) ও মুমিনদেরকে বলেনঃ এরা অত্যন্ত কৃপণ। তাদের নিকট থেকে তোমরা কোন আর্থিক সাহায্য পাবে না এবং তোমাদের প্রতি তাদের অন্তরে কোন সহানুভূতিও নেই। তোমরা যখন গনীমতের মাল প্রাপ্ত হও তখন তারা অসন্তুষ্ট হয়। যখন বিপদ আসে তখন তোমরা দেখতে পাও যে, মৃত্যু ভয়ে মুচ্ছাতুর ব্যক্তির মত চক্ষু উল্টিয়ে তারা তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ দূর হয়ে যায় তখন তারা ধনের লোভে তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। তারা নবী (সঃ)-কে বলেঃ আমরা তো আপনারই সঙ্গী। আমরা আপনার সঙ্গে থেকে রীতিমত যুদ্ধ করেছি। সুতরাং গনীমতের মালে আমাদেরও অংশ রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা মুখও দেখায় না। তারা পলাতকদের আগে এবং যোদ্ধাদের পিছনে থাকে। মালের দিকে তারা মাছির মত লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায়। মিথ্যা ও কাপুরুষতা এ দুটো দোষই তাদের মধ্যে বিদ্যমান। এ দুটো দোষে যারা দোষী হয় তাদের কাছে কল্যাণের কোন আশা করা যায় কি? শান্তির সময় প্রতারণা, দুশ্চরিত্রতা এবং রূঢ়তা, আর যুদ্ধের সময় ভীরুতা ও নারীত্বপনা! যুদ্ধের সময় ঋতুবতী নারীর ন্যায় পৃথক হয়ে যাওয়া, আর মাল নেয়ার সময় গাধার মত লোভনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করাই তাদের কাজ।আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তারা ঈমান আনেনি, এজন্যে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন এবং আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ।
وَاتَّبِعْ مَا يُوحَىٰ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
📘 Please check ayah 33:3 for complete tafsir.
يَحْسَبُونَ الْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا ۖ وَإِنْ يَأْتِ الْأَحْزَابُ يَوَدُّوا لَوْ أَنَّهُمْ بَادُونَ فِي الْأَعْرَابِ يَسْأَلُونَ عَنْ أَنْبَائِكُمْ ۖ وَلَوْ كَانُوا فِيكُمْ مَا قَاتَلُوا إِلَّا قَلِيلًا
📘 এই মুনাফিকদের কাপুরুষতা ও ভীতি-বিহ্বলতার অবস্থা এই যে, কাফির সৈন্যরা যে ফিরে গেছে এ বিশ্বাসই তাদের হয়নি। তাদের মনে এ ভয় রয়েই গেছে যে, না জানি হয়তো তারা আবার ফিরে আসবে। মুশরিকদের সৈন্যদেরকে দেখেই তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। তারা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে, যদি তারা মুসলমানদের সাথে ঐ শহরেই না থাকতো তবে কতই না ভাল হতো! বরং তারা যদি অশিক্ষিত ও অজ্ঞদের সাথে কোন জনমানবহীন গ্রামে অথবা কোন বন জঙ্গলে অবস্থান করতো এবং কোন পথিককে যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতো তবে কতই না ভাল হতো! মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তোমাদের সাথে অবস্থান করলেও যুদ্ধ অল্পই করতো। তাদের মন তো মরে গেছে। কাপুরুষতার ঘুণ তাদেরকে ধরে বসেছে। তারা যুদ্ধ করবে কি, কী বীরত্বপনা তারা দেখাবে?
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
📘 Please check ayah 33:22 for complete tafsir.
وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَٰذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ ۚ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا
📘 ২১-২২ নং আয়াতের তাফসীর
এ আয়াত ঐ বিষয়ের উপর বড় দলীল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণের যোগ্য। আহযাবের যুদ্ধে তিনি যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যেমন আল্লাহর পথের প্রস্তুতি, জিহাদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ এবং কাঠিন্যের সময়ও আসমানী সাহায্যের আশা যে তিনি করেছিলেন, এগুলো নিঃসন্দেহে এ যোগ্যতা রাখে যে, মুসলমানরা এগুলোকে জীবনের বিরাট অংশ বানিয়ে নেয়। আর যেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে নিজেদের জন্যে উত্তম নমুনা বানিয়ে নেয় এবং তার গুণাবলী যেন নিজেদের মধ্যে আনয়ন করে। এই কারণেই ভয় ও উদ্বেগ প্রকাশকারী লোকদের জন্যে আল্লাহ পাক কুরআন কারীমে ঘোষণা দেনঃ তোমরা আমার নবী (সঃ)-এর অনুসরণ কর না কেন? আমার রাসূল (সঃ) তো তোমাদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছেন। তার নমুনা তোমাদের সামনে বিদ্যমান ছিল। তোমাদেরকে তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতা অবলম্বনের কথা শুধু শিক্ষাই দিচ্ছেন না বরং কার্যে অটলতা, ধৈর্য এবং দৃঢ়তা তিনি নিজের জীবনেও ফুটিয়ে তুলেছেন। তোমরা যখন আল্লাহর উপর ও কিয়ামতের উপর বিশ্বাসের দাবী করছো তখন তাকে নমুনা বানাতে আপত্তি কিসের?এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর সেনাবাহিনী, খাঁটি মুসলমান এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্য সঙ্গীদের পাকা ঈমানের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, মুমিনরা যখন শত্রুপক্ষীয় ভীরু ও কাপুরুষ সম্মিলিত বাহিনীকে দেখলো তখন তারা বলে উঠলো: এটা তো তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) যার প্রতিশ্রুতি আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) সত্যই বলেছিলেন। আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেলো।খুব সম্ভব আল্লাহর যে ওয়াদার দিকে এতে ইঙ্গিত রয়েছে তা সূরায়ে বাকারার নিম্নের আয়াতটিঃ (আরবি)অর্থাৎ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনো তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি? অর্থ সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল।এমনকি রাসূল এবং তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা বলে উঠেছিলঃ আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? হ্যা, হ্যা, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (২:২১৪) অর্থাৎ এটা তো পরীক্ষা মাত্র। এদিকে তোমরা যুদ্ধে অটল থেকেছো, আর ওদিকে আল্লাহর সাহায্য এসেছে। এজন্যেই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আল্লাহ এবং তার রাসূল (সঃ) সত্য বলেছেন এবং এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেলো। অর্থাৎ তাদের ঈমান পূর্ণ হয়ে গেল এবং আনুগত্য আরো বৃদ্ধি পেলো। ঈমান বেশী হওয়ার একটি দলীল এই আয়াতটি এবং অন্যদের তুলনায় তাঁদের ঈমান বেশী হওয়ারও দলীল। জমহুর ইমামগণও একথাই বলেন যে, ঈমান বাড়ে ও কমে। আমরাও সহীহ বুখারীর শরাহের শুরুতে এটা বর্ণনা করেছি। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা। মহান আল্লাহ তাই বলেনঃ তাদের ঈমান যা ছিল, কঠিন বিপদের সময় তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে গেল।
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ ۖ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا
📘 Please check ayah 33:24 for complete tafsir.
لِيَجْزِيَ اللَّهُ الصَّادِقِينَ بِصِدْقِهِمْ وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ إِنْ شَاءَ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا
📘 ২৩-২৪ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে মুমিন ও মুনাফিকদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, সময় আসার পূর্বে মুনাফিকরা বড় বড় বুলি আওড়িয়ে থাকে কিন্তু যখন সময় এসে যায় তখন। অত্যন্ত ভীরুতা ও কাপুরুষতা প্রদর্শন করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সাথে কৃত ওয়াদা সব ভুলে যায়। সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করার পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে মুমিনরা তাদের ওয়াদা পূর্ণভাবে পালন করে। কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করে এবং কেউ কেউ শাহাদাতের প্রতীক্ষায় থাকে।হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যখন আমি কুরআন মাজীদ লিখতে শুরু করি তখন একটি আয়াত আমি পাচ্ছিলাম না। অথচ সূরায়ে আহযাবে আমি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে তা শুনেছিলাম। অবশেষে হযরত খুযাইমা ইবনে সাবিত আনসারী (রঃ)-এর নিকট আয়াতটি পাওয়া গেল। ইনি ঐ সাহাবী, যাঁর একার সাক্ষ্যকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্যের সমান করে দিয়েছিলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, (আরবি)-এ আয়াতটি হযরত আনাস ইবনে মাযার (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনাটি এই যে, তিনি বদরের যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি বলে মনে অত্যন্ত দুঃখ ও ব্যথা অনুভব করেছিলেন। তার দুঃখের কারণ ছিল এই যে, যে যুদ্ধে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেই যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করতে পারলেন না। সুতরাং তার মত। হতভাগ্য আর কে আছে? তাই তিনি অঙ্গীকার করে বলেনঃ “আবার যদি জিহাদের সুযোগ এসে যায় তবে অবশ্যই আমি আল্লাহ তাআলাকে আমার সত্যবাদিতা ও সৎ সাহসিকতা প্রদর্শন করবো আর এও দেখিয়ে দেবো যে, আমি কি করছি!” অতঃপর যখন উহুদ যুদ্ধের সুযোগ আসলো তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, সামনের দিক হতে হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রাঃ) ফিরে আসছেন। তাকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আবু আমর (রাঃ)! কোথায় যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ! উহুদ পাহাড়ের এই দিক হতে আমি জান্নাতের সুগন্ধ পাচ্ছি।” এ কথা বলেই তিনি সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং মুশরিকদের মধ্যে প্রবেশ করে বহুক্ষণ ধরে তরবারী চালনা করেন। কিন্তু মুসলমানরা সবাই ফিরে গিয়েছিলেন বলে তিনি একা হয়ে গেলেন। তাঁর এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে মুশরিকরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো। অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। তার দেহে আশিটিরও বেশী যখম হয়েছিল। কোনটি ছিল বর্শার যখম এবং কোনটি ছিল তরবারীর যখম। শাহাদাতের পর তাঁকে কেউ চিনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভগ্নী তাঁকে তাঁর হাতের অঙ্গুলীগুলোর অগ্রভাগ দেখে চিনতে পারেন। তার ব্যাপারেই (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, যখন মুসলমানরা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা মুসলমানরা) যা করলো এজন্যে আমি আপনার নিকট ওযর প্রকাশ করছি এবং মুশরিকরা যা করেছে সে জন্যে আমি আপনার নিকট অসন্তোষ প্রকাশ করছি।” তাতে এও রয়েছে যে, হযরত সা'দ (রাঃ) তাকে বলেনঃ “আমি আপনার সাথেই রয়েছি। আমি তার সাথে চলছিলামও বটে। কিন্তু তিনি যা করছিলেন। তা আমার সাধ্যের অতিরিক্ত ছিল।”হযরত তালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ উহুদের যুদ্ধ হতে মদীনায় ফিরে এসে মিম্বরের উপর আরোহণ করেন এবং আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর মুসলমানদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের মর্যাদার বর্ণনা দেন। অতঃপর তিনি (আরবি) এ আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। একজন মুসলমান দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এ আয়াতে যাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাঁরা কারা?” ঐ সময় আমি সামনের দিক হতে আসছিলাম এবং হারামী ও সবুজ রঙ-এর দু'টি কাপড় পরিহিত ছিলাম। আমার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেনঃ “হে প্রশ্নকারী ব্যক্তি! এই লোকটিও তাদের মধ্যে একজন।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)বর্ণিত আছে যে, হযরত মূসা ইবনে তালহা (রাঃ) হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর দরবারে গমন করেন। যখন তিনি তার দরবার হতে ফিরে আসতে উদ্যত হন তখন তিনি তাকে ডেকে বলেনঃ “হে মূসা (রাঃ)! এসো, আমার নিকট হতে একটি হাদীস শুনে যাও। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি। যে, (আরবি)-এই আয়াতে যেসব লোকের বর্ণনা রয়েছে তাদের মধ্যে তোমার পিতা হযরত তালহা (রাঃ) একজন।”এটাও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।এঁদের বর্ণনা দেয়ার পর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আর কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আবার যুদ্ধের সুযোগ আসলে তারা তাদের কাজ আল্লাহকে প্রদর্শন করবে এবং শাহাদাতের পেয়ালা পান করবে। তারা তাদের অঙ্গীকারে কোন পরিবর্তন করেনি। এই ভীতি এবং এই সন্ত্রাস এই কারণেই ছিল যে, আল্লাহ সত্যবাদীদেরকে পুরস্কৃত করেন তাদের সত্যবাদিতার জন্যে এবং তাঁর ইচ্ছা হলে মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা তাদেরকে ক্ষমা করেন। আল্লাহ তা'আলা হলেন আলেমুল গায়েব। তার কাছে প্রকাশ্য ও গোপনীয় সবই সমান। যা হয়নি তা তিনি তেমনি জানেন যেমন জানেন যা হয়ে গেছে। কিন্তু তার অভ্যাস এই যে, বান্দা কোন কাজ যে পর্যন্ত না করে বসে সে পর্যন্ত তাকে শুধু নিজের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে শাস্তি প্রদান করেন না। যেমন তিনি বলেনঃ (আারবি)অর্থাৎ “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমি জেনে নিই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদের এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি।” (৪৭:৩১) সুতরাং অস্তিত্বের পূর্বের জ্ঞান, তারপর অস্তিত্ব লাভের পরের জ্ঞান উভয়ই আল্লাহ তা'আলার রয়েছে। আর অস্তিত্বে আসার পর হবে পুরস্কার অথবা শাস্তি। যেমন মহান আল্লাহ অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আারবি)অর্থাৎ “অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদেরকে অবহিত করবার নন।” (৩:১৭৯) সুতরাং আল্লাহ তা'আলা এখানে বলেনঃ তার ইচ্ছা হলে তিনি মুনাফিকদেরকে শাস্তি দেন অথবা তাদেরকে ক্ষমা করেন। অর্থাৎ তাদেরকে তিনি খাটি অন্তরে তাওবা করার তাওফীক দেন। ফলে তারা তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে। আল্লাহ তা'আলা তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তাঁর করুণা ও রহমত তার গযব ও ক্রোধের উপর বিজয়ী।
وَرَدَّ اللَّهُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِغَيْظِهِمْ لَمْ يَنَالُوا خَيْرًا ۚ وَكَفَى اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ الْقِتَالَ ۚ وَكَانَ اللَّهُ قَوِيًّا عَزِيزًا
📘 আল্লাহ তা'আলা নিজের ইহসান বা অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি ঝড়-তুফান ও অদৃশ্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে কাফিরদের শক্তি-সাহস সবকিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। তারা কঠিন নৈরাশ্যের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অকৃতকার্য অবস্থায় তারা অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। যদি তারা বিশ্ব শান্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উম্মতের মধ্যে না থাকতো তবে এ ঝড়-তুফান তাদের সাথে ঐ ব্যবহারই করতো যেমন ব্যবহার করেছিল আ’দ জাতির সাথে। যেহেতু বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেছেনঃ যতদিন তুমি তাদের মধ্যে অবস্থান করবে ততদিন আল্লাহ তাদের উপর সাধারণ আযাব নাযিল করবেন না, সেহেতু তিনি তাদেরকে তাদের দুষ্টামির স্বাদ গ্রহণ করালেন তাদের একতাকে ভেঙ্গে দিয়ে, তাদেরকে তিনি ছিন্ন ভিন্ন করে দিলেন এবং নিজের আযাব সরিয়ে নিলেন। তাদের একতাবদ্ধতা তাদের প্রবৃত্তি প্রসূত ছিল বলে ঝড়-তুফানই তাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিলো। যারা চিন্তা-ভাবনা করে এসেছিল তারাও সবাই মাটির সাথে মিশে গেল। কোথায় গেল তাদের গনীমতের মাল এবং কোথায় গেল তাদের বিজয়! তাদের জীবনের উপর মরিচা পড়ে গেল। তারা হাতে হাত মলতে লাগলো; দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলো। ঘুরানো চক্রে আপতিত হয়ে অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে উদ্দেশ্য সাধন ছাড়াই অকৃতকার্য হয়ে তারা ফিরে গেল। দুনিয়ার ক্ষতি তাদের পৃথকভাবে হলো এবং আখিরাতের শাস্তি তো পৃথকভাবে আছেই। কেননা, কেউ যদি কোন কাজ করার নিয়ত করে এবং তা কার্যে পরিণত করে, তবে সে তাতে কৃতকার্য হালে আর নাই হালে, পাপ তার হবেই। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হত্যা ও তার দ্বীনকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ইত্যাদি সব কিছুই তারা করেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা উভয় জগতের বিপদ তাদের উপর আপতিত করে তাদের অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন এবং তাদেরকে ব্যর্থ মনোরথ করে ফিরিয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের পক্ষ থেকে তাদের মুকাবিলা করেন। মুসলমানরা না তাদের সাথে লড়েছে, না তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে। বরং মুসলমানরা তাদের জায়গাতেই অবস্থান করেছে। আর কাফির ও মুশরিকরা এমনিতেই পলায়ন করেছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সেনাবাহিনীর মর্যাদা রক্ষা করলেন, নিজের বান্দাদের তিনি সাহায্য করলেন এবং নিজেই তিনি যথেষ্ট হয়ে গেলেন। এজন্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন মা'বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর ওয়াদা সত্য, তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, তার সেনাবাহিনীর মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন, সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হলো এবং এরপরে আর কিছুই নেই। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে তাখরীজ করেছেন)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আহযাবের যুদ্ধে দু'আ করেছিলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে কিতাব অবতীর্ণকারী, হে তাড়াতাড়ি হিসাব গ্রহণকারী! সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করুন এবং তাদেরকে আন্দোলিত ও প্রকম্পিত করুন।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)মহান আল্লাহ বলেনঃ “যুদ্ধে মুমিনদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। এতে একটি অতি সূক্ষ্ম কথা এই আছে যে, মুসলমানরা শুধু এই যুদ্ধ হতেই মুক্ত হননি, বরং আগামীতে সদা-সর্বদার জন্যে সাহাবীগণ (রাঃ) যুদ্ধ হতে মুক্তি লাভ করেছিলেন। মুশরিকরা আর তাঁদের উপর আক্রমণ করার সাহস কখনো করেনি। ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, আহযাবের যুদ্ধের পর কাফিরদের এ সাহস হয়নি যে, তারা মদীনার উপর অথবা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কোন স্থান হতে আক্রমণ করে। তাদের এ অপবিত্র পদক্ষেপ হতে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে এবং তার বাসস্থান ও আরামের জায়গাকে সুরক্ষিত রেখেছেন। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে। বরং অপরপক্ষে মুসলমানরা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি আল্লাহ তা'আলা আরব উপমহাদেশ হতে শিরক ও কফরী সমলে উৎপাটিত করেছেন। যখন কাফিররা এ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করে। তখনই রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বলেছিলেনঃ “এ বছরের পর কুরায়েশরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। বরং তোমরাই তাদের সাথে যুদ্ধ করবে।” তাই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মক্কা বিজিত হলো। আল্লাহর শক্তির মুকাবেলা করা বান্দার সাধ্যাতীত। আল্লাহকে কেউই পরাজিত করতে পারে না। তিনিই স্বীয় শক্তি ও সাহায্যবলে ঐ সম্মিলিত বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিলেন। তাদের নাম নেয়ার মত কেউই থাকলো না। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বিজয় দান করলেন এবং স্বীয় ওয়াদাকে সত্য করে দেখালেন। তিনি স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সাহায্য করলেন। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই জন্যে।
وَأَنْزَلَ الَّذِينَ ظَاهَرُوهُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِنْ صَيَاصِيهِمْ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ فَرِيقًا تَقْتُلُونَ وَتَأْسِرُونَ فَرِيقًا
📘 Please check ayah 33:27 for complete tafsir.
وَأَوْرَثَكُمْ أَرْضَهُمْ وَدِيَارَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ وَأَرْضًا لَمْ تَطَئُوهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرًا
📘 ২৬-২৭ নং আয়াতের তাফসীর
ইতিপূর্বে আমরা বর্ণনা করেছি যে, যখন মুশরিক ও ইয়াহূদীদের সেনাবাহিনী মদীনায় আসে ও অবরোধ সৃষ্টি করে তখন বানু কুরাইযা গোত্রের ইয়াহুদীরা যারা মদীনার অধিবাসী ছিল এবং যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চুক্তি হয়েছিল, তারাও ঠিক এই সময় বিশ্বাসঘাতকতা করলো এবং সন্ধি ভেঙ্গে দিলো। তারা চোখ রাঙাতে শুরু করলো। তাদের সরদার কাব ইবনে আসাদ আলাপ আলোচনার জন্য আসলো। ম্লেচ্ছ হুয়াই ইবনে আখতাব ঐ সরদারকে সন্ধি ভঙ্গ করতে উদ্বুদ্ধ করলো। প্রথমে সে সন্ধি ভঙ্গ করতে সম্মত হলো না। সে এ সন্ধির উপর দৃঢ় থাকতে চাইলো। হুয়াই বললো: “এটা কেমন কথা হলো? আমি তোমাকে সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়ে তোমার মস্তকে রাজ মুকুট পরাতে চাচ্ছি, অথচ তুমি তা মানছো না? কুরায়েশরা ও তাদের অন্যান্য সঙ্গীসহ আমরা সবাই এক সাথে আছি। আমরা শপথ করেছি যে, যে পর্যন্ত না আমরা এক একজন মুসলমানের মাংস ছেদন করবো সে পর্যন্ত এখান হতে সরবো না।” কা'বের দুনিয়ার অভিজ্ঞতা ভাল ছিল বলে সে উত্তর দিলো: “এটা ভুল কথা। এটা তোমাদের ক্ষমতার বাইরে। তোমরা আমাকে লাঞ্ছনার বেড়ী পরাতে এসেছে। তুমি একটা কুলক্ষণে লোক। সুতরাং তুমি আমার নিকট হতে সরে যাও। আমাকে তোমার ধোকাবাজীর শিকারে পরিণত করো না।" হুয়াই কিন্তু তখনো তার পিছন ছাড়লো না। সে তাকে বারবার বুঝাতে থাকলো। অবশেষে সে বললো: “মনে কর যে, কুরায়েশ ও গাতফান গোত্র পালিয়ে গেল, তাহলে আমরা দলবলসহ তোমার গর্তে গিয়ে পড়বো। তোমার ও তোমার গোত্রের যে দশা হবে, আমার ও আমার গোত্রেরও সেই দশাই হবে।"অবশেষে কাবের উপর হুয়াই-এর যাদু ক্রিয়াশীল হলো। বানু কুরাইযা সন্ধি ভঙ্গ করলো। এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবীগণ (রাঃ) অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং এটা তাঁদের কাছে খুবই কঠিন ঠেকলো। আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদের সাহায্য করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণ সমভিব্যাহারে বিজয়ীর বেশে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। সাহাবীগণ (রাঃ) অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহও (সঃ) অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)-এর গৃহে ধূলো-ধূসরিত অবস্থায় হাযির হলেন এবং পাক সাফ হওয়ার জন্যে গোসল করতে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আবির্ভূত হন। তাঁর মস্তকোপরি রেশমী পাগড়ী ছিল। তিনি খচ্চরের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। ওর পিঠে রেশমী গদি ছিল। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি কি অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলেছেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “ফেরেশতারা কিন্তু এখনো অস্ত্র-শস্ত্র হতে পৃথক হয়নি। আমি কাফিরদের পশ্চাদ্ধাবন হতে এইমাত্র ফিরে এলাম। জেনে রাখুন! আল্লাহর নির্দেশ, বানু কুরাইযার দিকে চলুন! তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দান করুন! আমার প্রতিও মহান আল্লাহর এ নির্দেশ রয়েছে যে, আমি যেন তাদেরকে প্রকম্পিত করি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে যান। নিজে প্রস্তুতি গ্রহণ করে সাহাবীদেরকেও প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা সবাই বানু কুরাইযার ওখানেই আসরের নামায আদায় করবে। যুহরের নামাযের পর এ হুকুম দেয়া হলো। বানু কুরাইযার দুর্গ মদীনা হতে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। পথেই নামাযের সময় হয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ নামায আদায় করে নিলেন। তাঁরা বললেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল যে, তারা যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসেন।” আবার কেউ কেউ বললেনঃ “আমরা সেখানে না পৌঁছে নামায পড়বো না।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ খবর জানতে পেরে দু’দলের কাউকেই তিনি ভৎসনা বা তিরস্কার করলেন না। তিনি ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ)-কে মদীনার খলীফা নিযুক্ত করলেন। সেনাবাহিনীর পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে প্রদান করলেন। তিনি নিজেও সৈন্যদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন। সেখানে গিয়েই তিনি তাদের দুর্গ অবরোধ করে ফেললেন। পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ স্থায়ী হলো। যখন ইয়াহূদীদের দম নাকে এসে গেল তখন তাদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠলো। তারা হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রাঃ)-কে নিজেদের সালিশ বা মীমাংসাকারী নির্ধারণ করলো। কারণ তিনি আউস গোত্রের সরদার ছিলেন। বানু কুরাইযা ও আউস গোত্রের মধ্যে যুগ-যুগ ধরে বন্ধুত্ব ও মিত্রতা চলে আসছিল। তারা একে অপরের সাহায্য করতো। তাদের ধারণা ছিল যে, হযরত সা'দ (রাঃ) তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল্ল বানু কাইনুকা গোত্রকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল। এদিকে হযরত সা'দ (রাঃ)-এর দেহে একটি তীর বিদ্ধ হয়েছিল, যার কারণে সেখান হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার ক্ষতস্থানে দাগ লাগিয়েছিলেন এবং মসজিদের তাঁবুতে তাঁর স্থান করেছিলেন। যাতে তাঁকে দেখতে যাওয়ার সুবিধা হয়। হযরত সা'দ (রাঃ) যে দু'আ করেছিলেন তন্মধ্যে একটি দু'আ এও ছিলঃ “হে আমার প্রতিপালক। যদি আরো কোন যুদ্ধ আপনার নবী (সঃ)-এর উপর থেকে থাকে যেমন কাফির মুশরিকরা আপনার নবী (সঃ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, তবে আমাকে জীবিত রাখুন, যেন আমি তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি। আর যদি কোন যুদ্ধ অবশিষ্ট না থেকে থাকে তবে আমার ক্ষতস্থান হতে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকুক। কিন্তু হে আমার প্রতিপালক! যে পর্যন্ত না আমি বানু কুরাইযা গোত্রের বিদ্রোহের পূর্ণ শাস্তি দেখে আমার চক্ষুদ্বয় ঠাণ্ডা করতে পারি সে পর্যন্ত আমার মৃত্যুকে বিলম্বিত করুন। হযরত সা'দ (রাঃ)-এর প্রার্থনা কবুল হওয়ার দৃশ দেখে বিস্মিত হতে হয়। তিনি এদিকে প্রার্থনা করছেন, আর ওদিকে বানু কুরাইযা গোত্র স্বীকার করে নিয়েছে যে, হযরত সা'দ (রাঃ) তাদের যে মীমাংসা করবেন তা তারা মেনে নেবে এবং তাদের দুর্গ মুসলমানদের হাতে সমর্পণ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত সা'দ (রাঃ)-এর নিকট সংবাদ পাঠালেন যে, তিনি যেন এসে তাদেরকে তার ফায়সালা শুনিয়ে দেন।হযরত সা'দ (রাঃ)-কে গাধার উপর সওয়ার করিয়ে নিয়ে আসা হলো। আউস গোত্রের সমস্ত লোক তাকে জড়িয়ে ধরে বললো: “দেখুন, বানু কুরাইযা গোত্র আপনারই লোক। তারা আপনার উপর ভরসা করেছে। তারা আপনার কওমের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সুতরাং আপনি তাদের উপর দয়া করুন এবং তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করুন!” হযরত সা'দ (রাঃ) নীরব ছিলেন। তাদের কথার কোন জবাব তিনি দিচ্ছিলেন না। তারা তাকে উত্তর দেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো এবং তার পিছন ছাড়লো না। অবশেষে তিনি বললেনঃ “ঐ সময় এসে গেছে, হযরত সা’দ এটা প্রমাণ করতে চান যে, আল্লাহর পথে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের তিনি কোন পরওয়া করবেন না। তাঁর এ কথা শোনা মাত্রই ঐ লোকগুলো হতাশ হয়ে পড়লো যে, বানু কুরাইযা গোত্রের কোন রেহাই নেই। যখন হযরত সা'দ (রাঃ)-এর সওয়ারী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁবুর নিকট আসলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা তোমাদের সরদারের অভ্যর্থনার জন্যে দাঁড়িয়ে যাও।” তখন মুসলমানরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাকে সওয়ারী হতে নামানো হলো। এরূপ করার কারণ ছিল এই যে, ঐ সময় তিনি ফায়সালাকারীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ঐ সময় তার ফায়সালাই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে। তিনি উপবেশন করা মাত্রই রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “বানু কুরাইযা গোত্র তোমার ফায়সালা মেনে নিতে সম্মত হয়েছে এবং দুর্গ আমাদের হাতে সমর্পণ করেছে। সুতরাং তুমি এখন তাদের ব্যাপারে ফায়সালা দিয়ে দাও।” হযরত সা'দ (রাঃ) বললেনঃ “তাদের ব্যাপারে আমি যা ফায়সালা করবো তাই কি পূর্ণ করা হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “নিশ্চয়ই।” তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেনঃ “এই তাঁবুবাসীদের জন্যেও কি আমার ফায়সালা মেনে নেয়া জরুরী হবে?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই।” আবার তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “এই দিকের লোকদের জন্যেও কি?” ঐ সময় তিনি ঐ দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন যেই দিকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইজ্জত ও বুযর্গীর খাতিরে তিনি তাঁর দিকে তাকালেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “হ্যা, এই দিকের লোলেদের জন্যেও এটা মেনে নেয়া জরুরী হবে।” তখন হযরত সা'দ (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে এখন আমার ফায়সালা শুনুন! বানু কুরাইযার মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মত যত লোক রয়েছে তাদের সবাইকেই হত্যা করে দেয়া হবে। তাদের শিশু সন্তানদেরকে বন্দী করা হবে এবং তাদের ধন-সম্পদ মুসলমানদের অধিকারভুক্ত হবে।” তাঁর এই ফায়সালা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! তুমি এ ব্যাপারে ঐ ফায়সালাই করেছে যা আল্লাহ তা'আলা সপ্তম আকাশের উপর ফায়সালা করেছেন। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহর যে ফায়সালা সেই ফায়সালাই তুমি শুনিয়েছো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে গর্ত খনন করা হয় এবং বানু কুরাইযা গোত্রের লোকদেরকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় হত্যা করে তাতে নিক্ষেপ করা হয়। তাদের সংখ্যা ছিল সাতশ’ বা আটশ'। তাদের নারীদেরকে ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদেরকে এবং তাদের সমস্ত মালধন হস্তগত করা হয়। আমি এসব ঘটনা আমার ‘কিতাবুস সিয়ার’ গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'আলারই জন্যে।তাই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ কিতাবীদের মধ্যে যারা তাদেরকে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে তিনি তাদের দুর্গ হতে অবতরণে বাধ্য করলেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করছে এবং কতককে করছো বন্দী। এই বানু কুরাইযা গোত্রের বড় নেতা, যার দ্বারা এই বংশ চালু হয়েছিল, পূর্ব যুগে এ আশায় সে হিজাযে এসে বসতি স্থাপন করেছিল যে, যে শেষ নবী (সঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী তাদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, তিনি যেহেতু হিজায প্রদেশে আবির্ভূত হবেন, সেহেতু তারা যেন সর্বপ্রথম তাঁর আনুগত্যের মর্যাদা লাভ করতে পারে। কিন্তু শেষ নবী (সঃ)-এর যখন আগমন ঘটলো তখন তার অযোগ্য উত্তরসূরীরা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো। যার ফলে তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হলো।(আরবি) দ্বারা দুর্গকে বুঝানো হয়েছে। এই কারণে জন্তুর মাথার শিংকেও (আরবি) বলা হয়। কেননা, জন্তুদের দেহের সবচেয়ে উপরে শিংই থাকে। আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি করে দিলেন। তারাই মুশরিকদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। শিক্ষিত ও মূর্খ কখনো সমান হয় না। তারাই মুসলমানদেরকে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘটনা তার বিপরীত হয়ে গেল। শক্তি দুর্বলতায় এবং সফলতা বিফলতায় পরিবর্তিত হলো। চিত্র নষ্ট হয়ে গেল। মিত্ররা পলায়ন করলো এবং তারা একেবারে অসহায় হয়ে পড়লো। সম্মানের জায়গা অসম্মান দখল করে নিলো। মুসলমানদেরকে দুনিয়া হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আনন্দ তাদের নিজেদেরকেই নিশ্চিহ্ন করে দিলো। এরপর আখিরাতের পালা তো আছেই। তাদের কিছু সংখ্যককে হত্যা করে দেয়া হলো। আতিয়্যা কারামী বর্ণনা করেছে, যখন আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে হাযির করা হলো তখন তিনি বললেনঃ “দেখো, যদি এর নাভীর নীচে চুল গজিয়ে থাকে তবে একে হত্যা করে দেবে। অন্যথায় একে বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত করবে।” দেখা গেল যে, তখনো আমার শৈশবকাল কাটেনি। সুতরাং জীবিত ছেড়ে দেয়া হলো।মুসলমানদেরকে তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী ও ধন-সম্পদের অধিকারী করে দেয়া হলো। এমনকি তাদেরকে ঐ ভূমির মালিক করে দেয়া হলো যা তখনো পদানত হয়নি। অর্থাৎ খাইবারের ভূমি অথবা মক্কা শরীফের ভূমি কিংবা পারস্য অথবা রোমের ভূমি। কিংবা হতে পারে যে, সব জায়গারই ভূমি। অর্থাৎ সব জমিই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “খন্দকের যুদ্ধের দিন আমি বের হলাম, আমার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবস্থা অবহিত হওয়া। এমন সময় আমার পিছন দিক থেকে কারো সবেগে আগমনের আভাষ পেলাম। তার অস্ত্রের ঝনঝনানীর শব্দও আমার কানে এলো। আমি তখন রাস্তা হতে সরে গিয়ে এক জায়গায় বসে পড়লাম। দেখলাম যে, হযরত সা'দ (রাঃ) সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছেন। তার সাথে তাঁর ভাই হারিস ইবনে আউস (রাঃ)-ও ছিলেন। তাঁর হাতে ঢাল ছিল। হযরত সা'দ (রাঃ) লৌহবর্ম পরিহিত ছিলেন। তিনি খুবই লম্বা দেহ বিশিষ্ট লোক ছিলেন বলে তাঁর দেহ বর্মে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত হয়নি। তাঁর হাত খোলা ছিল। যুদ্ধের কবিতা পাঠ করতে করতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি সেখান হতে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। একটি বাগানে আমি প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছু মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। একটি লোক লৌহ-শিরস্ত্রাণ পরিহিত ছিলেন। ঐ লোকদের মধ্যে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-ও বিদ্যমান ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে ফেলেছিলেন এবং এ কারণে তিনি আমার উপর অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে বীরাঙ্গনা! আপনি কি জানেন না যে, যুদ্ধ চলছে? আল্লাহ তাআলাই জানেন পরিণতি কি হবে! আপনি কি করে এখানে আসতে পারলেন? ইত্যাদি অনেক কিছু বলে তিনি আমাকে ভৎসনা করলেন। তিনি আমাকে এতো বেশী তিরস্কার করলেন যে, যদি যমীন ফেটে যেতো তবে আমি তাতে ঢুকে পড়তাম। যে লোকটি মুখ ঢেকে ছিলেন তিনি হযরত উমারের এসব কথা শুনে মাথা হতে লোহার টুপি নামিয়ে ফেললেন। তখন আমি তাকে দেখে চিনতে পারলাম। তিনি ছিলেন হযরত তালাহা ইবনে উবাইদিল্লাহ (রাঃ)। তিনি হযরত উমার (রাঃ)-কে নীরব করিয়ে দিয়ে বললেনঃ “কি ভৎসনা করছেন? পরিণামের জন্যে কি ভয়? আপনি এতো ভয় করছেন কেন? কেউ যদি পালিয়ে যায় তবে সে যাবে কোথায়? সবকিছুই আল্লাহর হাতে।” একজন কুরায়েশী হযরত সা'দ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে তীর মেরে দিলো এবং বললো: “আমি হলাম ইবনে আরকা।” হযরত সা’দ (রাঃ)-এর রক্তবাহী শিরায় তীরটি বিদ্ধ হয়ে গেল এবং রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। ঐ সময় তিনি দু'আ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার মৃত্যু ঘটাবেন না যে পর্যন্ত না আমি বানু কুরাইযা গোত্রের ধ্বংস স্বচক্ষে দেখে যেতে পারি।” আল্লাহ তাআলার কি মাহাত্ম্য যে, তৎক্ষণাৎ তার ক্ষতস্থানের রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। ঝড়-তুফান মুশরিকদেরকে তাড়িয়ে দিলো। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর সদয় হলেন। আবু সুফিয়ান এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তেহামায় পালিয়ে গেল। উয়াইনা ইবনে বদর এবং তার সঙ্গীরা পালিয়ে গেল নজদের দিকে। বানু কুরাইযা গোত্র তাদের দুর্গে আশ্রয় নিলো। যুদ্ধক্ষেত্র শূন্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় ফিরে গেলেন। হযরত সা'দ (রাঃ)-এর জন্যে মসজিদে নববীতেই একটা তাঁবুর ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। ঐ সময়েই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আসলেন। তার চেহারা ধূলিময় ছিল। তিনি বলতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়েছেন? ফেরেশতারা কিন্তু এখনো অস্ত্র-শস্ত্র খুলে ফেলেননি। চলুন, বানু কুরাইযার ব্যাপারেও একটা ফায়সালা করে নেয়া হালে। তাদের উপর আক্রমণ চালানো হালে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৎক্ষণাৎ অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হলেন এবং সাহাবীদেরকেও যুদ্ধযাত্রার নির্দেশ প্রদান করলেন। বানু তামীম গোত্রের ঘরবাড়ী মসজিদে নববী সংলগ্ন ছিল। পথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আচ্ছা ভাই! এখান দিয়ে কাউকেও যেতে দেখেছো কি?” তারা উত্তরে বললো: “এখনই হযরত দাহইয়া কালবী (রাঃ) গেলেন।” অথচ উনিই তো ছিলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ)। তাঁর দাড়ী এবং চেহারা সম্পূর্ণরূপে হযরত দাহইয়া কালবী (রাঃ)-এর সাথে সাদৃশ্যযুক্ত ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) গিয়ে বানু কুরাইযার দুর্গ অবরোধ করে বসলেন। পঁচিশ দিন পর্যন্ত এই অবরোধ স্থায়ী হলো। যখন তারা অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় পতিত হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বললেনঃ “দুর্গ আমাদের হাতে ছেড়ে দাও এবং তোমরা নিজেরাও আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। আমি তোমাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা ফায়সালা করবো।” তারা আবু লুবাবা আব্দুল মুনযিরের সাথে পরামর্শ করলো। সে ইঙ্গিতে বললো: “এ অবস্থায় তোমরা জীবনের আশা পরিত্যাগ কর।” তারা এটা জানতে পেরে এতে অসম্মতি জানালো। তারা বললো: “আমরা আমাদের দুর্গ শূন্য করে দিচ্ছি এবং এটা আপনার সেনাবাহিনীর হাতে সমর্পণ করছি। আমাদের ব্যাপারে আমরা হযরত সা'দ (রাঃ)-কে আমাদের ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নিচ্ছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেলেন। তিনি হযরত সা'দ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। তিনি গাধার উপর সওয়ার হয়ে আসছিলেন যার উপর খেজুর গাছের বাকলের গদি ছিল। তাঁকে অতি কষ্টে ওর উপর সওয়ার করে দেয়া হয়। তাঁর কওম তাকে ঘিরে ফেলেছিল। তারা তাকে বুঝাচ্ছিলঃ “দেখুন, বানু কুরাইযা আমাদের মিত্র। তারা আমাদের বন্ধু। সুখে-দুঃখে তারা আমাদের সাথী। তাদের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তা আপনার অজানা নয়।” হযরত সা'দ (রাঃ) নীরবে তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। যখন তিনি তাদের মহল্লায় পৌছেন তখন ঐদিকে দৃষ্টিপাত করে বলেনঃ “এখন এমন সময় এসে গেছে যখন আমি আল্লাহর পথে কোন ভৎসনাকারীর ভৎসনাকে মোটেই পরওয়া করবো না।” যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁবুর নিকট হযরত সা'দ (রাঃ)-এর সওয়ারী পৌছলো তখন তিনি স্বীয় সাহাবীদেরকে বললেনঃ “তোমাদের সাইয়্যেদের জন্যে উঠে দাঁড়াও এবং তাঁকে নামিয়ে নাও।” এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আমাদের সাইয়্যেদ তো স্বয়ং আল্লাহ।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তাঁকে নামিয়ে নাও।” সবাই তখন মিলে জুলে তাঁকে সওয়ারী হতে নামিয়ে নিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “হে সা'দ (রাঃ)! তাদের ব্যাপারে তুমি যে ফায়সালা করতে চাও, কর।” তিনি তখন বললেনঃ “তাদের বড়দেরকে হত্যা করা হালে, ছোটদেরকে গোলাম বানিয়ে নেয়া হালে এবং তাদের মালধন বন্টন করে নেয়া হালে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার এ ফায়সালা শুনে বললেনঃ “হে সা’দ (রাঃ)! এই ফায়সালায় তুমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুকূল্য করেছো।” অতঃপর হযরত সা'দ (রাঃ) প্রার্থনা করেনঃ “হে আল্লাহ! যদি আপনার নবী (সঃ)-এর উপর কুরায়েশদের আর কোন আক্রমণ বাকী থেকে থাকে তবে তাতে অংশগ্রহণের জন্যে আমাকে জীবিত রাখুন। অন্যথায় আমাকে আপনার নিকট উঠিয়ে নিন।” তৎক্ষণাৎ তাঁর ক্ষতস্থান হতে রক্তের ফোয়ারা ছুটতে শুরু করলো। অথচ ওটা সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়েই গিয়েছিল। সামান্য কিছু বাকী ছিল। সুতরাং তাকে তার তাঁবুতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সেখানেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ), হযরতআবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) প্রমুখ মহান ব্যক্তিগণও আসলেন। তাঁরা সবাই কাঁদছিলেন। আমি হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ)-এর ক্রন্দনের শব্দ পৃথক পৃথকভাবে বুঝতে পারছিলাম। আমি ঐ সময় আমার কক্ষে ছিলাম। সত্যিই তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহচরই ছিলেন। যেমন মহান আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেনঃ (আারবি) অর্থাৎ “তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।” (৪৮:২৯)হযরত আলকামা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূলুল্লাহ (সঃ) কিভাবে কাঁদতেন তা বলুন তো?” উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ “কারো জন্যে তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরতো না। তবে, দুঃখ ও বেদনার সময় তিনি স্বীয় দাড়ি মুবারক স্বীয় মুষ্টির মধ্যে নিয়ে নিতেন।”
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا
📘 Please check ayah 33:29 for complete tafsir.
وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا
📘 ২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন তাঁর সহধর্মিণীদেরকে দুটি জিনিসের একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেন। যদি তারা পার্থিব জগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সৌন্দর্য ও আঁক-জমক পছন্দ করে তবে তিনি যেন তাদেরকে তাঁর বিবাহ-সম্পর্ক হতে বিচ্ছিন্ন করে দেন। আর যদি দুনিয়ার অভাব অনটনে ধৈর্য ধারণ করতঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সুখ-শান্তি কামনা করে তবে যেন তারা তাঁর সাথে ধৈর্য অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করে। আল্লাহ তা'আলা সমস্ত নিয়ামত দ্বারা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখবেন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের মাতা নবী (সঃ)-এর সমস্ত সহধর্মিণীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তাঁরা সবাই আল্লাহকে, তাঁর রাসূল (সঃ)-কে এবং আখিরাতকেই পছন্দ করে নেন। ফলে মহান আল্লাহ তাদের সবারই উপর খুশী হন। অতঃপর তিনি তাদেরকে আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়ার আনন্দ ও সুখ-শান্তিও দান করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণী হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবী (সঃ) তাঁর নিকট আগমন করেন এবং বলেনঃ “আমি তোমাকে একটি কথা বলতে চাই। তুমি তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করো না। বরং পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করে উত্তর দাও।” তিনি বলেনঃ “তিনি তো অবশ্যই জানেন যে, আমার পিতা-মাতা যে তার বিবাহ বন্ধন হতে বিচ্ছিন্ন হবার পরামর্শ আমাকে দেবেন এটা অসম্ভব। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করে আমাকে শুনিয়ে দেন। আমি উত্তরে তাকে বললাম, এ ব্যাপারে আমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করার কিছুই নেই। আমার আল্লাহ কাম্য, তাঁর রাসূল (সঃ) কাম্য এবং আখিরাতের সুখ-শান্তিই কাম্য। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অন্যান্য সমস্ত স্ত্রী আমার মতই কথা বলেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ “দেখো, তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ করা ছাড়া তুমি নিজেই কোন ফায়সালা করে ফেললা না।” অতঃপর আমার জবাব শুনে তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে যান এবং হেসে ওঠেন। তারপর তিনি তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে যান এবং তাদেরকে পূর্বেই বলেছেন যে, আয়েশা (রাঃ) এ কথা বলেছে। তারা তখন বলেন যে, তাদেরও জবাব এটাই।হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “এই ইখতিয়ার প্রদানের পর আমরা যে তাঁকেই গ্রহণ করলাম, সুতরাং এটা তালাকের মধ্যে গণ্য হলো না।” হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। জনগণ তাঁর দরযার উপর উপবিষ্ট ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভিতরে অবস্থান করছিলেন। তিনি প্রবেশের অনুমতি পাননি এমতাবস্থায় হযরত উমার (রাঃ) এসে পড়েন। তিনিও অনুমতি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু অনুমতি পেলেন না। কিছুক্ষণ পর দু’জনকেই অনুমতি দেয়া হলো। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পান যে, তার স্ত্রীরা তার পার্শ্বে বসে আছে এবং তিনি নীরব হয়ে আছেন। হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “দেখো, আমি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে হাসিয়ে দিচ্ছি।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি দেখতেন যে, আজ আমার স্ত্রী আমার কাছে টাকা-পয়সা চাইলো। আমার কাছে টাকা-পয়সা ছিল না। যখন কঠিন জিদ করতে লাগলো তখন আমি উঠে গিয়ে গর্দান মাপলাম।” এ কথা শুনেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠলেন এবং বলতে লাগলেনঃ “এখানেও এ ব্যাপারই ঘটেছে। দেখুন, এরা সবাই আমার কাছে ধন-মাল চাইতে শুরু করেছে!” এ কথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর দিকে এবং হযরত উমার (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-এর দিকে ধাবিত হলেন এবং বললেনঃ “বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর কাছে এমন কিছু চাচ্ছ যা তাঁর কাছে নেই?””ভাগ্য ভাল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের দু’জনকে থামিয়ে দিলেন। নতুবা তাঁরা যে নিজ নিজ কন্যাকে প্রহার করতেন এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। তখন তার সব স্ত্রীই বলতে লাগলেনঃ “আমাদের অপরাধ হয়েছে। আর কখনো আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এমনভাবে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলবো না।” অতঃপর এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হলো। সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর নিকট গমন করলেন। তিনি আখিরাতকেই পছন্দ করলেন যেমন উপরে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হলো। সাথে সাথে হযরত আয়েশা (রাঃ) আবেদন জানালেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি যে আপনাকে গ্রহণ করলাম এ কথাটি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীকে বলবেন না।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহ আমাকে গোপনকারী রূপে প্রেরণ করেননি। বরং আমাকে শিক্ষাদাতা ও সহজকারী রূপে প্রেরণ করা হয়েছে। আমাকে যে যা বলবে, আমি তাকে সঠিক ও পরিষ্কারভাবেই উত্তর দেবো।হযরত আলী (রাঃ) বলেন, তালাক গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। বরং দুনিয়া বা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর সনদেও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে এবং এটা প্রকাশ্য আয়াতের বিপরীতও বটে। কেননা, প্রথম আয়াতের শেষে স্পষ্টভাবে রয়েছেঃ ‘এসো, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় দিই।”এতে উলামায়ে কিরামের মতভেদ রয়েছে যে, যদি তিনি স্বীয় স্ত্রীদেরকে তালাক প্রদান করেন তবে তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা জায়েয হবে কি কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটা জায়েয হবে, যাতে এই তালাকের ফল তারা পেয়ে যায় অর্থাৎ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ ও সৌন্দর্য কামনা এবং দুনিয়ার সুখ-শান্তি লাভ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ হুকুম স্বীয় সহধর্মিণীদেরকে শুনিয়ে দেন তখন তার নয়জন স্ত্রী ছিলেন। পাঁচজন ছিলেন কুরায়েশ বংশের। তাঁরা হলেনঃ হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ), হযরত উম্মে হাবীবাহ (রাঃ), হযরত সাওদাহ (রাঃ) এবং হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)। আর বাকী চারজন হলেনঃ হযরত সাফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ), তিনি ছিলেন নাযার গোত্রের নারী। হযরত মাইমূনা বিনতে হারিস (রাঃ), তিনি ছিলেন হালালিয়্যাহ গোত্রের নারী। হযরত যয়নব বিনতে জহশ (রাঃ), তিনি ছিলেন আসাদিয়্যাহ গোত্রের নারী। যুওয়াইরিয়্যাহ বিনতে হারিস (রাঃ), তিনি ছিলেন মুসতালিক গোত্রের নারী।
وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا
📘 মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হযরত যির (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “সূরায়ে আহযাবের কতটি আয়াত গণনা করা হয়?" উত্তরে তিনি বলেনঃ “ তেহাত্তরটি।” তখন হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) বলেনঃ “না, না। আমি তো দেখেছি যে, এ সূরাটি প্রায় সূরায়ে বাকারার সমান ছিল। এই সূরার মধ্যেই নিম্নের আয়াতটিও আমরা পাঠ করতামঃ (আরবি)অর্থাৎ “বুড়ো ও বুড়ী যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে তোমরা তাদেরকে অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে হত্যা করে ফেললো, এটা হলো আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি এবং আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়।” এর দ্বারা জানা যায় যে, এই সূরার। কতকগুলো আয়াত আল্লাহর নির্দেশক্রমে রহিত হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর
সতর্ক করার সুন্দর পন্থা এই যে, বড়দেরকে বলতে হবে যাতে ছোটরা তা শুনে সাবধান হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে যখন কোন কথা গুরুত্বের সাথে বলেন তখন বুঝে নিতে হবে যে, অন্যের জন্যে এর গুরুত্ব আরো বেশী। আল্লাহর হিদায়াত অনুযায়ী পুণ্য লাভ করার নিয়তে তাঁর ফরমানের আনুগত্য করা এবং তাঁর ফরমান অনুযায়ী তার শাস্তি থেকে বাচার উদ্দেশ্যে তাঁর নাফরমানী পরিত্যাগ করার নাম হলো তাকওয়া। আর কাফির ও মুনাফিকদের কথা না মানা, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ না করা এবং স্বীকার করে নেয়ার নিয়তে তাদের কথা না শোনার নামও তাকওয়া। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী তো। একমাত্র আল্লাহ। তিনি তাঁর প্রশস্ত ও ব্যাপক জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যেক কাজের ফুল বা পরিণাম সম্যক অবগত। তার সীমাহীন হিকমতের কারণে তার কোন কাজ, কোন কথা বিবেচনা ও নীতি বহিভূর্ত হয় না। তাই তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ অতএব তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অহী করা হয় তুমি তারই অনুসরণ কর, যাতে তুমি খারাপ পরিণতি ও বিভ্রান্তি হতে বাঁচতে পার। আল্লাহ তা'আলার কাছে কারো ক্রিয়াকলাপ গোপন নেই। নিজের সমস্ত কাজকর্মে শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা কর। তার উপর যে ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট হন। কারণ তিনি সমস্ত কাজের উপর পূর্ণ শক্তিশালী। তাঁর প্রতি যে আকৃষ্ট হয় বা তাঁর দিকে যে ঝুঁকে পড়ে সে সফলকামই হয়ে থাকে।
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ ۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا
📘 রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীরা অর্থাৎ মুমিনদের মাতারা যখন আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং আখিরাতকে পছন্দ করলেন তখন মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাঁদেরকে উপদেশ দিচ্ছেনঃ হে নবী-সহধর্মিণীরা! তোমাদের কাজ কারবার সাধারণ নারীদের মত নয়। মনে কর, যদি তোমরা নবী (সঃ)-এর অবাধ্যাচরণ কর কিংবা তোমাদের দ্বারা কোন নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ সংঘটিত হয়ে যায় তবে জেনে রেখো যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে। কেননা, মর্যাদার দিক দিয়ে তোমরা সাধারণ নারীদের হতে বহু উর্ধে। সুতরাং পাপকার্য হতে তোমাদের সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা উচিত। অন্যথায় মর্যাদা অনুপাতে তোমাদের শাস্তিও বহুগুণে বেশী হবে। আল্লাহ তা'আলার কাছে সবকিছুই সহজ।এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, এ কথাগুলো শর্তের উপর বলা হয়েছে এবং শর্ত হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! যদি তুমি শিরক কর তবে অবশ্যই তোমার আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে।” (৩১:৬৫) অন্য এক জায়গায় নবীদের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যদি তারা শিরক করে তবে তাদের আমলগুলো অবশ্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে।” (৬:৮৯) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)অর্থাৎ “যদি রহমানের (আল্লাহর) সন্তান হতো তবে আমিই হতাম সর্বপ্রথম ইবাদতকারী।” (৩৯:৮১) আর একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)অর্থাৎ “যদি আল্লাহ সন্তান গ্রহণের ইচ্ছা করতেন তবে তিনি স্বীয় সৃষ্টজীবের মধ্য হতে যাকে পছন্দ করতেন সন্তান বানিয়ে নিতেন। তিনি তো পবিত্র, একক, বিজয়ী এবং সবারই উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।” (৩৯:৮) সুতরাং এ পাঁচটি আয়াতে শর্তের সাথে বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এরূপ হয়নি। না নবীদের দ্বারা শিরকের কাজ হয়েছে, না নবীদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দ্বারা শিরকের কাজ সম্ভব, না আল্লাহ তা'আলার সন্তান গ্রহণ সম্ভব। অনুরূপভাবে নবী-সহধর্মিণী ও মুমিনদের মাতাদের সম্পর্কে যে বলা হয়েছেঃ যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অশ্লীল কাজ করে বসে তবে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে, এর দ্বারা এটা মনে করা যাবে না যে, তাঁদের মধ্যে কেউ কখনো এরূপ কোন বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ করেছেন। নাঊযুবিল্লাহ!
۞ وَمَنْ يَقْنُتْ مِنْكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ وَتَعْمَلْ صَالِحًا نُؤْتِهَا أَجْرَهَا مَرَّتَيْنِ وَأَعْتَدْنَا لَهَا رِزْقًا كَرِيمًا
📘 এই আয়াতে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় ন্যায়পরায়ণতা ও অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ তোমাদেরকে তোমাদের অনুগত ও সকার্যের জন্যে দ্বিগুণ পুরস্কার প্রদান করা হবে। তোমাদের জন্যে জান্নাতে সম্মান জনক আহার্য প্রস্তুত রয়েছে। কেননা, তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে তাঁর বাসস্থানে অবস্থান করবে। আর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর বাসস্থান ইল্লীঈনের উচ্চতম স্থানে অবস্থিত রয়েছে। এটা সমস্ত মানুষের বাসস্থান হতে উঁচুতে রয়েছে। এরই নাম ওয়াসিলা। এটা জান্নাতের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মনযিল যার ছাদ হলো আল্লাহর আরশ।
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا
📘 Please check ayah 33:34 for complete tafsir.
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
📘 Please check ayah 33:34 for complete tafsir.
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا
📘 ৩২-৩৪ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় প্রিয়তম নবী (সঃ)-এর সহধর্মিণীদেরকে আদব-কায়দা ও ভদ্রতা শিক্ষা দিচ্ছেন। সমস্ত স্ত্রীলোক তাদের অধীনস্থ। সুতরাং এই নির্দেশাবলী সমস্ত মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোজ্য। তিনি নবী (সঃ)-এর সহধর্মিণীদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ হে নবী-পত্নীরা! তোমরা অন্যান্য সাধারণ নারীদের মত নও। তাদের তুলনায় তোমাদের মর্যাদা অনেক বেশী। যদি তোমরা আল্লীহূকে ভয় কর তবে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। স্ত্রীলোকদের পরপুরুষের সাথে কোমল সুরে ও লোভনীয় ভঙ্গিতে কথা বলা নিষিদ্ধ। সুমিষ্ট ভাষায় ও নরম সুরে শুধুমাত্র স্বামীর সাথে কথা বলা যেতে পারে। এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কোন জরুরী কাজকর্ম ছাড়া তোমরা বাড়ী হতে বের হবে না। মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া শরয়ী প্রয়োজন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর বাদীদেরকে আল্লাহ্র মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করো না। কিন্তু তাদের উচিত যে, তারা বাড়ীতে যে সাদাসিধা পোশাক পরে থাকে ঐ পোশাক পরেই যেন মসজিদে গমন করে। অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, স্ত্রীলোকদের জন্যে বাড়ীই উত্তম।হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা স্ত্রীলোকেরা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) ! পুরুষ লোকেরা আল্লাহর পথে জিহাদের ফযীলত নিয়ে যায়। আমাদের জন্যে কি এমন আমল আছে যার দ্বারা আমরা আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সমমর্যাদা লাভ করতে পারি?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যারা নিজেদের বাড়ীতে (পর্দার সাথে) বসে থাকে (অথবা এ ধরনের কথা তিনি বললেন), তারা আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের আমলের মর্যাদা লাভ করবে। (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর আল বায্যার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই স্ত্রীলোক পর্দার বস্তু। এরা যখন বাড়ী হতে বের হয় তখন শয়তান তাদের প্রতি ওঁৎ পেতে থাকে। তারা আল্লাহ্ তা'আলার খুব বেশী নিকটবর্তী হয় তখন যখন নিজেদের বাড়ীতে অবস্থান করে। (এ হাদীসটিও হাফিয আবু বকর আল বাযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)নবী (সঃ) বলেছেনঃ “নারীর অন্দর মহলের নামায তার বাড়ীর নামায হতে উত্তম এবং বাড়ীর নামায আঙ্গিনার নামায হতে উত্তম। (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অজ্ঞতার যুগে নারীরা বেপর্দাভাবে চলাফেরা করতো। ইসলাম এরূপ বেপর্দাভাবে চলাফেরা করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। ভঙ্গিমা করে নেচে নেচে চলাকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দো-পাট্টা ও চাদর গায়ে দিয়ে চলাফেরা করতে হবে। তা গায়ে দিয়ে গলায় জড়িয়ে রাখা ঠিক নয়। যাতে গলা ও কানের অলংকার অন্যের নযরে না পড়ে সেভাবে গায়ে দিতে হবে। এগুলো অসত্য ও বর্বর যুগের নিয়ম-পদ্ধতি ছিল। যা এ আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত ইদরীস (আঃ)-এর মধ্যকার ব্যবধান ছিল এক হাজার বছর। এই মধ্যবর্তী যুগে হযরত আদম (আঃ)-এর দু’টি বংশ আবাদ ছিল। একটি পাহাড়ী এলাকায় এবং অপরটি সমতল ভূমিতে বসবাস করতো। পাহাড়ীয় অঞ্চলের পুরুষ লোকেরা চরিত্রবান ও সুন্দর ছিল এবং স্ত্রীলোকেরা ছিল কুৎসিত। পুরুষদের দেহের রং ছিল শ্যামল ও সুশ্রী। ইবলীস তাদেরকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে মানুষের রূপ ধারণ করে সমতল ভূমির লোকদের কাছে গেল। একটি লোকের গোলাম হয়ে তথায় থাকতে লাগলো। সেখানে সে বাঁশীর মত একটি জিনিস আবিষ্কার করলো এবং তা বাজাতে লাগলো। এই বশীর সুরে জনগণ খুবই মুগ্ধ হয়ে গেল এবং সেখানে ভীড় জমাতে শুরু করলো। এভাবে একদিন সেখানে মেলা বসে গেল। হাজার হাজার নারী-পুরুষ সেখানে একত্রিত হলো। আকস্মিকভাবে একদিন এক পাহাড়ী লোকও সেখানে পৌঁছে গেল। বাড়ী ফিরে গিয়ে সে নিজের লোকদের সামনে তাদের সৌন্দর্যের আলোচনা করতে লাগলো। তখন তারাও খুব ঘন ঘন সেখানে আসতে লাগলো। দেখাদেখির মাধ্যমে এদের নারীদের সাথে তাদের মেলামেশা বেড়ে গেল। সাথে সাথে ব্যভিচার ও অনান্য অসৎ কর্ম বেড়ে চললো। এভাবেই অসভ্যতা ও বর্বরতার পত্তন হলো। এ ধরনের কাজে বাধা দেয়ার পর কিছু কিছু নির্দেশাবলীর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ আল্লাহর ইবাদত সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইবাদত হচ্ছে নামায। সুতরাং তোমরা নিয়মানুবর্তিতার সাথে নামায প্রতিষ্ঠিত করবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ যাকাত প্রদান করতে হবে। এই বিশেষ আদেশ প্রদানের পর মহামহিমান্বিত আল্লাহ তার ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। এই আয়াতটি এটাই প্রমাণ করে যে, নবী (সঃ)-এর সহধর্মিণীরা আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত। এ আয়াতটি তাঁদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে। আয়াতের শানে নুযূল তো আয়াতের আদেশ-নিষেধ। মুতাবেক হয়ে থাকে। কেউ কেউ বলেন যে, আয়াতের বিষয়বস্তু তাদের উপর বর্তাবে যাদের শানে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, তারা তো হবেই, তা ছাড়া তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে যাদের ক্রিয়া-কলাপ এদের অনুরূপ হবে। দ্বিতীয় কথাটিই অধিকতর সঠিক। হযরত ইকরামা (রাঃ) বাজারে বাজারে বলে বেড়াতেনঃ “এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীদের জন্যে বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়েছে।” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ), ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ কথা বলেছেন। হযরত ইকরামা (রাঃ) বলতেনঃ “যদি কেউ এ ব্যাপারে মুকাবিলা করতে চায় তবে আমি মুকাবিলা করতে সদা প্রস্তুত।” এ আয়াতটি শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণীদের শানে অবতীর্ণ হয়েছে- একথার ভাবার্থ এই যে, এর শানে নুযূল অবশ্যই এটাই। যদি এর উদ্দেশ্য এই হয় যে, আহূলে বায়েতের সাথে অন্যান্যরাও জড়িত, তবে এখানে আবার প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে যে, এ আয়াতে বর্ণিত আহলে বায়েত ছাড়া অন্যান্যরাও শামিল রয়েছে।মুসনাদে আহমাদ ও জামেউত তিরমিযীতে উল্লিখিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ফজরের নামাযের জন্যে বের হতেন তখন তিনি হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর দরযার নিকট গিয়ে বলতেনঃ “হে আহলে বায়েত! নামাযের সময় হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি এই পবিত্র আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন। (ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান ও গারীব বলেছেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর এরূপ একটি হাদীসে সাত মাসের বর্ণনা রয়েছে) (এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবু দাউদ আমানাকী ইবনে হারিস চরম মিথ্যাবাদী। এ রিওয়াইয়াতটি সঠিক নয)শাদ্দাদ ইবনে আম্মার (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি একবার হযরত ওয়াসিলা ইবনে আসফা (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। ঐ সময় সেখানে আরো কিছু লোক বসেছিল এবং হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে আলোচনা চলছিল। তারা তাঁকে ভাল-মন্দ বলছিল। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। যখন তারা চলে গেল তখন হযরত ওয়াসিলা (রাঃ) বললেনঃ “তুমিও হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্য করলে?” আমি উত্তরে বললামঃ হ্যাঁ, আমি তাদের কথায় সমর্থন যোগিয়েছি মাত্র। তখন তিনি আমাকে বললেনঃ “তাহলে শুনো, আমি যা দেখেছি তা তোমাকে শুনাচ্ছি। একদা আমি হযরত আলী (রাঃ)-এর বাড়ী গিয়ে জানতে পারি যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে গিয়েছেন। আমি তার আগমনের অপেক্ষায় সেখানেই বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আসছেন এবং তার সাথে হযরত আলী (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইনও (রাঃ) রয়েছেন। হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অঙ্গুলী ধরে ছিলেন। তিনি হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর সামনে বসলেন এবং নাতিদ্বয়কে কোলের উপর বসালেন। একখানা চাদর দ্বারা তাদেরকে আবৃত করলেন। অতঃপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহ! এরাই আমার আহলে বায়েত। আর আমার আহলে বায়েতই বেশী হকদার।” অন্য রিওয়াইয়াতে নিম্নের কথাটুকু বেশী আছে যে, হযরত ওয়াসিলা (রাঃ) বলেন, আমি এ দেখে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমিও কি আপনার আহ্লে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত? উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা, তুমিও আমার আহলে বায়েতেরই অন্তর্ভুক্ত।” হযরত ওয়াসিলা (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর এই ঘোষণা আমার জন্যে বড়ই আশাব্যঞ্জক।”অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত ওয়াসিলা (রাঃ) বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম এমন সময় হযরত আলী (রাঃ), হযরত ফাতিমা (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ) এবং হযরত হুসাইন (রাঃ) আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় চাদরখানা তাঁদের উপর ফেলে দিয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়েত। হে আল্লাহ! তাদের হতে অপবিত্রতা দূরীভূত করুন এবং তাদেরকে পবিত্র করে দিন।” আমি বললামঃ আমিও কি? তিনি জবাব দিলেনঃ “হ্যা, তুমিও। নিশ্চয়ই তুমি কল্যাণের উপর রয়েছে।”হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমার ঘরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) অবস্থান করছিলেন এমন সময় হযরত ফাতিমা (রাঃ) রেশমী কাপড়ের একটি পুঁটলিতে করে কিছু নিয়ে আসলেন। তিনি (নবী সঃ) বললেনঃ “তোমার স্বামীকে ও দুই শিশুকে নিয়ে এসো।” সুতরাং তারাও এসে গেলেন ও খেতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার বিছানায় ছিলেন। বিছানায় খায়বারের একটি উত্তম চাদর বিছানো ছিল। আমি কামরায় নামায পড়ছিলাম। এমন সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদেরকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তিনি চাদরের ভিতর থেকে হাত দুটি বের করলেন এবং আকাশের দিকে উঠিয়ে দু'আ করলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়েত ও আমার সাহায্যকারী। আপনি এদের অপবিত্রতা দূর করে দিন এবং এদেরকে পবিত্র করুন!” আমি আমার মাথাটি ঘর থেকে বের করে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমিও তো আপনাদের সবারই সাথে রয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, অবশ্যই। তুমি তো সদা কল্যাণের উপর রয়েছে। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে) এ রিওয়াইয়াতের সনদে আতার নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং তিনি কি ধরনের বর্ণনাকারী সেটাও বলা হয়নি। অবশিষ্ট বর্ণনাকারীরা বিশ্বাসযোগ্য।অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেনঃ “একদা আমার সামনে হযরত আলী (রাঃ)-এর আলোচনা শুরু হলো। আমি বললাম, আয়াতে তাতহীর তো আমার ঘরে অবতীর্ণ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট এসে বললেনঃ “কাউকেও এখানে আসার অনুমতি দেবে না।” অল্পক্ষণ পরেই হযরত ফাতিমা (রাঃ) আসলেন। কি করে আমি মেয়েকে তাঁর পিতার নিকট যেতে বাধা দিতে পারি? অতঃপর হযরত হাসান (রাঃ) আসলেন। কে নাতিকে তার নানার কাছে যেতে বাধা দেবে? তারপর হযরত হুসাইন (রাঃ)আসলেন। তাঁকেও আমি বাধা দিলাম না। এরপর হযরত আলী (রাঃ) আগমন করলেন। তাঁকেও আমি বাধা দিতে পারলাম না। তারা সবাই যখন একত্রিত হলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদেরকে চাদর দ্বারা আবৃত করলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়েত। সুতরাং আপনি এদের অপবিত্রতা দূর করে দিন এবং এদেরকে পবিত্র করুন!” ঐ সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। যখন এঁদেরকে চাদর দ্বারা আবৃত করা হলো তখন আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমিও কি এদের অন্তর্ভুক্ত? কিন্তু আল্লাহ জানেন, তিনি আমার এ প্রশ্নে সন্তোষ প্রকাশ করলেন না। তবে শুধু বললেনঃ “তুমি কল্যাণের দিকেই রয়েছে।”
হাদীসের অন্য ধারাঃ
হযরত আতিয়্যাহ তাফাভী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) তার কাছে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার ঘরে ছিলেন। খাদেম খবর দিলো যে হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) এসেছেন। তখন তিনি আমাকে বললেনঃ “একটু সরে যাও, আমার আহলে বায়েত এসেছে।” একথা শুনে আমি ঘরের এক কোণে সরে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) শিশুদ্বয়কে কোলে নিলেন ও আদর করলেন। একটি হাত তিনি হযরত আলী (রাঃ)-এর উপর রাখলেন এবং আর একটি হাত রাখলেন হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর ঘাড়ের উপর। অতঃপর উভয়কেই তিনি স্নেহ করলেন। তারপর একটি কালো রং এর চাদর সকলের উপর বিছিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে আবৃত করলেন। এরপর তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমি আপনার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি, আগুনের দিকে নয়। এরাও আমার আহলে বায়েত।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ আমিও কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা, তুমিও। (এ বর্ণনাটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)
অন্য ধারাঃ
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ (আরবি) -এ আয়াতটি আমার বাড়ীতে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি ঘরের দরজায় বসেছিলাম এমতাবস্থায় আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত নই? জবাবে তিনি বললেনঃ “তুমি কল্যাণের উপর রয়েছে এবং তুমি নবী (সঃ)-এর স্ত্রীদের একজন।” ঐ সময় আমার বাড়ীতে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত ফাতিমা (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ) অবস্থান করছিলেন।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য ধারাঃ
হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ), হযরত ফাতিমা (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ)-কে একত্রিত করেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে তার কাপড়ের নীচে প্রবিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহকে বলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহ্লে বায়েত।” তখন আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। তিনি তখন বললেনঃ “তুমিও আমার পরিবারের একজন।”
অন্য হাদীসঃ
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা সকালে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কালো চাদর গায়ে দিয়ে বের হলেন। অতঃপর পর্যায়ক্রমে হযরত হাসান (রাঃ), হযরত হুসাইন (রাঃ), হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) আসলেন। সকলকেই তিনি তার ঐ চাদরের মধ্যে প্রবিষ্ট করলেন। তারপর তিনি (আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করলেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য ধারাঃ
হযরত ইবনে হাওশিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর চাচাতো ভাই হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, একদা আমি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট গমন করে তাঁকে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তখন তিনি বলেনঃ তুমি আমাকে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছো যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। তার বাড়ীতেই তাঁর প্রিয়তমা কন্যা ছিলেন। যিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট সবচেয়ে বেশী ভালবাসার পাত্রী আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখেছি যে, তিনি হযরত আলী (রাঃ), হযরত ফাতিমা (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত হুসাইন (রাঃ)-কে আহ্বান করেন। অতঃপর তিনি তাঁদের উপর কাপড় নিক্ষেপ করেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়েত। সুতরাং আপনি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করুন এবং তাদেরকে পবিত্র করে দিন!” আমি তখন তাদের নিকটবর্তী হলাম। অতঃপর বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমিও কি আপনার আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি জবাবে বললেনঃ “নিশ্চয়ই, জেনে রেখো যে, তুমি কল্যাণের উপর রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য হাদীসঃ
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ (আরবি) এ আয়াতটি আমাদের পাঁচজনের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ আমি, হযরত আলী (রাঃ), হযরত হাসান (রাঃ), হযরত হুসাইন (রাঃ) এবং হযরত ফাতিমা (রাঃ)।” অন্য সনদে এটা হযরত আবু সাঈদ (রাঃ)-এর নিজস্ব উক্তিরূপে বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ।হযরত সা'দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অহী অবতীর্ণ হয় তখন তিনি হযরত আলী (রাঃ), তাঁর দুই ছেলে এবং হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে ধরে তাঁর কাপড়ের নীচে প্রবিষ্ট করেন। অতঃপর বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! এরা আমার আহলে বায়েত।" (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইয়াযীদ ইবনে হিব্বান (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি, হুসাইন ইবনে সাবরা (রঃ) এবং হযরত উমার ইবনে সালমা (রঃ) হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-এর নিকট গমন করি। আমরা তাঁর কাছে উপবেশন করলে হযরত হুসাইন (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে যায়েদ (রাঃ)! আপনি তো বহু কল্যাণ লাভ করেছেন। আপনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখেছেন, তাঁর হাদীস শুনেছেন, তার সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং তার পিছনে নামায পড়েছেন। সুতরাং হে যায়েদ (রাঃ)! আপনি বহু কল্যাণ ও মঙ্গল লাভ করেছেন! হে যায়েদ (রাঃ)! আপনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে যা শুনেছেন তা আমাদের নিকট বর্ণনা করুন।” তিনি তখন বললেন, হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! আল্লাহর কসম! এখন আমার বয়স খুব বেশী হয়ে গেছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যমানা দূরে চলে গেছে, যা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছি তার কিছু কিছু বিস্মরণ হয়েছি। এখন আমি তোমাকে যা বলি তাই কর এবং তা মেনে নাও আমাকে তুমি এ ব্যাপারে কষ্ট দিয়ো না। শুনো, মক্কা ও মদীনার মাঝখানে একটি পানির জায়গা রয়েছে যার নাম ‘খাম'। সেখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে ভাষণ দান করেন। তিনি বলেনঃ “আমি একজন মানুষ। খুব সম্ভব আমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আমার নিকট একজন দূত আগমন করবেন। আমি যেন তার কথা মেনে নিই। আমি তোমাদের কাছে দু'টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। একটি হলো আল্লাহর কিতাব, যাতে হিদায়াত ও জ্যোতি রয়েছে। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ কর ও ওকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর।” অতঃপর তিনি আল্লাহর কিতাবের দিকে আমাদের দৃষ্টি পূর্ণভাবে আকর্ষণ করলেন। তারপর তিনি বললেনঃ “আমার আহলে বায়েতের ব্যাপারে আমি আল্লাহর কথা তোমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি ।” তিনবার তিনি একথার পুনরাবৃত্তি করলেন। তখন হুসাইন (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে যায়েদ (রাঃ)! আহলে বায়েত কারা? তাঁর স্ত্রীরা কি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত নন?" উত্তরে তিনি বলেনঃ “তাঁর স্ত্রীরাও আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত বটে, তবে তার আহ্ল তাঁরা যাদের উপর তার পরে সাদকা হারাম।” আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কারা?' জবাবে তিনি বললেনঃ “তারা হলেন হযরত আলী (রাঃ)-এর বংশধর, হযরত আকীল (রাঃ)-এর বংশধর ও হযরত আব্বাস (রাঃ)-এর বংশধর।” তাকে প্রশ্ন করা হলো: “এঁদের সবারই উপর কি সাদকা হারাম?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “হ্যা। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)অন্য সনদে বর্ণনা করা হয়েছেঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীরাও কি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি জবাব দিলেনঃ “না। আল্লাহর কসম! স্ত্রীরা তো দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর সাথে অবস্থান করে। কিন্তু যদি স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয় তবে সে তার পিত্রালয়ের সদস্যা ও নিজ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আহলে বায়েত হবে তাঁর মূল ও আসাবা।. যেসব ওয়ারিশের অংশ নির্ধারিত থাকে না, বরং যাদের অংশ নির্ধারিত রয়েছে তাদের অংশ নেয়ার পর বাকী অংশ যারা পায় তাদেরকেই ফারায়েযের পরিভাষায় আসাবা বলা হয়। তার পরে তাদের উপর সাদকা হারাম।” এ রিওয়াইয়াতে এ রকমই আছে। কিন্তু প্রথম রিওয়াইয়াতটিই বেশী গ্রহণযোগ্য। আর দ্বিতীয়টিতে রয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো শুধু ঐ আহলে বায়েত যাদের কথা হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। কেননা সেখানে ঐ (আরবি) উদ্দেশ্য যাদের উপর সাদকা হারাম। কিংবা এটাই যে, উদ্দেশ্য শুধু স্ত্রীরাই নয়, বরং তারাসহ তার অন্যান্য (আরবি)-ও উদ্দেশ্য। এ কথাটিই বেশী যুক্তিযুক্ত। এর দ্বারা এ বর্ণনা ও পূর্ববর্তী বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধিত হচ্ছে। কুরআন ও পূর্ববর্তী হাদীসগুলোর মধ্যেও সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে। তবে তখনই তা সম্ভব হবে যখন এ হাদীসগুলোকে সহীহ বলে মেনে নেয়া হবে। কেননা, এগুলোর কোন কোন সনদের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এসব ব্যাপারে সর্বাধিক সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই রয়েছে।যে ব্যক্তি মারেফাতের জ্যোতি লাভ করেছে এবং যাদের কুরআন কারীম সম্পর্কে গবেষণা করার অভ্যাস আছে তারা এক দৃষ্টিতেই এটা অবশ্যই জানতে পারবে যে, নবী (সঃ)-এর স্ত্রীরাও নিঃসন্দেহে এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। কেননা, উপর হতেই প্রসঙ্গটি তাদের সম্পর্কে এবং তাঁদের ব্যাপারেই চলে আসছে। এরপরে মহান আল্লাহ ঘোষণা করছেনঃ আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তা তোমরা স্মরণ রাখবে; আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত। সুতরাং হযরত কাতাদা (রঃ) প্রমুখ গুরুজনের উক্তি হিসেবে আল্লাহর আয়াত ও হিকমত দ্বারা কিতাব ও সুন্নাতকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা তাঁরা ছাড়া আর কেউই লাভ করতে পারেনি। তা এই যে, তাঁদের গৃহেই আল্লাহর অহী ও রহমতে ইলাহী অবতীর্ণ হয়ে থাকে। আর তাঁদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) সবচেয়ে বেশী লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেননা, হাদীসে পরিষ্কারভাবে উল্লিখিত হয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিছানা ছাড়া আর কারো বিছানায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অহী আসেনি। এটা এ কারণেই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) ছাড়া অন্য কোন কুমারী নারীকে বিয়ে করেননি। তাঁর বিছানা রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছাড়া আর কারো জন্যে ছিল না। সুতরাং তিনি সঠিকভাবেই এই উচ্চ মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। হ্যা, তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণীরাই যখন তাঁর আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত তখন তাঁর নিকটাত্মীয়গণ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত হবেন। যেমন হাদীসে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার আহ্বালে বায়েত সবচেয়ে বেশী হকদার।” সহীহ মুসলিমে যে হাদীসটি এসেছে এটা ওর সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। তা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে যখন (আরবি) মসজিদ যার ভিত্তি প্রথম দিন হতেই তাকওয়ার উপর স্থাপিত) (৯:১০৮) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “ওটা আমার এই মসজিদ।" কথাটি মসজিদে কুবা সম্বন্ধে বলা হয়েছে। হাদীসে এটা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সহীহ্ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো: “এই মসজিদ বলতে কোন মসজিদকে বুঝানো হয়েছে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমার মসজিদ অর্থাৎ মসজিদে নববী (সঃ)।” সুতরাং যে মর্যাদা মসজিদে কুবার ছিল সে মর্যাদা মসজিদে নববীরও (সঃ) রয়েছে। এ জন্যে এই মসজিদকেও ঐ নামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর হযরত হাসান (রাঃ)-কে খলীফা নির্বাচন করা হলো। তিনি ঐ সময় নামায পড়ছিলেন। বানী আসাদের গোত্রভুক্ত এক ব্যক্তি হঠাৎ এসে পড়লো এবং সিজদারত অবস্থায় তাঁকে ছুরি মেরে দিলো। ছুরিটি তাঁর গোশতের উপর লাগলো। কয়েক ঘন্টা মাত্র তিনি শয্যাগত থাকলেন। যখন একটু সুস্থ হলেন তখন তিনি মসজিদে এলেন এবং মিম্বরের উপর বসে বসে খুৎবা পাঠ করলেন ও বললেনঃ “হে ইরাকবাসী! আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। আমি তোমাদের নেতা ও তোমাদের মেহমান। আমি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত। যাদের সম্পর্কে (আরবি) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। এ কথাটির উপর তিনি খুব জোর দিলেন এবং বাক্যগুলো বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন। যারা মসজিদে ছিল তারা কাঁদতে লাগলো।একবার তিনি এক সিরিয়াবাসীকে বলেছিলেনঃ “তুমি কি সরায়ে আহযাবের আয়াতে তাতহীর তিলাওয়াত করেছো?” সে জবাব দিলো: “হ্যা। এর দ্বারা কি আপনাদেরকেই বুঝানো হয়েছে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ হ্যা। সে বললো: “আল্লাহ তা'আলা বড়ই স্নেহশীল, দয়াময়, সবজান্তা এবং সবকিছুরই খবর তিনি রাখেন। তিনি জানতেন যে, আপনারা তাঁর দয়া ও স্নেহলাভের যোগ্য। তাই তিনি আপনাদেরকে এ নিয়ামতগুলো দান করেছেন।” সুতরাং তাফসীরে ইবনে জারীরের বর্ণনা অনুযায়ী আয়াতের অর্থ হবেঃ “হে মুমিনদের মাতা ও নবী (সঃ)-এর স্ত্রীরা! তোমাদের উপর যে আল্লাহর নিয়ামত রয়েছে তা তোমরা স্মরণ কর। তিনি তোমাদেরকে এমন বাড়ীতে অবস্থান করতে দিয়েছেন যেখানে আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা পঠিত হয়। আল্লাহর এসব নিয়ামতের জন্যে তোমাদের তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এখানে হিকমতের অর্থ হাদীস আল্লাহ তাআলা শেষ পরিণতিরও খবর রাখেন। তাই তিনি সঠিক ও পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন। নবী (সঃ)-এর সহধর্মিণী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনকারিণী কারা হবেন তা তিনি নির্বাচন করেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলোও তোমাদের উপর আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বড় অনুগ্রহ। তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত।
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
📘 উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “কুরআন কারীমে আল্লাহ তা'আলা পুরুষদের কথা উল্লেখ করেছেন, আর আমরা স্ত্রীলোক, আমাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি কেন?" হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেনঃ “একদিন আমি আমার ঘরে বসে আমার মাথার যত্ন করছিলাম এমন সময় মিম্বর হতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর শব্দ শুনতে পেলাম। তখন আমি আমার চুলগুলো ঐ অবস্থায় জড়িয়ে নিলাম এবং কক্ষে বসে তার কথাগুলো শুনতে লাগলাম। ঐ সময় তিনি মিম্বরে পাঠ করছিলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেনঃ অবশ্য আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারিণী নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিনা নারী।” (হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদের বর্ণনা করেছেন। অন্য ধারায় ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীরও (রঃ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, কতিপয় স্ত্রীলোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ কথা বলেছিলেন।আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, স্ত্রীলোকেরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীদেরকে একথা বলেছিলেন। ইসলাম ও ঈমানকে পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, এর দ্বারা তো প্রমাণিত হচ্ছে যে, ঈমান ইসলাম হতে পৃথক এবং ঈমান ইসলাম হতে বিশিষ্টতর। কেননা, মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আরব মরুবাসীরা বলেঃ আমরা ঈমান আনলাম। (হে মুহাম্মাদ সঃ) তুমি বলঃ তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমরা বলঃ আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।” (৪৯:১৪) সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ব্যভিচারী ব্যভিচার করার সময় মুমিন থাকে না। আবার এ বিষয়ের উপর সবাই একমত যে, ব্যভিচার দ্বারা মানুষ প্রকৃত কাফের হয়ে যায় না। এটা একটা দলীল যা আমি শরহে বুখারীতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রমাণ করেছি।শব্দের অর্থ হলো শান্তভাবে আনুগত্য করা। যেমন কুরআন কারীমে রয়েছে (আরবি) অর্থাৎ “ঐ ব্যক্তি কি যে রাত্রিকালে আনুগত্যকারী হয় সিজদাকারী ও দণ্ডায়মানরূপে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের করুণার আশা রাখে?” (৩৯:৯) আর এক জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যারা রয়েছে সবাই তার অনুগত।” (৩০:২৬) আরো একটি জায়গায় মহান আল্লাহ বলেন (আরবি)অর্থাৎ “হে মারইয়াম (আঃ)! তোমার প্রতিপালকের অনুগত হও ও সিজদা কর এবং যারা রুকূ' করে তাদের সাথে রুকূ' কর।” (৩:৪৩) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা আনুগত্যের অবস্থায় আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হও।” (২:২৩৮) অতএব বুঝা গেল যে, ঈমানের মর্যাদা ইসলামের উপরে। উভয়ের একত্র মিলনে মানুষের ভিতরে আনুগত্যের শক্তি বৃদ্ধি পায়। সত্য কথা বলা আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। আর এ অভ্যাস সর্বাবস্থাতেই প্রশংসনীয়। সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম ব্যক্তি যিনি অজ্ঞতার যুগেও কখনো মিথ্যা কথা বলেননি। সত্যবাদিতা ঈমানের একটি লক্ষণ। সত্যবাদী লোক পরিত্রাণ পেয়ে থাকে। মানুষের উচিত সব সময় সত্য কথা বলা। সত্যবাদিতা মানুষকে সৎ কাজের ও জান্নাতের পথ প্রদর্শন করে। মিথ্যা কথা বলা পরিহার করা উচিত। মিথ্যাবাদিতা মানুষকে অসৎ কাজ এবং ফিক ও ফুজুরের পথ দেখিয়ে থাকে। আর ফিসক ও ফুজুর মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। সত্যবাদী লোক যখন সব সময় সত্য কথা বলে, সত্য কাজের প্রচেষ্টা চালায় তখন তার নামটি সিদ্দীকের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদী লোক সব সময় মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যার প্রচেষ্টা চালায় বলে তার নামটি আল্লাহ তা'আলা মিথ্যাবাদীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্বন্ধে বহু হাদীস রয়েছে।সবর বলা হয় বিপদে-আপদে দৃঢ়ভাবে ধৈর্যধারণ করাকে। তাকদীরের সাথে জড়িয়ে সবরকে লিখার কোন দলীল আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে কঠিন সবর বলা হয় মানসিক আঘাতের প্রাথমিক অবস্থায় দৃঢ়ভাবে ধৈর্যধারণ করাকে। আল্লাহ তা'আলার কাছে এর প্রতিদান অত্যন্ত বেশী। অতঃপর যখন ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হয় তখন সবর আপনা আপনিই এসে যায়।(আরবি)-এর অর্থ হলো শান্তি, সন্তুষ্টি ও অনুরোধ। মানুষের মনে যখন আল্লাহর ভয় বিরাজ করে তখন মানুষের মনে এটা আপনা আপনিই এসে পড়ে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে সব জায়গায় চির বিরাজমান বলে বিশ্বাস করে তার অন্তরে এটা প্রবেশ করে। তখন সে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করে যে, যেন সে স্বয়ং আল্লাহকে দেখছে। আল্লাহকে দেখছে এ ধারণা যদি করতে না পারে তবে অবশ্যই এটা মনে করে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে নিশ্চয়ই দেখছেন।সাদকা বলা হয় সেই দানকে যা গরীব-দুঃখীকে দেয়া হয়, যাদের আয়-উপার্জন করার কোন ক্ষমতা নেই। এ ধরনের লোককে নিজের প্রয়োজন। অপূর্ণ রেখে দান করাকেই সাদকা বলে। এ নিয়তে দান করলে এটা আল্লাহর আনুগত্য বলে বিবেচিত হবে। এর ফলে তার সৃষ্টজীব উপকৃত হয়ে থাকে।হাদীসে আছে যে, কিয়ামতের দিন সাত প্রকারের লোককে আল্লাহ তা'আলা তাঁর আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন যেই দিন তাঁর (আরশের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। এই সাত প্রকারের মধ্যে একটি এও আছে যে, সে যা কিছু দান-খয়রাত করে তা এতো গোপনে করে যে, তার দক্ষিণ হস্ত যা দান করে বাম হস্ত তা জানতে পারে না। হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, সাদকা দোষগুলোকে মুছে দেয় যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। এ বিষয়ের উপর আরো বহু হাদীস রয়েছে যেগুলো স্ব-স্ব স্থানে বর্ণিত হয়েছে। রোযা সম্বন্ধে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এটা শরীরের যাকাত অর্থাৎ এর দ্বারা শরীর পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। আর এটা মন্দ স্বভাবকে পরিবর্তন করে দেয়।হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, যে ব্যক্তি রমান মাসের রোযা রাখার পর প্রত্যেক মাসে তিনটি করে রোযা রাখে সে আসসায়েমূন ও আসসায়েমাতের অন্তর্ভুক্ত। রোযা কাম-শক্তিকে প্রশমিত করে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যারা শক্তিশালী। তারা যেন বিয়ে করে নেয়। যাতে তোমাদের দৃষ্টি নিম্নমুখী হয় এবং তোমরা পবিত্রতা অর্জন করতে পার। আর যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না তারা যেন রোযা রাখে। এটা তার জন্যে খাসি হওয়ার সমতুল্য।” এ জন্যে রোযার বিধানের সাথে সাথে মন্দ কর্ম হতে বাঁচবার পথ দেখানো হয়েছে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “এবং যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে তাদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্র ব্যতীত, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। তবে কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘনকারী।” (২৩:৫-৭)(আরবি) (আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী)- হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি রাত্রে জাগ্রত হয় এবং স্বীয় স্ত্রীকে জাগায়, অতঃপর দু'রাকাত নামায পড়ে নেয়, ঐ রাত্রে তারা দুজন (আরবি)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রাঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন)হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলার নিকট সবচেয়ে মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি কে হবে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “অত্যধিক যিকরকারী ব্যক্তি। তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মুজাহিদের চেয়েও কি বেশী?” জবাবে তিনি বললেনঃ “যদিও মজাহিদ কাফিরের উপর তরবারী চালনা করতে করতে তরবারী ভেঙ্গে ফেলে, আর সে রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে তবুও আল্লাহর যিকরকারীর মর্যাদা তার চেয়ে বেশী।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কার পথ দিয়ে চলছিলেন। জামদান নামক স্থানে পৌঁছে তিনি বললেনঃ “এ জায়গাটি জামদান। সামনে চলতে থাকে, কারণ মুফরাদুনরা অগ্রগামী হয়েছে।” জনগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “মুফরাদুন কারা?" জবাবে তিনি বললেনঃ “আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারীরা।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহ! মাথা মুণ্ডনকারীদেরকে ক্ষমা করে দিন।” জনগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যারা চুল ছেটে ফেলেছে তাদের জন্যেও দুআ করুন!” এবারও তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহ! মাথা মুণ্ডনকারীদেরকে আপনি ক্ষমা করুন!" জনগণ পুনরায় বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যারা চুল হেঁটে ফেলেছে তাদের জন্যেও ক্ষমা প্রার্থনা করুন!” এবার তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহ! যারা মাথার চুল ছেটেছে তাদেরকেও ক্ষমা করে দিন! (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা পাওয়ার বড় হাতিয়ার আল্লাহর যিকর ছাড়া আর কিছুই নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)একবার তিনি বললেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে উত্তম, সবচেয়ে পবিত্র এবং সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন আমলের কথা বলে দিবো না যা তোমাদের জন্যে আল্লাহর পথে স্বর্ণ ও রৌপ্য লুটিয়ে দেয়ার চেয়ে উত্তম? আর তোমরা শত্রুদের মুকাবিলা করবে, তাদের গর্দান দ্বিখণ্ডিত করবে এবং তারাও তোমাদের গর্দান দ্বিখণ্ডিত করবে এর চেয়েও উত্তম? সাহাবীগণ সমস্বরে উত্তর দিলেনঃ “হ্যা, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ) (আমাদেরকে এই খবর দিন)!” তিনি তখন বললেনঃ “তোমরা মহামহিমান্বিত আল্লাহর যিকর কর।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে)হযরত আনাস আল জুনী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেঃ “কোন ধরনের মুজাহিদ বড় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহর যিকরকারী (সেই সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য)।" লোকটি পুনরায় জিজ্ঞেস করেঃ “কোন রোযাদার বেশী পুণ্য লাভের যোগ্য?” জবাবে রাসূলুল্লাহ বললেনঃ “যে মহামহিমান্বিত আল্লাহর অধিক যিকরকারী।” তারপর লোকটি নামায, যাকাত, হজ্ব এবং দান-খয়রাতের ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করে এবং প্রত্যেকটির ব্যাপারেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহর যিকরকারী (সেই সবচেয়ে বড় পুণ্য লাভের যোগ্য)।” তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে বললেনঃ “তাহলে তো যিকরকারীরাই সমস্ত কল্যাণ ও পুণ্য নিয়ে গেল?” তাঁর এ প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হ্যাঁ, অবশ্যই।" (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)অধিক যিকর সম্পর্কে বাকী যে হাদীসগুলো রয়েছে তা আমরা ইনশাআল্লাহ এই সূরার নিম্নের আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করবো। আয়াতটি হলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে এবং সকালসন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে।মহান আল্লাহর উক্তি: এদের জন্যে আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান। অর্থাৎ উল্লিখিত গুণ বিশিষ্ট লোকদের প্রতিদান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, এই সমুদয় গুণের অধিকারী লোকদের পাপসমূহ তিনি ক্ষমা করে দিবেন এবং তাদের জন্যে রেখেছেন তিনি মহা প্রতিদান এবং ওটা হলো জান্নাত।
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
📘 রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর পয়গাম নিয়ে হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর কাছে হাযির হন। তিনি উত্তর দিলেনঃ “আমি তাকে বিয়ে করবো না।” তিনি বললেনঃ “এমন কথা বলো না, বরং তার সাথে বিবাহিতা হয়ে যাও।” হযরত যয়নাব (রাঃ) বললেনঃ “আচ্ছা, আমাকে কিছু সময় দিন, আমি একটু চিন্তা-ভাবনা করে দেখি।” এ ধরনের কথাবার্তা চলছে এমন সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়ে গেল। এটা শুনে হযরত যয়নাব (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি কি এ বিয়েতে সম্মত আছেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা।” তখন হযরত যয়নাব (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে আমারও কোন আপত্তি নেই। আমি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর বিরোধিতা করবো না। আমি তাকে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলাম।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, বংশ মর্যাদার দিক থেকে হযরত যয়নাব (রাঃ) হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর ঊর্ধে ছিলেন। হযরত যায়েদ (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আযাদকৃত গোলাম।হযরত আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (রাঃ) বলেছেন যে, এ আয়াতটি উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা ইবনে আবি মুঈত (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর সর্বপ্রথম মুহাজির মহিলা ছিলেন ইনিই। তিনি নবী (সঃ)-কে বলেছিলেনঃ “আমি আমার নফসকে আপনার নিকট হিবা করলাম।” তিনি উত্তরে বললেনঃ “বেশ, আমি তা কবূল করলাম। অতঃপর তিনি হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন। খুব সম্ভব হযরত যয়নাব (রাঃ) হতে পৃথক হওয়ার পর এ বিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। হযরত উম্মে কুলসূম (রাঃ) এ বিয়েতে অসম্মত হলেন এবং তাঁর ভাইও অমত প্রকাশ করলেন। কারণ তাদের ইচ্ছা ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে বিয়ে দেয়ার, তার গোলামের সাথে নয়। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার করে দিয়ে বলা হয়ঃ (আরবি)অর্থাৎ “নবী (সঃ) মুমিনদের সাথে তাদের নফসের চেয়েও অধিক। সম্পর্কযুক্ত।” (৩৩:৬) সুতরাং (আরবি) আয়াতটি (আরবি) বা বিশিষ্ট এবং এর চেয়েও ব্যাপক আয়াত এইটি। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একজন আনসারীকে বললেনঃ “তুমি জালবীব (রাঃ)-এর সাথে তোমার কন্যার বিয়ে দিয়ে দাও।” তিনি জবাবে বললেনঃ “ঠিক আছে, আমি তার মায়ের সাথে একটু পরামর্শ করে নিই।” তিনি তাঁর সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী বললেনঃ “না, হবে না। কারণ তার চেয়ে বড় বড় অমুক অমুক লোকের পয়গাম ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর আজ নাকি জালবীব (রাঃ)-এর সাথে বিয়ে দিবো?” আনসারী স্ত্রীর কথা শুনে নবী (সঃ)-এর কাছে যাবেন এমন সময় তার মেয়ে পর্দার আড়াল থেকে সব কথা শুনলো এবং বললো: “তোমরা নবী (সঃ)-এর কথা মানবে না? তিনি যখন এ বিয়েতে খুশী তখন তোমাদের এ পয়গাম রদ করা ঠিক হবে না।” তখন তারা উভয়ে বললেনঃ “মেয়ে ঠিক কথাই বলেছে। এ বিয়ের মাধ্যম যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বয়ং তখন এতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা তাঁকে অমান্য করারই শামিল। তাঁর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা মোটেই ঠিক নয়। সুতরাং আনসারী সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ “এ বিয়েতে আপনি খুশী আছেন তো?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমি এ বিয়েতে খুশী ও সম্মত আছি।” তখন আনসারী বললেনঃ “তাহলে আপনার যা ইচ্ছা তাই হালে। আপনি বিয়ে দিয়ে দিন।” সুতরাং বিয়ে হয়ে গেল।একদা মদীনার মুসলমানরা শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এ যুদ্ধে হযরত জালবীব (রাঃ) শহীদ হয়ে যান। তিনি বহু কাফিরকে হত্যা করেছিলেন যাদের মৃতদেহ তাঁরই পার্শ্বে পড়েছিল। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “আমি দেখেছি যে, তাঁর বাড়ী সদা আনন্দমুখর থাকতো। সারা মদীনায় তার মত খরচকারী লোক আর ছিল না।” অন্য রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ “হযরত জালবীব (রাঃ) বড়ই আমোদী লোক ছিলেন। এ জন্যে আমি আমার বাড়ীর লোকদেরকে বলে দিয়েছিলামঃ “এ লোকটি যেন তোমাদের কাছে আসে। আনসারীদের অভ্যাস ছিল এই যে, তারা কোন স্ত্রী লোককে বিয়ে করতেন না যে পর্যন্ত না তারা জানতে পারতেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার সম্পর্কে কিছু বলেননি।” অতঃপর এ ঘটনাটি শুনালেন যা উপরে বর্ণিত হলো। তাতে একথাও বলা হয়েছে যে, হযরত জালবীব (রাঃ) এ যুদ্ধে সাতজন কাফিরকে হত্যা করেছিলেন। অতঃপর কাফিররা তাঁকে ভীড়ের মধ্যে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর মৃতদেহ খুঁজতে খুঁজতে তার কাছে পৌঁছলেন। তাঁকে দেখে তিনি বললেনঃ “এ ব্যক্তি সাতজন কাফিরকে হত্যা করে শহীদ হয়েছে। এ আমার এবং আমি তার।” তিনি দু’বার বা তিনবার একথাটি বললেন। অতঃপর কবর খনন করিয়ে নিজ হাতে তাঁকে তিনি কবরে নামালেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র হাতই ছিল তাঁর জানাযা। অন্য কোন খাট-খাটুলী ছিল না। তাঁকে গোসল দেয়া ইত্যাদির কোন উল্লেখ নেই। আর যে সতী-সাধ্বী মহিলাটি তাঁর পিতা-মাতাকে বুঝিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা যাবে না, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার জন্যে দু'আ করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি এ মহিলার উপর করুণা বর্ষণ করুন! তার জীবনের যাবতীয় স্বাদ পূর্ণ করে দিন!” সমস্ত আনসারীর মধ্যে তাঁর ন্যায় অধিক খরচকারিণী আর কেউ ছিল যখন সে পর্দার আড়াল থেকে পিতা-মাতাকে উপরোক্ত কথা বলেছিল ঐ সময় (আরবি) এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। হযরত তাউস (রাঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “আসরের নামাযের পর দু'রাকাত (নফল) নামায পড়া যায় কি?” উত্তরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) নিষেধ করেন এবং(আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করেন। সুতরাং এ আয়াতটি শানে নুযূলের দিক দিয়ে বিশিষ্ট হলেও হুকুমের দিক দিয়ে সাধারণ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর নির্দেশ থাকা অবস্থায় না কেউ ঐ হুকুমের বিরোধিতা করতে পারে, না ওটা মানা বা না মানার কারো কোন অধিকার থাকতে পারে। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেছেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “কিন্তু না, তোমাদের প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না। থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে না নেয়।” (৪:৬৫)।হাদীসে এসেছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত না তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে আগমন করেছি তার অনুগত হয়। যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরোধিতা করে তারা প্রকাশ্যে পাপী। তাই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।” যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “যারা নবী (সঃ)-এর আদেশের বিরোধিতা করে তাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হয় অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এসে পড়ে এর থেকে তাদের সতর্ক থাকা ও ভয় করা উচিত।” (২৪:৬৩)
وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا
📘 আল্লাহ তা'আলা খবর দিচ্ছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় আযাদকৃত গোলাম হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-কে বিশেষভাবে বুঝিয়েছেন। তার উপর আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহেরবানী ছিল। তাঁকে তিনি ইসলাম ও নবী (সঃ)-এর অনুসরণ করার তাওফীক দান করেছিলেন। তাঁর প্রতি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁকে তিনি গোলামী হতে মুক্তি দান করেছিলেন। তিনি বড়ই জাঁকজমকপূর্ণ লোক ছিলেন। তিনি(আরবি) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। এমন কি সমস্ত মুসলমান তাঁকে রাসূলের প্রিয়’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর পুত্র হযরত উসামা (রাঃ)-কে (আরবি) ‘প্রিয়ের প্রিয়’ নামে সবাই সম্বোধন করতেন। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, কোন স্থানে সৈন্য পাঠালে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকেই দলের নেতা মনোনীত করতেন। যদি তিনি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন তবে তাকেই হয়তো তিনি তাঁর খলীফা নিযুক্ত করে যেতেন।হযরত উসামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি এক সময় মসজিদে অবস্থান করছিলাম এমন সময় আমার কাছে হযরত আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) আসলেন ও বললেনঃ “যান, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হতে আমাদের জন্যে অনুমতি নিয়ে আসেন।” আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ খবর দিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কি জন্যে এসেছে তা তুমি জান কি?" আমি উত্তর দিলামঃ জ্বি না। তখন তিনি বললেনঃ “আমি কিন্তু জানি। যাও, তাদেরকে ডেকে আনো।” তাঁরা এলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! বলুন তো, আপনার পরিবারে আপনার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? তিনি জবাবে বললেনঃ “আমার কন্যা ফাতিমা (রাঃ)। তাঁরা বললেনঃ “আমরা হযরত ফাতিমা (রাঃ) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করিনি।” তখন তিনি বললেনঃ “উসামা ইবনে যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ), যাকে আল্লাহ তাআলা পুরস্কৃত করেছেন এবং আমিও যার প্রতি স্নেহশীল।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় ফুফু উমাইমা বিনতে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ)-এর কন্যা হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ আসাদিয়্যা (রাঃ)-এর সাথে তাঁর (যায়েদ রাঃ -এর) বিয়ে দিয়েছিলেন। মোহর হিসেবে দশ দীনার (স্বর্ণ মুদ্রা) ও সাত দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) প্রদান করেছিলেন। আর দিয়েছিলেন একখানা শাড়ী, একখানা চাদর এবং একটি জামা। আরো দিয়েছিলেন পঞ্চাশ মুদ্দ (ওযন বিশেষ) শস্য ও দশ মুদ্দ খেজুর। এক বছর অথবা তা থেকে কিছু কম-বেশী সময়ের মধ্যে নিজ সংসার তিনি গুছিয়ে নিয়েছিলেন। পরে তাদের মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। হযরত যায়েদ (রাঃ) গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট অভিযোগ করেন। তিনি তাকে বুঝিয়ে বললেনঃ “সংসার ভেঙ্গে দিয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।” এই জায়গায় ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) সঠিক নয় এরূপ বহু আসার বর্ণনা করেছেন, যেগুলো বর্ণনা করা উচিত নয় মনে করে আমরা ছেড়ে দিলাম। কেননা ওগুলোর মধ্যে একটিও প্রমাণিত ও সঠিক নয়। মুসনাদে আহমাদেও হযরত আনাস (রাঃ) হতে একটি রিওয়াইয়াত রয়েছে। কিন্তু তাতেও বড়ই অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। এ জন্যে আমরা ওটাও বর্ণনা করলাম না। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, এ আয়াতটি হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) ও হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণী হবেন একথা পূর্বে আল্লাহ তাকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথাটি প্রকাশ করেননি। তিনি হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে বুঝিয়ে বলেছিলেনঃ “তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় কর।” তাই আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ “তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন।”হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যদি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর উপর অহীকৃত কিতাবুল্লাহর কোন আয়াত গোপন করতেন তবে অবশ্যই (আরবি)-এ আয়াতটিই গোপন করতেন।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)(আরবি) শব্দের অর্থ হলো প্রয়োজন। ভাবার্থ হচ্ছেঃ যখন হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর মন ভেঙ্গে গেল এবং বহু বুঝানোর পরেও তাদের মনোমালিন্য কাটলো না, বরং তালাক হয়ে গেল তখন আল্লাহ তা'আলা হযরত যয়নাব (রাঃ)-কে স্বীয় নবী (সঃ)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। এজন্যে অলী, প্রস্তাব-সমর্থন, মহর এবং সাক্ষীদের কোন প্রয়োজন থাকলো না। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যখন হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি যাও এবং তাকে আমার বিবাহের পয়গাম পৌঁছিয়ে দাও।" হযরত যায়েদ (রাঃ) গেলেন। ঐ সময় হযরত যয়নাব (রাঃ) আটা ঠাসছিলেন। হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা এমনভাবে ছেয়ে গেল যে, সামনে থেকে তার সাথে কথা বলতে পারলেন না। বরং তিনি মুখ ফিরিয়ে বসে পড়লেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর প্রস্তাব শুনিয়ে দিলেন। হযরত যয়নাব (রাঃ) তখন তাকে বললেনঃ “থামুন, আমি আল্লাহ তাআলার নিকট ইসতিখারা (লক্ষণ দ্বারা শুভাশুভ বিচার) করে নিই।” অতঃপর তিনি দাড়িয়ে নামায পড়তে শুরু করলেন। আর এদিকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অহী অবতীর্ণ হলো এবং তাকে বলা হলো: “আমি তাকে তোমার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করলাম।” সুতরাং নবী (সঃ) কোন খবর না দিয়ে সেখানে চলে গেলেন। ওলীমার দাওয়াতে তিনি সাহাবীদেরকে গোশত ও রুটি খাওয়ালেন। সব লোক খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে গেলেন। কতিপয় লোক সেখানে বসে থেকে খোশ-গল্পে মত্ত হয়ে পড়লো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বের হয়ে তাঁর অন্যান্য স্ত্রীদের নিকট গেলেন। তিনি তাদেরকে সালাম দিচ্ছিলেন। তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! বলুন, আপনি আপনার স্ত্রীকে (যয়নাব রাঃ-কে) কিরূপ পেয়েছেন?" বর্ণনাকারী হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “লোকেরা তার বাড়ী হতে চলে গেছে এ খবর আমি তাঁকে দিলাম কি অন্য কারো মাধ্যমে তাঁকে এ খবর দেয়া হলো তা আমার জানা নেই। এরপর তিনি তাঁর বাড়ীতে গেলেন। আমিও তার সাথে ছিলাম। আমি তার সাথে তার বাড়ীতে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু তিনি পর্দা ফেলেদিলেন। ফলে আমার ও তাঁর মধ্যে আড় হয়ে গেল। ঐ সময় পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হলো এবং তিনি সাহাবীদের যা উপদেশ দেয়ার তা দিলেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা নবী (সঃ)-এর বাড়ীতে তাঁর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করো।” (৩৩:৫৩) (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত যয়নাব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অন্যান্য স্ত্রীদের কাছে গর্ব করে বলতেনঃ “তোমাদের বিয়ে দিয়েছেন তোমাদের অভিভাবক ও ওয়ারিশরা। আর আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা সপ্তম আকাশের উপর।” (এটা ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)সূরায়ে নূরের তাফসীরে আমরা এ রিওয়াইয়াতটি বর্ণনা করেছি যে, হযরত যয়নাব (রাঃ) বলেছিলেনঃ “আমার বিবাহ আকাশ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।” তাঁর একথার জবাবে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমার নিষ্কলুষতা ও সতীত্বের আয়াতগুলো আকাশ হতে অবতীর্ণ হয়েছে।” হযরত যয়নাব (রাঃ) তাঁর একথা স্বীকার করে নেন।হযরত শা’বী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত যয়নাব (রাঃ) নবী (সঃ)-কে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমার মধ্যে তিনটি বিশেষত্ব রেখেছেন যা আপনার অন্যান্য স্ত্রীদের মধ্যে নেই। প্রথম এই যে, আমার নানা ও আপনার দাদা একই ব্যক্তি। দ্বিতীয় এই যে, আপনার সাথে আমার বিবাহ আল্লাহ তা'আলা আকাশে পড়িয়েছেন। আর তৃতীয় হলো এই যে, আমাদের মাঝে সংবাদবাহক ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ) (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তার সাথে তোমার বিবাহ বৈধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলেই সেই সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আরবে এ প্রথা চালু ছিল যে, পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদের বিয়ে করা বৈধ নয়। এ আয়াত দ্বারা তাদের ঐ কু-প্রথাকে উঠিয়ে দেয়া হলো। কারণ আরব দেশে এ ধরনের পুত্র বহু বাড়ীতে বিদ্যমান ছিল। হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর জন্যে এ গৌরব প্রথম থেকেই আল্লাহর ইলমে নির্ধারিত ছিল যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র ও সতী-সাধ্বী স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
مَا كَانَ عَلَى النَّبِيِّ مِنْ حَرَجٍ فِيمَا فَرَضَ اللَّهُ لَهُ ۖ سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا
📘 আল্লাহ তা'আলা বলছেনঃ পোষ্যপুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করা যখন বৈধ কাজ তখন এ কাজ যদি নবী (সঃ) করেন তাহলে তাতে দোষ কি? তাতে কোন দোষ নেই। পূর্ববর্তী নবীদের উপর আল্লাহ তা'আলা যে হুকুম নাযিল করতেন ওর উপর আমল করায় তাদের কোন দোষ ছিল না। এখানে এ কথাটি বলার উদ্দেশ্য মুনাফিকদের ঐ কথার প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা বলতো যে, নবী (সঃ) তাঁর ছেলের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন। আল্লাহর আইন অবশ্যই পূর্ণ হয়ে থাকে। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করে থাকেন। আর যা তিনি ইচ্ছা করেন না তা কখনই হয় না।
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ ۗ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ حَسِيبًا
📘 Please check ayah 33:40 for complete tafsir.
مَا جَعَلَ اللَّهُ لِرَجُلٍ مِنْ قَلْبَيْنِ فِي جَوْفِهِ ۚ وَمَا جَعَلَ أَزْوَاجَكُمُ اللَّائِي تُظَاهِرُونَ مِنْهُنَّ أُمَّهَاتِكُمْ ۚ وَمَا جَعَلَ أَدْعِيَاءَكُمْ أَبْنَاءَكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ قَوْلُكُمْ بِأَفْوَاهِكُمْ ۖ وَاللَّهُ يَقُولُ الْحَقَّ وَهُوَ يَهْدِي السَّبِيلَ
📘 Please check ayah 33:5 for complete tafsir.
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَٰكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
📘 ৩৯-৪০ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা ঐ লোকদের (নবীদের) প্রশংসা করছেন যারা আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির কাছে তাঁর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেন। তাঁরা আল্লাহকে ভয় করেন এবং তাঁকে ছাড়া আর কাউকেও ভয় করেন না। কোন ভীতি-বিহ্বল কাজে অথবা কারো প্রভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন না। আল্লাহ তা'আলার সাহায্য-সহানুভূতিই যথেষ্ট।এই পদ ও দায়িত্ব পালনে সবারই নেতা, এমন কি প্রত্যেক কাজে-কর্মে ও প্রতিটি বিষয়ে সবারই সর্দার বা নেতা হলেন হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে যে, পূর্বে ও পশ্চিমে সমস্ত বানী আদমের কাছে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার করেছেন তিনিই। যতদিন আল্লাহর এই দ্বীন চারদিকে ছড়িয়ে না পড়েছে ততদিন তিনি বরাবরই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে গেছেন। তিনি আল্লাহর দ্বীনের প্রচারের ব্যাপারে সদা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তাঁর পূর্বে যেসব নবী-রাসূল এসেছিলেন তাঁরা নিজ নিজ জাতির জন্যে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এসেছিলেন সারা দুনিয়ার জন্যে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ!) তুমি বলে দাও- হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের নিকট রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।” (৭:১৫৮) তাঁর পরে এ দ্বীনের প্রচারের দায়িত্ব তাঁর উম্মতের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে। তাঁর পরে নেতৃত্বের দায়িত্ব তাঁর সাহাবীদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। তাঁরা যা কিছু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে শিখেছিলেন তা তাদের পরবর্তীদের শিখিয়ে দেন। তারা সমস্ত কাজ ও কথা, পরিস্থিতি, রাত-দিনের সফর, তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবকিছু তুলে ধরেছেন। সুতরাং তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। পরবর্তী লোকেরা উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো প্রাপ্ত হয়েছে। এভাবেই পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের ওয়ারিশ হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন এভাবেই ছড়াতে থাকে। কুরআন ও হাদীস জনগণের কাছে পৌঁছতে থাকে। হিদায়াত প্রাপ্তরা তাঁদের অনুসরণ করে জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠেন। যাঁরা ভাল কাজ করার তাওফীক লাভ করেছেন তাঁরা তাঁদের মাসলাকের বা চলার পথের উপর চলতে থাকেন। করুণাময় আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন আমাদেকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যেন নিজেকে লাঞ্ছিত না করে যে সে কাউকে শরীয়ত বিরোধী কাজ করতে দেখেও নীরব তাকে। (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেনঃ “এ ব্যাপারে কিছু বলতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছিল”? সে উত্তরে বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি লোকদেরকে ভয় করতাম।তখন আল্লাহ বলবেনঃ “আমাকে সবচেয়ে বেশী ভয় করা উচিত ছিল।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)মহান আল্লাহ বলেনঃ মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়। আল্লাহ তা'আলা নিষেধ করছেন যে, এরপরে যেন যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ (সঃ) বলা না হয়। অর্থাৎ তিনি যায়েদ (রাঃ)-এর পিতা নন। যদিও তিনি তাঁকে পুত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কোন পুত্র সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত জীবিত থাকেননি। কাসেম, তাইয়েব ও তাহের নামক তার তিনটি পুত্র সন্তান হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভজাত ছিলেন। কিন্তু তিনজনই শৈশবে ইন্তেকাল করেন। হযরত মারিয়াহ কিবতিয়াহ (রাঃ)-এর গর্ভজাত একটি পুত্র সন্তান ছিলেন, তাঁর নাম ছিল ইবরাহীম। তিনি দুগ্ধ পান অবস্থাতেই ইন্তেকাল করেন। হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভজাত রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চার কন্যা সন্তান ছিলেন। তাঁরা হলেন হযরত যয়নাব (রাঃ), হযরত রুকাইয়া (রাঃ), হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) ও হযরত ফাতিমা (রাঃ)। তাঁদের মধ্যে তিনজন তাঁর জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেছিলেন। শুধুমাত্র হযরত ফাতিমা (রাঃ) তাঁর ইন্তেকালের ছয় মাস পরে ইন্তেকাল করেছিলেন।এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ বরং মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ্ তাঁর রিসালাত কোথায় রাখবেন তা তিনি খুব ভাল জানেন।” (৬:১২৫) সুতরাং এ আয়াতটি এটাই প্রমাণ করে যে, তার পরে কোন নবী নেই। আর তার পরে যখন কোন নবী নেই তখন তাঁর পরে কোন রাসূলও যে নেই তা বলাই বাহুল্য। রিসালাত তো নবুওয়াত হতে বিশিষ্ট। প্রত্যেক রাসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রাসূল নন। তিনি যে খাতামুন নাবীঈন তা হাদীসে মুতাওয়াতির দ্বারাও প্রমাণিত।হযরত কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “নবীদের মধ্যে আমার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত যে একটি বাড়ী তৈরী করলো এবং ওটা পূর্ণরূপে ও উত্তমভাবে নির্মাণ করলো, কিন্তু তাতে একটা ইট পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দিলো। সেখানে কিছুই করলো না। লোকেরা চারদিক থেকে তা দেখতে লাগলো এবং ওর নির্মাণকার্যে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করলো। কিন্তু তারা বলতে লাগলো: 'যদি এ স্থানটি খালি না থাকতো তবে আরো কত সুন্দর হতো!' সুতরাং নবীদের মধ্যে আমি ঐ নবী যিনি ঐ স্থানটি পূর্ণ করে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযীও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং একে হাসান সহীহ বলেছেন)
অপর একটি হাদীসঃ
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “রিসালাত ও নবুওয়াত শেষ হয়ে গেছে। আমার পরে আর কোন রাসূল বা নবী আসবে না।” সাহাবীদের কাছে তাঁর “একথাটি খুবই কঠিন বোধ হলো। তখন তিনি বললেনঃ “কিন্তু সুসংবাদ দানকারীরা থাকবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সুসংবাদদাতা কি?" তিনি উত্তরে বললেনঃ “মুসলমানদের স্বপ্ন, যা নবুওয়াতের একটি অংশ বিশেষ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে সহীহ গারীব বলেছেন)
অন্য একটি হাদীসঃ
অন্য একটি হাদীসঃ হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার দৃষ্টান্ত ও নবীদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত যে একটি ঘর বানালো এবং পূর্ণ ও সুন্দর করে বানালো। কিন্তু একটি ইট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রেখে দিলো। সুতরাং যেই সেখানে প্রবেশ করে ও ওর দিকে তাকায় সেই বলেঃ ‘এটা কতইনা সুন্দর! যদি এই ইট পরিমাণ জায়গাটি ফাঁকা না থাকতো!' আমি ঐ খালি স্থানের ইট। আমার মাধ্যমে নবীদের ধারাবাহিকতা শেষ করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসিলম (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি হাদীসঃ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার দৃষ্টান্ত ও নবীদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের ন্যায় যে একটি ঘর নির্মাণ করলো এবং পূর্ণভাবে করলো, কিন্তু একটি ইট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রেখে দিলো। অতঃপর আমি আগমন করলাম ও ঐ ইট পরিমাণ খালি জায়গাটি পূর্ণ করে দিলাম।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আর একটি হাদীসঃ
হযরত আবূ তোফায়েল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার পরে কোন নবী নেই। তবে সুসংবাদ বহনকারী বিদ্যমান থাকবে।” জিজ্ঞেস করা হলো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সুসংবাদ বহনকারী আবার কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “উত্তম ও ভাল স্বপ্ন।”
অন্য একটি হাদীসঃ
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার ও নবীদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের ন্যায় যে একটি ঘর নির্মাণ করলো এবং তা পূর্ণরূপে ও উত্তমরূপে নির্মাণ করলো। কিন্তু একটি ইট পরিমাণ জায়গা ফাঁকা রেখে দিলো। তখন চতুর্দিক হতে লোকেরা এ ঘরটি দেখতে আসলো এবং তা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অতঃপর লোকটিকে তারা জিজ্ঞেস করলো: ‘এখানে তুমি কেন ইট রাখখানি? এখানে ইট দিলে তো তোমার এ দালানটি পূর্ণ হতো? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন: আমিই ঐ ইট। (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা আবদুর রাযযাকের হাদীস হতে তাখরীজ করেছেন)
আর একটি হাদীসঃ
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাকে ছয়টি জিনিসের মাধ্যমে সমস্ত নবীর উপর ফযীলত দান করা হয়েছে। প্রথমঃ আমাকে জামে’ কালিমাত বা ব্যাপক ও সার্বজনীন কথা প্রদান করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রভাব বা গাম্ভীর্য দ্বারা আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। তৃতীয়ঃ আমার জন্যে গানীমাত বা যুদ্ধলব্ধ মাল হালাল করা হয়েছে। চতুর্থঃ আমার জন্যে সারা দুনিয়াকে মসজিদ ও অযুর স্থানরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। পঞ্চমঃ সমস্ত সৃষ্টির নিকট আমাকে নবী করে পাঠানো হয়েছে। ষষ্ঠঃ আমার দ্বারা নবী আগমনের ধারাবাহিকতা শেষ করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে হাসান সহীহ বলেছেন)
আর একটি হাদীসঃ
হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, নবী (সঃ) তাকে বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট আমি নবীদেরকে শেষকারীরূপে ছিলাম ঐ সময় যখন হযরত আদম (আঃ) পূর্ণরূপে সৃষ্ট হননি।”
আর একটি হাদীসঃ
হযরত মুতইম (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “নিশ্চয়ই আমার কয়েকটি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (সঃ), আমি আহমাদ (সঃ), আমি মাহী। আমার কারণে আল্লাহ তাআলা কুফরীকে মিটিয়ে দিবেন। আমি হাশের। আমার পায়ের উপর দিয়ে জনগণকে উঠানো ও একত্রিত করা হবে। আমি আকেব। আমার পরে আর কোন নবী হবে না।” (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হাদীসটিকে তাখরীজ করা হয়েছে)হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে এমনভাবে আসলেন যেন তিনি আমাদের থেকে বিদায় গ্রহণকারী। তিনি তিনবার বললেনঃ “আমি মুহাম্মাদ (সঃ) নিরক্ষর নবী। আমার পরে কোন নবী নেই। আমাকে ব্যাপক ও সার্বজনীন কালেমা প্রদান করা হয়েছে। আমি সর্ববিজয়ী ও পরিপূর্ণ জ্ঞানী। জাহান্নামের দারোগা যত আছে, আরশ বহনকারী ফেরেশতা যতজন আছেন তাদেরকে আমার সমস্ত উম্মতের সাথে পরিচিত করা হয়েছে। আমি যতদিন তোমাদের সাথে আছি আমার কথা মেনে চলো। যখন আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় গ্রহণ করবো তখন তোমরা আল্লাহর কিতাবকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। আল্লাহর কিতাব যা হালাল করেছে তাকে হালাল জানবে এবং যা হারাম করেছে তা হারাম বলে মেনে নেবে।” এ বিষয়ের উপর আরো বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার এ ব্যাপক রহমতের জন্যে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। তিনি তাঁর দয়া-দাক্ষিণ্যের কারণে আমাদের জন্যে শ্রেষ্ঠ নবী (সঃ)-কে পাঠিয়েছেন। তিনি তার হাতে সহজ ও সরল জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ স্বীয় কিতাবে এবং বিশ্ব শান্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) মুতাওয়াতির হাদীসে এ খবর জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার পরে আর কোন নবী নেই। অতএব তাঁর পরে যদি কেউ নবুওয়াত ও রিসালাতের দাবী করে তবে নিঃসন্দেহে সে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, দাজ্জাল, পথভ্রষ্ট এবং পথভ্রষ্টকারী। যদিও সে ফন্দী করে, যাদু করে, বড় বড় জ্ঞানীদের জ্ঞানকে বিভ্রান্ত করে, বিস্ময়কর বিষয়গুলো দেখিয়ে দেয়, বিভিন্ন প্রকারের ডিগবাজী প্রদর্শন করে, তবুও জ্ঞানীরা অবশ্যই জানে যে, এ সবই প্রতারণা ও চালাকী ছাড়া আর কিছুই নয়। ইয়ামনের নবুওয়াতের দাবীদার আনসী ও ইয়ামামার নবুওয়াতের দাবীদার মুসাইলামা কাযযাবকে দেখলেই বুঝা যাবে যে, তারা যা করেছিল তা দেখে দুনিয়াবাসী তাদেরকে ধরে ফেলেছিল। তাদের আসল রূপ জনগণের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে পড়েছিল। কিয়ামত পর্যন্ত তাদেরও ঐ অবস্থাই হবে যারা এ ধরনের মিথ্যা দাবী নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির কাছে হাযির হবে। এমনকি সর্বশেষে আসবে মাসীহ্ দাজ্জাল। তার চিহ্নসমূহ দেখে প্রত্যেক আলেম এবং প্রত্যেক মুমিন সে যে মিথ্যাবাদী তা জেনে নেবে। এটাও আল্লাহ তা'আলার একটা অশেষ মেহেরবানী। এ ধরনের মিথ্যা দাবীদারদের এ নসীবই হয় না যে, তারা পুণ্যের আহকাম জারী করে এবং মন্দ কাজ থেকে লোকদেরকে ফিরিয়ে দেয়। অবশ্য যে কাজের তার উদ্দেশ্য হবে তাতে সে সিদ্ধিলাভ করবে। তার কথা ও কাজ ধোকা ও প্রতারণামূলকই হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “আমি তোমাদেরকে খবর দেবো কি যাদের কাছে শয়তানরা এসে থাকে? তারা প্রত্যেক ধোকাবাজ, পাপীর কাছে আসে।” (২৬:২২১-২২২)সত্য নবীদের ঘটনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা পুণ্যময় সঠিক হিদায়াত দানকারী। তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাঁদের কথা ও কাজ পুণ্য বিজড়িত। তাঁরা মানুষকে ভাল কাজের আদেশ করেন এবং মন্দ কাজ হতে বিরত রাখেন। তারা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। মুজিযা বা অলৌকিক কাজের দ্বারা তাঁদের সত্যবাদিতা প্রকাশিত হয়। তাঁদের নবুওয়াতের উপর এমন সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল দলীল থাকে যে, সুস্থির মন তাঁদের নবুওয়াতকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর সমস্ত নবীর উপর কিয়ামত পর্যন্ত দরূদ ও সালাম নাযিল করতে থাকুন!
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا
📘 Please check ayah 33:44 for complete tafsir.
وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
📘 Please check ayah 33:44 for complete tafsir.
هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۚ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا
📘 Please check ayah 33:44 for complete tafsir.
تَحِيَّتُهُمْ يَوْمَ يَلْقَوْنَهُ سَلَامٌ ۚ وَأَعَدَّ لَهُمْ أَجْرًا كَرِيمًا
📘 ৪১-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর
বহু প্রকারের নিয়ামতদাতা আল্লাহ তা'আলা বলছেনঃ আমাকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করা তোমাদের উচিত। তাছাড়াও তিনি আরো বহু প্রকারের নিয়ামত প্রদানের ওয়াদা করেছেন। হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে উত্তম কাজ, পবিত্র আমল, সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের পুণ্য, স্বর্ণ-রৌপ্য আল্লাহর পথে ব্যয় করা অপেক্ষা অধিক উত্তম এবং জিহাদ হতে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন কাজের কথা বলবো না?” সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সেটা কি উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহর যিক্র বা স্মরণ। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) (আরবি) আয়াতের তাফসীরে এগুলো ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে এমন এক দু'আ শুনেছি যা আমি কখনো পরিত্যাগ করি না। তা হলো: (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার বড় কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী, আপনার উপদেশের অনুসরণকারী, আপনার অধিক যিকরকারী এবং আপনার অসিয়তের অধিক হিফাযতকারী বানিয়ে দিন।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বাশার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, দু'জন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করলো। তাদের একজন জিজ্ঞেস করলো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লোকদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম কে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “যে ব্যক্তি দীর্ঘ সময় পেলো ও ভাল কাজ করলো।” দ্বিতীয়জন জিজ্ঞেস করলো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের উপর ইসলামের বিধান তো অনেক রয়েছে। আমাকে একটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বিধান বাতলিয়ে দিন যার সাথে আমি সদা লেগে থাকবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আল্লাহর যিক্র দ্বারা সদা-সর্বদা তোমার জিহ্বাকে সিক্ত রাখবে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান গারীব বলেছেন)হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা খুব বেশী বেশী আল্লাহর যি কর, এমনকি জনগণ তোমাদেরকে পাগল বলে ফেলে।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা খুব বেশী বেশী আল্লাহর যিক্র কর, শেষ পর্যন্ত যেন মুনাফিকরা বলতে শুরু করে যে, তোমরা লোক দেখানো যিক্র করছে। (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবদুল্লহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে কওম এমন মজলিসে বসে যেখানে আল্লাহর যিক্র হয় না, তারা কিয়ামতের দিন এ জন্যে আফসোস ও দুঃখ প্রকাশ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)(আরবি) আল্লাহ তা'আলার এই উক্তির ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক ফরয কাজের একটা সীমা আছে এবং বিশেষ ওজর বশতঃ তা মাফও করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর যিক্রের কোন সীমা নেই। কোন সময়েই তা সঙ্গ ছাড়া হয় না। তবে কেউ যদি পাগল হয়ে যায় তবে সেটা অন্য কথা। দাঁড়িয়ে, বসে, রাত্রে, দিবসে, স্থলে, পানিতে, বাড়ীতে, সফরে, ধনী অবস্থায় ও দরিদ্র অবস্থায়, সুস্থ অবস্থায় ও অসুস্থ অবস্থায়, গোপনে ও প্রকাশ্যে, মোটকথা সর্বাবস্থায়ই আল্লাহর যিকর করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতে হবে। তুমি যখন এগুলো করতে থাকবে তখন আল্লাহ তা'আলা তোমার উপর তার রহমত বর্ষণ করতে থাকবেন। আর ফেরেশতারাও তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবেন। এ সম্পর্কে আরো বহু হাদীস ও আসার রয়েছে। এই আয়াতেও খুব বেশী বেশী আল্লাহর যিক্র করার হিদায়াত করা হয়েছে। অনেকে আল্লাহর যিক্র ও অযীফা সম্পর্কে বহু স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেছেন, যেমন ইমাম নাসাঈ (রঃ), ইমাম মামারী (রঃ) প্রমুখ। এগুলোর মধ্যে এ বিষয়ের উপর সর্বোত্তম কিতাব হচ্ছে ইমাম নববী (রঃ)-এর লিখিত কিতাব।মহান আল্লাহ বলেনঃ সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর সন্ধ্যায় ও সকালে। তারই জন্যে প্রশংসা আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে এবং বিকালে ও যোহরের সময়।” (৩০:১৭-১৮)অতঃপর এর ফযীলত বর্ণনা এবং এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করার জন্যে মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ স্বয়ং তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। এতদসত্ত্বেও কি তোমরা তাঁর যি হতে উদাসীন থাকবে? যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যেমন আমি তোমাদের মধ্যে তোমাদেরই মধ্য হতে এমন এক রাসূল পাঠিয়েছি যে তোমাদের কাছে আমার নিদর্শনাবলী পাঠ করে থাকে ও তোমাদেরকে (পাপ হতে) পবিত্র করে এবং তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং তোমাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো, এবং তোমরা আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর ও অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” (২:১৫১-১৫২)।নবী (সঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “যে আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি, আর যে আমাকে কোন জামাআত বা দলের মধ্যে স্মরণ করে, আমি তাকে এমন জামাআতের মধ্যে স্মরণ করি যা তার জামাআত হতে উত্তম।”(আারবি) শব্দটি যখন আল্লাহ তা'আলার দিকে সম্বন্ধযুক্ত হয় তখন ওর অর্থ হয় আল্লাহ তা'আলা তার কল্যাণ ও মঙ্গল তাঁর ফেরেশতাদের সামনে বর্ণনা করেন। অন্য কেউ বলেছেন যে, (আারবি) শব্দটি আল্লাহ তা'আলার দিকে সম্বন্ধযুক্ত হলে ওর অর্থ হবে রহমত। এ দু'টি উক্তির মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। আর শব্দটি (আারবি) ফেরেশতাদের দিকে সম্বন্ধযুক্ত হলে তখন অর্থ হবে মানুষের জন্যে দু'আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ (আারবি)অর্থাৎ “আরশ বহনকারীরা ও ওর আশে-পাশে অবস্থানকারীরা তাদের প্রতিপালকের মহিমা কীর্তন করে ও তাঁর উপর ঈমান আনে এবং মুমিন বান্দাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে বলেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আপানি প্রত্যেক জিনিসকে রহমত ও ইলম দ্বারা পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন যারা তাওবা করে ও আপনার পথে চলে। তাদেরকে আপনি জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করুন এবং জান্নাতে আদনে প্রবিষ্ট করুন যার ওয়াদা আপনি তাদের সাথে করেছেন। আর তাদের সাথে তাদেরকেও পৌছিয়ে দিন যারা তাদের বাপ-দাদা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে সৎকর্মশীল নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। আর তাদেরকে মন্দ ও অসৎ কাজ হতে বাঁচিয়ে নিন।” (৪০:৭-৯) এই দু'আ ও ক্ষমা প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে মুমিন বান্দাদের উপর মহান আল্লাহ স্বীয় রহমত বর্ষণ করেন। তাদেরকে তিনি অজ্ঞতা ও কুফরীর অন্ধকার হতে বের করে ঈমানের আলোকের দিকে আনয়ন করেন। আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু। দুনিয়ায় তিনি তাদেরকে সত্যের পথ প্রদর্শন করেন ও জীবিকার ব্যবস্থা করেন এবং আখিরাতে তিনি তাদেরকে ভয়-ভীতি ও কঠিন শাস্তি হতে বাঁচিয়ে নিবেন। ফেরেশতারা বারবার মুমিনদের কাছে এসে তাদেরকে সুসংবাদ দেন। তাদেরকে তারা বলেনঃ “তোমরা জাহান্নাম হতে মুক্তি পেয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশের অধিকার লাভ করেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ তার মুমিন বান্দাদের উপর অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহশীল।হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে পথ চলছিলেন। ঐ সময় রাস্তার উপর একটি ছোট ছেলে ছিল। একটি দল আসছে দেখে ছেলেটির মা ভয় পেয়ে গেল এবং আমার ছেলে আমার ছেলে বলে চীৎকার করতে করতে ছুটে আসলো এবং ছেলেকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে একদিকে সরে গেল। ছেলের প্রতি মায়ের এই স্নেহ ও মমতা দেখে সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মা কি এই ছেলেটিকে আগুনে ফেলতে পারে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের উদ্দেশ্য বুঝে নিয়ে বললেনঃ “না, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা'আলা কখনো তাঁর বন্ধুকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি বন্দিনী নারীকে দেখেন যে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দেখা মাত্রই উঠিয়ে নিলো এবং বুকে লাগিয়ে দিয়ে দুধ পান করাতে শুরু করলো। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বললেনঃ “আচ্ছা বল তো, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই মহিলাটি তার এই ছেলেটিকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে কি? সাহাবীগণ উত্তরে বললেনঃ “না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহর শপথ! এই মহিলা তার ছেলের প্রতি যতটা স্নেহশীল ও দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি এর চেয়ে অনেক বেশী দয়ালু।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)মহান আল্লাহর উক্তিঃ যেদিন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদের প্রতি অভিবাদন হবে ‘সালাম'। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আারবি)অর্থাৎ “পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদেরকে বলা হবেঃ সালাম।” (৩৬:৫৮) কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলো: পরকালে মুমিনরা যখন আল্লাহ তা'আলার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তারা একে অপরকে সালাম দেবে। ইবনে জারীর (রঃ) এ উক্তিটি পছন্দ করেছেন। আমি বলিঃ এই উক্তির স্বপক্ষে দলীল হচ্ছে নিম্নের আয়াতটিঃ(আারবি) অর্থাৎ “সেখানে তাদের ধ্বনি হবে- হে আল্লাহ! আপনি মহান, পবিত্র! এবং সেখানে তাদের অভিবাদন হবেঃ সালাম এবং তাদের শেষ ধ্বনি হবে- প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য।” (১০:১০)মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনি তাদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন উত্তম প্রতিদান। অর্থাৎ জান্নাত এবং ওর সমুদয় ভোগ্যবস্ত যেগুলো তাদের জন্যে নির্ধারিত করে রাখা হয়েছে। সেখানে তারা পানাহারের দ্রব্য, পরিধানের বস্ত্র, বাসস্থান, স্ত্রী, নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকন ইত্যাদি সবকিছুই পাবে! এগুলোর ধ্যান-ধারণা মানুষ করতেই পারে না। এগুলো এমনই যে, মানুষ চোখে দেখেনি, কানে শুনেনি এবং অন্তরে কল্পনাও করেনি।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
📘 Please check ayah 33:48 for complete tafsir.
وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا
📘 Please check ayah 33:48 for complete tafsir.
وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِنَ اللَّهِ فَضْلًا كَبِيرًا
📘 Please check ayah 33:48 for complete tafsir.
وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ وَدَعْ أَذَاهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا
📘 ৪৫-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং তাঁকে বললামঃ তাওরাতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যে বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে আমাকে তার খবর দিন। উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা, কুরআন কারীমে তার যে বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে তারই কতক অংশ তাওরাতেও বর্ণিত হয়েছে। তাওরাতে রয়েছেঃ হে নবী (সঃ)! আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে। অজ্ঞ ও নিরক্ষর লোকদেরকে তুমি সতর্ক করবে। তুমি আমার বান্দা ও রাসূল। আমি তোমার নাম মুতাওয়াকিল (ভরসাকারী) রেখেছি। তুমি কঠোর চিত্ত ও কর্কশভাষী নও। তুমি বাজারে গোলমাল ও চীকার করে বেড়াও না। তুমি মন্দকে মন্দ দ্বারা দূরীভূত কর না। বরং তুমি ক্ষমা ও মাফ করে থাকো। আল্লাহ তোমাকে কখনো উঠিয়ে নিবেন না যে পর্যন্ত না তুমি মানুষের বক্রকৃত দ্বীনকে সোজা করবে। আর তারা যে পর্যন্ত বলবেঃ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। যার দ্বারা অন্ধের চক্ষু উজ্জ্বল হয়ে যাবে, বধির শ্রবণশক্তি ফিরে পাবে এবং মোহরকৃত অন্তর খুলে যাবে।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম বুখারী (রঃ) এবং ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত অহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রঃ) বলেন, আল্লাহ তা'আলা বানী ইসরাঈলের নবীদের মধ্যে শুইয়া (আঃ) নামক একজন নবীর নিকট অহী করলেনঃ “তুমি তোমার কওম বানী ইসরাঈলের জন্যে দাঁড়িয়ে যাও। আমি তোমার মুখের ভাষায় আমার কথা বলবো। আমি অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের মধ্যে। একজন নিরক্ষর নবীকে পাঠাবো। সে না বদ স্বভাবের হবে, না কর্কশভাষী হবে। সে হাটে-বাজারে হট্টগোল সৃষ্টি করবে না। সে এতো শান্ত-শিষ্ট হবে যে, জ্বলন্ত প্রদীপের পার্শ্ব দিয়ে সে গমন করলেও প্রদীপটি নিভে যাবে না। যদি সে বাঁশের উপর দিয়েও চলে তবুও তাতে তার পায়ের শব্দ হবে না। আমি তাকে সুসংবাদ প্রদানকারী ও ভয় প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করবো। সে সত্যভাষী হবে। আমি তার সম্মানার্থে অন্ধের চক্ষ খুলে দিবো, বধির শ্রবণশক্তি ফিরে পাবে এবং দাগ ও কালিমাযুক্ত অন্তরকে পরিষ্কার করে দিবো। আমি তাকে প্রত্যেক ভাল কাজের দিকে পরিচালিত করবো। সমস্ত ভাল স্বভাব তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে। লোকের অন্তর জয়কারী হবে তার পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সৎ কাজ করা তার প্রকৃতিগত বিষয় হবে। তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকবে। তার কথাবার্তা হবে হিকমত পূর্ণ। সত্যবাদিতা ও অঙ্গীকার পালন হবে তার স্বভাবগত বিষয়। ক্ষমা ও সদাচরণ হবে তার চরিত্রগত গুণ। সত্য হবে তার শরীয়ত। তার স্বভাব-চরিত্রে থাকবে ন্যায়পরায়ণতা। হিদায়াত হবে তার কাম্য। ইসলাম হবে তার মিল্লাত। তার নাম হবে আহমাদ (সঃ)। তার মাধ্যমে আমি পথভ্রষ্টকে সুপথ প্রদর্শন করবো, মূর্খদেরকে বিদ্বান বানিয়ে দিবো। অধঃপতিতকে করবো মর্যাদাবান। অপরিচিতকে করবো খ্যাতি সম্পন্ন ও সকলের পরিচিত। তার কারণে আমি রিক্ত হস্তকে দান করবো প্রচুর সম্পদ। ফকীরকে বানিয়ে দিবো বাদশাহ। কঠোর হৃদয়ের লোকের অন্তরে আমি দয়া ও প্রেম-প্রীতি দিয়ে দিবো। মতভেদকে ইত্তেফাকে পরিবর্তিত করবো। মতপার্থক্যকে করে দিবো একমত। তার কারণে আমি দুনিয়াকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করবো। সমস্ত উম্মত হতে তার উম্মত হবে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদা সম্পন্ন। মানব জাতির উপকারার্থে তাদের আবির্ভাব ঘটবে, তারা সৎ কার্যের নির্দেশ দান করবে ও মন্দ কার্যে বাধা দেবে। তারা হবে একত্ববাদী মুমিন ও নিষ্ঠাবান। পূর্ববর্তী নবীদের উপর যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তারা মেনে নেবে। তারা মসজিদে, মজলিসে, চলা-ফেরাতে এবং উঠা-বসাতে আমার মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণাকারী হবে। তারা আমার জন্যে দাঁড়িয়ে ও বসে নামায পড়বে। আল্লাহর পথে দলবদ্ধ ও সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ করবে। তাদের মধ্যে হাজার হাজার লোক আমার সন্তুষ্টির অন্বেষণে ঘরবাড়ী ছেড়ে জিহাদের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকবে। অযু করার জন্যে তারা মুখ-হাত ধৌত করবে। পায়ের গোছার অর্ধেক পর্যন্ত তারা কাপড় পরিধান করবে। আমার কিতাব তাদের বুকে বাঁধা থাকবে। আমার নামে তারা কুরবানী করবে। তারা হবে রাত্রে আবেদ এবং দিনে মুজাহিদ। এই নবীর আহূলে বায়েত ও সন্তানদের মধ্যে আমি অগ্রগামী, সত্যের সাধক, শহীদ ও সৎ লোকদেরকে সৃষ্টি করবো। তারপরে তার উম্মত দুনিয়ায় সত্যের পথে মানুষকে আহ্বান করতে থাকবে এবং ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করবে। তাদেরকে যারা সাহায্য করবে তাদেরকে আমি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করবো। পক্ষান্তরে তাদের যারা বিরোধিতা ও বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং অমঙ্গল কামনা করবে তাদের জন্যে আমি খুব মন্দ দিন আনয়ন করবো। আমি এই নবীর উম্মতকে নবীর ওয়ারিশ বানিয়ে দিবো। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে আহ্বানকারী হবে। তারা ভাল কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে। তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং তাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। ঐ ভাল কাজ আমি তাদের হাতেই সমাপ্ত করাবো, যা তারা শুরু করেছিল। এটা আমার অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ আমি। যাকে ইচ্ছা প্রদান করে থাকি এবং আমি বড় অনুগ্রহশীল।” (এটা ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, (আরবি) এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় ঐ সময় যখন তিনি হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুআয (রাঃ)-কে ইয়ামনের শাসনকর্তা করে পাঠাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা দু’জন যাও, সুসংবাদ শুনাবে, ঘৃণা উৎপাদন করবে না, সহজ পন্থা বাতলাবে, তাদের প্রতি কঠোর হবে কেননা, আমার প্রতি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে- “হে নবী (সঃ)! আমি তো তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে।' অর্থাৎ তুমি তোমার উম্মতের উপর সাক্ষী হবে, জান্নাতের সুসংবাদদাতা ও জাহান্নাম হতে সতর্ককারী হবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে এই সাক্ষ্যদানের দিকে আহ্বানকারী হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা'বুদ নেই এবং কুরআনের মাধ্যমে উজ্জ্বল প্রদীপ হবে।” সুতরাং আল্লাহ তা'আলার উক্তি (আরবি) বা সাক্ষী দ্বারা বুঝানো হয়েছে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী হওয়াকে। আর কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মানুষের আমলের উপর সাক্ষী হবেন। যেমন কুরআন কারীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি)অর্থাৎ “তোমাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করবো।” (৪:৪১) যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যেন তোমরা (উম্মতে মুহাম্মাদী সঃ) লোকদের (অন্যান্য নবীদের উম্মতের) উপর সাক্ষী হও এবং রাসূল (সঃ) তোমাদের উপর সাক্ষী হন।” (২:১৪৩)মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি মুমিনদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদানকারী এবং কাফিরদেরকে জাহান্নাম হতে ভয় প্রদর্শনকারী। আর তুমি আল্লাহর অনুমতিক্রমে সমগ্র সৃষ্টিকে আল্লাহর দাসত্বের দিকে আহ্বানকারী। তোমার সত্যতা ঐ রকম সুপ্রতিষ্ঠিত যেমন সূর্যের আলো সুপ্রতিষ্ঠিত। যদি কোন হঠকারী লোক অকারণে হঠকারিতা করে তবে সেটা অন্য কথা।এরপর মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তুমি কাফির ও মুনাফিকদের কথা মেনে নিয়ো না, বরং তাদের কথা ছেড়ে দাও। আর তারা যে তোমাকে কষ্ট দেয় ও তোমার প্রতি নির্যাতন করে সেটা তুমি উপেক্ষা কর, ওটাকে কিছুই মনে করো , বরং আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরশীল হও। কর্মবিধায়করূপে তিনিই যথেষ্ট।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نَكَحْتُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ فَمَا لَكُمْ عَلَيْهِنَّ مِنْ عِدَّةٍ تَعْتَدُّونَهَا ۖ فَمَتِّعُوهُنَّ وَسَرِّحُوهُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا
📘 এই আয়াতে অনেকগুলো হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে। এ কথা দ্বারা বুঝা যায় যে, শুধু বিবাহ বন্ধনের পরও তালাক দেয়া যেতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে এর চেয়ে উত্তম আর কোন আয়াত নেই। এতে কিছুটা মতভেদ রয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে বিবাহ কি শুধু ঈযাব-ককূলের নাম? না কি শুধু সহবাসের জন্যেই বিবাহ? না কি উভয় কাজের জন্যেই বিবাহ? কুরআন কারীমে কথাটি বন্ধন ও সহবাস উভয় কাজের জন্যে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু এই আয়াতে শুধু বন্ধনের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, সহবাসের পূর্বে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। এখানে মুমিনাতের উল্লেখ করার কারণ এই যে, সাধারণতঃ মুমিনরা মুমিনা নারীদেরকেই বিয়ে করে থাকে। তবে আহলে কিতাব স্ত্রীদের ব্যাপারেও এটাই প্রযোজ্য হবে। পূর্বযুগীয় গুরুজনদের একটি বড় দল এ আয়াত হতে একটি দলীল গ্রহণ করেছেন যে, তালাক তখনই প্রযোজ্য হবে যখন পূর্বে বিবাহ হয়ে থাকবে। এ আয়াতে বিবাহের পরে তালাকের কথা উল্লেখ করা। হয়েছে। বিবাহের পূর্বে তালাক সহীহ নয় এবং তা প্রযোজ্যও হয় না। ইমাম শাফেয়ী (রঃ), ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং আরো কয়েকজন বড় বড় মনীষীরও উক্তি এটাই। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও ইমাম মালিক (রঃ)-এর মত এই যে, বিবাহের পূর্বেও তালাক হয়ে থাকে। যেমন কেউ যদি বলে, “আমি যদি অমুক মহিলাকে বিয়ে করি তবে সে তালাকপ্রাপ্তা ।" এমতাবস্থায় তাঁদের উভয়ের মতে যদি সে ঐ মহিলাকে বিয়ে করে তবে তার তালাক হয়ে যাবে। আবার ইমাম মালিক (রঃ) ও ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মধ্যে ঐ লোকটির ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে যে বলেঃ ‘আমি যে মহিলাকে বিয়ে করবো সেই তালাকপ্রাপ্তা হবে।” এই অবস্থায় ইমাম আবু হানীফা (রঃ) বলেন যে, যে নারীকেই সে বিয়ে করবে সেই তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে। কিন্তু ইমাম মালিক (রঃ)-এর মত এই যে, তার তালাক হবে না। কেননা লোকটি কোন নারীকে নির্দিষ্ট করেনি। জমহুর উলামা এর বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁদের দলীল এ আয়াতটি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, যদি কেউ বলেঃ “আমি যে মহিলাকে বিয়ে করবো তার উপরই তালাক পড়ে যাবে, তবে এর হকুম কি? উত্তরে তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন এবং বলেনঃ “এই অবস্থায় তালাক হবে না। কেননা, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বিবাহের পরে তালাকের কথা বলেছেন। সুতরাং বিবাহের পূর্বের তালাক কিছুই নয়।" হযরত আমর ইবনে শুআয়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ইবনে আদম যার মালিক নয় তাতে তালাক নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ, (রঃ) ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন) অন্য এক হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বিবাহের পূর্বে তালাক নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা মুমিনা নারীদেরকে বিয়ে করার পর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে তালাক দিলে তোমাদের জন্যে তাদের পালনীয় কোন ইদ্দত নেই যা তোমরা গণনা করবে। এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, যদি কোন নারীকে সহবাসের পূর্বে তালাক দেয়া হয় তবে তার জন্যে কোন ইদ্দত নেই। সুতরাং সে তখনই যার সাথে ইচ্ছা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। হ্যা, তবে যদি এই অবস্থায় তার স্বামী মৃত্যুবরণ করে তাহলে এ হুকুম প্রযোজ্য হবে না। বরং তাকে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। সুতরাং বিবাহের পরেই এবং স্পর্শ করার পূর্বেই যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়, আর যদি এ বিবাহের মহরও ধার্য হয়ে থাকে তবে স্ত্রী অর্ধেক মহর পাবে। কিন্তু যদি মহর নির্ধারিত না হয়ে থাকে তবে অল্প কিছু স্ত্রীকে দিলেই তা যথেষ্ট হবে। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)অর্থাৎ “যদি তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক প্রদান কর এবং তাদের জন্যে মহর নির্ধারণ করে থাকো তবে যা নির্ধারণ করেছে তার অর্ধেক তারা পাবে।” (২:২৩৭) আর এক জায়গায় রয়েছে (আরবি)অর্থাৎ “যদি তোমরা তোমাদের স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দাও তবে এতে কোন অপরাধ নেই। যদি তাদের জন্যে কোন মহর নির্ধারণ না করে থাকো তবে নিজ নিজ সাধ্যানুসারে তাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে দাও। ধনী তার শক্তি অনুযায়ী দেবে এবং গরীবও তার শক্তি অনুযায়ী দেবে, এটা প্রচলিত পন্থায় দিতে হবে, এটা সৎকর্মশীলদের জন্যে অবশ্যকরণীয় কাজ।” (২:২৩৬)হযরত সাহল ইবনে সা'দ (রাঃ) ও হযরত আবু উসায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তারা দু'জন বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) উমাইয়া বিনতে শারাহীলকে বিয়ে করেন। অতঃপর সে যখন নবী (সঃ)-এর কাছে আসলো তখন তিনি তার দিকে হাত বাড়ালেন। কিন্তু সে যেন এটা অপছন্দ করলো। তখন তিনি হযরত আবু উসায়েদ (রাঃ)-কে হুকুম করলেন যে, তার বিদায়ের সামান তৈরী করে দেয়া হালে এবং মূল্যবান দু'খানা কাপড় তাকে পরিয়ে দেয়া হোক। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রাঃ) বলেন যে, যদি স্ত্রীর জন্যে মহর নির্ধারণ করা হয় এবং স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেয়া হয় হবে তার জন্যে অর্ধেক মহর ছাড়া আর কিছুই নেই। আর মহর ধার্য করা না হলে তাকে সাধ্যমত প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কিছু দিতে হবে এবং এটাই হবে সৌজন্যের সাথে বিদায় করা।
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِنْدَ اللَّهِ ۚ فَإِنْ لَمْ تَعْلَمُوا آبَاءَهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ ۚ وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَٰكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ ۚ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
📘 ৪-৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা উদ্দেশ্য বর্ণনা করার পূর্বে ভূমিকা ও প্রমাণের দৃষ্টান্ত স্বরূপ দু'একটি ঐ কথা বলেছেন যা সবাই অনুভব করে থাকে। অতঃপর সেদিক থেকে চিন্তা ও খেয়াল ফিরিয়ে নিজের উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেনঃ কোন মানুষের হৃদয় বা অন্তর দু’টি হয় না। এভাবেই তুমি বুঝে নাও যে, তুমি যদি তোমার কোন স্ত্রীকে মা বলে দাও তবে সে সত্যিই তোমার মা হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে অপরের পুত্রকে তুমি পুত্র বানিয়ে নিলে সে সত্যিকারের পুত্র হবে না। কেউ যদি ক্রোধের সময় তার স্ত্রীকে বলে ফেলেঃ তুমি আমার কাছে এমনই যেমন আমার মায়ের পিঠ। এরূপ বললে সে সত্যি সত্যিই মা হয়ে যাবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তারা তাদের মা নয়, তাদের মা তো তারাই যাদেরকে তারা জন্ম দিয়েছে বা প্রসব করেছে।” (৫৮:২) এ দু'টি কথা বর্ণনা করার পর মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হচ্ছে যে, মানুষের পালক পুত্র তার প্রকৃত পুত্র হতে পারে না। এ আয়াতটি হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নবুওয়াতের পূর্বে তাঁকে পোষ্যপুত্র করে রেখেছিলেন। তাঁকে যায়েদ (রাঃ) ইবনে মুহাম্মাদ (সঃ) বলা হতো। এ আয়াত দ্বারা এ সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়াই উদ্দেশ্য। যেমন এই সূরারই মধ্যে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়, রবং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (৩৩:৪০) এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা তো তোমাদের মুখের কথা মাত্র। তোমরা কারো ছেলেকে অন্য কারো ছেলে বলবে এবং এভাবেই বাস্তব পরিবর্তন হয়ে যাবে এটা হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তার পিতা সেই যার পিঠ হতে সে বের হয়েছে। একটি ছেলের দু’টি পিতা হওয়া অসম্ভব, যেমন একটি বক্ষে দু'টি অন্তর হওয়া অসম্ভব। আল্লাহ তা'আলা সত্য কথা বলে থাকেন ও সরল-সোজা পথ প্রদর্শন করে থাকেন। এ আয়াতটি একটি কুরায়েশীর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যে প্রচার করে রেখেছিল যে, তার দুটি অন্তর আছে এবং দুটোই জ্ঞান ও বোধশক্তিতে পরিপূর্ণ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তার একথাকে খণ্ডন করে দেন।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একদা নামাযে দণ্ডায়মান ছিলেন, এমতাবস্থায় তিনি আতংকগ্রস্ত হলেন। তখন যেসব মুনাফিক তাঁর সাথে নামায পড়ছিল তারা পরস্পর বলাবলি করলো: “দেখো, তাঁর দু’টি অন্তর রয়েছে, একটি তোমাদের সাথে এবং অপরটি তাদের সাথে।” ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা (আরবি)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।যুহরী (রঃ) বলেন যে, এটা শুধু দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা হয়েছে। অর্থাৎ যেমন কোন লোকের দু’টি অন্তর হয় না, তেমনই কোন ছেলের দু’টি পিতা হয় না। এ মুতাবেকই আমরাও এ আয়াতের তাফসীর করেছি। এসব ব্যাপারে মহামহিমান্বিত আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। পূর্বে তো এর অবকাশ ছিল যে, পালক পুত্রকে পালনকারীর দিকে সম্বন্ধ লাগিয়ে তার পুত্র বলে ডাকা যাবে। কিন্তু এখন ইসলাম এটাকে রহিত করে দিয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাকে তার প্রকৃত পিতার দিকে সম্পর্ক লাগিয়ে ডাকতে হবে। ন্যায়, হক ও সত্য এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেনঃ “এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে আমরা হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে যায়েদ (রাঃ) ইবনে মুহাম্মাদ (সঃ) বলতাম। কিন্তু এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আমরা এটা বলা পরিত্যাগ করি। পূর্বে তো পালক পুত্রের ঐ সমুদয় হক থাকতো যা ঔরষজাত ছেলের থাকে।"এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত সালেহ বিনতে সুহায়েল (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা সালিম (রাঃ)-কে মৌখিক পুত্র বানিয়ে রেখেছিলাম। এখন কুরআন তার ব্যাপারে ফায়সালা করে দিয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত তার থেকে পর্দা করিনি। সে আসে এবং যায়। আমার স্বামী হযরত হুযাইফা (রাঃ) তার এভাবে যাতায়াতে কিছুটা অসন্তুষ্ট রয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “তাহলে যাও, সালিম (রাঃ)-কে তোমার দুধ পান করিয়ে দাও। এতে তুমি তার উপর হারাম হয়ে যাবে (শেষ পর্যন্ত)।”মোটকথা পূর্বের হুকুম রহিত হয়ে যায়। এখন পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদেরকে পোষ্যপুত্র রূপে গ্রহণকারীদের জন্যে বৈধ করে দেয়া হয়। অর্থাৎ তারা তাদের পোষ্যপুত্রদের স্ত্রীদেরকে বিয়ে করে নিতে পারে। হযরত যায়েদ (রাঃ) যখন তার স্ত্রী হযরত যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে তালাক দেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বিয়ে করে নেন এবং এভাবে মুসলমানরা একটি কঠিন সমস্যা হতে রক্ষা পেয়ে গেলেন। এর প্রতি লক্ষ্য রেখেই যেসব নারীকে বিয়ে করা হারাম তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “এবং তোমাদের জন্যে অবৈধ বা নিষিদ্ধ তোমাদের ঔরষজাত পুত্রদের স্ত্রীরা।" (৪:২৩) তবে এখানে দুগ্ধ সম্পৰ্কীয় ছেলেরাও ঔরষজাত ছেলেদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হাদীস রয়েছে যে, দুধপানের কারণে ঐ সব আত্মীয় হারাম যা বংশের কারণে হারাম হয়ে থাকে। তবে কেউ যদি স্নেহ বশতঃ কাউকেও পুত্র বলে ডাকে তাহলে সেটা অন্য কথা, এতে কোন দোষ নেই।মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমাদের ন্যায় আবদুল মুত্তালিব বংশের ছোট বালকদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুযদালাফাহ হতে রাত্রেই জামরাতের দিকে বিদায় করে দেন এবং আমাদের উরুতে হাত বুলিয়ে বলেনঃ “হে আমার ছেলেরা!সূর্যোদয়ের পূর্বে জামরাতের উপর কংকর মারবে না।” এটা দশম হিজরীর যিলহজ্ব মাসের ঘটনা। এটা প্রমাণ করছে যে, স্নেহের বাক্য ধর্তব্য নয়।হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাঃ) যার ব্যাপারে এ হুকুম অবতীর্ণ হয়েছে, ৮ম হিজরীতে মূতার যুদ্ধে শহীদ হন। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ‘হে আমার প্রিয় পুত্র বলে সম্বোধন করতেন।”এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভ্রাতা ও বন্ধু।উমরাতুল কাযার বছরে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন হযরত হামযা (রাঃ)-এর কন্যা তাকে চাচা বলে ডাকতে ডাকতে তার পিছনে পিছনে দৌড়তে শুরু করে। হযরত আলী (রাঃ) তখন তাকে ধরে হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেনঃ “এটা তোমার চাচাতো বোন, একে ভালভাবে রাখো।" তখন হযরত যায়েদ (রাঃ) ও হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) বলে উঠলেনঃ “এই শিশু কন্যার হকদার আমরাই। আমরাই একে লালন-পালন করবো।” হযরত আলী (রাঃ) প্রমাণ পেশ করলেন যে, সে তার চাচার মেয়ে। আর হযরত যায়েদ (রাঃ) বললেন যে, সে তার ভাই-এর কন্যা। হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) বললেন : “এটা আমার চাচার মেয়ে এবং তার চাচী আমার বাড়ীতেই আছে অর্থাৎ হযরত আসমা বিনতে উমায়েস (রাঃ)।” অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ ফায়সালা করলেন যে, এ কন্যা তার খালার কাছেই থাকবে, যেহেতু খালা মায়ের স্থলাভিষিক্তা। হযরত আলী (রাঃ)-কে তিনি বললেনঃ “তুমি আমার ও আমি তোমার।” হযরত জাফর (রাঃ)-কে বললেনঃ “তোমার আকৃতি ও চরিত্র তো আমার সাথেই সাদৃশ্যযুক্ত। হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে তিনি বললেনঃ “তুমি আমার ভাই ও আমার আযাদকৃত দাস।” এ হাদীসে বহু কিছু হুকুম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ন্যায়ের হুকুম শুনিয়ে দিলেন, অথচ দাবীদারদেরকেও তিনি অসন্তুষ্ট করলেন না, বরং নম্র ভাষার মাধ্যমে তাঁদের অন্তর জয় করলেন। তিনি এ আয়াতের উপর আমল করতে গিয়ে হযরত যায়েদ (রাঃ)-কে বললেনঃ “তুমি আমার ভাই ও বন্ধু।” হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াত অনুযায়ী আমি তোমাদের দ্বীনী ভাই।” হযরত উবাই (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! যদি জানা যেতো যে, তার পিতা ছিল গাদা তবে অবশ্যই তার দিকে সে সম্পর্কিত হতো।”হাদীসে এসেছে যে, যদি কোন লোক তার সম্পর্ক জেনে শুনে তার পিতা ছাড়া অন্যের দিকে জুড়ে দেয় তবে সে কুফরী করলো। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, নিজেকে নিজের সঠিক ও প্রকৃত বংশ হতে সরিয়ে অন্য বংশের সাথে সম্পর্কিত করা খুব বড় পাপ। এরপর বলা হচ্ছেঃ তোমরা যদি তোমাদের সাধ্যমত তাহকীক ও যাচাই করার পর কাউকেও কারো দিকে সম্পর্কিত কর এবং সেটা ভুল হয়ে যায় তবে এতে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না। কেননা, স্বয়ং আল্লাহ তাবারাক ওয়া। তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন বলিঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে অপরাধী করবেন না।" (২:২৮৬) সহীহ মুসলিমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন বান্দা এ প্রার্থনা করে তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাই করলাম অর্থাৎ তোমাদের প্রার্থনা কবুল করে নিলাম।”হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি বিচারক (বিচারের ব্যাপারে) ইজতেহাদ (সঠিকতায় পৌছার জন্যে চেষ্টা-তদবীর ও চিন্তা-ভাবনা করে এবং এতে সে সঠিকতায় পৌঁছে যায় তবে তার জন্যে দ্বিগুণ পুণ্য রয়েছে। আর যদি তার ইজতিহাদে ভুল হয়ে যায় তবে তার জন্যে রয়েছে একটি পুণ্য। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমার উম্মতের ভুল-চুক এবং যে কাজ তাদের দ্বারা জোরপূর্বক করিয়ে নেয়া হয় তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখানেও মহান আল্লাহ একথা বলার পর বলেনঃ কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে অপরাধ হবে।কসম সম্পর্কেও ঐ একই কথা। উপরে যে হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, নসব বা বংশ পরিবর্তনকারী কাফিরের পর্যায়ভুক্ত, সেখানেও বলা হয়েছে যে, এরূপ অপরাধ হবে জেনে শুনে করলে। কুরআন কারীমের আয়াত, যার তিলাওয়াত বা পঠন এখন মানসূখ বা রহিত, তাতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমাদের নিজেদের পিতাদের দিক হতে সম্পর্ক সরিয়ে নেয়া কুফরী।”হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তাতে রজমের আয়াত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজে রজম করেছেন অর্থাৎ ব্যভিচারের অপরাধে বিবাহিত পুরুষ ও বিবাহিতা নারীকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন। আমরাও তার পরে রজম করেছি।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “আমরা পাঠ করতাম কুরআন কারীমের (আরবি)-এ আয়াতটি (যার পঠন এখন রহিত হয়ে গেছে)।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হয়েছিল। আমি তো আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলবে।” একটি রিওয়াইয়াতে শুধু ইবনে মারইয়াম (আঃ) আছে। আর একটি হাদীসে আছে যে, মানুষের মধ্যে তিনটি কুফরী (স্বভাব) রয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ বংশকে ভৎর্সনা ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, মৃতের উপর ক্রন্দন করা এবং তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَحْلَلْنَا لَكَ أَزْوَاجَكَ اللَّاتِي آتَيْتَ أُجُورَهُنَّ وَمَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ مِمَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَيْكَ وَبَنَاتِ عَمِّكَ وَبَنَاتِ عَمَّاتِكَ وَبَنَاتِ خَالِكَ وَبَنَاتِ خَالَاتِكَ اللَّاتِي هَاجَرْنَ مَعَكَ وَامْرَأَةً مُؤْمِنَةً إِنْ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لِلنَّبِيِّ إِنْ أَرَادَ النَّبِيُّ أَنْ يَسْتَنْكِحَهَا خَالِصَةً لَكَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۗ قَدْ عَلِمْنَا مَا فَرَضْنَا عَلَيْهِمْ فِي أَزْوَاجِهِمْ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ لِكَيْلَا يَكُونَ عَلَيْكَ حَرَجٌ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
📘 আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ তুমি যেসব স্ত্রীর মহর আদায় করে দিয়েছে তারা তোমার জন্যে হালাল। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সমস্ত স্ত্রীর মহর ছিল সাড়ে বারো উকিয়া, যার মূল্য হয় তখনকার পাঁচশ' দিরহাম। উম্মল মুমিনীন হযরত হাবীবা বিনতে আবি সুফিয়ান (রাঃ)-এর মহর ছিল এই পরিমাণই। হ্যরত নাজ্জাশী (রঃ) নিজের পক্ষ হতে চারশ’ দীনার (স্বর্ণ মুদ্রা) দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে উম্মুল মুমিনীন হযরত সুফিয়া বিনতে হুওয়াই (রাঃ)-এর মহর ছিল শুধু তাঁকে আযাদী দান। খাইবারের ইয়াহুদীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে মুক্ত করে দিয়ে বিয়ে করে নেন।হযরত জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেসা মুসতালেকিয়্যাহ যত অর্থের উপর মুকাতাবা করেছিলেন, তার সমুদয় অর্থ রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রাঃ)-কে আদায় করে দিয়ে তাঁর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সমস্ত স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন। এভাবেই যেসব বাদী গানীমাতের মাল স্বরূপ তাঁর অধীনে এসেছিল সেগুলোও তাঁর জন্যে হালাল ছিল। সুফিয়া (রাঃ) ও জুওয়াইরিয়্যা (রাঃ)-এর মালিক হয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে আযাদ করে দিয়ে বিবাহ করেছিলেন। রাইহানা বিনতে শামাউন্ নারিয়্যাহ ও মারিয়া কিবতিয়্যারও তিনি মালিক ছিলেন। হযরত মারিয়া (রাঃ)-এর গর্ভে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একটি সন্তানও হয়েছিল যার নাম ছিল ইবরাহীম। যেহেতু বিবাহের ব্যাপারে নাসারা ও ইয়াহূদীদের ভিতরে খুব বাড়াবাড়ী প্রচলিত ছিল এবং সেভাবেই কাজ করা হয়েছিল, সেহেতু আদল ও ইনসাফ বিশিষ্ট সহজ ও স্বচ্ছ শরীয়ত মধ্যম পন্থা প্রকাশ করে দিয়েছে। নাসারাগণ সাত পিড়ী পর্যন্ত যে পুরুষ বা স্ত্রী লোকের নসবনামা (বংশ তালিকা) পেতো না তার বিবাহ জায়েয বলে মেনে নিতো না। ইয়াহূদীরা ভাই বা বোনের ছেলে মেয়েদেরকে বিবাহ করে নিতো। ইসলাম ভাতিজী ও ভাগিনীর সাথে বিবাহ অবৈধ ঘোষণা করেছে। চাচার মেয়ে, ফুফুর মেয়ে, মামার মেয়ে ও খালার মেয়ের সাথে বিবাহ ইসলাম জায়ে রেখেছে। এ আয়াতের শব্দগুলো কতই না চমৎকার! (আরবি) (চাচা) এবং (আরবি) (মামা) এ শব্দগুলোকে এক বচন ব্যবহার করা হয়েছে। আর (ফুফুরা) এবং (আরবি) (খালারা) এই শব্দগুলোকে বহু বচন ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পুরুষ লোকদের স্ত্রীলোকদের উপর এক ধরনের ফযীলত বা মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ(আরবি) (ডান ও বাম হতে) (১৬:৪৮) (আরবি) (তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোকের দিকে বের করে আনেন) (২:২৫৭) এবং(আরবি) (তিনি অন্ধকার ও আলো করেছেন)। (৬:১) এখানে ডানের ফযীলত বামের উপর এবং আলোর ফযীলত অন্ধকারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ (আরবি) শব্দটিকে বহু বচন এবং (আরবি) শব্দটিকে এক বচন ব্যবহার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে (আরবি) শব্দটিকে বহু বচন এবং শব্দটিকে এক বচন ব্যবহার করা হয়েছে। এর আরো বহু উপমা দেয়া যেতে পারে।মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা তোমার সাথে দেশ ত্যাগ করেছে। হযরত উম্মে হানী (রাঃ) বলেনঃ “আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম এলো। আমি আমার অপারগতা প্রকাশ করলাম। তিনি তা মেনে নিলেন। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা এই আয়াতটি নাযিল করলেন। আমি তার জন্যে বৈধকৃত স্ত্রীদের মধ্যেও ছিলাম না এবং তার সাথে হিজরতকারীদের অন্তর্ভুক্তও না। বরং আমি মক্কা বিজয়ের পর ঈমান এনেছিলাম। আমি ছিলাম আযাদকৃতদের অন্তর্ভুক্ত।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)তাফসীর কারকগণও একথাই বলেছেন। আসল কথা হলো যারা মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হিজরত করেছেন। হযরত কাতাদা (রঃ) হতে একটি রিওয়াইয়াত আছে যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবি) রয়েছে। এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ কোন মুমিনা নারী নবী (সঃ)-এর নিকট নিজেকে নিবেদন করলে এবং নবী (সঃ) তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ। এ আদেশ দুটি শর্তের উপর প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! মুমিনা নারী তোমার জন্যে বৈধ যদি সে নিজেকে তোমার নিকট নিবেদন করে যে, তুমি ইচ্ছা করলে তাকে বিনা মহরে বিয়ে করতে পার। যেমন আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর কওমকে বলেছিলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “আর আমি তোমাদেরকে নসীহত করলেও আমার নসীহত তোমাদের কোন উপকারে আসবে না যদি আল্লাহ তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন।” (১১:৩৪) এবং হযরত মূসা (আঃ)-এর উক্তির মত। তিনি বলেছিলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “হে আমার কওম! যদি তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনে থাকো। তবে তার উপরই ভরসা কর যদি তোমরা আত্মসমর্পণকারী হও।” (১০:৮৪)আর এখানে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যদি মুমিনা নারী নবী (সঃ)-এর নিকট নিজেকে নিবেদন করে।”হযরত সাহল ইবনে সা'দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে একটি মহিলা এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আমি নিজেকে আপনার জন্যে নিবেদন করেছি।” অতঃপর সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন একটি লোক দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি তার প্রয়োজন আপনার না তাকে তবে আমার সাথে তার বিয়ে দিয়ে দিন?" রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ “তাকে তুমি মহর হিসেবে দিতে পার এমন কোন জিনিস তোমার কাছে আছে কি?” উত্তরে লোকটি বললো: “আমার কাছে আমার এই লুঙ্গিটি ছাড়া আর কিছুই নেই।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “একটি লোহার আংটি হলেও তুমি খোজ কর।” তখন সে খোঁজ করলো, কিন্তু কিছুই পেলো না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তোমার কুরআনের কিছু অংশ মুখস্থ আছে কি?” লোকটি জবাব দিলো: “হ্যা, আমার অমুক অমুক সূরা মুখস্থ আছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তাহলে তুমি তাকে কুরআন শিক্ষাদানের বিনিময়ে বিয়ে করে নাও। (হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা হযরত আনাস (রাঃ)-এর নিকট বসেছিলেন এবং ঐ সময় তাঁর নিকট তাঁর কন্যাও ছিল। হযরত আনাস বলেন যে, একটি স্ত্রীলোক নবী (সঃ)-এর কাছে এসে বলেঃ “আমার কোন প্রয়োজন আপনার আছে কি?” তখন তাঁর কন্যাটি বলেঃ “মহিলাটির লজ্জা-শরম কত কম!” তার একথা শুনে হযরত আনাস (রাঃ) তাকে বলেনঃ “ঐ মহিলা তোমার চেয়ে বরং ভাল যে, সে নিজেকে নবী (সঃ)-এর নিকট নিবেদন করেছে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি মহিলা নবী (সঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার এ রকম এ রকম একটি মেয়ে আছে।” অতঃপর সে তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলো। অতঃপর বললো: “আমি চাই যে, আপনি আমার এ মেয়েকে বিয়ে করে নিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার এ প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করলেন। মহিলাটি কিন্তু তার কন্যার প্রশংসা করতেই থাকলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত সে বললো যে, তার মেয়ে কখনো রোগে ভোগেনি এবং তার মাথায় কখনো ব্যথা হয়নি। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমার মেয়ের আমার প্রয়োজন নেই।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে মহিলাটি নবী (সঃ)-এর নিকট নিজেকে নিবেদন করেছে সে হলো হযরত খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ)। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, ইনি বানী সালীম গোত্রভুক্ত ছিলেন। আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, তিনি অত্যন্ত সতী-সাধ্বী রমণী ছিলেন। হতে পারে যে, উম্মে সালীমই ছিলেন হযরত খাওলা (রাঃ) আবার তিনি অন্য কোন মহিলাও হতে পারেন। হযরত মুহাম্মাদ ইবনে কা'ব (রাঃ), হযরত উমার ইবনুল হাকাম (রাঃ) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উবাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তেরোটি বিবাহ করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন কুরায়েশ গোত্রভুক্ত। তাঁরা হলেনঃ হযরত খাদীজা (রা), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ), হযরত উম্মে হাবীবা (রাঃ), হযরত সাওদা (রাঃ)। এবং হযরত উম্মে সালমা (রাঃ)। তিনজন ছিলেন বানু আমির ইবনে সাসা গোত্রভুক্ত। দু’জন ছিলেন বানু হিলাল ইবনে আমির গোত্রভুক্ত। তাঁরা হলেন হযরত মায়মূনা বিনতে হারিস (রাঃ), ইনি তিনিই যিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন এবং হযরত যয়নাব, উম্মুল মাসাকীন (রাঃ)। একজন ছিলেন বানু বকর ইবনে কিবলা গোত্রভুক্ত। ইনি ঐ মহিলা যিনি দুনিয়াকে পছন্দ করেছিলেন। একজন স্ত্রী ছিলেন বানুল জুন গোত্রভুক্ত, যিনি ছিলেন আশ্রয় প্রার্থিনী। আর একজন স্ত্রী ছিলেন যয়নাব বিনতে জাহশ আসাদিয়্যা (রাঃ)। আর দু’জন ছিলেন বন্দিনী। তাঁরা হলেন: সুফিয়া বিনতে হুওয়াই ইবনে আখতাব (রাঃ) এবং জুওয়াইরিয়া বিনতে হারিস ইবনে আমর ইবনুল মুসতালিক আল খুযাইয়্যা (রাঃ)।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যে মুমিনা নারী নিজেকে নবী (সঃ)-এর নিকট নিবেদন করেছিলেন তিনি হলেন মায়মূনা বিনতে হারিস (রাঃ)। কিন্তু এতে ইনকিতা বা ছেদ-কাটা রয়েছে। এ রিওয়াইয়াতটি মুরসাল। এটা প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, হযরত যয়নাব (রাঃ), যার কুনইয়াত ছিল উম্মুল মাসাকীন, তিনি হলেন যয়নাব বিনতে খুযাইমা (রাঃ)। তিনি ছিলেন আনসারিয়্যা। তিনি নবী (সঃ)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর নিকট ইন্তেকাল করেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। উদ্দেশ্য এই যে, যারা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইখতিয়ারে দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা অনেকেই ছিলেন। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমিরাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঐ সব স্ত্রী হতে আত্মগরিমায় থাকতাম যারা নিজেদেরকে তাঁর নিকট নিবেদন করেছিলেন। আমি বিস্ময় বোধ করতাম যে, কেমন করে স্ত্রীলোক নিজেকে নিবেদন করতে পারে! অতঃপর যখন আল্লাহ তাআলা নিম্ন লিখিত আয়াতটি অবতীর্ণ করেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “তুমি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তোমার নিকট হতে দূরে রাখতে পার এবং যাকে ইচ্ছা তোমার নিকট স্থান দিতে পার এবং তুমি যাকে দূরে রেখেছে, তাকে কামনা করলে তোমার কোন অপরাধ নেই।” (৩৩:৫১) তখন আমি বললামঃ আপনার প্রতিপালক তো আপনার পথ খুবই সহজ ও প্রশস্ত করে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এমন কোন স্ত্রীলোক ছিল না যে নিজেকে তাঁর কাছে নিবেদন করেছে। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন) ইউনুস ইবনে বুকায়ের (রাঃ) এর ভাবার্থ বর্ণনা করেছেন যে, যেসব স্ত্রীলোলে নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট নিবেদন করেছে তাদের একজনকেও তিনি গ্রহণ করেননি, যদিও এটা তার জন্যে জায়েয ও বিশিষ্ট ছিল। কেননা, এটা তাঁর ইচ্ছার উপর ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ (আারবি)অর্থাৎ “নবী (সঃ) যদি তাকে বিয়ে করার ইচ্ছা করে।" মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা বিশেষ করে তোমারই জন্যে, অন্য মুমিনদের জন্যে নয়। তবে যদি মহর আদায় করে তাহলে জায়েয হবে। যেমন হযরত বন্ধু বিনতে ওয়াশিক (রাঃ) নিজেকে নিবেদন করে দিয়েছিলেন। যখন তাঁর স্বামী মারা যান তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফায়সালা করলেন যে, তার বংশের অন্যান্য মহিলাদের মত তাকে মহর দিতে হবে। এভাবেই শুধু সহবাসের পর মহর আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ হুকুমের বাইরে রয়েছেন। ঐ স্ত্রী লোকদেরকে কিছু দেয়া তাঁর উপর ওয়াজিব ছিল না। তাঁকে এ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল যে, তিনি বিনা মহরে, বিনা ওলীতে এবং বিনা সাক্ষীতে বিবাহ করার অধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমন হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ)-এর ঘটনা। হযরত কাতাদা (রঃ) বর্ণনা করেছেনঃ কোন স্ত্রী লোকের এ অধিকার নেই যে, বিনা মহরে ও বিনা ওলীতে সে কারো কাছে নিজেকে বিবাহের জন্যে পেশ করতে পারে। এটা শুধু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যেই খাস ছিল। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ মুমিনদের স্ত্রী এবং তাদের মালিকানাধীন দাসীগণ সম্বন্ধে যা নির্ধারিত করেছি তা আমি জানি। অর্থাৎ কোন পুরুষ এক সাথে চারের অধিক স্ত্রী রাখতে পারে না। হ্যা, তবে স্ত্রীদের ছাড়াও সে দাসীদেরকে রাখতে পারে এবং তাদের ব্যাপারে কোন সংখ্যা নির্ধারিত নেই। অনুরূপভাবে মুমিনদের জন্যে ওলী, মহর ও সাক্ষীরও শর্ত রয়েছে। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উম্মতের জন্যে এই নির্দেশ। কিন্তু তার জন্যে এই ধরা-বাঁধা কোন বিধান নেই এবং এ কাজে তার কোন দোষও নেই।
۞ تُرْجِي مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِي إِلَيْكَ مَنْ تَشَاءُ ۖ وَمَنِ ابْتَغَيْتَ مِمَّنْ عَزَلْتَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكَ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ تَقَرَّ أَعْيُنُهُنَّ وَلَا يَحْزَنَّ وَيَرْضَيْنَ بِمَا آتَيْتَهُنَّ كُلُّهُنَّ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي قُلُوبِكُمْ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَلِيمًا
📘 হযরত উরওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) ঐ সব মহিলাকে অবজ্ঞা করতেন যাঁরা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হিবা করে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন যে, নারীরা বিনা মহরে নিজেকে হিবা করতে লজ্জা বোধ করে না? অতঃপর আল্লাহ তাআলা (আরবি) আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “আমি দেখি যে, আপনার চাহিদার ব্যাপারে প্রশস্ততা আনয়ন করেছেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারীও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন যা ইতিপূর্বে গত হয়েছে) সুতরাং বুঝা গেল যে, এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য এই মহিলারাই। এদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে যে, তিনি যাকে ইচ্ছা কবূল করবেন এবং যাকে ইচ্ছা কবুল করবেন না। এর পরেও তাঁকে অধিকার দেয়া হয়েছে যে, যাদেরকে তিনি কবুল করেননি তাদেরকেও ইচ্ছা করলে পরে কবুল করে নিতে পারেন।হযরত আমের শাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যাদেরকে দূরে রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে উম্মে শুরায়েকও (রাঃ) ছিলেন।এই বাক্যের একটি ভাবার্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, স্ত্রীদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে অধিকার দেয়া হয়েছিল যে, তিনি ইচ্ছা করলে তাঁদের মধ্যে (পালা) ভাগ-বাটোয়ারা করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তা নাও করতে পারেন। যাকে ইচ্ছা আগে করতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছা পিছে করতে পারেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সারাটি জীবন স্ত্রীদের মধ্যে পর্ণ আদল ও ইনসাফের সাথে (পালা) ভাগ-বাটোয়ারা করে গেছেন। ফকীহদের মধ্যে ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এ মত পোষণ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর (পালার) সমতার বণ্টন ওয়াজিব ছিল। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরেও স্ত্রীর পালার দিনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে অনুমতি চাইতেন।” বর্ণনাকারী মুআয (রাঃ)। তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কি বলতেন?” উত্তরে তিনি বলেন, আমি বলতামঃ এটা যদি আমার প্রাপ্য হয়ে থাকে তবে আমি অন্য কাউকেও আমার উপর প্রাধান্য দিতে চাইনে। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)সুতরাং সঠিক কথা যা অতি উত্তম এবং যার দ্বারা এই উক্তিগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যতাও এসে যায়, তা এই যে, আয়াতটি সাধারণ। নিজেকে নিবেদনকারী ও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীরা সবাই এর আওতায় পড়ে যায়। নিজেদেরকে হিবাকারিণীদের ব্যাপারে তাদেরকে বিয়ে করা ও না করা এবং বিবাহিতা স্ত্রীদের মধ্যে (পালা) বণ্টন করা বা না করা তাঁর ইচ্ছাধীন ছিল। এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এই বিধান এই জন্যে যে, এতে তাদের তুষ্টি সহজতর হবে এবং তারা দুঃখ পাবে না, আর তুমি তাদেরকে যা দিবে তাতে তাদের প্রত্যেকেই প্রীত থাকবে। অর্থাৎ তারা যখন জানতে পারবেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর পালা বণ্টন জরুরী নয় তবুও তিনি সমতা প্রতিষ্ঠিত রাখছেন তখন তাঁরা তাঁর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হবেন এবং তার কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করবেন। তারা তার ইনসাফকে মুবারকবাদ জানাবেন।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তোমাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন। অর্থাৎ কার প্রতি কার আকর্ষণ আছে তা আল্লাহ ভালরূপেই অবগত আছেন। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ন্যায় ও ইনসাফের সাথে তার স্ত্রীদের মধ্যে (পালা) বণ্টন করতেন। অতঃপর তিনি বলতেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! যা আমার অধিকারে ছিল তা আমি করলাম, এখন যা আপনার অধিকারে আছে, কিন্তু আমার অধিকারে নেই সেজন্যে আপনি আমাকে তিরস্কার করবেন না।”
لَا يَحِلُّ لَكَ النِّسَاءُ مِنْ بَعْدُ وَلَا أَنْ تَبَدَّلَ بِهِنَّ مِنْ أَزْوَاجٍ وَلَوْ أَعْجَبَكَ حُسْنُهُنَّ إِلَّا مَا مَلَكَتْ يَمِينُكَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ رَقِيبًا
📘 পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে এটা গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণীরা ইচ্ছা করলে তার বিবাহ বন্ধনে থাকতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে পৃথক হয়ে যেতে পারেন এ অধিকার তিনি তাদেরকে প্রদান করেছিলেন। কিন্তু মুমিনদের মাতারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অঞ্চল ছেড়ে দেয়া পছন্দ করেননি। এ কারণেই আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তারা পার্থিব একটি প্রতিদান এই লাভ করলেন যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিলেনঃ এরপর তোমার জন্যে কোন নারী বৈধ নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নয় যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে বিস্মিত করে। তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নয়। পরে অবশ্য আল্লাহ তাআলা তার উপর থেকে এই বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নিয়েছিলেন এবং তাঁকে আরো বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এরপরে আর কোন বিয়ে করেননি। এ বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেয়া এবং এতদসত্ত্বেও তা না করার মধ্যে এক বড় যৌক্তিকতা এই ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই ইহসান তাঁর স্ত্রীদের উপর রয়েছে। যেমন আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইন্তেকাল করেননি যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলা অন্যান্য স্ত্রী লোকদেরকেও তার জন্যে হালাল করেছেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম নাসাঈও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে তাঁর ইচ্ছায় যে কোন মহিলাকে বিবাহ করা বৈধ হওয়ার আয়াত হলো (আরবি) এটাই যা এর পূর্বে গত হয়েছে। বর্ণনা করার দিক দিয়ে ওটা পূর্বে এবং নাযিল হওয়ার দিক দিয়ে পরে। সূরায়ে বাকারাতেও অনুরূপভাবে মৃত্যুর ইদ্দত সম্পৰ্কীয় পরের আয়াতটি মানসূখ বা রহিত এবং পূর্বের আয়াতটি ওর নাসিখ বা রহিতকারী। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।এই আয়াতের অন্য আর একটি অর্থও অনেক আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা বলেনঃ এর উদ্দেশ্য হলো: যেসব স্ত্রীলোকের বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে তাদের ছাড়া অন্যেরা হালাল নয়। যরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যে স্ত্রীরা ছিলেন, তারা যদি তার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করতেন, তাহলে কি তিনি আর বিবাহ করতে পারতেন না?” উত্তরে হযরত উবাই (রাঃ) বললেনঃ “কেন পারতেন না?” তখন প্রশ্নকারী। (আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন। তখন হযরত উবাই (রাঃ) বললেনঃ “এ কথার উদ্দেশ্য এই যে, স্ত্রীদের যে প্রকারগুলো ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে, অর্থাৎ বিবাহিতা স্ত্রী, দাসী, চাচা, ফুফু, মামা ও খালাদের মেয়েরা এবং নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হিবাকারী স্ত্রী লোকেরা, এগুলো ছাড়া অন্য প্রকারের যারা হবে এবং তারা যদি বর্ণিত গুণের অধিকারিণী না হয় তবে তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে হালাল নয়।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, এই হিজরতকারিণী মুমিনা নারীরা ছাড়া অন্যান্য স্ত্রী লোকদেরকে বিয়ে করতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে নিষেধ করা হয়েছে। অমুসলিম মহিলাদের সাথে বিবাহ হারাম করা হয়েছে। কুরআন কারীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “ঈমানের পরে যারা কুফরী করে তাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যায়।” (৫:৫) সুতরাং আল্লাহ তা'আলা (আরবি) (৩৩:৫০)-এই আয়াতে স্ত্রী লোকদের যে প্রকারগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন ঐগুলো তো হালাল, ওগুলো ছাড়া অন্যগুলো হারাম। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এগুলো ছাড়া সর্বপ্রকারের স্ত্রী লোকই হারাম, তারা মুসলমানই হালে বা ইয়াহদীই হালে অথবা খৃষ্টানই হালে। আবু সালেহ্ (রঃ) বলেন যে, গ্রাম্য ও অপরিচিতা স্ত্রী লোকদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যে স্ত্রী লোকগুলো হালাল ছিল তাদের মধ্য হতে তিনশ' জনকে বিয়ে করলেও তা হালাল হবে। মোটকথা, আয়াতটি সাধারণ। যেসব স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাড়ীতে ছিলেন এবং যেসব স্ত্রীর প্রকার বর্ণনা করা হয়েছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আর যেসব লোক হতে এর বিপরীত বর্ণিত হয়েছে তাঁদের থেকেই এর অনুকূলেও বর্ণিত আছে। সুতরাং এতে কোনই বৈপরীত্য নেই। এর উপর একটি কথা বাকী থেকে যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-কে তালাক দিয়েছিলেন এবং পরে আবার ফিরিয়েও নিয়েছিলেন। আর হযরত সাওদা (রাঃ)-কে তিনি তালাক দিতে চেয়েছিলেন যার উপর হযরত সাওদা (রাঃ) নিজের পালার দিনটি হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে প্রদান করেছিলেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এর উত্তর এই দিয়েছিলেন যে, এটা এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ঘটনা। কথা এটাই বটে কিন্তু আমরা বলি যে, এ জবাবেরও দরকার নেই। কারণ এ আয়াতে তাদেরকে ছাড়া অন্যদেরকে বিয়ে করা এবং তাদেরকে বের করে দিয়ে অন্যকে ঘরে আনায় বাধা প্রদান করা হয়েছে, তালাক দেয়ার কথা বলা হয়নি ও উল্লেখ করা হয়নি। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।হযরত সাওদা (রাঃ)-এর ঘটনার ব্যাপারে সহীহ হাদীসে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা হলো আল্লাহ তা'আলার নিম্নের উক্তির শানে নুযূলঃ (আরবি)অর্থাৎ “কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আংশকা করে তবে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাদের কোন দোষ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই শ্রেয়।" (৪:১২৮) আর হযরত হাফসা (রাঃ) সম্পৰ্কীয় ঘটনাটি সুনানে আবি দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। হাফিয আবু ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেছনঃ হযরত উমার (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট এমন অবস্থায় প্রবেশ করেন যে, তিনি কাঁদছিলেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কাঁদছো কেন? সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) তোমাকে তালাক দিয়েছেন। নিশ্চয়ই একবার তিনি তোমাকে তালাক দিয়েছিলেন। অতঃপর আমারই কারণে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যদি তিনি তোমাকে তালাক দিয়ে থাকেন তবে আমি কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না।”মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নয় যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে বিস্মিত করে। এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বাড়াবাড়ী করতে ও কাউকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সে স্থানে অন্য কাউকে আনতে নিষেধ করেছেন ও দাসীকে হালাল করেছেন।হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “অজ্ঞতার যুগে একটি জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল যে, জনগণ তাদের স্ত্রীদেরকে আপোসে বদলা-বদলী করে নিতো। একজন নিজের স্ত্রী অন্যকে দিয়ে দিতো এবং অন্যজন তার স্ত্রী ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে দিতো। ইসলাম এ ধরনের জঘন্য প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এক সময়ের একটি ঘটনা এই যে, উয়াইনা ইবনে হাসান আল ফাযারী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করলো এবং নিজের অজ্ঞতা যুগের অভ্যাস অনুযায়ী অনুমতি না নিয়েই প্রবেশ করলো। ঐ সময় হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি অনুমতি না নিয়ে আসলে কেন?” সে উত্তরে বললো: “আমি তো আজ পর্যন্ত মুযার গোত্রের কারো কাছে অনুমিত প্রার্থনা করিনি।” অতঃপর সে বললো: “আপনার নিকট যে মহিলা বসেছিলেন উনি কে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “সে হলো উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)।” সে বললো: “আপনি আমার কাছে তাকে দিয়ে দিন, আর আমি তার পরিবর্তে আমার স্ত্রীকে আপনার কাছে দিয়ে দিচ্ছি। তার সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয় না।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “এরূপ করা আল্লাহ তাআলা হারাম করে দিয়েছেন।” যখন সে চলে গেল তখন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “লোকটি কি বলছিল? এবং সে কে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “সে হলো এক নির্বোধ সরদার। তুমি তো তার কথা শুনেছো। এমন নির্বোধ হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু সে তার কওমের সরদার।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তিনি বলেন যে, এ হাদীসের একজন বর্ণনকারী ইসহাক ইবনে আবদিল্লাহ রয়েছেন। তিনি খুবই নিম্ন পর্যায়ের লোক।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَىٰ طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَٰكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنْكُمْ ۖ وَاللَّهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ ۚ وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ۚ ذَٰلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ ۚ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّهِ وَلَا أَنْ تَنْكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أَبَدًا ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمًا
📘 Please check ayah 33:54 for complete tafsir.
إِنْ تُبْدُوا شَيْئًا أَوْ تُخْفُوهُ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
📘 ৫৩-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর
এ আয়াতে পর্দার হুকুম রয়েছে ও আদবের আহকাম বৰ্ণনা করা হয়েছে। হযরত উমার (রাঃ)-এর উক্তি অনুযায়ী যে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় ওগুলোর মধ্যে এটিও একটি। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত আল্লাহর আমি আনুকূল্য করেছি তিনটি বিষয়ে। আমি বলেছিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আপনি মাকামে ইবরাহীমকে নামাযের স্থান বানিয়ে নিতেন (তাহলে কতই না ভাল হতো)। তখন আল্লাহ তাআলা অবতীর্ণ করেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে নামাযের স্থান বানিয়ে নাও।” (২:১২৫) আমি বলেছিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার স্ত্রীদের নিকট সৎ ও অসৎ সবাই প্রবেশ করে থাকে। সুতরাং যদি আপনি তাদের উপর পর্দা করতেন (তবে খুব ভাল হতো)! আল্লাহ তাআলা তখন পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করেন। যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রীরা মর্যাদা বোধের কারণে কিছু বলতে কইতে শুরু করেন তখন আমি বললামঃ অহংকার করবেন না। যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ) আপনাদেরকে তালাক দিয়ে দেন তবে সত্বরই আল্লাহ তা'আলা আপনাদের পরিবর্তে তাঁকে আপনাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করবেন। তখন আল্লাহ তা'আলা এরূপই আয়াত অবতীর্ণ করেন না।" সহীহ মুসলিমে চতুর্থ আর একটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। তাহলে বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে ফায়সালা সংক্রান্ত বিষয়।হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার কাছে সৎ ও অসৎ সর্বপ্রকারের লোকই এসে থাকে। সুতরাং যদি আপনি মুমিনদের মাতাদেরকে পর্দার নির্দেশ দিতেন (তবে ভাল হতো)।” তখন আল্লাহ তাআলা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করেন। আর ঐ সময়টা ছিল ৫ম হিজরীর যুল-কাদাহ মাসের ঐ দিনের সকাল যেই দিন তিনি হযরত যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে স্ত্রী রূপে বরণ করে নিয়েছিলেন এবং যে বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছিলেন। অনেকেই এ ঘটনাটি তৃতীয় হিজরীর ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) যয়নাব বিনতে জাহশ (রাঃ)-কে বিয়ে করেন তখন তিনি জনগণকে ওলীমার দাওয়াত করেন। তারা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বসে গল্প-গুজবে মেতে উঠে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উঠবার জন্যে তৈরী হলেন, কিন্তু তখনো তারা উঠলো না। তা দেখে তিনি উঠে গেলেন এবং কিছু লোক তাঁর সাথে সাথে উঠে চলে গেল। কিন্তু এর পরেও তিনজন লোক বসে থাকলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাড়ীতে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে আসলেন। কিন্তু দেখেন যে, তখনো লোকগুলো বসেই আছে। এরপর তারা উঠে চলে গেল। বর্ণনাকারী হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “আমি তখন এসে নবী (সঃ)-কে খবর দিলাম যে, লোকগুলো চলে গেছে। তখন তিনি এসে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন। আমিও তাঁর সাথে যেতে লাগলাম। কিন্তু তিনি আমার ও তার মাঝে পর্দা ফেলে। দিলেন। তখন আল্লাহ তা'আলা (আরবি)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় জনগণকে রুটি ও গোশত আহার করিয়েছিলেন। হযরত আনাস (রাঃ)-কে তিনি লোকদেরকে ডাকতে পাঠিয়েছিলেন। লোকেরা এসেছিল ও খেয়েছিল এবং ফিরে যাচ্ছিল। যখন আর কাউকেও ডাকতে বাকী থাকলো না তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ খবর। দিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে দস্তরখান উঠিয়ে নিতে বললেন। পানাহার শেষ করে সবাই চলে গিয়েছিল। শুধুমাত্র তিনজন লোক পানাহার শেষ করার পরেও বসে বসে গল্প করছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বেরিয়ে গিয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কক্ষের দিকে গেলেন। অতঃপর বললেনঃ “হে আহলে বায়েত! তোমাদের উপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত বর্ষিত হালে!” উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেনঃ “আপনার উপরও শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হালে। হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি আপনার (নব-পরিণিতা) স্ত্রীকে কেমন পেয়েছেন? আপনাকে আল্লাহ বরকত দান করুন!” এভাবে তিনি তাঁর সমস্ত স্ত্রীর নিকট গেলন এবং সবারই সাথে একই কথা-বার্তা হলো। অতঃপর ফিরে এসে দেখলেন যে, ঐ তিন ব্যক্তি তখনো গল্পে মেতে আছে। তারা তখনো যায়নি। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর লজ্জা-শরম খুব বেশী ছিল বলে তিনি তাদেরকে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি আবার হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরের দিকে চলে গেলেন। হযরত আনাস (রাঃ) বলেনঃ “আমি জানি না যে, লোকগুলো চলে গেছে এ খবর তাঁকে আমিই দিলাম কি অন্যেরা দিলো। এ খবর পেয়ে তিনি ফিরে আসলেন এবং এসে তাঁর পা দরযার চৌকাঠের উপর রাখলেন। এক পা তার দরযার ভিতরে ছিল এবং আর এক পা দরযার বাইরে ছিল এমন সময় তিনি আমার ও তাঁর মধ্যে পর্দা ফেলে দিলেন এবং পর্দার আয়াত নাযিল হয়ে গেল। একটি রিওয়াইয়াতে তিনজনের স্থলে দু’জন লোকের কথা রয়েছে। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কোন এক বিবাহে হযরত উম্মে সালীম (রাঃ) মালীদা (এক প্রকার খাদ্য) তৈরী করেন এবং পাত্রে রেখে আমাকে বলেনঃ “এটা নিয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে পৌছিয়ে দাও এবং বলো: এ সামান্য উপটৌকন হযরত উম্মে সালীম (রাঃ)-এর পক্ষ হতে। তিনি যেন এটা কবুল করে নেন। আর তাকে আমার সালাম জানাবে।” ঐ সময় জনগণ খুব অভাবী ছিল। আমি ওটা নিয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সালাম বললাম ও হযরত উম্মে সালীমেরও (রাঃ) সালাম জানালাম এবং খবরও পৌছালাম। তিনি বললেনঃ “আচ্ছা, ওটা রেখে দাও। আমি তখন ঘরের এক কোণে ওটা রেখে দিলাম। অতঃপর তিনি আমাকে বললেনঃ “অমুক অমুককে ডেকে নিয়ে এসো।” তিনি বহু লোকের নাম করলেন। তারপর আবার বললেনঃ “তাছাড়া যে মুসলমানকেই পাবে ডেকে নিয়ে আসবে।” আমি তাই করলাম। যাকেই পেলাম তাকেই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট খাবারের জন্যে পাঠাতে লাগলাম। ফিরে এসে দেখলাম যে ঘর, বৈঠকখানা ও আঙ্গিনা লোকে পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রায় তিনশ’ লোক এসে গেছে। অতঃপর তিনি আমাকে বললেনঃ “যাও, ঐ খাবারের পাত্রটি নিয়ে এসো।” আমি সেটা নিয়ে আসলে তিনি তাতে হাত লাগিয়ে দু'আ করলেন এবং আল্লাহ যা চাইলেন তিনি মুখে উচ্চারণ করলেন। অতঃপর বললেনঃ “দশ দশজন লোকের দল করে বসিয়ে দাও।” সবাই বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করলো। এভাবে খাওয়া চলতে লাগলো। সবাই খাওয়া শেষ করলো। তখন তিনি আমাকে বললেনঃ “পাত্রটি উঠিয়ে নাও।” আমি তখন পাত্রটি উঠালাম। আমি সঠিকভাবে বলতে পারবো না যে, যখন আমি পাত্রটি রেখেছিলাম তখন তাতে খাবার বেশী ছিল, না এখন বেশী আছে। বেশকিছু লোক তখনো বসে বসে গল্প করছিল। উম্মুল মুমিনীন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসেছিলেন। লোকগুলোর এতক্ষণ ধরে বসে থাকা এবং চলে না যাওয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে খুবই কঠিন ঠেকছিল। কিন্তু তিনি লজ্জা করে কিছুই বলতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই মানসিক অবস্থার কথা জানতে পারলে লোকগুলো অবশ্যই উঠে চলে যেতো। কিন্তু তারা কিছুই জানতে পারেনি বলে নিশ্চিন্তে গল্পে মেতেছিল। তিনি ঘর হতে বের হয়ে স্ত্রীদের কক্ষের দিকে চলে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন যে, তারা তখনো বসেই আছে। তখন তারা বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো এবং তাড়াতাড়ি চলে গেলো। তিনি বাড়ীর ভিতরে গেলেন এবং পর্দা লটকিয়ে দিলেন। আমি আমার কক্ষেই ছিলাম এমতাবস্থায় এ আয়াত নাযিল হলো। তিনি আয়াতটি তিলাওয়াত করতে করতে বেরিয়ে আসলেন। সর্বপ্রথম এ আয়াতটি মহিলারাই শুনেছিলেন। আমি তো এর পূর্বেই শুনেছিলাম ।হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রস্তাব নিয়ে যাবার রিওয়াইয়াতটি (আরবি) এ আয়াতের তাফসীরে গত হয়েছে। এর শেষে কোন কোন রিওয়াইয়াতে এও আছে যে, এরপর লোকদেরকে উপদেশ দেয়া হয় এবং হাশিমের এ হাদীসে এই আয়াতের বর্ণনা রয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সতী-সাধ্বী সহধর্মিণীরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ময়দানের দিকে চলে যেতেন। কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) এটা পছন্দ করতেন না। তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতেনঃ ‘এভাবে তাদেরকে যেতে দিবেন না।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেদিকে কোন খেয়াল করতেন না। একদা হযরত সাওদা বিনতে জামআ (রাঃ) বাড়ী হতে বের হলেন। এদিকে হযরত উমার (রাঃ) চাচ্ছিলেন যে, এ প্রথা রহিত হয়ে যাক। তিনি তার দেহের গঠন দেখেই তাকে চিনতে পারলেন এবং উচ্চ স্বরে বললেনঃ “(হে সাওদা রাঃ)! আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি।” অতঃপর আল্লাহ তা'আলা পর্দার আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। এই রিওয়াইয়াতে এ প্রকারই বলা হয়েছে। কিন্তু আসল কথাটি হলো এই যে, এটা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা। কাজেই মুসনাদে আহমাদে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরে হযরত সাওদা (রাঃ) বের হয়েছিলেন। একথা এখানে বলা হয়েছে যে, তিনি হযরত উমার (রাঃ)-এর একথা শুনে সাথে সাথে ফিরে চলে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাত্রের খাদ্য খাচ্ছিলেন এবং তাঁর হাতে একটি হাড় ছিল এমতাবস্থায় হযরত সাওদা (রাঃ) সেখানে পৌছে তার ঘটনাটি বর্ণনা করেন। ঐ সময় অহী নাযিল হয়। যখন অহী আসা শেষ হলো তখনো তার হাতে ঐ হাড়টি ছিল। তিনি তা ফেলে দেননি। তখন তিনি বললেনঃ “আল্লাহ তাআলা তোমাকে প্রয়োজনে বাইরে যাবার অনুমতি প্রদান করেছেন। এই আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ঐ অভ্যাসে বাধা প্রদান করেছেন যা অজ্ঞতার যুগে ও ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ছিল। যেমন তখন বিনা অনুমতিতে অন্যের বাড়ীতে যাওয়া প্রচলিত ছিল। আল্লাহ তা'আলা উম্মতে মুহাম্মদীকে (সঃ) সম্মানের সাথে আদব শিক্ষা দিয়েছেন। একটি হাদীসেও এ বিষয়টি রয়েছেঃ “সাবধান! স্ত্রী লোকদের নিকট যেয়ো না।” অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে স্বতন্ত্র করলেন যাদেরকে অনুমতি দেয়া হবে। আরো বলা হচ্ছেঃ তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্যে অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্যে নবী-গৃহে প্রবেশ করো না এবং ভোজন শেষে তোমরা চলে যেয়ো। মুজাহিদ (রঃ) এবং কাতাদা (রঃ) বলেন যে, খাদ্য রান্না করা এবং প্রস্তুত হওয়ার সময়েই যেতে হবে যখন বুঝতে পারবে যে, খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে তখনই যে উপস্থিত হয়ে যাবে এ আচরণ আল্লাহ তা'আলার নিকট পছন্দনীয় নয়। এটা তোফায়লী বনে যাওয়া হারাম হওয়ার দলীল। ইমাম খতীব বাগদাদী (রঃ) এটা নিন্দনীয় হওয়ার উপর একটি পূর্ণ কিতাব লিখেছেন।অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমাদেরকে আহ্বান করলে প্রবেশ করো এবং ভোজন শেষে চলে যেয়ো। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্য হতে কাউকেও যদি তার ভাই (খাবার জন্যে) আহ্বান করে তবে তার দাওয়াত কবূল করা উচিত। ঐ দাওয়াত বিবাহের হালে বা অন্য কিছুরই হোক। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)অন্য একটি সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাকে যদি একটি খেজুরের দাওয়াত দেয়া হয় তবুও আমি তা কবূল করবো।” দাওয়াত খাওয়ার নিয়ম-কানুনের কথাও তিনি বলেছেনঃ “যখন খাওয়া শেষ হয়ে যাবে তখন সেখানে জেঁকে বসে থেকো না, বরং সেখান হতে চলে যেয়ো। গল্পে মশগুল হয়ে যেয়ো না। যেমন বর্ণিত তিন ব্যক্তি করেছিল, যার কারণে রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুবই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। কিন্তু তিনি লজ্জা করে কিছু বলতে পারেননি। এর উদ্দেশ্যে এও বটে যে, বিনা অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাড়ীতে চলে যাওয়া তাঁর জন্যে কষ্টদায়ক। কিন্তু তিনি লজ্জা-শরমের কারণে তোমাদেরকে কিছু বলতে পারেন না। আল্লাহর এটা স্পষ্ট নির্দেশ যে, এর পরে যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়। আল্লাহ তা'আলা যখন আদেশ করেছেন তখন। তোমাদের উচিত তা মেনে নেয়া। যেমন বিনা অনুমতিতে তার সহধর্মিণীদের সামনে চলে যাওয়া নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে তাঁদের দিকে চোখ তুলে তাকানোও নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমরা তাঁর পত্নীদের নিকট কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল হতে চাইবে।হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমি নবী (সঃ)-এর সাথে মালীদাহ্ (এক প্রকার খাদ্য) খাচ্ছিলাম। এমন সময় হযরত উমার (রাঃ) সেখান দিয়ে গমন করেন। তিনি তাঁকে ডেকে নেন। তখন তিনি (আমাদের সাথে) খেতে শুরু করে দেন। খেতে খেতে তার অঙ্গুলী আমার অঙ্গুলীতে ঠেকে যায়। তখন তিনি বলে উঠেনঃ “যদি আমার কথা মেনে নিতেন। ও পর্দার ব্যবস্থা করা হতো তবে কারো উপর কারো দৃষ্টি পড়তো না।” ঐ সময়েই পর্দার আয়াত নাযিল হয়ে যায়।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অতঃপর এই পর্দার উপকারিতা বর্ণনা করতে গিয়ে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্যে অধিকতর পবিত্র। এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তোমাদের কারো পক্ষে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দেয়া অথবা তার মৃত্যুর পর তাঁর পত্নীদেরকে বিয়ে করা কখনো সঙ্গত নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ঘোরতর অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সহধর্মিণীরা এখানে ও জান্নাতে তাঁরই সহধর্মিণী থাকবেন। সমস্ত মুসলমানের তাঁরা মাতা। এই জন্যে তাদেরকে বিয়ে করা মুসলমানদের জন্যে হারাম করে দেয়া হয়েছে। এ আদেশ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঐ সহধর্মিণীদের জন্যে যারা তার মৃত্যুকালে তার বাড়ীতেই ছিলেন। কিন্তু নবী (সঃ) তাঁর যে পত্নীদেরকে তাঁর জীবদ্দশায় তালাক দিয়েছেন এবং তার সাথে সহবাস হয়েছে তাকে কেউ বিয়ে করতে পারে কি না এতে দু'টি উক্তি রয়েছে। আর যার সাথে সহবাস হয়নি। তাকে অন্য লোক বিয়ে করতে পারে। হযরত আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কীলা বিনতে আশআস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর অধিকারভুক্ত হয়েছিলেন। তার ইন্তেকালের পর সে ইকরামা ইবনে আবু জেহেলের সাথে বিবাহিতা হয়। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর কাছে এটা খুবই অপছন্দনীয় হয়। কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে বুঝিয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর খলীফা! সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর স্ত্রী ছিল না। তিনি তাকে কোন অধিকারও প্রদান করেননি এবং পর্দারও হুকুম দেননি। তার কওমের হীনতার সাথে তার নিজের হীনতা ও নীচতার কারণে আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল (সঃ) হতে তাকে মুক্ত করে দিয়েছেন।” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তোমাদের কারো পক্ষে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দেয়া অথবা তার মৃত্যুর পর তার পত্নীদেরকে বিয়ে করা কখনো সঙ্গত নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ঘোরতর অপরাধ। তোমাদের গোপন ও প্রকাশ সবই আল্লাহর কাছে উন্মুক্ত। তাঁর কাছে ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম বস্তুও গোপন নেই। চোখের খিয়ানত, অন্তরের গোপন তথ্য, মনের বাসনা ইত্যাদি তিনি সবই জানেন।
لَا جُنَاحَ عَلَيْهِنَّ فِي آبَائِهِنَّ وَلَا أَبْنَائِهِنَّ وَلَا إِخْوَانِهِنَّ وَلَا أَبْنَاءِ إِخْوَانِهِنَّ وَلَا أَبْنَاءِ أَخَوَاتِهِنَّ وَلَا نِسَائِهِنَّ وَلَا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ ۗ وَاتَّقِينَ اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا
📘 পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর স্ত্রী লোকদের জন্যে যেসব নিকটতম আত্মীয়ের সামনে বের হলে কোন দোষ হবে না, এ আয়াতে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। সূরায়ে নূরে বলা হয়েছেঃ “নারীরা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, আপন নারীগণ, মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের আভরণ প্রকাশ না করে।” এর পূর্ণ তাফসীর এই আয়াতের আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে। চাচা ও মামার উল্লেখ এ জন্যেই করা হয়নি যে, সম্ভবতঃ তারা তাদের ছেলেদের সামনে এদের বিশেষণ বর্ণনা করে দেবে। হযরত শা’বী (রঃ) ও ইকরামা (রঃ) তো এ দু’জনের সামনে স্ত্রী লোকের দো-পাট্টা নামিয়ে ফেলা মাকরূহ মনে করতেন। (আরবি) দ্বারা মুমিন নারীদেরকে বুঝানো হয়েছে।(আরবি) দ্বারা দাস-দাসীকে বুঝানো হয়েছে। যেমন পূর্বে এর বর্ণনা গত হয়েছে। হাদীসও আমরা সেখানে আনয়ন করেছি। সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা শুধু দাসীদেরকে বুঝানো হয়েছে।মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহকে ভয় কর, তিনি সবকিছুই প্রত্যক্ষ করেন। গোপনীয় ও প্রকাশ্য সবই তিনি জানেন।
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
📘 সহীহ বুখারীতে হযরত আবুল আলিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলার স্বীয় নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করার ভাবার্থ হলো তাঁর নিজ ফেরেশতাদের কাছে নবী (সঃ)-এর প্রশংসা ও গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া। আর ফেরেশতাদের তার উপর দরূদ পাঠের অর্থ হলো তার জন্যে দু'আ করা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, বারাকাতের দুআ। আলেমগণ বলেন যে, আল্লাহর দরূদ অর্থ তাঁর রহমত এবং ফেরেশতাদের দরূদ পাঠের অর্থ ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। আতা (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তাবারাকা। ওয়া তা'আলার সালাতের ভাবার্থ হলো: (আরবি)অর্থাৎ “আমি মহান ও পবিত্র, আমার রহমত আমার গযবের উপর বিজয়ী।” এই আয়াতে কারীমার উদ্দেশ্য এই যে, যেন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কদর, মান-মর্যাদা ও ইজ্জত-সম্মান মানুষের নিকট প্রকাশ পেয়ে যায়। তারা যেন জানতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং তাঁর প্রশংসাকারী এবং তাঁর ফেরেশতারা তার উপর দরূদ পাঠকারী। মালায়ে আ’লার এই খবর দিয়ে জগতবাসীকে আল্লাহ তাআলা এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারাও যেন তার উপর দরূদ ও সালাম পাঠাতে থাকেন। যাতে মালায়ে আ’লা ও দুনিয়াবাসীর মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। হযরত মূসা (আঃ)-কে বানী ইসরাঈল জিজ্ঞেস করেছিলঃ “আপনার উপর কি আল্লাহ তা'আলা দরূদ পড়ে থাকেন?” আল্লাহ তা'আলা তখন তার কাছে অহী। পাঠিয়ে তাঁকে জানিয়ে দিলেনঃ “তুমি তাদেরকে বলে দাও যে, হা, মহান আল্লাহ নিজ নবী ও রাসূলদের উপর রহমত বর্ষণ করে থাকেন। এ আয়াতে ঐ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা খবর দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর মুমিন বান্দাদের উপরও রহমত বর্ষণ করে থাকেন। তিনি বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ তাআলাকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ পাঠ কর। আল্লাহ তিনিই যিনি তোমাদের উপর রহমত বর্ষণ করে থাকেন এবং তাঁর ফেরেশতারাও।” (৩৩:৪১-৪৩) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও যাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলেঃ আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে আশীষ ও দয়া বর্ষিত হয়।” (২:১৫৫-১৫৭) হাদীসে রয়েছেঃ “আল্লাহ তা'আলা কাতারের (সারীর) ডান দিকের লোকদের উপর দরূদ পড়ে থাকেন।” অন্য হাদীসে আছেঃ “হে আল্লাহ! আবুল আওফার বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করুন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে হযরত জাবির (রাঃ)-এর স্ত্রী আবেদন জানিয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর উপর ও তাঁর স্বামীর উপর দরূদ পাঠ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আল্লাহ তোমার উপর ও তোমার স্বামীর উপর রহমত বর্ষণ করুন।”রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠের নির্দেশ সম্পর্কে বহু মুতাওয়াতির হাদীস এসেছে। ওগুলোর মধ্যে আমরা কিছু কিছু বর্ণনা করবো ইনশাআল্লাহ। তাঁরই নিকট আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি।এই আয়াতের তাফসীরে হযরত কা'ব ইবনে আজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনাকে সালাম করা তো আমরা জানি। কিন্তু আপনার উপর সালাত বা দরূদ পাঠ কেমন?” উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা বলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন আপনি দরূদ নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর, নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।” (এভাবে এই দরূদ শরীফ ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারীও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন কিন্তু তার বর্ণনায় (আরবি) শব্দ নেই)
অন্য হাদীসঃ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা আপনার উপর সালাম, কিন্তু আপনার উপর আমরা দরূদ পাঠ করবো কিভাবে? উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা বলো: (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর, যেমন দরূদ নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর এবং বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর।” (এভাবে এই দরূদ ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য হাদীসঃ
আবু হুমাইদ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিভাবে আমরা আপনার উপর দরূদ পাঠ করবো?” জবাবে তিনি বলেন, তোমরা বলো: (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং তার স্ত্রীদের উপর ও তার সন্তানদের উপর যেমন দরূদ নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর এবং বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং তাঁর স্ত্রীদের ও সন্তানদের উপর, যেমন বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, সম্মানিত। (এভাবে এই দরূদ ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য হাদীসঃ
হযরত আবু মাসঊদ আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করেন যখন আমরা হযরত সা’দ ইবনে উবাদা (রাঃ)-এর মজলিসে বসেছিলাম। অতঃপর তাঁকে হযরত বাশীর ইবনে সা’দ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন আপনার উপর দরূদ পাঠ করি। সুতরাং কিভাবে আমরা আপনার উপর দরূদ পাঠ করবো?” বর্ণনাকারী বলেন যে, একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর বললেন, তোমরা বলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর যেমন আপনি দরূদ বর্ষণ করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর, এবং আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর সারা বিশ্বজগতে, নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মর্যাদাবান।” আর সালাম তো তেমনই যেমন তোমরা জান। (এভাবে ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ),ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)হযরত ইবনে মাসউদ বদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সাহাবীগণ বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সালাম তো আমরা জানি। কিন্তু আমরা যখন নামায পড়বো তখন আপনার উপর দরূদ কিভাবে পাঠ করবো?” উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা বলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর।” ইমাম শাফিয়ী (রঃ) স্বীয় মুসনাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে অনুরূপ আনয়ন করেছেন।ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর মাযহাব এই যে, নামাযের শেষ তাশাহহুদে কেউ যদি দরূদ না পড়ে তবে তার নামায শুদ্ধ হবে না। এই জায়গায় দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। পরবর্তী যুগের কোন কোন গুরুজন এই মাসআলায় ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর মতকে খণ্ডন করেছেন এবং বলেছেন যে, এটা শুধু তাঁরই উক্তি। তাঁর উক্তির বিপরীত কথার উপর ইজমা হয়েছে। অথচ এটা ভুল। সাহাবীদের আর একটি দল এটাই বলেছেন, যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবু মাসউদ বদরী (রাঃ) এবং জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ)। তাবেয়ীদের মধ্যেও এই মাযহাবের লোক গত হয়েছেন, যেমন শাবী (রঃ), আবু জাফর বাকির (রঃ) এবং মুকাতিল ইবনে হাইয়ান (রঃ)। ইমাম শাফিয়ী (রঃ) তো এদিকেই গিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার মধ্যে ও তাঁর সহচরদের মধ্যে কোনই মতানৈক্য নেই। ইমাম আহমাদ (রঃ)-এরও শেষ উক্তি এটাই, যেমন আবু যারআহ দেমাশকী (রঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে। ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (রঃ), ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম ফকীহও (রঃ) এটাই বলেন। এমন কি কোন কোন হাম্বলী মাযহাবের ইমাম বলেন যে, নামাযে কমপক্ষে (আরবি) বলাওয়াজিব। যেমন তিনি তাঁর সঙ্গীদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা দিয়েছেন। আর আমাদের কোন কোন সঙ্গী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বংশধরের উপর দরূদ পাঠও ওয়াজিব বলেছেন। মোটকথা, নামাযে দরূদ পাঠ ওয়াজিব হওয়ার উক্তিটি খুবই প্রকাশমান। আর হাদীসেও এর দলীল বিদ্যমান রয়েছে। পূর্বযুগীয় ও পরবর্তী যুগের গুরুজনদের মধ্যে ইমাম শাফিয়ী (রঃ) ছাড়াও অন্যান্য ইমামগণও এই উক্তিই করেছেন। সুতরাং এটা বলা কোনক্রমেই ঠিক হবে না যে, এটা শুধু ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর উক্তি এবং এটা ইজমার বিপরীত। আল্লাহ তাআলাই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। তাছাড়া নিম্নের হাদীসটিও এর পৃষ্ঠপোষকতা করেঃহযরত ফুযালা ইবনে উবায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে তার নামাযে দু'আ করতে শুনতে পান যে দু'আয় সে আল্লাহর প্রশংসা করেনি এবং নবী (সঃ)-এর উপর দরূদও পাঠ করেনি। তখন তিনি বলেনঃ “এ লোকটি খুব তাড়াতাড়ি করলো। তারপর তিনি তাকে ডাকলেন এবং তাকে অথবা অন্য কাউকে বললেনঃ “তোমাদের কেউ যখন দুআ করবে তখন যেন প্রথমে মহামহিমান্বিত আল্লাহর প্রশংসা করে ও তার উপর সানা পড়ে, তারপর যেন নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করে। অতঃপর যা ইচ্ছা করে তাই যেন চায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) (তিনি এটাকে সহীহ বলেছেন), ইমাম নাসাঈ (রঃ), ইবনে খুযাইমা (রঃ) এবং ইবনে হিব্বান (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এর সমর্থনে নিম্নের হাদীসটিও রয়েছেঃহযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী (রাঃ) তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার অযু নেই তার নামায নেই, ঐ ব্যক্তির অযু হয় না যে অযুর সময় বিসমিল্লাহ বলে না, ঐ ব্যক্তির নামায হয় না যে নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়ে না এবং ঐ ব্যক্তির নামায হয় না যে আনসারকে ভালবাসে না।” (এ হাদীস ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য হাদীসঃ
হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনাকে কিভাবে সালাম দিতে হবে তা আমরা জানি। কিন্তু কিভাবে আপনার উপর দরূদ পাঠ করবো? তিনি উত্তরে বললেন, তোমরা বললঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনার অনুগ্রহ, আপনার রহমত এবং আপনার বরকত নাযির করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন তা করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর, নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মর্যাদাবান। (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবু দাউদ আলআমা, যার নাম নাফী ইবনে হারিস পরিত্যক্ত ব্যক্তি। হযরত সালামা আল কানদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আলী (রাঃ) জনগণকে নিম্ন লিখিত দু'আটি শিক্ষা দিতেনঃ (আরবি) ঐ হাদীসের সনদ ঠিক নয়। এর বর্ণনাকারী আবু হারবাজ মুযীঃ সালামা কানদী পরিচিতও নয় এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর সাথে তার সাক্ষাৎ প্রমাণিতও নয়।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “যখন তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবে তখন খুব উত্তমরূপে পাঠ করবে। কারণ তোমরা জান না যে, হয়তো এটা তার উপর পেশ করা হবে।” জনগণ তখন তাকে বললেনঃ “তাহলে আপনি আমাদেরকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তোমরা বলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আপনার অনুগ্রহ, আপনার রহমত এবং আপনার বরকত দান করুন রাসূলদের নেতা, সংযমীদের ইমাম, নবীদেরকে শেষকারী, আপনার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর, যিনি কল্যাণের ইমাম, মঙ্গলের পরিচালক এবং রহমতের রাসূল। হে আল্লাহ! তাঁকে প্রশংসিত জায়গায় পাঠিয়ে দিন যার প্রতি পূর্ববর্তী ও পরবর্তীরা ঈর্ষা পোষণ করেন। হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন আপনি দরূদ নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহাসম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর, যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহামর্যাদাবান।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ্ বর্ণনা করেছেন। এ রিওয়াইয়াতটি মাওকুফ)হযরত ইউনুস ইবনে খাব্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, তাঁকে এমন এক ব্যক্তি খবর দিয়েছেন যিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন : “সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার উপর সালাম সম্পর্কে আমরা জানি। এখন বলুনঃ আপনার উপর দরূদ কিভাবে পাঠ করতে হবে?” তিনি উত্তরে বললেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর পরিবারের উপর, যেমন দরূদ নাযিল করেছেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ও ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারের উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহাসম্মানিত। আর দয়া করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর প্রতি ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর পরিবারের প্রতি, যেমন দয়া করেছেন ইবরাহীম (আঃ)-এর পরিবারের প্রতি। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহাসম্মানিত। আর বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বংশধরের উপর যেমন আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহাসম্মানিত। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)এর দ্বারা এ দলীলও গ্রহণ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে রহম বা করুণারও দু'আ রয়েছে। জমহূরের এটাই মাযহাব। এর আরো দৃঢ়তা নিম্নের হাদীস দ্বারা হয়ঃ হাদীসটি এই যে, একজন গ্রাম্য লোলে বলেছিলঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমার ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর দয়া করুন এবং আমাদের সাথে আর কারো উপর দয়া করবেন না।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি খুব বেশী প্রশস্ত জিনিসকে সংকীর্ণ করে দিলে।” কাযী আইয়ায (রঃ) জমহুর মালেকিয়া হতে এর অবৈধতা বর্ণনা করেছেন এবং আবু মুহাম্মাদ ইবনে আবি যায়েদ (রঃ) এটাকে জায়েয বলেছেন।
অন্য একটি হাদীসঃ
হযরত রাবীআহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করে তার জন্যে ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন যতক্ষণ সে আমার উপর দরূদ পড়তে থাকে। সুতরাং বান্দা এখন দরূদ পাঠ কম করুক অথবা বেশী করুক।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আর একটি হাদীসঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “লোকদের মধ্যে যারা আমার উপর অধিক দরূদ পাঠকারী তারাই হবে কিয়ামতের দিন সর্বোত্তম লোক। [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী (রঃ)]হযরত যায়েদ ইবনে তালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে একজন আগন্তুক আমার নিকট এসে বলেনঃ “যে বান্দা আপনার উপর একটি দুরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করেন। তখন একটি লোক দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি অবশ্যই আমার দু'আর অর্ধেক সময় আপনার উপর দরূদ পাঠে ব্যয় করবো।” জবাবে তিনি তাকে বললেনঃ “তুমি ইচ্ছা করলে তাই কর।” লোকটি আবার বললো: “আমার দু'আর দুই তৃতীয়াংশ সময় আমি আপনার উপর দরূদ পাঠে লাগাবো।” তিনি বললেনঃ “ইচ্ছা হলে তাই কর।” লোকটি পুনরায় বললো: “আমি আমার দু'আর সর্বাংশই আপনার উপর দরূদ পাঠে লাগিয়ে দিবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তাহলে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের চিন্তা হতে মুক্তি দান করবেন এবং তিনিই তোমার জন্যে যথেষ্ট হবেন। (এ হাদীসটি ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি হাদীসঃ
হযরত কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, মধ্যরাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বের হতেন এবং বলতেনঃ “প্রকম্পিতকারী আসছে এবং ওকে অনুসরণকারী পরবর্তী ধ্বনিও রয়েছে এবং মৃত্যু তার মধ্যে যা আছে তা নিয়ে আসছে।” [এ হাদীসটিও বর্ণনা করেছেন ইসমাঈল কাযী (রঃ)]হযরত উবাই (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা রাত্রে নামায পড়ে থাকি। আমি আমার নামাযের এক তৃতীয়াংশ সময় আপনার উপর দরূদ পাঠে কাটিয়ে দিবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “অর্ধেক (কাটাবে)।” তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে, তাহলে অর্ধেক সময় আপনার উপর দরূদ পাঠে লাগিয়ে দিবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “দুই তৃতীয়াংশ।” হযরত উবাই (রাঃ) বললেনঃ “আমি আমার নামাযের সমস্ত সময়ই আপনার উপর দরূদ পাঠে ব্যয় করে দিবো।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তাহলে তো আল্লাহ তা'আলা তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন।”হযরত কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত হতো তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) উঠতেন ও বলতেনঃ “হে লোক সকল! আল্লাহকে স্মরণ কর, আল্লাহকে স্মরণ কর! প্রকম্পিতকারী আসছে এবং ওকে অনুসরণকারীও আসছে। মৃত্যু তার মধ্যস্থিত বিপদ-আপদ নিয়ে চলে আসছে, মৃত্যু তার মধ্যস্থিত বিপদ-আপদ নিয়ে চলে আসছে।" হযরত উবাই (রাঃ) তখন বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আপনার উপর অধিক দরূদ পাঠ করে থাকি। বলুন তো, আমি আমার নামাযের কত অংশ আপনার উপর দরূদ পাঠে ব্যয় করবো?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তুমি যা চাইবে।” তিনি বললেনঃ “এক চতুর্থাংশ?” নবী (সঃ) জবাব দিলেনঃ “তুমি যা ইচ্ছা করবে। তুমি যদি বেশী সময় ব্যয় কর তবে সেটা তোমার জন্যে কল্যাণকর হবে।” উবাই বললেনঃ “তাহলে অর্ধেক?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি যা চাইবে, তবে তুমি যদি বেশী কর তখন তা তোমার জন্যে মঙ্গলজনক হবে।” হযরত উবাই বললেনঃ “তাহলে দুই তৃতীয়াংশ?” নবী (সঃ) জবাব দিলেনঃ “তুমি যা ইচ্ছা করবে। তবে যদি তুমি বেশী কর তা তোমার জন্যে হবে কল্যাণকর।” তখন হযরত উবাই (রাঃ) বললেনঃ “তাহলে আমার নামাযের সমস্ত সময়ই আমি আপনার উপর দরূদ পাঠে কাটিয়ে দিবো।” তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তাহলে আল্লাহ তোমাকে সমস্ত চিন্তা ও দুর্ভাবনা হতে রক্ষা করবেন এবং গুনাহ্ মাফ করে দিবেন। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং একে হাসান বলেছেন)হযরত উবাই (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, একটি লোক বললো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যদি আমি আমার সমস্ত দরূদ আপনার উপর পাঠ করি তবে কি হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাহলে আল্লাহ তা'আলা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত চিন্তা হতে বাঁচিয়ে নিবেন। এবং তোমার সমস্ত উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ (একদা) রাসূলুল্লাহ (সঃ) বের হলেন এবং আমিও তার অনুসরণ করলাম। তিনি একটি খেজুরের বাগানে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি সিজদায় পড়ে গেলেন। তিনি এতো দীর্ঘক্ষণ ধরে সিজদায় পড়ে থাকলেন যে, আমার মনে সন্দেহ হলো, তার রূহ বের হয়ে যায়নি তো! নিকটে গিয়ে আমি তাকে দেখতে লাগলাম। ইতিমধ্যে তিনি মাথা উঠালেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” আমি আমার অবস্থা তার কাছে প্রকাশ করলাম। তিনি তখন বললেনঃ “ব্যাপার ছিল এই যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বললেন, আমি আপনাকে একটি শুভ সংবাদ শুনাচ্ছি যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ আপনাকে বলেছেন- যে তোমার উপর দরূদ পাঠ করবে আমিও তার উপর রহমত নাযিল করবো এবং যে তোমার উপর সালাম পাঠাবে আমিও তার উপর সালাম পাঠাবো। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, শেষে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেনঃ “আমি মহিমান্বিত আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে এ সিজদা করেছিলাম।” হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কোন কার্যোপলক্ষে বের হন। তাঁর সাথে যাবে এমন কেউ ছিল না। তখন হযরত উমার (রাঃ) দ্রুত গতিতে তার পিছনে পিছনে চলতে থাকেন। দেখেন যে, তিনি সিজদায় পড়ে রয়েছেন। তিনি দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তিনি সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি যে আমাকে সিজদার অবস্থায় দেখে দূরে সরে গেছো এটা খুব ভাল কাজ করেছো, জেনে রেখো যে, আমার কাছে হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে বললেনঃ “আপনার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি একবার আপনার উপর দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন এবং তার দশধাপ মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। (এ হাদীসটি আবুল কাসেম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আবু তালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদের নিকট আসেন, ঐ সময় তাঁর চেহারায় আনন্দের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। সাহাবীগণ তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “একজন ফেরেশতা আমার নিকট এসে আমাকে এই সুসংবাদ দিলেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে কেউ আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করলে তার উপর আল্লাহর দশটি রহমত নাযিল হবে। অনুরূপভাবে আমার উপর কেউ একটি সালাম পাঠালে আল্লাহ তার উপর দশটি সালাম পাঠাবেন করেছেন। (ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, একটি দরূদের বিনিময়ে সে দশটি পুণ্য লাভ করবে, দশটি গুনাহ্ তার মাফ হয়ে যাবে, মর্যাদা দশ ধাপ উঁচু হয়ে যাবে এবং ওরই অনুরূপ তার উপর ফিরিয়ে দেয়া হবে।হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার উপর একটি দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তার উপর দশটি রহমত নাযিল করবেন। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে হাসান সহীহ বলেছেন)হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ তোমরা আমার উপর দরূদ পাঠ কর, কেননা এটা তোমাদের যাকাত। আর তোমরা আমার জন্যে আল্লাহর নিকট ওয়াসিলা যাজ্ঞা কর। এটা জান্নাতের একটি বিশেষ উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জায়গা। ওটা একজন লোকই শুধু লাভ করবে। আমি আশা করি যে, ঐ লোকটি আমিই হবো। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা তার উপর সত্তর বার দরূদ নাযিল করবেন। এখন যার ইচ্ছা কম করুক এবং যার ইচ্ছা বেশী করুক। জেনে রেখো যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের নিকট বের হয়ে আসলেন, তিনি যেন কাউকেও বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ “আমি মুহাম্মাদ (সঃ) উম্মী নবী।” একথা তিনি তিনবার বলেন। এরপর বলেনঃ “আমার পরে কোন নবী নেই। আমাকে অত্যন্ত উন্মুক্ত এবং খুবই ব্যাপক ও খতমকারী কালাম প্রদান করা হযেছে। জাহান্নামের দারোগা ও আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সংখ্যা কত তা আমি জানি। আমাকে বিশেষ দানে। ভূষিত করা হয়েছে। আমাকে ও আমার উম্মতকে সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দান করা হয়েছে। যতদিন আমি তোমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকবে ততদিন তোমরা আমার কথা শুনবে ও মানবে। যখন আমার প্রতিপালক আমাকে উঠিয়ে নিবেন তখন তোমরা আল্লাহর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে। তাতে বর্ণিত হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম মনে করবে।” (মুসনাদে আহমাদে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হয় সে যেন আমার উপর দরূদ পাঠ করে।”
অন্য হাদীসঃ
যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন।” (এ হাদীসটি আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
অন্য হাদীসঃ
হযরত হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তি বখীল বা কৃপণ যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হয় অথচ সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে না।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটিকে হাসান, গারীব, সহীহ বলেছেন)
অন্য হাদীসঃ
হযরত আবু যার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হয় অথচ সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে না সে হলো মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় কৃপণ। (এ হাদীসটি ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আর একটি হাদীসঃ
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হালে যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে না। ঐ ব্যক্তির নাক ধুলো-মলিন হালে যার উপর রমযান মাস অতিবাহিত হয়ে গেল অথচ তার গুনাহ মাফ হলো না। ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হালে যে তার পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ (তাদের খিদমত করে) সে জান্নাতে যেতে পারলো না। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং তিনি এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)এ হাদীসগুলো দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়া ওয়াজিব। আলেমদের একটি বড় দল এই মতের সমর্থক। যেমন তাহাবী (রঃ), হালীমী (রঃ) প্রমুখ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পড়তে ভুলে গেছে সে জান্নাতের পথ ভুল করেছে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটি মুরসাল হাদীস কিন্তু পূর্বের হাদীস দ্বারা এটা সবলতা লাভ করেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই ভাল জানেন)কোন কোন আলেম বলেন যে, মজলিসে অন্ততঃ একবার দরূদ পাঠ ওয়াজিব এবং পরেরগুলো মুস্তাহাব। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যারা কোন মজলিসে বসে এবং আল্লাহর যিকর ও নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ ছাড়াই উঠে পড়ে তারা কিয়ামতের দিন হতভাগ্য হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তিও দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)অন্য রিওয়াইয়াতে আল্লাহর যিকরের উল্লেখ নেই। তাতে এও আছে যে, তারা জান্নাতে গেলেও দরূদ পাঠের সওয়াব লাভে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আফসোস করতে থাকবে।কারো কারো উক্তি এই যে, জীবনে একবার নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ ওয়াজিব, তারপর মুস্তাহাব, যাতে আয়াতের উপর আমল করা যায়। কাযী আইয়ায (রঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ ওয়াজিব হওয়ার কথা বলার পর এই উক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কিন্তু তাবারী (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত দ্বারা তো নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ মুস্তাহাব হওয়াই প্রমাণিত হচ্ছে এবং এর উপর ইজমা হওয়ার তিনি দাবী করেছেন। খুব সম্ভব তারও উদ্দেশ্য এটাই যে, একবার ওয়াজিব এবং পরে মুস্তাহাব। যেমন তার নবুওয়াতের সাক্ষ্য দান। কিন্তু আমি বলি যে, এটা খুবই গরীব বা দুর্বল উক্তি। কেননা, নবী (সঃ)-এর উপর বহু সময় দরূদ পাঠের নির্দেশ এসেছে। এগুলোর মধ্যে কোনটা ওয়াজিব। এবং কোনটা মুস্তাহাব। যেমন আযান সম্পর্কে হাদীসে এসেছেঃ হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “যখন তোমরা মুআযযিনকে আযান দিতে শোন তখন সে যা বলে তোমরাও তা-ই বলো। অতঃপর আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। কেননা, যে আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করেন। তারপর আমার জন্যে আল্লাহর নিকট ওয়াসীল যা করবে। নিশ্চয়ই ওটা জান্নাতের এমন একটি স্থান যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একজন বান্দা ছাড়া আর কারো জন্যে শোভনীয় নয়। আমি আশা করি যে, আমিই সেই বান্দা। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্যে ওয়াসীলা যাঞা করবে তার জন্যে আমার। শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যাবে।'
অন্য ধারাঃ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে আমার জন্যে ওয়াসীলা প্রার্থনা করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্যে আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন)
অন্য হাদীসঃ
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। কেননা, আমার উপর তোমাদের দরূদ পাঠ তোমাদের জন্যে যাকাত। আর তোমরা আমার জন্যে ওয়াসীলা প্রার্থনা কর। ওয়াসীলা হচ্ছে জান্নাতের মধ্যে একটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন স্থান। একটি লোক ছাড়া তা কেউ লাভ করতে পারবে না এবং আমি আশা করি যে, ঐ লোকটি আমিই হবো।” (এ হাদীসটি ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত রুওয়াইফা ইবনে সাবিত আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করে এবং বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তাঁকে আপনি আপনার নিকটতম আসন দান করুন,” কিয়ামতের দিন তার জন্যে আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত তাউস হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বড় শাফাআ'ত কবুল করুন এবং তার উঁচু দরযা উপরে উঠিয়ে দিন, তাঁর পারলৌকিক ও ইহলৌকিক চাহিদার জিনিস তাকে প্রদান করুন, যেমন প্রদান করেছিলেন ইবরাহীম (আঃ) ও মূসা (আঃ)-কে।” এর ইসনাদ উত্তম, সবল ও সঠিক।দরূদ পাঠ করতে হবে মসজিদে প্রবেশ করার সময় এবং মসজিদ হতে বের হবার সময়। কেননা, এরূপ হাদীস রয়েছে যা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীস হলো: হযরত ফাতিমা (রাঃ) বিনতে রাসূলিল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন তিনি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়তেন, তারপর বলতেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিন এবং আমার জন্যে আপনার রহমতের দরগুলো খুলে দিন। আর যখন মসজিদ হতে বের হতেন। তখন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করতেন, তারপর বলতেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমার গুনাহগুলো মাফ করে দিন এবং আপনার অনুগ্রহের দুরগুলো খুলে দিন!”ইসমাঈল কাযী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা মসজিদে গমন করবে তখন নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবে।” নামাযের শেষের আত্তাহিয়্যাতু এর আলোচনা পূর্বেই গত হয়েছে। তবে প্রথম তাশাহহুদে এটাকে কেউই ওয়াজিব বলেননি। অবশ্য এটা মুস্তাহাব হওয়ার একটি উক্তি ইমাম শাফিয়ী (রঃ)-এর রয়েছে। যদিও দ্বিতীয় উক্তিতে এর বিপরীতও তার থেকেই বর্ণিত হয়েছে। জানাযার নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়তে হবে। সুন্নাত তারীকা এই যে, প্রথম তাকবীরে সূরায়ে ফাতেহা পড়তে হবে, দ্বিতীয় তাকবীরে পড়তে হবে দরূদ শরীফ, তৃতীয় তাকবীরে মৃতের জন্যে দু'আ করতে হবে এবং চতুর্থ তাকবীরে পড়তে হবে: (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! এর পূণ্য হতে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না এবং এর পরে আমাদেরকে ফিত্নায় ফেলবেন না।” নবী (সঃ)-এর সাহাবীদের এক ব্যক্তির উক্তি হলো এই যে, জানাযার নামাযের মাসনূন তরীকা হলো: ইমাম সাহেব তাকবীর পড়ে আস্তে আস্তে সূরায়ে ফাতেহা পড়বেন। তারপর নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবেন এবং মৃতের জন্যে আন্তরিকতার সাথে দু'আ করবেন এবং তাকবীরগুলোতে কিছুই পড়বেন। তারপর চুপে চুপে সালাম ফিরাবেন। (এটা ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)ঈদের নামাযের পূর্বে হযরত ওয়ালীদ ইবনে উকবা (রাঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত আবু মূসা (রাঃ) এবং হযরত হুযাইফা (রাঃ)-এর নিকট আগমন করেন। এসে তিনি বলেনঃ “আজ তো ঈদের দিন। বলুন তো তাকবীরের নিয়ম কি?” উত্তরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “তাকবীরে তাহরীমা বলে আল্লাহর প্রশংসা করবে ও নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়বে। তারপর দু'আ করবে। এপর তাকবীর বলে এটাই করবে, আবার তাকবীর বলে এটাই করবে, পুনরায় তাকবীর বলে এটাই করবে, আবার তাকবীর বলে এটাই করবে। এরপর কিরআত পড়বে। তারপর তাকবীর পাঠ করে রুকু করবে। তারপর দাঁড়িয়ে পাঠ করবে এবং স্বীয় প্রতিপালকের প্রশংসা করবে ও নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়বে। এরপর দু'আ করবে ও তাকবীর দিবে এবং এভাবে আবার রুকূতে যাবে।” হযরত হুযাইফা (রাঃ) ও হযরত আবু মূসাও (রাঃ) তাঁর কথা সত্যায়িত করেন।নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠের সাথে দু'আ শেষ করতে হবে। এটা মুস্তাহাব। হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “দু’আ আসমান ও যমীনের মাঝে রুদ্ধ থাকে যে পর্যন্ত না তুমি তোমার নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ কর।” রাযীন ইবনে মুআবিয়া (রাঃ) তাঁর কিতাবে মারফুরূপে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “দু'আ আসমান ও যমীনের মাঝে রুদ্ধ থেকে যায় যে পর্যন্ত আমার উপর দরূদ পাঠ করা হয়। তোমরা আমাকে আরোহীর পানপাত্রের মত করো না। তোমরা দুআর প্রথমে, শেষে ও মধ্যে আমার উপর দরূদ পাঠ করো।” (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেছেনঃ “তোমরা আমাকে সওয়ারের পেয়ালার মত করো না। যখন সে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গ্রহণ করে তখন পানপাত্রটিও পূর্ণ করে থাকে। অযুর প্রয়োজন হলে তা থেকে অযু করে, পিপাসা পেলে তা হতে পান করে, অন্যথায় ফেলে দেয়। তোমরা দু'আর শুরুতে, মধ্যভাগে এবং শেষে আমার উপর দরূদ পাঠ করে নিবে। এটি গারীব বা দুর্বল হাদীস। বিশেষ করে দু'আয়ে কুনূতে এর খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ) বলেনঃ “আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কয়েকটি কালেমা শিখিয়ে দিয়েছেন যা বেতরের নামাযে পড়ে থাকি। সেগুলো হলো: (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি যাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন তাদের মধ্যে আমাকেও হিদায়াত দান করুন, যাদেরকে আপনি নিরাপদে রেখেছেন তাদের মধ্যে আমাকেও নিরাপদে রাখুন, যাদের আপনি কর্ম সম্পাদন করেছেন তাদের মধ্যে আমারও কর্ম সম্পাদন করুন, আমাকে আপনি যা দিয়েছেন তাতে আমার জন্যে বরকত দান করুন, আপনি যে অমঙ্গলের ফায়সালা করেছেন তা হতে আমাকে রক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আপনি ফায়সালা করেন এবং আপনার উপর ফায়সালা করা হয় না। নিশ্চয়ই যাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন সে লাঞ্ছিত হয় না এবং যার সাথে আপনি শত্রুতা রাখেন সে সম্মান লাভ করে না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি কল্যাণময় এবং সমুচ্চ।” সুনানে নাসাঈতে এর পরে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “নবী (সঃ)-এর উপর আল্লাহ দুরূদ নাযিল করুন।”জুমআর দিনে ও রাত্রে নবী (সঃ)-এর উপর বেশী বেশী দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। হযরত আউস ইবনে আউস সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বোত্তম দিন হলো জুমআর দিন। এদিনেই হযরত আদম (রাঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়, এই দিনেই তাঁর রূহ কবয করা হয়। এই দিনেই শিঙ্গায় ফুঙ্কার দেয়া হবে এবং এই দিনেই সবাই অজ্ঞান হবে। সুতরাং তোমরা এই দিনে খুব বেশী বেশী আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। তোমাদের দরূদ আমার উপর পেশ করা হয়।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনাকে তো যমীনে দাফন করে দেয়া হবে, সুতরাং এমতাবস্থায় কিভাবে আমাদের দরূদ আপনার উপর পেশ করা হবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা যমীনের উপর নবীদের দেহকে ভক্ষণ করা হারাম করে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে আবি দাউদ, সুনানে নাসাঈ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থেও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে)
অন্য একটি হাদীসঃ
হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জুমআর দিন তোমরা খুব বেশী বেশী দরূদ পড়বে। ঐ দিন ফেরেশতা হাযির হন। যখন কেউ আমার উপর দরূদ পড়ে তখন তার দরূদ আমার উপর পেশ করা হয় যে পর্যন্ত না সে এর থেকে ফারেগ হয়।” জিজ্ঞেস করা হলো: “মৃত্যুর পরেও কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীদের দেহকে খাওয়া যমীনের উপর হারাম করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহর নবীরা জীবিত থাকেন এবং তাঁদেরকে আহার্য পৌঁছানো হয়। (এ হাদীসটি আবু আবদিল্লাহ ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব এবং ছেদ কাটা। এসব ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন)ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জুমআর দিনে ও রাত্রে আমার উপর খুব বেশী বেশী দরূদ পড়বে।” (এ হাদীসটিও দুর্বল)একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, যার সাথে রুহুল কুদুস (হযরত জিবরাঈল আঃ) কথা বলেছেন তার দেহ যমীনে খায় না। এ হাদীসটি মুরসাল। আর একটি মুরসাল হাদীসেও জুমআর দিনে ও রাত্রে খুব বেশী করে দরূদ পাঠের হুকুম রয়েছে। অনুরূপভাবে খতীবের উপর দুই খুৎবায় দরূদ পাঠ ওয়াজিব। এটা ছাড়া খুৎবা শুদ্ধ হবে না। কেননা, এটা ইবাদত এবং ইবাদতে আল্লাহর যিকর ওয়াজিব। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যিকরও ওয়াজিব হবে। যেমন আযান ও নামায। ইমাম শাফিয়ী (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ)-এর মাযহাব এটাই।আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর কবর যিয়ারত করার সময়ও তার উপর দরূদ পাঠ মুস্তাহাব। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমাদের কেউ আমার উপর সালাম পাঠ করে তখন আল্লাহ আমার উপর রূহ ফিরিয়ে দেন, শেষ পর্যন্ত আমি তার সালামের জবাব দিয়ে থাকি।” (ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নববী (রঃ) এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন)হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবর বানিয়ে নেবে না এবং আমার কবরে মেলা বসাবে না। হ্যা, তবে আমার উপর দরূদ পাঠ করবে। কেননা, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তোমাদের দরূদ আমার কাছে পৌঁছে থাকে। (এ হাদীসটিও ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)বর্ণিত আছে যে, একটি লোক প্রত্যহ সকালে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর রওযা মুবারকের উপর আসততা এবং তার উপর দরূদ পাঠ করতো। একদা তাকে হযরত আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) বললেনঃ “তুমি এরূপ কর কেন?” সে উত্তরে বললো: “নবী (সঃ)-এর উপর সালাম পাঠ আমি খুব পছন্দ করি।” তখন তিনি লোকটিকে বললেন, তাহলে শুন, আমি তোমাকে একটি হাদীস শুনাচ্ছি যা আমি আমার পিতা হতে এবং তিনি আমার দাদা হতে শুনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমার কবরকে ঈদ বানিয়ে নিয়ো না। নিজেদের ঘরগুলোকে তোমরা কবর বানিয়ে নিয়ো না। যেখানেই তোমরা থাকো না কেন আমার উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করতে থাকবে। ঐ দরূদ ও সালাম আমার নিকট পৌঁছে যায়। এ হাদীসটি কাযী ইসমাঈল ইবনে ইসহাক (রঃ) স্বীয় কিতাব ফাযলুস সলাতে আলান নাবিয়্যি (সঃ)'-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদে একজন বর্ণনাকারী সন্দেহযুক্ত রয়েছে যার নাম উল্লেখ করা হয়নি। অন্য সনদে এ রিওয়াইয়াতটি মরসালরূপে বর্ণিত হয়েছে যাতে হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কবরের পার্শ্বে কতকগুলো লোককে দেখে তাদেরকে এই হাদীসটি শুনিয়েছিলেন এবং তাঁর কবরে মেলা বসাতে তিনি নিষেধ করেছিলেন। খুব সম্ভব, লোকগুলোর বেআদবীর কারণেই তিনি তাদেরকে হাদীসটি শুনিয়েছিলেন এবং তাদেরকে এটা শুনানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, তারা হয়তো উচ্চস্বরে দরূদ পাঠ করছিল।এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি একটি লোককে দিনের পর দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর রওযা মুবারকের পার্শ্বে আসতে দেখে তাকে বলেনঃ “তুমি এবং যে ব্যক্তি স্পেনে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ ও সালাম পাঠ করার দিব দিয়ে উভয়েই সমান।”হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন আমার উপর দরূদ পাঠ করো। কেননা, তোমাদের দরূদ আমার নিকট পৌঁছে থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “এটা একটা বিশেষ গোপনীয় বিষয়। যদি তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করতে তবে আমি বলতাম না। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তা'আলা আমার সাথে দু’জন ফেরেশতা নিযুক্ত রেখেছেন। যখন কোন মুসলমানের সামনে আমার যিকর করা হয় এবং সে আমার উপর দরূদ পাঠ করে তখন ঐ ফেরেশতা দু’জন বলেনঃ “আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন!” তখন আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা ঐ দু’জন ফেরেশতার এ কথার জবাবে ‘আমীন’ বলেন। (এ হাদীসটিও ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হাদীসটি খুবই দুর্বল এবং সদনও দুর্বল)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর যেসব ফেরেশতা যমীনে চলাফেরা করেন তারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌঁছিয়ে থাকেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) প্রমুখ বর্ণনা করেছেন) একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে আমার কবরের পার্শ্বে আমার উপর সালাম পাঠ করে আমি তার ঐ সালাম শুনে থাকি এবং যে দরূদ ও সালাম পাঠায়, আমার কাছে তা পৌঁছিয়ে দেয়া হয়।” সনদের দিক দিয়ে এ হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। মুহাম্মাদ ইবনে মারওয়ান সুদ্দী সাগীর পরিত্যক্ত। আমাদের সাথীরা বলেছেন যে, যে ব্যক্তি হজ্বের ইহরাম বেঁধেছে সে যখন তালবিয়া বা লাব্বায়েক' পাঠ হতে ফারেগ হবে তখন তারও উচিত নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা। মুহাম্মাদ ইবনে আবি কবর (রাঃ) বলেন যে, মানুষ যখন তালবিয়া পাঠ হতে ফারেগ হবে তখন সর্বাবস্থায় তাকে নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” (এটা ইমাম শাফিয়ী (রঃ) ও ইমাম দারে কুনী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “যখন তোমরা মক্কায় পৌঁছবে তখন সাতবার বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে ও মাকামে ইবরাহীমে দু'রাকআত নামায পড়বে। তারপর সাফা পাহাড়ের উপর উঠবে যেখান থেকে তোমরা বায়তুল্লাহকে দেখতে পাবে, সেখানে সাতবার তাকবীর পাঠ করবে যার মাঝে আল্লাহর উপর হামদ ও সানা এবং নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করবে ও নিজের জন্যে দুআ করবে। মারওয়া পাহাড়েও অনুরূপ কাজ করবে। এটা ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর ইসনাদ খুবই উত্তম, সুন্দর ও সবল।আমাদের সাথীরা একথাও বলেছেন যে, কুরবানীর পশু যবেহ করার সময়ও আল্লাহর যিরের সাথে নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পড়া মুস্তাহাব। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “এবং আমি তোমার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।” (৯৪:৪)। জমহুর এর বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন যে, এখানে শুধু আল্লাহর যিকরই যথেষ্ট। যেমন আহারের সময়, সহবাসের সময় ইত্যাদি। এই সময়গুলোতে দরূদ পাঠ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়। অন্য একটি হাদীসঃ হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহর সমস্ত নবী ও রাসূলের উপরও দরূদ ও সালাম পাঠ করবে। কেননা, আল্লাহ তা'আলা আমার ন্যায় তাঁদেরকেও প্রেরণ করেছেন। (এ হাদীসটি ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সনদে দুই জন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। তারা হলেন আমর ইবনে হারূন ও তার শায়েখ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)কানের টুনটুন শব্দের সময়ও নবী (সঃ)-এর উপর দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব।হযরত আবু রাফে’ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, তোমাদের কারো কানে যখন টুনটুন শব্দ হবে তখন যেন সে আমাকে স্মরণ করে ও আমার উপর দরূদ পাঠ করে এবং বলেঃ “যে আমাকে মঙ্গলের স্মরণ করেছে তাকেও যেন আল্লাহ তা'আলা স্মরণ করেন।" এর ইসনাদ দুর্বল এবং এটা প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
মাসআলাঃ
লিখকগণ এটা মুস্তাহাব বলেছেন যে, লিখক যখনই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম লিখবে তখনই যেন সে (আরবি) লিখে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন কিতাবে আমার উপর দরূদ লিখে, তার দরূদের সওয়াব ঐ সময় পর্যন্ত জারি থাকে যে সময় পর্যন্ত এ কিতাবখানা বিদ্যমান থাকে।” বিভিন্ন কারণে এ হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়। এমনকি ইমাম যাহাবী (রঃ)-এর শায়েখ এটাকে মাওযু হাদীস বলেছেন।(আরবি)বা অধ্যায়ঃ নবীগণ ছাড়া অন্যদের উপর দরূদ পাঠ যদি নবীদের সাথে জড়িত বা মিলিতভাবে হয় তবে তা নিঃসন্দেহে জায়েয। যেমন পূর্বে বর্ণিত হাদীসে গত হয়েছে (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি দরূদ নাযিল করুন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর এবং তাঁর পরিবারবর্গের উপর, তাঁর স্ত্রীদের উপর এবং তাঁর সন্তানদের উপর।” হ্যাঁ, তবে শুধু গায়ের নবীদের উপর দরূদ পাঠের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ একে জায়েয বলেছেন এবং দলীল হিসেবে (আরবি) (৩৩:৩) এবং (আরবি) (২:১৫৭) আল্লাহ তা'আলার এ উক্তিকে গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বাণীকেও দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। যখন তার কাছে কোন কওমের সাদকা আসতো তখন তিনি বলতেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি তাদের উপর দরূদ নাযিল করুন!” যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রাঃ) বলেন, যখন আমার পিতা সাদকার মাল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আসলেন তখন তিনি বললেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আবু আওফা (রাঃ)-এর পরিবারের উপর দরূদ নাযিল করুন।”অন্য একটি হাদীসে আছে যে, একটি স্ত্রীলোক বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার উপর ও আমার স্বামীর উপর দরূদ পাঠ করুন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ তোমার উপর ও তোমার স্বামীর উপর রহমত নাযিল করুন।”কিন্তু জমহুর উলামা এর বিপরীত মত পোষণ করেন। তাঁরা বলেন যে, স্বতন্ত্রভাবে গায়ের নবীদের উপর দরূদ পাঠ জায়েয নয়। কেননা এর ব্যবহার নবীদের জন্যে এতো বেশী প্রচলিত যে, এটা শুনা মাত্রই যমীনে এই খেয়াল জেগে ওঠে যে, এ নাম কোন নবীরই হবে। সুতরাং এটা গায়ের নবীর জন্যে ব্যবহার না করাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। যেমন আবু বকর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা আলী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলা ঠিক হবে না, যদিও অর্থের দিক দিয়ে তেমন কোন দোষ নেই। অনুরূপভাবে (আরবি) বলা চলবে না, যদিও মুহাম্মাদ (সঃ) মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। কেননা, এ শব্দগুলো আল্লাহ তা'আলার জন্যেই প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। আর কিতাব ও সুন্নাতে (আরবি) শব্দের ব্যবহার গায়ের নবীদের জন্যে এসেছে দুআ হিসেবে। এ কারণেই আলে আবি আওফাকে এর পরে কেউই এই শব্দগুলোর দ্বারা স্মরণ করেনি। এই পন্থা আমাদের কাছেও ভাল লাগছে। তবে এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। কেউ কেউ অন্য একটি কারণও বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ নবীদের ছাড়া অন্যদের জন্যে এই ‘সালাত' শব্দ ব্যবহার করা প্রবৃত্তি পূজকদের আচরণ। তারা তাদের বুযর্গদের ব্যাপারেও এরূপ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং তাদের অনুসরণ করা আমাদের উচিত নয়।এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা বিরোধ কি পর্যায়ের সে সম্পর্কেও মতানৈক্য রয়েছে যে, এটা কি তাহরীম না কারাহাতে তানযীহিয়্যাহ? না পূর্ববর্তীদের বিরোধ? সঠিক কথা এই যে, এটা মাকরূহে তানযীহী। কেননা, এটা প্রবৃত্তি পূজকদের রীতি। সুতরাং আমাদের তাদের অনুসারী হওয়া উচিত নয়। আর মাকরূহ তো ওটাই যেটা ছেড়ে দেয়াই উত্তম। আমাদের সাথীরা বলেনঃ নির্ভরযোগ্য কথা হচ্ছে এটাই যে, পূর্বযুগীয় মনীষীরা ‘সালাত' শব্দটিকে নবীদের জন্যেই নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন (আরবি) শব্দটি আল্লাহ তা'আলার জন্যেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখন থাকলো সালাম সম্পর্কে কথা। এ সম্পর্কে শায়েখ আবু মুহাম্মাদ জুওয়াইনী (রঃ) বলেন যে, এটাও (আরবি) এর অর্থ প্রকাশ করে থাকে। সুতরাং অনুপস্থিতের উপর এটা ব্যবহৃত হয় না। আর যে নবী নয়, বিশেষ করে তার জন্যে এটা ব্যবহার করা চলবে না। সুতরাং আলী (আলাইহিস সালাম) বলা যাবে না। জীবিত ও মৃতদের এটাই হুকুম। হ্যাঁ, তবে যে সামনে বিদ্যমান থাকে তাকে সম্বোধন করে (আরবি) বা (আরবি) অথবা(আরবি) কিংবা (আরবি) বলা জায়েয। আর এর উপর ইজমা হয়েছে। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, লেখকদের কলমে আলী আলাইহিস সালাম বা আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু লিখিত হয়ে থাকে। যদিও অর্থের দিক দিয়ে এতে কোন দোষ নেই, কিন্তু এর দ্বারা অন্যান্য সাহাবীদের সাথে কিছুটা বেআদবী করা হয়। সমস্ত সাহাবীর সাথেই আমাদের ভাল ধারণা রাখা উচিত। এ শব্দগুলো তাযীম ও তাকরীমের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং এ শব্দগুলো তো হযরত আলী (রাঃ)-এর চেয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) এবং হযরত উসমান (রাঃ)-এর জন্যে বেশী প্রযোজ্য। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, নবী (সঃ) ছাড়া আর কারো জন্যে দুরূদ পাঠ উচিত নয়। হ্যা, তবে মুসলমান নর ও নারীর জন্যে দু'আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) তঁার এক পত্রে লিখেনঃ “কতক লোক আখিরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া লাভের চিন্তায় লেগে রয়েছে। আর কতক লোক তাদের খলীফা ও আমীরদের জন্যে ‘সালাত' শব্দটি ব্যবহার করছে যা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে ছিল। যখন তোমার কাছে আমার এই পত্র পৌঁছবে তখন তুমি তাদেরকে বলে দেবে যে, তারা যেন 'সালাত' শব্দটি শুধু নবীদের জন্যে ব্যবহার করে এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্যে এটা ছাড়া যা ইচ্ছা প্রার্থনাকরে।” ইসমাঈল কাযী (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন। এটি উত্তম ‘আসার'।হযরত কা'ব (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যহ সকালে সত্তর হাজার ফেরেশতা এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কবরকে ঘিরে নেন এবং নিজেদের ডানাগুলো গুটিয়ে নিয়ে তাঁর জন্যে রহমতের প্রার্থনা করতে থাকেন এবং সত্তর হাজার ফেরেশতা রাত্রে আসেন এবং সত্তর হাজার ফেরেশতা দিনে আসেন। এমনকি যখন তাঁর কবর মুবারক ফেটে যাবে তখনও সত্তর হাজার ফেরেশতা তাঁর সাথে থাকবেন। (এ হাদীসটিও ইসমাঈল কাযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ফরা বা শাখা
ইমাম নববী (রঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দরূদ ও সালাম এক সাথে পাঠ করা উচিত। শুধু (আরবি) অথবা শুধু (আরবি) বলা উচিত নয়। এ আয়াতেও দুটোরই হুকুম রয়েছে। সুতরাং(আরবি) এরূপ বলাই উত্তম।
إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُهِينًا
📘 Please check ayah 33:58 for complete tafsir.
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
📘 ৫৭-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর
যারা আল্লাহর আহকামের বিরোধিতা করে, তার নিষিদ্ধ কাজগুলো হতে বিরত না থেকে তাঁর অবাধ্যতায় চরমভাবে লেগে থাকে এবং এভাবে তাঁকে অসন্তুষ্ট করে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ধমক দিচ্ছেন ও ভয় প্রদর্শন করছেন। তাছাড়া তারা তাঁর রাসূল (সঃ)-কে নানা প্রকারের অপবাদ দেয়। তাই তারা অভিশপ্ত ও শাস্তির যোগ্য। হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা প্রতিমা তৈরীকারীদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। তারা যুগকে গালি দেয়, অথচ যুগতো আমিই। আমিই তো রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তন আনয়ন করি। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)ভাবার্থ এই যে, অজ্ঞতার যুগের লোকেরা বলতোঃ হায়, হায়! কি যুগ এলো! খারাপ যুগের কারণেই আমাদের এ অবস্থা হলো! এভাবে আল্লাহর কাজকে যুগের উপর চাপিয়ে দিয়ে যুগকে গালি দেয়। তাহলে যুগের যিনি পরিবর্তনকারী প্রকারান্তরে তাঁকেই গালি দেয়া হলো। হযরত সুফিয়া (রাঃ)-কে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বিয়ে করলেন তখন কতগুলো লোক সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর কথামত এ আয়াত এই ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়। তবে আয়াতটি সাধারণ। যে কোন দিক দিয়েই যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দিবে সেই এই আয়াতের মর্মমূলে অভিশপ্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। কেননা, আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দেয়ার অর্থ আল্লাহকেই কষ্ট দেয়া।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল আল মুযানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। দেখো, আমি আল্লাহকে মাঝে রেখে বলছি যে, আমার পরে আমার সঙ্গীদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করো না। আমাকে ভালবাসার কারণে তাদেরকেও ভালবাসবে। তাদের সাথে শত্রুতা পোষণকারী মূলতঃ আমার সাথেই শত্রুতাকারী। তাদেরকে যারা কষ্ট দিবে তারা আমাকে কষ্ট দিবে। আর যে আমাকে কষ্ট দিলে সে আল্লাহকে কষ্ট দিলো। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিলো, আল্লাহ সত্বরই তাকে পাকড়াও করবেন।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অতঃপর ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেছেন যে, এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল)মহান আল্লাহ বলেনঃ মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী কোন অপরাধ না করলেও যারা তাদেরকে পীড়া দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে। আল্লাহ তা'আলার এই শাস্তির প্রতিজ্ঞার মধ্যে প্রথমে কাফিররা শামিল ছিল, পরে রাফেয়ী এবং শীআ'রাও এর অন্তর্ভুক্ত হয় যারা ঐ সাহাবীদের (রাঃ) দোষ অন্বেষণ করতো আল্লাহ যাদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তা'আলা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তিনি আনসার ও মুহাজিরদের প্রতি সন্তুষ্ট। কুরআন কারীমে জায়গায় জায়গায় তাদের প্রশংসা ও স্তুতি বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এই অনভিজ্ঞ ও স্থূল বুদ্ধির ললাকেরা তাদের মন্দ বলে ও তাদের নিন্দে করে। তারা তাদেরকে এমন দোষে দোষারোপ করে যে দোষ তাঁদের মধ্যে মোটেই নেই। সত্য কথা তো এই যে, আল্লাহর পক্ষ হতে তাদের অন্তর উল্টে গেছে। এজন্যেই তাদের জিহ্বাও উল্টে গেছে। ফলে তারা তাদের দুর্নাম করছে যারা প্রশংসার যোগ্য এবং যারা নিন্দার পাত্র তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জিজ্ঞেস করা হলো: “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! গীবত কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তোমার ভাই সম্পর্কে তোমার এমন আলোচনা, যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হবে। আবার প্রশ্ন করা হলো: “আমি আমার ভাই সম্পর্কে যা বলি তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থাকে (তাহলেও কি ওটা গীবত হবে)?” জবাবে তিনি বললেনঃ “তুমি তোমার ভাই সম্বন্ধে যা বললে তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থাকে তবেই তো তুমি তার গীবত করলে। আর তুমি তার সম্বন্ধে যা বললে তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তো তুমি তাকে অপবাদ দিলে। (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এরূপ বর্ণনা ইমাম তিরযিমীও (রঃ) করেছেন এবং তিনি এ হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন)হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় সুদ কোনটি (তা তোমরা জান কি)?” সাহাবীগণ উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সঃ) সবচেয়ে ভাল জানেন।” তখন তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় সুদ হলো কোন মুসলমানকে বে-ইজ্জত ও অপদস্থ করা।” অতঃপর তিনি; (আরবি) এ আয়াতটি পাঠ করেন। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
📘 Please check ayah 33:62 for complete tafsir.
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ ۗ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ إِلَّا أَنْ تَفْعَلُوا إِلَىٰ أَوْلِيَائِكُمْ مَعْرُوفًا ۚ كَانَ ذَٰلِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا
📘 আল্লাহ তা'আলা জানেন যে, তাঁর রাসূল (সঃ) নিজের জীবন অপেক্ষা নিজের উম্মতের উপর অধিকতর দয়ালু, এজন্যে তিনি তাঁর রাসূল (সঃ)-কে তাদের উপর তাদের জীবনের চেয়েও বেশী অধিকার দিয়েছেন। তারা নিজেদের জন্যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, বরং রাসূল (সঃ)-এর প্রত্যেক হুকুমকে জান-প্রাণ দিয়ে তাদেরকে কবুল করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ বিসম্বাদের বিচারের ভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে ওটা মেনে না নেয়।” (৪:৬৫) সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! ততামাদের মধ্যে কেউ মুমিন হতে পারে না যে পর্যন্ত না আমি তার কাছে প্রিয়। হই তার নিজের জান, মাল, সন্তান এবং সমস্ত লোক অপেক্ষা।” সহীহ হাদীসে আরো বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আপনি আমার নিকট আমার প্রাণ ছাড়া সবকিছু হতেই প্রিয়।" তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! না (এতেও তুমি মুমিন হতে পার না), বরং আমি যেন তোমার কাছে তোমার জীবন অপেক্ষাও প্রিয় হই।" তখন তিনি বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহর শপথ! (এখন হতে) আপনি আমার নিকট সব কিছু হতেই প্রিয় হয়ে গেলেন। এমনকি আমার নিজের জীবন হতেও।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “হে উমার (রাঃ)! এখন (তুমি পূর্ণ মুমিন হলে)।” এ জন্যেই আল্লাহ তা'আলা বলেন যে, নবী (সঃ) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর।এ আয়াতের তাফসীরে সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়া ও আখিরাতে সমস্ত মুমিনের সবচেয়ে বেশী হকদার আমিই, এমনকি তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও। তোমরা ইচ্ছা করলে। (আরবি)-এই আয়াতটি পড়ে নাও। জেনে রেখো যে, যদি কোন মুসলমান মাল-ধন রেখে মারা যায় তবে সেই মালের হকদার হবে তার উত্তরাধিকারীরা। আর যদি কোন মুসলমান তার কাঁধে ঋণের বোঝা রেখে মারা যায় অথবা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে মারা যায় তবে তার ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার এবং তার ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের লালন-পালনের দায়িত্ব ভারও আমারই উপর ন্যাস্ত।”এরপর ঘোষিত হচ্ছেঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পত্নীগণ মুমিনদের মাতাতুল্য। তারা তাদের সম্মানের পাত্রী। সম্মান, বুযর্গী ইত্যাদির দিক দিয়ে তাঁরা যেন তাদের মা। হ্যা, তবে মায়ের সাথে অন্যান্য আহকাম যেমন নির্জনতা ইত্যাদিতে পার্থক্য আছে। তাঁদের গর্ভজাত কন্যাদের সাথে এবং বোনদের সাথে বিয়ে হারাম হওয়ার কথা এখানে বলা হয়নি। কোন কোন আলেম তাদের কন্যাদেরও মুসলমানদের বোন বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইমাম শাফেয়ী (রঃ) মুখতাসার গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা ইবারতের প্রয়োগ, হুকুম সাব্যস্ত করা নয়। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) প্রমুখ কোন না কোন উম্মুল মুমিনীনের ভাই ছিলেন। তাঁকে মামা বলা যাবে কি না এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, বলা যেতে পারে। বাকী রইলো এখন এই কথা যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আবুল মুমিনীন (মুমিনদের পিতা) বলা যাবে কি-না? এটাও খেয়াল করা প্রয়োজন যে, আবুল মুমিনীন বললে স্ত্রীলোকেরাও এসে যায়।এর মধ্যে আধিক্য হিসেবে স্ত্রী লিঙ্গও রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, আবুল মুমিনীন বলা যাবে না। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) (আরবি)-এর দু’টি উক্তির মধ্যেও অধিকতর সঠিক উক্তি এটাই। হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)(আরবি)-এর কিরআতে -এর পরে।(এবং তিনি তাদের পিতা) এরূপও রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ)-এর মাযহাবেও একটি উক্তি এটাই এবং নিম্নের হাদীসটিও এ উক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করেঃ (আরবি) হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের পিতাদের স্থলাভিষিক্ত। আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছি যে, তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কিবলার দিকে যেন মুখ না করে এবং পিঠও যেন না করে, ডান হাতে যেন ঢিলা ব্যবহার না করে এবং ডান হাতে যেন ইসতিজাও না করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) তিনি ইসতিজার জন্যে তিনটি ঢিলা নিতে বলেছেন। গোবর ও হাড় দ্বারা ইসতিজা করতে তিনি নিষেধ করেছেন। দ্বিতীয় উক্তি এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে পিতা বলা যাবে না। কেননা কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।” (৩৩:৪০)এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর বিধান অনুসারে মুমিনও মুহাজিরগণ অপেক্ষা যারা আত্মীয়, তারা পরস্পরের নিকটতর। ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিলেন ঐ দিক দিয়েই তারা একে অপরের উত্তরাধিকারী হতেন। শপথ করে যারা সম্বন্ধ জুড়ে দিতেন তারাও তাঁদের সম্পত্তির হকদার হয়ে যেতেন। এ আয়াত দ্বারা এগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।পূর্বে কোন আনসার মারা গেলে তাঁর নিকটাত্মীয়রা ওয়ারিস হতো না, বরং মুহাজিররা ওয়ারিস হতেন, যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। হযরত যুহায়ের ইবনে আওয়াম (রাঃ) বলেনঃ “এই হুকুম বিশেষভাবে আমাদের আনসার ও মুহাজিরদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় আগমন করি তখন আমাদের কাছে কিছুই ছিল না। এখানে (মদীনায়) এসে আমরা আনসারদের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। তারা আমাদের উত্তম ভাই সাব্যস্ত হন। এমনকি তাদের মৃত্যুর পর আমরা তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতাম। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল হযরত খারেজা ইবনে যায়েদ (রাঃ)-এর সাথে। হযরত উমার (রাঃ)-এর হয়েছিল অমুকের সাথে। হযরত উসমান (রাঃ) ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন একজন যারকী ব্যক্তির সাথে। আর স্বয়ং আমার ভাই হয়েছিলেন হযরত কা'ব ইবনে মালিক (রাঃ)। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হলেন। ঐ সময় তার ইন্তেকাল হলে আমিও তার ওয়ারিস হয়ে যেতাম। অতঃপর এ আয়াত অবতীর্ণ হলো এবং মীরাসের সাধারণ হুকুম আমাদের জন্যেও প্রযোজ্য হয়ে গেল ।এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তবে তোমরা যদি তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করতে চাও তবে তা করতে পার। তুমি তার জন্যে অসিয়ত করে যেতে পার। অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর এই হুকুম প্রথম হতেই এই কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল। তাতে কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা হয়নি। মধ্যখানে পাতানো ভাই-এর উপর যে ওয়ারিসী স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটা শুধু একটা বিশেষ যুক্তিসঙ্গতার ভিত্তিতে হয়েছিল একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এরপর এটা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন মূল হুকুম জারী হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
۞ لَئِنْ لَمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْمُرْجِفُونَ فِي الْمَدِينَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لَا يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلًا
📘 Please check ayah 33:62 for complete tafsir.
مَلْعُونِينَ ۖ أَيْنَمَا ثُقِفُوا أُخِذُوا وَقُتِّلُوا تَقْتِيلًا
📘 Please check ayah 33:62 for complete tafsir.
سُنَّةَ اللَّهِ فِي الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلُ ۖ وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا
📘 ৫৯-৬২ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ তুমি মুমিন নারীদেরকে বলে দাও, বিশেষ করে তোমার পত্নীদেরকে ও তোমার কন্যাদেরকে, কারণ তারা সারা দুনিয়ার স্ত্রীলোকদের জন্যে আদর্শ স্থানীয়া, উত্তম মর্যাদার অধিকারিণী, যে তারা যেন চাদর দিয়ে নিজেদের সারা দেহ আচ্ছাদিত করে নেয়। যাতে মুমিন স্ত্রীলোক এবং অমুসলিম স্ত্রীলোকদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে যায়। এভাবেই যেন আযাদ মহিলা ও দাসীদের মধ্যে পার্থক্য করতে কোন অসুবিধা না হয়। ‘জালবাব’ ঐ চাদরকে বলা হয় যা স্ত্রীলোকেরা তাদের দো-পাট্টার উপর পরে থাকে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা মুসলিম নারীদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ তারা যখন কোন কাজে বাড়ীর বাইরে যাবে তখন যেন তারা তাদের দো-পাট্টা মুখের নীচে টেনে দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। শুধুমাত্র চোখ দুটি ভোলা রাখবে।ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রঃ)-এর প্রশ্নের উত্তরে হযরত উবাইদাহ সালমানী (রঃ) স্বীয় চেহারা এবং মাথা ঢেকে ও চক্ষু খুলে রেখে বলেন যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহর (আরবি) উক্তির ভাবার্থ এটাই।” হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, নিজের চাদর দিয়ে গলা ঢেকে নিবে। হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেনঃ “এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর আনসারদের মহিলারা যখন বাইরে বের হতেন তখন এতো গোপনীয়ভাবে চলতেন যে, যেন তাদের মাথার উপর পাখী বসে আছে। নিজেদের দেহের উপর তারা কালো চাদর ফেলে দিতেন। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) ইউনুস ইবনে ইয়াযীদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত যুহরী (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলো: “দাসীরা বিবাহিতা বা অবিবাহিতা হালে, তাদেরকেও কি চাদর গায়ে দিতে হবে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “দো-পাট্টা তারা অবশ্যই পরবে, তবে তারা চাদর পরবে না, যাতে তাদের মধ্যে ও স্বাধীন মহিলাদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। (এটাও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যিম্মী নারীদের সৌন্দর্য দর্শন করা শুধু ব্যভিচারের ভয়ে নিষিদ্ধ, তাদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে নয়। কেননা আয়াতে মুমিনা নারীদের বর্ণনা রয়েছে। চাদর লটকানো হচ্ছে আযাদ সতী-সাধ্বী মহিলাদের লক্ষণ, কাজেই চাদর লটকানো দ্বারা এটা জানা যাবে যে, এরা বাজে স্ত্রী লোকও নয় এবং নাবালিকা মেয়েও নয়। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, ফাসেক লোকেরা অন্ধকার মদীনার পথে বের হতো এবং নারীদেরকে অনুসন্ধান করতো। মদীনাবাসী ছিলেন দরিদ্র শ্রেণীর লোক। কাজেই রাত্রে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতো তখন মহিলারা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার উদ্দেশ্যে পথে বের হতেন। আর দুষ্ট শ্রেণীর লোকেরা এই সুযোগের সন্ধানেই থাকতো। অতঃপর যখন তারা চাদর পরিধানকারিণী মহিলাদেরকে দেখতো তখন বলতো যে, এঁরা আযাদ মহিলা। সুতরাং তারা দুষ্কর্ম থেকে বিরত থাকতো। আর যখন ঐ সব মহিলাকে দেখতে যাদের দেহে চাদর থাকতো না তখন তারা বলতো যে, এরা দাসী। তখন তারা তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়তো।মহান আল্লাহ বলেনঃ অজ্ঞতার যুগে বেপর্দাভাবে চলার যে প্রচলন ছিল, যখন তোমরা আল্লাহ তা'আলার এই নির্দেশের উপর আমলকারী হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তা'আলা তোমাদের পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন। যেহেতু তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যদি মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে ও যারা নগরে গুজব রটনা করে বেড়ায়, তারা বিরত না হয় তবে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করবো এবং তাদের উপর তোমার আধিপত্য বিস্তার করবো। এরপর তারা খুব কম সময়ই মদীনায় অবস্থান করতে পারবে। অতি সত্বরই তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যে কয়েক দিন তারা মদীনায় অবস্থান করবে সে কয়েকদিনও তারা কাটাবে অভিশপ্ত অবস্থায়। চারদিক থেকে তাদেরকে ধিক্কার দেয়া হবে। তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।আল্লাহ তা'আলা এরপর বলেনঃ পূর্বে যারা গত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর বিধান। হে নবী (সঃ)! তুমি কখনো আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না।
يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ ۖ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ ۚ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُونُ قَرِيبًا
📘 Please check ayah 33:68 for complete tafsir.
إِنَّ اللَّهَ لَعَنَ الْكَافِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمْ سَعِيرًا
📘 Please check ayah 33:68 for complete tafsir.
خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۖ لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
📘 Please check ayah 33:68 for complete tafsir.
يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا
📘 Please check ayah 33:68 for complete tafsir.
وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا
📘 Please check ayah 33:68 for complete tafsir.
رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا
📘 ৬৩-৬৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে সংবাদ দিচ্ছেন যে, লোকেরা তাঁকে। কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও তার সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা'আলারই রয়েছে। সূরায়ে আরাফেও এই বর্ণনা আছে এবং এই সূরায়ও রয়েছে। সূরায়ে আ'রাফ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং এই সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে মদীনায়। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কিয়ামতের সঠিক জ্ঞান রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ছিল না। তবে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদেরকে এটুকু জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, কিয়ামত অতি নিকটবর্তী। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে।” (৫৪:১) আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন, কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।” (২১:১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ আসবেই, সুতরাং ওটা ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১)মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ কাফিরদেরকে অভিশপ্ত করেছেন অর্থাৎ তাদেরকে স্বীয় রহমত হতে দূর করে দিয়েছেন। আর তাদের জন্যে (পরকালে) প্রস্তুত রেখেছেন জ্বলন্ত অগ্নি।তারা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। অর্থাৎ সেখান হতে তারা বের হতেও পারবে না এবং নিষ্কৃতিও লাভ করবে না। সেখানে তাদের অভিযোগ শুনবার মত কেউ থাকবে না। সেখানে তাদের জন্যে এমন কোন বন্ধু-বান্ধব থাকবে না যারা তাদেরকে কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারে বা ঐ কঠিন বিপদ হতে তাদেরকে ছাড়িয়ে নিতে পারে। তাদেরকে উল্টোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারা সেদিন আফসোস করে বলবেঃ হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে মানতাম! যেমন আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “যালিম ব্যক্তি সেই দিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবেঃ হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে সে তো বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ পৌছবার পর। শয়তান তো মানুষের জন্যে মহা প্রতারক।" (২৫:২৭-২৯) মহামহিমান্বিত আল্লাহ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “কখনো কখনো কাফিররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, তারা যদি মুসলিম হতো!” (১৫:২)অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে ঐ কাফিরদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের নেতারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তাদের কাছে হক ও সত্য আছে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, তারা সম্পূর্ণরূপে মিথ্যার উপর ছিল। তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে আপনি দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন। একতো এই কারণে যে, তারা নিজেরা কুফরী করেছে। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে, তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে আমাদের সর্বনাশ সাধন করেছে। আর তাদেরকে মহা অভিসম্পাত দিন!একটি কিরআতে (আরবি) এর স্থলে (আরবি) শব্দ রয়েছে। দুটোরই ভাবার্থ একই। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে একটি দু'আ শিখিয়ে দিন যা আমি আমার নামাযে পাঠ করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তুমি নিম্নের দু'আটি পড়বেঃ (আরবি)অর্থাৎ “হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আমার নফসের উপর বহু যুলুম করেছি। এবং আপনি ছাড়া কেউ গুনাহ মাফ করতে পারে না। সুতরাং আপনার পক্ষ হতে আমাকে ক্ষমা করে দিন এবং আমার উপর দয়া করুন, নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন) কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে, দু'আয় (আরবি) ও (আরবি) এই দু’টি শব্দই মিলিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু এটা ঠিক নয়। বরং সঠিক কথা এটাই যে, কোন সময় বলতে (আরবি) হবে এবং কোন সময় (আরবি) বলতে হবে। যেটা ইচ্ছা সেটাই বলা যাবে কিন্তু দুটোকেই এক সাথে জমা করা যাবে না। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ آذَوْا مُوسَىٰ فَبَرَّأَهُ اللَّهُ مِمَّا قَالُوا ۚ وَكَانَ عِنْدَ اللَّهِ وَجِيهًا
📘 সহীহ বুখারীতে এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত মূসা (আঃ) একজন বড় লজ্জাবান লোক ছিলেন।” ইমাম বুখারীও তাঁর সহীহ গ্রন্থের ‘কিতাবুত তাফসীর’-এ কুরআন কারীমের এই আয়াতের ভাবার্থ এভাবেই সংক্ষেপে আনয়ন করেছেন। কিন্তু নবীদের হাদীসগুলোর বর্ণনায় এটাকে দীর্ঘভাবে এনেছেন। তাতে এও রয়েছে যে, তিনি অত্যধিক লজ্জার কারণে নিজের দেহের কোন অংশ কারো সামনে উলঙ্গ করতেন না। বানী ইসরাঈল তাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা করলো। তারা গুজব রটিয়ে দিলো যে, তাঁর দেহে শ্বেত-কুষ্টের দাগ রয়েছে অথবা এক শিরার কারণে একটি অণ্ডকোষ বড় হয়ে গেছে বা অন্য কোন রোগ রয়েছে, যার কারণে তিনি এভাবে তার দেহকে ঢেকে রাখেন। আল্লাহ তাআলা তার উপর থেকে এই বদধারণা দূর করে দেয়ার ইচ্ছা করলেন। একদা তিনি নির্জনে উলঙ্গ অবস্থায় গোসল করছিলেন। একটি পাথরের উপর তার পরনের কাপড় রেখে দিয়েছিলেন। গোসল শেষ করে তিনি কাপড় নিতে যাবেন এমতাবস্থায় পাথরটি দূরে সরে গেল। তিনি তাঁর লাঠিটি নিয়ে পাথরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পাথরটি দৌড়াতেই থাকলো। তিনিও হে পাথর! আমার কাপড়, আমার কাপড় বলে চীৎকার করতে করতে পাথরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করলেন। বানী ইসরাঈলের একটি দল এক জায়গায় বসেছিল। যখন তিনি লোকগুলোর কাছে পৌঁছে গেলেন তখন আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে পাথরটি সেখানে থেমে গেল। তিনি তাঁর কাপড় নিয়ে পরে নিলেন। বানী ইসরাঈল তার সমস্ত শরীর দেখে নিলো। যে গুজব তারা শুনেছিল তা থেকে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (আঃ)-কে মুক্ত করে দিলেন। রাগে হযরত মূসা (আঃ) পাথরের উপর তার লাঠি দ্বারা তিন বার বা চার বার অথবা পাঁচ বার আঘাত করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! ঐ পাথরের উপর তাঁর লাঠির দাগ পড়ে গিয়েছিল।” (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়নি। এই রিওয়াইয়াত বহু সনদে বহু কিতাবে বর্ণিত আছে। কিছু কিছু মাওকুফ রিওয়াইয়াতও রয়েছে)এই (আরবি) বা মুক্ত করার কথাই এই আয়াতে বলা হয়েছে (আরবি) আল্লাহ পাকের এই উক্তি সম্পর্কে হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূন (আঃ) পাহাড়ের উপর গিয়েছিলেন যেখানে হযরত হারূন (আঃ) ইন্তেকাল করেন। জনগণ হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর অহেতুক সন্দেহ পোষণ করতে লাগলো এবং তাকে শাসাতে ও ধমকাতে শুরু করলো। মহামহিমান্বিত আল্লাহ তা'আলার নির্দেশক্রমে ফেরেশতারা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে বানী ইসরাঈলের একটি মজলিসের পার্শ্ব দিয়ে চলতে থাকলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বাকশক্তি দান করলেন। তিনি প্রকাশ করলেন যে, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তার কবরের সঠিক চিহ্ন জানা যায় না। শুধু ঐ পাহাড়টিই তার কবরের স্থানটির কথা জানে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা ওকে বাকশক্তিহীন করেছেন। তাহলে হতে পারে যে, (আরবি) বা কষ্ট দেয়া এটাই অথবা হতে পারে যে, (আরবি) দ্বারা ঐ কষ্টকে বুঝাননা হয়েছে যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমি বলি যে, এটা এবং ওটা দুটোই উদ্দেশ্য হতে পারে বা এ দু'টো ছাড়া অন্য কষ্টও উদ্দেশ্য হতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোকদের মধ্যে কিছু বন্টন করেন। একটি লোক বলেঃ “এই বন্টনে আল্লাহর সন্তুষ্টির ইচ্ছা করা হয়নি।” এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “ওরে আল্লাহর শত্রু! আমি অবশ্যই তোমার এ কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জানিয়ে দিবো।” সুতরাং তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এটা জানিয়ে দিলেন। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর সদয় হোন! তাকে এর চেয়েও বেশী কষ্ট দেয়া হয়েছিল। তথাপি তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদেরকে বলেনঃ “আমার সাহাবীদের কেউ যেন কারো কথা আমার কাছে পৌঁছিয়ে না দেয়। কেননা, আমি পছন্দ করি যে, কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোেগ নেই এমতাবস্থায় যেন আমি তোমাদের মধ্যে বের হয়ে আসি।” অতঃপর একবার তাঁর কাছে কিছু মাল আসে। তিনি তা বন্টন করে দেন। বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি দু'টি লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করি। তাদের একজন অপরজনকে বলছেঃ “আল্লাহর কসম! এ বন্টনে মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের ঘর কামনা করেননি।” এ কথা শুনে আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট হাযির হয়ে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি বলেছেন যে, কেউ যেন কারো কোন কথা আপনার নিকট পৌঁছিয়ে না দেয়। কিন্তু আমি অমুক অমুক দুটি লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করেছিলাম। তাদের একজন অপরজনকে এরূপ এরূপ কথা বলেছিল।” একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চেহারা মুবারক লাল হয়ে যায় এবং এটা তাঁর নিকট খুবই কঠিন বোধ হয়। অতঃপর তিনি বলেনঃ “ছেড়ে দাও, হযরত মূসা (আঃ)-কে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।” (হাদীসটি এই ধারায় ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)ঘোষিত হচ্ছেঃ মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট মর্যাদাবান ছিল। তাঁর দুআ মহান আল্লাহর নিকট গৃহীত হতো। হ্যাঁ, তবে তিনি আল্লাহকে দর্শনের দু'আ করেছিলেন, তা গৃহীত হয়নি। কেননা, ওটা ছিল মানবীয় শক্তি বহির্ভূত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, তিনি তাঁর ভাই-এর নবুওয়াতের জন্যে দু'আ করেছিলেন, সেটাও আল্লাহ তা'আলার নিকট গৃহীত হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভ্রাতা হারূন (আঃ)-কে নবীরূপে।” (১৯:৫৩)
وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا
📘 Please check ayah 33:8 for complete tafsir.
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
📘 Please check ayah 33:71 for complete tafsir.
يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
📘 ৭০-৭১ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁকে ভয় করার হিদায়াত করছেন। তিনি তাদেরকে বলছেন যে, তারা যেন তার ইবাদত এমনভাবে করে যেন তারা তাকে দেখছে এবং তারা সত্য ও সঠিক কথা বলে। তাদের কথায় কোন বক্রতা ও পাঁচ না থাকে। যখন তারা অন্তরে তাকওয়া পোষণ করে এবং মুখে সত্য কথা বলে তখন এর বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করেন। তাদের সমস্ত গুনাহ তিনি মাফ করে দেন। আর ভবিষ্যতেও ক্ষমার সুযোগ দান করেন, যেন গুনাহ বাকী রয়ে না যায়। আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্যই হলো সত্যিকারের সফলতা। এর মাধ্যমেই মানুষ জাহান্নাম হতে দূরে থাকে এবং জান্নাতের নিকটবর্তী হয়। হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমাদেরকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যোহরের নামায পড়েন। সালাম ফিরানোর পর তিনি আমাদের প্রতি বসার ইঙ্গিত করেন। সুতরাং আমরা বসে পড়ি। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার ও সঠিক কথা বলার নির্দেশ দিই।" তারপর তিনি মহিলাদের নিকট আসেন এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “আল্লাহ আমাকে হুকুম করেছেন যে, আমি যেন তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার এবং সত্য ও সঠিক কথা বলার নির্দেশ দিই।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরে দাঁড়ালেই আমি তাঁকে বলতে শুনতামঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।" (এ হাদীসটি ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) কিতাবুত তাকওয়ায় বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা খুবই গারীব বা দুর্বল হাদীস)হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ যে এতে আনন্দ পায় যে, লোকে তার সম্মান করুক সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।” হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো (আরবি) বা সঠিক কথা। অন্য কেউ বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো সত্যবাদিতা। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) হলো সোজা ও সঠিক কথা। এ সবই (আরবি) এর অন্তর্ভুক্ত।
إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ ۖ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا
📘 Please check ayah 33:73 for complete tafsir.
لِيُعَذِّبَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوبَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ۗ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا
📘 ৭২-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এখানে (আরবি) অর্থ হলো (আরবি) বা আনুগত্য। এটা হযরত আদম (আঃ)-এর উপর পেশ করার পূর্বে যমীন, আসমান ও পাহাড়ের উপর পেশ করা হয়। তারা সবাই কিন্তু এই বিরাট দয়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। তখন মহা মহিমান্বিত আল্লাহ ওটা হযরত আদম (আঃ)-এর সামনে পেশ করেন এবং বলেনঃ “ওরা সবাই তো অস্বীকার করলো, এখন তুমি কি বলছো, বল।” হযরত আদম (আঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” আল্লাহ্ তা'আলা উত্তরে বললেনঃ “এতে যা রয়েছে তা যদি তুমি মেনে চল তবে তুমি পুণ্য লাভ করবে ও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। আর যদি অমান্য কর তবে শাস্তি পাবে।” তখন হযরত আদম (আঃ) বললেনঃ “আমি এ দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত আছি।”হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে যে, এখানে আমানত দ্বারা ফারায়েয উদ্দেশ্য। অন্যান্যদের কাছে যে এটা পেশ করা হয়েছিল তা আদেশ পর্যায়ে ছিল না, বরং শুধু তাদের মনোভাব জেনে নেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। তাদের অস্বীকৃতি ও অক্ষমতা প্রকাশের কারণে তাদের কোন গুনাহ ছিল না। বরং ওটা তাদের এক ধরনের তা'যীম ছিল। পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের ব্যাপারেই তারা কেঁপে উঠেছিল। তারা ভয় করেছিল যে, পূর্ণভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে তাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।কিন্তু মানুষ অজ্ঞতা ও দুর্বলতার কারণে সন্তুষ্ট চিত্তে ঐ আমানত উঠিয়ে নিয়েছিল।হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই এটাও বর্ণিত আছে যে, প্রায় আসরের সময় মানুষ এই আমানত উঠিয়ে নিয়েছিল এবং মাগরিবের পূর্বেই ভুল প্রকাশ পেয়েছিল।হযরত উবাই (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নারীদের সতীত্ব রক্ষাও একটা আমানত। হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তি আছে যে, ফারায়েয, হুদুদ ইত্যাদি সবই আল্লাহর আমানত। কারো কারো উক্তিমতে অপবিত্রতার গোসলও আমানত। যায়েদ ইবনে আসলাম বলেন যে, তিনটি জিনিস হলো আল্লাহর আমানত। ওগুলো হলো: অপবিত্রতার গোসল, রোযা এবং নাযায। ভাবার্থ এই যে, এগুলো সবই আল্লাহর আমানতের অন্তর্ভুক্ত। সমস্ত আদেশ পালন এবং সমস্ত নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকা মানুষের দায়িত্ব। যে ঐ দায়িত্ব পালন করবে সে সওয়াব পাবে এবং যে পালন করবে না সে পাপী হবে এবং শাস্তি পাবে। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেছেনঃ চিন্তা করে দেখো, আসমান নিরাপদ, সুন্দর এবং সৎ ও নিস্পাপ ফেরেশতাদের বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর আমানত উঠাতে সাহস করেনি। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল যে, ঐ আমানত রক্ষায় অপারগ হলে সে শাস্তির যোগ্য হয়ে যাবে। যমীন অত্যন্ত শক্ত, দীর্ঘ ও প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও ঐ আমানত বহনের ব্যাপারে ভীত হয়ে গেল এবং বিনীতভাবে নিজের অক্ষমতা ও অপাগরতার কথা জানিয়ে দিলো। পাহাড় স্বীয় উচ্চতা, দৃঢ়তা ও কাঠিন্য সত্ত্বেও আমানতের ব্যাপারে কেঁপে উঠলো এবং নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলো। মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, আসমানসমূহ উত্তরে বলেছিলঃ “আমরা তো। এমনিতেই আপনার বাধ্য। কিন্তু এটা বহনের শক্তি আমাদের নেই। কেননা এতে অকৃতকার্য হলে বড় রকম বিপদের আশংকা রয়েছে। তারপর মহান আল্লাহ যমীনকে বললেনঃ “তুমি যদি এটা পূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে পার তবে আমি তোমাকে দয়া, অনুগ্রহ ও দানে ভূষিত করবো।" সে উত্তর দিয়েছিলঃ “আমি তো সবকিছুতেই আপনার অনুগত। আপনি যে আদেশই আমাকে করেন আমি তা পালন করে থাকি। কিন্তু এটা আমার সাধ্যের অতিরিক্ত।” অতঃপর পাহাড়কে বলা হলে সেও উত্তরে বলেঃ “আমি তো আপনার অবাধ্য নই। কথা হলো এই যে, যদি আমানত আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তবে তা আমি অবশ্যই উঠিয়ে নিবো, কিন্তু আসলে এটা বহনের ক্ষমতা আমার নেই। সুতরাং এটা হতে আমাকে অব্যাহতি দান করা হালে।” অতঃপর হযরত আদম (আঃ)-কে বলা হলো তিনি উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ! যদি আমি এটা পূর্ণভাবে প্রতিপালন করতে পারি তবে কি পাবো?” উত্তরে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “তাহলে তুমি অতি সম্মানের স্থান জান্নাত লাভ করবে। তুমি দয়া ও অনুগ্রহে ভূষিত হবে। আর যদি তুমি অবাধ্য হও তবে এই অবাধ্যতার কারণে তোমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তোমাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হবে। তিনি তখন বললেনঃ “হে আল্লাহ! আমি এটা গ্রহণ করে নিলাম।”মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আসমান উত্তরে বলেছিলঃ “হে আল্লাহ! আমি তারকামণ্ডলীকে স্থান এবং ফেরেশতাদেরকে জায়গা দিয়েছি, কিন্তু আমি এ দায়িত্ব পালন করতে পারবো না। এতো ফরযসমূহের ভার। এটা বহনের শক্তিই তো আমার নেই।যমীন বলেছিলঃ “হে আল্লাহ! আমার উপর আপনি গাছপালা লাগিয়েছেন, সাগর জারি করেছেন, মানুষকে স্থান দিয়েছেন। এগুলো আমি বহন করেই চলেছি। কিন্তু এখন যে আমানতের দায়িত্বভার আমার উপর অর্পণ করতে চাচ্ছেন, এটা বহন করা আমার সাধ্যের অতীত। আমি সওয়াবের আশায় আযাবের সম্ভাবনা কাঁধে নিতে পারবো না।" পাহাড়ও এ ধরনেরই জবাব দিলো। কিন্তু মানুষ ঐ দায়িত্বভার গ্রহণ করে নিলো। কোন কোন রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা তিন দিন পর্যন্ত কাঁদতে থাকে ও নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু মানুষ ওটাকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ মানুষকে সম্বোধন করে বলেনঃ “শুনো, যদি তোমার নিয়ত ভাল হয় তবে আমার সাহায্য সদা তোমার উপর থাকবে। তোমার চোখের দু’টি পলক করে দিবো। আমার অসন্তুষ্টির জিনিস হতে তোমার চোখ দুটি হেফাজত করবে। তোমার মুখে আমি দুটি ঠোট বানিয়ে দিচ্ছি। সে আমার মর্জির বিপরীত কিছু বলতে চাইলে ওকে বন্ধ করে দিবে। তোমার লজ্জাস্থানের হিফাজতের জন্যে আমি পোশাকের ব্যবস্থা করছি। আমার মর্জির বিপরীত তুমি ওটা খুলবে না।”যমীন ও আসমান সওয়াব ও আযাবকে প্রত্যাখ্যান করলো এবং আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লেগে থাকলো। কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করে নিলো।একটি খুবই গরীব বা দুর্বল মারফু হাদীসে আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আমানত ও অফা মানুষের উপর নবীদের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কালাম নবীদের মুখ হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছেছে। নবীদের ভাষার মাধ্যমে তারা ভাল-মন্দ সবকিছু জানতে পেরেছে। প্রত্যেকই পুণ্য ও পাপ সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। জেনে রেখো যে, আমানতই হলো সর্বপ্রথম জিনিস যা উঠানো হয় এবং মানুষের অন্তরে এর লক্ষণ বাকী রয়েছে। তারপর উঠানো হয় অফা, আহাদ বা অঙ্গীকার ও যিম্মাদারী। কিতাবসমূহ তাদের হাতে রয়েছে। আলেমরা আমল করছে। আর অজ্ঞরা জানছে, কিন্তু না জানার ভান করছে। এখন এই আমানত এবং অফা আমি পর্যন্ত ও আমার উম্মত পর্যন্ত পৌঁছেছে। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তাকেই ধ্বংস করেন যে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে। তারা উদাসীনতায় লিপ্ত থাকে। হে লোক সকল! তোমরা সাবধান হয়ে যাও, ভাল হয়ে চল, শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হয়ো না। আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করছেন যে, তোমাদের মধ্যে ভাল আমলকারী কে?” হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন ঈমানসহ পাঁচটি জিনিস যে নিয়ে আসবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের হিফাজত করবে, ওগুলোর অ্যু, রুকূ', সিজদা ও সময়সহ আদায় করবে আর খুশী মনে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের মালের যাকাত দিবে, অতঃপর তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম! মুমিন ছাড়া এটা কেউ করতে পারে না এবং আমানত আদায় করে।” জনগণ প্রশ্ন করলেনঃ “হে আবু দারদা (রাঃ)! আমানত আদায় করা কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “অপবিত্রতার গোসল। কেননা, আল্লাহ তাআলা স্বীয় দ্বীনকে রক্ষার ব্যাপারে আদম সন্তানকে এর চেয়ে বড় আমানত আর কিছু দেননি।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেন, আল্লাহর পথে জীবন দান সমস্ত পাপ মুছে ফেলে। কিন্তু আমানতের খিয়ানতকারীকে ক্ষমা করা হয় না। খিয়ানতকারীকে কিয়ামতের দিন আনয়ন করা হবে। অতঃপর তাকে বলা হবেঃ “তোমার আমানত আদায় কর।” সে উত্তর দিবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! কোথা হতে এবং কি করে আদায় করবো, দুনিয়া তো শেষ হয়ে গেছে।” তিনবার তাকে এ কথা বলা হবে এবং তিনবারই সে এই ব্রনের উত্তর দিবে। অতঃপর আদেশ করা হবেঃ “একে হাবিয়া জাহান্নামে নিয়ে যাও।” ফেরেশতারা তখন তাকে ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। সে একেবারে তলদেশে পৌঁছে যাবে। অতঃপর সেখানে ঐ আমানতের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত আগুনের জিনিস তার দৃষ্টিগোচর হবে। ওটাকে সে উপরের দিকে উঠাতে থাকবে। যখন জাহান্নামের ধারে পৌছবে তখন তার পা পিছলে যাবে এবং আবার নীচে পড়ে যাবে। আবার জাহান্নামের তলদেশে চলে যাবে। পুনরায় উঠবে এবং পুনরায় পড়বে। চিরকাল সে ঐ শাস্তিই ভোগ করতে থাকবে।অযু এবং নামাযেও আমানত আছে। কথা-বার্তার মধ্যেও আছে আমানত। সবচেয়ে বড় আমানত ঐ জিনিসগুলোতে রয়েছে যেগুলো আমানত হিসেবে কারো কাছে রাখা হয়। হযরত বারা (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হলো: “আপনার ভাই আবদুল্লাহ (রাঃ) কি হাদীস বর্ণনা করলেন তা কি আপনি শুনলেন না?” তিনি উত্তরে বললেন যে, তিনি সত্য বলেছেন।হযরত হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের কাছে দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। একটি তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি এবং দ্বিতীয়টির জন্যে অপেক্ষা করছি। প্রথম এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমানত মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে।” অতঃপর তিনি আমানত উঠে যাওয়া সম্পর্কে বলেনঃ “মানুষ শয়ন করবে এমতাবস্থায় তার অন্তর হতে আমানত উঠে যাবে। এমন একটি দাগ থেকে যাবে যা দেখে মনে হবে যেন কোন জ্বলন্ত কাঠ তার পায়ে লেগে আছে এবং এর ফলে তার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। আর ওটা বেশ উঁচু হয়ে আছে। কিন্তু তার ভিতরে কিছুই থাকবে না।” অতঃপর তিনি একটি কংকর নিয়ে নিজ পায়ে চেপে দিয়ে লোকদেরকে তা দেখিয়ে দিলেন যে, এইভাবে জনগণ লেন-দেন ও ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ঈমানদার থাকবে না। এমন কি এটা মশহুর হয়ে পড়বে যে, অমুক গোত্রের মধ্যে একজন আমানতদার লোক রয়েছে এবং এতদূর পর্যন্ত বলা হবে যে, এ লোকটি কতই না জ্ঞানী, বিজ্ঞ, বিদ্বান ও বিচক্ষণ! অথচ তার মধ্যে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান থাকবে না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “দেখো, ইতিপূর্বে তো আমি অনেককেই ধার কর্জ দিতাম এবং অনেকের নিকট হতে ধার নিতাম। কেননা, সে মুসলমান হলে তো আমার প্রাপ্য আমাকে দিয়ে যাবে। আর সে ইয়াহূদী বা খৃষ্টান হলে ইসলামী শাসন তার নিকট হতে আমাকে আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দিবে। কিন্তু বর্তমানে আমি শুধু অমুক অমকুকে ধার কর্জ দিয়ে থাকি এবং বাকী সবাইকে ধার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। (এটা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁদের সহীহ গ্রন্থে তাখরীজ করেছেন)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন চারটি জিনিস তোমার মধ্যে থাকবে তখন সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার কোন ক্ষতি নেই। সেগুলো হলো : আমানত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, চরিত্র ভাল হওয়া এবং খাদ্য পবিত্র ও হালাল হওয়া।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছন)হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রঃ) কিতাবুয যুহদে বলেছেন যে, একদা খাননাস ইবনে সাহীম অথবা জিবিল্লাহ ইবনে সাহীম (রঃ) যিয়াদ ইবনে হাদীর (রঃ)-এর সাথে ছিলেন। ঘটনাক্রমে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়ঃ “আমানতের কসম!”এ কথা শুনে হযরত যিয়াদ (রঃ) কাঁদতে শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি কাঁদতে থাকেন। তখন ইবনে সাহীম (রঃ) ভয় পেলেন যে, তার মুখ দিয়ে খুব কঠিন কথা বের হলো না কি! তাই তিনি বলেনঃ “তিনি কি ওটাকে মন্দ জানতেন? উত্তরে হযরত যিয়াদ (রঃ) বললেনঃ “হ্যা, হযরত উমার (রাঃ) এটাকে খুবই মন্দ জানতেন এবং এটা হতে নিষেধ করতেন।”হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে আমানতের কসম খায় সে আমাদের মধ্যে নয়। (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাঊদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ হযরত আদম (আঃ) যা করলেন এবং পরিণামে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারী অর্থাৎ যারা বাহ্যিক মুসলমান এবং ভিতরে কাফির ছিল, আর যারা বাইরে ও ভিতরে উভয় ক্ষেত্রেই কাফির ছিল, তাদেরকে শাস্তি দিবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হবে। যারা আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে এবং তাঁর রাসূলদেরকে মেনে চলতো এবং তার আনুগত্য করতো সঠিকভাবে। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَنْ صِدْقِهِمْ ۚ وَأَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا أَلِيمًا
📘 ৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আমি এই পাঁচজন স্থিরপ্রতিজ্ঞ নবীর নিকট হতে এবং সাধারণ সমস্ত নবীর নিকট হতে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তারা আমার দ্বীনের প্রচার করবেন ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। তারা পরস্পরে একে অপরকে সাহায্য করবেন এবং একে অপরকে সমর্থন করবেন। তারা পরস্পরের মধ্যে ইত্তেহাদ ও ইত্তেফাক কায়েম রাখবেন। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)অর্থাৎ “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেনঃ তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি তার শপথ! যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেনঃ তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এই সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বললো: আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেনঃ তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী থাকলাম।” (৩:৮১) এখানে সাধারণ নবীদের বর্ণনা দেয়ার পর বিশিষ্ট মর্যাদা সম্পন্ন নবীদের নামও উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে তাদের নাম নিম্নের আয়াতেও রয়েছেঃ (আরবি)এখানে হযরত নূহ (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যিনি ভূ-পৃষ্ঠে আল্লাহ তাআলার সর্বপ্রথম নবী ছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী এবং হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)-এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে যারা ছিলেন মধ্যবর্তী নবী। এতে সূক্ষ্মদর্শিতা এই রয়েছে যে, প্রথম নবী হযরত আদম (আঃ)-এর পরবর্তী নবী হযরত নূহ (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর পূর্ববর্তী নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এর নাম উল্লেখ রয়েছে। আর মধ্যবর্তী নবীদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও তো এই ক্রমপর্যায় রয়েছে যে, প্রথম ও শেষের নাম উল্লেখ করার পর মধ্যবর্তী নবীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আর এ আয়াতে সর্বপ্রথম সর্বশেষ নবী (সঃ)-এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কারণ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা অধিক মর্যাদা সম্পন্ন নবী। অতঃপর একের পর এক ক্রমানুযায়ী অন্যান্য নবীদের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সমস্ত নবীর উপর দরূদ ও সালাম নাযিল করুন! এই আয়াতের তাফসীরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি সমস্ত নবীর পূর্বে সৃষ্ট হয়েছি এবং দুনিয়ায় সর্বশেষে আগমন করেছি। তাই আমা হতেই শুরু করা হয়েছে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) কিন্তু এর একজন বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনে বাশীর দুর্বল এবং সনদ হিসেবে এটা মুরসাল রূপে বর্ণিত হয়েছে। এটাই বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেউ কেউ এটাকে মাওকুফ রূপে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে পাঁচজন নবী আল্লাহ তা'আলার নিকট খুইব পছন্দনীয়। তাঁরা হলেনঃ হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সঃ)। এর একজন বর্ণনাকারী হামযাহ দুর্বল। এও বলা হয়েছে যে, এই আয়াতে যে অঙ্গীকারের বর্ণনা রয়েছে তা হলো ওটাই যা আল্লাহ তা'আলা রোযে আযলে হযরত আদম (আঃ)-এর পিঠ হতে সমস্ত মানুষকে বের করে গ্রহণ করেছিলেন।হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আদম (আঃ)-কে উচ্চে তুলে ধরা হয়। তিনি তাঁর সন্তানদের দেখেন। তাদের মধ্যে তিনি ধনী, নির্ধন, সুন্দর, কুৎসিত সর্বপ্রকারের লোককেই দেখতে পান। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! যদি আপনি এদের সবাইকে সমান করতেন তবে কতই না ভাল হতো!” মহামহিমান্বিত আল্লাহ জবাবে বলেনঃ “এটা এজন্যেই করা হয়েছে যে, যেন আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে যারা নবী ছিলেন। তিনি তাদেরকেও দেখেন। তাঁরা জ্যোতির্ময় রূপে প্রকাশিত ছিলেন। তাঁদের উপর নূর বর্ষিত হচ্ছিল। তাদের নিকট হতেও নবুওয়াত ও রিসালাতের একটি বিশেষ অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল। যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।ঘোষিত হচ্ছেঃ সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদীতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবার জন্যে, অর্থাৎ তাদেরকে রাসূল (সঃ)-এর হাদীসগুলো পৌঁছিয়ে দিতো। আর আল্লাহ তা'আলা অমান্যকারীদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছেন বেদনাদায়ক শাস্তি। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করছি যে, আপনার রাসূলগণ আপনার বান্দাদের কাছে আপনার বাণী কমবেশী ছাড়াই পৌছিয়ে দিয়েছেন। তারা পূর্ণভাবে মঙ্গল কামনা করেছে এবং সত্যকে পরিষ্কারভাবে উজ্জ্বল পন্থায় জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। যাতে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই, যদিও হতভাগ্য ও হঠকারীরা তাদেরকে মানেনি। আমাদের বিশ্বাস আছে যে, আপনার রাসূলদের সমস্ত কথা ন্যায় ও সত্য। যারা তাঁদের পথ অনুসরণ করেনি তারা বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। তারা বাতিলের উপর রয়েছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا ۚ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا
📘 Please check ayah 33:10 for complete tafsir.