slot qris slot gacor terbaru slot gacor terbaik slot dana link slot gacor slot deposit qris slot pulsa slot gacor situs slot gacor slot deposit qris
| uswah-academy
WhatsApp Book A Free Trial
القائمة

🕋 تفسير سورة مريم

(Maryam) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ كهيعص

📘 কা-ফ হা ইয়া আ’ইন স্বা-দ।

قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِي آيَةً ۚ قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَ لَيَالٍ سَوِيًّا

📘 যাকারিয়া বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি নিদর্শন দাও!’ তিনি বললেন, ‘তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও কারো সাথে ক্রমাগত তিন রাত্রি (দিন) বাক্যালাপ করবে না।’ [১] [১] রাত্রি বলতে দিন-রাত্রি উভয়কেই বোঝানো হয়েছে। سَوِيَّا অর্থ বিলকুল নীরোগ, সুস্থ। অর্থাৎ তোমার এমন কোন ব্যাধি হবে না, যার ফলে তুমি কথা বলতে পারবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তোমার মুখ দিয়ে কথা না বের হলে তুমি জেনে নিও যে, সুসংবাদের সময় নিকটবর্তী।

فَخَرَجَ عَلَىٰ قَوْمِهِ مِنَ الْمِحْرَابِ فَأَوْحَىٰ إِلَيْهِمْ أَنْ سَبِّحُوا بُكْرَةً وَعَشِيًّا

📘 অতঃপর সে উপাসনাকক্ষ[১] হতে বের হয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট এল ও ইঙ্গিতে তাদেরকে বলল যে, ‘তোমরা সকাল-সন্ধ্যায় (আল্লাহর) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।’ [২] [১] مِحراب (মিহরাব) অর্থ ঐ ঘর যেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদত করতেন, এই শব্দ حرب হতে গঠিত; যার অর্থ যুদ্ধ, যেহেতু উপাসনাকক্ষে আল্লাহর ইবাদত করতে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করতে হয়, তাই ঐ কক্ষের নাম মিহরাব। [২] সকাল-সন্ধ্যায় পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা বা তসবীহ করার অর্থঃ আসরের ও ফজরের নামায পড়া। অথবা এর অর্থঃ সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তসবীহতে বেশী মনোযোগী হও।

يَا يَحْيَىٰ خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ ۖ وَآتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا

📘 (আল্লাহ বললেন,) ‘হে য়্যাহয়্যা! এই কিতাব[১] দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ কর’; আমি শৈশবেই তাকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা। [২] [১] আল্লাহ যাকারিয়া (আঃ)-কে পুত্র য়্যাহয়্যা দান করলেন। আর তিনি যখন একটু বড় হলেন, তখন মহান আল্লাহ কিতাবকে শক্ত করে ধারণ করার; অর্থাৎ তার উপর আমল করার আদেশ করলেন। 'কিতাব' বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অথবা তাঁকে যে বিশেষ কিতাব দান করা হয়েছিল তা, যা আমাদের অজানা। [২] حُكم (প্রজ্ঞা)এর অর্থঃ জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, কিতাবে উল্লিখিত দ্বীন সম্পর্কে পান্ডিত্য, ইলম ও আমলের সমষ্টি অথবা নবুঅত হতে পারে। ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেছেন যে, এতে কোন বাধা নেই যে, حكم বলতে উক্ত সকল অর্থই শামিল।

وَحَنَانًا مِنْ لَدُنَّا وَزَكَاةً ۖ وَكَانَ تَقِيًّا

📘 এবং আমার নিকট হতে মমতা ও পবিত্রতা। [১] আর সে ছিল একজন সংযমশীল। [১] حنان মমতা, দয়া। অর্থাৎ আমি তার অন্তরে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি দয়া-মমতা করার প্রেরণা এবং কুপ্রবৃত্তি ও সমস্ত পাপ হতে পবিত্রতা দান করেছিলাম।

وَبَرًّا بِوَالِدَيْهِ وَلَمْ يَكُنْ جَبَّارًا عَصِيًّا

📘 পিতা-মাতার অনুগত এবং সে উদ্ধত ও অবাধ্য ছিল না। [১] [১] অর্থাৎ, পিতা-মাতা বা নিজ প্রতিপালকের অবাধ্য ছিলেন না। এর অর্থ হল, যদি আল্লাহ তাআলা কারো অন্তরে পিতা-মাতার প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, তাঁদের আনুগত্য ও খিদমত, তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার বা সদাচার করার শক্তি দান করেন তাহলে তা হবে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ। সুতরাং যদি এর বিপরীত চরিত্র কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে তা হল আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চনার ফল।

وَسَلَامٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا

📘 তার প্রতি শান্তি তার জন্মদিনে, তার মৃত্যুদিনে এবং তার পুনরুজ্জীবনের দিনে। [১] [১] মানুষের জন্য তিনটি সময় কঠিন ও ভয়াবহ। (ক) যখন মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে। (খ) যখন মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। এবং (গ) যখন কবর হতে জীবিত করে উঠানো হবে এবং নিজেকে কিয়ামতের ভয়াবহতায় পরিবেষ্টিত দেখবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, এই তিন সময়েই তার জন্য থাকবে শান্তি ও নিরাপত্তা। বিদআতীরা এই আয়াত দ্বারা (মহানবীর) জন্মোৎসব (নবীদিবস) পালন করার বৈধতা প্রমাণ করে। কিন্তু তাদের নিকট জিজ্ঞাস্য যে, মৃত্যুর দিনে মৃত্যু-উৎসব পালন করাও তাদের জন্য জরুরী। কেননা জন্ম দিনের জন্য যেমন সালাম (শান্তি) শব্দ ব্যবহার হয়েছে তেমনি মৃত্যুর জন্যও সালাম শব্দ ব্যবহার হয়েছে। শুধু সালাম শব্দ দ্বারা যদি 'ঈদে মীলাদ' (জন্মোৎসব) সাব্যস্ত হয়, তাহলে সালাম শব্দ দ্বারা 'ঈদে ওফাত' (মৃত্যু-উৎসব)ও সাব্যস্ত হবে। কিন্তু এখানে মৃত্যু-উৎসব তো দূরের কথা বরং নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুকেই অস্বীকার করা হয়। নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুকে অস্বীকার করে কুরআনের আয়াতকে তো অস্বীকার করেই থাকে; উপরন্তু তারা তাদের দলীল গ্রহণের পদ্ধতি অনুসারে আলোচ্য আয়াতের এক অংশের উপর ঈমান রাখে এবং ঐ আয়াতেরই দ্বিতীয় অংশের উপর ঈমান রাখে না। {أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ} অর্থাৎ, তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশের উপর ঈমান আনবে, আর কিছুকে অস্বীকার করবে? (বাক্বা রাহঃ ৮৫)

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انْتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا

📘 (হে রসূল!) তুমি এই কিতাবে (উল্লিখিত) মারয়্যামের কথা বর্ণনা কর; যখন সে তার পরিবারবর্গ হতে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল।

فَاتَّخَذَتْ مِنْ دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا

📘 অতঃপর তাদের হতে সে নিজেকে পর্দা করল;[১] অতঃপর আমি তার নিকট আমার রূহ (জিবরীল)কে পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ মানুষ আকারে আত্মপ্রকাশ করল। [২] [১] লোকালয় হতে পৃথক হয়ে নিরালায় আসা ও পর্দা করা আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে ছিল, যাতে তাঁকে কেউ দেখতে না পায় তথা মনে একাগ্রতা সৃষ্টি হয়। অথবা তা মাসিক হতে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ছিল। আর পূর্ব দিকের স্থান বলতে বায়তুল মাকদিসের পূর্ব দিককে বুঝানো হয়েছে। [২] রূহ বলতে জিবরীল (আঃ)। যাকে পূর্ণ মনুষ্য আকৃতিতে মারয়্যামের নিকট পাঠানো হয়েছিল। যখন মারয়্যাম দেখলেন যে, এক ব্যক্তি বিনা বাধায় ভিতরে প্রবেশ করে ফেলেছে, তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন, হয়তো বা সে কোন অসৎ উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেছে। জিবরীল (আঃ) বললেন, আমি তা নই, যা তুমি ধারণা করছ। আমি তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত দূত। আর আমি তোমাকে এই সুসংবাদ দিতে এসেছি যে, আল্লাহ তাআলা তোমাকে এক পুত্র-সন্তান দান করবেন। কোন কোন কিরাআতে لِيهَبَ প্রথম পুরুষের শব্দ আছে। কিন্তু (এখানে যেমন আছে) জিবরীল (আঃ) উত্তম পুরুষের শব্দ لأَهَب ব্যবহার করেছেন। যেহেতু বাহ্যিক হেতু স্বরূপ জিবরীল (আঃ) মারয়্যামের কামিসের বুকের উপর খোলা অংশে ফুঁক মেরে দিলেন, আর আল্লাহর হুকুমে তাঁর গর্ভ সঞ্চার হল। এই কারণেই পুত্র দানের সম্বন্ধ নিজের দিকে জুড়েছেন। কিংবা এর অর্থ এও হতে পারে যে, এ কথাটি স্বয়ং আল্লাহর। জিবরীল (আঃ) শুধু তা হুবহু নকল করেছেন; অর্থাৎ, পরিপূর্ণ বাক্য হবে এইরূপঃ أرسَلَنِي يَقُولُ لَكِ أرسَلتُ رَسُولِي إِلَيكِ لأَهَبَ لَكِ আল্লাহ আমাকে (তোমার নিকট) প্রেরণ করেছেন; তিনি বলেন, আমি আমার দূত তোমার নিকট এই সংবাদ দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছি যে, আমি তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করব। আর এই শ্রেণীর ঊহ্য ও অনুক্ত কথা কুরআনের অনেক স্থানে আছে।

قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَٰنِ مِنْكَ إِنْ كُنْتَ تَقِيًّا

📘 মারয়্যাম বলল, ‘আমি তোমা হতে পরম করুণাময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি; তুমি যদি সংযমশীল হও (তাহলে আমার নিকট থেকে সরে যাও)।’

قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا

📘 সে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালক-প্রেরিত (দূত) মাত্র; তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করবার জন্য (আমি প্রেরিত হয়েছি)।’

ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيَّا

📘 এটা তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর দাস যাকারিয়ার[১] প্রতি। [১] যাকারিয়া (আঃ) বানী ইস্রাঈলের একজন নবী ছিলেন। তিনি ছিলেন ছুতোর এবং এই পেশাই ছিল তাঁর জীবিকার একমাত্র উপায়।

قَالَتْ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا

📘 মারয়্যাম বলল, ‘কেমন করে আমার পুত্র হবে! যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি; আর আমি ব্যভিচারিণীও নই।’

قَالَ كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ ۖ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِنَّا ۚ وَكَانَ أَمْرًا مَقْضِيًّا

📘 সে বলল, ‘এই ভাবেই হবে;[১] তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং তাকে আমি এই জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন[২] ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ;[৩] এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’ [৪] [১] অর্থাৎ, এ কথা তো সত্য যে তোমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি বৈধ উপায়ে, আর না অবৈধ উপায়ে। যদিও স্বাভাবিক গর্ভ ধারণের জন্য তা অতি আবশ্যক। তবুও এভাবেই হবে। [২] অর্থাৎ, আমি স্বাভাবিক হেতুর (মিলন সংসাধনের) মুখাপেক্ষী নই। আমার জন্য এটা অতি সহজ আর তাকে আমি আমার সৃজন-শক্তির এক নির্দশন করতে চাই। এর আগে আমি তোমাদের আদি পিতা আদমকে বিনা পুরুষ ও নারীতে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের মাতা হাওয়াকেও কেবল পুরুষ হতে সৃষ্টি করেছি। এবার ঈসাকে সৃষ্টি করে চতুর্থ পদ্ধতি সৃষ্টি করার যে ক্ষমতা তা প্রকাশ করতে চাই; আর তা হল শুধু মায়ের গর্ভ হতে বিনা পুরুষের মিলনে সৃষ্টি করা। আমি সৃষ্টির চারটি পদ্ধতিতেই সৃষ্টি করতে সমভাবে ক্ষমতাবান। [৩] এর অর্থ নবুঅত যা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ তাঁর জন্য এবং ওদের জন্যও যারা তাঁর নবুঅতের উপর ঈমান আনবে। [৪] এটি জিবরীলের কথারই পরিশিষ্ট; যা তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ, মু'জিযামূলক (অস্বাভাবিক) সৃষ্টি আল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর মহাশক্তি ও ইচ্ছায় স্থিরীকৃত আছে।

۞ فَحَمَلَتْهُ فَانْتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا

📘 অতঃপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল ও তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল।

فَأَجَاءَهَا الْمَخَاضُ إِلَىٰ جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَٰذَا وَكُنْتُ نَسْيًا مَنْسِيًّا

📘 প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের তলে নিয়ে এল; সে বলল, ‘হায়! এর পূর্বে যদি আমি মারা যেতাম ও লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম।’ [১] [১] মৃত্যু কামনা এই ভয়ে যে, আমি সন্তানের ব্যাপারে লোকেদেরকে কিভাবে সন্দেহমুক্ত করব; যখন তারা আমার কোন কথাই বিশ্বাস করতে চাইবে না। তথা এই চিন্তাও ছিল যে, আমি মানুষের নিকট আবেদা-যাহেদা (ইবাদত কারিণী, সংসার-বিরাগিণী) হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছি। কিন্তু এরপর আমি তাদের চোখে একজন ব্যভিচারিণী হিসাবে গণ্য হব।

فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلَّا تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا

📘 (জিবরীল) তার নিম্নপাশ হতে আহবান করে তাকে বলল, ‘তুমি দুঃখ করো না, তোমার নিম্নদেশে তোমার প্রতিপালক এক নদী সৃষ্টি করেছেন।

وَهُزِّي إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا

📘 তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কান্ড হিলিয়ে দাও; ওটা তোমার সামনে সদ্যঃপক্ব তাজা খেজুর ফেলতে থাকবে। [১] [১] سَري ছোট নদী বা ঝরনাকে বলা হয়। অর্থাৎ মু'জিযা বা কারামত স্বরূপ মারয়্যামের পদতলে পান করার জন্য পানির ছোট নদী এবং খাওয়ার জন্য একটি শুকনো খেজুর গাছ হতে টাটকা পাকা খেজুরের ব্যবস্থা করলেন। আহবানকারী ছিলেন জিবরীল (আঃ) যিনি উপত্যকার নীচে হতে আহবান করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, سَري অর্থ সরদার বা নেতা, আর সে অর্থে ঈসা (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে এবং তিনিই মা মারয়্যামকে নিম্নদেশ হতে আওয়াজ দিয়েছিলেন।

فَكُلِي وَاشْرَبِي وَقَرِّي عَيْنًا ۖ فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَٰنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا

📘 সুতরাং আহার কর, পান কর ও চোখ জুড়াও;[১] মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখ, তাহলে বল, [২] আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে চুপ থাকার মানত করেছি; সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না।’ [১] অর্থাৎ খেজুর খাও, নদী বা ঝরনার পানি পান কর এবং সন্তানকে দেখে চোখ জুড়াও। [২] এখানে বলার অর্থ ইশারা বা ইঙ্গিতে বলা; মুখের বলা নয়। যেহেতু তাদের শরীয়তে রোযার অর্থই ছিল খাওয়া ও কথা বলা হতে বিরত থাকা।

فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ ۖ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئًا فَرِيًّا

📘 অতঃপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হল; তারা বলল, ‘হে মারয়্যাম! তুমি তো এক অদ্ভুত কান্ড করে বসেছ।

يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيًّا

📘 হে হারূন ভগ্নী![১] তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিণী। [১] হারূন বলতে মারয়্যামের সহোদর বা বৈমাত্রেয় কোন ভাইকে বুঝানো হয়েছে। অথবা হারূন বলতে মূসা (আঃ)-এর ভাই হারূন (আঃ)-কে বুঝানো হয়েছে এবং আরবের পরিভাষা অনুযায়ী তাঁর প্রতি সম্বদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, আরবের লোকেরা বলে থাকে, يَا أخَا تَمِيم! يَا أخَا العَرَب (অর্থাৎ, হে তামীম বংশের লোক, হে আরবের লোক!) অথবা তাকওয়া-পরহেযগারী, পবিত্রতা ও ইবাদতে হারূন (আঃ)-এর মত মনে করে তাঁকে তাঁরই সাদৃশ্যে 'হে হারূনের বোন' বলা হয়েছে। এ ধরনের উদাহরণ কুরআনেও রয়েছে। (আইসারুত তাফাসীর ও ইবনে কাসীর)

فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ ۖ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَنْ كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيًّا

📘 অতঃপর মারয়্যাম ইঙ্গিতে সন্তানকে দেখাল। তারা বলল, যে দোলনার শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?’

إِذْ نَادَىٰ رَبَّهُ نِدَاءً خَفِيًّا

📘 যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করেছিল গোপনে। [১] [১] গোপনে আহবান বা দু'আ এই জন্যই করেছিলেন যে, প্রথমতঃ এইভাবে দু'আ আল্লাহর নিকট বেশী পছন্দনীয়। কারণ এর মধ্যে কাকুতি-মিনতি বেশী প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়তঃ লোকে যাতে তাকে বোকা না ভাবে যে, এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তান চাচ্ছে; যখন সন্তান হওয়ার সকল প্রকার বাহ্যিক সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।

قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا

📘 (শিশুটি) বলল, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর দাস; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। [১] [১] আল্লাহ তাঁর লিখিত তকদীরে আমার ব্যাপারে ফায়সালা করে রেখেছিলেন যে, তিনি আমাকে কিতাব ও নবুঅত দান করবেন।

وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا

📘 যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময়[১] করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আজীবন নামায ও যাকাত আদায় করতে। [১] বরকত অর্থাৎ, আল্লাহর দ্বীনে দৃঢ়তা, বা প্রত্যেক জিনিসে প্রাচুর্য, উন্নতি ও সফলতা। অথবা মানুষের জন্য উপকারী শিক্ষক বা সৎকাজের আদেশদাতা ও অসৎকাজে বাধাদানকারী। (ফাতহুল কাদীর)

وَبَرًّا بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّارًا شَقِيًّا

📘 এবং আমার মাতার প্রতি অনুগত থাকতে।[১] আর তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য। [২] [১] শুধু মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার কথা উল্লেখ হওয়াতেও স্পষ্ট যে, ঈসা (আঃ)-এর পিতা ছিল না। বরং তাঁর জন্ম বিনা পিতায়, এক অলৌকিক মু'জিযার ব্যাপার। অন্যথা তিনিও য়্যাহয়্যা (আঃ)-এর মত بَرًا بوالدَيه (পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী) বলতেন এবং শুধু মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী বা মাতার অনুগত হিসাবে উল্লেখ করতেন না। [২] এর মর্মার্থ এই যে, যে ব্যক্তি মাতা-পিতার সেবাকারী ও অনুগত হয় না, তার স্বভাব-চরিত্রে ঔদ্ধত্য এবং ভাগ্যে দুর্ভাগ্যই নির্ধারিত থাকে। ঈসা (আঃ) সমস্ত কথোপকথনের শব্দে অতীত কাল ব্যবহার করেছেন; যদিও এ সমস্ত কথার সম্পর্ক হচ্ছে ভবিষ্যতের সাথে। আর তখন তিনি ছিলেন সবে মাত্র দুধ খাওয়া শিশু। তা এই কারণেই যে, আল্লাহর লিখিত তকদীরের এমন অটল ফায়সালা ছিল যে, যদিও তার কিছু বর্তমানে প্রকাশ পায়নি, তবুও ভবিষ্যতে এ সবের সত্য হয়ে প্রকাশ এমন সুনিশ্চিত ছিল, যেমন অতীত কালের ঘটে যাওয়া ঘটনায় সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।

وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدْتُ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا

📘 আমার প্রতি শান্তি, যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি ও যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হব।’

ذَٰلِكَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ ۚ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ

📘 এই হল মারয়্যাম তনয় ঈসা (এর বৃত্তান্ত)। (আমি বললাম) সত্য কথা; যে বিষয়ে তারা সন্দেহ করে।[১] [১] এ হল সেই সকল গুণাবলী যা ঈসা (আঃ)-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। আর ঐ গুণ তাঁর মধ্যে ছিল না, যে গুণের কথা খৃষ্টানরা তাঁর ব্যাপারে অতিরঞ্জন করে বলে থাকে এবং যা ইয়াহুদীরা তাঁর ব্যাপারে অবজ্ঞা ও ঘৃণা পোষণ করে বলে থাকে। বরং উপরোক্ত বিবরণই হল সত্য, যাতে মানুষ বেকার সন্দেহ পোষণ করছে।

مَا كَانَ لِلَّهِ أَنْ يَتَّخِذَ مِنْ وَلَدٍ ۖ سُبْحَانَهُ ۚ إِذَا قَضَىٰ أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ

📘 সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর কাজ নয়। তিনি পবিত্র, মহিমময়; তিনি যখন কিছু স্থির করেন, তখন বলেন, ‘হও’ এবং তা হয়ে যায়। [১] [১] যে আল্লাহর মহিমা ও ক্ষমতা এই, তার আবার সন্তানের প্রয়োজন কি? আর এমনিভাবে তার পক্ষে বিনা পিতায় সন্তান জন্ম দেওয়া কোন কঠিন কাজ নয়। সুতরাং যারা আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে ও ঈসার মু'জিযা স্বরূপ অলৌকিকভাবে জন্মের কথা অস্বীকার করে, তারা আসলে আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতাকে অস্বীকার করে।

وَإِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ ۚ هَٰذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ

📘 নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা তাঁর উপাসনা কর, এটাই হল সরল পথ।

فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ مِنْ بَيْنِهِمْ ۖ فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ مَشْهَدِ يَوْمٍ عَظِيمٍ

📘 অতঃপর দলগুলি নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল।[১] সুতরাং এক মহান দিবসের আগমনে অবিশ্বাসীদের ভীষণ দুর্দশা রয়েছে। [২] [১] এখানে الأَحزَاب (দলগুলি) বলতে খ্রিষ্টান ও ইয়াহুদীদের দলকে বুঝানো হয়েছে; যারা ঈসার ব্যাপারে মতভেদ করেছিল। ইয়াহুদীরা বলেছিল, তিনি জাদুকর ও জারজ সন্তান; অর্থাৎ ইউসুফ (যোসেফ) নাজ্জারের অবৈধ সন্তান। খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রোটেষ্ট্যান্টদের বক্তব্য ঈসা আল্লাহর পুত্র। ক্যাথলিকরা বলে, তিনি তিন আল্লাহর তৃতীয়জন। অর্থোডক্সরা বলে তিনি স্বয়ং আল্লাহ। এভাবে ইয়াহুদীরা তাঁকে হীন জ্ঞান করে, আর খ্রিষ্টানরা তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে। (আইসারুত তাফাসীর, ফাতহুল কাদীর) [২] ঐ সমস্ত কাফেরদের জন্য ভীষণ দুর্দশা রয়েছে, যারা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে মতভেদ এবং অতিরঞ্জন ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। কিয়ামতের দিন যখন উপস্থিত হবে, তখন তারা ধ্বংস হবে।

أَسْمِعْ بِهِمْ وَأَبْصِرْ يَوْمَ يَأْتُونَنَا ۖ لَٰكِنِ الظَّالِمُونَ الْيَوْمَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ

📘 তারা যেদিন আমার নিকট আসবে সেদিন তারা কত স্পষ্ট শুনবে ও দেখবে![১] কিন্তু সীমালংঘনকারিগণ আজ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। [১] এগুলি বিস্ময়সূচক শব্দ। অর্থাৎ পৃথিবীতে তারা সত্য দেখা হতে ও সত্য শোনা হতে অন্ধ ও বধির ছিল। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা খুব বেশী দেখতে ও শুনতে পাবে; যদিও এই বেশী দেখা ও শোনা তাদের কোনই কাজে লাগবে না।

وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

📘 (হে রসূল!) তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিন সম্বন্ধে,[১] যেদিন সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে; [২] অথচ (এখন) তারা উদাসীন আছে এবং তারা বিশ্বাস করে না। [১] কিয়ামতের দিনকে আফসোস তথা অনুতাপের দিন বলার কারণ এই যে, সেদিন সকলেই আফসোস করবে। যারা পাপী তারা এই বলে অনুতাপ করবে যে, 'হায়! যদি আমরা পাপ না করতাম।' আর যারা সৎকর্মপরায়ণ তারা এই জন্য অনুতাপ করবে যে, 'হায়! আরো বেশী সৎকর্ম কেন করিনি?' [২] অর্থাৎ হিসাব-নিকাশের পর আমল-নামা গুটিয়ে নেওয়া হবে এবং যারা জান্নাতবাসী তারা জান্নাতে ও যারা জাহান্নামবাসী তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। হাদীসে এসেছে যে, সেদিন মৃত্যুকে এক ভেড়ার আকৃতিতে আনা হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে রেখে জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসী সকলকেই জিজ্ঞাসা করা হবে, 'এটা কি?' তারা বলবে, 'এটা হচ্ছে মৃত্যু।' তারপর তাদের সম্মুখেই তাকে যবেহ করে দেওয়া হবে এবং ঘোষণা করা হবে, 'হে জান্নাতবাসীগণ! তোমরা এবার জান্নাতে চিরস্থায়ী বাস করবে; কখনই মৃত্যু আসবে না। আর হে জাহান্নাম বাসীরা! তোমরা চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। কখনই মৃত্যু আসবে না।' (সহীহ বুখারী, তফসীর সূরা মারয়্যাম, মুসলিম, জান্নাত অধ্যায়)

قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا

📘 সে বলেছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয় আমার অস্থি দুর্বল হয়ে গেছে, আমার মস্তক শুভ্রোজ্জ্বল হয়েছে;[১] হে আমার প্রতিপালক! তোমাকে আহবান করে আমি কখনো ব্যর্থকাম হইনি।[২] [১] যেভাবে জ্বালানী আগুনে জলে উঠে সেইভাবে আমার মাথা সাদা চুলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এর অর্থঃ বার্ধক্য ও দুর্বলতার প্রকাশ। [২] সেই জন্যই বাহ্যিক সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার নিকট সন্তান চাচ্ছি।

إِنَّا نَحْنُ نَرِثُ الْأَرْضَ وَمَنْ عَلَيْهَا وَإِلَيْنَا يُرْجَعُونَ

📘 নিশ্চয় পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে তার চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী আমিই এবং তারা আমারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ ۚ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا

📘 বর্ণনা কর এই কিতাবে (উল্লিখিত) ইব্রাহীমের কথা; নিশ্চয় সে ছিল একজন পরম সত্যবাদী নবী। [১] [১] صِدِّيق শব্দটি صِدق ধাতুর অতিশয়োক্তিমূলক রূপ। সিদ্দীকের অর্থঃ অত্যন্ত বা পরম সত্যবাদী। অর্থাৎ, যাঁর কথায় ও কাজে অত্যন্ত মিল থাকে এবং সত্যবাদিতাই তাঁর প্রতীক হয়। সিদ্দীক বা চরম সত্যবাদিতার এই মর্যাদা নবুঅতের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ের। প্রত্যেক নবী ও রসূল নিজ নিজ যুগের সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী ও সত্যের প্রতীক ছিলেন। সেই জন্য তিনি নবী হওয়ার সাথে সাথে সিদ্দীকও। তবে প্রত্যেক সিদ্দীক নবী নন। কুরআন কারীমে মারয়্যামকে সিদ্দীকাহ বলা হয়েছে, যার অর্থ হল, তিনি আল্লাহর ভয়, পবিত্রতা (সতীত্ব) ও সত্যবাদিতার উচ্চাসনে আসীন ছিলেন; যদিও তিনি নবী ছিলেন না। মুসলিমদের মধ্যেও সিদ্দীক আছে। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ); যাঁকে নবীদের পর উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে মান্য করা হয়েছে।

إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا

📘 যখন সে তার পিতাকে বলল, ‘হে আমার পিতা! যে শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজে আসে না তুমি তার উপাসনা কর কেন?

يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا

📘 হে আমার পিতা! আমার নিকট সেই জ্ঞান এসেছে, যা তোমার নিকট আসেনি।[১] সুতরাং তুমি আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাব। [২] [১] যার দ্বারা আমি আল্লাহর পরিচয় ও প্রত্যয় প্রাপ্ত হয়েছি। মরণের পরপারের জীবন এবং আল্লাহ ছাড়া যারা অন্যের ইবাদত করে, তাদের স্থায়ী শাস্তি সম্বন্ধেও অবগত হয়েছি। [২] যে পথ তোমাকে পরিত্রাণ ও চিরসুখের জীবন দান করবে।

يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَٰنِ عَصِيًّا

📘 হে আমার পিতা! শয়তানের উপাসনা করো না; নিশ্চয় শয়তান পরম দয়াময়ের অবাধ্য। [১] [১] অর্থাৎ শয়তানের কুমন্ত্রণা ও তার প্রলোভনে পড়ে তুমি এমন সব দেবদেবীর পূজা করছ, যারা না শুনতে ও দেখতে পায়, আর না লাভ-নোকসানের ক্ষমতা রাখে। বাস্তবে এটা তো সেই শয়তানেরই পূজা; যে আল্লাহর অবাধ্য এবং অন্যদেরকে তাঁর অবাধ্য করে নিজের মত করতে চেষ্টা করে।

يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَٰنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا

📘 হে আমার পিতা! নিশ্চয় আমি আশংকা করি, তোমাকে পরম দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করবে এবং তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে পড়বে।’[১] [১] অর্থাৎ, আমার ভয় হয় যে, যদি তুমি নিজ কুফরী ও শির্কে অটল থাকো, আর এই অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু এসে যায়, তাহলে আল্লাহর শাস্তি হতে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। অথবা পৃথিবীতেই তোমার উপর আল্লাহর আযাব এসে পতিত হবে এবং শয়তানের সঙ্গী হয়ে চিরদিনের মত আল্লাহর রহমত হতে বিতাড়িত হয়ে যাবে। ইবরাহীম (আঃ) নিজ পিতার সম্মান-সম্ভ্রম সম্পূর্ণ খেয়াল রেখে অত্যদিক নম্রতা ও শ্রদ্ধার সাথে তাওহীদের (এক আল্লাহর ইবাদতের) নসীহত শোনালেন। কিন্তু তাওহীদের এই সবক (পাঠ) যতই নরম ভাষা ও মধুর ভঙ্গিমায় বলা হোক না কেন, মুশরিকদের কাছে তা অসহনীয়ই হবে। অতএব মূর্তিপূজক পিতা এই নম্রতা ও ভালবাসা-মাখা সম্বোধনের জবাবে অত্যন্ত কটু ও কঠোর বাক্য দ্বারা একেশ্বরবাদী পুত্রকে বলল, 'যদি তুমি আমার দেবদেবী থেকে বিমুখ হওয়া হতে ফিরে না এসো, তাহলে আমি তোমাকে পাথরের আঘাতে শেষ করে ফেলব।'

قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ ۖ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ ۖ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا

📘 পিতা বলল, ‘হে ইব্রাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হতে বিমুখ হচ্ছ? যদি তুমি বিরত না হও, তাহলে অবশ্যই আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করব; তুমি দীর্ঘকালের জন্য আমার নিকট হতে দূর হয়ে যাও।’ [১] [১] مَلِي অর্থঃ দীর্ঘ সময় ও কাল। এর দ্বিতীয় অর্থ সুস্থ ও অক্ষত করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাকে নিজের অবস্থায় ছেড়ে দাও, যেন আমি তোমার হাত-পা ভেঙ্গে না ফেলি।

قَالَ سَلَامٌ عَلَيْكَ ۖ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي ۖ إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا

📘 ইব্রাহীম বলল, ‘তোমার উপর সালাম; [১] আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব, [২] নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। [১] এই সালাম অভিবাদনের জন্য নয়; যেমন এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে করে থাকে; বরং এটি হল কথা বলা বন্ধ করার ইঙ্গিত। যেমন মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, "তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, সালাম।" (সূরা ফুরকান ২৫:৬৩) অর্থাৎ, তারা চুপ হয়ে যায়। আর এর মধ্যে ঈমানদার ও আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের আচরণ বর্ণনা করা হয়েছে।[২] ইবরাহীম (আঃ) এ কথা ঐ সময় বলেছিলেন, যখন মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। অতঃপর যখন তিনি জানতে পারলেন, তখন সাথে সাথে প্রার্থনা করা বন্ধ করে দিলেন। (সূরা তাওবা ৯:১১৪)

وَأَعْتَزِلُكُمْ وَمَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَأَدْعُو رَبِّي عَسَىٰ أَلَّا أَكُونَ بِدُعَاءِ رَبِّي شَقِيًّا

📘 আমি তোমাদের নিকট হতে ও তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা কর তাদের নিকট হতে পৃথক হচ্ছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করব। আর আশা করি, আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করে ব্যর্থকাম হব না।’

فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۖ وَكُلًّا جَعَلْنَا نَبِيًّا

📘 অতঃপর সে যখন তাদের হতে ও তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করত সেই সব হতে পৃথক হয়ে গেল, তখন আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকূব[১] এবং প্রত্যেককে নবী করলাম। [১] ইয়াকূব (আঃ) ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর পৌত্র ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর উল্লেখও পুত্রের সাথে পুত্রের মতই করেছেন। তাৎপর্য্য এই যে, যখন ইবরাহীম আল্লাহর একত্ববাদের খাতিরে নিজ পিতা, ঘর ও প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করে পবিত্র ভূমির দিকে হিজরত করল, তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকূব প্রদান করলাম; যাতে তাদের স্নেহ-ভালবাসা পিতাকে ছেড়ে আসার শোককে ভুলিয়ে দেয়।

وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَائِي وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا

📘 নিশ্চয় আমি আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের ব্যাপারে আশংকা করি।[১] আর আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা, সুতরাং তুমি তোমার নিকট হতে[২] আমাকে দান কর একজন উত্তরাধিকারী। [১] এই আশংকার অর্থ এই যে, যদি আমার কোন উত্তরাধিকারী আমার ওয়ায ও উপদেশের দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তাহলে আমার স্বগোত্রীয় আত্মীয়দের মধ্যে তো কেউ এর যোগ্য নেই। আর এর ফলস্বরূপ হয়তো আমার আত্মীয়রা তোমার রাস্তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে। [২] 'তোমার নিকট হতে' এর অর্থ যদিও আমার বাহ্যিক সন্তান-সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে, তবুও তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একটি সন্তান দান কর। (যে আমার ওয়ারেস ও উত্তরাধিকারী হবে।)

وَوَهَبْنَا لَهُمْ مِنْ رَحْمَتِنَا وَجَعَلْنَا لَهُمْ لِسَانَ صِدْقٍ عَلِيًّا

📘 এবং তাদেরকে আমি দান করলাম আমার বহু অনুগ্রহ[১] ও তাদেরকে দিলাম সমুচ্চ খ্যাতি। [২] [১] অর্থাৎ, নবুঅত ছাড়া আরো অনেক অনুগ্রহ তাকে দান করেছিলাম। যেমন ধন-মাল, অতিরিক্ত সন্তান-সন্ততি, অতঃপর তারই বংশে বহু কাল পর্যন্ত নবুঅতের পরম্পরা বজায় রাখা; যা ছিল সব থেকে বড় অনুগ্রহ যা আমি তার উপর করেছি। আর সেই কারণে ইবরাহীম (আঃ)-কে 'আবুল আম্বিয়া' (নবীদের পিতা) বলা হয়ে থাকে। [২] لِسَان صِدق অর্থঃ সুনাম ও সুখ্যাতি। لسان (জিহ্বা)র সম্বন্ধ صِدق (সত্য) এর দিকে জুড়ার পর তার বিশেষণ 'সমুচ্চ' উল্লেখের মাধ্যমে এই কথার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষের মুখে তাঁদের যে সুনাম ও সুখ্যাতি আছে, বাস্তবেই তাঁরা তার যোগ্য অধিকারী। সুতরাং আসমানী ধর্মসমূহের সকল অনুসারীগণ এমন কি মুশরিকরা পর্যন্ত ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর সন্তানদের কথা উত্তম শব্দ দ্বারা ও অত্যধিক আদব ও সম্মানের সাথে আলোচনা করে থাকে। এটি নবুঅত ও সন্তান দানের পর অন্য একটি অনুগ্রহ, যা আল্লাহর পথে হিজরত করার জন্য তিনি প্রাপ্ত হয়েছেন।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مُوسَىٰ ۚ إِنَّهُ كَانَ مُخْلَصًا وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا

📘 এই কিতাবে (উল্লিখিত) মূসার কথা বর্ণনা কর, সে ছিল একজন মনোনীত এবং সে ছিল রসূল, নবী।[১] [১] مُخلَص، مُصطَفى، مُجتَبى، مُختَار চারটি শব্দের অর্থ একই। অর্থাৎ রিসালাত ও নবুঅতের জন্য নির্বাচিত ও মনোনীত ব্যক্তি। রসূল (সংবাদবাহক, দূত) মুরসাল (প্রেরিত)এর অর্থে ব্যবহূত। আর নবীর অর্থঃ যিনি আল্লাহর বাণী মানুষদের নিকট পৌঁছে দেন বা আল্লাহর অহীর সংবাদ দেন। অবশ্য দুয়ের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ, আল্লাহ যে বান্দাকে মানুষদের পথ প্রদর্শন ও হিদায়াতের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং অহী দ্বারা সম্মানিত করেছেন তাঁকে রসূল বা নবী বলা হয়। প্রাচীন কাল হতে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ চলে আসছে যে, রসূল ও নবীর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি না? এবং থাকলে তা কি? পার্থক্যকারীগণ সাধারণতঃ বলে থাকেন যে, যাঁকে নতুন শরীয়ত তথা আসমানী কিতাব দান করা হয়েছে তাঁকে রসূল ও নবী দুই বলা হয়। কিন্তু যিনি পূর্ববতী শরীয়ত মোতাবেক মানুষদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের কথা পৌঁছে দেন, তাঁকে নবী বলা হয়; রসূল নয়। তা সত্ত্বেও কুরআনে উভয় শব্দই একটি অন্যের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোথাও পাশাপাশি পৃথক পৃথক অর্থেও ব্যবহার হয়েছে। যেমন (সূরা হাজ্জ ২২:৫২ আয়াত) দেখুন।

وَنَادَيْنَاهُ مِنْ جَانِبِ الطُّورِ الْأَيْمَنِ وَقَرَّبْنَاهُ نَجِيًّا

📘 আমি তাকে আহবান করেছিলাম তূর পর্বতের ডান দিক হতে এবং আমি নিভৃত আলাপ করা অবস্থায় তাকে নিকটবর্তী করেছিলাম।

وَوَهَبْنَا لَهُ مِنْ رَحْمَتِنَا أَخَاهُ هَارُونَ نَبِيًّا

📘 আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভ্রাতা হারূনকে নবীরূপে।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ ۚ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا

📘 এই কিতাবে (উল্লিখিত) ইসমাঈলের কথা বর্ণনা কর, সে ছিল একজন প্রতিশ্রুতি পালনকারী এবং সে ছিল রসূল, নবী।

وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِنْدَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا

📘 সে তার পরিজনবর্গকে নামায ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার প্রতিপালকের নিকট সন্তোষভাজন।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِدْرِيسَ ۚ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا

📘 এই কিতাবে (উল্লিখিত) ইদরীসের কথা বর্ণনা কর; সে ছিল একজন সত্যবাদী নবী।

وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا

📘 এবং আমি তাকে সুউচ্চ স্থানে উঠিয়ে নিয়েছিলাম। [১] [১] কথিত আছে যে, ইদরীস (আঃ) আদম (আঃ)-এর পর প্রথম নবী ছিলেন এবং নূহ (আঃ) বা তাঁর পিতার দাদা ছিলেন। সর্বপ্রথম তিনিই কাপড় সিলাই শুরু করেন। 'সুউচ্চ স্থানে'র তাৎপর্য্য কি? কিছু মুফাসসির মনে করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর মত ইদরীস (আঃ)-কেও আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কুরআনের শব্দ এই অর্থের জন্য পরিষ্কার নয় এবং সহীহ হাদীসেও এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না। অবশ্য ইস্রাঈলী বর্ণনায় তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়ার কথা পাওয়া যায়, যা এ অর্থ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। সেই জন্য সঠিক অর্থ এটাই মনে হয় যে, 'আমি তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছিলাম।' সেই মর্যাদা ও সম্মান যা তাঁকে নবুঅত দান করার পর দেওয়া হয়েছিল। আর আল্লাহই ভাল জানেন।

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا ۚ إِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَٰنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا ۩

📘 নবীদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এরাই তারা, আদমের ও যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশোদ্ভূত, ইব্রাহীম ও ইস্রাঈলের বংশোদ্ভূত ও যাদেরকে আমি পথ নির্দেশ করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম তাদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিকট পরম করুণাময়ের আয়াত আবৃত্তি করা হলে, তারা ক্রন্দন করতে করতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত। [১] (সিজদাহ-৫) [১] আল্লাহর আয়াত শ্রবণ করে নম্রতা ও কান্নাভাব সৃষ্টি হওয়া ও আল্লাহর মহত্ত্বের সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়া আল্লাহর বান্দাদের বিশেষ লক্ষণ। (এই আয়াত পাঠ শেষে তিলাঅতের সিজদাহ করা সুন্নত। সিজদার আহকাম জানতে সূরা আ'রাফের শেষ আয়াতের ৭:২০৬ টীকা দেখুন।)

۞ فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلَاةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ ۖ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا

📘 তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তিগণ, তারা নামায নষ্ট করল ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হল; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। [১] [১] আল্লাহর পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দাদের বর্ণনার পর ঐ সমস্ত লোকেদের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে যারা এর বিপরীত আল্লাহর আদেশের অন্যথাচরণ করে ও বিমুখতা অবলম্বন করে। নামায বিনষ্ট করার অর্থ একেবারে নামায না পড়া; যা মূলতঃ কুফরী, অথবা নামাযের সময় বিনষ্ট করা; যার অর্থ সঠিক সময়ে নামায আদায় না করা, যখন ইচ্ছা পড়া বা বিনা ওযরে দুই বা ততোধিক নামাযকে একত্রে পড়া, অথবা কখনো দুই, কখনো চার, কখনো এক, কখনো পাঁচ অক্তের নামায পড়া। এ সমস্ত নামায বিনষ্ট করার অর্থে শামিল। এ রকম ব্যক্তি অত্যন্ত পাপী এবং আয়াতে বর্ণিত শাস্তির যোগ্য। غَي এর অর্থ ধ্বংস, অমঙ্গল, অশুভ পরিণাম বা জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম।

يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ ۖ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا

📘 যে উত্তরাধিকারী হবে আমার এবং উত্তরাধিকারী হবে ইয়াকূবের বংশের। আর হে আমার প্রতিপালক! তাকে তুমি সন্তোষভাজন কর।’

إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ شَيْئًا

📘 কিন্তু তারা নয় যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে; তারা তো জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর তাদের প্রতি কোন যুলুম করা হবে না। [১] [১] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তওবা করে নামায ত্যাগ ও খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করা হতে ফিরে আসবে এবং ঈমান ও সৎকাজের দাবীসমূহ পূরণ করবে তারা উল্লিখিত অশুভ পরিণাম হতে পরিত্রাণ লাভ করবে এবং জান্নাতের অধিকারী বিবেচিত হবে।

جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدَ الرَّحْمَٰنُ عِبَادَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّهُ كَانَ وَعْدُهُ مَأْتِيًّا

📘 সেই স্থায়ী জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি পরম দয়াময় নিজ দাসদেরকে অদৃশ্যভাবে দিয়েছেন; [১] নিশ্চয় তাঁর প্রতিশ্রুত বিষয় অবশ্যম্ভাবী। [১] অর্থাৎ, এটি তাদের ঈমান ও ইয়াক্বীনের দৃঢ়তা যে, তারা জান্নাত তো দেখেইনি বরং আল্লাহর অদৃশ্যভাবে দেওয়া প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করে জান্নাত পাওয়ার আশায় ঈমান ও আল্লাহ-ভীতির রাস্তা অবলম্বন করেছে।

لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا إِلَّا سَلَامًا ۖ وَلَهُمْ رِزْقُهُمْ فِيهَا بُكْرَةً وَعَشِيًّا

📘 সেখানে তারা ‘শান্তি’ ছাড়া কোন অসার বাক্য শুনবে না[১] এবং সেথায় সকাল-সন্ধ্যায় তাদের জন্য থাকবে জীবনোপকরণ। [২] [১] অর্থাৎ, ফিরিশতারাও চর্তুদিক হতে সালাম করবে এবং জান্নাতীরাও একে অপরকে বেশি বেশি সালাম করবে। [২] ইমাম আহমাদ (রঃ) এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, জান্নাতে দিন-রাত হবে না। জান্নাত সর্বদা আলোয় আলোকিত থাকবে। হাদীসের মধ্যে আছে, জান্নাতে প্রবেশকারী প্রথম দলটির মুখমন্ডল হবে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। না মুখে থুথু আসবে আর না নাকে পানি, না মল-মূত্র ত্যাগের প্রয়োজন হবে। (মহিলাদের মাসিক আসবে না।) তাদের বাসনপত্র ও চিরুনী হবে সোনার। তাদের সুরভিত ধোঁয়া হবে সুগন্ধ কাঠের। তাদের শরীরের ঘাম হবে মৃগনাভির ন্যায় সুগন্ধময়। প্রত্যেক জান্নাতীকে দু'জন স্ত্রী দেওয়া হবে; যাদের রূপ-সৌন্দর্য্যের কারণে বাহির হতে পায়ের হাড়ের ভিতরের মগজ দেখা যাবে। আপোসে কোন প্রকার মনোমালিন্য থাকবে না। তাদের অন্তর হবে একটি মানুষের অন্তরের মত। সকাল-সন্ধ্যা তারা আল্লাহর তসবীহ পাঠ করবে। (বুখারী, মুসলিম)

تِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي نُورِثُ مِنْ عِبَادِنَا مَنْ كَانَ تَقِيًّا

📘 এ হল সেই জান্নাত যার অধিকারী করব আমি আমার দাসদের মধ্যে সংযমশীলকে।

وَمَا نَتَنَزَّلُ إِلَّا بِأَمْرِ رَبِّكَ ۖ لَهُ مَا بَيْنَ أَيْدِينَا وَمَا خَلْفَنَا وَمَا بَيْنَ ذَٰلِكَ ۚ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا

📘 (জিবরীল বলল,) ‘আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ব্যতিরেকে অবতরণ করি না;[১] আমাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে ও এই দু-এর অন্তর্বর্তী যা আছে তা তাঁরই। আর আপনার প্রতিপালক ভুলবার নন।’ [১] নবী (সাঃ) একবার জিবরীলের নিকট বেশী বেশী ও সত্বর সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করলে এই আয়াত অবর্তীণ হয়।

رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا فَاعْبُدْهُ وَاصْطَبِرْ لِعِبَادَتِهِ ۚ هَلْ تَعْلَمُ لَهُ سَمِيًّا

📘 তিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের অন্তর্বর্তী যা কিছু আছে সবারই প্রতিপালক; সুতরাং তুমি তাঁরই উপাসনা কর এবং তাঁর উপাসনায় ধৈর্যশীলতা অবলম্বন কর; তুমি কি তাঁর সমনাম কাউকেও জান?[১] [১] অর্থাৎ, জান না। যখন তার সমনাম ও সমতুল্য আর কেউ নেই, তখন তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্যও নেই।

وَيَقُولُ الْإِنْسَانُ أَإِذَا مَا مِتُّ لَسَوْفَ أُخْرَجُ حَيًّا

📘 মানুষ[১] বলে, ‘আমার মৃত্যু হলে আমি কি জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হব?’ [২] [১] এখানে মানুষ বলতে সাধারণ কাফেরকে বুঝানো হয়েছে; যারা কিয়ামত ও পুনরুত্থানে বিশ্বাসী নয়। [২] এখানে প্রশ্ন অস্বীকৃতির অর্থে ব্যবহার হয়েছে; অর্থাৎ, আমি মৃত্যুর পর যখন মাটিতে মিশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব, তখন আমাকে পুনঃ দ্বিতীয়বার কিভাবে সৃষ্টি করা হবে? অর্থাৎ এরূপ সম্ভব নয়।

أَوَلَا يَذْكُرُ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ قَبْلُ وَلَمْ يَكُ شَيْئًا

📘 মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমি তাকে পূর্বে সৃষ্টি করেছি যখন সে কিছুই ছিল না? [১] [১] আল্লাহ তাআলা উত্তরে বলেন, যখন আমি মানুষকে প্রথমবার বিনা কোন নমুনা ছাড়া সৃষ্টি করেছি, তখন দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা কেমন করে কঠিন হতে পারে? প্রথমবার সৃষ্টি করা কঠিন, না দ্বিতীয়বার? মানুষ কতই না বোকা ও আত্মবিস্মৃত! আর আত্মবিস্মৃতিই মানুষকে আল্লাহবিস্মৃত বানিয়েছে।

فَوَرَبِّكَ لَنَحْشُرَنَّهُمْ وَالشَّيَاطِينَ ثُمَّ لَنُحْضِرَنَّهُمْ حَوْلَ جَهَنَّمَ جِثِيًّا

📘 সুতরাং শপথ তোমার প্রতিপালকের! আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে সমবেত করব। অতঃপর আমি অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চতুর্দিকে উপস্থিত করব।[১] [১] جِثي শব্দটি جَاثٍ এর বহুবচন, যার উৎপত্তি جَثا يَجثُو থেকে। এর অর্থঃ হাঁটু গেড়ে বসা, নতজানু হওয়া। শব্দটি এখানে অবস্থা বর্ণনার জন্য ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ আমি শুধু ওদেরকেই পুনর্জীবিত করব না বরং ঐ সমস্ত শয়তানকেও জীবিত করব যারা তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল বা যাদের তারা ইবাদত করত। অতঃপর তাদের সকলকেই এই অবস্থায় জাহান্নামের নিকট একত্রিত করব যে তারা কিয়ামতের ময়দানের ভয়াবহতা ও জবাবদিহির ভয়ে হাঁটু গেড়ে বসে যাবে। হাদীসে কুদসীতে আছে, মহান আল্লাহ বলেন, "আদম-সন্তান আমাকে মিথ্যাজ্ঞান করে, অথচ তার জন্য এটা সঙ্গত নয়। আদম-সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়, অথচ তার জন্য এটা শোভনীয় নয়। আমাকে তার মিথ্যাজ্ঞান করা এই যে, আমার সম্পর্কে সে বলে, 'আল্লাহ যেরূপ আমাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন কখনই আমাকে সেইরূপ পুনর্জীবিত করবেন না'; অথচ আমার প্রথমবার সৃষ্টি করা দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার চেয়ে সহজ নয়। (অর্থাৎ যদি সৃষ্টি করা কঠিন হয় তাহলে প্রথমবার হওয়াই উচিত, দ্বিতীয়বার নয়।) আর আমাকে ওর কষ্ট দেওয়া এই যে, সে বলে, আমার সন্তান আছে; অথচ আমি একক, আমি কারো মুখাপেক্ষী নই। না আমি কাউকে জন্ম দিয়েছি, এবং না আমাকে কেউ জন্ম দিয়েছে। আর আমার সমকক্ষ ও সমতুল্য কেউ নেই।" (বুখারী, সূরা ইখলাসের তফসীর)

ثُمَّ لَنَنْزِعَنَّ مِنْ كُلِّ شِيعَةٍ أَيُّهُمْ أَشَدُّ عَلَى الرَّحْمَٰنِ عِتِيًّا

📘 অতঃপর প্রত্যেক দলের মধ্যে যে পরম দয়াময়ের প্রতি সর্বাধিক অবাধ্য আমি তাকে টেনে অবশ্যই বের করব। [১] [১] عِتي শব্দটিও عَاتٍٍ এর বহুবচন, যার উৎপত্তি عَتا يَعتُو থেকে। এর অর্থঃ অত্যধিক অবাধ্য, বিদ্রোহী। অর্থাৎ প্রত্যেক ভ্রষ্ট দল হতে বড় বড় নেতা ও বিদ্রোহীদেরকে আলাদা করে নেব এবং একত্রিত করে জাহান্নামে ঠেলে দেব। কেননা এ সব নেতারা অন্য সব জাহান্নামীদের তুলনায় বেশী শাস্তিযোগ্য। যেমন পরবর্তী আয়াতে এ কথা এসেছে।

يَا زَكَرِيَّا إِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلَامٍ اسْمُهُ يَحْيَىٰ لَمْ نَجْعَلْ لَهُ مِنْ قَبْلُ سَمِيًّا

📘 তিনি বললেন, ‘হে যাকারিয়া! অবশ্যই আমি তোমাকে একজন পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি; তার নাম হবে য়্যাহয়্যা; এই নামে আমি পূর্বে কারো নামকরণ করিনি।’ [১] [১] আল্লাহ তাআলা শুধু তাঁর দু'আই কবুল করলেন না; বরং সন্তানের নামও ঠিক করে দিলেন।

ثُمَّ لَنَحْنُ أَعْلَمُ بِالَّذِينَ هُمْ أَوْلَىٰ بِهَا صِلِيًّا

📘 তারপর আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা জাহান্নাম প্রবেশের অধিকতর যোগ্য তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। [১] [১] صِلِيًا শব্দটি صَلَى يَصلى এর 'মাসদার সাময়ী' (শ্রুত ক্রিয়ামূল) যার অর্থ প্রবেশ করা। অর্থাৎ জাহান্নামে প্রবেশ করায় ও ওতে জ্বলে ভস্ম হওয়ার অধিক যোগ্য কারা, আমি তা ভালোই জানি।

وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا ۚ كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا

📘 তোমাদের প্রত্যেকেই তাতে প্রবেশ করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।

ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا

📘 পরে আমি সাবধানীদেরকে উদ্ধার করব এবং সীমালংঘনকারীদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় বর্জন করব। [১] [১] এর ব্যাখ্যা সহীহ হাদীসে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, জাহান্নামের উপর সেতু (পুলসিরাত) স্থাপন করা হবে যার উপর দিয়ে প্রত্যেক মুমিন ও মুনাফিককে পার হতে হবে। মুমিনরা নিজ নিজ আমল অনুসারে দ্রুত ও ধীর গতিতে পার হয়ে যাবে; কেউ চোখের পাতা ফেলার গতিতে (পলকের মধ্যে), কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ হাওয়ার গতিতে, কেউ উড়ন্ত পাখির গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ বা অন্যান্য যানবাহনের গতিতে, কেউ বা পূর্ণ নিরাপদে, কেউ যখম হয়েও পার হয়ে যাবে। আবার কিছু জাহান্নামে পড়েও যাবে পরে তাদেরকে সুপারিশ দ্বারা বের করে নেওয়া হবে। কিন্তু মুনাফিকদল ঐ পুল পার হতে সফল বা সক্ষম হবে না। বরং সকলেই জাহান্নামে পড়ে যাবে। এর সমর্থন ঐ হাদীস দ্বারাও হয়, যাতে বলা হয়েছে যে, "যার তিন তিনটি সন্তান সাবালক হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করবে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না; কিন্তু প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য (জাহান্নামের উপর বেয়ে অতিক্রম করবে)।" (বুখারী, মুসলিম) আর সেই প্রতিজ্ঞা, যা উক্ত আয়াতে "এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং জাহান্নামে প্রবেশ করার অর্থ হবে, শুধুমাত্র পুলসিরাতের উপর বেয়ে পার হওয়া। (বিস্তৃত জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ ইবনে কাসীর, আইসারুত্ তাফাসীর)

وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا أَيُّ الْفَرِيقَيْنِ خَيْرٌ مَقَامًا وَأَحْسَنُ نَدِيًّا

📘 তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে আবৃত্ত হলে অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসীদেরকে বলে, ‘দু’দলের মধ্যে কোন্‌টি মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতর ও মজলিস হিসাবে কোনটি উত্তম?’ [১] [১] মক্কার কাফেররা দরিদ্র মুসলিম ও ধনী কুরাইশ তথা তাদের সভা ও ঘর-বাড়ির মধ্যে তুলনা করে কুরআনী আহবানের মোকাবেলা করে থাকে। মুসলিমদের মধ্যে আম্মার, বিলাল, সুহাইবের মত দরিদ্র মানুষ রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শগৃহ (মন্ত্রণালয়) 'দারুল আরকাম'। অন্য দিকে কাফেরদের মধ্যে রয়েছে আবু জাহল, নযর বিন হারিস, উতবা, শাইবা প্রভৃতির মত নেতৃস্থানীয় লোক, তাদের উঁচু উঁচু প্রাসাদ রয়েছে এবং মন্ত্রণাসভার জন্য রয়েছে 'দারুন নাদওয়াহ' যা অতি সুন্দর।

وَكَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنْ قَرْنٍ هُمْ أَحْسَنُ أَثَاثًا وَرِئْيًا

📘 তাদের পূর্বে কত জাতিকে আমি বিনাশ করেছি, যারা তাদের অপেক্ষা সাজ-সরঞ্জাম ও বাহ্য দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ ছিল। [১] [১] আল্লাহ তাআলা বলেন, দুনিয়ার এই সমস্ত জিনিস এমন নয় যা নিয়ে গর্ব করা যেতে পারে বা হক ও বাতিল (সত্য ও অসত্য) এর মধ্যে পার্থক্য করা যেতে পারে। এসব তো পূর্ববর্তী উম্মতের কাছেও ছিল, তা সত্ত্বেও সত্যকে অস্বীকার করার ফলে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর এই ধন-সম্পদ তাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে বাঁচাতে পারেনি।

قُلْ مَنْ كَانَ فِي الضَّلَالَةِ فَلْيَمْدُدْ لَهُ الرَّحْمَٰنُ مَدًّا ۚ حَتَّىٰ إِذَا رَأَوْا مَا يُوعَدُونَ إِمَّا الْعَذَابَ وَإِمَّا السَّاعَةَ فَسَيَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ شَرٌّ مَكَانًا وَأَضْعَفُ جُنْدًا

📘 বল, ‘যারা বিভ্রান্তিতে আছে, পরম দয়াময় তাদেরকে প্রচুর ঢিল দেবেন; পরিশেষে যখন তারা যে বিষয়ে তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করবে; তা শাস্তি হোক অথবা কিয়ামতই হোক; তখন তারা জানতে পারবে, কে মর্যাদায় নিকৃষ্ট ও কে দলবলে দুর্বল।’ [১] [১] এ ছাড়াও এসব বস্তু পথভ্রষ্ট ও কাফেরদেরকে অবকাশ ও ঢিল দেওয়ার জন্য দান করা হয়। অতএব তা দেখার বিষয় নয়। মূলতঃ ভাল-মন্দের পার্থক্য ঐ সময় সূচিত হবে, যখন আমলের অবকাশ সময় শেষ হয়ে গিয়ে আল্লাহর আযাব এসে পড়বে বা কিয়ামত এসে পড়বে। কিন্তু ঐ সময়ের জ্ঞান কোন উপকার দেবে না। কারণ ঐ সময় শুধরে নেওয়ার অথবা সংশোধনের কোন সুযোগ থাকবে না।

وَيَزِيدُ اللَّهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى ۗ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ مَرَدًّا

📘 যারা সৎপথে চলে আল্লাহ তাদের পথপ্রাপ্তিতে বৃদ্ধি দান করেন;[১] আর স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও শ্রেষ্ঠ। [২] [১] এখানে অন্য এক রীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা এই যে, যেমন কুরআন দ্বারা যাদের অন্তরে কুফরী, শিরক তথা ভ্রষ্টতার ব্যাধি রয়েছে তাদের বদমায়েশি ও ভ্রষ্টতা আরো বৃদ্ধি পায়, তেমনি যারা ঈমানদার তাদের ঈমান ও হিদায়াতে আরো বেশী দৃঢ়তা আসে। [২] এই আয়াতে দরিদ্র মুসলিমদেরকে সান্তনা দেওয়া হয়েছে যে, কাফের ও মুশরিকরা যে সব ধন-সম্পদ নিয়ে গর্ব, অহংকার করে তা এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমরা যে সৎকর্ম করছ তা চিরকাল বাকী থাকবে; যার সওয়াব ও নেকী তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রাপ্ত হবে এবং তার উত্তম প্রতিদান ও উপকারিতা তোমরা সেখানে লাভ করবে।

أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالًا وَوَلَدًا

📘 তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে, অবশ্যই আমাকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবে।

أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَٰنِ عَهْدًا

📘 সে কি অদৃশ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে অথবা পরম দয়াময়ের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে?

كَلَّا ۚ سَنَكْتُبُ مَا يَقُولُ وَنَمُدُّ لَهُ مِنَ الْعَذَابِ مَدًّا

📘 কখনই নয়! তারা যা বলে, আমি তা লিখে রাখব এবং তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করতে থাকব।

قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا وَقَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِيًّا

📘 সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমার স্ত্রী বন্ধ্যা ও আমি বার্ধক্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি।’ [১] [১] عاقِر ঐ মহিলাকে বলা হয় যে বার্ধক্যের কারণে সন্তান জন্মাতে সক্ষম নয়, আর ঐ মহিলাকেও বলা যায়, যে প্রথম হতেই বন্ধ্যা। এখানে দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যে কাঠ শুকিয়ে যায় তাকে عِتي বলা হয়। এখানে অর্থ বার্ধক্যের শেষ পর্যায়, যখন শরীরের গোশত শুকিয়ে যায়। বলার উদ্দেশ্য হল, আমার স্ত্রী তো যৌবন কাল হতেই বন্ধ্যা, আর আমিও বৃদ্ধ ব্যক্তি। এখন আমাদের সন্তান হবে কিভাবে? কথিত আছে যাকারিয়া (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম ছিল আশা' বিনতে ফাক্বূদ বিন মীল। ইনি ছিলেন মারয়্যামের মা হান্নার বোন। কিন্তু সঠিক কথা হল আশা'ও মারয়্যামের পিতা ইমরানেরই কন্যা ছিলেন। অতএব (মারয়্যাম ও আশা' দুই বোন এবং) য়্যাহয়্যা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) আপোসে খালাতো ভাই। যেমন সহীহ হাদীসেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। (ফাতহুল কাদীর)

وَنَرِثُهُ مَا يَقُولُ وَيَأْتِينَا فَرْدًا

📘 সে যার কথা বলে, তা থাকবে আমার অধিকারে এবং সে আমার নিকট একাকী আসবে।[১] [১] এই আয়াতগুলোর অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় যে, আমর বিন আ'স (রাঃ)-এর পিতা আ'স বিন ওয়ায়েল ইসলামের চরম শত্রু ছিল। তার কাছে খাব্বাব বিন আরাত্তের কিছু ঋণ পাওনা ছিল। তিনি লোহার (কামারের) কাজ করতেন। খাব্বাব যখন ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে তাগাদা করলেন, তখন আ'স বলল, 'যতক্ষণ তুমি মুহাম্মাদকে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করব না।' খাব্বাব বললেন, 'আমি এ কাজ তো তুমি মরে গিয়ে পুনর্জীবিত হওয়ার পরেও করব না।' সে বলল, 'আচ্ছা যখন আমাকে মরার পর আবার জীবিত হতে হবে, তখন আমাকে ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দেওয়া হবে, তখন আমি তোমার ঋণ শোধ করে দেব।' (বুখারী, মুসলিম) আল্লাহ বলেন, সে যে এই দাবী করছে, তার কাছে কি গায়বের জ্ঞান আছে যে, ওখানে তাকে ধন ও সন্তান দান করা হবে? অথবা আল্লাহ কি তাকে কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? এমন কখনই না। বরং তার কথায় রয়েছে অহংকার ও আল্লাহর আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাস। এ ব্যক্তি যে মাল ও সন্তানের কথা বলছে তার উত্তরাধিকারী তো আমিই। অর্থাৎ মৃত্যুর পর পর সে সমস্ত হতে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে এবং আমার নিকট একাকী আসবে; তখন সাথে না মাল থাকবে, না সন্তান না কোন সাঙ্গপাঙ্গ। বরং থাকবে আগুনের শাস্তি; যা তার জন্য ও তার মত অন্য লোকদের জন্য আমি বৃদ্ধি করতে থাকব।

وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لِيَكُونُوا لَهُمْ عِزًّا

📘 তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যদেরকে গ্রহণ করেছে এই জন্য যে, যাতে তারা তাদের সম্মানের কারণ হয়।

كَلَّا ۚ سَيَكْفُرُونَ بِعِبَادَتِهِمْ وَيَكُونُونَ عَلَيْهِمْ ضِدًّا

📘 কখনই নয়, তারা তাদের উপাসনা অস্বীকার করবে এবং তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।[১] [১] عِزّ এর মমার্থ হল এই সব উপাস্য (দেবদেবী)রা তাদের ইয্যত-সম্মানের কারণ ও সহায় হবে। আর ضَدّ এর অর্থ হল শত্রু, অস্বীকারকারী, প্রতিবাদী তথা ওদের বিরুদ্ধে অন্যদের সহায়ক হবে। অর্থাৎ এই সব দেবদেবী তাদের ধারণার বিপরীত তাদের পক্ষ অবলম্বন না করে তাদের শত্রু, অস্বীকারকারী, প্রতিপক্ষ ও বিরোধী হিসাবে প্রকাশ পাবে।

أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا

📘 তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আমি অবিশ্বাসীদের জন্য শয়তানদেরকে ছেড়ে রেখেছি; তারা তাদেরকে মন্দকর্মে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ করে থাকে। [১] [১] অর্থাৎ পথভ্রষ্ট করে, প্রলোভন ও কুমন্ত্রণা দেয় এবং পাপের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

فَلَا تَعْجَلْ عَلَيْهِمْ ۖ إِنَّمَا نَعُدُّ لَهُمْ عَدًّا

📘 সুতরাং তাদের বিষয়ে তাড়াতাড়ি করো না; আমি তো গণনা করছি তাদের নির্ধারিত কাল। [১] [১] আর যখন সেই অবকাশের নির্ধারিত কাল শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহর আযাবে পতিত হবে। সুতরাং তোমার তাড়াহুড়ো করার কোন প্রয়োজন নেই।

يَوْمَ نَحْشُرُ الْمُتَّقِينَ إِلَى الرَّحْمَٰنِ وَفْدًا

📘 (স্মরণ কর,) যেদিন আমি পরম দয়াময়ের নিকট সাবধানীদেরকে অতিথিরূপে (সওয়ার অবস্থায়) সমবেত করব।

وَنَسُوقُ الْمُجْرِمِينَ إِلَىٰ جَهَنَّمَ وِرْدًا

📘 এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাব। [১] [১] وَفد শব্দটি وَافِد শব্দের বহুবচন, যেমন رَكب শব্দটি رَاكِب শব্দের বহুবচন। অর্থ এই যে, সেদিন পরহেযগার ও সাধানীদেরকে উট ও ঘোড়ার উপর চড়িয়ে অত্যন্ত ইয্যত ও সম্মানের সাথে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। وِردًا এর অর্থ পিপাসার্ত। অর্থাৎ, তাঁদের বিপরীত অপরাধীদেরকে ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।

لَا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَٰنِ عَهْدًا

📘 যে পরম দয়াময়ের নিকট প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ছাড়া অন্য কারো সুপারিশ করবার ক্ষমতা থাকবে না। [১] [১] প্রতিশ্রুতির অর্থঃ ঈমান ও আল্লাহর ভয়। অর্থাৎ ঈমানদার ও আল্লাহ-ভীরু বান্দাদের মধ্যে যাঁদেরকে আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি প্রদান করবেন তাঁরা ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অনুমতিই পাবে না।

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا

📘 তারা বলে, ‘পরম দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন!’

لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا

📘 তোমরা তো এক বীভৎস[১] কথার অবতারণা করেছ। [১] إَدّ এর অর্থঃ ভয়ানক ব্যাপার বা বীভৎস কান্ড। এ বিষয় এর আগেও আলোচিত হয়েছে যে, 'আল্লাহর সন্তান আছে' বলা এত বড় অপরাধ যে, এই অপরাধে আকাশ-পৃথিবী বিদীর্ণ হতে পারে এবং পাহাড়-পর্বত চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে পারে।

قَالَ كَذَٰلِكَ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا

📘 তিনি বললেন, ‘এই রূপই হবে; তোমার প্রতিপালক বললেন, এটা আমার জন্য সহজসাধ্য; আমি তো পূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না।’ [১] [১] ফিরিশতাগণ যাকারিয়া (আঃ)-এর বিস্ময় এই বলে দূর করলেন যে, আল্লাহ তোমাকে পুত্র সন্তান দেওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করে ফেলেছেন এবং তা তিনি অবশ্যই তোমাকে দান করবেন। আর আল্লাহর পক্ষে এটা মোটেই অসম্ভব নয়; কারণ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন যখন তুমি কিছুই ছিলে না, তিনি তোমাকে বাহ্যিক কারণ না থাকা সত্ত্বেও সন্তান দিতে সক্ষম।

تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا

📘 এতে যেন আকাশসমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হবে এবং পর্বতসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে।

أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَٰنِ وَلَدًا

📘 যেহেতু তারা পরম দয়াময়ের প্রতি সন্তান আরোপ করে।

وَمَا يَنْبَغِي لِلرَّحْمَٰنِ أَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا

📘 অথচ সন্তান গ্রহণ করা পরম দয়াময়ের জন্য শোভনীয় নয়।

إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَٰنِ عَبْدًا

📘 আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যে পরম দয়াময়ের নিকট দাসরূপে উপস্থিত হবে না। [১] [১] যখন সবাই আল্লাহর দাস ও অসহায় বান্দা, তখন তাঁর সন্তানের প্রয়োজন কি? আর সন্তান গ্রহণ করা আল্লাহর জন্য শোভনীয়ও নয়।

لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدًّا

📘 তিনি তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি তাদেরকে বিশেষভাবে গণনা করেছেন। [১] [১] অর্থাৎ, আদম থেকে নিয়ে কিয়ামতের সকাল পর্যন্ত যত মানব ও দানব জন্ম নেবে সকলের পরিসংখ্যান আল্লাহর কাছে রয়েছে। সবাই তাঁর পাকড়াও ও আয়ত্তের অধীনে। কেউ তাঁর দৃষ্টিতে লুক্কায়িত নয়, লুকিয়ে থাকতেও পারে না।

وَكُلُّهُمْ آتِيهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْدًا

📘 কিয়ামতের দিন তাদের সকলেই তাঁর নিকট আসবে একাকী অবস্থায়। [১] [১] অর্থাৎ, কেউ কারো সাহায্যকারী হবে না, আর না মালই কারো কোন কাজে আসবে। {يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ} অর্থাৎ, সেদিন না ধন-মাল কোন কাজ দেবে, আর না সন্তান-সন্ততি। (সূরা শুআরা ২৬:৮৮) প্রত্যেককেই একা একা নিজ হিসাব দিতে হবে। আর মানুষ পৃথিবীতে যাদের জন্য কিয়ামতের দিন সাহায্যকারী ও সহায়ক হবে বলে মনে করে, তারা সবাই অদৃশ্য ও উধাও হয়ে যাবে। কেউ কারো সাহায্যের জন্য উপস্থিত হবে না।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَٰنُ وُدًّا

📘 যারা বিশ্বাস করেছে এবং সৎকর্ম করেছে পরম দয়াময় তাদের জন্য (পারস্পরিক) সম্প্রীতি সৃষ্টি করবেন। [১] [১] অর্থাৎ, পৃথিবীতে মানুষের অন্তরে নেকী ও পরহেযগারীর জন্য ভালবাসার সৃষ্টি করবেন। যেমন হাদীসে এসেছে, "যখন আল্লাহ কোন বান্দাকে নিজের প্রিয় করে নেন, তখন তিনি জিবরীল (আঃ)-কে বলেন যে, আমি অমুক বান্দাকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস। সুতরাং জিবরীল (আঃ)ও তাকে ভালবাসতে শুরু করেন। অতঃপর তিনি সারা আকাশে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তোমরাও তাকে ভালবাস। সুতরাং আকাশের সমস্ত ফিরিশতা তাকে ভালবাসতে শুরু করেন। তারপর পৃথিবীতে তার বরণ ও গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করা হয়। (বুখারী)

فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْمًا لُدًّا

📘 আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি;[১] যাতে তুমি তার দ্বারা সাবধানীদেরকে সুসংবাদ দিতে পার এবং বিতর্কপ্রিয় সম্প্রদায়কে[২] সতর্ক করতে পার। [১] কুরআনকে সহজ করে দেওয়ার অর্থ ঐ ভাষায় অবতীর্ণ করা যা নবী (সাঃ) জানতেন, অর্থাৎ আরবী ভাষায়। এ ছাড়া তার বিষয়-বস্তুর স্পষ্টতা ও সরলতা এই অর্থের শামিল। [২] لُدّ শব্দটি ألَدّ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ ঝগড়াটে, বিতর্ক-প্রিয়। এখানে কাফের ও মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে।

وَكَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنْ قَرْنٍ هَلْ تُحِسُّ مِنْهُمْ مِنْ أَحَدٍ أَوْ تَسْمَعُ لَهُمْ رِكْزًا

📘 তাদের পূর্বে আমি কত জাতিকে বিনাশ করেছি! তুমি কি তাদের কারো কিছু অনুভব কর অথবা তাদের ক্ষীণতম শব্দও শুনতে পাও? [১] [১] تُحسّ এর অর্থ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা, অর্থাৎ তুমি কি তাদেরকে চোখ দিয়ে দেখতে পাও, হাত দিয়ে ছুঁতে পার? প্রশ্ন অস্বীকৃতির জন্য; অর্থাৎ পৃথিবীতে ওদের অস্তিতত্ত্বই নেই যাকে দেখে ও ছুঁয়ে অনুভব করা যায় অথবা তাদের ক্ষীণতম শব্দও শুনতে পাওয়া যায়। رِكز এর অর্থঃ ক্ষীণতম শব্দ।