🕋 تفسير سورة سبأ
(Saba) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي الْآخِرَةِ ۚ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
📘 প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্ত কিছুরই মালিক[১] এবং পরলোকেও সকল প্রশংসা তাঁরই।[২] তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্ববিষয়ে অবহিত।
[১] অর্থাৎ, তা তাঁরই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে আছে এবং তাতে তাঁরই ইচ্ছা ও ফায়সালা চলে। মানুষ যে সকল নিয়ামত পেয়েছে, তার সব কিছু তাঁরই সৃষ্টি এবং তা তাঁরই অনুগ্রহ। যার ফলে আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তুর প্রশংসা প্রকৃত পক্ষে আল্লাহরই ঐ নিয়ামতের উপর প্রশংসা; যা তিনি তাঁর সৃষ্টিকে প্রদান করেছেন।[২] এ প্রশংসা কিয়ামতের দিন মু'মিন ব্যক্তিগণ করবে। যেমন, প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন.......।
(সূরা যুমার ৩৯:৭৪ আয়াত)
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই; যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন।
(সূরা আ'রাফ ৭:৪৩ আয়াত)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর; যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন।
(সূরা ফাত্বির ৩৫:৩৪ আয়াত)
ইত্যাদি। তার পরেও দুনিয়াতে আল্লাহর হামদ্ ও প্রশংসা করা এক প্রকার ইবাদত; যা পালন করতে মানুষকে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর আখেরাতে (বেহেশ্তে) তা মু'মিনদের রূহের খোরাক হবে, যাতে তারা আনন্দ ও খুশী উপভোগ করবে।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
۞ وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ مِنَّا فَضْلًا ۖ يَا جِبَالُ أَوِّبِي مَعَهُ وَالطَّيْرَ ۖ وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيدَ
📘 নিশ্চয় আমি দাঊদকে আমার তরফ থেকে অনুগ্রহ প্রদান করেছিলাম।[১] হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং হে পক্ষীকুল তোমরাও।[২] আর লৌহকে তার জন্য নম্র করেছিলাম। [৩]
[১] অর্থাৎ নবুঅতের সাথে সাথে বাদশাহী এবং আরো কিছু বিশেষ মর্যাদা দান করেছিলেন।
[২] বিশেষ মর্যাদাসমূহের মধ্যে একটি মর্যাদা সুমধুর কণ্ঠস্বরের নিয়ামত ছিল। যখন তিনি আল্লাহর তসবীহ পাঠ করতেন, তখন তাঁর সাথে পাথরের পাহাড় তসবীহ পাঠে বিভোল হয়ে যেতো, পক্ষীকুল উড়া বন্ধ করে দিত এবং তসবীহর গুনগুন্ আওয়াজ আরম্ভ করত। أَوِّبِيْ এর অর্থ হল তসবীহ পাঠ কর। অর্থাৎ পাহাড় ও পাখিদেরকে আমি বলেছিলাম, সুতরাং এরাও দাঊদ (আঃ)-এর সাথে তসবীহ পাঠে রত হয়ে যেত। وَالطَّيْرَ শব্দটি يَاجِبَالُ এর স্থানের উপর আত্ব্ফ করা হয়েছে বলে শেষে যবর হয়েছে। কারণ جِبَالُ শব্দটিতে আনুমানিক যবরই আছে। মূলতঃ বাক্য এইভাবে হবে نَادَيْنَا الْجِبَالَ وَالطَّيْرَ (আমি পাহাড় ও পক্ষীদের ডাক দিয়ে বললাম,--)।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[৩] অর্থাৎ লোহাকে আগুন দিয়ে গলানো ও হাতুড়ি দিয়ে পিটানো ছাড়াই তা মোম, সানা আটা এবং ভেজা মাটির মত যেভাবে চাইতেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ইচ্ছামত জিনিস-পত্র তৈরী করতেন।
أَنِ اعْمَلْ سَابِغَاتٍ وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ ۖ وَاعْمَلُوا صَالِحًا ۖ إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
📘 এবং তাকে বলেছিলাম, তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী কর,[১] ওগুলির কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত কর[২] এবং তোমরা সৎকাজ কর। [৩] তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয় আমি তার সম্যক দ্রষ্টা।
[১] سَابِغَاتٍ এর বিশেষ্য ঊহ্য আছে دُرُوْعًا ساَبِغاَتٍ অর্থাৎ পূর্ণ মাপের লম্বা লৌহবর্ম, যা যোদ্ধার পূর্ণ শরীর ঠিকভাবে আবৃত করে এবং তাকে শত্রুর আঘাত থেকে বাঁচাতে পারে।
[২] (কড়াসমূহ যথাযথ সংযুক্ত কর) যাতে ছোট বড় না হয়ে যায়, অথবা টাইট বা ঢিলা না হয়ে যায়। অর্থাৎ কড়াসমূহ সংযুক্ত করতে তার খিলগুলি এমন পাতলা না হয়, যাতে জোড়গুলি নড়াসড়া করতেই থাকে এবং তাতে স্থিরতা না আসে। পরন্তু এমন মোটাও যেন না হয়, যাতে তা ভেঙ্গেই যায় অথবা তা জমে না যায় এবং তা পরাই সম্ভব না হয়। এখানে দাউদ (আঃ)-কে লৌহবর্ম তৈরী করার নিয়ম বলা হয়েছে।
[৩] অর্থাৎ সেই নিয়ামতের বদলে নেক আমল কর, যাতে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয়। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা যাকে পার্থিব নিয়ামত দান করেছেন তাকে সেই নিয়ামত হিসাবে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা দরকার। আর আসল কৃতজ্ঞতা হল, অনুগ্রহকারীকে সন্তুষ্ট করার পূর্ণ চেষ্টা রাখা। অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য করা ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা।
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ ۖ وَأَسَلْنَا لَهُ عَيْنَ الْقِطْرِ ۖ وَمِنَ الْجِنِّ مَنْ يَعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِإِذْنِ رَبِّهِ ۖ وَمَنْ يَزِغْ مِنْهُمْ عَنْ أَمْرِنَا نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ السَّعِيرِ
📘 আমি বাতাসকে সুলাইমানের অধীন করেছিলাম, তার সকালের ভ্রমণ একমাসের পথ ছিল এবং সন্ধ্যার ভ্রমণও এক মাসের পথ ছিল।[১] আমি তার জন্য গলিত তামার এক ঝরনা প্রবাহিত করেছিলাম। [২] আল্লাহর অনুমতিক্রমে কিছু সংখ্যক জ্বিন তার সম্মুখে কাজ করত। ওদের মধ্যে যারা আমার নির্দেশ অমান্য করে তাদেরকে আমি জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তি আস্বাদন করাব। [৩]
[১] অর্থাৎ সুলাইমান (আঃ) সভাসদ ও সৈন্যসহ তক্তায় বসে যেতেন। বাতাস তাঁর আজ্ঞাধীন হয়ে তিনি যেখানে আদেশ করতেন সেখানে তাঁকে এমন গতিতে নিয়ে যেত যে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত এবং অনুরূপ দুপুর থেকে রাত্রি পর্যন্ত এক মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত। এইভাবে এক দিনে দুই মাসের পথ অতিক্রম হয়ে যেত।
[২] অর্থাৎ যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য লোহা নরম করে দেওয়া হয়েছিল, অনুরূপ সুলাইমান (আঃ)-এর জন্য আমি তামার ঝরনা প্রবাহিত করে দিয়েছিলাম যাতে তামা পদার্থ দ্বারা সে অনায়াসে ইচ্ছামত পাত্র ইত্যাদি বানাতে পারে।
[৩] অধিকাংশ তফসীরবিদের মতে এ শাস্তি কিয়ামতের দিন দেওয়া হবে। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, এ শাস্তি হল দুনিয়ার শাস্তি। তাঁরা বলেন, দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর একজন ফিরিশতা নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর হাতে আগুনের চাবুক থাকত। যে জ্বিন সুলাইমান (আঃ)-এর আদেশ অমান্য করত, তাকে ফিরিশতা চাবুক মারতেন; যাতে সে পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِنْ مَحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَاسِيَاتٍ ۚ اعْمَلُوا آلَ دَاوُودَ شُكْرًا ۚ وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ
📘 ওরা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, প্রতিমা, হওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির ওপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত।[১] (আমি বলেছিলাম,) ‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার দাসদের মধ্যে কৃতজ্ঞ অতি অল্পই।’
[১] مَحَارِيْبَ শব্দটি مِحْرَابٌ এর বহুবচন। অর্থ হল উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা, উদ্দেশ্য উঁচু উঁচু অট্টালিকা, বিশাল বিশাল বাসভবন বা মসজিদ ও উপাসনালয়। تَمَاثِيْلَ শব্দটি تِمْثاَلٌ এর বহুবচন। অর্থঃ প্রতিমা, মূর্তি। এ মূর্তি অপ্রাণীর হত। অনেকে বলেন, পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও নেক লোকেদের মূর্তি মসজিদে নির্মাণ করা হত, যাতে তা দেখে মানুষ (আল্লাহর) ইবাদত করে। তবে এ অর্থ ঐ সময় নেওয়া সঠিক হবে, যখন এটা মেনে নেওয়া যাবে যে, সুলাইমান (আঃ)-এর শরীয়তে মূর্তি নির্মাণ বৈধ ছিল। আর এ কথা সঠিক নয়। পক্ষান্তরে ইসলাম মূর্তি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। جِفَانٌ শব্দটি جَفْنَةٌ এর বহুবচন অর্থঃ বিরাট পাত্র, جَواَبٍ শব্দটি جَابِيَةٌ এর বহুবচন ,অর্থঃ হওয, ছোট চৌবাচ্চা, যাতে পানি জমা রাখা হয়। অর্থাৎ চৌবাচ্চার মত বড় বড় পাত্র قُدُوْرٌ ডেগ, رَاسِيَاتٌ অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। বলা হয় যে, এই সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত, যা স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না। যাতে এক সাথে এক হাজার মানুষের খাবার রান্না হত। আর এ সকল কাজ জ্বিনরা করত।
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَىٰ مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ ۖ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ
📘 যখন আমি সুলাইমানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন উই পোকাই জ্বিনদেরকে তার মৃত্যু বিষয় জানাল; যা সুলাইমানের লাঠি খাচ্ছিল। যখন সুলাইমান মাটিতে পড়ে গেল, তখন জ্বিনেরা বুঝতে পারল যে, ওরা যদি অদৃশ্য বিষয় অবগত থাকত, তাহলে ওরা এতকাল লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না। [১]
[১] সুলাইমান (আঃ)-এর সময়ে জ্বিনদের বিষয়ে এই খবর প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, জ্বিনরা গায়বের খবর জানে, আল্লাহ তাআলা সুলাইমান (আঃ)-এর মৃত্যু দ্বারা সেই আকীদার ভ্রষ্টতা পরিষ্কার করে দিলেন।
لَقَدْ كَانَ لِسَبَإٍ فِي مَسْكَنِهِمْ آيَةٌ ۖ جَنَّتَانِ عَنْ يَمِينٍ وَشِمَالٍ ۖ كُلُوا مِنْ رِزْقِ رَبِّكُمْ وَاشْكُرُوا لَهُ ۚ بَلْدَةٌ طَيِّبَةٌ وَرَبٌّ غَفُورٌ
📘 সাবা’বাসীদের জন্য ওদের বাসভূমিতে এক নিদর্শন ছিল;[১] দু’টি বাগানঃ একটি ছিল ডান দিকে, অপরটি ছিল বাম দিকে;[২] ওদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দেওয়া রুযী ভোগ কর[৩] এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।[৪] এ শহর উত্তম[৫] এবং তোমাদের প্রতিপালক ক্ষমাশীল।’ [৬]
[১] سَبَأٍ (সাবা') এক জাতি ছিল, যার রানী সাবা' নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। যিনি সুলাইমান (আঃ)-এর সময় (তাঁরই হাতে) মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন। জাতির নামে দেশের নামও সাবা' ছিল। বর্তমানে সে দেশ ইয়ামান নামে প্রসিদ্ধ। উক্ত দেশ বড় সুখী দেশ ছিল। স্থল ও জলপথের বাণিজ্যের জন্যও উত্তম ছিল এবং চাষ-বাস ও ফল-ফসল ইত্যাদিতেও বড় ভাল ছিল। আর বাণিজ্য ও চাষাবাদ উভয়ের উৎকর্ষই যে কোন দেশ ও জাতির সুখের কারণ হয়। এখানে সেই ধন-দৌলতের আতিশয্যকে আল্লাহর বিশাল ক্ষমতার একটি নিদর্শন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
[২] বলা হয়েছে যে, তাদের শহরের দুই দিকে পর্বত ছিল, সেখান থেকে ঝরনা ও নালা বেয়ে পানি শহরে প্রবেশ করত। তাদের শাসকগণ পর্বতের মাঝে বাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছিল এবং তার সাথে বহু বাগান লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে নির্দিষ্টভাবে পানি যাওয়ার রাস্তা হয়ে গিয়েছিল এবং বাগানে পানি পৌঁছতে সহজ ও সুবিধা হয়ে গিয়েছিল। সেই বাগানগুলিকে ডানে ও বামে দুটি বাগান বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেকে বলেন, جَنَّتَيْنِ এর অর্থ দুটি বাগান নয়; বরং উদ্দেশ্য হল ডান ও বাম পার্শ্ব। আর এ থেকে উদ্দেশ্য এত বাগান যে, যেদিকেই নজর যায় সেদিকেই সবুজ-শ্যামল বাগান আর বাগানই চোখে পড়ে।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[৩] এই আদেশ তাদের পয়গম্বরের দ্বারা করা হয়েছিল অথবা উদ্দেশ্য সেই সকল নিয়ামতের বর্ণনা, যা তাদেরকে প্রদান করা হয়েছিল।
[৪] অর্থাৎ, সেই দাতা ও অনুগ্রহকারীর আনুগত্য কর এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে দূরে থাক।
[৫] অর্থাৎ, বাগানসমূহের আধিক্য ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূলের কারণে উক্ত শহর উৎকৃষ্ট ছিল। বলা হয় যে, সুন্দর আবহাওয়ার কারণে সেই শহর মশা, মাছি ও অনুরূপ অন্যান্য কষ্টদায়ক জীবজন্তু থেকেও মুক্ত ছিল। আর আল্লাহই ভালো জানেন।
[৬] অর্থাৎ, যদি তোমরা প্রতিপালকের কৃতজ্ঞতা বর্ণনা করতে থাক, তবে তিনি তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এর অর্থ এও হল যে, যদি মানুষ তওবা করতে থাকে, তাহলে পাপাচরণ ব্যাপক ধ্বংস ও অনুগ্রহ ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না; বরং আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেবেন।
فَأَعْرَضُوا فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ سَيْلَ الْعَرِمِ وَبَدَّلْنَاهُمْ بِجَنَّتَيْهِمْ جَنَّتَيْنِ ذَوَاتَيْ أُكُلٍ خَمْطٍ وَأَثْلٍ وَشَيْءٍ مِنْ سِدْرٍ قَلِيلٍ
📘 পরে ওরা আদেশ অমান্য করল। ফলে আমি ওদের ওপর বাঁধ-ভাঙ্গা বন্যা প্রবাহিত করলাম এবং ওদের বাগান দু’টিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দু’টি বাগানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ। [১]
[১] অর্থাৎ, তারা পাহাড়ের মাঝে বাঁধ তৈরী করে পানি আটকে রাখার যে ব্যবস্থা করেছিল এবং তা চাষাবাদ ও বাগান সেচ করার কাজে লাগাত, আমি কঠিন বাঁধভাঙ্গা বন্যার দ্বারা সেই বাঁধকে ভেঙ্গে ফেললাম এবং সবুজ ও ফলদার বাগানকে এমন বাগানে পরিবর্তন করে দিলাম যাতে শুধু প্রাকৃতিক ঝাড় জঙ্গল থাকে। যাতে প্রথমতঃ কোন ফল হয় না। আর যদি কোন গাছে হয়, তবে তা তেতো, কষা ও এমন বদমজাদার যা কেউ খেতেই পারবে না। তবে কিছু কুল (বা বরই) গাছ ছিল তাতেও অধিক কাঁটা, আর কুল সামান্যই ছিল। عَرِمٌ -عَرِمَةٌ -এর বহুবচন অর্থ বাঁধ। অর্থাৎ, এমন জোরে পানির স্রোত পাঠালাম যা সেই বাঁধ ভেঙ্গে ফেলল এবং পানি শহরেও প্রবেশ করে গেল। যাতে তাদের ঘর-বাড়ী ডুবে গেল এবং গাছপালা উজাড় করে পতিত জমিতে পরিণত করে দিল। উক্ত বাঁধ সাদ্দু মা'রিব নামে প্রসিদ্ধ।
ذَٰلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِمَا كَفَرُوا ۖ وَهَلْ نُجَازِي إِلَّا الْكَفُورَ
📘 আমি ওদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম ওদের সত্য অকৃতজ্ঞতা (বা অস্বীকারের) জন্য। আর আমি অকৃতজ্ঞ (বা অস্বীকারকারী)কেই শাস্তি দিয়ে থাকি।
وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ الْقُرَى الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا قُرًى ظَاهِرَةً وَقَدَّرْنَا فِيهَا السَّيْرَ ۖ سِيرُوا فِيهَا لَيَالِيَ وَأَيَّامًا آمِنِينَ
📘 ওদের এবং যে সব জনপদে আমি প্রাচুর্য দান করেছিলাম[১] সেগুলির অন্তর্বর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম[২] এবং ঐ সকল জনপদে ভ্রমণকালে বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট ব্যবধানে বিশ্রামস্থান নির্ধারিত করেছিলাম এবং ওদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা এ সব জনপদে রাত-দিন নিরাপদে ভ্রমণ কর।’ [৩]
[১] 'যে সব জনপদে আমি প্রাচুর্য দান করেছিলাম' বলে বরকতময় শাম দেশের জনপদকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আমি সাবা' (ইয়ামান) ও শামের মাঝে পথের ধারে ধারে বহু জনবসতি আবাদ করে রেখেছিলাম। অনেকে ظاهرة শব্দটির অর্থ মিলিত করেছেন। অর্থাৎ, এক অপরের সাথে মিলিত ও সংযুক্ত। তাফসীরবিদগণ সেই জনবসতির সংখ্যা চার হাজার সাত শত বলেছেন। এটাই তাদের ব্যবসার প্রধান রাস্তা ছিল, যার সংলগ্নে সাবা' থেকে শাম পর্যন্ত কাছাকাছি জনবসতি প্রতিষ্ঠিত ছিল। যার ফলে প্রথমতঃ তাদের পানাহার ও আরাম করার জন্য পাথেয় সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন হত না। দ্বিতীয়তঃ জনশূন্য হওয়ার ফলে পথে যে চুরি-ডাকাতি, লুট-মার ইত্যাদির আশঙ্কা থাকার কথা, তা ছিল না।
[২] অর্থাৎ, এক জনবসতি থেকে অপর জনবসতি নির্দিষ্ট ও পরিচিত দূরত্বে অবস্থিত ছিল এবং সেই হিসাবে তারা অতি সহজে নিজেদের সফর অতিক্রম করত। যেমন সকালে সফর আরম্ভ করলে ঠিক দুপুর পর্যন্ত কোন গ্রাম বা জনবসতি পর্যন্ত পৌঁছে যেত। সেখানে খাবারের প্রয়োজন মিটিয়ে দুপুরের আরাম করত এবং পুনরায় সফর আরম্ভ করলে রাত্রি পর্যন্ত অন্য কোন জনপদে পৌঁছে যেত।
[৩] এটা সকল প্রকার ভীতি থেকে সুরক্ষা ও পাথেয়-সামগ্রী বহন করার ব্যাপারে অমুখাপেক্ষিতার বর্ণনা যে, রাত বা দিনের যে কোন সময়ে তোমরা সফর করতে চাও কর, না জান-মালের কোন ভয়, আর না সফরের জন্য সাথে কোন সামগ্রী নেওয়ার প্রয়োজন।
فَقَالُوا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَجَعَلْنَاهُمْ أَحَادِيثَ وَمَزَّقْنَاهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ
📘 কিন্তু ওরা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের সফরের বিশ্রামস্থান দূরে দূরে স্থাপন কর।’[১] এভাবে ওরা নিজেদের প্রতি যুলম করেছিল। ফলে আমি ওদেরকে কাহিনীর বিষয়বস্তুতে পরিণত করলাম[২] এবং ওদেরকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।[৩] নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।
[১] অর্থাৎ, (ভ্রমণে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি বা বিপদ না এলে তাতে কোন মজা নেই --এই কথা স্মরণ করে তারা নিজেরাই প্রার্থনা করল যে,) যেমন মানুষ সফরের কষ্ট, সমস্যা এবং বিভিন্ন মৌসুমের নানা অসুবিধা ইত্যাদির বর্ণনা করে, অনুরূপ আমাদের জন্য ভ্রমণের দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যেন কাছাকাছি জনবসতি না হয়ে মাঝখানে জঙ্গল ও জনহীন প্রান্তর ও মরুভূমি বেয়ে আমাদেরকে পার হতে হয়, গ্রীষ্মের সময় রৌদ্রের কষ্ট এবং শীতের সময় বরফের ন্যায় ঠান্ডা হাওয়া আমাদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলে এবং পথে ক্ষুৎ-পিপাসা ও মৌসুমের কঠিনতা থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে পাথেয়-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সাথে রাখতে হয়। তাদের এই দু'আ বানী-ইস্রাঈলের অনুরূপ ছিল, যারা কোন কষ্ট ও শ্রম ছাড়াই মান্ন্ ও সালওয়া (ইলাহী খানা) এবং আরো অন্যান্য সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু তারা সে সবের পরিবর্তে ডাল ও সবজি তরকারি ইত্যাদি পাওয়ার জন্য দু'আ করেছিল! তাদের এই দু'আ মৌখিক ছিল অথবা তাদের অবস্থা এ কথা বলেছিল।
[২] অর্থাৎ, তাদেরকে (সাবা'বাসীকে) এমনভাবে সর্বস্বান্ত করলাম যে, দুনিয়াতে তাদের বাগান ধ্বংসের কাহিনী প্রসিদ্ধ রয়ে গেল এবং মজলিস ও মহফিলের বক্তব্যের বিষয়রূপে পরিগণিত হল।
[৩] অর্থাৎ, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিলাম ও বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে দিলাম। সুতরাং সাবাবাসীর প্রসিদ্ধ গোত্রগুলি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে লাগল, কেউ মদীনা কেউ মক্কা কেউ শাম এলাকায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا ۚ وَهُوَ الرَّحِيمُ الْغَفُورُ
📘 তিনি জানেন যা ভূগর্ভে প্রবেশ করে,[১] যা তা থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ হতে অবতরণ করে[২] ও যা কিছু আকাশে উত্থিত হয়। [৩] তিনিই পরম দয়ালু, চরম ক্ষমাশীল।
[১] যেমন বৃষ্টি, প্রোথিত গুপ্তধন এবং খনিজ-সম্পদ ইত্যাদি।
[২] বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, মেঘগর্জন, বিদ্যুত ও আল্লাহর বরকত, ফিরিশতা এবং আসমানী কিতাব ইত্যাদি।
[৩] অর্থাৎ, ফিরিশতা এবং বান্দাদের আমল।
وَلَقَدْ صَدَّقَ عَلَيْهِمْ إِبْلِيسُ ظَنَّهُ فَاتَّبَعُوهُ إِلَّا فَرِيقًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
📘 তাদের উপর ইবলীস তার অনুমান সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল, ফলে ওদের মধ্যে একটি বিশ্বাসী দল ছাড়া সকলেই তার অনুসরণ করল;
وَمَا كَانَ لَهُ عَلَيْهِمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يُؤْمِنُ بِالْآخِرَةِ مِمَّنْ هُوَ مِنْهَا فِي شَكٍّ ۗ وَرَبُّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ
📘 ওদের ওপর শয়তানের কোন আধিপত্য ছিল না। কারা পরকালে বিশ্বাসী এবং কারা ওতে সন্দিহান তা জানাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আর তোমার প্রতিপালক সর্ববিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক।
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ ۖ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ
📘 বল, ‘তোমরা তাদেরকে আহবান কর, আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা (যাদেরকে উপাস্য) মনে কর।[১] ওরা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয়[২] এবং এতে ওদের কোন অংশও নেই[৩] এবং ওদের কেউ আল্লাহর কাজে সাহায্যকারীও নয়।’ [৪]
[১] অর্থাৎ, যাদেরকে উপাস্য ধারণা কর। এখানে زَعَمْتُمْ শব্দটির দুটি مفعول (কর্মকারক) ঊহ্য আছে । অর্থাৎ, زَعَمْتُمُوْهُمْ آلِهَةً
[২] অর্থাৎ, তাদের না কোন ভাল-মন্দের এখতিয়ার আছে, না তারা কারোর উপকার করার ক্ষমতা রাখে, আর না কোন ক্ষতি থেকে রক্ষার। এখানে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর উল্লেখ ব্যাপকতা প্রকাশের জন্য করা হয়েছে, কারণ উভয়ই সকল বাহ্যিক বস্তুর অবস্থানক্ষেত্র।
[৩] না সৃষ্টি করায়, না মালিকানায় এবং না নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায়।
[৪] যারা কোন ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য করে থাকে। বরং আল্লাহ তাআলা কোন অংশীদার ছাড়াই সকল এখতিয়ারের একমাত্র মালিক এবং কারোর সাহায্য ছাড়াই তিনি সকল কর্ম নিজেই করে থাকেন।
وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ ۚ حَتَّىٰ إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ ۖ قَالُوا الْحَقَّ ۖ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ
📘 যাকে অনুমতি দেওয়া হবে সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।[১] এমনকি যখন ওদের অন্তর হতে ভয় বিদূরিত হয়, তখন ওরা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ‘তোমাদের প্রতিপালক কি হুকুম করেছেন?’ উত্তরে তারা বলে, ‘যা সত্য তিনি তাই বলেছেন।[২] তিনি সুউচ্চ, সুমহান।’
[১] "যাকে অনুমতি দেওয়া হবে"-এর উদ্দেশ্য হল নবী, ফিরিশতাগণ ইত্যাদি। অর্থাৎ এঁরাই সুপারিশ করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়। কারণ অন্য কারোর সুপারিশ না তো উপকারে আসবে, আর না তাদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, সুপারিশের হকদারগণ অর্থাৎ, আম্বিয়া, ফিরিশতা এবং নেক বান্দাগণ ঐ সকল মানুষের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন যারা সুপারিশ পাওয়ার প্রকৃত হকদার। কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরই সুপারিশের জন্য অনুমতি হবে, অন্য কারোর জন্য নয়।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
উদ্দেশ্য হল যে, আম্বিয়া, ফিরিশতা এবং নেক বান্দাগণ ছাড়া সেখানে অন্য কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। আর এঁরাও আবার কেবল গোনাহগার মু'মিনদের জন্যই সুপারিশ করতে পারবেন; কোন কাফের, মুশরিক এবং আল্লাহর বিরোধীদের জন্য নয়। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় উক্ত দুই বিষয়ের পরিষ্কার বর্ণনা এসেছে। যেমনঃ "কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?"
(সূরা বাক্বারাহ ২:২৫৫ আয়াত)
এবং তারা সুপারিশ করে কেবল তাদের জন্য, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।"
(সূরা আম্বিয়া ২১:২৮ আয়াত)
[২] এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইবনে জারীর ও ইবনে কাসীর (রহঃ) হাদীসের আলোকে এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা যখন কোন বিষয়ে অহী করেন, তখন আকাশে অবস্থিত ফিরিশতাগণ ভয়ে কম্পিত ও জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। জ্ঞান ফিরে পেলে তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। অতঃপর আরশ বহনকারী ফিরিশতাগণ অন্য ফিরিশতাগণকে এবং তাঁরা তাঁদের নিমেনর ফিরিশতাগণকে খবর করেন। আর এইভাবে প্রথম আসমানের ফিরিশতাদের নিকট সেই খবর পৌঁছে যায়।
(ইবনে কাসীর)
فُزِّعَ (এর মূল ধাতু হল فَزَعٌ অর্থাৎ ভয় বা আতঙ্ক। باب تفعيل এ এসে নিরাকরণের অর্থ হয়েছে। অর্থাৎ, যখন আতঙ্ক দূরীভূত করে দেওয়া হয়।
۞ قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ قُلِ اللَّهُ ۖ وَإِنَّا أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلَىٰ هُدًى أَوْ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
📘 বল, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী হতে কে তোমাদের জীবিকা সরবরাহ করে?’ বল, ‘আল্লাহ। নিশ্চয় আমরা অথবা তোমরা সৎপথে অথবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছি।’ [১]
[১] পরিষ্কার কথা যে, বিভ্রান্তিতে সেই আছে, যে সেই সকল সৃষ্টিকে উপাস্য মনে করে, যাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে আহার দানের ব্যাপারে কোন অংশই নেই; না তারা বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারে, আর না তারা কিছু উৎপন্ন করতে সক্ষম। অতএব নিঃসন্দেহে কেবল তাওহীদবাদীরাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে, দুই দলই নয়।
قُلْ لَا تُسْأَلُونَ عَمَّا أَجْرَمْنَا وَلَا نُسْأَلُ عَمَّا تَعْمَلُونَ
📘 বল, ‘আমাদের অপরাধের জন্য তোমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না এবং তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে না।’
قُلْ يَجْمَعُ بَيْنَنَا رَبُّنَا ثُمَّ يَفْتَحُ بَيْنَنَا بِالْحَقِّ وَهُوَ الْفَتَّاحُ الْعَلِيمُ
📘 বল, ‘আমাদের প্রতিপালক আমাদের সকলকে একত্রিত করবেন, অতঃপর তিনি আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফায়সালা করে দেবেন,[১] তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়সালাকারী, সর্বজ্ঞ।’
[১] অর্থাৎ, আমল মত বদলা প্রদান করবেন; সৎলোকদেরকে জান্নাত এবং অসৎ লোকদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।
قُلْ أَرُونِيَ الَّذِينَ أَلْحَقْتُمْ بِهِ شُرَكَاءَ ۖ كَلَّا ۚ بَلْ هُوَ اللَّهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
📘 বল, ‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর অংশী স্থির করেছ, তাদেরকে আমাকে দেখাও।’ কক্ষনো না,[১] বরং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[১] অর্থাৎ, না তাঁর কেউ সমতুল আছে আর না সমকক্ষ, বরং তিনি সকল বস্তুর উপর পরাক্রমশালী এবং তাঁর সকল কর্ম ও কথা যুক্তি ও হিকমতে পরিপূর্ণ ।
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
📘 আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। [১]
[১] এই আয়াতে প্রথমতঃ আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ)-এর বিশ্বজনীন রসূল হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন যে, তাঁকে সকল মানুষের হিদায়াতকারী ও পথপ্রদর্শকরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এই যে, নবী (সাঃ)-এর কামনা ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অনেকেই ঈমান থেকে বঞ্চিত থাকবে। অন্য স্থানেও উক্ত দুই বিষয়ের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন। যেমন, নবী (সাঃ)-এর সর্বজনীন রসূল হওয়ার ব্যাপারে বলেছেন, (قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا ) অর্থাৎ, বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর (প্রেরিত) রসূল।
(সূরা আ'রাফ ৭:১৫৮ আয়াত)
(تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا) অর্থাৎ, কত প্রাচুর্যময় তিনি যিনি তাঁর দাসের প্রতি ফুরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে।
(সূরা ফুরকান ২৫:১ আয়াত)
এক হাদীসে নবী (সাঃ) বলেছেন, "আমাকে এমন পাঁচটি বস্তু প্রদান করা হয়েছে যা আমার পূর্বে কোন নবীকে প্রদান করা হয়নি। এক মাসের পথ চলার মত দূরত্বেও আমার ভীতি দুশমনদের মনে ঢুকিয়ে দিয়ে আমার সাহায্য করা হয়েছে। আমার জন্য সারা পৃথিবীকে মসজিদ ও পবিত্র করে দেওয়া হয়েছে; অতএব আমার উম্মত যেখানেই থাকুক নামাযের সময় হয়ে গেলে সেখানেই সে যেন নামায পড়ে নেয়। আমার জন্য (যুদ্ধলব্ধ) গনীমতের সম্পদ বৈধ করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে অন্য কারোর জন্য বৈধ ছিল না। আমাকে কিয়ামতের দিন সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর অন্য সকল নবীকে নির্দিষ্ট গোত্রের নিকট পাঠানো হয়েছিল, আর আমাকে সকল মানুষের জন্য নবী করে পাঠানো হয়েছে।"
(বুখারীঃ কিতাবুত তায়াম্মুম, মুসলিমঃ কিতাবুল মাসাজিদ)
অন্য এক হাদীসে বলেছেন, আমি লাল ও কালো সকলের জন্য প্রেরিত হয়েছি।
(মুসলিমঃ কিতাবুল মাসাজিদ)
লাল ও কালো থেকে অনেকে জ্বিন ও মানুষ উদ্দেশ্য নিয়েছেন, আবার অনেকে আরবী ও অনারবী উদ্দেশ্য নিয়েছেন। ইমাম ইবনে কাসীর বলেন, উভয় অর্থই সঠিক। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার কথাও বর্ণনা করেছেন। (وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ) অর্থাৎ, তুমি যতই আগ্রহী হও না কেন, অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করবার নয়।
(সূরা ইউসুফ ১২:১০৩ আয়াত)
(وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ) অর্থাৎ, যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করে দেবে।
(সূরা আনআম ৬:১১৬ আয়াত)
মোটকথা বিপথগামীদের সংখ্যাই বেশি।
وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هَٰذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
📘 তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে বল, এ প্রতিশ্রুতি কখন বাস্তবায়িত হবে?’ [১]
[১] তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ স্বরূপ জিজ্ঞাসা করত, কারণ তা বাস্তবায়িত হওয়া তাদের নিকট সুদূরপরাহত ও অসম্ভব ছিল।
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَأْتِينَا السَّاعَةُ ۖ قُلْ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَالِمِ الْغَيْبِ ۖ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِنْ ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
📘 অবিশ্বাসীরা বলে, ‘আমরা কিয়ামতের সম্মুখীন হব না।’ বল, ‘অবশ্যই তোমাদেরকে তার সম্মুখীন হতেই হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ; যিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।[১] আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছু কিংবা তার থেকে ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু তাঁর অগোচর নয়; [২] ওর প্রত্যেকটি সুস্পষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ। [৩]
[১] উক্ত বাক্যে মহান আল্লাহ শপথও করেছেন এবং তাকীদের শব্দও ব্যবহার করেছেন এবং তার উপর তাকীদের 'লাম' ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ কিয়ামত কেন সংঘটিত হবে না? তা যে কোন অবস্থায় অবশ্য-অবশ্যই সংঘটিত হবে।
[২] لاَيَعْزُبُ অদৃশ্য, গুপ্ত ও দূর নয়। অর্থাৎ, যখন আকাশ ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ কিছু তাঁর দৃষ্টিতে অদৃশ্য ও অগোচর নয়, তখন তোমাদের শরীরের বিক্ষিপ্ত অংশ যা মাটিতে মিশে গেছে তা একত্রিত করে পুনরায় তোমাদেরকে জীবিত করা কেন সম্ভব হবে না?
[৩] অর্থাৎ, তা লাওহে মাহ্ফূযে সংরক্ষিত ও লিপিবদ্ধ আছে।
قُلْ لَكُمْ مِيعَادُ يَوْمٍ لَا تَسْتَأْخِرُونَ عَنْهُ سَاعَةً وَلَا تَسْتَقْدِمُونَ
📘 বল, ‘তোমাদের জন্য এক নির্ধারিত দিবস রয়েছে; যা তোমরা মুহূর্তকাল বিলম্বিত করতে পারবে না, ত্বরান্বিতও করতে পারবে না।’ [১]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের একটি দিন নির্ধারিত করে রেখেছেন; যা একমাত্র তিনিই অবগত। যখন সেই নির্ধারিত সময় এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তকালও আগে-পিছে হবে না। ( (إِنَّ أَجَلَ اللَّهِ إِذَا جَاءَ لا يُؤَخَّرُ অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কাল উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত হয় না।
(সূরা নূহ ৭১:৪ আয়াত)
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ نُؤْمِنَ بِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَلَا بِالَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ ۗ وَلَوْ تَرَىٰ إِذِ الظَّالِمُونَ مَوْقُوفُونَ عِنْدَ رَبِّهِمْ يَرْجِعُ بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ الْقَوْلَ يَقُولُ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لَوْلَا أَنْتُمْ لَكُنَّا مُؤْمِنِينَ
📘 অবিশ্বাসীরা বলে, ‘আমরা এ কুরআনে কখনও বিশ্বাস করব না, এর পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহেও নয়।’[১] আর তুমি যদি দেখতে, যখন সীমালংঘনকারীদেরকে তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান করা হবে, তখন ওরা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে,[২] যারা দুর্বল (অনুসারী) ছিল তারা দাম্ভিক (অনুসৃত)দেরকে বলবে,[৩] ‘তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই বিশ্বাসী হতাম।’[৪]
[১] যেমন তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জীল ইত্যাদি। অনেকে 'بَيْنَ يَدَيْهِ -এর অর্থ আখেরাত নিয়েছেন। এতে কাফেরদের শত্রুতা ও ঔদ্ধত্যের বর্ণনা রয়েছে যে, তারা সর্বপ্রকার প্রমাণ পাওয়ার পরেও কুরআন কারীম ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে অস্বীকার করে।
[২] অর্থাৎ, তারা পৃথিবীতে কুফর ও শিরক করাতে একে অপরের সাহচর্য ও আত্মীয়তার বন্ধনের ফলে আপোসে সম্প্রীতি রাখত। কিন্তু আখেরাতে এরা একে অপরের শত্রু হবে এবং একে অপরকে দোষারোপ করবে।
[৩] অর্থাৎ, পৃথিবীতে ওরা ঐ সকল মানুষ, যারা চিন্তা-ভাবনা না করে অবুঝের মত দশের কথা অনুযায়ী চলা ফেরা করে। ওরা এ কথা ওদের সেই নেতাদেরকে বলবে, পৃথিবীতে ওরা যাদের অনুসরণ করে চলত।
[৪] অর্থাৎ, তোমরাই আমাদেরকে পয়গম্বর ও সত্যের আহবায়কদের অনুসরণ করা থেকে বিরত রেখেছিলে। যদি তোমরা বিরত না রাখতে, তাহলে আমরা অবশ্যই মু'মিন হতাম।
قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا أَنَحْنُ صَدَدْنَاكُمْ عَنِ الْهُدَىٰ بَعْدَ إِذْ جَاءَكُمْ ۖ بَلْ كُنْتُمْ مُجْرِمِينَ
📘 যারা দাম্ভিক (অনুসৃত) ছিল, তারা দুর্বল (অনুসারী)দেরকে বলবে, ‘আমরা কি তোমাদের কাছে সৎপথের উপদেশ আসার পর তা গ্রহণ করতে তোমাদেরকে বাধা দিয়েছিলাম? বরং তোমরাই তো অপরাধী ছিলে।’ [১]
[১] অর্থাৎ, আমাদের নিকট এমন কি ক্ষমতা ছিল যে, আমরা তোমাদেরকে হিদায়াতের পথ থেকে বিরত রাখতাম। তোমরা নিজেরাই তার উপর চিন্তা-ভাবনা করনি বরং নিজেদের প্রবৃত্তি-পূজার কারণে তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছ এবং এখন আমাদেরকে দোষী বানাচ্ছ? অথচ সব কিছু নিজেরাই নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী করেছ। অতএব অপরাধী তোমরা নিজেরাই; আমরা নই।
وَقَالَ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُونَنَا أَنْ نَكْفُرَ بِاللَّهِ وَنَجْعَلَ لَهُ أَنْدَادًا ۚ وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَجَعَلْنَا الْأَغْلَالَ فِي أَعْنَاقِ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
📘 আর যারা দুর্বল (অনুসারী) ছিল, তারা দাম্ভিক (অনুসৃত)দেরকে বলবে, ‘প্রকৃতপক্ষে তোমরাই তো দিন-রাত আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহকে অমান্য করি এবং তাঁর অংশী স্থাপন করি।’ [১] যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন মনে মনে অনুতপ্ত হবে।[২] আমি অবিশ্বাসীদের গলদেশে বেড়ি পরাব।[৩] ওরা যা করত তারই প্রতিফল ওদেরকে দেওয়া হবে। [৪]
[১] অর্থাৎ, আমরা অপরাধী তখনই হতাম, যখন আপন ইচ্ছায় পয়গম্বরদেরকে মিথ্যা মনে করতাম। কিন্তু ঘটনা হল যে, তোমরাই দিবা-রাত্রি আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার এবং আল্লাহর সাথে কুফুরী ও তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত তোমাদের অনুসরণ করে আমরা ঈমান থেকে বঞ্চিত থেকেছি।[২] অর্থাৎ, এক অপরকে দোষারোপ তো করবে, কিন্তু উভয় দলই মনে মনে নিজেদের কুফরীর কারণে লজ্জিত হবে। কিন্তু শত্রুর আনন্দ থেকে বাঁচার জন্য তা প্রকাশ করবে না।[৩] অর্থাৎ, এমন বেড়ি যার দ্বারা তাদের হাতকে গলার সাথে বেঁধে দেওয়া হবে।[৪] অর্থাৎ, দুই দলই তাদের নিজ নিজ কর্মের প্রতিফল পাবে। নেতারা তাদের কর্ম অনুসারে এবং তাদের অনুসারীরা নিজেদের কর্ম অনুসারে শাস্তি পাবে। যেমন অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, (لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لا تَعْلَمُونَ) অর্থাৎ, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না।
(সূরা আ'রাফ ৭:৩৮ আয়াত)
وَمَا أَرْسَلْنَا فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ
📘 যখনই আমি কোন জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি সেখানকার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলেছে, ‘তুমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।’ [১]
[১] এখানে নবী করীম (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে যে, মক্কার নেতারা তোমার উপর ঈমান আনছে না এবং তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে, এটা এমন কোন নতুন কাজ নয়। প্রত্যেক যুগেই অধিকাংশ ধনী শ্রেণীর মানুষেরা পয়গম্বরদেরকে মিথ্যা মনে করেছে। আর প্রত্যেক পয়গম্বরের প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকত গরীব ও দুর্বল শ্রেণীর লোকেরাই। যেমন নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় তাদের পয়গম্বরকে বলেছিল, (قَالُوا أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الأَرْذَلُونَ) অর্থাৎ, আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব, অথচ নিচু শ্রেণীর লোকেরা তোমার অনুসরণ করেছে?
(শুআরা ২৬:১১১ আয়াত)
(وَمَا نَرَاكَ اتَّبَعَكَ إِلَّا الَّذِينَ هُمْ أَرَاذِلُنَا بَادِيَ الرَّأْيِ) অর্থাৎ, আমরা দেখছি যে, শুধু ঐ লোকেরাই না বুঝে তোমার অনুসরণ করছে, যারা আমাদের মধ্যে নিতান্তই হীন।
(হূদ ১১:২৭ আয়াত)
অন্য পয়গম্বরদেরকেও তাঁদের সম্প্রদায়রা এই কথাই বলেছিল। দেখুনঃ সূরা আ'রাফ ৭:৭৫ আয়াত, সূরা আনআম ৬:৫৩, ৬:১৩৩ আয়াত, সূরা বানী ইস্রাঈল ১৭:১৬ আয়াত ইত্যাদি। مُتْرَفُوْنَ এর অর্থ হল বিত্তশালী ও সর্দার।
وَقَالُوا نَحْنُ أَكْثَرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ
📘 ওরা আরও বলত, ‘আমাদের ধন-জন সবার চেয়ে বেশী; সুতরাং আমাদেরকে কিছুতেই শাস্তি দেওয়া হবে না।’ [১]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা যখন আমাদেরকে পৃথিবীতে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির আতিশয্য প্রদান করেছেন, তখন কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের শাস্তি হবে না। তারা ঠিক যেন কিয়ামতের দিনকেও দুনিয়ার সাথে তুলনা করেছে যে, যেমন পৃথিবীতে কাফের ও মু'মিন সকলকে আল্লাহর নিয়ামত প্রদান করা হচ্ছে, অনুরূপ আখেরাতেও প্রদান করা হবে। অথচ আখেরাত হচ্ছে ফলাফল ক্ষেত্র, সেখানে পৃথিবীতে কৃত নিজ নিজ কর্মের ফল পাওয়া যাবে; ভাল কর্মের ভাল ফল এবং মন্দ কর্মের মন্দ ফল। আর পৃথিবী হচ্ছে পরীক্ষালয়। এখানে আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা স্বরূপ সকলকে পার্থিব-সম্পদ প্রদান করেন। অথবা তারা পার্থিব ধন-সম্পদের আতিশয্যকে আল্লাহর সন্তষ্টির বহিঃপ্রকাশ ধরে নিয়েছে; অথচ এই রকম নয়। যদি তাই হত তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে সর্বাধিক ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি প্রদান করতেন।
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
📘 তুমি বল, ‘আমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছা তার রুযী বর্ধিত করেন অথবা তা সীমিত করেন;[১] কিন্তু অধিকাংশ লোক এ বোঝে না।’
[১] এই আয়াতে কাফেরদের উক্ত ভুল ধারণা ও সন্দেহ দূর করা হচ্ছে যে, রুযীর প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং তার সম্পর্ক আল্লাহর ইচ্ছা ও হিকমতের সাথে। এই জন্য তিনি সম্পদ যাকে পছন্দ করেন তাকেও দেন এবং যাকে অপছন্দ করেন তাকেও দেন। তিনি যাকে চান ধনী করেন এবং যাকে চান গরীব করেন।
وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِي تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفَىٰ إِلَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفَاتِ آمِنُونَ
📘 তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আমার নৈকট্য লাভের সহায়ক হবে না। [১] তবে (নৈকট্য লাভ করবে) তারাই যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে[২] এবং তারা তাদের কাজের জন্য পাবে বহুগুণ পুরস্কার। [৩] আর তারা প্রাসাদসমূহে নিরাপদে বসবাস করবে।
[১] অর্থাৎ, এই ধন-সম্পদ এই কথার প্রমাণ নয় যে, তোমাদের সাথে আমার ভালবাসা আছে এবং আমার নিকট তোমাদের বিশেষ মর্যাদা আছে।
[২] অর্থাৎ, আমার ভালবাসা ও নৈকট্য লাভ করার পন্থাই হচ্ছে ঈমান ও নেক আমল। যেমন হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন "আল্লাহ তাআলা তোমাদের আকার-আকৃতি ও ধন-সম্পদ দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখে থাকেন।"
(মুসলিমঃ কিতাবুল বির্র)
[৩] মহান আল্লাহ একটি নেকীর বদলা কমপক্ষে দশ গুণ এবং ঊর্ধ্বপক্ষে সাতশ' গুণ; বরং তার চেয়েও অধিক গুণ বর্ধিত করে থাকেন।
وَالَّذِينَ يَسْعَوْنَ فِي آيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَٰئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ
📘 যারা আমার বাক্যকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা করবে তাদেরকে শাস্তিতে (চিরকাল) উপস্থিত রাখা হবে।
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَيَقْدِرُ لَهُ ۚ وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُهُ ۖ وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
📘 বল, ‘আমার প্রতিপালক তাঁর দাসদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার জীবিকা বর্ধিত করেন অথবা সীমিত করেন।[১] তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তিনি তার বিনিময় দেবেন। [২] আর তিনিই শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা।’ [৩]
[১] অতএব তিনি কখনো কাফেরকেও অনেক ধন দেন, কিন্তু কি জন্য? তাকে ঢিল দেওয়ার জন্য এবং কখনো মু'মিনকে অভাবগ্রস্ত রাখেন কি জন্য? তার নেকী বৃদ্ধি করার জন্য। সুতরাং ধন-সম্পদের কম ও বেশি হওয়া তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কারণ বা প্রমাণ নয়। তাকীদের জন্য এ কথার পুনরুক্তি করা হয়েছে।[২] إِخْلاَفٌ -এর অর্থ হল 'বিনিময় বা প্রতিদান দেওয়া। এই বিনিময় ইহকালেও সম্ভব। আর পরকালে তো সুনিশ্চিত। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, "তুমি খরচ কর, আমি তোমার উপর খরচ করব।" (অর্থাৎ তোমার খরচের বিনিময় দেব।)
(বুখারীঃ তাফসীর সূরা হূদ)
দুইজন ফিরিশতা প্রত্যহ ঘোষণা করেন, তাঁদের একজন বলেন, "হে আল্লাহ! (তোমার রাস্তায়) যারা খরচ করে না তাদের সম্পদ নষ্ট করে দাও।" আর দ্বিতীয় ফিরিশতা বলেন, "হে আল্লাহ! (তোমার রাস্তায়) খরচকারীদেরকে বিনিময় দাও।"
(বুখারীঃ যাকাত অধ্যায়)
[৩] কারণ, যদি কোন ব্যক্তি কাউকে কিছু দেয়, তবে তার এই দেওয়াটা হয় আল্লাহ তাআলার তাওফীক, প্রয়াস ও সুমতিদান এবং তার লিখিত ভাগ্যের ফল। প্রকৃতপক্ষে দানকারী কারো রুযীদাতা নয়। যেমন পিতাকে সন্তানদের বা বাদশাহকে তাঁর সৈন্যদের দায়িত্বশীল বা মালিক বলা হয়। আসলে রাজা-প্রজা ছোট-বড় সকলের রুযীদাতা প্রকৃতপক্ষে সেই আল্লাহ তাআলাই, যিনি সকলের সৃষ্টিকর্তা। অতএব যে ব্যক্তি তার ধন থেকে কাউকে কিছু দান করে, সে আসলে ঐ ধন খরচ করে, যা তাকে আল্লাহ তাআলাই প্রদান করেছেন। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে রুযীদাতা আল্লাহই হলেন। তারপরেও তাঁর অতিরিক্ত অনুগ্রহ এই যে, তাঁর দেওয়া ধন তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী খরচ করলে তিনি তার বিনিময় ও নেকীও প্রদান করেন।
لِيَجْزِيَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ۚ أُولَٰئِكَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
📘 এ এজন্য যে, যারা বিশ্বাসী ও সৎকর্মপরায়ণ তিনি তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।[১] এদেরই জন্য ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা রয়েছে।’
[১] এটা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কারণ। অর্থাৎ, কিয়ামত এই জন্য সংঘটিত হবে এবং সকল মানুষকে আল্লাহ তাআলা এই জন্য পুনর্জীবিত করবেন, যাতে তিনি নেককার ব্যক্তিদেরকে তাঁদের নেকীর বদলা দেন। কারণ প্রতিদান দেওয়ার জন্যই তিনি উক্ত দিবস নির্ধারিত রেখেছেন। প্রতিদান দিবস না হওয়ার অর্থই হচ্ছে নেককার ও বদকার সকলেই সমান। আর এই রকম হওয়া অবশ্যই ন্যায় ও ইনসাফের পরিপন্থী। তাতে বান্দাদের -- বিশেষ করে নেক বান্দাদের -- প্রতি যুলুম করা হবে। অথচ আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি কোন প্রকার যুলুম করেন না।
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلَائِكَةِ أَهَٰؤُلَاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ
📘 যেদিন তিনি এদের সকলকে একত্রিত করবেন এবং ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এরা কি তোমাদেরই পূজা করত?’ [১]
[১] মুশরিকদেরকে লাঞ্ছিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাদেরকে এ কথা জিজ্ঞাসা করবেন। যেমন ঈসা (আঃ) সম্পর্কেও উল্লেখ হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকেও জিজ্ঞাসা করবেন, "হে মারয়্যাম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর?" ঈসা (আঃ) বলবেন, 'তুমিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই, তা বলা আমার জন্য আদৌ শোভনীয় নয়।'
(সূরা মাইদাহ ৫:১১৬ আয়াত)
অনুরূপ আল্লাহ তাআলা বাতিল উপাস্যগণকেও জিজ্ঞাসা করবেন, যেমন সূরা ফুরক্বানের ২৫:১৭ নং আয়াতে বর্ণনা হয়েছে যে, "তোমরাই কি আমার বান্দাগণকে বিভ্রান্ত করেছিলে, না ওরা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছিল?"
قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيُّنَا مِنْ دُونِهِمْ ۖ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجِنَّ ۖ أَكْثَرُهُمْ بِهِمْ مُؤْمِنُونَ
📘 ফিরিশতারা বলবে, ‘তুমি পবিত্র মহান! আমাদের সম্পর্ক তোমারই সাথে; ওদের সাথে নয়।[১] বরং ওরা তো পূজা করত জ্বিনদের[২] এবং ওদের অধিকাংশই ছিল তাদেরই প্রতি বিশ্বাসী।’
[১] অর্থাৎ, ফিরিশতাগণও ঈসা (আঃ)-এর মত আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে এ ব্যাপারে সম্পর্কহীনতার কথা প্রকাশ করবেন এবং বলবেন যে, আমরা তো তোমার বান্দা এবং তুমি আমাদের অভিভাবক, ওদের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?
[২] জ্বিন বলতে শয়তানকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এরা আসলে শয়তানের পূজারী কারণ সেই তাদেরকে মূর্তিপূজা করাতো এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট করত। যেমন অন্য জায়গাতে বলেছেন, (إِنْ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِنْ يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَرِيدًا) অর্থাৎ, তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে তারা কেবল দেবীদের পূজা করে এবং তারা কেবল বিদ্রোহী শয়তানের পূজা করে।
(সূরা নিসা ৪:১১৭ আয়াত)
فَالْيَوْمَ لَا يَمْلِكُ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا وَنَقُولُ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّتِي كُنْتُمْ بِهَا تُكَذِّبُونَ
📘 (তখন আমি বলব,) আজ তোমাদের একে অন্যের কোন উপকার কিংবা অপকার করবার ক্ষমতা নেই।[১] আর যারা সীমালংঘন করেছিল[২] তাদেরকে বলব, ‘তোমরা যে অগ্নির শাস্তিকে মিথ্যা মনে করতে আজ তা আস্বাদন কর।’
[১] অর্থাৎ, পৃথিবীতে তোমরা এই ভেবে এদের ইবাদত করতে যে, এরা তোমাদের উপকার করতে পারবে, তোমাদের জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করবে। (যেমন বর্তমানেও পীর পূজারী ও কবর পূজারীদের অবস্থা।) কিন্তু এখন দেখে নাও যে, এরা কোন উপকারের ক্ষমতা রাখে না।
[২] 'যারা সীমালংঘন করেছিল' (যালেম) বলতে গায়রুল্লাহর উপাসকদের বুঝানো হয়েছে। যেহেতু শিরক হল সবচেয়ে বড় সীমালংঘন ও সবচেয়ে বড় যুলম। আর মুশরিকরা হল সবচেয়ে বড় যালেম ও সীমালংঘনকারী।
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ قَالُوا مَا هَٰذَا إِلَّا رَجُلٌ يُرِيدُ أَنْ يَصُدَّكُمْ عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُكُمْ وَقَالُوا مَا هَٰذَا إِلَّا إِفْكٌ مُفْتَرًى ۚ وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُمْ إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ
📘 এদের নিকট যখন আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হয়, তখন এরা বলে, ‘এ তো সেই ব্যক্তিই,[১] যে তোমাদের পূর্বপুরুষ যার উপাসনা করত, তার উপাসনায় বাধা দিতে চায়।’ এরা আরও বলে, ‘এ (কুরআন) তো মিথ্যা উদ্ভাবন ব্যতীত কিছু নয়।’[২] আর সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের নিকট যখন সত্য আসে, তখন তারা বলে, ‘এ তো এক সুস্পষ্ট যাদু।’ [৩]
[১] 'ব্যক্তি' থেকে উদ্দেশ্য হল নবী করীম (সাঃ)। বাপ-দাদার ধর্ম তাদের নিকট সঠিক ধর্ম ছিল। যার ফলে তারা নবী (সাঃ)-এর এই অপরাধ বর্ণনা করেছে যে, এ তোমাদেরকে সেই সকল উপাস্য থেকে বিরত রাখতে চায়, যাদের ইবাদত তোমাদের বাপ-দাদারা করত।
[২] দ্বিতীয় 'هذا' (এ)র উদ্দেশ্য হল কুরআন কারীম। কুরআনকে তারা তৈরী করা (স্বরচিত) বা মনগড়া এবং (আল্লাহর প্রতি) মিথ্যা অপবাদ বলে আখ্যায়িত করেছে।
[৩] কাফেররা কুরআনকে প্রথমে মনগড়া মিথ্যা বলেছে এবং এখানে স্পষ্ট যাদু বলেছে। প্রথম কথার সম্পর্ক কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্যের সাথে আর দ্বিতীয় কথা কুরআনের অলৌকিক ছন্দ ও বর্ণনাভঙ্গি এবং সাহিত্য-শৈলী ও শব্দস্বাচ্ছন্দ্যের সাথে সম্পৃক্ত।
وَمَا آتَيْنَاهُمْ مِنْ كُتُبٍ يَدْرُسُونَهَا ۖ وَمَا أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمْ قَبْلَكَ مِنْ نَذِيرٍ
📘 আমি পূর্বে এ (মক্কাবাসী)দেরকে কোন গ্রন্থ দিইনি, যা এরা অধ্যয়ন করতে পারে এবং তোমার পূর্বে এদের নিকট কোন সতর্ককারীও প্রেরণ করিনি। [১]
[১] এই জন্য তারা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত, যেন তাদের নিকটেও কোন পয়গম্বর আসেন এবং আসমানী কোন গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়। কিন্তু যখন তা এসে গেল, তখন তারা অস্বীকার করে বসল।
وَكَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَمَا بَلَغُوا مِعْشَارَ مَا آتَيْنَاهُمْ فَكَذَّبُوا رُسُلِي ۖ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ
📘 এদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যা মনে করেছিল। ওদেরকে আমি যা দিয়েছিলাম এরা (মক্কার অধিবাসীরা) তার দশ ভাগের এক ভাগ পর্যন্তও পৌঁছেনি, তবুও ওরা আমার রসূলদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল। সুতরাং কেমন (ভয়ঙ্কর) ছিল আমার প্রতিকার (শাস্তি)! [১]
[১] এখানে মক্কার কাফেরদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, তোমরা মিথ্যা ও অস্বীকার করার যে পথ অবলম্বন করেছ, তা দারুণ বিপজ্জনক। তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরাও সেই পথ অবলম্বন করে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ তারা ধন-সম্পদ, বল ও শক্তি এবং বয়সের দিক থেকে তোমাদের থেকে অধিক ছিল, এমন কি তোমরা তাদের দশ ভাগের এক ভাগও পাওনি। কিন্তু তার পরেও তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি। উক্ত বিষয়কে সূরা আহক্বাফের ৪৬:২৬ নং আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।
۞ قُلْ إِنَّمَا أَعِظُكُمْ بِوَاحِدَةٍ ۖ أَنْ تَقُومُوا لِلَّهِ مَثْنَىٰ وَفُرَادَىٰ ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا ۚ مَا بِصَاحِبِكُمْ مِنْ جِنَّةٍ ۚ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ
📘 বল, ‘আমি তোমাদের একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছিঃ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’জন করে অথবা একা একা দাঁড়াও এবং চিন্তা করে দেখ, তোমাদের সঙ্গী (মুহাম্মাদ) পাগল নয়।[১] সে তো আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ককারী মাত্র।’ [২]
[১] অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে তোমাদের কর্ম-পদ্ধতির ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করছি এবং একটি কথারই উপদেশ দিচ্ছি। আর তা এই যে, তোমরা জেদ ও ঔদ্ধত্য ছেড়ে দিয়ে শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে একাকী বা দু'জন করে আমার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা কর, আমার জীবন তোমাদের মাঝেই অতিবাহিত হয়েছে এবং এখনো যে দাওয়াত আমি তোমাদেরকে দিচ্ছি তাতে কি এমন কোন বিষয় আছে, যাতে এই কথার প্রমাণ হয় যে, আমার মাঝে পাগলামি আছে? তোমরা যদি নিজেদের অন্ধ-পক্ষপাতিত্ব এবং মনের খেয়াল-খুশী থেকে মুক্ত হয়ে চিন্তা-ভাবনা কর, তাহলে অবশ্যই তোমরা বুঝতে পারবে যে, তোমাদের সাথীর মাঝে কোন পাগলামি নেই।[২] অর্থাৎ তিনি তো শুধু তোমাদের হিদায়াতের জন্য এসেছেন, যাতে তোমরা সেই কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পারো, যা হিদায়াতের পথে না চলার কারণে তোমাদেরকে ভোগ করতে হবে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সাঃ) একদা সাফা পাহাড়ে চড়ে বললেন, ياصباحاه (সাবধান! সতর্ক হও!) যা শ্রবণ করে কুরাইশরা একত্রিত হয়ে গেল। তিনি তাদেরকে বললেন, "তোমরা বল, যদি আমি সংবাদ দিই যে, শত্রুদল সকাল বা সন্ধ্যায় তোমাদের উপর হামলা করবে, তাহলে তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, 'কেন বিশ্বাস করব না? (আমাদের অভিজ্ঞতায় তুমি তো কখনো মিথ্যা বলনি।) তিনি (সাঃ) বললেন, "তবে তোমরা শুনে নাও যে, আমি তোমাদেরকে (আল্লাহর) কঠিন শাস্তি আসার পূর্বে সতর্ক করছি।" এই কথা শুনে আবু লাহাব বলল تَبًّا لَكَ! أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا 'তুমি ধ্বংস হও। এই জন্য তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছিলে?' যার ফলে আল্লাহ তাআলা সূরা تَبَّتْ يَدَآ اَبِيْ لَهَبٍ অবতীর্ণ করেছেন।
(বুখারীঃ তাফসীর সূরা সাবা')
قُلْ مَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ فَهُوَ لَكُمْ ۖ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
📘 বল, ‘আমি তোমাদের নিকট যে পারিশ্রমিক চেয়েছি তা তোমাদের জন্যই;[১] আমার পারিশ্রমিক আছে আল্লাহর নিকট এবং তিনি সর্ববিষয়ে সাক্ষী।’
[১] নবুঅত প্রচারে নবী (সাঃ) নিজের যে কোন লাভ বা স্বার্থ ছিল না এবং তাঁর পার্থিব ধন-সম্পদের যে কোন লোভ ছিল না সে কথা মহান আল্লাহ এই আয়াতে বিশেষভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন। যাতে তাদের মনে এই সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে তারা দূরে সরে না যায় যে, উক্ত দাওয়াতের পিছনে তাঁর পার্থিব ধন-সম্পদ উপার্জন উদ্দেশ্য আছে।
قُلْ إِنَّ رَبِّي يَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَّامُ الْغُيُوبِ
📘 বল, ‘আমার প্রতিপালক সত্য অবতারণ করেন;[১] তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা।’
[১] قَََََذَفَ এর অর্থ হল, (নিক্ষেপ করা) তীর চালানো, পাথর ছুঁড়া এবং কথা বলাও হয়। এখানে শেষোক্ত অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ হক কথা বলেন, নিজ রসূলগণের প্রতি অহী অবতীর্ণ করেন এবং তাঁদের মাধ্যমে মানুষের জন্য হক স্পষ্ট করে থাকেন। যেমন অন্য স্থানে বলেছেন (يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ) অর্থাৎ, তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় আদেশসহ অহী প্রেরণ করেন।
(সূরা মু'মিন ৪০:১৫ আয়াত)
قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيدُ
📘 বল, ‘সত্য এসেছে এবং অসত্য নতুন কিছু সৃজন করতে পারে না এবং পারে না পুনরাবৃত্তি ঘটাতে।’ [১]
[১] হক বা সত্য হল কুরআন আর বাতিল বা অসত্য হল শিরক ও কুফর। উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর দ্বীন এবং তাঁর কুরআন এসে গেছে, যার দ্বারা বাতিল চূর্ণ-বিচূর্ণ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এখন আর সে মাথা উঠানোর ক্ষমতা রাখে না। যেমন তিনি বলেছেন, (بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَى الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُهُ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ) অর্থাৎ, বরং আমি সত্য দ্বারা মিথ্যার উপর আঘাত হানি; সুতরাং তা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়; ফলে মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
(আম্বিয়া ২১:১৮ আয়াত)
হাদীসে বর্ণনা হয়েছে, যেদিন মক্কা বিজয় হয়, নবী (সাঃ) কা'বা শরীফে প্রবেশ করে চারিদিকে যে সব মূর্তি স্থাপন করা ছিল, তিনি ধনুকের ডগা দিয়ে সেই মূর্তিগুলিকে খোঁচা মারছিলেন আর উক্ত আয়াত ও সূরা বানী ইস্রাঈলের ১৭:৮১ আয়াত (وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِل) পড়ছিলেন।
(বুখারীঃ জিহাদ অধ্যায়)
وَالَّذِينَ سَعَوْا فِي آيَاتِنَا مُعَاجِزِينَ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مِنْ رِجْزٍ أَلِيمٌ
📘 যারা আমার বাক্যসমূহকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা করে[১] তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে।
[১] অর্থাৎ, আমার ঐ সকল আয়াতকে বাতিল ও মিথ্যা মনে করে, যা আমি আমার পয়গম্বরদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি। مُعَاجِزِيْنَ (ব্যর্থ করার অপচেষ্টা করে) এই ভেবে যে, আমি তাদেরকে পাকড়াও করতে অপারগ। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর পর যখন আমরা মাটিতে মিশে যাব, তখন কিভাবে পুনরায় জীবিত হয়ে কারো সামনে আপন কর্মের জন্য আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে? তাদের এই মনোভাব এ কথারই ঘোষণা ছিল যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাকড়াও করতে সক্ষম নন! অতএব আমাদের কিয়ামতের আর ভয় কি?
قُلْ إِنْ ضَلَلْتُ فَإِنَّمَا أَضِلُّ عَلَىٰ نَفْسِي ۖ وَإِنِ اهْتَدَيْتُ فَبِمَا يُوحِي إِلَيَّ رَبِّي ۚ إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ
📘 বল, ‘আমি বিভ্রান্ত হলে বিভ্রান্তির পরিণাম আমাকেই ভোগ করতে হবে। আর যদি আমি সৎপথে থাকি তবে তা এ জন্য যে, আমার প্রতি আমার প্রতিপালক অহী (প্রত্যাদেশ) প্রেরণ করেন।[১] তিনি সর্বশ্রোতা, সন্নিকটবর্তী।’ [২]
[১] অর্থাৎ সর্বপ্রকার মঙ্গল আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহ তাআলা যে অহী ও স্পষ্ট সত্য অবতীর্ণ করেছেন, তাতে সঠিক পথ ও হিদায়াত নিহিত আছে। মানুষ তাতেই সঠিক পথের দিশা পায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তাতে মানুষের নিজের ত্রুটি এবং প্রবৃত্তির খেয়াল-খুশী থাকে। এই জন্য তার কুফলও তাকেই ভোগ করতে হবে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) যখন কোন জিজ্ঞাসকের উত্তরে নিজের পক্ষ থেকে কিছু বর্ণনা করতেন, তখন বলতেন, এ ব্যাপারে আমি আমার নিজস্ব রায় বললাম। সুতরাং তা যদি সঠিক হয়, তাহলে তা আল্লাহর তরফ হতে, আর যদি তা বেঠিক হয়, তাহলে তা আমার ও শয়তানের তরফ হতে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল তার সাথে সম্পর্কহীন।
(ইবনে কাসীর)
[২] যেমন হাদীসে এসেছে যে, একদা সাহাবীগণ জোরে-শোরে তকবীর পড়তে শুরু করলেন। তখন নবী (সাঃ) বললেন, হে লোক সকল! নিজেদের উপর কৃপা কর। নিশ্চয় তোমরা কোন বধির অথবা কোন (দূরবর্তী) অনুপস্থিতকে আহবান করছ না; বরং তোমরা সর্বশ্রোতা নিকটবর্তীকে আহবান করছ। তিনি (তাঁর ইলমসহ) তোমাদের সঙ্গে আছেন।"
(বুখারী ৫
/
৭৫, মুসলিম ৪
/
২০৭৬)
وَلَوْ تَرَىٰ إِذْ فَزِعُوا فَلَا فَوْتَ وَأُخِذُوا مِنْ مَكَانٍ قَرِيبٍ
📘 তুমি যদি দেখতে যখন এরা ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে, তখন এরা কোন প্রকার অব্যাহতি পাবে না[১] এবং এরা অদূরে থেকেই ধৃত হবে।
[১] 'فَلاَ فَوْتَ' কোথাও পালাতে পারবে না, কারণ সে আল্লাহর পাকড়াও-এর আয়ত্তে হবে। এ বর্ণনা হাশরের ময়দানের।
وَقَالُوا آمَنَّا بِهِ وَأَنَّىٰ لَهُمُ التَّنَاوُشُ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ
📘 এবং এরা বলবে, ‘আমরা তা বিশ্বাস করলাম।’ কিন্তু এখন এতদূর হতে ওর নাগাল পাবে কিরূপে? [১]
[১] 'تَنَاوُشٌ -এর অর্থ ধরা বা নাগাল পাওয়া। অর্থাৎ, এখন আখেরাতে তারা ঈমানের নাগাল কিভাবে পাবে, অথচ পৃথিবীতে তা থেকে দূরে থাকতো। ঠিক যেন আখেরাত ঈমানের জন্য পৃথিবীর তুলনায় অনেক দূরের জায়গা। যেমন দূর থেকে কোন বস্তুকে ধরা অসম্ভব, তেমনি আখেরাতে ঈমান পাওয়ার কোন সুযোগই নেই।
وَقَدْ كَفَرُوا بِهِ مِنْ قَبْلُ ۖ وَيَقْذِفُونَ بِالْغَيْبِ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ
📘 ওরা তো পূর্বে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল; ওরা (সত্য হতে) দূরে থেকে অদেখা বিষয়ে মন্তব্য করত। [১]
[১] অর্থাৎ, নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলত যে, কিয়ামত ও হিসাব-কিতাব কিচ্ছু হবে না। অথবা কুরআন সম্পর্কে বলত যে, এটা হল জাদু, তৈরী করা মিথ্যা এবং পূর্বযুগীয় উপকথা। অথবা মুহাম্মাদ (সাঃ) সম্পর্কে বলত যে, ও একজন জাদুকর, গণক, কবি বা পাগল। অথচ কোন কথারই কোন প্রমাণ তাদের নিকট ছিল না।
وَحِيلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ مَا يَشْتَهُونَ كَمَا فُعِلَ بِأَشْيَاعِهِمْ مِنْ قَبْلُ ۚ إِنَّهُمْ كَانُوا فِي شَكٍّ مُرِيبٍ
📘 এদের এবং এদের কামনার মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়েছে,[১] যেমন করা হয়েছিল এদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে। [২] ওরা ছিল বিভ্রান্তিকর সন্দেহে সন্দিহান। [৩]
[১] অর্থাৎ, কিয়ামত দিবসে তারা চাইবে, তাদের ঈমান গ্রহণ করে নেওয়া হোক, শাস্তি থেকে তাদের পরিত্রাণ হয়ে যাক। কিন্তু তাদের ও তাদের মনোবাঞ্ছার মাঝে পর্দা স্থাপন করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ তাদের সেই মনোবাঞ্ছা রদ করা হবে।
[২] অর্থাৎ, পূর্ববর্তী উম্মতের ঈমানও সেই সময় গ্রহণ করা হয়নি, যখন তারা শাস্তি স্বচক্ষে অবলোকন করার পর ঈমান এনেছিল।
[৩] সুতরাং বর্তমানে শাস্তি অবলোকন করার পর তাদের ঈমান কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? ক্বাতাদা (রঃ) বলেন, 'সন্দেহ থেকে দূরে থাক। কারণ, যে ব্যক্তি সন্দেহ রাখা অবস্থায় ইন্তিকাল করবে, সে সেই অবস্থায় পুনরুত্থান করবে এবং যে ব্যক্তি প্রত্যয় রাখা অবস্থায় ইন্তিকাল করবে, সে কিয়ামতের দিন প্রত্যয় রাখা অবস্থায় পুনরুত্থান করবে।'
(ইবনে কাসীর)
وَيَرَى الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ الَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ هُوَ الْحَقَّ وَيَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
📘 যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তারা সুনিশ্চিতভাবে জানে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা সত্য;[১] এবং তা মানুষকে পরাক্রমশালী প্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে। [২]
[১] এখানে يَرَى দেখার অর্থ হল অন্তর-চক্ষু দিয়ে দেখা; শুধু চোখের দেখা নয়। অর্থাৎ, 'ইলমে ইয়াকীন' দ্বারা সুনিশ্চিতরূপে জানে। 'যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে' বলে সাহাবায়ে-কিরামগণ অথবা আহলে কিতাবদের মু'মিন বা সকল মু'মিনদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মু'মিনগণ তা জানেন ও তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন।
[২] এর সংযোগ 'সত্য' শব্দের সাথে। অর্থাৎ, তারা এটাও জানে যে, এই কুরআন কারীম ঐ পথের দিশা দেয়, যা সেই আল্লাহর পথ, যিনি সৃষ্টি জগতে সকলের উপর প্রতাপশালী এবং আপন সৃষ্টির মাঝে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। সে পথ হল তাওহীদের পথ, যে পথের দিকে সকল পয়গম্বরগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়কে দাওয়াত দিয়েছিলেন।
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا هَلْ نَدُلُّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ يُنَبِّئُكُمْ إِذَا مُزِّقْتُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّكُمْ لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ
📘 অবিশ্বাসীরা বলে,[১] ‘আমরা কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির সন্ধান দেব[২] যে তোমাদেরকে খবর দেয় যে,[৩] তোমাদের দেহ সম্পূর্ণ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও তোমরা নতুন সৃষ্টিরূপে উত্থিত হবে? [৪]
[১] এটা মু'মিনদের মোকাবেলায় আখেরাত অস্বীকারকারীদের কথা, যা তারা নিজেদের মাঝে বলাবলি করত।
[২] উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ (সাঃ), যিনি তাদের নিকট আল্লাহর নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন।
[৩] অর্থাৎ, অবিশ্বাস্য, আশ্চর্য ও অদ্ভুত খবর, বুঝে আসে না এমন খবর!
[৪] অর্থাৎ, মৃত্যুর পর যখন তোমরা মাটিতে মিশে ধূলিকণায় পরিণত হয়ে যাবে, তোমাদের দেহের কোন চিহ্নই থাকবে না, অথচ তোমাদেরকে কবর থেকে পুনরায় জীবিত করা হবে এবং পুনরায় পূর্বের আকার-আকৃতি তোমাদেরকে প্রদান করা হবে? এ সকল কথোপকথন তারা আপোসে ঠাট্টা-মজাক হিসাবে করত।
أَفْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَمْ بِهِ جِنَّةٌ ۗ بَلِ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ فِي الْعَذَابِ وَالضَّلَالِ الْبَعِيدِ
📘 সে কি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে অথবা সে উন্মাদ?’[১] বস্তুতঃ যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তারা শাস্তি এবং ঘোর বিভ্রান্তিতে রয়েছে। [২]
[১] অর্থাৎ, (তারা বলত,) দু'য়ের এক অবশ্যই হবে, হয় সে মিথ্যা বলছে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী ও রিসালাতের দাবী করে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করছে। অথবা তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এবং পাগলামির জন্য ঐ সব কথা বলছে, যা জ্ঞানে ধরার মত নয়।
[২] আল্লাহ তাআলা বলেন, আসল ব্যাপার তা নয়, যা তারা ধারণা করে। বরং ঘটনা হচ্ছে যে, জ্ঞান করে দেখা ও প্রকৃত বুঝার ক্ষমতা থেকে এরাই বঞ্চিত, যার ফলস্বরূপ তারা পরকালকে বিশ্বাস করার পরিবর্তে তা অস্বীকার করে। যার পরিণাম হল পরকালের চিরস্থায়ী শাস্তি এবং তারা এখন এমন ভ্রষ্টতার শিকার, যা সত্য থেকে অনেক দূরে।
أَفَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۚ إِنْ نَشَأْ نَخْسِفْ بِهِمُ الْأَرْضَ أَوْ نُسْقِطْ عَلَيْهِمْ كِسَفًا مِنَ السَّمَاءِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِكُلِّ عَبْدٍ مُنِيبٍ
📘 ওরা কি ওদের সম্মুখে ও পশ্চাতে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে, তার প্রতি লক্ষ্য করে না?[১] আমি ইচ্ছা করলে ওদেরকে সহ ভূমি ধসিয়ে দেব অথবা ওদের ওপর আকাশ হতে (আযাবের) কোন অংশ পতিত করব।[২] আল্লাহ-অভিমুখী প্রতিটি দাসের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।
[১] অর্থাৎ, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না? আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন যে, পরকালকে অস্বীকার আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করার ফল। তাছাড়া যে আল্লাহ বর্ণনাতীত উচ্চ ও প্রশস্ত আকাশের মত বস্তু এবং বিশাল লম্বা-চওড়া পৃথিবীর মত বস্তু সৃষ্টি করতে পারেন, সেই আল্লাহর জন্য তাঁরই সৃষ্টি করা বস্তুকে পুনরায় সৃষ্টি করা এবং তা পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা কি সম্ভব নয়?
[২] উক্ত আয়াতটি দুটি বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছে; প্রথমতঃ আল্লাহর পূর্ণ ক্ষমতার বর্ণনা, যা এক্ষুনি বর্ণিত হল। দ্বিতীয়তঃ কাফেরদের জন্য সতর্কতা ও ধমক এইভাবে যে, যে আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন, উভয়ের উপরে ও মাঝে যা কিছু আছে তার সকল কিছুর উপর তাঁর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ, তিনি যখন ইচ্ছা তাদের উপর আযাব প্রেরণ করে সকলকে ধ্বংস করতে পারেন। মাটি ধসিয়েও তিনি ধ্বংস করতে পারেন, যেমন কারূনকে ধসিয়ে ছিলেন অথবা আকাশ থেকে কিছু নিক্ষেপ করেও ধ্বংস করতে পারেন, যেমন আইকাবাসীকে ধ্বংস করা হয়েছিল।