🕋 تفسير سورة محمد
(Muhammad) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ أَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ
📘 যারা অবিশ্বাস করেছে এবং অপরকে আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করেছে[১] তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন।[২]
[১] কেউ কেউ এ থেকে কুরাইশ কাফেরদেরকে বুঝিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বুঝিয়েছেন আহলে-কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান)-দেরকে। তবে এটি ব্যাপক, তারা সহ সকল অবিশ্বাসীরাই এর অন্তর্ভুক্ত।
[২] এর একটি অর্থ এই যে, তারা নবী করীম (সাঃ) এর বিরুদ্ধে যেসব ষড়যন্ত্র করেছিল, মহান আল্লাহ সেগুলোকে ব্যর্থ করে তা তাদের উপরেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় অর্থ হল, তাদের মধ্যে উত্তম যে কিছু নৈতিকতা ছিল; যেমন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, বন্দীদের মুক্ত করা এবং অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদি অথবা কা'বাগৃহ ও হাজীদের খিদমত করা, এ সবের কোন প্রতিদান তারা আখেরাতে পাবে না। কারণ, ঈমান ব্যতীত আমলের কোন নেকী নির্ধারিত হয় না।
۞ أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۚ دَمَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ۖ وَلِلْكَافِرِينَ أَمْثَالُهَا
📘 তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি এবং দেখেনি যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল?[১] আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে অনুরূপ পরিণাম। [২]
[১] যাদের বহু নিদর্শন তাদের এলাকায় বিদ্যমান রয়েছে। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় কোন কোন জাতির ধ্বংসাবশেষ চিহ্নসমূহ বিদ্যমান ছিল। এই জন্য তাদেরকে ঘুরে-ফিরে তাদের ভয়ানক পরিণাম দেখতে বলা হয়েছে, যাতে তা দেখে তারা ঈমান নিয়ে আসে।
[২] এখানে মক্কাবাসীদেরকে ভয় দেখানো হয়েছে যে, তোমরা যদি কুফরী থেকে ফিরে না এস, তবে তোমাদের জন্যেও অনুরূপ শাস্তি হতে পারে এবং বিগত বহু কাফের সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার ন্যায় তোমাদেরকেও ধ্বংস করে দেওয়া হতে পারে।
ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ مَوْلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَأَنَّ الْكَافِرِينَ لَا مَوْلَىٰ لَهُمْ
📘 এটা এ জন্য যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের অভিভাবক এবং অবিশ্বাসীদের কোন অভিভাবক নেই। [১]
[১] তাই উহুদ যুদ্ধে কাফেরদের শ্লোগানের উত্তরে মুসলিমরা যে শ্লোগান বলেছিলেন তা আয়াতের বাস্তব রূপ। যেমন কাফেররা বলেছিল, أُعْلُ هُبَل، أُعْلُ هُبَل (হুবালের নাম উচ্চ হোক)। এর উত্তরে মুসলিমগণ বলেছিলেন, اللهُ أَعْلَى وأَجَلُّ (আল্লাহই সর্বোচ্চ ও সর্বমহান)। কাফেরদের আরো একটি শ্লোগান ছিল, لَنَا الْعُزَّى وَلاَ عُزَّى لَكُمْ (আমাদের উয্যা আছে, তোমাদের উয্যা নেই।) উত্তরে মুসলিমগণ বলেছিলেন, اللهُ مَوْلاَنَا وَلاَ مَوْلَى لَكُمْ (আল্লাহ আমাদের সাহায্যকারী, তোমাদের কোন সাহায্যকারী নেই।)
(বুখারী)
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ
📘 যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত। কিন্তু যারা অবিশ্বাস করে, তারা ভোগ-বিলাসে লিপ্ত থাকে এবং জন্তু-জানোয়ারের মত উদর-পূর্তি করে। [১] আর তাদের নিবাস হল জাহান্নাম।
[১] অর্থাৎ, যেভাবে জীব-জন্তুদের উদর এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না, অনুরূপ অবস্থা হল কাফেরদের। তাদের জীবনের উদ্দেশ্যও (ইহকালে) খাওয়া-পরা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরকালের ব্যাপারে তারা একেবারে উদাসীন। এরই ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে খাওয়া যে নিষেধ তাও প্রমাণিত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দাওয়াত অনুষ্ঠানে যার ব্যাপক প্রচলন হয়ে গেছে। কেননা, এতে রয়েছে জীব-জন্তুর সাদৃশ্য অবলম্বন; যেটা কাফেরদের অভ্যাস। বহু হাদীসে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) নিষেধ করেছেন যে, কোন লোক যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। আনাস (রাঃ)-কে দাঁড়িয়ে খাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, 'এটা তো আরো খারাপ ও আরো নোংরা।"
(মুসলিম ২০২৪নং)
কাজেই জন্তু-জানোয়ারের মত দাঁড়িয়ে পানাহার করা থেকে বিরত থাকা অতীব প্রয়োজনীয় আচরণ।
(দ্রঃ যাদুল মাআ'দ)
وَكَأَيِّنْ مِنْ قَرْيَةٍ هِيَ أَشَدُّ قُوَّةً مِنْ قَرْيَتِكَ الَّتِي أَخْرَجَتْكَ أَهْلَكْنَاهُمْ فَلَا نَاصِرَ لَهُمْ
📘 তোমার সেই জনপদ; যা তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তা অপেক্ষা অতি শক্তিশালী কত জনপদ ছিল, আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।
أَفَمَنْ كَانَ عَلَىٰ بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّهِ كَمَنْ زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ
📘 যে ব্যক্তি তার প্রতিপালক হতে (আগত) সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি তার মত, যার নিকট নিজের মন্দ কর্মগুলো শোভনীয় প্রতীয়মান হয় এবং যারা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে? [১]
[১] 'মন্দ কর্ম' বলতে শিরক ও অবাধ্যতাকে বুঝানো হয়েছে। এর অর্থও তা-ই যা পূর্বে বহু স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। আর তা হল, মু'মিন ও কাফের, মুশরিক ও তাওহীদবাদী এবং সৎলোক ও অসৎলোক সমান হতে পারে না। একজনের জন্যে আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান এবং জান্নাতের নিয়ামতসমূহ। পক্ষান্তরে অপরজনের জন্য রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি। পরের আয়াতে উভয়ের পরিণামের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রথমে সেই জান্নাতের বৈশিষ্ট্য ও তার সৌন্দর্যের কথা, যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহভীরু পরহেজগার বান্দাদেরকে দেওয়া হয়েছে।
مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ فِيهَا أَنْهَارٌ مِنْ مَاءٍ غَيْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِنْ لَبَنٍ لَمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِنْ عَسَلٍ مُصَفًّى ۖ وَلَهُمْ فِيهَا مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ ۖ كَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِي النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِيمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ
📘 সাবধানীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হলঃ ওতে আছে নির্মল পানির নদীমালা,[১] আছে দুধের নদীমালা যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়,[২] আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নদীমালা,[৩] আছে পরিশোধিত মধুর নদীমালা।[৪] আর সেখানে তাদের জন্য আছে বিবিধ ফল-মূল ও তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা। সাবধানীরা কি তাদের মত, যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং যাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি; যা তাদের নাড়ী-ভুঁড়ি ছিন্ন-ভিন্ন করে দেবে? [৫]
[১] آسِنٍ এর অর্থঃ পরিবর্তনীয়। غير آسن এর অর্থঃ অপরিবর্তনীয়। অর্থাৎ, পৃথিবীতে পানি যদি কোন এক স্থানে কিছুক্ষণের জন্য পড়ে থাকে, তবে তার রঙ পরিবর্তন হয়ে যায় এবং তার গন্ধ ও স্বাদে এমন বিকৃতি ঘটে যে, তা সবাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু জান্নাতের পানির এমন বৈশিষ্ট্য হবে যে, তাতে কোন পরিবর্তন ঘটবে না। অর্থাৎ, তার গন্ধ ও স্বাদ অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকবে। যখনই পান করবে, তখনই তা টাটকা, তৃপ্তিদায়ক ও স্বাস্থ্যকর হবে। পৃথিবীর পানি যেহেতু খারাপ বা নষ্টযোগ্য, তাই এই পানির ব্যাপারে শরীয়তের বিধান হল, ততক্ষণ পর্যন্ত তা পবিত্র বলে গণ্য হবে, যতক্ষণ না তার রঙ বা গন্ধ পরিবর্তন হবে। কেননা, গন্ধ বা রঙের বিকৃতি ঘটলেই পানি নাপাক হয়ে যায়।[২] দুনিয়াতে উট, গাই, মহিষ ও ছাগলের স্তন থেকে দোহানো দুধ কিছুকাল পরে খারাপ হয়ে যায়; কিন্তু জান্নাতের দুধ যেহেতু কোন পশুর স্তন থেকে এইভাবে নির্গত হবে না, বরং তার নহর থাকবে, সেহেতু সে দুধ যেমন সুস্বাদু হবে, তেমনি তা খারাপ হওয়া থেকেও সুরক্ষিত থাকবে।[৩] পৃথিবীতে যে সুরা বা মদ পাওয়া যায়, তা সাধারণতঃ অত্যন্ত ঝাঁঝালো, বদ-মজাদার ও দুর্গন্ধময় হয়। এ ছাড়া তা পান করে মানুষ সাধারণতঃ বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে, আবোল-তাবোল বকে এবং নিজের দেহের ব্যাপারেও কোন খেয়াল থাকে না। কিন্তু জান্নাতের সুরা দেখতে হবে সুন্দর,স্বাদে হবে অতুলনীয় এবং তা হবে অতীব সুবাসিত। তা পান করে না কোন মানুষ জ্ঞানশূন্য হবে, আর না অস্বস্তি বোধ করবে। বরং এমন তৃপ্তি ও আনন্দ বোধ করবে যে, তা এই দুনিয়াতে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। যেমন, মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, {لا فِيهَا غَوْلٌ وَلا هُمْ عَنْهَا يُنْزَفُونَ} (الصافات:৪৭) "ওতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না এবং ওতে তারা নেশাগ্রস্তও হবে না।" (সূরা সা-ফফা-ত ৩৭:৪৭ আয়াত)
(আরো দেখুনঃ সূরা ওয়াকিআহ ৫৬:১৯ আয়াত)
[৪] অর্থাৎ, মধুতে সাধারণতঃ যে সব জিনিসের মিশ্রণ ঘটানোর সম্ভাবনা থাকে; যেমন দুনিয়াতে ব্যাপকহারে দেখা যায়, জান্নাতে এ রকম কোন আশঙ্কা থাকবে না। তা একেবারে নির্মল ও স্বচ্ছ হবে। কারণ, এ মধু দুনিয়ার মত মৌমাছি থেকে সংগৃহীত হবে না। বরং তারও খাস নহর হবে। এই জন্য হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, "যখন তোমরা চাইবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউস চাইবে। কেননা, তা হল মধ্যবর্তী ও সর্বোচ্চ জান্নাত। সেখান থেকেই জান্নাতের নহরগুলো প্রবাহিত হয় এবং তার উপরে রয়েছে পরম দয়াময়ের আরশ।"
(বুখারী, জিহাদ অধ্যায়)
[৫] অর্থাৎ, যে জান্নাতে পূর্বে উল্লিখিত সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করবে, সে কি এমন জাহান্নামীদের সমান, যাদের এই অবস্থা হবে? পরিষ্কার কথা যে, এমন হবে না। বরং একজন উন্নত মর্যাদায় থাকবে, আর অপরজন থাকবে জাহান্নামে। একজন জান্নাতের নিয়ামতসমূহে আমোদ-প্রমোদে মেতে থাকবে, আর অপরজন জাহান্নামের শাস্তির কঠিন কষ্ট ভোগ করবে। একজন আল্লাহর অতিথি হবে, যার সম্মানার্থে বিভিন্ন প্রকারের জিনিস প্রস্তুত থাকবে। আর অপরজন আল্লাহর বন্দী হবে, যাকে খেতে দেওয়ার জন্য যাক্কুমের মত তিক্ত ও বদ-মজাদার খাদ্য এবং পান করার জন্য ফুটন্ত পানি দেওয়া হবে।
وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُ إِلَيْكَ حَتَّىٰ إِذَا خَرَجُوا مِنْ عِنْدِكَ قَالُوا لِلَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مَاذَا قَالَ آنِفًا ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ
📘 তাদের মধ্যে কতক তোমার কথা মন দিয়ে শোনে, অতঃপর তোমার নিকট হতে বের হয়ে জ্ঞানবানদেরকে বলে, ‘এই মাত্র সে কি বলল?’ [১] ওরাই তারা যাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেন এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে।
[১] এখানে মুনাফিকদের কথা আলোচনা করা হচ্ছে। তাদের নিয়ত যেহেতু ভাল হত না, তাই নবী করীম (সাঃ)-এর কথাগুলোও বুঝতে পারত না। তারা মজলিস থেকে বেরিয়ে এসে সাহাবাদেরকে জিজ্ঞাসা করত যে, তিনি কি বললেন?
وَالَّذِينَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْوَاهُمْ
📘 যারা সৎপথ অবলম্বন করে, তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে ধর্মভীরু হবার শক্তি দান করেন।[১]
[১] অর্থাৎ, যাদের হিদায়াত অর্জন করার নিয়ত হয়, আল্লাহ তাদেরকে হিদায়াত লাভ করার তওফীকও দান করেন এবং তাদেরকে তার উপর প্রতিষ্ঠিতও রাখেন।
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً ۖ فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا ۚ فَأَنَّىٰ لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ
📘 তারা কি শুধু এ জন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের নিকট আকস্মিকভাবে এসে পড়ুক? কিয়ামতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে।[১] অতঃপর কিয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে? [২]
[১] অর্থাৎ, নবী করীম (সাঃ)-এর নবী হয়ে প্রেরিত হওয়াই কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি নিদর্শন। যেমন তিনি নিজেও এ কথা বলেছেন, (بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَاتَيْنِ) "আমার প্রেরিত হওয়ার ও কিয়ামতের মাঝে ব্যবধান হল এই দুই আঙ্গুলের (মাঝে ব্যবধানের) ন্যায়।"
(বুখারী)
তিনি ইঙ্গিত করে একথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, যেভাবে এই আঙ্গুল দু'টি পরস্পর মিলে রয়েছে, অনুরূপ আমার ও কিয়ামতের মধ্যেও কোন ব্যবধান নেই। অথবা একটি আঙ্গুল যেমন অপর আঙ্গুলটির চেয়ে একটু বেশি লম্বা আছে, অনুরূপ কিয়ামতও আমার জীবনকালের একটু পরে সংঘটিত হবে।
[২] অর্থাৎ, কিয়ামত যখন হঠাৎ এসে পড়বে, তখন কাফের কিভাবে উপদেশ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে? অর্থাৎ, সেই সময় সে যদি তওবাও করে, তবুও তা গৃহীত হবে না। কাজেই তওবা করতে চাইলে এটাই সময়। তাছাড়া এমন সময়ও এসে উপস্থিত হতে পারে, যখন তাদের তওবাও ফলপ্রসূ হবে না।
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ
📘 সুতরাং তুমি জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া (সত্য) কোন উপাস্য নেই।[১] আর ক্ষমা-প্রার্থনা কর তোমার এবং মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য।[২] আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান ক্ষেত্র সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন। [৩]
[১] অর্থাৎ, এই বিশ্বাসের উপর অটল ও দৃঢ় থাক। কেননা, এটাই তাওহীদ (একত্ব), আল্লাহর আনুগত্য এবং যাবতীয় কল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। আর এ থেকে বিচ্যুতি অর্থাৎ, শিরক ও অবাধ্যতা হল যাবতীয় অকল্যাণের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
[২] এই আয়াতে নবী করীম (সাঃ)-কে তাঁর নিজের জন্যও এবং মু'মিনদের জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার গুরুত্ব ও ফযীলত অনেক। বহু হাদীসেও এর প্রতি বড়ই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। একটি হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, "হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট তওবা কর। কারণ, আমি দিনে সত্তরবারেরও বেশী তাঁর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।"
(বুখারী, দা'ওয়াত অধ্যায়)
[৩] অর্থাৎ, দিনে তোমরা যেখানেই যাও এবং যা কিছু কর এবং রাতে যেখানেই বিশ্রাম নাও ও অবস্থান কর, মহান আল্লাহ তার সবকিছু জানেন। অর্থাৎ, তোমাদের দিবারাত্রির কোন কর্মতৎপরতা আল্লাহর নিকট গুপ্ত নয়।
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَهُوَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ ۙ كَفَّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ
📘 এবং যারা বিশ্বাস করেছে, সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে বিশ্বাস করেছে,[১] আর তা তাদের প্রতিপালক হতে সত্য; তিনি তাদের পাপরাশি ক্ষমা করেছেন[২] এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দিয়েছেন। [৩]
[১] যদিও বিশ্বাস ও ঈমান আনার মধ্যে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি প্রেরিত অহী অর্থাৎ, পবিত্র কুরআনের উপর ঈমান আনাও শামিল, তবুও এর গুরুত্ব ও মর্যাদাকে আরো বেশী সুস্পষ্ট করার জন্য এটাকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
[২] অর্থাৎ ঈমান আনার পূর্বেকার ভুল-ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে দেন। যেমন, নবী করীম (সাঃ)ও বলেছেন, "ইসলাম পূর্বেকার যাবতীয় পাপকে মুছে দেয়।" (সহীহুল জামে', আলবানী)
[৩] بَالَهُمْ এর অর্থ أَمْرَهُمْ، شَأنَهُمْ، حَالَهُمْ এগুলোর অর্থ প্রায় একই ধরণের। অর্থাৎ, তাদেরকে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে কল্যাণ ও মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করেছেন। আর একজন মু'মিনের জন্য অবস্থা ভালো হওয়ার এটাই সর্বোত্তম চিত্র। এর অর্থ এই নয় যে, ধন-সম্পদের মাধ্যমে তাদের অবস্থা ভালো করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, সকল মু'মিন ধন-সম্পদ পায় না। তাছাড়া পার্থিব ধন-সম্পদ লাভ অবস্থা ভাল হওয়ার সুনিশ্চিত প্রমাণও নয়। বরং এতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশী থাকে। এই জন্য নবী করীম (সাঃ) অধিক মাল পছন্দ করতেন না।
وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا لَوْلَا نُزِّلَتْ سُورَةٌ ۖ فَإِذَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ مُحْكَمَةٌ وَذُكِرَ فِيهَا الْقِتَالُ ۙ رَأَيْتَ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يَنْظُرُونَ إِلَيْكَ نَظَرَ الْمَغْشِيِّ عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ۖ فَأَوْلَىٰ لَهُمْ
📘 বিশ্বাসীরা বলে, ‘একটি সূরা অবতীর্ণ করা হয় না কেন?’[১] অতঃপর যদি সুস্পষ্ট মর্মবিশিষ্ট কোন সূরা অবতীর্ণ করা হয়[২] এবং তাতে যুদ্ধের কোন নির্দেশ থাকে, তাহলে তুমি দেখবে, যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা মৃত্যুভয়ে বিহ্বল মানুষের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। [৩] সুতরাং তাদের জন্য উত্তম ছিল,
[১] যখন জিহাদের নির্দেশ আসেনি, তখন জিহাদের জন্য উদ্গ্রীব মু'মিনগণ, যাঁরা জিহাদ করার অনুমতির আশা করতেন এবং বলতেন যে, 'এ (জিহাদের) ব্যাপারে কোন সূরা অবতীর্ণ করা হয় না কেন?' অর্থাৎ, এমন সূরা যাতে জিহাদ করার নির্দেশ থাকবে।[২] অর্থাৎ, এমন সূরা যা 'মানসূখ'(রহিত) নয়।[৩] এ হল সেই মুনাফিকদের কথা, যাদের কাছে জিহাদের নির্দেশ বড় কঠিন মনে হত। কিছু দুর্বল শ্রেণীর মু'মিনও কখনো কখনো তাদের দলভুক্ত হয়ে যেত। সূরা নিসার ৪:৭৭ নং আয়াতেও এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
طَاعَةٌ وَقَوْلٌ مَعْرُوفٌ ۚ فَإِذَا عَزَمَ الْأَمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا اللَّهَ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ
📘 আনুগত্য করা ও ন্যায়সঙ্গত কথা বলা।[১] সুতরাং জিহাদের সিদ্ধান্ত হলে[২] যদি তারা আল্লাহকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করত, [৩] তাহলে তাদের জন্য এটা মঙ্গলজনক হত। [৪]
[১] অর্থাৎ, জিহাদের নির্দেশ পেয়ে বিচলিত না হয়ে তাদের জন্য এটাই উত্তম ছিল, শুনে আনুগত্য করার মনোভাব প্রদর্শন করা এবং নবী করীম (সাঃ)-এর ব্যাপারে কোন অসভ্য কথা না বলে উত্তম কথা বলা। أوْلَى শব্দের অর্থ এখানে أَجْدَرُ (উত্তম)। আর এই অর্থকেই ইবনে কাসীর (রঃ) গ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ أولى শব্দটিকে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনমূলক শব্দ অর্থাৎ, বদ্দুআমূলক শব্দ বলে গণ্য করেছেন। مَعْنَاهُ قَارَبَهُ مَا يُهْلِكُهُ (তাদের ধ্বংস অতি নিকটেই) অর্থাৎ, তাদের ভীরুতা ও মুনাফিক্বীই তাদের ধ্বংসের কারণ হবে। এই হিসাবে طَاعَةٌ وَقَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ হবে সম্পূর্ণ এক নতুন বাক্য; যার উদ্দেশ্যপদ এটি এবং বিধেয়পদ হবে خَيْرٌ لَكُمْ যা এখানে ঊহ্য আছে।
(ফাতহুল ক্বাদীর, আয়সারুত তাফাসীর)
[২] অর্থাৎ, জিহাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে এবং তার সময় এসে গেলে।
[৩] অর্থাৎ, এখনও যদি তারা মুনাফিক্বী ত্যাগ করে নিজেদের নিয়তকে আল্লাহর জন্য নিষ্ঠাপূর্ণ করে নিত। অথবা রসূল (সাঃ)-এর সামনে তাঁর সঙ্গী হয়ে জিহাদ করার যে অঙ্গীকার করেছিল, তাতে যদি আল্লাহর নিকট তারা সত্যতার প্রমাণ দিত।
[৪] অর্থাৎ, মুনাফিক্বী ও বিরুদ্ধাচরণের স্থলে তওবা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন মঙ্গলজনক হত।
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ
📘 ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবতঃ তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে[১] এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে।
[১] একে অপরকে হত্যা করে। অর্থাৎ এখতিয়ার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) تَوَلَّيْتُمْ এর অর্থ করেছেন, "তোমরা জিহাদ থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও"। অর্থাৎ, তোমরা পুনরায় সেই মূর্খতার যুগে ফিরে যাবে এবং পরস্পর খুনোখুনি ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। আয়াতে সাধারণভাবে পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি এবং বিশেষভাবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে। আর পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ হল, মৌখিকভাবে, কর্মের মাধ্যমে এবং মাল-ধন ব্যয় করার মাধ্যমে আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার কর। বহু হাদীসেও এ বিষয়ে বড়ই তাকীদ ও ফযীলতের কথা এসেছে।
(ইবনে কাসীর)
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَىٰ أَبْصَارَهُمْ
📘 ওরা তো তারা, যাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন। [১]
[১] অর্থাৎ, এ ধরনের লোকদের কানগুলোকে মহান আল্লাহ (সত্য শোনা থেকে) বধির এবং চোখগুলোকে (সত্য দেখা হতে) অন্ধ করে দেন। আর এটা হল তাদের উল্লিখিত মন্দ কর্মসমূহের ফল।
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
📘 তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? [১]
[১] যার কারণে কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য তাদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে না।
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى ۙ الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ
📘 যারা নিজেদের নিকট সৎপথ ব্যক্ত হবার পর তা পরিত্যাগ করেছে,[১] শয়তান তাদের কাজকে সুশোভিত করে দেখিয়েছে এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দিয়ে রেখেছে। [২]
[১] এ থেকে মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। যারা জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের কুফরী এবং দ্বীন পরিহার করার ব্যাপারটা প্রকাশ করে দিয়েছে।
[২] أَملَى (মিথ্যা আশা দিয়ে রেখেছে) এর فاعل (কর্তৃপদ)ও শয়তান। অর্থাৎ, مَدَّ لَهُمْ فِي الْأَمَلِ وَوَعَدَهُمْ طُولَ الْعُمرِ শয়তান তাদেরকে বিরাট আশায় এবং এই প্রতারণায় ফেলে রেখেছে যে, এখনো তোমাদের অনেক বয়স আছে। কেন যুদ্ধে গিয়ে নিজেদের প্রাণ হারাবে? অথবা এর فاعل (কর্তৃপদ) হল আল্লাহ। অর্থাৎ, আল্লাহ তাদেরকে ঢিল ও অবকাশ দিয়েছেন। অর্থাৎ, তিনি তাদেরকে সত্বর পাকড়াও করেননি।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لِلَّذِينَ كَرِهُوا مَا نَزَّلَ اللَّهُ سَنُطِيعُكُمْ فِي بَعْضِ الْأَمْرِ ۖ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِسْرَارَهُمْ
📘 এটা এ জন্য যে,[১] আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, যারা তা অপছন্দ করে তাদেরকে তারা বলে,[২] ‘আমরা কোন কোন বিষয়ে তোমাদের আনুগত্য করব।’[৩] আল্লাহ তাদের গোপন অভিসন্ধি অবগত আছেন।[৪]
[১] এখানে 'এটা' বলে তাদের ধর্মত্যাগ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।[২] অর্থাৎ, মুনাফিকরা মুশরিকদেরকে অথবা ইয়াহুদীদেরকে বলে।[৩] অর্থাৎ, নবী করীম (সাঃ) এবং তার আনীত দ্বীনের বিরোধিতায়।[৪] যেমন অন্যত্র বলেছেন, {وَاللهُ يَكْتُبُ مَا يُبَيِّتُونَ} অর্থাৎ,তারা রাত্রে যা পরামর্শ করে, আল্লাহ তা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। (সূরা নিসা ৪:৮১)
فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
📘 ফিরিশতারা যখন তাদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করবে, তখন (তাদের দশা) কেমন হবে? [১]
[১] এখানে কাফেরদের সেই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে, যখন ফিরিশতাগণ তাদের আত্মা বের করবেন। মৃত্যুর সময় কাফের ও মুনাফিকদের আত্মা ফিরিশতার হাত থেকে বাঁচার জন্য দেহের মধ্যে লুকোচুরি করতে লাগে এবং এদিক ওদিক পালাবার চেষ্টা করে। সে সময় ফিরিশতাগণ তা কঠোরভাবে ধরে সজোরে টানেন এবং মারেন। এই বিষয়টি ইতিপূর্বে সূরা আনআম ৬:১৯৩ নং আয়াতে এবং সূরা আনফাল ৮:৫০ নং আয়াতেও উল্লিখিত হয়েছে।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
📘 এটা এ জন্য যে, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, তারা তার অনুসরণ করে এবং তাঁর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে, সুতরাং তিনি তাদের কর্ম নিষ্ফল করে দেন।
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَنْ لَنْ يُخْرِجَ اللَّهُ أَضْغَانَهُمْ
📘 যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা কি মনে করে যে, আল্লাহ তাদের বিদ্বেষ ভাব কখনই প্রকাশ করবেন না? [১]
[১] أَضْغَانٌ হল ضِغْنٌ এর বহুবচন। যার অর্থ হিংসা ও বিদ্বেষ। মুনাফিকদের অন্তরে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ ছিল। এ ব্যাপারেই বলা হচ্ছে যে, তারা কি মনে করে যে, মহান আল্লাহ তা প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন না?
ذَٰلِكَ بِأَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا اتَّبَعُوا الْبَاطِلَ وَأَنَّ الَّذِينَ آمَنُوا اتَّبَعُوا الْحَقَّ مِنْ رَبِّهِمْ ۚ كَذَٰلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ لِلنَّاسِ أَمْثَالَهُمْ
📘 এটা[১] এই জন্য যে, যারা অবিশ্বাস করেছে তারা মিথ্যার অনুসরণ করেছে এবং যারা বিশ্বাস করেছে তারা তাদের প্রতিপালক হতে (আগত) সত্যের অনুসরণ করেছে। এভাবে আল্লাহ মানুষের জন্য তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। [২]
[১] ذَلِكَ এটি হয় 'মুবতাদা' (উদ্দেশ্য পদ) কিংবা ঊহ্য উদ্দেশ্য পদের বিধেয় পদ। أَيْ: الأَمْرُ ذَلِكَ এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে সেই সব শাস্তি ও অঙ্গীকারের প্রতি, যা কাফের ও মু'মিনদের জন্য বর্ণিত হয়েছে।
[২] যাতে মানুষ কাফেরদের জন্য বরাদ্দ পরিণাম থেকে দূরে থাকে এবং সেই সরল ও সঠিক পথ অবলম্বন করে; যে পথে চলে ঈমানদারগণ চিরন্তন সফলতা ও সুখ-সমৃদ্ধি লাভে ধন্য হবে।
وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُمْ بِسِيمَاهُمْ ۚ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ
📘 আমি ইচ্ছা করলে তোমাকে তাদেরকে দেখিয়ে দিতাম, ফলে তুমি তাদের লক্ষণ দেখে তাদেরকে চিনতে পারতে,[১] তবে তুমি অবশ্যই কথার ভঙ্গিতে তাদেরকে চিনতে পারবে।[২] আর আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে অবগত।
[১] অর্থাৎ, এক একজনকে এমনভাবে চিহ্নিত করে দিতাম যে, প্রত্যেক মুনাফিককে প্রকাশ্যে চেনা যেত। কিন্তু সমস্ত মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ এ রকম এই জন্য করেননি যে, এটা তাঁর গোপনকারী গুণের বিপরীত। তিনি সাধারণতঃ (মানুষের পাপ-রহস্য) গোপন রাখেন; প্রকাশ করেন না। দ্বিতীয়তঃ তিনি মানুষের বাহ্যিক অবস্থার ভিত্তিতে বিচার করার এবং গোপনীয় ব্যাপারকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
[২] অবশ্য তাদের কথা বলার ধরণ ও বাচনভঙ্গি এমন হয় যে, তা তাদের মনের খবর প্রকাশ করে দেয়। যার দ্বারা পয়গম্বর তো তাদেরকে অবশ্যই চিনতে পারেন। এটা সাধারণতঃ দেখা যায় যে, মানুষের অন্তরে যা কিছু হয়, সেটাকে সে যতই গোপন করার চেষ্টা করুক না কেন, তার কথার ঢঙ, হাবভাব, ভাবভঙ্গি, গতিবিধি এবং কোন কোন বিশেষ অবস্থা তার অন্তরের গোপন রহস্যকে উদঘাটন করে দেয়।
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ
📘 আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি। [১]
[১] আল্লাহ তাআলার প্রথম থেকেই জানা আছে। এখানে জানার অর্থ, তা বাস্তবায়িত ও সংঘটিত হওয়া। যাতে অন্যরাও জেনে এবং দেখে নেয়। আর এই জন্য ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) এর অর্থ বর্ণনা করেছেন, حَتَّى نَعْلَمَ وُقُوْعَهُ যাতে আমি তার বাস্তবায়ন জেনে নিই। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এই ধরনের শব্দের অর্থ করতেন, لِنَرَى যাতে আমি দেখে নিই।
(ইবনে কাসীর)
আর এই অর্থই বেশী স্পষ্ট।
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَشَاقُّوا الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَىٰ لَنْ يَضُرُّوا اللَّهَ شَيْئًا وَسَيُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ
📘 যারা অবিশ্বাস করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে এবং নিজেদের নিকট পথের দিশা ব্যক্ত হবার পর রসূলের বিরোধিতা করে, তারা কখনই আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।[১] আর তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করবেন। [২]
[১] বরং নিজেদেরই ক্ষতি করবে।
[২] কেননা, আল্লাহর নিকট ঈমান ব্যতীত কোন আমলেরই কোনই মূল্য নেই। ঈমান ও ইখলাসই প্রত্যেক আমলকে আল্লাহর নিকট প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য বানায়।
۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসূলের আনুগত্য কর, আর তোমাদের কর্মসমূহ বিনষ্ট করো না। [১]
[১] অর্থাৎ, মুনাফিক ও মুর্তাদ্দের মত মুনাফিক্বী ও ধর্মত্যাগ করে নিজেদের আমলগুলো নষ্ট করো না। এ বাক্য দ্বারা যেন ইসলামের উপর অবিচল থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ মহাপাপ ও অশ্লীলতা সম্পাদন করাকেও আমলসমূহ নষ্টকারী কর্ম হিসাবে গণ্য করেছেন। আর এই জন্য মু'মিনদের গুণাবলীর মধ্যে একটি গুণ এও বর্ণিত হয়েছে যে, তারা মহাপাপ ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকে।
(সূরা নাজম ৫৩:৩২)
এই দিক দিয়ে এ আয়াতে মহাপাপ ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকার তাকীদ এসেছে। এই আয়াত থেকে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, কোন আমল যতই ভাল মনে হোক না কেন, যদি তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য-গন্ডির বাইরে হয়, তবে তা নিষ্ফল ও অনর্থক।
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ مَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يَغْفِرَ اللَّهُ لَهُمْ
📘 যারা অবিশ্বাস করে ও আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে অতঃপর অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।
فَلَا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّهُ مَعَكُمْ وَلَنْ يَتِرَكُمْ أَعْمَالَكُمْ
📘 সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না; যখন তোমরাই প্রবল[১] এবং আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। [২] আর তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো নষ্ট করবেন না। [৩]
[১] অর্থ হল, তোমরা যখন সংখ্যা ও শক্তি-সামর্থ্যের দিক দিয়ে শত্রুদের উপর প্রবল ও তাদের থেকে অনেক উন্নত, তখন এমতাবস্থায় কাফেরদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব ও দুর্বলতা প্রদর্শন করো না। বরং কুফরীর উপর এমন কড়া আঘাত হান, যেন আল্লাহর দ্বীন উঁচু হয়ে যায়। প্রবল ও উন্নত থাকা অবস্থায় কুফরীর সাথে সন্ধিতে আসার অর্থ হবে, কুফরীর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করা। আর এটা হল অতি বড় অন্যায়। তবে এর অর্থ এও নয় যে, কাফেরদের সাথে সন্ধি করার অনুমতি নেই। এর অনুমতি অবশ্যই আছে, কিন্তু সব সময় নয়। কেবল সেই সময় এর অনুমতি আছে, যখন মুসলিমরা সংখ্যায় এবং উপায়-উপকরণের দিক থেকে দুর্বল হবে। এ রকম অবস্থায় যুদ্ধ করার চেয়ে সন্ধি করাতেই লাভ বেশী। যাতে মুসলিমরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে নেয়। যেমন স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)ও মক্কার কাফেরদের সাথে দশ বছরের জন্য যুদ্ধ-বিরতির সন্ধি-চুক্তি করেছিলেন।
[২] এতে রয়েছে মুসলিমদের জন্য শত্রুর উপর জয়যুক্ত হওয়ার ও সাহায্য লাভের বড়ই সুসংবাদ। যার সাথে থাকেন আল্লাহ, তাকে কে পরাজিত করতে পারে?
[৩] বরং তিনি তার পরিপূর্ণ বদলা দেবেন এবং তাতে কোন কমি করবেন না।
إِنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ ۚ وَإِنْ تُؤْمِنُوا وَتَتَّقُوا يُؤْتِكُمْ أُجُورَكُمْ وَلَا يَسْأَلْكُمْ أَمْوَالَكُمْ
📘 পার্থিব জীবন তো শুধু খেল-তামাশা মাত্র।[১] যদি তোমরা বিশ্বাস কর ও আল্লাহ-ভীরুতা অবলম্বন কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে পুরস্কার দেবেন। আর তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ চান না। [২]
[১] অর্থাৎ, একটি ধোঁকা ও প্রতারণা মাত্র। এর কোন জিনিসের না আছে ভিত্তি, না আছে তার স্থায়িত্ব এবং না আছে তার কোন মূল্য।
[২] অর্থাৎ, তিনি তোমাদের ধন-সম্পদের মুখাপেক্ষী নন। আর এ জন্যই তিনি তোমাদের কাছে যাকাত হিসাবে তোমাদের নিকট সমস্ত ধন-সম্পদ চাননি; বরং তা থেকে অতি সামান্যতম অংশ চান। অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ মাত্র। আবার তাও এক বছর পূর্ণ হবার পর প্রয়োজনের অতিরিক্ত (নিসাব পরিমাণ) হলে। উপরন্তু এর উদ্দেশ্যও আল্লাহর সেই বান্দাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, যারা তোমাদেরই ভাই। তিনি এ দিয়ে তাঁর রাজত্বের প্রয়োজন পূরণ করেন না।
إِنْ يَسْأَلْكُمُوهَا فَيُحْفِكُمْ تَبْخَلُوا وَيُخْرِجْ أَضْغَانَكُمْ
📘 তোমাদের নিকট হতে তিনি তা চাইলে ও তার জন্যে তোমাদের উপর চাপ দিলে তোমরা তো কার্পণ্য করবে এবং তিনি তোমাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দেবেন। [১]
[১] অর্থাৎ, যদি তোমাদের প্রয়োজনের অধিক অবশিষ্ট সমস্ত ধন-সম্পদ চাইতেন, তাও আবার বারবার তাকীদের সাথে ও জোর দিয়ে, তাহলে এটাই মানুষের স্বভাব যে, তোমরা কার্পণ্য করবে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রকাশ করবে। অর্থাৎ, এই পরিস্থিতিতে স্বয়ং ইসলামের বিরুদ্ধে তোমাদের মনে এই শত্রুতার জন্ম নিত যে, এমন ধর্ম কোন ভাল ধর্ম নয়, যে আমাদের পরিশ্রমের সমস্ত উপার্জন নিজের মধ্যেই গুটিয়ে নেয়।
هَا أَنْتُمْ هَٰؤُلَاءِ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَمِنْكُمْ مَنْ يَبْخَلُ ۖ وَمَنْ يَبْخَلْ فَإِنَّمَا يَبْخَلُ عَنْ نَفْسِهِ ۚ وَاللَّهُ الْغَنِيُّ وَأَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ ۚ وَإِنْ تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُمْ
📘 তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হচ্ছে[১] অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা করছে; যারা কার্পণ্য করে, তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদের প্রতি।[২] আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরা অভাবগ্রস্ত।[৩] যদি তোমরা বিমুখ হও,[৪] তাহলে তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন; অতঃপর তারা তোমাদের মত হবে না। [৫]
[১] অর্থাৎ, কিয়দংশ যাকাত হিসেবে এবং কিছু আল্লাহর পথে ব্যয় কর।
[২] অর্থাৎ, নিজেকেই আল্লাহর পথে ব্যয় করার পুণ্য থেকে বঞ্চিত রাখে।
[৩] অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদেরকে ব্যয় করার উৎসাহ এই কারণে দেন না যে, তিনি তোমাদের ধন-সম্পদের মুখাপেক্ষী। তা আদৌ নয়। তিনি তো ধনী ও অমুখাপেক্ষী। তিনি তোমাদেরই লাভের জন্য তোমাদেরকে এই নির্দেশ দেন। যাতে প্রথমতঃ তোমাদের নাফসের পবিত্রতা সাধন হয়। দ্বিতীয়তঃ তোমাদেরই অভাবী ভাইদের প্রয়োজন পূরণ হয়। আর তৃতীয়তঃ তোমরা শত্রুদের উপর বিজয়ী ও উন্নত থাক। কাজেই আল্লাহর রহমত ও তাঁর সাহায্যের মুখাপেক্ষী তোমরাই। তিনি তোমাদের মুখাপেক্ষী নন।
[৪] অর্থাৎ, ইসলাম থেকে কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন কর।
[৫] বরং তোমাদের চেয়েও বেশী আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যশীল এবং আল্লাহর পথে অনেক ব্যয়কারী হবে। নবী করীম (সাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সালমান ফারসী (রাঃ)-এর কাঁধে হাত রেখে বললেন, "এ থেকে লক্ষ্য এই (সালমান) এবং তাঁর গোত্রের লোক। শপথ সেই সত্তার, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি ঈমান 'সুরাইয়া' তারকাগুচ্ছের সাথে ঝুলে থাকত, তবুও তা পারস্যের কিছু মানুষ অর্জন করে নিত। (তিরমিযী, আল্লামা আলবানী তাঁর সহীহাতেও উল্লেখ করেছেন।)
فَإِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّىٰ إِذَا أَثْخَنْتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّىٰ تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ۚ ذَٰلِكَ وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِنْ لِيَبْلُوَ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ ۗ وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَنْ يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ
📘 অতএব যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধে মোকাবিলা কর, তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর,[১] পরিশেষে যখন তোমরা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করবে, তখন তাদেরকে কষে বাঁধবে; [২] অতঃপর হয় অনুগ্রহ, না হয় মুক্তিপণ;[৩] যে পর্যন্ত না যুদ্ধ তার অস্ত্ররাজি নামিয়ে ফেলে।[৪] এটাই বিধান।[৫] আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের নিকট হতে প্রতিশোধ নিতে পারতেন,[৬] কিন্তু তিনি চান তোমাদের কিছুকে অপরদের দ্বারা পরীক্ষা করতে।[৭] যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তিনি কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না। [৮]
[১] উভয় দলের কথা উল্লেখ করার পর এখন কাফের এবং যে কিতাবধারীদের সাথে কোন চুক্তি হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। হত্যার পরিবর্তে গর্দান কাটার নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে রয়েছে কাফেরদের সাথে চরম কঠোরতা প্রদর্শনের নির্দেশ।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[২] অর্থাৎ, তুমুল যুদ্ধ এবং তাদেরকে অধিকহারে হত্যা করার পর তাদের মধ্যে যারা তোমাদের হাতে ধরা পড়বে, তাদেরকে বন্দী করে শক্তভাবে বেঁধে রাখ। যাতে তারা পালাতে না পারে।
[৩] مَنٌّ এর অর্থ হল, কোন বিনিময় না নিয়ে কেবল অনুগ্রহ করে ছেড়ে দেওয়া। আর فِدَاء এর অর্থ হল, কিছু মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া। যুদ্ধবন্দীদের ব্যপারে এই স্বাধীনতা বা এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে যে, পরিস্থিতি ও অবস্থা অনুপাতে যেটাই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য সর্বাধিক উত্তম হবে, সেটাই অবলম্বন করা যাবে।
[৪] অর্থাৎ কাফেরদের সাথে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। অথবা এর অর্থ এই যে, যুদ্ধরত শত্রু পরাস্ত হয়ে কিংবা সন্ধির আশ্রয় নিয়ে অস্ত্র রেখে দেয় অথবা ইসলাম বিজয়ী হয় এবং কুফরীর সমাপ্তি ঘটে। উদ্দেশ্য হল, এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া অবধি কাফেরদের সাথে তোমাদের যুদ্ধ চলতেই থাকবে। তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে এবং যুদ্ধবন্দীদের ক্ষেত্রে উক্ত দু'টি সিদ্ধান্তই (মুক্তিপণ নিয়ে বা না নিয়ে ছেড়ে দেওয়া) তোমাদের এখতিয়ারাধীন থাকবে। কেউ বলেছেন, এই আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে; বিধায় এখন হত্যা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে সঠিক কথা এই যে, আয়াতটি রহিত নয়, বরং অব্যাহত। সুতরাং শাসকের চারটি জিনিসের এখতিয়ার আছেঃ কাফেরদের হত্যা করবে, না হয় বন্দী। বন্দীদের মধ্যে কাউকে অথবা সবাইকে হয় অনুগ্রহ করে ছেড়ে দেবে, না হয় মুক্তিপণ নিয়ে ছাড়বে।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
[৫] কিংবা তোমরা এ রকমই করো। افْعَلُوْا ذَلِكَ বা ذَلِكَ حُكْمُ الْكُفَّار
[৬] কাফেরদেরকে বিনাশ করে কিংবা শাস্তি দিয়ে। অর্থাৎ, তোমাদের তাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজনই পড়ত না।
[৭] অর্থাৎ, তোমাদেরকে একে অপরের মাধ্যমে পরীক্ষা করতে। যাতে তিনি জেনে নেন যে, তোমাদের মধ্যে তাঁর পথে মুজাহিদ কারা? যাতে তিনি তাদেরকে প্রতিদান দেন এবং কাফেরদেরকে তাদের হাতে পরাস্ত করেন।
[৮] অর্থাৎ, তাদের পুণ্য ও পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না।
سَيَهْدِيهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ
📘 তিনি তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেবেন। [১]
[১] অর্থাৎ, তাদেরকে এমন কাজের তাওফীক দান করবেন, যার ফলে তাদের জান্নাতের পথ সুগম হয়ে যাবে।
وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ
📘 তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার কথা তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। [১]
[১] অর্থাৎ, কোন পথ প্রদর্শন ছাড়াই তা চিনে নিবে এবং যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন তারা নিজে নিজেই আপন আপন ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়বে। একটি হাদীস থেকেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়; যাতে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন; "সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ আছে! একজন জান্নাতীর তার জান্নাতের ঘরের পথের জ্ঞান দুনিয়ার ঘরের চেয়েও অনেক বেশী হবে।"
(বুখারী, রিক্বাক অধ্যায়ঃ)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন[১] এবং তোমাদের পা দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। [২]
[১] আল্লাহর সাহায্য করার অর্থ, আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করা। কারণ, তিনি উপায়-উপকরণ অনুযায়ী তাঁর দ্বীনের সাহায্য তাঁর মু'মিন বান্দাদের দ্বারাই করেন। এই মু'মিন বান্দারা আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণ ও তার দাওয়াত-তবলীগের কাজ করেন তাই তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। অর্থাৎ, তাঁদেরকে কাফেরদের উপর জয়যুক্ত করেন। যেমন, সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) ও প্রাথমিক শতাব্দীগুলির মুসলিমদের উজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে; তাঁরা দ্বীনের (খাদেম) হয়ে গিয়েছিলেন, ফলে আল্লাহও তাঁদের (সহায়) হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা দ্বীনকে বিজয়ী করলে, আল্লাহও তাঁদেরকে পৃথিবীতে জয়যুক্ত করেছিলেন। যেমন, তিনি অন্যত্র বলেন, {وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُه} (الحج: ৪০) অর্থাৎ, "আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাঁকে সাহায্য করে।" (সূরা হাজ্জ ২২:৪০)[২] এটা যুদ্ধের সময়। تَثْبِيْتُ أَقْدَامٍ এটা যুদ্ধক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতার অর্থেই বলা হয়। কেউ কেউ বলেছেন, ইসলাম অথবা পুলসিরাতের উপর তাদের পা সুদৃঢ় রাখবেন।
وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ
📘 যারা অবিশ্বাস করেছে, তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দেবেন।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ
📘 এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তারা তা অপছন্দ করে।[১] সুতরাং আল্লাহ তাদের কর্মসমূহ নিস্ফল করে দেবেন। [২]
[১] অর্থাৎ, কুরআন ও ঈমানকে তারা অপছন্দ করে।
[২] কর্মসমূহ বলতে এমন কর্মসমূহ, যা বাহ্যতঃ কল্যাণকর, কিন্তু তাদের ঈমান না থাকার কারণে তারা আল্লাহর নিকট তার কোন প্রতিদান পাবে না।