🕋 تفسير سورة الأنفال
(Al-Anfal) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ ۖ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ ۖ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ ۖ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
📘 লোকে তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে।[১] বল, ‘যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ এবং রসূলের।’[২] সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন কর; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর। [৩]
[১] أنفال نفل শব্দের বহুবচন। যার অর্থ অতিরিক্ত। নফল ঐ সম্পদকে বলা হয় যা কাফেরদের সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে মুসলিমদের হস্তগত হয়। যাকে গনীমতের মালও বলা হয়। আর একে নফল এই জন্য বলা হয় যে, এই মাল ঐ সকল বস্তুর মধ্যে গণ্য যা পূর্বের জাতির জন্য হারাম ছিল, এভাবে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য এটি একটি অতিরিক্ত হালাল। অথবা এই মালকে নফল এই জন্য বলা হয় যে, জিহাদের যে প্রতিদান তা পরকালে দেওয়া হবে। তার উপর এই মাল একটি অতিরিক্ত জিনিস, যা কখনো কখনো পৃথিবীতেই পাওয়া যায়।
[২] অর্থাৎ, এ ব্যাপারে ফায়সালা করার অধিকারী তাঁরা। আল্লাহর রসূল আল্লাহর আদেশে তা বণ্টন করবে; তোমরা যেভাবে চাও, সেভাবে নয়।
[৩] এর অর্থ এই যে, উপরি উক্ত তিনটি বিষয়ে আমল না করা পর্যন্ত ঈমান পূর্ণাঙ্গ নয়। এখান থেকে তাকওয়া, পরস্পর সদ্ভাব রাখা এবং রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য করার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়। বিশেষ করে গনীমতের মাল বণ্টনের সময় এই তিনটি বিষয়ের উপর আমল অত্যন্ত জরুরী। মাল বণ্টনের সময় আপোসে বিশৃংখলা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। এ জন্য এখানে পরস্পর সদ্ভাব বজায় রাখার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। মাল বণ্টনে নয়-ছয় ও খিয়ানতেরও আশংকা থাকে। সেই কারণে তাকওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব সত্ত্বেও যদি কোন দুর্বলতা থেকে যায়, তাহলে তা দূর করার একমাত্র উপায় আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য।
وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَىٰ وَلِتَطْمَئِنَّ بِهِ قُلُوبُكُمْ ۚ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
📘 আল্লাহ এটা করেন কেবল তোমাদেরকে শুভ সংবাদ দেওয়ার জন্য এবং এ উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে। আর সাহায্য তো শুধু আল্লাহর নিকট হতেই আসে।[১] নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।
[১] অর্থাৎ, ফিরিশতাদের অবতরণ কেবলমাত্র সুসংবাদ ও তোমাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ছিল। তাছাড়া সত্যিকারে সাহায্য ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। যিনি ফিরিশতা বিনাও তোমাদের সাহায্য করতে পারতেন। তবে এটা ভাবাও ঠিক নয় যে, ফিরিশতারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ফিরিশতারাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং কিছু কাফেরদেরকে হত্যাও করেছিলেন।
(দেখুনঃ বুখারী, মুসলিম যুদ্ধ অধ্যায়)
إِذْ يُغَشِّيكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الْأَقْدَامَ
📘 স্মরণ কর, যখন তিনি তাঁর পক্ষ হতে নিরাপত্তা (ও শান্তি) দানের জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন[১] এবং আকাশ হতে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, যাতে তা দিয়ে তোমাদেরকে পবিত্র করেন, তোমাদের নিকট হতে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করেন,[২] তোমাদের হৃদয় সুদৃঢ় করেন এবং তোমাদের পা স্থির রাখেন। [৩]
[১] দ্বিতীয় পুরস্কার হল, উহুদ যুদ্ধের মত বদরের যুদ্ধেও মহান আল্লাহ মুসলিমদের উপর তন্দ্রা আচ্ছন্ন করেন। যার ফলে তাঁদের হৃদয়-ভার অনেকটা হাল্কা হয়ে যায় এবং দেহ-মনে প্রশান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে।
[২] তৃতীয় পুরস্কার তাঁদেরকে এই দান করলেন যে, তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। যার ফলে প্রথমতঃ বালুময় মাটিতে চলাফেরা সহজ হল। দ্বিতীয়তঃ ওযূ ও গোসল করা সহজ হল। তৃতীয়তঃ শয়তান মু'মিনদের অন্তরে যে কুমন্ত্রণা দিচ্ছিল যে, (১) তোমরা আল্লাহর নেক বান্দা হওয়া সত্ত্বেও পানি হতে এত দূরে অবস্থান করছ। (২) অপবিত্র অবস্থায় যুদ্ধ করলে তোমরা কিভাবে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য পেতে পারবে? (৩) তোমরা পিপাসিত অথচ তোমাদের শত্রুরা পিপাসিত নয় ইত্যাদি ইত্যাদি-- তা দূর হয়ে গেল।
[৩] এটি ছিল চতুর্থ পুরস্কারঃ অন্তর ও পা দৃঢ়ীকরণ।
إِذْ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى الْمَلَائِكَةِ أَنِّي مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِينَ آمَنُوا ۚ سَأُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ
📘 স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিপালক ফিরিশতাগণের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং তোমরা বিশ্বাসীগণকে অবিচলিত রাখ। যারা অবিশ্বাস করে, আমি অচিরেই তাদের হৃদয়ে আতঙ্ক প্রক্ষেপ করব।[১] সুতরাং তাদের ঘাড়ের উপর আঘাত কর এবং আঘাত কর তাদের সর্বাঙ্গে।[২]
[১] এখানে মহান আল্লাহ ফিরিশতা দ্বারা এবং বিশেষভাবে নিজ পক্ষ হতে যেভাবে বদরে মুসলিমদের সাহায্য করেছেন তার বর্ণনা রয়েছে।
[২] بنان হাত ও পায়ের আঙ্গুলের অগ্রভাগ। অর্থাৎ, তাদের হাত-পায়ের আঙ্গুল কেটে দিলে তারা অসহায় হয়ে পড়বে। আর এভাবে তারা হাত দ্বারা তরবারি চালাতে ও পা ছাড়া পালাতে সক্ষম হবে না। (অথবা উদ্দেশ্য তাদের সর্বাঙ্গে আঘাত কর।)
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ وَمَنْ يُشَاقِقِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَإِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
📘 এটা এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করেছে। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করবে (তারা জেনে রাখুক,) নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
ذَٰلِكُمْ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابَ النَّارِ
📘 এটাই তোমাদের শাস্তি; সুতরাং তোমরা তার আস্বাদ গ্রহণ কর। আর অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে দোযখের শাস্তি।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا زَحْفًا فَلَا تُوَلُّوهُمُ الْأَدْبَارَ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যখন (যুদ্ধকালে) অবিশ্বাসী বাহিনীর সম্মুখীন হবে, তখন (তাদের মুকাবিলা করতে) পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো না।[১]
[১] زحفا এর অর্থ হল এক অন্যের সম্মুখীন হওয়া। অর্থাৎ, মুসলিম ও কাফের যখন এক অপরের সম্মুখীন হবে, তখন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করার অনুমতি নেই। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, إجتنبوا السبع الموبقات সাতটি ধ্বংসকারী পাপ হতে বাঁচ, এই সাতটির মধ্যে একটি হল التولى يوم الزحف শত্রু সম্মুখীন অবস্থায় পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা (পলায়ন করা)।
(বুখারীঃ কিতাবুল অসা-ইয়া, মুসলিমঃ ঈমান অধ্যায়)
وَمَنْ يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلَّا مُتَحَرِّفًا لِقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزًا إِلَىٰ فِئَةٍ فَقَدْ بَاءَ بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
📘 সেদিন যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন কিংবা স্বীয় দলে স্থান নেওয়া ব্যতীত[১] অন্য কারণে কেউ তার পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে, সে তো আল্লাহর বিরাগভাজন হবে এবং তার আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম, আর তা কত নিকৃষ্ট ঠিকানা! [২]
[১] পূর্বের আয়াতে যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে তা হতে দুটি অবস্থা ব্যতিক্রম। প্রথমতঃ যুদ্ধ-কৌশল অবলম্বন। দ্বিতীয়তঃ স্বীয় বাহিনীর কেন্দ্রস্থলে স্থান নেওয়া। প্রথমটির অর্থ এক দিকে সরে যাওয়া; অর্থাৎ, যুদ্ধ-কৌশল পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে বা শত্রুদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য যুদ্ধরত অবস্থায় পিছু হটা। যাতে শত্রু মনে করতে পারে যে, তারা হেরে গিয়ে পালাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ নতুন শক্তি নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। এটি পৃষ্ঠপ্রদর্শন নয়; বরং একটি যুদ্ধ কৌশল। যা কখনো কখনো উপকারী ও জরুরী হয়। تحيز এর অর্থ মিলিত হওয়া বা আশ্রয় নেওয়া। কোন মুজাহিদ যুদ্ধ করতে করতে একা হয়ে পড়ে, তাহলে রণ-কৌশল হিসাবে যুদ্ধ ময়দান হতে সরে পড়া এবং নিজ বাহিনীর নিকট আশ্রয় নেওয়া এবং তাদের সাহায্যে পুনর্বার আক্রমণ করা। এই দুই অবস্থাই বৈধ।
[২] অর্থাৎ, এই দুই অবস্থা ব্যতীত কেউ পালিয়ে গেলে তার জন্য রয়েছে এই কঠিন সতর্কবাণী।
فَلَمْ تَقْتُلُوهُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ قَتَلَهُمْ ۚ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ رَمَىٰ ۚ وَلِيُبْلِيَ الْمُؤْمِنِينَ مِنْهُ بَلَاءً حَسَنًا ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
📘 তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, বরং আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন।[১] এবং তুমি যখন (মাটি) নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ করনি,[২] বরং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন। যাতে তিনি বিশ্বাসীগণকে নিজের তরফ হতে উত্তমরূপে পরীক্ষা (করে পুরস্কৃত) করেন।[৩] নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা।
[১] অর্থাৎ, বদর যুদ্ধের সকল অবস্থা তোমার সামনে তুলে ধরা হল, আর যেভাবে আল্লাহ তোমার সাহায্য করেছেন তাও। এসব স্পষ্ট করে দেওয়ার পর যেন তুমি এটা না ভাব যে, কাফেরদেরকে হত্যা করা তোমার কৃতিত্ব। না, বরং তা আল্লাহর সাহায্যের ফল। যার ফলে তুমি এই শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছ। সত্যিকার তাদের হত্যাকারী মহান আল্লাহই।[২] বদর যুদ্ধে নবী (সাঃ) এক মুঠি বালি নিয়ে কাফেরদের দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন; যা প্রথমতঃ মহান আল্লাহ তাদের মুখ ও চোখ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ এর মধ্যে এমন প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায় ও তারা কিছুই দেখতে পায় না। এই মু'জিযা যা আল্লাহর তরফ থেকে সেই সময় প্রকাশ পায়, তা মুসলিমদের বিজয়ে বিরাট সহযোগিতা করে। মহান আল্লাহ বলেন, 'হে নবী! ধুলোবালি তুমি অবশ্যই তাদের দিকে নিক্ষেপ করেছিলে। কিন্তু ওর মধ্যে প্রভাব আমিই সৃষ্টি করেছিলাম, আমি প্রভাব সৃষ্টি না করলে এই ধুলো-বালি কি করতে পারত? এতএব এ কাজ সত্যিকারে আমার, নাকি তোমার?'[৩] بلاء এখানে পুরস্কারের অর্থে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর এই সমর্থন ও সাহায্য মুসলিমদের জন্য একটি উত্তম পুরস্কার ছিল।
ذَٰلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ
📘 এ তো ছিলই। আর নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসীদের ষড়যন্ত্র দুর্বল করে থাকেন।[১]
[১] দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, কাফেরদের চক্রান্ত দুর্বল ও নস্যাৎ করে দেওয়া।
إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ ۖ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ ۖ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ
📘 তোমরা যদি বিজয় চাও, তাহলে তা তো তোমাদের নিকট এসেই গেছে।[১] যদি তোমরা বিরত হও, তাহলে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা পুনরায় (সে কাজ) কর, তাহলে আমিও পুনরায় তোমাদেরকে শাস্তি দেব এবং তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসীদের সাথে রয়েছেন।
[১] আবূ জাহল প্রভৃতি মক্কার কুরাইশ নেতারা মক্কা হতে বের হবার সময় দু'আ করেছিল যে, 'হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যারা তোমার বেশি অবাধ্য ও সম্পর্ক ছিন্নকারী, কাল তাদেরকে ধ্বংস করে দিও।' তারা মুসলিমদেরকে সম্পর্ক ছিন্নকারী ও অবাধ্য মনে করত, সেই জন্য তারা উক্ত দু'আ করেছিল। এবার যখন মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে বিজয় দান করলেন, তখন তিনি তাদেরকে বলছেন যে, তোমরা তো সত্যের বিজয়ই চাচ্ছিলে। সে ফায়সালা ও বিজয় তো তোমাদের সামনে এসে গেছে। অতএব তোমরা যদি কুফরী হতে বিরত হও, তাহলে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর যদি তোমরা আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হও, তাহলে আমি আবার তাদেরকে সাহায্য করব। আর তোমাদের বিরাট বাহিনী কোনই কাজে আসবে না।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
📘 বিশ্বাসী (মুমিন) তো তারাই যাদের হৃদয় আল্লাহকে স্মরণ করার সময় কম্পিত হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের বিশ্বাস (ঈমান) বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপরই ভরসা রাখে। [১]
[১] এই আয়াতে ঈমানদারদের চারটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছেঃ (ক) তারা আল্লাহ ও তদীয় রসূলের আনুগত্য করে; কেবল আল্লাহর অর্থাৎ, কুরআনের আনুগত্য নয়। (খ) আল্লাহর স্মরণের সময় আল্লাহর মহত্ত্বে তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। (গ) কুরআন পাঠ করলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। (যার দ্বারা বুঝা যায়, ঈমান কম-বেশি হয়; যেমন মুহাদ্দিসগণের অভিমত।) (ঘ) তারা নিজ প্রভু (আল্লাহর) উপর ভরসা করে। ভরসা করার অর্থঃ যথাসাধ্য বাহ্যিক সকল উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার পর আল্লাহর উপর ভরসা করা। অর্থাৎ, বাহ্যিক উপায় অবলম্বন পরিহার করে না, কারণ তা অবলম্বন করার আদেশ মহান আল্লাহই দিয়েছেন। তবে বাহ্যিক উপায়কেই তারা সব কিছু মনে করে না; বরং তাদের দৃঢ়-বিশ্বাস যে, আসলে সকল কর্ম আল্লাহর ইচ্ছাতেই সম্পন্ন হয়। অতএব যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা না হবে, ততক্ষণ বাহ্যিক উপায় অবলম্বন কোনই কাজে আসবে না। আর এই দৃঢ়-বিশ্বাস ও ভরসার কারণে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া হতে এক পলও গাফেল থাকে না। পরবর্তীতে আরো কিছু গুণের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে। এই সকল গুণের অধিকারীদেরকে মহান আল্লাহ প্রকৃত মু'মিন গণ্য করেছেন এবং ক্ষমা, দয়া ও উত্তম জীবনোপকরণের সুসংবাদ দিয়েছেন। (আল্লাহ আমাদেরকে যেন তাদের দলভুক্ত করেন।)
বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটঃ- বদর যুদ্ধ হিজরী দ্বিতীয় সনে সংঘটিত হয়। এটি কাফেরদের সাথে প্রথম যুদ্ধ। এ ছাড়া এ যুদ্ধের কোন পরিকল্পনা ছিল না; বরং তা হঠাৎ সংঘটিত হয়ে যায়। যোদ্ধা ও যুদ্ধাস্ত্র অল্প থাকার কারণে কোন কোন মুসলিম মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না। এর প্রেক্ষাপট ছিল এরূপ যে, আবু সুফিয়ান (যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি) এর নেতৃত্বে একটি বাণিজ্য কাফেলা শাম হতে মক্কায় ফিরছিল। এদিকে মুসলিমদের হিজরত করার ফলে তাদের ধন-সম্পদ মক্কায় থেকে গিয়েছিল বা কাফেররা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেই সাথে মক্কার কাফেরদের শক্তি ভেঙ্গে দেওয়াও ছিল সময়ের দাবী। উক্ত সকল কারণে রসূল (সাঃ) বাণিজ্য কাফেলার উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে মুসলিমগণ মদীনা ত্যাগ করেন। আবূ সুফিয়ানের নিকট এই সংবাদ পৌঁছে যায়। সুতরাং তিনি রাস্তা পরিবর্তন করে ফেলেন এবং মক্কায় এ সংবাদ পৌঁছে দেন। যার ফলে আবূ জাহল একটি সেনাদল নিয়ে কাফেলার হিফাযতের জন্য বদরের দিকে রওনা হয়। যখন নবী (সাঃ) এই পরিস্থিতি জানতে পারেন তখন তা সাহাবাদের নিকট খুলে বলেন। সেই সাথে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথাও ব্যক্ত করেন যে, (বাণিজ্য কাফেলা অথবা সেনাদল) এই দুয়ের মধ্যে একটির সাক্ষাৎ পাবে। তবুও কিছু সাহাবী যুদ্ধের ব্যাপারে দ্বিধা প্রকাশ করে বাণিজ্য কাফেলার পিছু নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। পক্ষান্তরে অন্যান্য সাহাবীগণ রসূল (সাঃ) সাথে থেকে যুদ্ধে পরিপূর্ণ সাহায্য-সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। এই প্রেক্ষিতেই উক্ত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنْتُمْ تَسْمَعُونَ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর এবং (তার কথা) শ্রবণ করার পরেও তার (আনুগত্য) হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ قَالُوا سَمِعْنَا وَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ
📘 আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা বলে, ‘শ্রবণ করলাম’ অথচ তারা শ্রবণ করে না।[১]
[১] অর্থাৎ, শোনার পরও আমল না করা, এটি কাফেরদের অভ্যাস। এই শ্রেণীর অভ্যাস থেকে তোমরা বিরত থাক। পরবর্তী আয়াতে তাদেরকে কালা, বোবা, বিবেকহীন ও নিকৃষ্টতম জীব বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। دَوَاب শব্দটি دَابَّة এর বহুবচন। পৃথিবীতে চলাফেরা করে এ রকম প্রত্যেক জীবকেই دابة বলা হয়। এখানে সৃষ্টিজগতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, এরা সকল জীব হতে নিকৃষ্ট, যারা সত্যের ব্যাপারে কালা, বোবা ও বিবেকহীন।
۞ إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ
📘 নিশ্চয় আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব কালা ও বোবা; যারা কিছুই বোঝে না।[১]
[১] এই কথাটিকেই কুরআনের অন্যত্র এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।{لَهُمْ قُلُوبٌ لاَّ يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لاَّ يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آذَانٌ لاَّ يَسْمَعُونَ بِهَا أُوْلَئِكَ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُوْلَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ} অর্থাৎ, তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দর্শন করে না এবং তাদের কর্ণ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়; বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত! তারাই হল উদাসীন।
(সূরা আ'রাফ ৭:১৭৯ আয়াত)
وَلَوْ عَلِمَ اللَّهُ فِيهِمْ خَيْرًا لَأَسْمَعَهُمْ ۖ وَلَوْ أَسْمَعَهُمْ لَتَوَلَّوْا وَهُمْ مُعْرِضُونَ
📘 আল্লাহ যদি তাদের মধ্যে ভাল কিছু জানতেন, তাহলে তিনি তাদেরকে শোনাতেন।[১] কিন্তু তিনি তাদেরকে শোনালেও তারা উপেক্ষা করে মুখ ফেরাত। [২]
[১] অর্থাৎ, তাদের শোনাকে ফলপ্রসূ করে তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করতেন, যাতে তারা সত্য গ্রহণ করে নিত। কিন্তু যেহেতু তাদের মধ্যে কল্যাণ অর্থাৎ, সত্যের সন্ধানই নেই, সেহেতু তারা সঠিক বুঝ হতে বঞ্চিত।
[২] প্রথম শোনা হতে লাভদায়ক শোনা (অর্থাৎ, মানা), আর দ্বিতীয় শোনা হতে কেবল সাধারণ শোনা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ যদি সত্য কথা শুনিয়েও থাকেন, তবুও যেহেতু তাদের মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান নেই, সেহেতু তারা পুনরায় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! রসূল যখন তোমাদেরকে এমন কিছুর দিকে আহবান করে, যা তোমাদেরকে প্রাণবন্ত করে,[১] তখন আল্লাহ ও রসূলের আহবানে সাড়া দাও এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন[২] এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে।
[১] لِمَا يُحْيِيكُم এর অর্থঃ এমন বস্তুর দিকে যা তোমাদেরকে জীবন দান করে। কেউ কেউ বলেন, এ থেকে জিহাদ বুঝানো হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিজয়ীর জীবন। আবার কেউ কুরআনের আদেশ-নিষেধ, শরীয়তের বিধান অর্থ নিয়েছেন, এর মধ্যে জিহাদও রয়েছে। সারকথা হল যে, কেবল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা মানো, তার উপর আমল কর। এতেই রয়েছে তোমাদের জীবন।
[২] অর্থ মৃত্যুদান করে, যার স্বাদ সকলকেই গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ, তোমাদের মৃত্যু আসার পূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা মেনে নিয়ে তার উপর আমল কর। কেউ কেউ বলেন, মহান আল্লাহ মানুষের হৃদয়ের এত নিকটে যে, তারই উপমা এখানে দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ তিনি মানুষের মনের গোপন কথাও জানেন, তাঁর কাছে কোন জিনিসই লুক্কায়িত নয়। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এর অর্থ বলেছেন যে, তিনি যখন চান মানুষ ও তার অন্তরের মাঝে অন্তরায় হয়ে যান। এমনকি মানুষ তাঁর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কিছুই পেতে পারে না। আবার কেউ কেউ একে বদরের যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত বলেছেন; মুসলিমগণ শত্রুদের সংখ্যাধিক্যে ভীত ছিলেন, মহান আল্লাহ তাঁদের অন্তরে অন্তরায় হয়ে ভয়কে অভয়ে বদলে দেন। ইমাম শাওকানী বলেন, আয়াতের উক্ত সকল অর্থই হতে পারে। (ফাতহুল কাদীর) ইমাম ইবনে জারীরের বর্ণিত অর্থের সমর্থন ঐ সকল হাদীস দ্বারা হয়, যাতে দ্বীনের উপর অবিচল থাকার দু'আ করতে তাকীদ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদীসে নবী (সাঃ) বলেছেন, "আদম সন্তানের অন্তরসমূহ একটি অন্তরের ন্যায় রহমানের (আল্লাহর) দুই আঙ্গুলের মাঝে রয়েছে। তিনি যেভাবে চান তা ঘুরিয়ে থাকেন। তারপর তিনি এই দু'আ পাঠ করেন। হে অন্তর ফিরানোর মালিক! আমাদের অন্তরকে তোমার আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে দাও।" (মুসলিমঃ তকদীর অধ্যায়) অন্য বর্ণনায় আছে, "হে হৃদয় পরিবর্তনকারী! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনে অবিচল রাখ।"
(তিরমিযী, তাকদীর পরিচ্ছেদ)
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً ۖ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
📘 তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় কর, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা অত্যাচারী কেবল তাদেরই ক্লিষ্ট করবে না[১] এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।
[১] অর্থাৎ, দোষী-নির্দোষ সকলকেই করবে। এই ফিতনা থেকে উদ্দেশ্য, মানুষের এক অপরের উপর ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নির্বিচারে সকলের উপর অত্যাচার করে। অথবা ব্যাপক আযাব বা শাস্তি, যেমন অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি, যা আকাশ ও পৃথিবী হতে প্রাকৃতিক দুর্যোগরূপে নেমে আসে, যাতে সৎ-অসৎ সবাই প্রভাবিত হয়। অথবা কিছু হাদীসে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধাদান ছেড়ে দিলে যে শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, এখানে তাকেই 'ফিতনা' বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
وَاذْكُرُوا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيلٌ مُسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَنْ يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
📘 স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে। তোমরা আশংকা করতে যে লোকেরা তোমাদেরকে অপহরণ করবে, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন এবং তোমাদেরকে উত্তম বস্তুসমূহ দান করেন; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। [১]
[১] আলোচ্য আয়াতে মক্কী জীবনের কষ্ট ও বিপদের বর্ণনা এবং তারপরে মাদানী জীবনে আল্লাহর অনুগ্রহে যে সুখ-শান্তি ও সচ্ছলতা মুসলিমগণ লাভ করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! জেনে-শুনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত (গচ্ছিত দ্রব্য) সম্পর্কেও নয়। [১]
[১] আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধিকারে খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) এই যে, জনসমাজে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করা তথা নির্জনে তার বিপরীত পাপে লিপ্ত হওয়া। অনুরূপভাবে এটিও খিয়ানত যে, ফারায়েযের মধ্যে কোন ফরয ছেড়ে দেওয়া ও নিষিদ্ধ জিনিষের মধ্যে কোন কিছু করা। পরস্পরের আমানতে খিয়ানত করতেও নিষেধ করা হয়েছে। নবী (সাঃ)ও আমানত রক্ষার ব্যাপারে খুব বেশি তাকীদ করেছেন। হাদীসে এসেছে যে, নবী (সাঃ) প্রায় খুতবায় এ কথাটি অবশ্যই বলতেন, "যে আমানত রক্ষা করে না তার ঈমান নেই, যে চুক্তি রক্ষা করে না, তার দ্বীন নেই।"
(আহমাদ)
وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ
📘 আর জেনে রাখ যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো পরীক্ষার বস্তু[১] এবং নিশ্চয় আল্লাহর নিকটে রয়েছে মহা পুরস্কার।।
[১] সাধারণতঃ সন্তান ও সম্পদ মানুষকে খিয়ানত করতে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হতে বাধ্য করে। সেই জন্য সে দুটিকে ফিতনা (পরীক্ষা) বলা হয়েছে। অর্থাৎ এর দ্বারা মানুষের পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে যে, তাদের ভালবাসায় আমানত ও আনুগত্যের হক পূর্ণরূপে আদায় করে কি না? যদি সে তা পূর্ণরূপে আদায় করে, তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, অন্যথা সে অনুত্তীর্ণ ও অসফল বলে গণ্য হয়। এই অবস্থায় এই সম্পদ ও সন্তান তাঁর জন্য আল্লাহর শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَتَّقُوا اللَّهَ يَجْعَلْ لَكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
📘 হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহশীল।[১]
[১] 'তাকওয়া' অর্থ হল আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ ও তাঁর নিষিদ্ধ কর্ম হতে বিরত থাকা। فُرقَان এর কয়েকটি অর্থ বলা হয়েছে; যেমন এমন বিবেক বা অন্তর যা হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। অর্থ এই যে, তাকওয়ার কারণে অন্তর দৃঢ়, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও হিদায়াতের রাস্তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ যখন দ্বিধা ও সন্দেহের মরুভূমিতে ঘুরপাক খায়, তখন সে সঠিক পথের সন্ধান পায়। এ ছাড়াও فُرقَان এর অর্থঃ সাহায্য, পরিত্রাণ, বিজয় সমস্যার সমাধানও করা হয়েছে। আর এ সকল অর্থই এখানে উদ্দিষ্ট হতে পারে। কারণ তাকওয়ার কারণে এই সব উপকার হয়ে থাকে। বরং তার সাথে সাথে গোনাহের কাফফারা, পাপ থেকে ক্ষমালাভ এবং মহা পুরস্কার লাভও হয়।
الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ
📘 যারা যথাযথভাবে নামায পড়ে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, তা থেকে দান করে।
وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
📘 স্মরণ কর, যখন অবিশ্বাসীরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দী করার জন্য, হত্যা অথবা নির্বাসিত করার জন্য।[১] তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ।[২]
[১] এটি সেই ষড়যন্ত্রের বর্ণনা যা মক্কার নেতারা এক রাত্রে 'দারুন নাদ্ওয়া'য় বসে করেছিল। আর শেষ পর্যন্ত তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, বিভিন্ন গোত্রের যুবকদেরকে মহানবী (সাঃ)-কে হত্যার জন্য নিযুক্ত করা হোক। যাতে তাঁর খুনের বদলে কোন একজনকে হত্যা না করা হয়; বরং মুক্তিপণ দিয়ে বাঁচা যায়।
[২] সুতরাং সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক রাতে যুবকগণ তাঁর বাড়ির সামনে এমন প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে যে, তিনি বের হলেই মেরে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলা উক্ত ষড়যন্ত্রের সংবাদ নবী (সাঃ)-কে পৌঁছে দিলেন এবং তিনি এক মুঠো বালি নিয়ে তাদের মাথায় ছড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলেন। কেউ নবী (সাঃ)-এর বের হওয়ার টের পর্যন্তও পায়নি। অতঃপর তিনি সওর গিরিগুহায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। এটিই ছিল মহান আল্লাহর কাফেরদের বিরুদ্ধে কৌশল বা ষড়যন্ত্র। আর তাঁর থেকে উত্তম ষড়যন্ত্র আর কেউ করতে পারে না। مكر এর অর্থ দেখার জন্য আল ইমরানের ৫৪নং আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।
وَإِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَٰذَا ۙ إِنْ هَٰذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ
📘 আর যখন তাদের নিকট আমার আয়াত পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা তো শুনেছি, ইচ্ছা করলে আমরাও এর অনুরূপ বলতে পারি, এ তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ছাড়া কিছু নয়।’
وَإِذْ قَالُوا اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَٰذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
📘 আরও স্মরণ কর, যখন তারা বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! যদি এ (কুরআন) তোমার পক্ষ হতে সত্য হয়, তাহলে আমাদের উপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দাও।’
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ ۚ وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
📘 আল্লাহ এরূপ নন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকা অবস্থায় তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন[১] এবং তিনি এরূপ নন যে, তাদের ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায় তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। [২]
[১] অর্থাৎ নবীর বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জাতির উপর আযাব আসে না। এই দিক দিয়ে নবী (সাঃ)-এর বিদ্যমানতা তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার কারণ ছিল।
[২] এর অর্থ তারা ভবিষ্যতে ইসলাম গ্রহণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অথবা তাওয়াফ করার সময় মুশরিকরা 'গুফরানাকা রাব্বানা গুফরানাক' (তোমার ক্ষমা চাই প্রভু! তোমার ক্ষমা চাই) বলত।
وَمَا لَهُمْ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُوا أَوْلِيَاءَهُ ۚ إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
📘 তাদের মধ্যে কি (এমন গুণ) আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না; যখন তারা লোকদেরকে মাসজিদুল-হারাম (পবিত্র কা’বা) হতে নিবৃত্ত করে? অথচ তারা ওর তত্ত্বাবধায়ক নয়, ওর তত্ত্বাবধায়ক তো কেবল (পরহেযগার) সাবধানী লোকেরাই। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা অবগত নয়।[১]
[১] অর্থাৎ, মুশরিকরা নিজেদেরকে মাসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধায়ক মনে করত। আর এই কারণেই তারা যাকে ইচ্ছা তাওয়াফের অনুমতি দিত, আবার যাকে ইচ্ছা তাওয়াফে বাধা দিত। অনুরূপ মুসলিমদেরকেও মসজিদে আসতে বাধা দিত। অথচ আসলে তারা মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক ছিল না। শক্তির জোরে এ রকম মনে করত। মহান আল্লাহ বলেন, 'তার তত্ত্বাবধায়ক একমাত্র (মু'মিন) মুত্তাক্বীরাই হতে পারে, মুশরিকরা নয়।' এ ছাড়া এই আয়াতে যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ মক্কা বিজয়। যা ছিল মক্কাবাসীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব সমতুল্য। পূর্বের আয়াতে নবী (সাঃ)-এর বর্তমানে আযাব না আসার যে কথা বলা হয়েছে, সে আযাব হল ধ্বংসের আযাব। তবে শিক্ষা ও সতর্ক করার জন্য ছোটখাট আযাব আসা তার বিরোধী নয়।
وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلَّا مُكَاءً وَتَصْدِيَةً ۚ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ
📘 আর কা’বা গৃহের নিকট শুধু শিস ও করতালি দেওয়াই ছিল তাদের নামায।[১] সুতরাং অবিশ্বাসের জন্য তোমরা শাস্তি ভোগ কর।
[১] মুশরিকরা যেমন উলঙ্গ হয়ে কা'বার তাওয়াফ করত অনুরূপ তাওয়াফের সময় মুখে আঙ্গুল দিয়ে শিস দিত ও দুই হাত দিয়ে তালি বাজাতো। আর এটিকে তারা ইবাদত ও পুণ্যের কাজ মনে করত। যেমন আজকাল কিছু সুফীরা মসজিদে ও আস্তানায় নাচে, ঢোল-তবলা বাজায় এবং বলে, 'এটিই আমাদের ইবাদত ও নামায। আমরা নেচে নেচে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে নেব।' (আমরা আল্লাহর কাছে এই সমস্ত কুসংস্কার হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ۚ فَسَيُنْفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ ۗ وَالَّذِينَ كَفَرُوا إِلَىٰ جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ
📘 নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাসী, আল্লাহর পথ হতে লোককে নিবৃত্ত করার জন্য তারা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর তা তাদের মনস্তাপের কারণ হবে। এরপর তারা পরাভূত হবে। আর যারা অবিশ্বাস করে, তাদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করা হবে। [১]
[১] যখন মক্কার কুরাইশদের বদরে পরাজয় ঘটল এবং পরাজিত সেনা মক্কায় পৌঁছল, এদিকে আবু সুফিয়ানও বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে মক্কায় এসে পৌঁছল, তখন যাদের পিতা, পুত্র বা ভাই নিহত হয়েছিল তারা আবূ সুফিয়ান ও যারা বাণিজ্যের শরীকান ছিল তাদের নিকট গিয়ে আপিল করল যে, এই কাফেলার সকল সম্পদ মুসলিমদের নিকট থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্যয় হোক। মুসলিমরা আমাদের প্রচুর ক্ষতি করেছে। এতএব প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ অত্যন্ত জরুরী। মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাদের বা তাদের মত চরিত্রের অধিকারী লোকেদের ব্যাপারে বলেন, নিঃসন্দেহে কাফেররা অন্যদেরকে আল্লাহর রাস্তায় বাধা দানের জন্য সম্পদ খরচ করবে। ফলে তাদের ভাগ্যে আফসোস ও দুঃখ ছাড়া আর কিছু থাকবে না। আর পরকালে তাদের স্থান হবে জাহান্নাম।
لِيَمِيزَ اللَّهُ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَيَجْعَلَ الْخَبِيثَ بَعْضَهُ عَلَىٰ بَعْضٍ فَيَرْكُمَهُ جَمِيعًا فَيَجْعَلَهُ فِي جَهَنَّمَ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
📘 এ জন্যই যে, আল্লাহ কুজনকে সুজন হতে পৃথক করবেন[১] এবং কুজনের এককে অপরের উপর রাখবেন, অতঃপর সকলকে স্তূপীকৃত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন, এরাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।
[১] এই পৃথকীকরণ হয়তো বা পরকালে হবে। সৎলোকদেরকে অসৎ লোক হতে আলাদা করে নেওয়া হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, {وَامْتَازُوا الْيَوْمَ أَيُّهَا الْمُجْرِمُونَ} "হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও।"
(সূরা ইয়াসীন ৩৬:৫৯ আয়াত)
অর্থাৎ, সৎলোকদের হতে আলাদা হয়ে যাও। আর অপরাধীরা অর্থাৎ, কাফের-মুশরিক ও অবাধ্য লোকেরা। এদেরকে একত্রিত করে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অথবা এই পৃথকীকরণ পৃথিবীতেই ঘটবে। আর 'লাম' হরফটি কারণ দর্শানোর জন্য হবে। অর্থাৎ, কাফেররা অন্যদেরকে আল্লাহর রাস্তায় বাধা দেওয়ার জন্য সম্পদ খরচ করবে। আমি তাদেরকে এ রকম করার সুযোগ দেব, যাতে এভাবে ভালকে মন্দ হতে, কাফেরকে মু'মিন হতে, মুনাফিককে প্রকৃত মুসলিম হতে আলাদা করে দিই। এইভাবে এই আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় যে, আমি কাফেরদের দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা নেব; তারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়বে। আর আমি তাদের লড়াইয়ে অর্থব্যয় করার শক্তি যোগাব, যাতে সুজন হতে কুজন আলাদা হয়ে যায়। অতঃপর তিনি সকল কুজনদের একত্রিত করবেন।
قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّتُ الْأَوَّلِينَ
📘 অবিশ্বাসীদেরকে তুমি বল, ‘যদি তারা (কুফরী ও অবিশ্বাস থেকে) বিরত হয়, তাহলে অতীতে তাদের যা (পাপ) হয়েছে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন,[১] কিন্তু তারা যদি অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে পূর্ববর্তীদের (সাথে আমার আচরিত) রীতি তো রয়েছেই। [২]
[১] 'বিরত হয়' অর্থঃ মুসলিম হয়ে যায়। যেমন, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে পুণ্যের রাস্তা অবলম্বন করবে, তাকে ঐ সকল পাপের জবাবদিহি করতে হবে না, যা সে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে করেছে। আর যে ইসলাম গ্রহণ করার পরও পাপের পথ ছাড়বে না, তাকে পূর্বের ও পরের সকল আমলের ব্যাপারে পাকড়াও করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম) এক অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, "ইসলাম পূর্বের গোনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়।"
(আহমাদ)
[২] যদি তারা কুফর ও শত্রুতার পথ ত্যাগ না করে, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক আল্লাহর আযাবে পতিত হবে।
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ۚ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
📘 তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক; যতক্ষণ না ফিতনা (শিরক) দূর হয়[১] এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।[২] অতঃপর তারা যদি বিরত হয়, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কার্যাবলীর সম্যক দ্রষ্টা।[৩]
[১] 'ফিতনা' শিরককে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ঐ সময় পর্যন্ত জিহাদ চালু রাখো, যতক্ষণ শিরক নিঃশেষ না হয়ে যায়।
[২] অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ববাদের পতাকা সারা পৃথিবী ব্যাপী উড্ডীন হয়।
[৩] অর্থাৎ, তাদের বাহ্যিক ইসলাম গ্রহণই তোমাদের জন্য যথেষ্ট, আর তাদের গোপন ব্যাপার আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। তিনি প্রকাশ্য-গোপন সবই জানেন।
أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
📘 তারাই প্রকৃত বিশ্বাসী। তাদেরই জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।
وَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَوْلَاكُمْ ۚ نِعْمَ الْمَوْلَىٰ وَنِعْمَ النَّصِيرُ
📘 আর যদি তারা মুখ ফেরায়[১] তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক[২] এবং তিনি কত উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী। [৩]
[১] অর্থাৎ, ইসলাম গ্রহণ না করে এবং কুফরীর ও তোমাদের বিরোধিতার উপর অবিচল থাকে।
[২] তোমাদের শত্রুদের উপর তোমাদের সাহায্যকারী এবং তোমাদের রক্ষক ও হিফাযতকারী।
[৩] সুতরাং সফলকাম সেই হবে, যার অভিভাবক আল্লাহ এবং বিজয় সেই লাভ করবে, যার সাহায্যকারী আল্লাহ।
۞ وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
📘 আরো জেনে রাখ যে, যুদ্ধে যা কিছু তোমরা (গনীমত) লাভ কর[১] তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তাঁর রসূলের, রসূলের নিকটাত্মীয়, পিতৃহীন এতীম, দরিদ্র এবং পথচারীদের জন্য;[২] যদি তোমরা আল্লাহতে ও সেই জিনিসে বিশ্বাসী হও যা ফায়সালার দিন[৩] (বদরে) আমি আমার দাসের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলাম;[৪] যেদিন দুই দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল[৫] এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।
[১] 'গনীমতের মাল' থেকে সেই মাল উদ্দেশ্য যা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর লাভ হয়। পূর্বের উম্মতে এই মাল বিতরণের পদ্ধতি এই ছিল যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কাফেরদের নিকট হতে লাভ করা সমস্ত মাল-সম্পদকে এক জায়গায় জমা করা হত, আর আসমান হতে আগুন এসে তাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত। কিন্তু মুসলিম উম্মতের জন্য এই গনীমতের মাল আল্লাহ হালাল করে দিয়েছেন। আর যে মাল দুই দলের সন্ধি চুক্তির ভিত্তিতে বিনা যুদ্ধে অথবা জিযিয়া কর ও খাজনা আদায়ের মাধ্যমে লাভ হয় তাকে 'ফাই-এর মাল' বলা হয়। কখনো কখনো গনীমতের মালকেও ফাই-এর মাল বলা হয়ে থাকে। من شيءٍ অর্থঃ যা কিছু। অর্থাৎ, কম হোক অথবা বেশী, মূল্যবান হোক অথবা সামান্য মূল্যের, সমস্তকে জমা করে তা যথারীতি বণ্টন করা হবে। কোন সৈন্যের জন্য তা হতে বণ্টনের পূর্বে কোন বস্তু রেখে নেওয়ার অনুমতি নেই।
[২] এখানে 'আল্লাহ' শব্দটি বরকতস্বরূপ। পরন্তু এই জন্যও যে, প্রত্যেক জিনিসের প্রকৃত পক্ষে মালিক হলেন তিনিই। আর আদেশও তাঁরই চলে। আল্লাহ ও তদীয় রসূলের ভাগ থেকে উদ্দেশ্য একটাই। অর্থাৎ, সমস্ত গনীমতের মালকে পাঁচ ভাগ করে চার ভাগ সেই মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা হবে, যাঁরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যেও পদাতিক (পায়ে হাঁটা ব্যক্তিদের)-কে এক ভাগ এবং অশ্বারোহীকে তিন ভাগ দেওয়া হবে। আর পঞ্চম ভাগটাকে পুনরায় পাঁচ ভাগ করা হবে, তার মধ্যে রসূল (সাঃ)-এর জন্য এক ভাগ। অতঃপর বাকী ভাগগুলি মুসলিমদের সাধারণ কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে। যেমন, নবী (সাঃ) নিজেও এই ভাগগুলি মুসলিমদের উপরেই খরচ করতেন। বরং তিনি বলেছেনও, الخمسُ مَردودٌ عليكم
(সুনানে নাসাঈ, সহীহ নাসাঈ ৩৮৫৮নং, আহমাদ ৫/৩১৯)
অর্থাৎ, আমার ভাগে যে পঞ্চম অংশ রয়েছে সেটাও মুসলিমদের উপকারে ব্যয় করা হবে। দ্বিতীয় ভাগ রসূল (সাঃ)-এর আত্মীয়-স্বজনের জন্য। অতঃপর এতীম ও মিসকীন ও মুসাফিরদের জন্য। আরো বলা হয় যে, এই পঞ্চম ভাগটি প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করা হবে।
[৩] 'ফায়সালার দিন' বলতে হক ও বাতিলের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালার দিন, বদর যুদ্ধের দিন। এ যুদ্ধ সন ২ হিজরী, রমযানের ১৭ তারীখে ঘটেছিল। সেই দিনটিকে 'ফায়সালার দিন' এই জন্য বলা হয় যে, এটা ছিল কাফের ও মুসলিমদের মাঝে প্রথম যুদ্ধ এবং তাতে মুসলিমদেরকে বিজয়ী করে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, ইসলাম ধর্মই হল সত্য ধর্ম আর কুফর ও শিরক হল বাতিল ধর্ম।
[৪] এখানে 'যা অবতীর্ণ' বলতে ফিরিশতা এবং অলৌকিক কিছু বিষয় ইত্যাদি অবতীর্ণ করাকে বুঝানো হয়েছে, যা বদর যুদ্ধের দিন ঘটেছিল।
[৫]অর্থাৎ, মুসলিম ও কাফিরদের সৈনদল।
إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَىٰ وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ ۚ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لَاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ ۙ وَلَٰكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَىٰ مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ ۗ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
📘 স্মরণ কর, তোমরা ছিলে উপত্যকার নিকট প্রান্তে এবং তারা ছিল দূর প্রান্তে[১] আর উষ্ট্রারোহী কাফেলা ছিল তোমাদের অপেক্ষা নিম্ন ভূমিতে।[২] যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে (যুদ্ধ সম্পর্কে সময়) ধার্য করতে, তাহলে সে ধার্যকৃত সময়ে পৌঁছতে তোমরা ভিন্নতর হতে।[৩] কিন্তু বস্তুতঃ যা ঘটার ছিল আল্লাহ তা সম্পন্ন করার জন্য উভয় দলকে যুদ্ধক্ষেত্রে (ধার্যকাল ছাড়াই সমবেত করলেন)। যাতে যে কেউ ধ্বংস হবে, সে যেন স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে, সে যেন স্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে জীবিত থাকে।[৪] আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
[১] دُنيا শব্দটির উৎপত্তি دُنُو থেকে, যার অর্থঃ নিকটে। এখানে 'নিকট প্রান্ত' বলে সেই প্রান্তকে বোঝানো হয়েছে যেটা মদীনা শহর থেকে নিকটেই ছিল। আর قصوى বলা হয় দূরকে। কাফেররা সেই প্রান্তে ছিল, যা মদীনা শহর থেকে দূরে অবস্থিত ছিল।
[২] 'কাফেলা' থেকে সেই বাণিজ্যিক দলকে বোঝানো হয়েছে যা আবূ সুফিয়ানের নেতৃত্বে শাম থেকে মক্কা ফিরছিল এবং (মক্কায় কবলিত সম্পত্তির বিনিময় স্বরূপ) যা পাবার উদ্দেশে মূলতঃ মুসলিমগণ এই দিকে এসেছিলেন। এ উটের কাফেলা পাহাড় থেকে বহুদূরে পশ্চিম দিকে নিম্নভূমিতে অবস্থিত ছিল। আর বদর প্রান্ত যুদ্ধক্ষেত্র ছিল উঁচু জায়গায়।
[৩] অর্থাৎ, যদি যুদ্ধের দিন ও তারীখ নির্ধারিত করে পরস্পরের মাঝে অঙ্গীকার বা ঘোষণা হত, তাহলে এমন সম্ভব ছিল, বরং নিশ্চিত ছিল যে, কোন দল লড়াই ছাড়াই পাশ কেটে যেত। কিন্তু এই যুদ্ধ ঘটার কথা যেহেতু আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছিলেন তাই তার জন্য এমন কারণ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, উভয় দল কোন প্রকার পূর্বদত্ত অঙ্গীকার ও হুমকি ছাড়াই বদর প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য এক অপরের সামনা-সামনি সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
[৪] এ হল আল্লাহর তকদীরী ইচ্ছার হেতু বা কারণ, যার ফলে উভয় দল বদরের ময়দানে একত্রিত হল। যাতে যে ঈমানদার হয়ে জীবিত থাকবে, সে যেন দলীলের সাথে জীবিত থাকে এবং তার এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, ইসলাম হল সত্য ধর্ম। কেননা, এর সত্যতার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছে বদরের যুদ্ধে। আর যে কাফের অবস্থায় ধ্বংস হবে, সেও যেন দলীলের সাথে ধ্বংস হয়। কেননা, এতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুশরিকদের পথ হল ভ্রষ্ট এবং বাতিল।
إِذْ يُرِيكَهُمُ اللَّهُ فِي مَنَامِكَ قَلِيلًا ۖ وَلَوْ أَرَاكَهُمْ كَثِيرًا لَفَشِلْتُمْ وَلَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ سَلَّمَ ۗ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
📘 স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে তাদের সংখ্যা অল্প দেখিয়েছিলেন। যদি তোমাকে তাদের সংখ্যা অধিক দেখাতেন, তাহলে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে অবশ্যই তিনি বিশেষভাবে অবহিত।[১]
[১] আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ)-কে সবপ্নে কাফেরদের সংখ্যা অল্প দেখিয়েছিলেন। আর সেই সংখ্যা তিনি সাহাবাদের কাছে বর্ণনা করলেন। যার ফলে তাঁদের হিম্মত বৃদ্ধি পেয়েছিল। যদি তাঁদের তুলনায় কাফেরদের সংখ্যা বেশী দেখানো হত, তাহলে হয়তো সাহাবাগণের হিম্মত দমে যেত এবং আপোসের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এই দু'টি সমস্যা থেকে তাঁদেরকে বাঁচিয়ে নিলেন।
وَإِذْ يُرِيكُمُوهُمْ إِذِ الْتَقَيْتُمْ فِي أَعْيُنِكُمْ قَلِيلًا وَيُقَلِّلُكُمْ فِي أَعْيُنِهِمْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا ۗ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ
📘 )স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে, তখন তিনি তাদেরকে তোমাদের দৃষ্টিতে স্বল্প-সংখ্যক দেখিয়েছিলেন এবং তোমাদেরকেও তাদের দৃষ্টিতে স্বল্প-সংখ্যক দেখিয়েছিলেন; [১] যাতে যা ঘটার ছিল তা তিনি সম্পন্ন করেন। [২] আর সব বিষয় আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে।
[১] যাতে সেই কাফেররাও তোমাদের ভয়ে পিছু হটে না যায়। প্রথম ঘটনাটি ছিল স্বপ্নের। আর এটা ঠিক লড়াইয়ের সময় দেখানো হয়েছিল, যেমন কুরআনের শব্দাবলী হতে এ কথা স্পষ্ট হয়। পরন্তু এই ব্যাপারটি শুরুর দিকে ছিল। কিন্তু যখন পূর্ণভাবে লড়াই আরম্ভ হয়ে গেল তখন কাফেররা মুসলিমদেরকে নিজেদের দ্বিগুণ দেখতে পেল; যেমন সূরা আলে ইমরানের ৩:১৩নং আয়াত থেকে সে কথা জানা যায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সংখ্যা বেশী দেখাবার হিকমত এই ছিল যে, যাতে অধিক সংখ্যা দেখে তাদের অন্তরে মুসলিমদের ত্রাস ও ভীতি সঞ্চার হয় এবং তার ফলে কাফেরদের মধ্যে কাপুরুষতা, ভীরুতা ও নিরুদ্যমতা এসে যায়। আর এর বিপরীত প্রথমে কম সংখ্যা দেখানোতে হিকমত এটাই ছিল যে, তারা যেন যুদ্ধ থেকে দূরে সরে না পড়ে।[২] এসবের উদ্দেশ্য ছিল যে, আল্লাহ তাআলা যে ফায়সালা করে রেখেছিলেন তা পূরণ হয়ে যায়। এই জন্য তিনি তার কারণ ও উপকরণ সৃষ্টি করে দিলেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
📘 হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা যখন কোন দলের সম্মুখীন হবে, তখন অবিচল থাক এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [১]
[১] এবার এখানে মুসলিমদেরকে সেই আদবসমূহ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় পালন করা জরুরী। (ক) দৃঢ়পদ ও অবিচলিত থাকবে। কারণ এ ছাড়া যুদ্ধের ময়দানে টিঁকে থাকা সম্ভব নয়। তবে কিন্তু এ থেকে যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন কিংবা স্বীয় দলে স্থান নেওয়ার দুই অবস্থা স্বতন্ত্র; যা পূর্বে
(সূরা আনফাল ৮:১৬ আয়াতে)
স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে। কেননা, কোন কোন ক্ষেত্রে দৃঢ়পদ থাকার জন্যেও যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন কিংবা স্বীয় দলে স্থান নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। (খ) যুদ্ধের সময় আল্লাহকে অধিকাধিক স্মরণ করবে। মুসলিম যোদ্ধা যদি সংখ্যায় কম থাকে, তাহলে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। অধিক যিকর করার ফলে আল্লাহও তাদের খেয়াল রাখবেন। আর যদি মুসলিমরা সংখ্যায় বেশী হয়, তাহলে আধিক্যের কারণে যেন তোমাদের অন্তরে গর্ব ও অহংকার সৃষ্টি না হয়। বরং আসল নির্ভর যেন আল্লাহর সাহায্যের উপরই থাকে।
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
📘 আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর ও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করো না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন। [১]
[১] তৃতীয় আদব হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে। এটা একেবারে স্পষ্ট কথা যে, এই শোচনীয় অবস্থায় আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের অবাধ্যাচরণে বড় ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে। এই জন্য প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এহেন অবস্থায় বরং প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করা আবশ্যক। তথাপি যুদ্ধের ময়দানে তাঁদের আনুগত্য করা আরো অধিকরূপে আবশ্যক হয়ে যায়। আর এই অবস্থায় সামান্য অবাধ্যাচরণও আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চতুর্থ আদব হল, কোন বিষয় নিয়ে আপোসে ঝগড়া-বিবাদ ও মতবিরোধ করবে না। কারণ এরূপ করলে তোমরা হীনবল হয়ে পড়বে। আর তোমাদের শক্তি চূর্ণ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। পঞ্চম আদব হল যে, ধৈর্যধারণ করবে। অর্থাৎ, যত বড়ই বিপদ বা কঠিন কষ্টের সম্মুখীন হও না কেন, ধৈর্যচ্যুত হবে না। নবী (সাঃ) বলেছেন, "হে লোক সকল! শত্রুদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো না, বরং তা হতে আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা চাও। পরন্তু যদি শত্রুদের সাথে লড়াই শুরু হয়েই যায়, তাহলে সবর কর (অর্থাৎ, বিচলিত না হয়ে লড়াই কর)। আর জেনে রাখ, জান্নাত তরবারির ছায়ার নিচেই আছে।"
(সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়)
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ۚ وَاللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
📘 তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা গর্বভরে ও লোক দেখানোর জন্য নিজ গৃহ হতে বের হয়েছিল এবং লোককে আল্লাহর পথ হতে বাধা দান করছিল।[১] তাদের সকল কীর্তিকলাপই আল্লাহর জ্ঞানায়ত্তে রয়েছে।
[১] মক্কার মুশরিকরা যখন নিজেদের বাণিজ্য কাফেলার হিফাযত ও যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হল, তখন তারা বড় ফখর, গর্ব ও অহংকারের সাথে বের হল। মুসলিমদেরকে কাফেরদের এই কুঅভ্যাস থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ ۖ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ ۚ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
📘 স্মরণ কর, শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করেছিল এবং বলেছিল, আজ মানুষের মধ্যে কেউই তোমাদের উপর বিজয়ী হবে না, আর আমি অবশ্যই তোমাদের সহযোগী (প্রতিবেশী)। অতঃপর দু’ দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হল, তখন সে পিছু হটে সরে পড়ল ও বলল, ‘নিশ্চয় তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। নিশ্চয় আমি তা দেখি, যা তোমরা দেখতে পাও না।[১] নিশ্চয় আমি আল্লাহকে ভয় করি।’[২] আর আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। [৩]
[১] মুশরিকরা যখন মক্কা থেকে রওনা দিল তখন তাদের দুশমন গোত্র বানী বাকার বিন কিনানার পক্ষ থেকে তাদের আশঙ্কা ছিল যে, তাদেরকে পিছন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুতরাং শয়তান বানী বাকার বিন কিনানার একজন সর্দার সুরাকা বিন মালেকের রূপ ধরে এল এবং সে তাদেরকে শুধু বিজয়ের সুসংবাদই দিল না; বরং তাদের সহযোগিতা করার পূর্ণ আস্থা দিল। কিন্তু যখন মুসলিমদের পক্ষে ফিরিশতা দ্বারা আল্লাহর মদদ তার পরিদৃষ্ট হল, তখন সে সকলকে ছেড়ে পিছন ফিরে পলায়ন করল।
[২] আল্লাহর ভয় তার অন্তরে আর কি সৃষ্টি হবে? তবে তার দৃঢ়-বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বিশেষ সাহায্য রয়েছে; মুশরিকরা তাদের সামনে টিঁকে থাকতে পারবে না।
[৩] হতে পারে এটা শয়তানের কথার একাংশ। আর এটাও হতে পারে যে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পৃথকভাবে নতুন বাক্য ছিল।
إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَٰؤُلَاءِ دِينُهُمْ ۗ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
📘 স্মরণ কর, যখন মুনাফিক্ব (কপট) ও যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে[১] তারা বলতে লাগল, ‘এদের ধর্ম এদেরকে প্রতারিত করেছে।’[২] আর যে আল্লাহর উপর নির্ভর করে, (সে বিজয়ী হয়।) নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [৩]
[১] 'যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে' থেকে উদ্দেশ্য হল সেই নও মুসলিমগণ যাঁরা প্রথম প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মুসলিমদের সাফল্যের ব্যাপারে তাদের সন্দেহ ছিল। অথবা এ থেকে উদ্দেশ্য মুশরিকদল। আর এটাও হতে পারে যে, এ থেকে মদীনায় বসবাসকারী ইয়াহুদীদল উদ্দেশ্য।
[২] অর্থাৎ, এদের সংখ্যা তো দেখ! আর যুদ্ধসামগ্রীর যা অবস্থা তাও তো প্রকাশ। অথচ এরা মুকাবিলা করতে চলেছে মক্কার মুশরিকদের সাথে; যারা এদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশী এবং তাদের আছে নানান ধরনের যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম ও উপকরণ। মনে হয় যে, এদের দ্বীন এদেরকে ধোঁকায় ফেলেছে। এই মোটা কথাও ওদের মগজে ধরে না?!
[৩] আল্লাহ তাআলা বলেন, ওই দুনিয়াদারদের কাছে সেই ঈমানদারদের ঈমান, মনোবল ও অবিচলতার কি অনুমান হতে পারে, যাদের ভরসা এক আল্লাহর উপর, যিনি মহাপরাক্রমশালী। অর্থাৎ, তাঁর প্রতি ভরসাকারীকে তিনি অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেন না। আর তিনি প্রজ্ঞাময়ও; তাঁর প্রত্যেক কর্ম প্রজ্ঞা ও হিকমতে পরিপূর্ণ; যা পূর্ণরূপে অনুভব করতে মানুষের জ্ঞান অপারগ।
كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنْ بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ لَكَارِهُونَ
📘 (যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারটা ওরা পছন্দ করেনি) যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে তোমার গৃহ হতে ন্যায়ভাবে বের করেছিলেন[১] অথচ বিশ্বাসীদের একদল এ পছন্দ করেনি।[২]
[১] যেমন গনীমতের মাল বণ্টনের ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় এবং তা আল্লাহ তাঁর রসূলের ফায়সালার উপর সোপর্দ করা হয়। সুতরাং তার মধ্যেই মুসলিমদের কল্যাণ নিহিত ছিল। অনুরূপ নবী (সাঃ)-এর মদীনা হতে বের হওয়া ও পরে বাণিজ্যিক কাফেলার পরিবর্তে সেনাদলের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যাওয়া। যদিও কিছু সাহাবীদের নিকট তা ছিল অপছন্দনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ মুসলিমদেরই হয়েছে।
[২] এই অপছন্দনীয়তা শুধু মাত্র সেনাদলের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে ছিল। যার প্রকাশ কিছু সাহাবী করেও ছিলেন। আর এর কারণও ছিল যুদ্ধাস্ত্র না থাকা। মদীনা হতে বের হওয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিল না।
وَلَوْ تَرَىٰ إِذْ يَتَوَفَّى الَّذِينَ كَفَرُوا ۙ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ وَذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ
📘 তুমি যদি দেখতে তখনকার অবস্থা যখন ফিরিশতাগণ অবিশ্বাসীদের মুখমন্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহন যন্ত্রণা ভোগ কর। [১]
[১] কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, এটা বদর যুদ্ধে মুশরিকদের নিহত হওয়ার ব্যাপার। ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত যে, যখন মুশরিকরা মুসলিমদের দিকে অগ্রসর হত, তখন মুসলিমরা তাদের চেহারায় তরবারি দ্বারা আঘাত করত। তা হতে বাঁচার জন্য তারা পিছন ফিরে পলায়ন করত। তখন ফিরিশতাগণ তাদের পাছাতে তরবারি মারতেন। কিন্তু এই আয়াত ব্যাপক; প্রত্যেক কাফের ও মুশরিক এর অন্তর্ভুক্ত। আর এর অর্থ হল, মৃত্যুর সময় ফিরিশতাগণ তাদের মুখমন্ডলে ও পাছায় আঘাত করে থাকেন; যেমন সূরা আনআমে (৬:৯৩ আয়াতে) বলা হয়েছে। {وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلآئِكَةُ بَاسِطُواْ أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُواْ أَنفُسَكُمُ} অর্থাৎ, "যদি তুমি দেখতে পেতে (তখনকার অবস্থা) যখন (ঐ) যালেমরা মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকবে আর ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের কর।" আর কারো কারো নিকটে ফিরিশতাগণের এই মার হবে কিয়ামতের দিন, যখন তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবেন এবং জাহান্নামের দারোগা বলবেন, 'তোমরা জাহান্নামের আযাব আস্বাদন কর।'
ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ
📘 এ হল তাদের কর্মফল। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি কখনও অন্যায় করেন না। [১]
[১] এই মার ও আযাব তোমাদের নিজেদেরই কর্মফল। নচেৎ আল্লাহ তাআলা বান্দাদের উপর অত্যাচার করেন না। বরং তিনি হলেন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। তিনি প্রত্যেক ধরনের অন্যায় ও অত্যাচার করা হতে পাক-পবিত্র। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, "হে আমার বান্দারা! আমি নিজের উপর যুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝেও তা হারাম করে দিয়েছি। অতএব তোমরাও আপোসে যুলুম করো না। হে আমার বান্দারা! এটা তোমাদেরই কৃত আমল যা আমি গণনা করে রেখেছি। অতএব যে নিজের আমলে কল্যাণ পাবে, সে যেন আল্লাহর প্রসংশা করে। আর যে তার বিপরীত পাবে, সে যেন নিজেকেই ভৎর্সনা করে।"
(সহীহ মুসলিমঃ নেকী করা ও অত্যাচার হারাম পরিচ্ছেদ)
كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ ۙ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۚ كَفَرُوا بِآيَاتِ اللَّهِ فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ شَدِيدُ الْعِقَابِ
📘 ফিরআউনের বংশধর ও তাদের পূর্ববর্তিগণের অভ্যাসের ন্যায়[১] এরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং আল্লাহ তাদের পাপের জন্য তাদেরকে শাস্তি দেন। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, শাস্তিদানে কঠোর।
[১] دأب অর্থঃ অভ্যাস। 'কাফ' হরফটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করার জন্য এসেছে। অর্থাৎ, আল্লাহর পয়গম্বরদেরকে মিথ্যা মনে করায় ঐ মুশরিকদের অভ্যাস বা অবস্থা হল সেই রকম, যে রকম ফিরআউন এবং তার পূর্বের অন্যান্য মিথ্যাজ্ঞানকারীদের অভ্যাস ও অবস্থা ছিল।
ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
📘 এ এ জন্য যে, আল্লাহ কোন সম্প্রদায়কে যে সম্পদ দান করেন, তিনি তা (ধ্বংস দিয়ে) পরিবর্তন করেন না; যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। [১] আর নিশ্চিত আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
[১] এর অর্থ এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতি বা গোষ্ঠী নিয়ামত অস্বীকারের পথ অবলম্বন করে এবং আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নিষেধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের অবস্থা ও আচরণকে বদলে না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাদের উপর নিজ নিয়ামতের দরজা বন্ধ করে দেন না। দ্বিতীয় শব্দে আল্লাহ তাআলা পাপের কারণে নিজ নিয়ামতকে ছিনিয়ে নেন। আর আল্লাহ তাআলার এই নিয়ামতের অধিকারী হওয়ার জন্য জরুরী হল পাপ হতে দূরে থাকা। সুতরাং পরিবর্তনের অর্থ এই যে, জাতি পাপ-পঙ্কিলতাকে বর্জন করে আল্লাহর আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে নিক।
كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ ۙ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ ۚ كَذَّبُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُمْ بِذُنُوبِهِمْ وَأَغْرَقْنَا آلَ فِرْعَوْنَ ۚ وَكُلٌّ كَانُوا ظَالِمِينَ
📘 ফিরআউনের বংশধর ও তাদের পূর্ববর্তিগণের অভ্যাসের ন্যায় এরা এদের প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যাজ্ঞান করে। তাদের পাপের জন্য আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং ফিরআউনের বংশধরকে (সমুদ্রে) নিমজ্জিত করেছি। আর তারা সকলেই ছিল অত্যাচারী।[১]
[১] এটা পূর্বোক্ত কথারই তাকীদ। অবশ্য এতে ধ্বংসের কথা অতিরিক্ত বর্ণনা হয়েছে যে, তাদেরকে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। এ ছাড়াও এ কথা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ডুবিয়ে মেরে তাদের প্রতি অত্যাচার করেননি। বরং তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছিল। যেহেতু আল্লাহ তাআলা কারোর প্রতি যুলুম করেন না। {وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيد} "তোমার প্রভু বান্দাদের উপর অত্যাচারী নন"
(সূরা হামীম সাজদাহ ৪১:৪৬ আয়াত)
إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الَّذِينَ كَفَرُوا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
📘 নিশ্চয় আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব তারাই, যারা সত্য প্রত্যাখ্যান (কুফরী) করেছে। সুতরাং তারা বিশ্বাস (ঈমান আনয়ন) করবে না। [১]
[১] شر الناس (নিকৃষ্টতম মানুষ) এর পরিবর্তে তাদেরকে شر الدوابّ (নিকৃষ্টতম জীব) বলা হয়েছে; যা আভিধানিক অর্থ হিসাবে এটা মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু প্রভৃতির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। কিন্তু সাধারণতঃ এর ব্যবহার চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। বুঝা যায় যে, কাফেরদের সম্পর্ক মানুষের সাথে নয়। (বরং জন্তুর সাথে। নিজের সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার ও অমান্য করে) কুফরে পতিত হয়ে তারা চতুষ্পদ জন্তু; বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট জীব হয়ে গেছে।
الَّذِينَ عَاهَدْتَ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنْقُضُونَ عَهْدَهُمْ فِي كُلِّ مَرَّةٍ وَهُمْ لَا يَتَّقُونَ
📘 ওদের মধ্যে তুমি যাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ, তারা প্রত্যেকবার তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা সাবধান হয় না। [১]
[১] এখানে কাফেরদেরই একটা খারাপ অভ্যাস বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রত্যেকবার তারা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তার মন্দ পরিণাম হতে একটুকুও ভয় করে না। কেউ কেউ এ থেকে ইয়াহুদী গোত্র বানু কুরাইযাকে বুঝিয়েছেন। যাদের সাথে রসূল (সাঃ)-এর চুক্তি ছিল যে, তারা কাফেরদের কোন প্রকার মদদ করবে না। কিন্তু তারা সে চুক্তি রক্ষা করেনি।
فَإِمَّا تَثْقَفَنَّهُمْ فِي الْحَرْبِ فَشَرِّدْ بِهِمْ مَنْ خَلْفَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ
📘 যুদ্ধে ওদেরকে তোমরা যদি তোমাদের আয়ত্তে পাও, তাহলে তাদেরকে এমন শায়েস্তা কর, যাতে ওদের পশ্চাতে যারা আছে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পলায়ন করে। [১] সম্ভবতঃ তারা শিক্ষা লাভ করবে।
[১] شرِّدْ بهم বলতে তাদেরকে এমন মার মারো, যাতে তাদের পশ্চাতে তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং সাথীদের মাঝে ভাগ-দৌড় অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। এমন কি তারা তোমার দিকে এই আশংকায় অগ্রসর না হয় যে, হতে পারে তাদেরও সেই অবস্থা হবে, যে অবস্থা তাদের অগ্রবর্তীদের হয়েছে।
وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِنْ قَوْمٍ خِيَانَةً فَانْبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَىٰ سَوَاءٍ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ
📘 যদি তুমি কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা কর, তাহলে তোমার চুক্তিও তুমি যথাযথভাবে বাতিল কর। [১] নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদেরকে পছন্দ করেন না। [২]
[১] 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলতে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ জাতির তরফ হতে চুক্তি ভঙ্গ করার আশঙ্কা। আর 'যথাযথ বা সমভাবে' বলতে তাদেরকে যথারীতি খবর করে দাও যে, আগামীতে আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন সন্ধিচুক্তি থাকবে না। যাতে উভয় দল নিজ নিজ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে এবং কোন দল অজানা অবস্থায় বা ভুলবশতঃ মারা না পড়ে।
[২] অর্থাৎ, এই চুক্তি ভঙ্গ করা যদি মুসলিমদের পক্ষ থেকেও হয় তবুও তা খিয়ানত; যা মহান আল্লাহ অপছন্দ করেন। মুআবিয়াহ (রাঃ) এবং রোমকদের মাঝে সন্ধিচুক্তি ছিল। যখন চুক্তির সময় শেষ হওয়ার নিকটবর্তী হয়ে এল, তখন মুআবিয়াহ (রাঃ) রোমকদের সীমান্ত এলাকার নিকট নিজের সৈন্যদল জমায়েত করতে শুরু করলেন। উদ্দেশ্য ছিল সন্ধিচুক্তি শেষ হওয়ার পরপরই রোমকদের উপর হামলা চালাবেন। এক সাহাবী আমর বিন আবাসাহ (রাঃ)-এর কানে মুআবিয়াহ (রাঃ)-এর এই প্রস্তুতির খবর পৌঁছলে তিনি এই আক্রমণকে প্রতারণা বলে আখ্যায়িত করলেন এবং রসূল (সাঃ)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করে এই আক্রমণকে সন্ধিচুক্তির পরিপন্থী বলে মন্তব্য করলেন। এ কথা শুনে মুআবিয়াহ (রাঃ) তাঁর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেন।
(মুসনাদে আহমাদ ৫/১১১, আবু দাঊদঃ জিহাদ অধ্যায়, তিরমিযীঃ সিয়ার)
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَبَقُوا ۚ إِنَّهُمْ لَا يُعْجِزُونَ
📘 আর অবিশ্বাসিগণ যেন কখনো মনে না করে যে, তারা (আমার) আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। তারা নিশ্চয়ই (আমাকে) হতবল করতে পারবে না।
يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُونَ
📘 সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও[১] তারা তোমার সাথে বিতর্ক করছিল, (মনে হচ্ছে) তারা যেন মৃত্যুর দিকে চালিত হচ্ছে এবং তারা যেন তা প্রত্যক্ষ করছে। [২]
[১] এ কথা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল যে, বাণিজ্য কাফেলা নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়ে প্রস্থান করেছে। আর এখন কুরাইশ সেনা সম্মুখে আছে, যাদের মুকাবিলা ছাড়া কোন গতি নেই।
[২] যোদ্ধা ও যুদ্ধাস্ত্রের স্বল্পতা হেতু মুসলিমদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এখানে তা প্রকাশ করা হয়েছে।
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ ۚ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ
📘 তোমরা তাদের (মোকাবিলার) জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সুসজ্জিত অশ্ব প্রস্তুত রাখ,[১] এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রু তথা তোমাদের শত্রুকে সন্ত্রস্ত করবে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ জানেন। আর আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় করবে, তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অত্যাচার করা হবে না।
[১] قُوَّة (শক্তি) শব্দের ব্যাখ্যা নবী (সাঃ) হতে প্রমাণিত আছে। তিনি বলেছেন, শক্তি হল, (তীর) নিক্ষেপ।
(মুসলিমঃ ইমারাহ অধ্যায় এবং আরো অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ)
কেননা, সে যুগে তীরই ছিল যুদ্ধের বড় অস্ত্র এবং তীর মারায় দক্ষতা অর্জন ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা। (যেহেতু তাতে দূর থেকেই শত্রু নিপাত করা যায়।) যেমন যুদ্ধের জন্য ঘোড়া ছিল অপরিহার্য ও অতীব প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম, যে কথা আলোচ্য আয়াতে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বর্তমান যুগে যুদ্ধে তীর নিক্ষেপ ও ঘোড়ার সেই গুরুত্ব এবং উপকারিতা বাকী নেই। এই জন্য 'তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সাধ্যমত শক্তি প্রস্তুত কর' এই নির্দেশ পালনে অধুনা যুগের যুদ্ধাস্ত্র (যেমন, ক্ষেপণাস্ত্র; রকেট, মিসাইল, ট্যাঙ্ক, কামান, বোমারু বিমান এবং সামুদ্রিক যুদ্ধের জন্য সাবমেরিন প্রভৃতি) এর প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক।
۞ وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا وَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
📘 আর যদি তারা সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সন্ধির জন্য আগ্রহী হও এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। [১] নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
[১] অর্থাৎ, যদি যুদ্ধের পরিবর্তে আপোসে সন্ধি অধিক ফলপ্রসূ ও যুক্তিসঙ্গত হয় এবং শত্রুরাও তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। পক্ষান্তরে যদি সন্ধি থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্য ধোঁকা ও প্রতারণা হয়, তবুও ঘাবড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। নিশ্চয় তিনি তোমাকে শত্রুর চক্রান্ত হতে নিরাপদে রাখবেন। আর তিনি একাই তোমার জন্য যথেষ্ট হবেন। কিন্তু সন্ধির এই অনুমতি এমন চূড়ান্ত অবস্থায় হবে, যখন মুসলিমরা দুর্বল হবে এবং সন্ধিতেই ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণ নিহিত থাকবে। পরন্তু অবস্থা যদি এর বিপরীত হয়; অর্থাৎ, মুসলিমরা শক্তিশালী ও যুদ্ধ উপকরণের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হয় এবং কাফেরদল দুর্বল ও পরাজেয় বলে বুঝা যায়, তাহলে এই অবস্থাতে সন্ধির পরিবর্তে কাফেরদের শক্তি ও প্রতাপ ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলা জরুরী। মহান আল্লাহ বলেন, "সুতরাং তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না। তোমরাই প্রবল; আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো নষ্ট করবেন না।"
(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩৫ আয়াত)
আরো এক জায়গায় তিনি বলেন, "এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যতক্ষণ না ফিৎনা দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।"
(সূরা আনফাল ৮:৩৯ আয়াত)
وَإِنْ يُرِيدُوا أَنْ يَخْدَعُوكَ فَإِنَّ حَسْبَكَ اللَّهُ ۚ هُوَ الَّذِي أَيَّدَكَ بِنَصْرِهِ وَبِالْمُؤْمِنِينَ
📘 পক্ষান্তরে যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায়, তাহলে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি তোমাকে স্বীয় সাহায্য ও বিশ্বাসিগণ দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।
وَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ۚ لَوْ أَنْفَقْتَ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا مَا أَلَّفْتَ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ أَلَّفَ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
📘 এবং তিনি ওদের পরস্পরের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন, পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না, কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। [১] নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[১] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ) এবং মু'মিনদের উপর যে অনুগ্রহ করেছেন তার মধ্যে একটি অনুগ্রহ উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হল এই যে, তিনি মু'মিনদের দ্বারা নবী (সাঃ)-এর সাহায্য করলেন; তাঁরা নবীর হাত, বাহু, পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী হয়ে গেলেন। আর মু'মিনদের প্রতি এই অনুগ্রহ করেছেন যে, তাঁদের মাঝে প্রথম দিকে যে শত্রুতা ছিল তিনি তাকে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যে পরিণত করে দিলেন। প্রথম দিকে তাঁরা একে অপরের রক্তপিপাসু ছিলেন। কিন্তু এখন একে অপরের জন্য প্রাণ কুরবানী দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। প্রথম দিকে তাঁরা একে অপরের প্রাণের শত্রু ছিলেন, এখন তাঁরা একে অন্যের জন্য দয়া ও স্নেহশীল হয়ে গেলেন। বহু যুগের আপোসের পুরাতন শত্রুতাকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে তাদের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেওয়া আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী এবং তাঁর কুদরত ও ইচ্ছাশক্তির প্রকৃষ্ট নমুনা ছিল। নতুবা এ এমন একটা কাজ ছিল যে, তার জন্য পৃথিবীর সমপরিমাণ ধনভান্ডার ব্যয় করলেও এই অভীষ্ট রত্ন লাভ হতো না। আল্লাহ তাআলা উক্ত অনুগ্রহের কথা সূরা আলে ইমরান ৩:১০৩নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন "তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে।" আর নবী (সাঃ)ও হুনাইনের যুদ্ধে গনীমতের মাল বণ্টনের সময় আনসারদেরকে লক্ষ্য করে দেওয়া এক ভাষণে বললেন, "হে আনসারদল! এ কথা কি সত্য নয় যে, তোমরা ভ্রষ্ট ছিলে, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে হিদায়াত দান করলেন। তোমরা অভাবী ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিলেন। আর তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিলে, আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দিলেন?" নবী (সাঃ)-এর প্রত্যেক কথার উত্তরে আনসারগণ বললেন, 'আল্লাহ ও তাঁর রসূল অধিক অনুগ্রহশীল।'
(বুখারীঃ মাগাযী অধ্যায়, তায়েফ যুদ্ধ পরিচ্ছেদ, মুসলিমঃ যাকাত অধ্যায়)
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
📘 হে নবী! তোমার জন্য ও তোমার অনুসারী বিশ্বাসিগণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ ۚ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ ۚ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ
📘 হে নবী! বিশ্বাসীদেরকে যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ কর,[১] তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন থাকলে এক হাজার অবিশ্বাসীর উপর বিজয়ী হবে। [২] কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।
[১] تحريض শব্দের অর্থ হল উদ্বুদ্ধকরণে অতিরঞ্জন করা। অর্থাৎ, খুব বেশী উদ্বুদ্ধ করা, আগ্রহ ও উৎসাহ সৃষ্টি করা। কেননা, এই নির্দেশ মোতাবেক নবী (সাঃ) যুদ্ধের পূর্বে সাহাবাদেরকে জিহাদের জন্য অতিশয় উদ্বুদ্ধ করতেন এবং তার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করতেন। যেমন, বদর যুদ্ধের সময় যখন মুশরিকরা নিজেদের ভারী সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ যুদ্ধসামগ্রীসহ ময়দানে উপস্থিত হল, তখন নবী (সাঃ) বললেন, "এমন জান্নাতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও, যার প্রস্থ আকাশ-পৃথিবী সমান।" এক সাহাবী উমাইর বিন হুমাম (রাঃ) বললেন, 'জান্নাতের প্রস্থ আকাশ-পৃথিবী সমান? হে আল্লাহর রসূল!' তিনি বললেন, "হ্যাঁ!" তা শুনে তিনি 'ওহো' বললেন। অর্থাৎ, খুশী প্রকাশ করলেন এবং এই আশা ব্যক্ত করলেন যে, 'আমিও জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই।' তিনি বললেন, "তুমি তাদের একজন হবে।" অতএব তিনি নিজের তরবারির খাপকে ভেঙ্গে ফেললেন এবং কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। খেতে খেতে অবশিষ্ট খেজুর তিনি মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, 'এগুলি খাবার জন্য জীবিত থাকলে সে জীবন তো বড় দীর্ঘ জীবন!' অতঃপর তিনি জিহাদ করার জন্য বীরত্বের সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। পরিশেষে তিনি কাফেরদের সাথে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গেলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন।
(মুসলিমঃ ইমারাহ অধ্যায়)
[২] এটা মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ যে, তোমাদের মধ্যে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধকারী ২০ জন যোদ্ধা ২০০ জন কাফের সৈন্যের বিরুদ্ধে এবং ১০০ জন যোদ্ধা তাদের এক হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট হয়ে বিজয়ী থাকবে।
الْآنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا ۚ فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ ۚ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ
📘 আল্লাহ এখন তোমাদের ভার লাঘব করলেন। তিনি অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে একশ’ জন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দু’শ জনের উপর বিজয়ী হবে। আর তোমাদের মধ্যে এক হাজার থাকলে আল্লাহর অনুজ্ঞাক্রমে তারা দু’ হাজারের উপর বিজয়ী হবে। [১] বস্তুতঃ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। [২]
[১] পূর্বের হুকুম সাহাবাদের উপর ভারী মনে হল। কেননা, এর অর্থ ছিল ১ জন মুসলিম ১০ জন কাফের, ২০ জন মুসলিম ২০০ কাফের এবং ১০০ জন মুসলিম ১০০০ জন কাফেরের মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট। আর তার মানেই হল কাফেরদের তুলনায় মুসলিমদের সংখ্যা অনুরূপ (১০ গুণ কম) হলে জিহাদ করা ফরয এবং তা ত্যাগ করা কোন প্রকারে বৈধ নয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা এই সংখ্যাকে হালকা করে ১/১০ থেকে কম করে ১/২ (অর্থাৎ আধা-আধি) সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিলেন।
(বুখারীঃ তফসীর সূরা আনফাল)
এখন এই তুলনামূলক উক্ত সংখ্যা হলে জিহাদ ফরয; তার থেকে কম হলে ফরয নয়।
[২] এই বলে সবর ও অবিচলতার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর মদদ লাভ করার জন্য উভয়ের প্রতি যত্ন নেওয়া জরুরী।
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُونَ لَهُ أَسْرَىٰ حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ ۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
📘 দেশে সম্পূর্ণভাবে শত্রু নিপাত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ। [১] আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[১] বদর যুদ্ধে ৭০ জন কাফের মারা পড়ল এবং ৭০ জন বন্দী হল। এটা কাফের ও মুসলিমদের প্রথম যুদ্ধ ছিল। এই জন্য যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে কি ধরনের আচরণ করা যেতে পারে এ ব্যাপারে পূর্ণরূপে কোন বিধান স্পষ্ট ছিল না। সুতরাং নবী (সাঃ) সেই ৭০ জন বন্দীদের ব্যাপারে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে, কি করা যাবে? তাদেরকে হত্যা করা হবে, না কিছু মুক্তিপণ (বিনিময়) নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে? বৈধতা হিসাবে এই দু'টি রায়ই সঠিক ছিল। সেই জন্য উক্ত দু'টি রায় নিয়ে বিবেক-বিবেচনা ও চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলেন। কিন্তু কখনো কখনো বৈধতা ও অবৈধতা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কাল-পাত্র ও পরিস্থিতি বুঝে অধিকতর উত্তম পন্থা অবলম্বন করার প্রয়োজন হয়। এখানেও অধিকতর কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বৈধতাকে সামনে রেখে অপেক্ষাকৃত কমতর কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করা হল। যে ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলার তরফ হতে ভৎর্সনাস্বরূপ আয়াত অবতীর্ণ হল। উমার (রাঃ) প্রভৃতিগণ নবী (সাঃ)-কে এই পরামর্শ দিলেন যে, কুফরের শক্তি ও প্রতাপকে ভেঙ্গে ফেলা দরকার আছে। এই জন্য বন্দীদেরকে হত্যা করা হোক। কেননা, এরা হল কুফর ও কাফেরদের প্রধান ও সম্মানিত ব্যক্তি। এরা মুক্তি পেলে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অধিকরূপে চক্রান্ত চালাবে। পক্ষান্তরে আবু বাকর (রাঃ) প্রভৃতিগণ উমার (রাঃ)-এর রায়ের বিপরীত রায় পেশ করলেন যে, তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ (বিনিময়) নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হোক। আর ঐ মাল দ্বারা আগামী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হোক। নবী (সাঃ) এই রায়কে প্রাধান্য দিলেন। তখন এ ব্যাপারে আয়াত অবতীর্ণ হল, {حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْض}। এর মতলব হল যদি দেশে কুফরের আধিপত্য হয় (যেমন, সেই সময় আরবে কুফরের আধিপত্য ছিল), তাহলে এ অবস্থায় বন্দী কাফেরদেরকে হত্যা করে তাদের শক্তির মাথাকে চূর্ণ করে ফেলা আবশ্যক। সুতরাং তোমরা এই সূক্ষ্ম নীতিকে দৃষ্টিচ্যুত করে যে মুক্তিপণ (বিনিময়) গ্রহণ করলে, তার মানে হল অধিকতর উত্তম পন্থা বর্জন করে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পন্থা অবলম্বন করলে; যা তোমাদের ভুল এখতিয়ার। পরবর্তীতে যখন কুফরের প্রভাব কম হয়ে গেল, তখন বন্দীদের ব্যাপার সেই সমসাময়িক রাষ্ট্রনেতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হল। তিনি চাইলে তাদেরকে হত্যা করবেন, নতুবা মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেবেন। কিম্বা মুসলিম বন্দীদের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করবেন। অথবা চাইলে তাদেরকে দাস বানিয়ে রাখবেন। অবস্থা ও পরিস্থিতি সমীক্ষা করে উক্ত কোন একটি পন্থা অবলম্বন করা বৈধ হবে।
لَوْلَا كِتَابٌ مِنَ اللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
📘 আল্লাহর পূর্ব বিধান (লিপিবদ্ধ) না থাকলে[১] তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তার জন্য তোমাদের উপর মহাশাস্তি আপতিত হত।
[১] এ ব্যাপারে তাফসীরবিদদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে যে, এই লিপিবদ্ধ বিধান কি ছিল? কেউ বলেন, তাতে গনীমতের মাল হালাল হওয়ার কথা লেখা ছিল। অর্থাৎ, যেহেতু লিপিবদ্ধ তকদীর এই ছিল যে, মুসলিমদের জন্য গনীমতের মাল হালাল হবে। এই জন্য তোমরা মুক্তিপণ নিয়ে এক বৈধ কাজ করেছ। যদি এমন না হত তাহলে মুক্তিপণ নেওয়ার কারণে তোমাদের উপর বড় ধরনের আযাব আসত। কেউ কেউ বলেছেন, তাতে বদর যুদ্ধে মুজাহিদদের জন্য ক্ষমা ঘোষণার কথা লিপিবদ্ধ ছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, রসূল (সাঃ)-এর বর্তমানে আযাব না আসার কথা লিপিবদ্ধ ছিল ইত্যাদি।
(এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য ফাতহুল ক্বাদীর দ্রষ্টব্য)
فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 যুদ্ধে তোমরা যা কিছু (গনীমত) লাভ করেছ, তা বৈধ ও পবিত্ররূপে ভোগ কর। [১] আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[১] এখানে গনীমতের মাল হালাল ও পবিত্র হওয়ার কথা উল্লেখ করে মুক্তিপণ গ্রহণ করার বৈধতা ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে এ কথার সমর্থন হয় যে, 'লিপিবদ্ধ' বিধানে সম্ভবতঃ গনীমতের মাল হালাল হওয়ার কথাই ছিল।
وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللَّهُ إِحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّونَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُونُ لَكُمْ وَيُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُحِقَّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِينَ
📘 আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তাধীন হবে,[১] অথচ তোমরা চাচ্ছ যে, নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তাধীন হোক।[২] আর আল্লাহ চাচ্ছিলেন যে, তিনি তাঁর বাণীদ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করবেন।
[১] অর্থাৎ, হয়তো বা বাণিজ্য কাফেলার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ ঘটবে আর বিনা যুদ্ধে তোমরা প্রচুর ধন-সম্পদ পেয়ে যাবে। অন্যথা কুরাইশ সেনাদের সাথে তোমাদের সংঘর্ষ হবে এবং তোমাদেরই জয় হবে ও গনীমতের মাল লাভ করবে।
[২] অর্থাৎ, বাণিজ্য কাফেলা, যাতে বিনা যুদ্ধে মাল পাওয়া যেতে পারে।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِمَنْ فِي أَيْدِيكُمْ مِنَ الْأَسْرَىٰ إِنْ يَعْلَمِ اللَّهُ فِي قُلُوبِكُمْ خَيْرًا يُؤْتِكُمْ خَيْرًا مِمَّا أُخِذَ مِنْكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 হে নবী! তোমাদের করায়ত্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভাল কিছু[১] দেখেন, তাহলে তোমাদের নিকট হতে (মুক্তিপণ হিসাবে) যা নেওয়া হয়েছে, তা অপেক্ষা উত্তম কিছু তিনি তোমাদেরকে দান করবেন[২] এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
[১] অর্থাৎ, ঈমান ও ইসলাম আনয়নের সংকল্প এবং তা গ্রহণ করার আগ্রহ।
[২] অর্থাৎ, যে মুক্তিপণ তোমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এ থেকে উত্তম জিনিস তোমাদের ইসলাম আনয়ন করার পর আল্লাহ তোমাদেরকে দান করবেন। সুতরাং পরবর্তীতে এমনটিই ঘটেছিল। আব্বাস (রাঃ) এবং আরো অন্যান্য জন যাঁরা সেই বন্দীদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাঁরা মুসলমান হয়ে গেলেন। মহান আল্লাহ তাঁদেরকে পার্থিব জীবনে মাল-ধনের প্রাচুর্য দান করলেন।
وَإِنْ يُرِيدُوا خِيَانَتَكَ فَقَدْ خَانُوا اللَّهَ مِنْ قَبْلُ فَأَمْكَنَ مِنْهُمْ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
📘 আর তারা তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইলে (করতে পারে) তারা তো পূর্বে আল্লাহর সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, পরিশেষে তিনি তাদেরকে (তোমার হাতে) গ্রেফতার করিয়েছেন। [১] আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
[১] 'বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইলে' অর্থাৎ, মুখে ইসলাম প্রকাশ করলে এবং উদ্দেশ্য ধোঁকা দেওয়া হলে। তাহলে এর পূর্বে তারা কুফর ও শির্কে পতিত হয়ে কি লাভ করল? এটাই যে, মুসলিমদের হাতে তারা বন্দী হল। এই জন্য ভবিষ্যতেও যদি তারা শিরকের উপর অটল থাকে, তাহলে এ থেকেও অধিক অপমান ও লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের জন্য অন্য কিছু জুটবে না।
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوْا وَنَصَرُوا أُولَٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَايَتِهِمْ مِنْ شَيْءٍ حَتَّىٰ يُهَاجِرُوا ۚ وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
📘 নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, (দ্বীনের জন্য স্বদেশত্যাগ) হিজরত করেছে, জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে[১] এবং যারা (মুমিনদেরকে) আশ্রয় দান করেছে ও সাহায্য করেছে[২] তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু।[৩] আর যারা ঈমান এনেছে; কিন্তু হিজরত করেনি, তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই।[৪] দ্বীন সম্বন্ধে যদি তারা তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য আবশ্যক;[৫] কিন্তু যে সম্প্রদায় ও তোমাদের মধ্যে চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়। [৬] তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
[১] এই সাহাবাদেরকে 'মুহাজিরীন' বলা হয়; যাঁরা ফযীলতের দিক দিয়ে সাহাবাদের মধ্যে প্রথম নম্বরে আছেন।
[২] এঁদেরকে 'আনসার' (সাহায্যকারী) বলা হয়; এঁরা সাবাহাবাদের মধ্যে দ্বিতীয় নম্বরে আছেন।
[৩] অর্থাঁৎ, একে অপরের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী। কেউ কেউ বলেন, একে অপরের ওয়ারেস বা উত্তরাধিকারী। যেমন হিজরতের পর রসূল (সাঃ) একজন মুহাজির ও একজন আনসারীর মাঝে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাঁরা একে অপরে উত্তরাধিকারীও হতেন। (অবশ্য পরবর্তীতে উত্তরাধিকারের বিধান রহিত হয়ে যায়)।
[৪] এই সাহাবাগণ তৃতীয় পর্যায়ের ছিলেন; যাঁরা মুহাজিরীন ও আনসার ছিলেন না। এঁরা মুসলমান হওয়ার পর নিজেদের এলাকা ও গোত্রের বাসিন্দা ছিলেন। এই জন্য বলা হল যে, তাদের অভিভাবকত্বের কোন দায়িত্ব তোমাদের উপর নেই; অর্থাৎ, এরা তোমাদের পৃষ্ঠপোষক কিম্বা উত্তরাধিকারী হওয়ার উপযুক্ত নয়।
[৫] অর্থাৎ, মুশরিকদের বিরুদ্ধে যদি তাদের জন্য তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা জরুরী।
[৬] হ্যাঁ! যদি তারা এমন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্যকামী হয়, যাদের ও তোমাদের মাঝে সন্ধি ও যুদ্ধ-বিরতির চুক্তি থাকে, তাহলে সেই মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতার তুলনায় চুক্তি পালন করা অধিক জরুরী।
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ إِلَّا تَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادٌ كَبِيرٌ
📘 যারা অবিশ্বাস করেছে, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। যদি তোমরা তা না কর, তাহলে দেশে ফিতনা ও মহাবিপর্যয় দেখা দেবে। [১]
[১] অর্থাৎ, যেমন কাফেররা এক অপরের বন্ধু এবং পৃষ্ঠপোষক, ঠিক তেমনি যদি তোমরাও ঈমানের ভিত্তিতে একে অপরের পৃষ্ঠপোষক এবং কাফেরদল থেকে নিঃসম্পর্ক না হও, তাহলে বড় ধরনের ফিতনা ও অশান্তি সৃষ্টি হবে। আর তা হল এই যে, মু'মিন ও কাফেরদের মাঝে মিশ্র সহাবস্থান, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের ফলে দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ ও তোষামোদ সৃষ্টি হবে। কেউ কেউ بَعْضُهُمْ أَوْلِيآءُ بَعْض এর অর্থ উত্তরাধিকারী বলেছেন। অর্থাৎ, কাফেররা একে অপরের উত্তরাধিকারী। উদ্দেশ্য এই যে, একজন মুসলিম কোন কাফেরের এবং একজন কাফের কোন মুসলিমের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। যেমন হাদীসমূহে এ কথার স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। মোট কথা, যদি তোমরা উত্তরাধিকারের ব্যাপারে কুফর ও ঈমানকে দৃষ্টিচ্যুত করে কেবল আত্মীয়তাকে বুনিয়াদ বানাও, তাহলে তাতে বড় ফিতনা, ফাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি হবে।
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آوَوْا وَنَصَرُوا أُولَٰئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا ۚ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
📘 যারা ঈমান এনেছে, (দ্বীনের জন্য স্বদেশত্যাগ) হিজরত করেছে, আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে এবং যারা (মু’মিনদেরকে) আশ্রয় দান করেছে ও সাহায্য করেছে তারাই প্রকৃত মু’মিন (বিশ্বাসী)। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। [১]
[১] এটা মুহাজিরীন ও আনসারদের সেই দুই দলের বর্ণনা যা পূর্বে উল্লেখ হয়েছে। এখানে তার পুনর্বার উল্লেখ তাঁদের ফযীলত ও মর্যাদার বর্ণনার জন্য করা হয়েছে। আর পূর্বের উল্লেখ তাঁদের আপোসে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার আবশ্যকতা বর্ণনা করার জন্য ছিল।
وَالَّذِينَ آمَنُوا مِنْ بَعْدُ وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا مَعَكُمْ فَأُولَٰئِكَ مِنْكُمْ ۚ وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَىٰ بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ اللَّهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
📘 যারা পরে ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে ও তোমাদের সঙ্গে থেকে জিহাদ করেছে, তারাও তোমাদের অন্তর্ভুক্ত।[১] আর আল্লাহর বিধানে নিকটাত্মীয়গণ একে অন্যের (অন্য অপেক্ষা) অধিক হকদার।[২] নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।
[১] এটা এক চতুর্থ দলের বিবরণ; যাঁরা ফযীলতে প্রথম দুই দলের পরবর্তী এবং তৃতীয় দলের (যাঁরা হিজরত করেননি তাঁদের) পূর্ববর্তী স্তরের সাহাবা ছিলেন।
[২] সাহাবীগণ ভ্রাতৃত্ব ও মিত্রতার ভিত্তিতে উত্তরাধিকারীরূপে পরস্পর যে অংশীদার হতেন এই আয়াতে তা রহিত করা হল। এখন ওয়ারেস (উত্তরাধিকারী) কেবল সেই হবে, যে বংশ অথবা বৈবাহিকসূত্রে নিকটাত্মীয় হবে। আল্লাহর কিতাব কিম্বা আল্লাহর বিধান থেকে উদ্দেশ্য হল, 'লাওহে মাহ্ফূযে' মূল নির্দেশ এটাই ছিল। কিন্তু ভ্রাতৃত্বের খাতিরে কেবলমাত্র সাময়িকভাবে এককে অপরের ওয়ারেস বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যা এখন প্রয়োজন না থাকার কারণে রহিত করা হল এবং মূল নির্দেশ বহাল করে দেওয়া হল।
لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ
📘 যাতে তিনি সত্যকে সত্যরূপে ও অসত্যকে অসত্যরূপে প্রতিপন্ন করেন, যদিও অপরাধিগণ তা অপছন্দ করে।[১]
[১] কিন্তু আল্লাহ এর বিপরীত চাচ্ছিলেন যে, তোমাদের মুকাবিলা কুরাইশ সেনাদের সাথে হোক, যাতে কুফরের শক্তি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাক; যদিও এটি মুশরিকদের নিকট ছিল অপছন্দনীয়।
إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ
📘 স্মরণ কর, যখন তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সকাতর প্রার্থনা করেছিলে, আর তিনি তা কবুল করে (বলে) ছিলেন, আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফিরিশতা দ্বারা সাহায্য করব, যারা একের পর এক আসবে। [১]
[১] এই যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। পক্ষান্তরে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এর তিনগুণ (এক হাজারের মত)। মুসলিমরা ছিল খালি হাতে অন্য দিকে কাফেরদের নিকট ছিল পর্যাপ্ত যুদ্ধাস্ত্র। এই অবস্থায় মুসলিমদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন মহান আল্লাহ। তারা কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। নবী (সাঃ) নিজে অন্য এক তাঁবুতে অত্যন্ত কাকুতি-মিনতি সহকারে আল্লাহর নিকট দু'আ করছিলেন। (বুখারীঃ যুদ্ধ অধ্যায়) সুতরাং মহান আল্লাহ দু'আ কবূল করলেন এবং এক হাজার ফিরিশতা একের পর এক মুসলিমদের সাহায্যে পৃথিবীতে নেমে এলেন। (এটি হল প্রথম পুরস্কার।)