🕋 تفسير سورة الزمر
(Az-Zumar) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ تَنْزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ
📘 এ গ্রন্থ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ করা হয়েছে।
قُلْ يَا عِبَادِ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا رَبَّكُمْ ۚ لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ ۗ وَأَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةٌ ۗ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
📘 ঘোষণা করে দাও (আমার এ কথা), হে আমার বিশ্বাসী দাসগণ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর।[১] যারা এ পৃথিবীতে কল্যাণকর কাজ করে, তাদের জন্য আছে কল্যাণ।[২] আর আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত।[৩] ধৈর্যশীলদেরকে তো অপরিমিত পুরস্কার দেওয়া হবে।[৪]
[১] তাঁর আনুগত্য করে, পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে এবং ইবাদত ও আনুগত্য বিশুদ্ধভাবে একমাত্র তাঁরই জন্য সম্পাদন করে।
[২] এটা তাকওয়ার (আল্লাহ-ভীতির) উপকার। 'কল্যাণ' বলতে জান্নাত ও তার চিরস্থায়ী নিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে। অনেকে فِيْ هَذِهِ الدُّنْيَا শব্দটিকে حَسَنَةٌ এর 'মুতাআল্লিক' (সম্পৃক্ত) ভেবে অর্থ করেছেন "যারা কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য এ পৃথিবীতে আছে কল্যাণ।" অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পৃথিবীতে সুস্থতা ও নিরাপত্তা, বিজয় ও গনীমত ইত্যাদি প্রদান করে থাকেন। তবে পূর্বের অর্থই অধিক সঠিক।
[৩] এখানে এই কথার ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যদি স্বদেশে থেকে ঈমান ও তাকওয়ার উপর অটল থাকা বা শরীয়তের হুকুম-আহকাম পালন করা দুষ্কর হয়, তবে সে স্থানে বসবাস করা অপছন্দনীয়। বরং সেখান থেকে হিজরত করে এমন স্থানে চলে যাওয়া দরকার, যেখানে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা সহজ হবে এবং যেখানে ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বনের পথে কোন বাধা থাকবে না।
[৪] ঈমান ও তাকওয়ার পথে কষ্ট অনিবার্য এবং প্রবৃত্তি ও আত্মার চাহিদাকেও কুরবানী করা অবধারিত। যার জন্য ধৈর্যের দরকার। এই জন্য ধৈর্যশীলদের মাহাত্ম্যও বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের ধৈর্যের প্রতিদান এমন অপরিসীম ও অগণিত রূপে দেওয়া হবে যা কোন ওজন বা হিসাবের যন্ত্র দ্বারা ওজন বা হিসাব করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ তাদের পুরস্কার অপরিমিত হবে। কারণ যার হিসাব করা যায়, তার একটি সীমা থাকে আর যার কোন সীমা ও শেষ নেই,তা গণনা করা অসম্ভব। এটি ধৈর্যের এমন বৃহৎ মাহাত্ম্য যা অর্জন করার চেষ্টা প্রত্যেক মুসলিমকে করা উচিত। কারণ অধৈর্য হয়ে হা-হুতাশ, ক্ষোভ প্রকাশ বা কান্না-কাটি করে কষ্ট ও বিপদ দূর করা যায় না, যে কল্যাণ ও বাঞ্ছিত জিনিস লাভে বঞ্চনা আসে, তা অর্জন করা যায় না এবং যে অপছন্দনীয় অবস্থা এসে যায়, তা দূর করা সম্ভব হয় না। অতএব মানুষের উচিত, সবর করে সেই বৃহৎ সওয়াবের অধিকারী হওয়া, যা আল্লাহ তাআলা সবরকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন।
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
📘 বল, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে তাঁর ইবাদত (দাসত্ব) করতে;
وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُونَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِينَ
📘 এবং আদিষ্ট হয়েছি আমি যেন আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)দের অগ্রণী হই।’[১]
[১] أَوَّلَ (প্রথম বা অগ্রণী) হওয়ার অর্থ হল, বাপ-দাদার ধর্মের বিপরীত আচরণ করে সর্বপ্রথম তওহীদের দাওয়াত তিনিই পেশ করেছিলেন।
قُلْ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
📘 বল, ‘যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তাহলে আমি অবশ্যই ভয় করি মহাদিনের শাস্তির।’
قُلِ اللَّهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِينِي
📘 বল, ‘আমি আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে তাঁরই ইবাদত (দাসত্ব) করি।
فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُمْ مِنْ دُونِهِ ۗ قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ وَأَهْلِيهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ أَلَا ذَٰلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ
📘 অতএব তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছা তার ইবাদত (দাসত্ব) কর।’ বল, ‘আসল ক্ষতিগ্রস্ত তো তারাই; যারা কিয়ামতের দিন নিজেদেরকে ও নিজেদের পরিজনবর্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জেনে রাখ, এটিই সুস্পষ্ট ক্ষতি।’
لَهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ ظُلَلٌ مِنَ النَّارِ وَمِنْ تَحْتِهِمْ ظُلَلٌ ۚ ذَٰلِكَ يُخَوِّفُ اللَّهُ بِهِ عِبَادَهُ ۚ يَا عِبَادِ فَاتَّقُونِ
📘 তাদের ঊর্ধ্বদেশে অগ্নিস্তর থাকবে এবং নিম্নদেশেও অগ্নিস্তর থাকবে।[১] এ শাস্তি হতে আল্লাহ নিজ দাসদেরকে ভীতিপ্রদর্শন করেন।[২] হে আমার দাসগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর।
[১] ظُلَلٌ, ظُلَّةٌ এর বহুবচন, যার আসল অর্থঃ ছায়া। এখানে উদ্দেশ্য হল, জাহান্নামের আগুনের স্তর। অর্থাৎ, তাদের ঊর্ধ্বে ও নিম্নে আগুনের স্তর হবে, যা তাদের উপর দাউদাউ করে জ্বলতে থাকবে।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[২] অর্থাৎ, এটাই পূর্ব বর্ণিত সুস্পষ্ট ক্ষতি ও স্তরবিশিষ্ট আগুনের শাস্তি, যা থেকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন, যাতে তারা আল্লাহর আনুগত্যের পথ বেছে নিয়ে উক্ত নিকৃষ্ট ফল ভোগ করা থেকে বাঁচতে পারে।
وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَىٰ ۚ فَبَشِّرْ عِبَادِ
📘 যারা তাগূতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অনুরাগী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার দাসদেরকে --
الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ
📘 যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে এবং যা উত্তম[১] তার অনুসরণ করে। ওরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং ওরাই বুদ্ধিমান। [২]
[১] أَحْسَنُ (উত্তম) শব্দ দ্বারা সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ কথাকে বুঝানো হয়েছে। অথবা বিধি-বিধানের মধ্যে সব থেকে উত্তম বিধানকে, অথবা বাধ্যবাধকতামূলক ও অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মের মধ্যে বাধ্যবাধকতামূলক কর্মকে, অথবা শাস্তি দানের পরিবর্তে ক্ষমাশীলতাকে বেছে নেওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে।
[২] কারণ, তারা নিজ জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যরা নিজ জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়নি।
أَفَمَنْ حَقَّ عَلَيْهِ كَلِمَةُ الْعَذَابِ أَفَأَنْتَ تُنْقِذُ مَنْ فِي النَّارِ
📘 যার ওপর দন্ডাদেশ অবধারিত হয়েছে;[১] তুমি কি তাকে রক্ষা করতে পারবে, যে জাহান্নামে আছে? [২]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহর ফায়সালা ও ভাগ্য অনুযায়ী সে শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গেছে। এমনভাবে সে কুফর ও যুলম এবং অন্যায় ও সীমালংঘনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সেখান থেকে ফিরে আসা তার পক্ষে আর সম্ভব নয় এবং তাকে গুনাহতে পূর্ণরূপে এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে, পরিশেষে সে জাহান্নামী হয়ে গেছে। যেমন আবু জাহল ও আস বিন ওয়ায়েল প্রভৃতিরা।
[২] যেহেতু নবী (সাঃ) নিজ জাতির সকল মানুষের ঈমানদার হওয়ার বড় আশা রাখতেন, সেহেতু আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তোমার এ আশা নিজ জায়গায় বিলকুল ঠিক, কিন্তু যার ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে এবং আল্লাহর দন্ডাদেশ যার জন্য অবধারিত হয়ে গেছে, তাকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
📘 নিশ্চয় আমি তোমার নিকট এ গ্রন্থ যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি;[১] সুতরাং তুমি আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে তাঁর উপাসনা কর। [২]
[১] অর্থাৎ এতে তাওহীদ ও রিসালাত, পরকাল এবং যে বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে, তা সত্য। তা যথাযথভাবে বিশ্বাস, গ্রহণ ও পালন করার মাঝেই রয়েছে মানুষের কল্যাণ।
[২] এখানে دِين এর অর্থ ইবাদত ও আনুগত্য এবং إخلاص এর অর্থ হল, বিশুদ্ধচিত্তে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নেক আমল করা। এই আয়াতটি নিয়ত ওয়াজেব ও তাতে ইখলাস থাকা জরুরী হওয়ার একটি দলীল। হাদীসেও খালেস নিয়তের গুরুত্ব (إنما الأعمال بالنيات) 'আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল' শব্দ দ্বারা প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে নেক আমল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করা হবে, তা গ্রহণযোগ্য হবে (তবে শর্ত হল যে তা সুন্নত মোতাবেক হতে হবে)। পক্ষান্তরে যে আমলে অন্য কোন উদ্দেশ্য মিলিত হবে, তা অগ্রহণযোগ্য হবে।
لَٰكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِنْ فَوْقِهَا غُرَفٌ مَبْنِيَّةٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ وَعْدَ اللَّهِ ۖ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ الْمِيعَادَ
📘 তবে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য বহুতলবিশিষ্ট নির্মিত প্রাসাদ রয়েছে;[১] যার নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত। (এটি) আল্লাহর প্রতিশ্রুতি,[২] আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
[১] এর উদ্দেশ্য এই যে, জান্নাতে একের উপর এক তলা হবে, যেমন পৃথিবীতে কয়েক তলাবিশিষ্ট অট্টালিকা হয়। জান্নাতেও মান অনুসারে বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা হবে, যার মধ্য হতে জান্নাতীদের ইচ্ছা অনুযায়ী দুধ, মধু, পানি এবং শারাবের নহর প্রবাহিত হতে থাকবে।
[২] যে প্রতিশ্রুতি তিনি মু'মিন বান্দাদের সাথে করেছেন এবং তা অবশ্যই পূর্ণ হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَلَكَهُ يَنَابِيعَ فِي الْأَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهِ زَرْعًا مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَجْعَلُهُ حُطَامًا ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَىٰ لِأُولِي الْأَلْبَابِ
📘 তুমি কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, অতঃপর ভূমিতে ঝরনারূপে প্রবাহিত করেন[১] এবং তা দিয়ে বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন,[২] অতঃপর এ শুকিয়ে যায় এবং তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও, অবশেষে তিনি তা টুকরা-টুকরা করে দেন? [৩] এতে অবশ্যই বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্য উপদেশ রয়েছে। [৪]
[১] يَنَابِيْعَ - يَنْبُوْعٌ এর বহুবচন। এর অর্থ ঝরনা। অর্থাৎ, বৃষ্টি রূপে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ হয় এবং তা শোষিত হয়ে ভূগর্ভে নেমে গিয়ে ঝরনার আকারে নির্গত হয় অথবা পুকুরসমূহে ও নদী-নালায় সংরক্ষিত হয়ে যায়।
[২] অর্থাৎ, সেই একই পানি দ্বারা বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপন্ন করেন, যার রঙ, স্বাদ, গন্ধ এক অপর থেকে আলাদা।
[৩] অর্থাৎ, সবুজ ও তরতাজা হওয়ার পর সেই ফসল শুকিয়ে হলুদবর্ণ হয়ে যায় অতঃপর টুকরো টুকরো হয়ে (শস্য ও খড়কুটা বা ভুসি আলাদা আলাদা হয়ে যায়) যেমন গাছের ডাল শুকিয়ে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে যায়।
[৪] অর্থাৎ, বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তিগণ এর মাধ্যমে বুঝতে পারেন যে, পৃথিবীর উদাহরণও অনুরূপ। পৃথিবী অতি অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর চাকচিক্য ও সতেজতা, তার শ্যামলতা ও সৌন্দর্য এবং তার আমোদ-প্রমোদ ও আরাম-আয়েশ ক্ষণকালের জন্য। এ সকল বস্তুকে মানুষের মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসা উচিত নয়। বরং সেই মৃত্যুর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকা দরকার, যার পরের জীবন হল চিরস্থায়ী জীবন, যার কোন শেষ নেই। কেউ কেউ বলেন, এ হল কুরআন ও ঈমানদার ব্যক্তির হৃদয়ের উদাহরণ। উদ্দেশ্য হল যে, আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন; যা তিনি মু'মিনদের হৃদয়ে প্রক্ষিপ্ত করেন। অতঃপর তার দ্বারা দ্বীন উদগত হয়। আর তার ফলে মানুষ এক অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। সুতরাং মু'মিনগণের ঈমান ও একীন বৃদ্ধি পায়। আর যাদের মনে রোগ আছে তারা শুকিয়ে যাওয়া ফসলের মত শুকিয়ে যায়।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
أَفَمَنْ شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٍ مِنْ رَبِّهِ ۚ فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
📘 আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, ফলে সে তার প্রতিপালক হতে (আগত) আলোর মধ্যে আছে,[১] সে কি তার সমান-- যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে কঠিন, ওরাই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।
[১] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য গ্রহণ করার এবং সঠিক পথ অবলম্বন করার সুমতি লাভ করেছে, অতঃপর সে তার অন্তরের প্রশস্ততার কারণে আল্লাহর দ্বীনের আলোর উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান হতে পারে, যার অন্তর ইসলামের প্রতি কঠোর, তার বক্ষ সংকীর্ণ এবং ভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
📘 আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত এমন এক গ্রন্থ, যাতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ একই কথা নানাভাবে বার বার বলা হয়েছে।[১] এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে[২] তাদের চামড়ার (লোম) খাড়া হয়, অতঃপর তাদের দেহ-মন আল্লাহর স্মরণের প্রতি নরম হয়ে যায়।[৩] এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে পথপ্রদর্শন করেন। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।
[১] أَحْسَنُ الْحَدِيْثِ (উত্তম বাণী)এর অর্থ হল কুরআন কারীম। متشابها এর অর্থ, কুরআনের শ্রুতিমধুর ও সুখপাঠ্য বাণী, তার সাহিত্য-শৈলী, শব্দালঙ্কার, অর্থ-সত্যতা ইত্যাদি গুণাবলীতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণ। অথবা কুরআন পূর্ব আসমানী গ্রন্থসমূহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অর্থাৎ, কুরআন অন্য সকল আসমানী কিতাবের অনুরূপ। مَثَانِيَ অর্থাৎ, এই কুরআনে বর্ণিত ইতিহাস ও কাহিনী, আদেশ-উপদেশ ও বিধি-বিধানগুলিকে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
[২] কারণ, তারাই ঐ সকল আযাব ও শাস্তির ধমক, সতর্কবাণী বুঝতে পারে, যা অবাধ্যদের জন্য তাতে বর্ণনা করা হয়েছে।
[৩] অর্থাৎ, যখন আল্লাহর করুণা, ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের আশা তাদের মনে জাগে তখন তাদের অন্তর নরম হয়ে যায় এবং আল্লাহর স্মরণে মগ্ন হয়ে পড়ে। ক্বাতাদা (রঃ) বলেন "এতে আল্লাহর আওলিয়াগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে; আল্লাহর ভয়ে তাঁদের অন্তর কম্পিত হয়, তাঁদের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় এবং আল্লাহর যিকর দ্বারা তাঁরা মনে শান্তি পান। যিকর করতে গিয়ে তাঁরা নেশাগ্রস্ত মাতালদের মত এবং সংজ্ঞাহীন বেহুঁশের মত হয়ে যান না। (যেমন তাঁরা নেচেও উঠেন না।) কারণ এসব হল বিদআতীদের আচরণ এবং তাতে শয়তানের হাত থাকে।
(ইবনে কাসীর)
যেমন বর্তমানেও বিদআতীদের কাওয়ালী-গান বা যিকরের আসর অনুরূপ শয়তানী কার্যকলাপে পরিপূর্ণ; যাতে বিভিন্ন অবস্থার তারা উন্মত্ততা, মূর্ছা, অচৈতন্য, মোহিত, আত্মহারা, বিভোর, ধ্যানমগ্ন, বেহুঁশী, মস্তী ইত্যাদি নাম দিয়ে থাকে। ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন, এই বিষয়ে মু'মিনগণ কাফেরদের থেকে কয়েক দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। প্রথম এই যে, মু'মিনগণের শ্রাব্য বস্তু হল কুরআন কারীম, আর কাফেরদের শ্রাব্য বস্তু হল নির্লজ্জ গায়িকাদের গান-বাজনা। (যেমন বিদআতীদের শ্রাব্য বস্তু হল শিরকী অতিরঞ্জনমূলক না'ত, গজল ও কাওয়ালী গান।) দ্বিতীয় এই যে, মু'মিনগণ কুরআন শ্রবণ করে আদব ও ভীতি, আশা ও মহব্বত এবং অনুধাবন ও উপলব্ধির সাথে ক্রন্দন করেন এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে কাফেররা হৈ-হাল্লা করে এবং খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকে। তৃতীয় এই যে, মু'মিনগণ কুরআন শ্রবণের সময় আদব ও বিনয় প্রকাশ করেন; যেমন সাহাবায়ে কিরামগণের বরকতময় অভ্যাস ছিল। যার ফলে তাঁদের দেহ শিউরে উঠত এবং তাঁদের অন্তর আল্লাহর প্রতি আসক্ত হয়ে যেত।
(ইবনে কাসীর)
أَفَمَنْ يَتَّقِي بِوَجْهِهِ سُوءَ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ وَقِيلَ لِلظَّالِمِينَ ذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْسِبُونَ
📘 যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল দ্বারা কঠিন শাস্তি ঠেকাতে চাইবে (সে কি তার মত, যে নিরাপদ?)[১] সীমালংঘনকারীদের বলা হবে, তোমরা যে কর্ম করতে, তার শাস্তি আস্বাদন কর।
[১] অর্থাৎ, এ ধরনের মানুষ কি ঐ সকল মানুষের সমান হবে, যারা কিয়ামতের দিন নির্ভয় ও নিরাপদ থাকবে?
كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَأَتَاهُمُ الْعَذَابُ مِنْ حَيْثُ لَا يَشْعُرُونَ
📘 ওদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যা মনে করেছিল, ফলে ওদের অজ্ঞাতসারে ওদের উপর শাস্তি এল।[১]
[১] এবং তাদেরকে সেই শাস্তি থেকে কেউ বাঁচাতে পারেনি ।
فَأَذَاقَهُمُ اللَّهُ الْخِزْيَ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَكْبَرُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
📘 সুতরাং আল্লাহ ওদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা আস্বাদন করালেন।[১] আর নিশ্চয় পরলোকের শাস্তি কঠিনতর; যদি ওরা জানত!
[১] এর দ্বারা মক্কার কাফেরদেরকে এই বলে সতর্ক করা হচ্ছে যে, পূর্ববর্তী জাতিরা পয়গম্বরদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করার ফলে তাদের এই অবস্থা হয়েছিল, আর তোমরা নবীকুল শিরোমণি ও মানবকুল শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে মিথ্যাজ্ঞান করছ। তোমাদেরকেও এই মিথ্যার ভয়াবহ পরিণতিকে ভয় করা দরকার।
وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
📘 আমি এ কুরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি; যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে।[১]
[১] অর্থাৎ, মানুষকে বুঝানোর জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি। যাতে সকল কথা তাদের মনে গেঁথে যায় এবং তারা নসীহত গ্রহণ করে।
قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
📘 আরবী ভাষায় এ কুরআন; যাতে কোন জটিলতা নেই, যাতে ওরা সাবধানতা অবলম্বন করে।[১]
[১] অর্থাৎ, কুরআন শুদ্ধ আরবী ভাষাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে, যাতে কোন বক্রতা, বঙ্কিমতা ও জটিলতা নেই। যাতে মানুষ তাতে বর্ণিত শাস্তিসমূহকে ভয় করে এবং তাতে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি অর্জন করার নিমিত্তে আমল করে।
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا رَجُلًا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلًا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا ۚ الْحَمْدُ لِلَّهِ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
📘 আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করছেনঃ এক ব্যক্তির প্রভু অনেক, যারা তাতে পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন শরীক এবং আরেক ব্যক্তির প্রভু কেবল একজন। এদের দু’জনের অবস্থা কি সমান?[১] সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য; [২] কিন্তু ওদের অধিকাংশই এ জানে না। [৩]
[১] এতে মুশরিক (অংশীবাদী) ও মুখলিস (এক আল্লাহতে বিশ্বাসী) দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ, একজন দাস যার কয়েকজন মনিব আছে, সুতরাং তারা আপোসে তাকে নিয়ে ঝগড়া করে। আর একজন দাস যার মনিব মাত্র একজন, তার মালিকানায় অন্য কেউ শরীক নেই। উক্ত দাস দু'টি কি সমান হতে পারে? না কক্ষনই না। অনুরূপ ঐ মুশরিক ব্যক্তি যে আল্লাহর সাথে অন্য দ্বিতীয় উপাস্যের ইবাদত করে এবং ঐ মুখলিস মু'মিন ব্যক্তি যে একমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না, উভয়ে সমান হতে পারে না।
[২] তাঁরই সমস্ত প্রশংসা এই জন্য যে, তিনি সকল প্রকার অকাট্য প্রমাণ পেশ করে দিয়েছেন।
[৩] আর এই কারণেই তারা আল্লাহর সাথে শিরক করে।
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ ۚ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
📘 জেনে রাখ, খাঁটি আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য।[১] যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তারা বলে, ‘আমরা এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে।’[২] ওরা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে, আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন।[৩] নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না, যে মিথ্যাবাদী অবিশ্বাসী। [৪]
[১] এটা সেই খালেস ইবাদতের তাকীদ যার আদেশ পূর্বের আয়াতে দেওয়া হয়েছে, আর তা হল ইবাদত ও আনুগত্য একমাত্র এক আল্লাহর জন্যই শোভনীয়, তাঁর ইবাদতে কাউকে অংশীদার করা যাবে না এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর যোগ্যও নয়। তবে রসূল (সাঃ)-এরও আনুগত্য করতে হবে, কারণ রাসূলের আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য; অন্য কারোর নয়। এ কথা আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন। এর পরেও ইবাদতের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়। কারণ ইবাদত আল্লাহ ছাড়া কোন বড় থেকে বড় রসূলেরও করা বৈধ নয়; সাধারণ মানুষের, যাদেরকে মানুষ নিজের ইচ্ছামত আল্লাহর আসনে বসিয়ে রেখেছে, তারা তো দূরের কথা। (مَا أَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطَان) 'আল্লাহর পক্ষ থেকে এর কোন প্রমাণ নেই।'[২] এখান হতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহ তাআলাকেই স্রষ্টা, রুযীদাতা এবং বিশ্বজাহানের নিয়ন্ত্রণকারী বলে বিশ্বাস করত। অথচ তারা অন্যের ইবাদত কেন করত? এর উত্তর তারা এই বলে দিত, যা কুরআন পাক এখানে বর্ণনা করেছে। তা হল 'সম্ভবতঃ এদের দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারব অথবা এরা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে।' যেমন অন্য জায়গায় বলেছেন, (هَؤُلآءِ شُفَعَآؤُنَا عِنْدَ اللهِ) "এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী হবে।"
(সূরা ইউনুস ১০:১৮ আয়াত)
[৩] কারণ, পৃথিবীতে কেউ এটা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় যে, সে শিরক করছে বা সে ভুল পথে আছে। ফলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলাই ফায়সালা করবেন এবং ফায়সালা অনুযায়ী প্রতিদান ও শাস্তি দেবেন।[৪] সেই মিথ্যা উপাস্য দ্বারা তারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে বা ওরা তাদের জন্য সুপারিশ করবে --এ কথা একেবারে মিথ্যা এবং আল্লাহ ব্যতীত ক্ষমতাহীন ব্যক্তিদেরকে উপাস্য মনে করাও বড় অকৃতজ্ঞতা। এমন মিথ্যুক ও অকৃতজ্ঞরা কিভাবে হিদায়াত পাবে?
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ
📘 নিশ্চয় তোমার মৃত্যু হবে এবং ওদেরও মৃত্যু হবে।
ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عِنْدَ رَبِّكُمْ تَخْتَصِمُونَ
📘 অতঃপর কিয়ামতের দিনে তোমরা পরস্পর তোমাদের প্রতিপালকের সম্মুখে বাক-বিতন্ডা করবে। [১]
[১] অর্থাৎ, হে নবী! তুমি ও তোমার বিরোধী সকলেই মৃত্যুবরণ করে আখেরাতে আমার নিকট উপস্থিত হবে। পৃথিবীতে তোমাদের মাঝে তাওহীদ ও শিরকের ফায়সালা সম্ভব হয়নি এবং তুমি এই বিষয়ে ঝগড়া করতেই থেকেছ। কিন্তু আমি এখানে তার ফায়সালা করব এবং মুখলিস ও একত্ববাদে বিশ্বাসীদেরকে জান্নাতে এবং মুশরিক (অংশীবাদী), অস্বীকারকারী এবং মিথ্যাজ্ঞানকারীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব। উক্ত দুটি আয়াত দ্বারা নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ হয়। যেমন সূরা আলে ইমরানের ৩:১৪৪ নং আয়াতেও সে কথা প্রমাণ হয়। এই সব আয়াতসমূহ থেকে দলীল নিয়ে আবু বাকর সিদ্দীক (রাঃ) লোকেদের মাঝে নবী (সাঃ)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ করেছিলেন। অতএব নবী (সাঃ) সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখা যে, তিনি পৃথিবীতে যেমন জীবন পেয়েছিলেন, বারযাখী জীবন (কবরে)ও অনুরূপ জীবিত আছেন, কুরআনের স্পষ্ট দলীলের পরিপন্থী। তিনিও অন্যান্য মানুষের মত মৃত্যুবরণ করেছেন, ফলে তাঁকেও দাফন করা হয়েছে এবং কবরে তিনি অবশ্যই বারযাখী জীবন পেয়েছেন। তবে তা কেমন তার জ্ঞান আমাদের নেই। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহ যে কবরে তাঁকে পৃথিবীর মত জীবন দেওয়া হয়নি। (সাঃ)
۞ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
📘 যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বলে[১] এবং তার নিকট আগত সত্যকে মিথ্যাজ্ঞান করে,[২] তার অপেক্ষা অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? অবিশ্বাসীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি?
[১] অর্থাৎ, দাবী করে যে, আল্লাহর সন্তান-সন্ততি অথবা তাঁর শরীক আছে কিংবা তাঁর স্ত্রী আছে, অথচ তিনি এই সমস্ত জিনিস থেকে পাক ও পবিত্র।
[২] যাতে আছে তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব), (দ্বীনের) বিধি-বিধান ও ফরয কার্যাদি, পুনরুত্থান সম্পর্কীয় আকীদা ও বিশ্বাস, হারাম কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ এবং মু'মিনদের জন্য সুসংবাদ ও কাফেরদের জন্য ধমক ও শাস্তির কথা। এ হল সেই দ্বীন ও শরীয়ত, যা মুহাম্মাদ (সাঃ) নিয়ে আগমন করেছেন। এটাকে তারা মিথ্যা মনে করে।
وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ ۙ أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
📘 যারা সত্য এনেছে[১] এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে,[২] তারাই তো আল্লাহ-ভীরু।
[১] এ থেকে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। যিনি সত্য দ্বীন নিয়ে আগমন করেছেন। কারো কারো নিকট এ কথাটি সাধারণ এবং এর লক্ষ্য এমন সকল ব্যক্তি, যারা তাওহীদের দাওয়াত দেয় এবং আল্লাহর শরীয়তের প্রতি মানুষকে পথপ্রদর্শন করে।
[২] কেউ কেউ এ থেকে আবূ বাকার (রাঃ)-কে বুঝিয়েছেন। যিনি সর্ব প্রথম রসূল (সাঃ)-এর সত্যায়ন করেছেন এবং তাঁর উপর ঈমান এনেছেন। আবার কেউ কেউ এটাকে সাধারণ গণ্য করেছেন। যা সেই সমস্ত মু'মিনকে শামিল করে, যারা রসূল (সাঃ)-এর রিসালতের প্রতি ঈমান রাখে এবং তাঁকে সত্য নবী বলে মনে করে।
لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ عِنْدَ رَبِّهِمْ ۚ ذَٰلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِينَ
📘 এদের বাঞ্ছিত সমস্ত কিছুই এদের প্রতিপালকের নিকট বর্তমান,[১] এটিই সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান।[২]
[১] অর্থাৎ, মহান আল্লাহ তাদের পাপগুলো মাফ করে দেবেন এবং তাদের মর্যাদাও বাড়িয়ে দেবেন। কেননা, প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহর কাছে এটাই আশা রাখে। এ ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার পর তো প্রত্যেক বাঞ্ছিত জিনিস পাওয়া যাবে।
[২] مُحْسِنيْنَ এর একটি অর্থ হল, যাঁরা নেক কাজ করেন। দ্বিতীয় অর্থ হল, যাঁরা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করেন। যেমন, হাদীসে 'ইহসান'এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, (أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ) "তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে কর যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি এ রকম ভাব সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তবে এটা যেন অবশ্যই মনে করা হয় যে, তিনি তোমাকে দেখছেন।" তৃতীয় অর্থ, যাঁরা মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ ও উত্তম ব্যবহার করেন। চতুর্থ অর্থ হল, যাঁরা প্রত্যেক নেক কাজকে সুন্দরভাবে বিনয়-নম্রতা এবং নবী করীম (সাঃ)-এর সুন্নত অনুযায়ী সম্পাদন করেন। ইবাদতে আধিক্যের পরিবর্তে (যেটুকু করেন তাতে) সৌন্দর্যের খেয়াল রাখেন।
لِيُكَفِّرَ اللَّهُ عَنْهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي عَمِلُوا وَيَجْزِيَهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ
📘 কারণ, এরা যে সব মন্দ কাজ করেছিল, আল্লাহ তা ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদের কৃত সৎকাজের জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন।
أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ ۖ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِنْ دُونِهِ ۚ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
📘 আল্লাহ কি তাঁর দাসের জন্য যথেষ্ট নন?[১] অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অপরের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন, তার জন্য কোন পথপ্রদর্শক নেই। [২]
[১] এখানে 'দাস' বলতে নবী করীম (সাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। কারো কারো নিকট এটা সাধারণ। সমস্ত নবী এবং প্রত্যেক মু'মিন এতে শামিল। অর্থ হল, তোমাকে গায়রুল্লাহর ভয় দেখানো হয়, কিন্তু আল্লাহ যখন তোমার সমর্থক ও সাহায্যকারী, তখন তোমার কেউ কিছুই করতে পারবে না। তোমার পক্ষ হতে তাদের মোকাবেলার জন্য তিনিই যথেষ্ট।
[২] যে এই ভ্রষ্টতা থেকে বের করে হিদায়াতের রাস্তা ধরিয়ে দেবে।
وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ ۗ أَلَيْسَ اللَّهُ بِعَزِيزٍ ذِي انْتِقَامٍ
📘 এবং যাকে আল্লাহ পথনির্দেশ করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না,[১] আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধগ্রহণকারী নন? [২]
[১] যে তাকে এই হিদায়াত থেকে বের করে ভ্রষ্টতার গর্তে নিক্ষেপ করবে। অর্থাৎ, হিদায়াত দান ও ভ্রষ্ট করা সবই আল্লাহর কাজ। তিনি যাকে চান ভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হিদায়াত দানে ধন্য করেন।
[২] কেন নন, অবশ্যই। এই জন্য যে, যদি এই লোকেরা কুফরী ও অবাধ্যতা থেকে ফিরে না আসে, তবে তিনি অবশ্যই তাঁর বন্ধুদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং তাদেরকে শিক্ষামূলক প্রতিফল ভোগ করাবেন।
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۚ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ ۚ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ ۖ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
📘 তুমি যদি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন?’ ওরা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বল, ‘তাহলে তোমরা ভেবে দেখেছ কি? আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা তাঁকে ছাড়া যাদেরকে আহবান কর, তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সেই অনুগ্রহকে রোধ করতে পারবে?’ বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।[১] নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে থাকে।’[২]
[১] কেউ কেউ বলেন যে, যখন নবী (সাঃ) উল্লিখিত প্রশ্ন তাদের সামনে পেশ করলেন, তখন তারা বলল যে, সত্যিই তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কোন জিনিসকে দূর করতে পারবে না, তবে তারা সুপারিশ করবে। এরই ভিত্তিতে এই অংশটুকু অবতীর্ণ হয়েছে যে, সমস্ত কার্যকলাপের ব্যাপারে আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
[২] যখন সমস্ত কিছু তাঁরই এখতিয়ারে, তখন অন্যের উপর নির্ভর করায় লাভ কি? এই জন্য ঈমানদারেরা কেবল তাঁরই উপর নির্ভর করে থাকে। তিনি ব্যতীত অন্য কারো উপর তারা নির্ভর করে না, ভরসা ও আস্থা রাখে না।
قُلْ يَا قَوْمِ اعْمَلُوا عَلَىٰ مَكَانَتِكُمْ إِنِّي عَامِلٌ ۖ فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ
📘 বল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা স্ব-স্ব অবস্থায় কাজ করতে থাক, আমিও আমার কাজ করছি।[১] অতঃপর শীঘ্রই জানতে পারবে--
[১] অর্থাৎ, যদি তোমরা আমার এই তাওহীদের দাওয়াতকে কবুল না কর, যা দিয়ে আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন, তবে ঠিক আছে, তোমাদের ইচ্ছা। তোমরা যে অবস্থায় আছ, তারই উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আর আমিও এই অবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকছি, যার উপর আল্লাহ আমাকে রেখেছেন।
لَوْ أَرَادَ اللَّهُ أَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا لَاصْطَفَىٰ مِمَّا يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ سُبْحَانَهُ ۖ هُوَ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
📘 আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করতে ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। পবিত্র ও মহান তিনি![১] তিনিই আল্লাহ, এক, পরাক্রমশালী।
[১] অর্থাৎ, মুশরিকদের বিশ্বাস মত, তাঁর সন্তান হওয়ার প্রয়োজনই বা কি? বরং তিনি আপন সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকে পছন্দ করতেন, তাকেই সন্তানরূপে গ্রহণ করতে পারতেন। তাদেরকে নয় যাদেরকে তারা তাঁর সন্তান বলে আখ্যায়িত করে থাকে। কিন্তু আসলে আল্লাহ তো এই ত্রুটি থেকে পবিত্র।
(ইবনে কাসীর)
مَنْ يَأْتِيهِ عَذَابٌ يُخْزِيهِ وَيَحِلُّ عَلَيْهِ عَذَابٌ مُقِيمٌ
📘 কার ওপর লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আসবে[১] এবং স্থায়ী শাস্তি আপতিত হবে।’ [২]
[১] যার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, সত্যের ওপর কারা আছে এবং বাতিলের ওপর কারা আছে? এ থেকে পার্থিব আযাব বুঝানো হয়েছে। যেমন বদর যুদ্ধে ঘটেছিল। এতে কাফেরদের মধ্য থেকে ৭০ জন লোক মারা গিয়েছিল এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিল। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব মুসলিমরাই লাভ করেছিল। এর পর থেকে কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনা ও অবমাননা বই কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
[২] এর অর্থ জাহান্নামের আযাব, যা কাফেররা চির দিনকার জন্য ভোগ করতে থাকবে।
إِنَّا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ لِلنَّاسِ بِالْحَقِّ ۖ فَمَنِ اهْتَدَىٰ فَلِنَفْسِهِ ۖ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا ۖ وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِوَكِيلٍ
📘 আমি মানুষের জন্য তোমার প্রতি সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি; অতঃপর যে সৎপথ অবলম্বন করে, সে তা নিজেরই কল্যাণের জন্য করে এবং যে বিপথগামী হয়, সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য। আর তুমি ওদের তত্ত্বাবধায়ক নও।[১]
[১] মক্কাবাসীদের কুফরীর উপর অটল থাকা নবী (সাঃ)-এর জন্য ছিল বড়ই কষ্টকর। তাই এই আয়াতে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, তোমার দায়িত্ব কেবল এই কিতাবের কথা বর্ণনা করে দেওয়া, যা আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি। তাদেরকে হিদায়াত দান করার দায়িত্ব তোমার নয়। যদি তারা হিদায়াতের পথ অবলম্বন করে নেয়, তবে তাতে তাদেরই লাভ। আর যদি তা অবলম্বন না করে, তবে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হবে। وَكِيل অর্থ, দায়িত্বপ্রাপ্ত, যিম্মেদার। অর্থাৎ, তাদের হিদায়াতের দায়িত্ব তোমার উপর নেই। পরবর্তী আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর এমন এক পরিপূর্ণ কুদরতের এবং বিস্ময়কর কর্মের কথা উল্লেখ করছেন, যা মানুষ প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করে। আর তা হল, যখন সে ঘুমিয়ে যায়, তখন তার আত্মা আল্লাহর নির্দেশে তার (দেহ) থেকে যেন বেরিয়েই যায়। কেননা, তখন তার অনুভূতি ও বোধশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর যখন সে জেগে ওঠে, তখন আত্মাকে ঠিক যেন তার মধ্যে পুনরায় প্রেরণ করা হয়। ফলে তার অনুভূতি পূর্বের ন্যায় ফিরে আসে। অবশ্য যার জীবনের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যায়, তার আত্মা আর ফিরে আসে না এবং সে মৃত্যুর হাতে ধরা খায়। এটাকেই মুফাসসিরগণ 'ওয়াফাতে কুবরা' (বড় মৃত্যু) এবং 'অফাতে স্বুগরা' (ছোট মৃত্যু) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنْفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا ۖ فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُسَمًّى ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
📘 মৃত্যুর সময় আল্লাহ প্রাণ হরণ করেন[১] এবং যারা জীবিত তাদেরও চেতনা হরণ করেন ওরা যখন নিদ্রিত থাকে।[২] অতঃপর যার জন্য মৃত্যু অবধারিত করেছেন, তিনি তার প্রাণ রেখে দেন[৩] এবং অপরকে এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চেতনা ফিরিয়ে দেন।[৪] এতে অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।[৫]
[১] এটা হল বড় মৃত্যু। এতে রূহকে ধরে নেওয়া হয়। আর ফিরে আসে না।[২] অর্থাৎ, যার মৃত্যুর সময় এখনো আসেনি, নিদ্রাকালে তারও রূহ কবয করে তাকে ছোট মৃত্যুতে পতিত করেন।[৩] এটা সেই বড় মৃত্যু, যার কথা এখনি আলোচনা হল। এতে রূহকে আর ছাড়া হয় না।[৪] অর্থাৎ, যতক্ষণ পর্যন্ত তার নির্ধারিত সময় আসে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মা আসা-যাওয়া করে। এটা হল ছোট মৃতু। এই বিষয়টাই সূরা আনআমের ৬:৬০-৬১ নং আয়াতে আলোচিত হয়েছে। তবে সেখানে ছোট মৃত্যুর কথা প্রথমে এবং বড় মৃত্যুর কথা পরে বর্ণিত হয়েছে। আর এখানে তার বিপরীত এসেছে।[৫] অর্থাৎ, রূহকে ধরা ও ছাড়া এবং মরণ ও জীবনের ব্যাপারটা প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের উপর সর্বশক্তিমান এবং কিয়ামতের দিন তিনি মৃতদেরকে অবশ্যই জীবিত করবেন।
أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ ۚ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ
📘 তবে কি ওরা আল্লাহকে ছেড়ে (অন্যদেরকে) সুপারিশকারী স্থির করেছে? বল, ওদের কোন ক্ষমতা না থাকলেও এবং ওরা না বুঝলেও কি? [১]
[১] অর্থাৎ, সুপারিশ করার এখতিয়ার থাকা তো দূরের কথা, তারা তো সুপারিশের অর্থ যে কি, তা-ই বুঝে না। কেননা, তারা হল পাথর অথবা জ্ঞানশূন্য বস্তু।
قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا ۖ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
📘 বল, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই এখতিয়ারে,[১] আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই, অতঃপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে।’
[১] অর্থাৎ, সমস্ত ধরনের সুপারিশের মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। অতএব কেবল এক আল্লাহরই ইবাদত কেন করা হয় না, যাতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং সুপারিশের জন্য কোন মাধ্যম খোঁজার প্রয়োজনই না পড়ে।
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
📘 ‘আল্লাহ এক’ --এ কথা উল্লেখ করা হলে যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয়।[১] আর আল্লাহর পরিবর্তে (তাদের উপাস্যদের কথা) উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।[২]
[১] অথবা কুফরী ও অহংকার করে অথবা তাদের মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, মুশরিকদেরকে যখন বলা হয় যে, উপাস্য কেবল একজনই, তখন তাদের মন তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় না।
[২] তবে হ্যাঁ, যখন বলা হয় যে, অমুক অমুকরাও উপাস্য অথবা তারাও তো আল্লাহরই ওলীই বটে, তাদেরও কিছু এখতিয়ার আছে, তারাও বিপদাপদ দূর এবং প্রয়োজনাদি পূরণ করার সামর্থ্য রাখে, তখন মুশরিকরা বড়ই আনন্দিত হয়। সঠিক পথচ্যুত লোকদের এই অবস্থা আজও বিদ্যমান। যখন তাদেরকে বলা হয়, কেবল বল, 'ইয়া আল্লাহ মদদ' কারণ তিনি ছাড়া তো কেউ সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না, তখন তারা চরম অসন্তুষ্ট হয়। এ বাক্য তাদের কাছে বড়ই অপছন্দনীয়। কিন্তু যদি বলা হয়, 'ইয়া আলী মদদ' অথবা 'ইয়া রাসূলুল্লাহ মদদ' অনুরূপভাবে অন্যান্য মৃতদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয় যেমন, যদি বলা হয়, 'হে পীর আব্দুল ক্বাদের! আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দিন!' তবে তাদের অন্তর আনন্দে নেচে ওঠে। বস্তুতঃ এদেরও চিন্তা-চেতনা ওদেরই মতই।
قُلِ اللَّهُمَّ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِي مَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ
📘 বল, ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা হে আল্লাহ! তোমার দাসগণ যে বিষয়ে মতবিরোধ করে, তুমি সে বিষয়ে তাদের মাঝে ফায়সালা করে দেবে।’ [১]
[১] হাদীসে এসেছে যে, নবী করীম (সাঃ) রাতের তাহাজ্জুদ নামাযের শুরুতে এই দু'আ পড়তেন, ((اللَّهُمَّ رَبَّ جَبْرَائِيلَ وَمِيكَائِيلَ وَإِسْرَافِيلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ، اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنْ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ، إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ )) অর্থাৎ, হে আল্লাহ! হে জিবরীল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের প্রভু! হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকর্তা! হে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা! তুমি তোমার বান্দাদের মাঝে মীমাংসা কর যে বিষয়ে ওরা মতভেদ করে। যে বিষয়ে মতভেদ করা হয়েছে সে বিষয়ে তুমি আমাকে তোমার অনুগ্রহে সত্য পথ দেখাও। নিশ্চয় তুমি যাকে ইচ্ছা সরল পথ দেখিয়ে থাক।
(মুসলিম, আবূ দাঊদ ৭৬৭, মিশকাত ১২১২নং)
وَلَوْ أَنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لَافْتَدَوْا بِهِ مِنْ سُوءِ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللَّهِ مَا لَمْ يَكُونُوا يَحْتَسِبُونَ
📘 যারা সীমালংঘন করেছে; যদি তাদের পৃথিবীর সমস্ত কিছু এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও কিছু থাকত, তাহলে কিয়ামতের দিন নিকৃষ্ট শাস্তি হতে মুক্তির জন্য পণ স্বরূপ তা প্রদান করত।[১] তাদের সামনে আল্লাহর নিকট হতে এমন কিছু প্রকাশ হবে, যা ওরা কল্পনাও করেনি।[২]
[১] তবুও তা গৃহীত হতো না। যেমন, অন্যত্র আরো পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ﴿فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِلءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَى بِهِ﴾ (آل عمران: ৯১) "যদি সারা পৃথিবী পরিমাণ সোনাও তার পরিবর্তে দেওয়া হয়, তবুও তা কবুল করা হবে না।" কারণ, ﴿وَلاَ يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ﴾ (البقرة: ৪৮) "সেখানে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না।"
[২] অর্থাৎ, আযাবের কঠিনতা, ভয়াবহতা এবং তা এত প্রকারের হবে যে, তা হয়তো কোনদিন তাদের ধারণা ও কল্পনাতেও আসেনি। (অথবা যে সকল কাজ তারা ভালো মনে করে করেছিল তা তাদের সামনে আল্লাহর নিকট খারাপ রূপে প্রকাশ পাবে; যা ওরা কল্পনাও করেনি যে, তা আসলে খারাপ কাজ।)
وَبَدَا لَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
📘 ওদের কৃতকর্মের মন্দ ফল ওদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়বে[১] এবং ওরা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা ওদেরকে পরিবেষ্টন করবে।[২]
[১] অর্থাৎ, দুনিয়ায় যেসব হারাম ও অন্যায় কার্যকলাপে তারা জড়িত ছিল, তার শাস্তি তাদের সামনে এসে যাবে।
[২] সেই আযাব তাদেরকে ঘিরে ফেলবে, যাকে দুনিয়াতে তারা অসম্ভব মনে করত এবং যার কারণে সে (আযাবের) ব্যাপারে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপও করত।
فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَىٰ عِلْمٍ ۚ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
📘 মানুষকে দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করলে সে আমাকে আহবান করে;[১] অতঃপর যখন আমি তাকে অনুগ্রহ প্রদান করি, তখন সে বলে, ‘আমি তো এ আমার জ্ঞানের মাধ্যমে লাভ করেছি।’[২] বস্তুতঃ এ এক পরীক্ষা,[৩] কিন্তু ওদের অধিকাংশই জানে না। [৪]
[১] এখানে মানুষের উল্লেখ 'জাতি' হিসাবে করা হয়েছে। অর্থাৎ, অধিকাংশ মানুষেরই এই অবস্থা যে, যখন তারা রোগ, অভাব-অনটন অথবা অন্য কোন সমস্যার শিকার হয়, তখন তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তার সামনে কাকুতি-মিনতি করে।
[২] অর্থাৎ, নিয়ামত লাভ করার সাথে সাথেই অবাধ্যতা ও ধৃষ্টতার পথ অবলম্বন করে নেয় এবং বলে যে, এতে আল্লাহর আবার অনুগ্রহ কি? এ তো আমার পারদর্শিতার ফল। অথবা যে জ্ঞান ও দক্ষতা আমার রয়েছে, তারই মাধ্যমে এসব নিয়ামত অর্জিত হয়েছে। কিংবা আমি জানতাম যে, দুনিয়াতে এই সমস্ত জিনিস আমি পাব। কেননা, আল্লাহর নিকট আমার সম্মান অনেক।
[৩] অর্থাৎ, ব্যাপার তা নয়, যা তুমি মনে করছ অথবা বর্ণনা করছ। বরং এই নিয়ামতগুলো তোমার জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। এই দেখার জন্য যে, তুমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছ, না অকৃতজ্ঞ হচ্ছ।
[৪] এই কথা যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে অবকাশ ও পরীক্ষা।
خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ ۖ يُكَوِّرُ اللَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى اللَّيْلِ ۖ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ ۖ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى ۗ أَلَا هُوَ الْعَزِيزُ الْغَفَّارُ
📘 তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত্রি দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা,[১] চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি করেছেন নিয়মাধীন। প্রত্যেকেই আবর্তন করে এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত। জেনে রাখ, তিনি পরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।
[১] تَكْوِيْرٌ -এর অর্থ এক বস্তুকে অপর বস্তুর উপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়া, রাত্রিকে দিনের উপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হল, রাত্রি আনয়ন করে দিনকে ঢেকে দিয়ে তার আলো শেষ করে দেওয়া এবং দিনকে রাত্রির পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হল, দিন আনয়ন করে রাত্রিকে ঢেকে দিয়ে তার অন্ধকার শেষ করে দেওয়া। এর অর্থ এবং (يُغْشِيْ الَّيْلَ النَّهَارَ) (الأعراف-৫৪) এর অর্থ একই।
قَدْ قَالَهَا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَمَا أَغْنَىٰ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
📘 ওদের পূর্ববর্তীগণও তাই বলত, কিন্তু ওদের কৃতকর্ম ওদের কোন কাজে আসেনি। [১]
[১] যেমন, কারূনও বলেছিল। কিন্তু পরিশেষে তাকেও তার ধন-ভান্ডার সহ যমীনে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। فَمَا أَغْنَى তে ما অক্ষরটি 'ইস্তিফহামিয়া' (জিজ্ঞাসাবাচক)ও হতে পারে এবং 'নাফিয়া' (নেতিবাচক)ও হতে পারে। আর উভয় অর্থই সঠিক।
فَأَصَابَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا ۚ وَالَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْ هَٰؤُلَاءِ سَيُصِيبُهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا وَمَا هُمْ بِمُعْجِزِينَ
📘 সুতরাং ওদের দুষ্কর্মের পাপরাশি ওদের উপর আপতিত হয়েছে।[১] আর ওদের মধ্যে যারা সীমালংঘন করে, তাদেরও দুষ্কর্মের পাপরাশি তাদের উপর আপতিত হবে এবং ওরা আল্লাহর শাস্তি ব্যাহত করতে পারবে না। [২]
[১] 'পাপরাশি' বলতে এখানে তাদের পাপরাশির মন্দ ফল বা শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। শব্দের মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষ্য রেখে পাপের মন্দ ফলকে পাপ বলা হয়েছে। যেমন, ﴿وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِثْلُهَا﴾ তে বলা হয়েছে। তাছাড়া পাপের শাস্তি পাপ নয়।
[২] এ হল মক্কার কাফেরদের জন্য হুঁশিয়ারি। আর হলও তাই। এরাও বিগত জাতির মত অনাবৃষ্টি, হত্যা এবং বন্দিদশা ইত্যাদির শিকার হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে আগত এই আযাবগুলোকে তারা রোধ করতে পারেনি।
أَوَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
📘 ওরা কি জানে না যে, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা তার রুযী বর্ধিত করেন অথবা হ্রাস করেন? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।[১]
[১] অর্থাৎ, রুযীর প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতার মধ্যেও আল্লাহর তাওহীদের দলীল বিদ্যমান। অর্থাৎ, এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বজাহানে কেবল তাঁরই নির্দেশ ও কর্তৃত্ব চলে। তাঁরই পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কার্যকর ও প্রভাবশীল। এই জন্য তিনি যাকে চান তাকে প্রচুর ধন দিয়ে ধন্য করেন এবং যাকে চান তাকে অভাব-অনটনে নাজেহাল করেন। তাঁর এই বিচার-বিবেচনায় -- যা তাঁর সুকৌশল ও ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত -- না কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে, আর না তাতে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তবে এই নিদর্শনাবলী কেবল ঈমানদারদের জন্যই ফলপ্রসূ হয়। কেননা, তারাই এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে উপকৃত হয় এবং আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে।
۞ قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
📘 ঘোষণা করে দাও (আমার এ কথা), হে আমার দাসগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছ, তারা আল্লাহর করুণা হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত পাপ মাফ করে দেবেন। নিশ্চয় তিনিই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [১]
[১] এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর মহা ক্ষমাশীলতার কথা বর্ণনা করেছেন। إسرَاف 'ইসরাফ' অর্থ পাপের আধিক্য ও তার প্রাচুর্য। "আল্লাহর করুণা হতে নিরাশ হয়ো না" এর অর্থ, ঈমান আনার পূর্বে অথবা তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে যতই গুনাহ করে থাক, মানুষ যেন এই মনে না করে যে, আমি তো অনেক বড় পাপী, আমাকে আল্লাহ কিভাবে ক্ষমা করবেন? বরং সত্য হৃদয়ে যদি ঈমান আনে বা নিষ্ঠার সাথে যদি তওবা করে, তবে মহান আল্লাহ সমস্ত পাপকে মাফ করে দেবেন। আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণিক ঘটনা থেকেও এই অর্থই সাব্যস্ত হয়। কিছু কাফের ও মুশরিক এমন ছিল, যারা প্রচুর হত্যা ও ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল। এরা নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল যে, আপনার দাওয়াত তো সঠিক, কিন্তু আমরা অনেক পাপের পাপী। যদি আমরা ঈমান আনি, তবে এই সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে কি? এরই ভিত্তিতে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।
(সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরা যুমার)
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশায় খুব পাপ করে যাও। তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান ও ফরয কার্যাদির ব্যাপারে কোনই পরোয়া করো না এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা ও নিয়ম-নীতি নিষ্ঠুরতার সাথে লঙ্ঘন করে যাও। এইভাবে তাঁর ক্রোধ ও প্রতিশোধকে আহবান জানিয়ে তাঁর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশা করা একেবারে বোকামি ও খামখেয়ালী। এটা হল নিম ফলের বীজ লাগিয়ে আঙ্গুর ফলের আশা রাখার মতই। এই ধরনের মানুষের স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি যেমন তাঁর বান্দাদের জন্য غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ তেমনি তিনি তাঁর অবাধ্যজনদের জন্য عَزِيْزٌ ذُو اْنْتِقَامٍ ও বটেন। তাই তো কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে এই উভয় দিককে এক সাথেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, ﴿نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ، وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ﴾ অর্থাৎ, আমার বান্দাদেরকে বলে দাও, নিশ্চয় আমিই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তিই হল অতি মর্মন্তুদ শাস্তি।
(সূরা হিজর ১৫:৪৯-৫০ আয়াত)
সম্ভবতঃ এটাই কারণ যে, এখানে আয়াতের আরম্ভ يَا عِبَادِيْ (হে আমার বান্দাগণ!) দিয়ে হয়েছে। যার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে অথবা সত্য হৃদয়ে তওবা করে প্রকৃত অর্থে সে তাঁর বান্দা হয়ে যাবে, তার পাপ যদি সমুদ্রের ফেনা বরাবরও হয়, তবুও তা মাফ হয়ে যাবে। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়াবান। যেমন, হাদীসে একশত মানুষের খুনীর তওবার ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে।
(বুখারীঃ আম্বিয়া
অধ্যায়, মুসলিমঃ তওবা অধ্যায়)
وَأَنِيبُوا إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ
📘 তোমাদের নিকট শাস্তি আসার পূর্বে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর; শাস্তি এসে পড়লে তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।
وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ
📘 তোমাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের ওপর অতর্কিতে শাস্তি আসার পূর্বে তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর।[১]
[১] অর্থাৎ, আযাব আসার পূর্বে তওবা এবং নেক আমলের প্রতি যত্নবান হয়ে যাও। কেননা, যখন আযাব আসবে, তখন তার কোন খবর তোমাদের থাকবে না এবং তোমরা টেরও পাবে না। এ থেকে পার্থিব আযাব বুঝানো হয়েছে।
أَنْ تَقُولَ نَفْسٌ يَا حَسْرَتَا عَلَىٰ مَا فَرَّطْتُ فِي جَنْبِ اللَّهِ وَإِنْ كُنْتُ لَمِنَ السَّاخِرِينَ
📘 যাতে কাউকেও বলতে না হয়, ‘হায়! আল্লাহর প্রতি আমার কর্তব্যে আমি তো শৈথিল্য করেছি।[১] আর অবশ্যই আমি ঠাট্টা-বিদ্রূপকারীদের একজন ছিলাম।’
[১] فِي جَنْبِ اللهِ এর অর্থ, আল্লাহর আনুগত্য। অর্থাৎ, কুরআন অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে শৈথিল্য। অথবা جَنْبٌ এর অর্থ, নিকট ও পাশে হওয়া। অর্থাৎ, আল্লাহর নৈকট্য (বা জান্নাত) কামনা করার ব্যাপারে শৈথিল্য করেছি।
أَوْ تَقُولَ لَوْ أَنَّ اللَّهَ هَدَانِي لَكُنْتُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
📘 অথবা কেউ না বলে, ‘আল্লাহ আমাকে পথপ্রদর্শন করলে আমি তো অবশ্যই সাবধানীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ [১]
[১] অর্থাৎ, যদি আল্লাহ আমাকে হিদায়াত দান করতেন, তবে আমি শিরক এবং পাপাচার থেকে বেঁচে যেতাম। এটা ঠিক মুশরিকদের উক্তির মতই; যা অন্যত্র উদ্ধৃত হয়েছে।﴿لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا﴾ "যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহলে আমরা শিরক করতাম না।"
(সূরা আনআম ৬:১৪৮)
তাদের এই কথা كَلِمَةُ حَقٍّ أُرِيْدَ بِهِ الْبَاطِلُ (কথা ভালো কিন্তু উদ্দেশ্য মন্দ)এর মতনই।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
أَوْ تَقُولَ حِينَ تَرَى الْعَذَابَ لَوْ أَنَّ لِي كَرَّةً فَأَكُونَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
📘 অথবা শাস্তি প্রত্যক্ষ করলে যেন কাকেও বলতে না হয়, ‘হায়! যদি একবার পৃথিবীতে আমার প্রত্যাবর্তন ঘটত, তাহলে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম।’
بَلَىٰ قَدْ جَاءَتْكَ آيَاتِي فَكَذَّبْتَ بِهَا وَاسْتَكْبَرْتَ وَكُنْتَ مِنَ الْكَافِرِينَ
📘 (আল্লাহ বলবেন,) প্রকৃত ব্যাপার তো এই যে, আমার নিদর্শনসমূহ তোমার নিকট এসেছিল; কিন্তু তুমি ঐগুলিকে মিথ্যা বলেছিলে এবং অহংকার করেছিলে। আর তুমি ছিলে অবিশ্বাসীদের একজন। [১]
[১] এটা মহান আল্লাহ তাদের বাসনামূলক উক্তির উত্তরে বলবেন।
خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ ۚ يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلَاثٍ ۚ ذَٰلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ فَأَنَّىٰ تُصْرَفُونَ
📘 তিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন।[১] অতঃপর তিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন।[২] তিনি তোমাদের জন্য আট প্রকার পশু অবতীর্ণ করেছেন।[৩] তিনি তোমাদের মাতৃগর্ভের তিন প্রকার অন্ধকারে[৪] পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি[৫] করেন। তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক, সার্বভৌমত্ব তাঁরই, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। অতএব তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলেছ? [৬]
[১] অর্থাৎ, আদম (আঃ) থেকে, তাঁকে আল্লাহ তাআলা নিজ হাত দ্বারা তৈরী করেছিলেন এবং তাঁর মধ্যে নিজ রূহ ফুঁকেছিলেন।[২] অর্থাৎ, হাওয়াকে আদম (আঃ)-এর বামপার্শ্বের অস্থি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এটাও তাঁর কুদরতের বড় কৃতিত্ব। কারণ হাওয়া ছাড়া কোন নারীর সৃষ্টি কোন পুরুষের অস্থি থেকে হয়নি। ফলে হাওয়ার সৃষ্টি সাধারণ নিয়ম-বহির্ভূত এবং আল্লাহর মহাশক্তির একটি নিদর্শন।[৩] এই আয়াতে সেই চার প্রকার চতুষ্পদ জন্তুর (ছাগল, ভেঁড়া, উট, গরু) বর্ণনা হয়েছে, যা নর ও মাদা মিলে আট প্রকার হচ্ছে, যার বর্ণনা সূরা আনআমের ৬:১৪৩-১৪৪ নং আয়াতে পার হয়ে গেছে। أَنْزَلَ خَلَقَ (সৃষ্টির) অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অথবা এক বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা প্রথমে এই সকল চতুষ্পদ জন্তুকে জান্নাতে সৃষ্টি করেছিলেন এবং পরে তাদেরকে অবতীর্ণ করেন। সুতরাং এক্ষেত্রে إنزال এর মূল অর্থ ধরতে হবে। অথবা أَنْزَلَ শব্দ এখানে রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ এসব চতুষ্পদ জন্তু ঘাস-পাতা ছাড়া বাঁচতে পারে না। আর ঘাস-পাতার জন্য আকাশ থেকে অবতীর্ণ পানি নিতান্ত জরুরী। তাই মূলতঃ চতুষ্পদ জন্তু আকাশ থেকেই অবতীর্ণ হয়েছে বলা যায়।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[৪] প্রথম অন্ধকার মায়ের পেট, দ্বিতীয় গর্ভাশয়, তৃতীয় ঝিল্লী; সেই পাতলা আবরণ যাতে বাচ্চা জড়ানো থাকে।[৫] অর্থাৎ, ভ্রূণ মাতৃগর্ভে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে, প্রথমে বীর্য, অতঃপর রক্তপিন্ড, অতঃপর গোশতপিন্ড, অতঃপর অস্থির গঠন, তার উপর মাংসের আবরণ। এই সকল স্তর অতিক্রম করার পর পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরী হয়।[৬] অথবা কেন তোমরা হক থেকে বাতিলের দিকে এবং হিদায়াত থেকে ভ্রষ্টতার দিকে ফিরে চলেছ?
وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى اللَّهِ وُجُوهُهُمْ مُسْوَدَّةٌ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْمُتَكَبِّرِينَ
📘 যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে।[১] অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? [২]
[১] কালো হওয়ার কারণ হবে, আযাবের ভয়াবহতা এবং আল্লাহর ক্রোধের প্রত্যক্ষ দর্শন।
[২] হাদীসে এসেছে যে, ((الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ)) "অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তাচ্ছিল্য করা।" এখানে 'ইস্তিফহাম' (প্রশ্ন) তাকরীরী (স্বীকৃতিমূলক; যার অর্থ হয় সাব্যস্ত করা)। অর্থাৎ, আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে যে অহংকার প্রদর্শন করে, তার ঠিকানা হল জাহান্নাম।
وَيُنَجِّي اللَّهُ الَّذِينَ اتَّقَوْا بِمَفَازَتِهِمْ لَا يَمَسُّهُمُ السُّوءُ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
📘 আল্লাহ সাবধানীদেরকে তাদের সাফল্য সহ উদ্ধার করবেন;[১] অমঙ্গল তাদেরকে স্পর্শ করবে না এবং তারা দুঃখও পাবে না। [২]
[১] مَفَازَةٌ শব্দটি হল 'মাসদার মীমী' (ক্রিয়ামূল)। অর্থাৎ, فَوْزٌ (সাফল্য) হল, অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভ করা। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা আল্লাহভীরুদেরকে সেই সফলতা ও সৌভাগ্যের কারণে মুক্তি দেবেন, যা পূর্ব থেকেই তাঁর নিকটে তাদের জন্য সাব্যস্ত হয়ে আছে।
[২] তারা দুনিয়াতে যা কিছু ছেড়ে এসেছে, তার জন্য তাদের কোন দুঃখ হবে না। আর যেহেতু তারা কিয়ামতের ভয়াবহতা হতে সুরক্ষিত থাকবে, তাই তারা কোন ব্যাপারে চিন্তিত ও দুঃখিত হবে না।
اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ
📘 আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর কর্মবিধায়ক। [১]
[১] অর্থাৎ, প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টাও তিনি এবং মালিকও তিনিই। তিনি যেভাবে চান, পরিচালনা করেন। প্রতিটি জিনিস তাঁর আয়ত্তে ও তাঁর পরিচালনার অধীনে বন্দী। কারো অবাধ্যতা করার অথবা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। وكيل (উকীল) অর্থ, দায়িত্বপ্রাপ্ত, কর্মবিধায়ক। প্রতিটি জিনিসই তাঁরই অধীনে এবং তিনি কারো অংশীদারী ছাড়াই সমস্ত কিছুর হেফাযত ও পরিচালনা করেন।
لَهُ مَقَالِيدُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
📘 আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবিসমূহ তাঁরই নিকট।[১] যারা আল্লাহর আয়াত (বাক্য)কে অস্বীকার করে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।[২]
[১] مَقَالِيْدٌ হল, مِقْلَدٌ এবং مِقْلاَدٌ এর বহুবচন।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
কেউ এর অর্থ করেছেন, চাবিসমূহ। আবার কেউ এর অর্থ করেছেন, ধন-ভান্ডার। উভয় অর্থের উদ্দেশ্য একই। সমস্ত কার্যকলাপের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে।
[২] অর্থাৎ, পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা, এই কুফরীর কারণে তারা জাহান্নামে যাবে।
قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ
📘 বল, ‘হে অজ্ঞ ব্যক্তিরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ভিন্ন অন্যের ইবাদত (দাসত্ব) করতে বলছ?’[১]
[১] এ কথা কাফেরদের সেই আহবানের জওয়াবে বলা হচ্ছে, যাতে তারা ইসলামের পয়গম্বর মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে বলত যে, তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম অবলম্বন করে নাও, আর তাতে মূর্তিপূজাও ছিল।
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
📘 তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই অহী (প্রত্যাদেশ) করা হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহর অংশী স্থির কর, তাহলে অবশ্যই তোমার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্তদের শ্রেণীভুক্ত।[১]
[১] "যদি তুমি শিরক (আল্লাহর অংশী স্থির) কর" এর অর্থ হল, যদি তোমার মৃত্যু শিরকের উপরেই আসে এবং তা থেকে তওবা না কর। সম্বোধন নবী করীম (সাঃ)-কে করা হয়েছে, যিনি ছিলেন শিরক থেকে পাক ও পবিত্র এবং আগামীতে যে তাঁর দ্বারা শিরক হবে না, সে ব্যাপারেও নিশ্চয়তা ছিল। কেননা, নবী আল্লাহর হিফাযত ও তাঁর সংরক্ষণে থাকেন। তাঁর দ্বারা শিরক হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। আসলে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, পরোক্ষভাবে উম্মতকে বুঝানো, (যদিও সম্বোধন নবীকে করা হয়েছে)।
بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِينَ
📘 বরং তুমি আল্লাহরই ইবাদত (দাসত্ব) কর[১] এবং কৃতজ্ঞদের দলভুক্ত হও।
[১] إِيَّاكَ نَعْبُدُ এর মতই এখানেও 'মাফউল' (কর্মপদ, আল্লাহ) কে পূর্বে উল্লেখ করে 'হাসর' (নির্দিষ্টীকরণের) এর অর্থ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ, কেবল আল্লাহরই ইবাদত কর।
وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ
📘 ওরা আল্লাহর যথোচিত কদর করেনি।[১] কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী তাঁর হাতের মুঠোয় থাকবে এবং আকাশমন্ডলী থাকবে তাঁর ডান হাতে গুটানো।[২] পবিত্র ও মহান তিনি, ওরা যাকে অংশী করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
[১] কেননা, তাঁর কথাও মানেনি, যা তিনি নবীদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এবং ইবাদতকেও কেবল তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করেনি, বরং অন্যকেও তাতে শরীক করেছিল। হাদীসে এসেছে যে, "এক ইয়াহুদী পন্ডিত নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল যে, আমরা আল্লাহর ব্যাপারে (কিতাবে) এই কথা পাই যে, তিনি (কিয়ামতের দিন) আসমানসমূহকে এক আঙ্গুলে, যমীনসমূহকে আর এক আঙ্গুলে, গাছ-পালাকে এক আঙ্গুলে, পানি ও স্থলকে এক আঙ্গুলে এবং সমস্ত সৃষ্টিকুলকে এক আঙ্গুলে ধারণ করে বলবেন, আমিই সম্রাট।" নবী (সাঃ) মুচকি হেসে তার কথার সত্যায়ন করলেন এবং وَمَا قَدَرُوا اللهَ আয়াতটি তেলাঅত করলেন।
(সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরা যুমার)
মুহাদ্দিসীন ও সলফদের আকীদা হল, আল্লাহর যেসব গুণাবলী কুরআনে এবং সহীহ হাদীসসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে, (যেমন, এই আয়াতে হাতের এবং হাদীসে তাঁর আঙ্গুলের কথা প্রমাণিত) সেগুলোর উপর কোন ধরন-গঠন নির্ণয়, সাদৃশ্য আরোপ এবং অপব্যাখ্যা ও পরিবর্তন করা ছাড়াই ঈমান অত্যাবশ্যক। কাজেই এখানে বর্ণিত প্রকৃতত্বকে কেবল প্রবলতা ও শক্তিমত্তার অর্থে গ্রহণ করা সঠিক নয়।[২] এ ব্যাপারেও হাদীসে এসেছে যে, অতঃপর মহান আল্লাহ বলবেন, ((أَنَا الْمَلِكُ، أَيْنَ مُلُوْكُ الأرضِ)) "আমিই বাদশাহ, পৃথিবীর বাদশাহরা আজ কোথায়?
(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫৫২২ নং)
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ۖ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَىٰ فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ
📘 সেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ফলে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকলে মূর্ছিত হয়ে পড়বে;[১] তবে যাদেরকে আল্লাহ রক্ষা করতে ইচ্ছা করবেন তারা নয়।[২] অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, তখন ওরা দন্ডায়মান হয়ে তাকাতে থাকবে।[৩]
[১] কারো কারো নিকট (অকস্মাৎ প্রথম ফুঁকের পর) এটা হবে দ্বিতীয় ফুঁক। অর্থাৎ, এটা হবে বেহুঁশ হওয়ার ফুঁক। যার ফলে সবারই মৃত্যু হয়ে যাবে। কারো কারো নিকট এ ফুঁকই প্রথম ফুঁক। এর ফলেই প্রথমতঃ সকলে কঠিন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং পরে সবারই মৃত্যু হয়ে যাবে। কেউ কেউ এই ফুঁকগুলোর পর্যায়ক্রম এইভাবে বর্ণনা করেছেন; প্রথমঃ نَفْخَةُ الْفَنَاءْ (ধ্বংসের ফুঁক), দ্বিতীয়ঃ نَفْخَةُ الْبَعْثِ (পুনরুত্থানের ফুঁক), তৃতীয় نَفْخَةُ الصَّعْقِ (বেহুঁশ হওয়ার ফুঁক) এবং চতুর্থ, نَفْخَةُ الْقِيَامِ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ (বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ফুঁক)।
(আয়সারুত্ তাফাসীর)
আবার কারো কারো মতে ফুঁক কেবল দুটোই; نَفْخَة المَوتُ (মৃত্যুর ফুঁক) এবং نَفْخَةُ الْبَعْثِ (পুনরুত্থানের ফুঁক)। আবার কারো কারো নিকট ফুঁক তিনটি হবে। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
[২] অর্থাৎ, যার জন্য আল্লাহ চাইবেন তার মৃত্যু আসবে না। যেমন তারা হলেন জিবরীল, মীকাঈল, এবং ইস্রাফীল (আলাইহিমুস্ সালাম)। কেউ কেউ (বেহেশ্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত) রিযওয়ান ফিরিশতা, حَمَلَةُ الْعَرْشِ (আরশ উত্তোলনকারী ফিরিশতা) এবং জান্নাত ও জাহান্নামের দারোগার কথাও বলেছেন।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[৩] যাঁরা চার ফুঁকের কথা বলেছেন, তাদের কাছে এটা হবে চতুর্থ ফুঁক, যাঁরা তিন ফুঁকের কথা বলেছেন, তাদের কাছে এটা হবে তৃতীয় ফুঁক এবং যাঁরা দু'টি ফুঁকের কথা বলেছেন, তাদের কাছে এটা হবে দ্বিতীয় ফুঁক।
وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ وَجِيءَ بِالنَّبِيِّينَ وَالشُّهَدَاءِ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
📘 বিশ্ব-প্রতিপালকের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হবে বিশ্ব,[১] আমলনামা উপস্থিত করা হবে এবং নবীগণ ও সাক্ষীদেরকে আনয়ন করা হবে[২] এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে ও তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না। [৩]
[১] এই জ্যোতি বা নূর থেকে কেউ সুবিচার এবং নির্দেশ অর্থ নিয়েছেন। তবে এ থেকে প্রকৃত অর্থ নেওয়াতে কোন বাধা নেই। কেননা, আল্লাহ আসমান ও যমীনের নূর।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[২] নবীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমরা আমার বার্তা তোমাদের উম্মতদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলে? অথবা জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের উম্মত তোমাদের দাওয়াতের কি উত্তর দিয়েছিল? তা গ্রহণ করেছিল, না প্রত্যাখ্যান করেছিল? উম্মতে মুহাম্মাদীকে সাক্ষীস্বরূপ আনা হবে। সুতরাং তারা সাক্ষ্য দেবে যে, তোমার নবীগণ তোমার পয়গাম স্ব-স্ব জাতির নিকট পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর তুমিই তোমার কুরআনের মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছ।
[৩] অর্থাৎ, কারো প্রাপ্য নেকী-সওয়াবে কোন প্রকার কম করা হবে না এবং কাউকে তার অপরাধের অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হবে না।
إِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنْكُمْ ۖ وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ ۖ وَإِنْ تَشْكُرُوا يَرْضَهُ لَكُمْ ۗ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۗ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ مَرْجِعُكُمْ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ۚ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
📘 তোমরা অকৃতজ্ঞ হলে জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন।[১] তিনি তাঁর দাসদের অকৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন না। যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে তিনি তোমাদের কৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন।[২] আর একের ভার অন্যে বহন করবে না। অতঃপর তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে এবং তোমরা যা করতে, তিনি তোমাদেরকে তা অবগত করাবেন। নিশ্চয়ই তিনি অন্তরে যা আছে তা সম্যক অবগত।
[১] এর ব্যখ্যার জন্য সূরা ইবরাহীমের ১৪:৮ নং আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।[২] অর্থাৎ, মানুষ যদিও কুফর (অকৃতজ্ঞতা) আল্লাহর (সৃষ্টিগত) ইচ্ছায় করে, কারণ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোন কাজই হয় না এবং হওয়া সম্ভবও নয়; তবুও তিনি কুফরীকে পছন্দ করেন না। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র পথ শুকরের পথ, কুফরের নয়। অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর সন্তুষ্টি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এর পূর্বেও এ বিষয়টির বর্ণনা কোন কোন স্থানে করা হয়েছে। সূরা বাক্বারার ২:২৫৩ নং আয়াতের শেষাংশের টীকা দ্রষ্টব্য।
وَوُفِّيَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَا عَمِلَتْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَا يَفْعَلُونَ
📘 প্রত্যেকের কৃতকর্মের পরিপূর্ণ প্রতিফল দেওয়া হবে। ওরা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। [১]
[১] অর্থাৎ, তাঁর কোন লেখক, হিসাবরক্ষক এবং সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। এই আমলনামা এবং সাক্ষী কেবল হুজ্জত কায়েম এবং ওজর-বাহানা দূর করার জন্য হবে।
وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ جَهَنَّمَ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا فُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا ۚ قَالُوا بَلَىٰ وَلَٰكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ
📘 সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।[১] যখন ওরা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে, তখন তার দরজা খুলে দেওয়া হবে[২] এবং জাহান্নামের রক্ষীরা ওদেরকে বলবে, ‘তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে রসূল আসেনি; যারা তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত আবৃত্তি করত এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’ ওরা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল।[৩] কিন্তু সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি শাস্তির বাক্য বাস্তবায়িত হয়েছে।’ [৪]
[১] زُمَرٌ এর উৎপত্তি হল زَمْرٌ থেকে। অর্থ হল, শব্দ। প্রত্যেক দল বা জামাআতে শোরগোল অবশ্যই হয়, এই জন্য এটা জামাআত ও দল অর্থেও ব্যবহার হয়। অর্থাৎ, কাফেরদেরকে দল আকারে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। একটি দলের পিছনে থাকবে আর একটি দল। তাছাড়া তাদেরকে মারতে মারতে ও ধাক্কা দিতে দিতে পশুর পালের মত হাঁকিয়ে-ডাকিয়ে-তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। যেমন, অন্যত্র বলেছেন, ﴿يَوْمَ يُدَعُّونَ إِلَى نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا﴾ অর্থাৎ, সেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।
(সূরা ত্বূর ৫২:১৩ আয়াত) প্রকাশ থাকে যে, উক্ত শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে।
[২] অর্থাৎ, তাদের পৌঁছনোর সাথে সাথেই জাহান্নামের সাতটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। যাতে শাস্তিদানে কোন প্রকার বিলম্ব না হয়।[৩] অর্থাৎ, যেভাবে দুনিয়াতে তর্ক-বিতর্ক, কথা কাটাকাটি এবং ঝগড়া-ঝাঁটি করত, সেখানে কিন্তু সব কিছু চোখের সামনে এসে যাওয়ার পর তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাঁটির কোন অবকাশ থাকবে না। ফলে স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।[৪] অর্থাৎ, আমরা নবীদেরকে মিথ্যাজ্ঞান এবং তাঁদের বিরোধিতা করেছি, সেই দুর্ভাগ্যের কারণে যার আমরা উপযুক্ত ছিলাম। আমরা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাতিলকে গ্রহণ করেছিলাম। এই বিষয়টাকে সূরা মুলকের ৬৭:৮-১০ নং আয়াতে আরো স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
قِيلَ ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ
📘 ওদেরকে বলা হবে, জাহান্নামে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য তোমরা ওতে প্রবেশ কর। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল!
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ
📘 আর যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।[১] যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে[২] এবং তার রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি), তোমরা সুখী হও এবং স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর।’
[১] ঈমানদার ও আল্লাহভীরুদেরকেও দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথমে 'মুক্বার্রাবীন' (নৈকট্যপ্রাপ্ত দল), তারপর 'আবরার' (সৎলোকদের দল), এইভাবে মর্যাদাক্রমে প্রত্যেক দল তার সমমানের দলের সাথে শামিল থাকবে। যেমন, নবীরা নবীদের সাথে, সত্যবাদীরা সত্যবাদীদের সাথে, শহীদরা শহীদদের সাথে এবং আলেমরা আলেমদের সাথে। অর্থাৎ, প্রত্যেক দল তারই ন্যায় দলের বা তার সমমানের দলের সাথে থাকবে।
[২] হাদীসে এসেছে, "জান্নাতের আটটি দরজা। তার মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে কেবল রোযাদাররা প্রবেশ করবে।"
(বুখারী ২২৫৭, মুসলিম ৮০৮নং)
এইভাবে অন্যান্য দরজারও নাম থাকবে। যেমন, বাবুস্ স্বলাত (নামাযের দরজা)। বাবুস্ স্বাদাক্বাহ (সাদকার দরজা)। বাবুল জিহাদ (জিহাদের দরজা) প্রভৃতি।
(বুখারীঃ রোযা অধ্যায়, মুসলিমঃ যাকাত অধ্যায়)
প্রত্যেক দরজা চল্লিশ বছরের পথ সমতুল্য চওড়া হবে। তা সত্ত্বেও তা পরিপূর্ণ থাকবে।
(মুসলিমঃ যুহুদ অধ্যায়)
সর্ব প্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাতকারী হবেন নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)।
(মুসলিম, ঈমান অধ্যায়)
জান্নাতে সর্বপ্রথম আগমনকারী দলটির চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত এবং দ্বিতীয় দলটির মুখমন্ডল আসমানে দীপ্যমান নক্ষত্রের মধ্যে সর্বাধিক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় চমকাতে থাকবে। জান্নাতে তারা প্রস্রাব-পায়খানা এবং থুতু-শ্লেষ্মা হতে পাক ও পবিত্র হবে। তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণের আর তাদের ঘর্ম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের ধুনুচিতে সুগন্ধিময় আগর-কাঠ হবে। ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুরগণ হবে তাদের স্ত্রী। তাদের উচ্চতা হবে আদম (আঃ)-এর মত ষাট হাত।
(বুখারী)
সহীহ বুখারীর অপর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, প্রত্যেকটি মু'মিন দু'টি করে হুর পাবে। তারা এত রূপসী ও সুন্দরী হবে যে, (স্বচ্ছ সৌন্দর্যের কারণে) তাদের গোশতপিন্ডের ভেতর থেকে পায়ের নলাস্থিত মজ্জাও দেখা যাবে।"
(বুখারীঃ সৃষ্টির শুরু অধ্যায়)
কেউ কেউ বলেছেন, এই দু'টি স্ত্রী হুর ছাড়া দুনিয়ার মহিলাদের মধ্য থেকে হবে। তবে যেহেতু (শহীদ ছাড়া সাধারণ লোকের জন্য) ৭২টি হুর পাওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস সনদের দিক দিয়ে সহীহ নয়, তাই বাহ্যিকভাবে এটাই সঠিক মনে হচ্ছে যে, প্রত্যেক জান্নাতী হুর সহ দু'টি করে স্ত্রী পাবে। আবার ﴿وَلَهُمْ مَا يَشْتَهُونَ﴾ (জান্নাতীরা জান্নাতে যা আশা করবে তাই পাবে) অনুসারে বেশী পাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
(অতিরিক্ত জানার জন্য ফাতহুল বারীর উল্লিখিত অধ্যায় দ্রষ্টব্যঃ)
وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ ۖ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
📘 তারা (প্রবেশ করে) বলবে, ‘প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির অধিকারী করেছেন; আমরা জান্নাতে যথা ইচ্ছা বসবাস করব। সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম!’
وَتَرَى الْمَلَائِكَةَ حَافِّينَ مِنْ حَوْلِ الْعَرْشِ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ ۖ وَقُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْحَقِّ وَقِيلَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
📘 তুমি ফিরিশতাদেরকে দেখতে পাবে যে, ওরা আরশের চারিপাশ ঘিরে ওদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে।[১] ন্যায়ের সঙ্গে সকলের বিচার করা হবে; আর বলা হবে, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর প্রাপ্য।’[২]
[১] আল্লাহর বিচার-ফায়সালার পর ঈমানদাররা জান্নাতে এবং কাফের ও মুশরিকরা জাহান্নামে চলে যাওয়ার পরের চিত্র আয়াতে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, ফিরিশতাগণ আল্লাহর আরশকে পরিবেষ্টিত রাখা অবস্থায় তাঁর পবিত্রতার ঘোষণা ও গুণবর্ণনায় ব্যস্ত থাকবেন।
[২] এখানে প্রশংসার সম্পর্ক কোন এক সৃষ্টির সাথে জোড়া হয়নি, যা থেকে জানা যায় যে, প্রতিটি জিনিস (কথা বলতে সক্ষম ও অক্ষম)এর মুখে থাকবে আল্লাহর হামদের সুর।
۞ وَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَا رَبَّهُ مُنِيبًا إِلَيْهِ ثُمَّ إِذَا خَوَّلَهُ نِعْمَةً مِنْهُ نَسِيَ مَا كَانَ يَدْعُو إِلَيْهِ مِنْ قَبْلُ وَجَعَلَ لِلَّهِ أَنْدَادًا لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِهِ ۚ قُلْ تَمَتَّعْ بِكُفْرِكَ قَلِيلًا ۖ إِنَّكَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
📘 মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে, তখন সে একনিষ্ঠভাবে তার প্রতিপালককে ডাকে; পরে যখন তিনি তার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন সে যার জন্য তাঁকে ডাকছিল তা ভুলে বসে[১] এবং সে আল্লাহর পথ হতে অন্যকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর অংশী ঠিক করে নেয়। বল, ‘অবিশ্বাস অবস্থায় তুমি কিছুকাল জীবনোপভোগ করে নাও, বস্তুতঃ তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত।’
[১] অর্থাৎ, সেই দু'আ ভুলে বসে। অথবা সেই কষ্ট ভুলে বসে, যা দূর করার জন্য সে অন্যদেরকে ছেড়ে আল্লাহর নিকট দু'আ করত। অথবা সেই প্রভুকে ভুলে বসে, যাকে সে ডাকত ও তার সামনে কাকুতি-মিনতি করত, অতঃপর সে পুনরায় শিরক করতে আরম্ভ করে।
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ
📘 যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তাঁর প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?)[১] বল, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? [২] বুদ্ধিমান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’[৩]
[১] উদ্দেশ্য হল যে, কাফের ও মুশরিকের তো এই অবস্থা যা বর্ণনা করা হল। পক্ষান্তরে আর এক ব্যক্তি যে সুখে-দুঃখে, আল্লাহর সামনে অক্ষমতা ও আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে সিজদা ও কিয়াম অবস্থায় রাত্রি যাপন করে। তার মন আখেরাতের ভয়ে ভীত এবং সে প্রভুর রহমতের আশাধারী হয়। অর্থাৎ ভয় ও আশা উভয় অবস্থাই তার মধ্যে পাওয়া যায়; যা প্রকৃত ঈমান। এরা দুইজন কি সমান হতে পারে? না, কক্ষনই না। ভয় ও আশা সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আনাস (রাঃ) বলেন, একদা রসূলুল্লাহ (সাঃ) মুত্যু মুখে পতিত এক ব্যক্তির নিকট গেলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার অবস্থা কি?" সে ব্যক্তি বলল, 'আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখছি এবং স্বকৃত পাপের জন্য ভয়ও করছি।' রসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, "এই অবস্থায় যদি কোন বান্দার মনে এই দু'টি কথা একত্রিত হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে ঐ বস্তু প্রদান করবেন, যে বস্তুর সে আশা করে এবং সেই বস্তু থেকে বাঁচিয়ে নেবেন, যার সে ভয় করে।"
(তিরমিযী -ইবনে মাজাহ)
[২] অর্থাৎ, সেই ব্যক্তি যে জানে যে, আল্লাহ শান্তি ও শাস্তির যে ওয়াদা করেছেন তা সত্য এবং ঐ ব্যক্তি যে এ কথা জানে না, এরা দুইজন সমান হতে পারে না। একজন বিজ্ঞ এবং অপরজন অজ্ঞ। যেমন শিক্ষা ও মূর্খতা এক নয়, অনুরূপ শিক্ষিত ও মূর্খ সমান নয়। হতে পারে যে, এখানে আলেম ও জাহেলের উদাহরণ দিয়ে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, যেমন এরা দুইজন সমান নয়, অনুরূপ আল্লাহর বাধ্য ও অবাধ্য বান্দা, দুইজনে সমান হতে পারে না। কেউ কেউ এর অর্থ এই বর্ণনা করেছেন যে, আলেম (জ্ঞানী) বলে ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে তার ইলম (জ্ঞান) অনুযায়ী আমল করে। কারণ সেই (প্রকৃত আলেম যে তার) ইলম দ্বারা উপকৃত হয়। আর যে নিজ ইলম অনুযায়ী আমল করে না, সে ঠিক যেন অজ্ঞ। এই অর্থ অনুযায়ী এখানে আমলকারী ও বেআমল ব্যক্তির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে, এরা দুইজন এক সমান নয়।
[৩] যারা মু'মিন, কাফের নয়; যদিও তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ভাবে। যখন তারা নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা চিন্তা-ভাবনাই করে না এবং শিক্ষা ও নসীহতই অর্জন করে না, তখন তারা ঠিক যেন চতুষ্পদ জন্তুর মত জ্ঞান-বুদ্ধি থেকে বঞ্চিত।