slot qris slot gacor terbaru slot gacor terbaik slot dana link slot gacor slot deposit qris slot pulsa slot gacor situs slot gacor slot deposit qris
| uswah-academy
WhatsApp Book A Free Trial
القائمة

🕋 تفسير سورة الكهف

(Al-Kahf) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا ۜ

📘 সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং এতে তিনি কোন প্রকার বক্রতা রাখেননি।[১] [১] 'বক্রতা' অর্থাৎ, অসঙ্গতি, পরস্পরবিরোধিতা, মতবিরোধিতা বা জটিলতা রাখেননি। অথবা এতে (যে পথ নির্দেশিত হয়েছে তার মধ্যে) কোন বক্রতা রাখেননি এবং মধ্যম পন্থা হতে বিচ্যুতি ঘটার কোন কিছু এতে নেই। বরং এটাকে সুপ্রতিষ্ঠিত, সরল ও সোজা রাখা হয়েছে। অথবা قَيِّم অর্থ, এমন কিতাব, যাতে বান্দাদের সেই সব ব্যাপারের প্রতি খেয়াল রাখা ও যত্ন নেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার মঙ্গল নিহিত আছে।

إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا رَبَّنَا آتِنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا

📘 যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল, তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজের তরফ থেকে আমাদেরকে করুণা দান কর এবং আমাদের কাজ-কর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর।’[১] [১] এরা হল সেই যুবকদল, যাদেরকে 'আসহাবে কাহ্ফ'(গুহার অধিবাসী) বলা হয়েছে। (বিস্তারিত আলোচনা ১৪৮নং টীকায় আসছে।) তারা যখন নিজেদের দ্বীনের রক্ষার্থে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখন এই প্রার্থনা করেছিল। আসহাবে কাহ্ফদের এই ঘটনায় যুবকদের জন্য রয়েছে গুরুতত্ত্বপূর্ণ শিক্ষা। বর্তমানে যুবকদের বেশীর ভাগ সময় নষ্ট হয় অনর্থক কার্যকলাপে তথা আল্লাহর প্রতি তাদের তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ থাকে না। আজকের মুসলিম যুবকেরা যদি তাদের যৌবনকালকে আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করত, তাহলে কতই না ভাল হত!

وَعَرَضْنَا جَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لِلْكَافِرِينَ عَرْضًا

📘 সেদিন আমি জাহান্নামকে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত করব সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের নিকট।

الَّذِينَ كَانَتْ أَعْيُنُهُمْ فِي غِطَاءٍ عَنْ ذِكْرِي وَكَانُوا لَا يَسْتَطِيعُونَ سَمْعًا

📘 যাদের চক্ষু ছিল আমার স্মরণ (কুরআন)এর ব্যাপারে অন্ধ এবং যারা শুনতেও ছিল অপারগ।

أَفَحَسِبَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنْ يَتَّخِذُوا عِبَادِي مِنْ دُونِي أَوْلِيَاءَ ۚ إِنَّا أَعْتَدْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ نُزُلًا

📘 যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার পরিবর্তে আমার দাসদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে? আমি সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত রেখেছি জাহান্নাম। [১] [১] حَسب অর্থ ধারণা করা, عِبادي আমার দাস বা বান্দা বলতে ফিরিশতা, ঈসা (আঃ) ও অন্যান্য আওলিয়াগণ যাঁদেরকে সাহায্যকারী, দাতা বা বিপত্তারণ মনে করা হয়। অনুরূপভাবে শয়তান ও জীন যাদের ইবাদত করা হয় তারাও। এখানে প্রশ্নবোধক বাক্য ধমক ও তিরস্কারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত যারা অন্যের ইবাদত (উপাসনা বা পূজা) করে তারা কি মনে করে যে, আমাকে ছেড়ে আমাদের বান্দাদের ইবাদত করলে তারা তাদেরকে আমার আযাব হতে বাঁচিয়ে নেবে? এটা একদম অসম্ভব। আমি তো কাফেরদের জন্য জাহান্নাম তৈরী করে রেখেছি। নিজেদের ত্রাণকর্তা মনে করে যাদের ইবাদত করা হচ্ছে, তারা তাদেরকে জাহান্নামে যাওয়া হতে রক্ষা করতে পারবে না।

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا

📘 তুমি বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব তাদের যারা কর্মে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত?’

الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا

📘 ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে।[১] [১] অর্থাৎ, তাদের আমলগুলো এমন, যা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়, কিন্তু তাদের ধারণা যে তারা (আল্লাহর পছন্দনীয়) নেক আমলই করছে। এই আয়াতে কাদের কথা বলা হয়েছে? কেউ কেউ বলেন ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের, কেউ বলেন খাওয়ারিজ (রাজদ্রোহী) সম্প্রদায় ও অন্যান্য বিদআতীদের, কেউ বলেন মুশরিকদের। কিন্তু সঠিক কথা হল, এই আয়াতে ব্যাপকভাবে ঐ সমস্ত ব্যক্তি বা দলকে বুঝানো হয়েছে, যাদের মধ্যে উক্ত গুণাবলী বিদ্যমান। পরের আয়াতে এই ধরনের লোকেদের জন্য আরো কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا

📘 ওরাই তারা যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী ও তাঁর সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করে;[১] ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কিয়ামতের দিন আমি তাদের জন্য কোন ওজন রাখব না। [২] [১] آيات ربِّهم 'প্রতিপালকের আয়াত বা নিদর্শনাবলী' বলতে আল্লাহর একতত্ত্ববাদের ঐ সমস্ত দলীল-প্রমাণ যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। অনুরূপভাবে ঐ সমস্ত আয়াতকেও বুঝানো হয়েছে যা তিনি নিজ গ্রন্থসমূহে অবতীর্ণ করেছেন এবং তাঁর নবী ও রসূলগণ তা মানুষের নিকট পৌছে দিয়েছেন। প্রতিপালকের সাক্ষাৎকে অস্বীকার করা বলতে পরকালের জীবন বা পুনরুত্থানকে বুঝানো হয়েছে। [২] অর্থাৎ, আমার নিকট তাদের কোন মূল্যায়ন হবে না। অথবা অর্থ এই যে, ওদের জন্য আমি ওজনের ব্যবস্থাই করব না যাতে তাদের আমলসমূহ ওজন করা যায়। কারণ আমল তো শুধুমাত্র ঐ সমস্ত তাওহীদবাদী মুসলিমদের ওজন করা হবে, যাদের আমল-নামায় পাপ-পুণ্য উভয়ই থাকবে। কিন্তু ওদের আমল-নামা পুণ্য (নেকী) হতে বিলকুল শূন্য থাকবে। যেমন হাদীসের মধ্যে এসেছে যে, কিয়ামতের দিন মোটা-তাজা মানুষ আসবে, কিন্তু আল্লাহর নিকট তার ওজন মাছির ডানা সমতুল্য হবে না। অতঃপর নবী (সাঃ) উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন। (বুখারী, সূরা কাহফের তাফসীর)

ذَٰلِكَ جَزَاؤُهُمْ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَرُسُلِي هُزُوًا

📘 জাহান্নাম, ওটাই তাদের প্রতিফল, যেহেতু তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলী ও রসূলদেরকে গ্রহণ করেছে বিদ্রূপের বিষয়রূপে।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا

📘 নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে ফিরদাউস বেহেশ্ত।[১] [১] ফিরদাউস জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন স্থানকে বলা হয়। নবী (সাঃ) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ জান্নাত প্রার্থনা করবে তখন জান্নাতুল ফিরদাউস প্রার্থনা কর। কারণ ওটা হচ্ছে জান্নাতের সর্বোচ্চ অংশ, যেখান হতে জান্নাতের নহর (নদী)সমূহ প্রবাহিত হয়। (বুখারী, তাওহীদ অধ্যায়)

خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا

📘 সেথায় তারা স্থায়ী হবে; এর পরিবর্তে তারা অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়া কামনা করবে না।[১] [১] অর্থাৎ জানণাতবাসীদের জান্নাত ও জান্নাতের নিয়ামতসমূহ পেয়ে কখনো তাদের মন একঘেয়েমি অনুভব করবে না, যাতে তারা জান্নাত ছেড়ে অন্যত্র যেতে চাইবে।

قُلْ لَوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَادًا لِكَلِمَاتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْفَدَ كَلِمَاتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدًا

📘 তুমি বল, ‘আমার প্রতিপালকের বাণী[১] লিপিবদ্ধ করবার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তাহলে আমার প্রতিপালকের বাণী শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে; সাহায্যার্থে যদিও এর মত আরো একটি সমুদ্র আনয়ন করি।’ [১] كلمات এর অর্থঃ মহান আল্লাহর পরিব্যাপ্ত জ্ঞান, তাঁর হিকমত এবং ঐ সমস্ত দলীল-প্রমাণ যা তাঁর একতত্ত্ববাদকে প্রমাণ করে, যা মানুষের পক্ষে পূর্ণমাত্রায় জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর সমস্ত গাছপালাকে যদি কলম বানানো যায় এবং সমস্ত সমুদ্র; বরং তার সমপরিমাণ আরো সমুদ্রের পানিকে যদি কালি তৈরী করা যায়, তাহলে কলমসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে এবং সমস্ত কালি নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর বাণী ও হিকমত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে কখনই শেষ হবে না।

فَضَرَبْنَا عَلَىٰ آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا

📘 অতঃপর আমি গুহায় কয়েক বছর তাদের কানে পর্দা দিয়ে রাখলাম।[১] [১] অর্থাৎ, কানে পর্দা সৃষ্টি করে তা বন্ধ করে দিলাম। যাতে বাইরের শব্দের কারণে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে। অর্থাৎ, আমি তাদেরকে গভীরভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম।

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

📘 তুমি বল, ‘আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ; [১] আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য;[২] সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের উপাসনায়[৩] কাউকেও শরীক না করে।’ [১] এই কারণে আমিও প্রতিপালকের বাণী ও কথা পরিপূর্ণরূপে জ্ঞাত হতে সক্ষম নই। [২] তবে অবশ্যই আমাকে এ বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে যে, আমার নিকট আল্লাহর অহী আসে। সেই অহী দ্বারাই আমি 'আসহাবে কাহফ' (গুহাবাসী) ও যুলক্বারনাইন সম্পর্কে আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত কথা তোমাদের সামনে তুলে ধরেছি। যা ইতিহাসের অতল তলে তলিয়ে ছিল বা যার প্রকৃতত্ব রূপকথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ঐ অহীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতত্ত্বপূর্ণ যে নির্দেশ আমাকে দেওয়া হয়েছে, তা হল তোমাদের মাবূদ (উপাস্য) শুধুমাত্র একজন। [৩] নেক আমল হল তাই, যা সুন্নাহর মোতাবেক হয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে দৃঢ়-বিশ্বাসী প্রথমতঃ তাদের উচিত প্রতিটি কাজ সুন্নাহ (সহীহ হাদীস) মোতাবেক করা, দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর ইবাদতে কাউকেও শরীক না করা। যেহেতু বিদআত ও শিরক; এই দু'টি হল, আমল পন্ড হওয়ার মূল কারণ। আল্লাহ প্রতিটি মুসলিমকে শিরক ও বিদআত হতে দূরে রাখুন।

ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَىٰ لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا

📘 পরে আমি তাদেরকে জাগরিত করলাম এই জানবার জন্য যে, দুই দলের মধ্যে কোনটি তাদের অবস্থানকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।[১] [১] এই দু'টি দল বলতে তারা, যারা মতবিরোধ করেছিল। এরা হয়তো সেই যুগেরই মানুষ ছিল, যাদের মধ্যে এদের ব্যাপারে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। অথবা নবী (সাঃ)-এর যুগের মু'মিন ও কাফেররা। আবার কেউ বলেছেন, এরা ছিল গুহারই অধিবাসী। তাদের মধ্যে দু'টি দল হয়ে গিয়েছিল। একদল বলল, আমরা এত দিন এখানে ঘুমিয়ে ছিলাম। অন্য দল এ কথা অস্বীকার করে প্রথম দলের চেয়ে কিছু কম-বেশী সময়-কাল বলল।

نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُمْ بِالْحَقِّ ۚ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى

📘 আমি তোমার কাছে তাদের সঠিক বৃত্তান্ত বর্ণনা করছিঃ তারা ছিল কয়েকজন যুবক,[১] তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম । [১] সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এখন বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। এই যুবকদের ব্যাপারে কেউ কেউ বলে, তারা খ্রীষ্টধর্মের অনুসারী ছিল। কেউ বলে, তাদের যুগ হল ঈসা (আঃ)-এর পূর্বের যুগ। হাফেয ইবনে কাসীর এ কথাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, দাকয়ানুস নামে একজন রাজা ছিল। সে লোকদেরকে মূর্তিপূজা করতে এবং তাদের নামে নজরানা পেশ করতে উদ্বুদ্ধ করত। মহান আল্লাহ এই যুবকদের অন্তরে এ কথা প্রক্ষিপ্ত করলেন যে, ইবাদতের যোগ্য তো একমাত্র সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা এবং বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। فِتْيَةٌ হল 'জাময়ে কিল্লাত' (স্বল্প সংখ্যাবোধক বহুবচন)। এ (فِتْيَةٌ) থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা সংখ্যায় ৯জন ছিল অথবা তার থেকেও কম ছিল। এরা (লোকালয়) থেকে পৃথক হয়ে কোন এক স্থানে এক আল্লাহর ইবাদত করত। ধীরে ধীরে মানুষের মাঝে তাদের আকীদা তাওহীদের চর্চা হতে লাগল। পরিশেষে রাজার নিকট পর্যন্ত তাদের কথা পৌঁছে গেলে সে তাদেরকে নিজ দরবারে ডেকে এনে ঘটনা জিজ্ঞাসা করল। সেখানে তারা পরিষ্কারভাবে আল্লাহর তাওহীদের কথা বর্ণনা করল। শেষ পর্যায়ে রাজা এবং মুশরিক জাতির ভয়ে নিজেদের দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য লোকালয় থেকে বেরিয়ে এক পাহাড়ের গুহায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করল। সেখানে মহান আল্লাহ তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন এবং ৩০৯ বছর পর্যন্ত তারা ঘুমিয়ে থাকল।

وَرَبَطْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَٰهًا ۖ لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا

📘 আর আমি তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করেছিলাম;[১] তারা যখন উঠে দাঁড়াল[২] তখন বলল, ‘আমাদের প্রতিপালক আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক; আমরা কখনই তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন উপাস্যকে আহবান করব না; যদি করে বসি তাহলে তা অতিশয় গর্হিত হবে। [৩] [১] অর্থাৎ, হিজরত করার কারণে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ধাক্কা যেহেতু তাদের উপর আসছে, তাই আল্লাহ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করে দিলেন। যাতে তারা তাদের জীবনের বিপদ-আপদকে খুশী মনে বরণ করে নিতে পারে। অনুরূপ হক বলার দায়িত্বকেও যেন সাহস ও উৎসাহের সাথে পালন করতে পারে। [২] এই দাঁড়ানো অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট রাজার দরবারে ছিল, তারা রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তাওহীদের ওয়ায করেছিল। কেউ কেউ বলেন, শহর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আপোসে একে অপরকে তাওহীদের সেই কথা শুনাতে লাগলেন, যা এক এক করে প্রত্যেকের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল এবং এইভাবে তারা আপোসে একত্রিত হয়ে গেল। [৩] شَطَطًا অর্থ, মিথ্যা অথবা সীমালঙ্ঘন করা।

هَٰؤُلَاءِ قَوْمُنَا اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةً ۖ لَوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِمْ بِسُلْطَانٍ بَيِّنٍ ۖ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا

📘 আমাদেরই এই স্বজাতিরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এসব উপাস্য সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তার চেয়ে অধিক সীমালংঘনকারী আর কে?

وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللَّهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ يَنْشُرْ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيُهَيِّئْ لَكُمْ مِنْ أَمْرِكُمْ مِرْفَقًا

📘 তোমরা যখন তাদের ও তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের সংস্পর্শ হতে বিচ্ছিন্ন হলে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর;[১] তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন।’ [১] অর্থাৎ, তোমরা যখন তোমাদের জাতির বাতিল উপাস্যসমূহ থেকে (মানসিকভাবে) পৃথক হয়েছ, তখন এবার দৈহিকভাবেও তাদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে যাও। এ কথা গুহার অধিবাসীরা আপোসে বলল। তাই তারা এরপর এক গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করল। এদিকে যখন তাদের নিখোঁজ হওয়ার কথা প্রচার হয়ে গেল, তখন তাদের খোঁজ করা হল। কিন্তু তারা ঐরূপ ব্যর্থ হল, যেরূপ নবী (সাঃ)-এর খোঁজে মক্কার কাফেররা সেই 'সওর গুহা' পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয়েছিল, যেখানে তিনি (সাঃ) আবূ বাকর সহ লুকিয়ে ছিলেন।

۞ وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَتْ تَزَاوَرُ عَنْ كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَتْ تَقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ وَهُمْ فِي فَجْوَةٍ مِنْهُ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ ۗ مَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ ۖ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُرْشِدًا

📘 তোমরা যখন তাদের ও তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের সংস্পর্শ হতে বিচ্ছিন্ন হলে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর;[১] তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন।’ [১] অর্থাৎ, তোমরা যখন তোমাদের জাতির বাতিল উপাস্যসমূহ থেকে (মানসিকভাবে) পৃথক হয়েছ, তখন এবার দৈহিকভাবেও তাদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে যাও। এ কথা গুহার অধিবাসীরা আপোসে বলল। তাই তারা এরপর এক গুহায় গিয়ে আত্মগোপন করল। এদিকে যখন তাদের নিখোঁজ হওয়ার কথা প্রচার হয়ে গেল, তখন তাদের খোঁজ করা হল। কিন্তু তারা ঐরূপ ব্যর্থ হল, যেরূপ নবী (সাঃ)-এর খোঁজে মক্কার কাফেররা সেই 'সওর গুহা' পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয়েছিল, যেখানে তিনি (সাঃ) আবূ বাকর সহ লুকিয়ে ছিলেন।

وَتَحْسَبُهُمْ أَيْقَاظًا وَهُمْ رُقُودٌ ۚ وَنُقَلِّبُهُمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَذَاتَ الشِّمَالِ ۖ وَكَلْبُهُمْ بَاسِطٌ ذِرَاعَيْهِ بِالْوَصِيدِ ۚ لَوِ اطَّلَعْتَ عَلَيْهِمْ لَوَلَّيْتَ مِنْهُمْ فِرَارًا وَلَمُلِئْتَ مِنْهُمْ رُعْبًا

📘 তুমি মনে করতে, তারা জাগ্রত; কিন্তু আসলে তারা নিদ্রিত।[১] আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডানে ও বামে[২] এবং তাদের কুকুর ছিল সম্মুখের পা দুটি গুহার দ্বারে প্রসারিত করে; তাকিয়ে তাদেরকে দেখলে তুমি পিছনে ফিরে পালিয়ে যেতে ও তাদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে।[৩] [১] أَيْقَاظٌ হল, يَقِظٌ (জাগ্রত) এর বহুবচন। আর رُقُوْدٌ হল, رَاقِدٌ (নিদ্রিত)এর বহুবচন। তারা জাগ্রত এই জন্য মনে হচ্ছিল যে, তাদের চোখগুলো জাগ্রত ব্যক্তির মত খোলা ছিল। কেউ কেউ বলেন, খুব বেশী পার্শ্ব পরিবর্তন করার কারণে তাদেরকে জাগ্রত মনে হত। [২] যাতে তাদের দেহকে মাটিতে খেয়ে না নেয়। (উই ধরে না যায়।) [৩] তাদের হেফাযতের জন্য এ ছিল আল্লাহ কর্তৃক ব্যবস্থাপনা। যাতে কেউ যেন তাদের নিকটে যেতে না পারে।

وَكَذَٰلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءَلُوا بَيْنَهُمْ ۚ قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ ۖ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ ۚ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُمْ بِوَرِقِكُمْ هَٰذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنْظُرْ أَيُّهَا أَزْكَىٰ طَعَامًا فَلْيَأْتِكُمْ بِرِزْقٍ مِنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا

📘 এভাবেই আমি তাদেরকে জাগ্রত করলাম,[১] যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে; তাদের একজন বলল, ‘তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?’ তাদের কেউ কেউ বলল, ‘একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ।’[২] তাদের কেউ কেউ বলল, ‘তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ, তা তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন।[৩] এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য উত্তম[৪] ও তা হতে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন সতর্কতা ও নম্রতার সাথে কাজ করে এবং কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও কিছু জানতে না দেয়। [৫] [১] অর্থাৎ, যেভাবে আমি তাদেরকে আমার নিজ কুদরতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেইভাবে ৩০৯ বছর পর আমি তাদেরকে উঠালাম এবং এমনভাবে উঠালাম যে, তাদের শারীরিক অবস্থা ঐ রকমই সুস্থ ছিল, যেমন ৩০০ বছর পূর্বে শোয়ার সময় ছিল। এই জন্য আপোসে তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করল। [২] হতে পারে যখন তারা গুহায় প্রবেশ করেছিল, তখন দিনের প্রথম প্রহর ছিল এবং যখন জাগ্রত হয়, তখন দিনের শেষ প্রহর ছিল। এইভাবে তারা মনে করল যে, মনে হয় আমরা একদিন অথবা তার থেকেও কম, দিনের কিছু অংশ এখানে ঘুমিয়ে থেকেছি। [৩] দীর্ঘকাল ঘুমিয়ে থাকার কারণে তারা বড়ই দ্বিধা-দন্দ্বে ভুগছিল। পরিশেষে এই বলে বিষয়কে আল্লাহর সোপর্দ করে দিল যে, তিনিই সঠিক জানেন কতকাল আমরা এখানে ছিলাম। [৪] জাগ্রত হওয়ার পর খাদ্য যা মানুষের সর্বাধিক প্রয়োজনের জিনিস, তারই ব্যবস্থাপনার চিন্তা দেখা দিল। [৫] সতর্ক হওয়ার ও নম্রতা প্রদর্শন করার তাকীদ সেই আশঙ্কার ভিত্তিতেই করেছিল, যার কারণে তারা লোকালয় থেকে বেরিয়ে নির্জন গুহায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাকে তাকীদ করল যে, তার আচরণে যেন শহরের লোকেরা আমাদের ব্যাপারে টের না পেয়ে যায় এবং আমাদের উপর নতুন কোন বিপদ এসে না পড়ে। যে কথা পরের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

قَيِّمًا لِيُنْذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِنْ لَدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا

📘 তিনি একে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত; যাতে ওটা তাঁর নিকট হতে (অবতীর্ণ)[১] কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করে এবং সৎকর্মশীল বিশ্বাসীগণ এই সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য আছে উত্তম পুরস্কার (জান্নাত); [১] مِنْ لَّدُنْهُ (তাঁর নিকট হতে) অর্থাৎ, আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।

إِنَّهُمْ إِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ يَرْجُمُوكُمْ أَوْ يُعِيدُوكُمْ فِي مِلَّتِهِمْ وَلَنْ تُفْلِحُوا إِذًا أَبَدًا

📘 তারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে, তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। আর সে ক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।’[১] [১] অর্থাৎ, আখেরাতের যে সফলতার জন্য আমরা এত কঠিনতা ও কষ্ট সহ্য করলাম, পরিষ্কার কথা যে, শহরের লোকেরা যদি পুনরায় আমাদেরকে পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করে, তাহলে আমাদের আসল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের পরিশ্রমও বরবাদে যাবে এবং আমরা না দ্বীন পাব, আর না দুনিয়া।

وَكَذَٰلِكَ أَعْثَرْنَا عَلَيْهِمْ لِيَعْلَمُوا أَنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَأَنَّ السَّاعَةَ لَا رَيْبَ فِيهَا إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ ۖ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا ۖ رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ ۚ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَىٰ أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا

📘 এভাবে আমি লোকেদেরকে তাদের বিষয় জানিয়ে দিলাম,[১] যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই।[২] যখন তারা তাদের কর্তব্য বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছিল[৩] তখন অনেকে বলল, ‘তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর।’[৪] তাদের প্রতিপালক তাদের বিষয়ে ভাল জানেন।[৫] তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বলল, ‘আমরা তো নিশ্চয়ই তাদের উপর মসজিদ নির্মাণ করব।’[৬] [১] অর্থাৎ, যেভাবে আমি তাদেরকে ঘুম পাড়িয়েছি ও জাগিয়েছি, অনুরূপভাবে মানুষদেরকেও তাদের ব্যাপারে অবহিত করিয়েছি। কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী এই অবহিত করণ এইভাবে সুসম্পন্ন হয় যে, যখন গুহা অধিবাসীদের একজন রূপার সেই মুদ্রা নিয়ে শহরে গেল, যা ৩০০ বছর পূর্বের রাজা দাকয়ানুসের আমলে প্রচলিত ছিল এবং সেই মুদ্রা সে একজন দোকানদারকে দিল, তখন সে বিস্মিত হল। সে পাশের দোকানদারকেও দেখাল। তারাও আশ্চর্যানিত হল। এদিকে এ লোক তাদেরকে বলছিল যে, আমি এই শহরেরই অধিবাসী, গত কালই এখান থেকে গেছি। কিন্তু এই 'কাল'এর যে তিন শতাব্দি অতিবাহিত হয়ে গেছে। অতএব মানুষ কিভাবে তার কথা মেনে নিবে? লোকদের এই সন্দেহ হল যে, হতে পারে এ লোক কোন গুপ্ত ধন-ভান্ডার পেয়েছে। পরিশেষে ধীরে ধীরে এ কথা রাজা বা শাসক পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং সে (গুহা অধিবাসীদের) এই সঙ্গীর সাহায্যে গুহা পর্যন্ত যায় এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। পরে মহান আল্লাহ পুনরায় তাদেরকে সেখানেই মৃত্যু দেন। (ইবনে কাসীর) [২] অর্থাৎ, গুহার অধিবাসীদের এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার এবং মৃত্যুর পর আল্লাহর পুনরুত্থানের ওয়াদা সত্য। অস্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে এই ঘটনার মধ্যে আল্লাহর মহাশক্তির এক নিদর্শন। [৩] إِذْ হয় أَعْثَرْنَا (ক্রিয়াপদের) এর 'যারফ' (যার দ্বারা সময়-কাল বুঝানো হয়)। অর্থাৎ, আমি তাদেরকে সেই সময় এদের ব্যাপারে জানালাম, যখন তারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আপোসে বিতর্কে লিপ্ত ছিল। অথবা এখানে أذْكُرْ ক্রিয়া ঊহ্য আছে। অর্থাৎ, সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন তারা আপোসে বিতর্ক করছিল। [৪] এ কথা কে বলেছিল? কেউ বলেন, সেই যুগের ঈমানদাররা। কেউ বলেন, বাদশাহ ও তার সাথের লোকেরা যখন সেখানে গিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করল এবং এরপর আল্লাহ তাদেরকে পুনরায় ঘুম পাড়িয়ে দিলেন, তখন বাদশাহ ও তার সাথীরা বলল যে, এদের হেফাযতের জন্য একটি অট্টালিকা নির্মাণ করে দেওয়া যাক। [৫] বিতর্ককারীদেরকে মহান আল্লাহ বললেন যে, তাদের ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান কেবল আল্লাহই রাখেন। [৬] এই প্রবল দলটি ঈমানদারদের ছিল, না কাফের ও মুশরিকদের? ইমাম শওকানী প্রথম মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং ইমাম ইবনে কাসীর দ্বিতীয় মতকে। কারণ, নেক লোকদের কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা আল্লাহর পছন্দ নয়। রসূল (সাঃ) বলেছেন, ((لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ)) "ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, তারা তাদের আম্বিয়াদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে।" (বুখারীঃ জানাযা অধ্যায়, মুসলিমঃ মাসাজিদ অধ্যায়) উমার (রাঃ)-এর খেলাফত কালে ইরাকে দানিয়াল (আঃ)-এর কবর পাওয়া গেল। তিনি নির্দেশ দিলেন যে, গোপনে সেটাকে সাধারণ কবরে পরিণত করা হোক। যাতে মানুষ যেন জানতে না পারে যে, এটা কোন নবীর কবর। (তাফসীর ইবনে কাসীর)

سَيَقُولُونَ ثَلَاثَةٌ رَابِعُهُمْ كَلْبُهُمْ وَيَقُولُونَ خَمْسَةٌ سَادِسُهُمْ كَلْبُهُمْ رَجْمًا بِالْغَيْبِ ۖ وَيَقُولُونَ سَبْعَةٌ وَثَامِنُهُمْ كَلْبُهُمْ ۚ قُلْ رَبِّي أَعْلَمُ بِعِدَّتِهِمْ مَا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ ۗ فَلَا تُمَارِ فِيهِمْ إِلَّا مِرَاءً ظَاهِرًا وَلَا تَسْتَفْتِ فِيهِمْ مِنْهُمْ أَحَدًا

📘 অচিরেই তারা বলবে,[১] ‘তারা ছিল তিন জন; তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর।’ কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল পাঁচজন; তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর।’ ওরা অজানা বিষয়ে অনুমান (তীর) চালায়।[২] আর কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল সাতজন; তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর।’[৩] বল, ‘তাদের সংখ্যা আমার প্রতিপালকই ভাল জানেন; তাদের সংখ্যা অল্প কয়েকজনই জানে।’ [৪] সুতরাং সাধারণ আলোচনা ব্যতীত তুমি তাদের বিষয়ে বিতর্ক করো না[৫] এবং তাদের কাউকেও তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করো না।[৬] [১] এ কথার বক্তা এবং বিভিন্ন সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন উক্তি পেশকারীরা ছিল নবী (সাঃ)-এর যুগের মু'মিন ও কাফেররা। বিশেষ করে কিতাবধারীরা, যারা যাবতীয় আসমানী কিতাব সম্পর্কে অবগতি ও জ্ঞানের দাবী করত। [২] অর্থাৎ, জ্ঞান এদের মধ্যে কারো কাছে নেই। যেমন, লক্ষ্যবস্তু না দেখেই কেউ তীর ছুঁড়ে, এরাও অনুরূপ অনুমানের তীর চালিয়ে যাচ্ছে। [৩] মহান আল্লাহ কেবল তিনটি উক্তি বর্ণনা করেছেন। প্রথম দু'টি উক্তিকে رَجْمًا بِالْغَيْبِ (অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমান করা) বলে দুর্বল উক্তি গণ্য করেছেন। এর পর তৃতীয় উক্তির উল্লেখ করেছেন। এ থেকে মুফাসসিরগণ প্রমাণ করেছেন যে, এই অনুমান সঠিক। আর বাস্তবিকই তাদের সংখ্যা এটাই ছিল। (ইবনে কাসীর) [৪] কোন কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলতেন, আমিও সেই অল্প লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা গুহার অধিবাসী কতজন ছিল তা জানে। তারা ছিল মাত্র সাতজন। যেমন, তৃতীয় উক্তিতে বলা হয়েছে। (ইবনে কাসীর) [৫] অর্থাৎ, এই কথাগুলোর উপরেই ক্ষান্ত থাক, যা তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথবা সংখ্যা নির্দিষ্টীকরণের ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করো না। কেবল এতটা বলে দাও যে, এই নির্দিষ্টীকরণের কোন দলীল নেই। [৬] অর্থাৎ, বিতর্ককারীদেরকে কিছুই জিজ্ঞাসা করো না। কারণ, যাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তার জ্ঞান জিজ্ঞাসাকারীর চেয়েও অধিক থাকা উচিত। আর এখানে তো ব্যাপার উল্টা। তোমার কাছে তবুও নিশ্চিত জ্ঞানের একটি মাধ্যম -- অহী -- রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যদের কাছে অনুমান ও ধারণা ব্যতীত কিছুই নেই।

وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا

📘 কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলো না যে, ‘আমি ওটা আগামীকাল করব’--

إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ ۚ وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَنْ يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا

📘 ইন শাআল্লাহ (আল্লাহ ইচ্ছা করলে) এই কথা না বলে;[১] যদি ভুলে যাও, তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করো[২] ও বলো, ‘সম্ভবতঃ আমার প্রতিপালক আমাকে এ অপেক্ষা সত্যের নিকটতম পথ নির্দেশ করবেন।’[৩] [১] মুফাসসিরগণ বলেন যে, ইয়াহুদীরা নবী (সাঃ)-কে তিনটি কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আত্মার স্বরূপ কি এবং গুহার অধিবাসী ও যুল-কারনাইন কে ছিল? তাঁরা বলেন যে, এই প্রশ্নগুলোই ছিল এই সূরা অবতীর্ণ হওয়ার কারণ। নবী (সাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আগামী কাল উত্তর দেব। কিন্তু এর পর ১৫ দিন পর্যন্ত জিবরীল (আঃ) অহী নিয়ে এলেন না। অতঃপর যখন এলেন, তখন মহান আল্লাহ 'ইন শা-আল্লাহ' বলার নির্দেশ দিলেন। আয়াতে غَدًا (আগামী কাল) বলতে ভবিষ্যৎ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, অদূর ভবিষ্যতে বা দূর ভবিষ্যতে কোন কাজ করার সংকল্প করলে, 'ইন শা-আল্লাহ' অবশ্যই বলে নিও। কেননা, মানুষ তো জানেই না যে, যা করার সে সংকল্প করে, তা করার তাওফীক সে আল্লাহর ইচ্ছা থেকে পাবে, না পাবে না? [২] অর্থাৎ, বাক্যালাপ অথবা অঙ্গীকার করার সময় যদি 'ইনশা-আল্লাহ' বলতে ভুলে যাও, তবে যখনই স্মরণ হবে তখনই তা বলে নাও। অথবা প্রতিপালককে স্মরণ করার অর্থ, তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর, তাঁর প্রশংসা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। [৩] অর্থাৎ, আমি যা করার সংকল্প করছি, হতে পারে মহান আল্লাহর তার থেকেও উত্তম এবং ফলপ্রসূ কাজের প্রতি আমার দিক নির্দেশনা করবেন।

وَلَبِثُوا فِي كَهْفِهِمْ ثَلَاثَ مِائَةٍ سِنِينَ وَازْدَادُوا تِسْعًا

📘 তারা তাদের গুহায় ছিল তিনশ’ বছর, অতিরিক্ত আরো নয় বছর। [১] [১] অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এটাকে আল্লাহর উক্তি গণ্য করেছেন। সৌর মাস হিসাবে ৩০০ এবং চান্দ্র মাস হিসাবে ৩০৯ বছর হয়। কোন কোন আলেমের ধারণা হল, এটা তাদেরই কথা, যারা তাদের সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন মত পেশ করছিল। আর এর দলীল হল আল্লাহর এই বাণী, "তুমি বল, তারা কত কাল ছিল, তা আল্লাহই ভাল জানেন।" বলা বাহুল্য তাঁরা এরই ভিত্তিতে (আয়াতে) উল্লিখিত মেয়াদের খন্ডন করার অর্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসিরদের তফসীর অনুযায়ী এর অর্থ এই যে, আহলে-কিতাব অথবা অন্য কেউ যদি (আয়াতে) বর্ণিত এই সময়-কালের ব্যাপারে বিরোধিতা করে, তবে তুমি তাদেরকে বলে দাও যে, তোমরা বেশী জান, না আল্লাহ? তিনি যখন ৩০৯ বছরের কথা বলেছেন, তখন এটাই সঠিক। কেননা, তিনিই জানেন তারা কত বছর গুহায় ছিল?

قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا ۖ لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۖ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ ۚ مَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا

📘 তুমি বল, ‘তারা কত কাল ছিল, তা আল্লাহই ভাল জানেন। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই; তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা! [১] তিনি ছাড়া তাদের অন্য কোন অভিভাবক নেই; তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বের শরীক করেন না।’ [১] এটা হল আল্লাহর সবকিছু জানার ও খবর রাখার গুণেরই অধিক আলোকপাত।

وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ ۖ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَنْ تَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا

📘 তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট তোমার প্রতিপালকের কিতাব আবৃত্তি কর; [১] তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউই নেই। আর তুমি কখনই তিনি ব্যতীত অন্য কোন আশ্রয়স্থল পাবে না। [২] [১] যদিও এই নির্দেশ এই দিক দিয়ে সাধারণ যে, যে জিনিসেরই অহী তোমার প্রতি করা হয়, তা তেলাঅত কর এবং লোকদেরকে তা শিক্ষা দাও, তবুও গুহা অধিবাসীদের ঘটনার শেষে এই নির্দেশের অর্থ এও হতে পারে যে, তাদের ব্যাপারে লোকেরা যা ইচ্ছা তাই বলুক, কিন্তু মহান আল্লাহ স্বীয় গ্রন্থে তাদের ব্যাপারে যা এবং যতটা বলেছেন, সেটাই হচ্ছে সঠিক। সুতরাং তাই মানুষদেরকে পড়ে শুনিয়ে দাও এবং এর অধিক বর্ণিত অন্যান্য কথা-বার্তার প্রতি আদৌ ভ্রূক্ষেপ করো না। [২] অর্থাৎ, যদি এর (অহীর) প্রচার না কর এবং এ থেকে বিমুখতা অবলম্বন কর অথবা তার (অহীর) বাক্যাবলীতে কোন হেরফের করার প্রচেষ্টা কর, তবে আল্লাহর হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। সম্বোধন রসূল (সাঃ)-কে করা হলেও এর প্রকৃত লক্ষ্য হল উম্মত।

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ ۖ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا

📘 তুমি নিজেকে তাদেরই সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তাঁর মুখমন্ডল (দর্শন বা সন্তুষ্টি) লাভের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে[১] তাদের দিক হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না।[২] আর তুমি তার আনুগত্য করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে। [৩] [১] এটা হল সেই নির্দেশই, যা সূরা আনআমের ৬:৫২ নং আয়াতে অতিবাহিত হয়েছে। এখানে লক্ষ্য সেই সাহাবায়ে কেরাম, যাঁরা গরীব ও দুর্বল ছিলেন। কুরাইশ বংশের সম্ভ্রান্ত লোকেরা যাঁদের সাথে ওঠা-বসা করতে পছন্দ করত না। সা'দ ইবনে আবী অক্কাস বলেন, আমরা ছয়জন সাহাবী রসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। আমাদের সাথে বিলাল, ইবনে মাসউদ, এবং একজন হুযালী ও দু'জন অন্য সাহাবীও ছিলেন। মক্কার কুরাইশগণ রসূল (সাঃ)-এর কাছে এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করল যে, যদি তুমি ঐ লোকদেরকে তোমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও, তাহলে আমরা তোমার কাছে উপস্থিত হয়ে তোমার কথা শুনব। নবী করীম (সাঃ)-এর অন্তরে এই খেয়াল জাগল যে, হতে পারে আমার কথা শুনে তাদের মনের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে এ রকম করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিলেন। (মুসলিমঃ ফাযায়েলে সাহাবা) [২] অর্থাৎ, এদেরকে দূরে ঠেলে দিয়ে এই সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালীদেরকে নিজের কাছে টেনে নিও না।[৩] فُرُطًا যদি إفراط থেকে হয়, তবে অর্থ হবে, যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে। আর যদি تفريط থেকে হয়, তবে অর্থ হবে, যার কার্যকলাপ অবহেলাপূর্ণ; যার পরিণাম হল বিনাশ ও ধ্বংস।

وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ ۖ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ ۚ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ۚ وَإِنْ يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ۚ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا

📘 বল, ‘সত্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে সমাগত; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করুক।’ আমি সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেওয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়; যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে; কত নিকৃষ্ট সেই পানীয় এবং কত নিকৃষ্ট সেই (অগ্নির) আশ্রয়স্থল।

مَاكِثِينَ فِيهِ أَبَدًا

📘 যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلًا

📘 যারা বিশ্বাস রাখে ও সৎকর্ম করে, আমি তাদেরকে পুরস্কৃত করি। যে ভালো কর্ম করে, আমি তার কর্মফল নষ্ট করি না। [১] [১] কুরআনের বর্ণনা-রীতি অনুযায়ী জাহান্নামীদের পর জান্নাতীদের কথা আলোচনা করা হচ্ছে। যাতে মানুষের মধ্যে জান্নাত লাভের প্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়।

أُولَٰئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِنْ سُنْدُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ ۚ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا

📘 তাদেরই জন্য আছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেথায় তাদেরকে স্বর্ণ-কঙ্কণে অলঙ্কৃত করা হবে,[১] তারা পরিধান করবে সূক্ষ্ণ ও স্থূ্ল রেশমের সবুজ বস্ত্র[২] ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে; কত সুন্দর সে পুরস্কার ও কত উত্তম সে আশ্রয়স্থল। [১] কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার যুগে এবং তারও পূর্বে প্রথা ছিল যে, বাদশাহ, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং গোত্রের সর্দাররা তাদের হাতে সোনার বালা পরিধান করত। যার দ্বারা তারা যে পৃথক মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ, সে কথা ফুটে উঠত। জান্নাতবাসীদেরকেও আল্লাহ জান্নাতে সোনার বালা পরাবেন।[২] سُنْدُسٍ পাতলা বা মিহি রেশম। এবং اِسْتَبْرَقٍ মোটা রেশম। দুনিয়াতে পুরুষের জন্য সোনা এবং রেশমের পোশাক পরিধান করা নিষেধ। যারা এই নির্দেশের উপর আমল করে দুনিয়াতে এই সব হারাম থেকে বিরত থাকবে, তারা জান্নাতে এ সব জিনিস লাভ করবে। সেখানে কোন জিনিসই নিষিদ্ধ হবে না, বরং জান্নাতবাসী যা চাইবে, তা-ই সেখানে বিদ্যমান পাবে। ﴿وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ﴾ "সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য আছে যা তোমরা দাবী কর।" (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১:৩১ আয়াত)

۞ وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلًا رَجُلَيْنِ جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا

📘 তুমি তাদের কাছে পেশ কর দুই ব্যক্তির একটি উপমা;[১] তাদের একজনকে আমি দিয়েছিলাম দু’টি আঙ্গুর বাগান এবং সে দু’টিকে আমি খেজুর বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছিলাম।[২] আর এই দুয়ের মধ্যবর্তী স্থানকে করেছিলাম শস্যক্ষেত্র। [৩] [১] এই দুই ব্যক্তি কারা ছিল এ ব্যাপারে মুফাসসিরদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। মহান আল্লাহ কেবল বুঝানোর জন্য তাদের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, না বাস্তবিকই দু'জন এ রকম ছিল? যদি ছিল, তবে তারা বানী-ইস্রাঈলদের মধ্যে ছিল, না মক্কাবাসীদের মধ্যে? এদের মধ্যে একজন মু'মিন এবং দ্বিতীয়জন কাফের ছিল। [২] যেভাবে চতুর্দিকে দেওয়াল দিয়ে হেফাযত করা হয়, অনুরূপভাবে এই বাগানগুলোর চতুর্দিকে খেজুরের গাছ ছিল। যা আড় ও দেওয়ালের কাজ দিত। [৩] অর্থাৎ, উভয় বাগানের মধ্যস্থলে ক্ষেত ছিল, যাতে ফসলাদি উৎপন্ন হত। আর এইভাবে উভয় বাগানে ছিল শস্য ও ফল-ফসলের সমাবেশ।

كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِمْ مِنْهُ شَيْئًا ۚ وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا

📘 উভয় বাগানই ফল দান করত এবং এতে কোন ত্রুটি করত না।[১] আর উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত করেছিলাম নদী। [২] [১] অর্থাৎ, ফল-ফসল উৎপাদনে কোন কমি না করে পরিপূর্ণরূপে ফসল দান করত। [২] যাতে বাগানের সেচের ব্যাপারে যেন কোন বাধা সৃষ্টি না হয় অথবা বৃষ্টির পানির উপর নির্ভরশীল অঞ্চলের মত যেন বৃষ্টির মুখাপেক্ষী না হয়।

وَكَانَ لَهُ ثَمَرٌ فَقَالَ لِصَاحِبِهِ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَنَا أَكْثَرُ مِنْكَ مَالًا وَأَعَزُّ نَفَرًا

📘 তার প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সে তার বন্ধুকে বলল,[১] ‘ধন-সম্পদে তোমার তুলনায় আমি শ্রেষ্ঠ এবং জনবলে[২] তোমার তুলনায় আমি বেশী শক্তিশালী।’ [১] অর্থাৎ, বাগানের মালিক যে কাফের ছিল সে তার মু'মিন সাথীকে বলল। [২] نَفَرٌ (দল, জনবল) বলতে সন্তান-সন্ততি ও ভৃত্য-চাকর।

وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَٰذِهِ أَبَدًا

📘 এভাবে নিজের প্রতি যুলুম করে সে তার বাগানে প্রবেশ করল। সে বলল, ‘আমি মনে করি না যে, এটা কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে।

وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَىٰ رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا

📘 আমি মনে করি না যে, কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। আর আমি যদি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবৃত্ত হই-ই, তাহলে আমি অবশ্যই এটা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান পাব। [১] [১] অর্থাৎ, সেই কাফের কেবল তার অহংকার ও দাম্ভিকতাতেই পতিত ছিল না, বরং তার উন্মত্ততা ও ভবিষ্যতের সৌন্দর্যময় ও সুদীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষা তাকে আল্লাহর পাকড়াও এবং কুকর্মের প্রতিফল পাওয়ার ব্যাপারে একেবারে উদাসীন করে রেখেছিল। এমন কি সে কিয়ামতকেও অস্বীকার করল এবং বড়ই ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে বলল যে, কিয়ামত যদি সংঘটিত হয়ও, তবে সেখানেও আমার ভাগ্যে জুটবে উত্তম পরিণাম। যার কুফরী ও অবাধ্যতা সীমা অতিক্রম করে যায়, সে মাতালের মত এই ধরনের অহংকারমূলক দাবী করে। যেমন, অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى﴾ (فصلت: ৫০) "আমি যদি আমার পালনকর্তার কাছে যাই, তবে অবশ্যই তাঁর কাছে আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে।" (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১:৫০ আয়াত) ﴿أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآياتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالًا وَوَلَدًا﴾ (مريم:৭৭) "তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে আমার নিদর্শনাবলীতে অবিশ্বাস করে এবং বলে, আমাকে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অবশ্যই দেওয়া হবে।" (সূরা মারয়্যাম ১৯:৭৭ আয়াত)

قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا

📘 উত্তরে তাকে তার বন্ধু বলল, ‘তুমি কি তাঁকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে ও পরে বীর্য হতে এবং তারপর পূর্ণাঙ্গ করেছেন মনুষ্য আকৃতিতে? [১] [১] তার এই ধরনের কথা-বার্তা শুনে তার মু'মিন সাথী তাকে ওয়ায ও নসীহতের ভঙ্গিমায় বুঝাতে লাগল যে, তুমি তোমার সেই স্রষ্টার সাথে কুফরী করছ, যিনি তোমাকে মাটি ও এক ফোঁটা পানি (বীর্যবিন্দু) থেকে সৃষ্টি করেছেন। মানবকুলের পিতা আদম (আঃ)-কে যেহেতু মাটি থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাই মানুষের মূল হল মাটিই। অতঃপর সৃষ্টির উপাদান হয়েছে বীর্য যা পিতার পৃষ্ঠদেশ থেকে স্খলিত হয়ে মায়ের গর্ভাশয়ে গিয়ে স্থির হয়। সেখানে আল্লাহ নয় মাস পর্যন্ত তার লালন-পালন করেন। অতঃপর তাকে সম্পূর্ণ একজন মানুষরূপে মায়ের পেট থেকে বের করেন। কারো কারো নিকট মাটি থেকে সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হল, মানুষ যে খাবার খায়, তা সবই যমীন অর্থাৎ, মাটি থেকে অর্জিত। এই খাবার হতেই সেই বীর্য তৈরী হয়, যা মহিলার গর্ভাশয়ে গিয়ে মানুষ সৃষ্টির মাধ্যম হয়। এইভাবে প্রত্যেক মানুষের মূল উপাদান মাটিই বিবেচিত হয়। অকৃতজ্ঞ মানুষকে তার (সৃষ্টির) মূল সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার স্রষ্টা এবং প্রতিপালকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো হচ্ছে যে, তুমি তোমার প্রকৃত স্বরূপ এবং মৌলিক উপাদানের ব্যাপারে চিন্তা কর। তাঁর এই সমস্ত অনুগ্রহের প্রতি লক্ষ্য কর যে, তিনি তোমাকে কি থেকে কি বানিয়ে দিয়েছেন। এই সৃষ্টি করার কাজে কেউ তাঁর শরীক ও সাহায্যকারী নেই। এ সব কিছুই করেছেন কেবল সেই মহান আল্লাহ, যাঁকে মানতে তুমি প্রস্তুত নও। হায় আফসোস! কত অকৃতজ্ঞ এই মানুষ!

لَٰكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا

📘 কিন্তু আমি বলি, তিনি আল্লাহই আমার প্রতিপালক এবং আমি কাউকেও আমার প্রতিপালকের শরীক করি না। [১] [১] অর্থাৎ, আমি তোমার মত কথা বলব না। আমি তো আল্লাহর প্রতিপালকত্বে এবং তাঁর একতত্ত্ববাদকে স্বীকার করি। এ থেকেও জানা গেল যে, দ্বিতীয়জন মুশরিকই ছিল।

وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ ۚ إِنْ تَرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنْكَ مَالًا وَوَلَدًا

📘 তুমি যখন ধনে ও সন্তানে তোমার তুলনায় আমাকে কম দেখলে, তখন তোমার বাগানে প্রবেশ করে তুমি কেন বললে না, ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন তা-ই হয়েছে; আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি নেই।’’[১] [১] আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার পদ্ধতি জানিয়ে দেওয়ার জন্য বলল যে, বাগানে প্রবেশ করার সময় অবাধ্যতা ও অহংকার প্রদর্শন না করে এইভাবে বললেই ভাল হত, مَا شَآءَ اللهُ لاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ যা কিছু হয় আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। তিনি চাইলে তা অবশিষ্ট রাখবেন এবং ইচ্ছা করলে ধ্বংস করে দিবেন। এই জন্যই হাদীসে এসেছে যে, "যাকে কারো মাল, সন্তান-সন্ততি অথবা অবস্থা ভাল লাগে, সে যেন বলে, 'মা শাআল্লাহু লা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।' (তাফসীর ইবনে কাসীর, মুসনাদ আবূ ইয়া'লা)

وَيُنْذِرَ الَّذِينَ قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا

📘 এবং তাদেরকেও সতর্ক করে, যারা বলে যে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।’[১] [১] যেমন, ইয়াহুদীরা বলে, 'উযাইর আল্লাহর বেটা', খ্রিষ্টানরা বলে, 'ঈসা আল্লাহর বেটা' এবং কোন কোন মুশরিকদল বলে থাকে, 'ফিরিশতাগণ আল্লাহর বেটী!'

فَعَسَىٰ رَبِّي أَنْ يُؤْتِيَنِ خَيْرًا مِنْ جَنَّتِكَ وَيُرْسِلَ عَلَيْهَا حُسْبَانًا مِنَ السَّمَاءِ فَتُصْبِحَ صَعِيدًا زَلَقًا

📘 সম্ভবতঃ আমার প্রতিপালক আমাকে তোমার বাগান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দেবেন[১] এবং তোমার বাগানে আকাশ হতে আগুন বর্ষণ করবেন; যার ফলে তা মসৃণ ময়দানে পরিণত হবে।[২] [১] দুনিয়াতে অথবা আখেরাতে কিংবা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই। [২] حُسْبَانٌ হল غُفْرَانٌ এর ওজনে حساب ধাতু থেকে গঠিত শব্দ। অর্থাৎ, এমন আযাব যা কারো কৃতকর্মের পরিণাম স্বরূপ আসে। অর্থাৎ, আসমানের আযাব দ্বারা তিনি তাকে ঘিরে নেবেন এবং এই স্থান যেখানে এখন সবুজ-শ্যামল বাগান বিদ্যমান, সেটা শূন্য ও মসৃণ ভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে।

أَوْ يُصْبِحَ مَاؤُهَا غَوْرًا فَلَنْ تَسْتَطِيعَ لَهُ طَلَبًا

📘 অথবা ওর পানি ভূ-গর্ভে অন্তর্হিত হবে এবং তুমি কখনো ওকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’ [১] [১] অথবা মধ্যস্থলে যে নদী প্রবাহিত, যেটা হল বাগানের শস্য-শ্যামলতার উৎস, তার পানিকে এত গভীরে পাঠিয়ে দেবেন যে, সেখান হতে পানি অর্জন করা অসম্ভব হয়ে যাবে। আর যেখানে পানি অতি গভীরে চলে যায়, পুনরায় সেখান হতে পানি বের করতে বড় বড় অশ্বশক্তিসম্পন্ন পাম্প্-মেশিনও ব্যর্থ সাব্যস্ত হয়।

وَأُحِيطَ بِثَمَرِهِ فَأَصْبَحَ يُقَلِّبُ كَفَّيْهِ عَلَىٰ مَا أَنْفَقَ فِيهَا وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا

📘 তার ফল-সম্পদ পরিবেষ্টিত হয়ে গেল[১] এবং সে তাতে যা ব্যয় করেছিল, তার জন্য হাত কচলিয়ে আক্ষেপ করতে লাগল;[২] যখন তা মাচান সহ পড়ে গেল।[৩] সে বলতে লাগল, ‘হায়! আমি যদি কাউকেও আমার প্রতিপালকের শরীক না করতাম।’[৪] [১] এটা হল ধ্বংস ও বিনাশেরই আভাস। অর্থাৎ, তার পুরো বাগানটাই ধ্বংস করে দেওয়া হল। [২] অর্থাৎ, বাগান প্রস্তুত ও সংস্কারের কাজে এবং চাষাবাদে যে অর্থ ব্যয় সে করেছিল, তার জন্য আক্ষেপের হাত কচলাতে লাগল। হাত কচলানোর অর্থ, অনুতপ্ত হওয়া। [৩] অর্থাৎ, যে মাচান ও ছাদ-ছপ্পরের উপর আঙ্গুরের লতা রাখা ছিল, সেগুলো সব যমীনে পড়ে গেল এবং আঙ্গুরের সমস্ত ফসল ধ্বংস হয়ে গেল। [৪] এখন সে অনুভব করতে পেরেছে যে, আল্লাহর সাথে কাউকে অংশী স্থাপন করা, তাঁর যাবতীয় নিয়ামত দ্বারা প্রতিপালিত ও উপকৃত হয়ে তাঁর বিধি-বিধানকে অস্বীকার করা ও তাঁর অবাধ্যতা করা কোনভাবেই কোন মানুষের জন্য উচিত নয়। তবে এখন আক্ষেপ ও অনুতাপ কোন ফল দেবে না। ধ্বংসের পর আফসোস করলে আর কি হবে?

وَلَمْ تَكُنْ لَهُ فِئَةٌ يَنْصُرُونَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَمَا كَانَ مُنْتَصِرًا

📘 আল্লাহ ব্যতীত তাকে সাহায্য করার কোন লোকজন ছিল না[১] এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হল না। [১] যে জনবলকে নিয়ে তার গর্ব ছিল, সে জনবল না তার কোন কাজে এল, আর না তারা নিজেরা আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে সক্ষম হল।

هُنَالِكَ الْوَلَايَةُ لِلَّهِ الْحَقِّ ۚ هُوَ خَيْرٌ ثَوَابًا وَخَيْرٌ عُقْبًا

📘 এই ক্ষেত্রে সাহায্য করবার অধিকার সত্য আল্লাহরই।[১] পুরস্কারদানে ও পরিণাম নির্ধারণে তিনিই শ্রেষ্ঠ। [২] [১] وِلاَيَةٌ এর অর্থ, বন্ধুতত্ত্ব ও সাহায্য। অর্থাৎ, এ রকম মুহূর্তে প্রত্যেক মু'মিন ও কাফের অবগত হয়ে যায় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ কারো সাহায্য করতে এবং তাঁর আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিতে সক্ষম নয়। আর এটাই কারণ যে, এ রকম মুহূর্তে বড় বড় অবাধ্য যালেমও ঈমান প্রকাশ করতে বাধ্য হয়ে যায়, যদিও এ সময় ঈমান ফলপ্রসূ ও গৃহীত হয় না। যেমন, কুরআন ফিরআউনের ব্যাপারে উল্লেখ করেছে যে, যখন সে ডুবতে লাগল, তখন বলতে লাগল যে, ﴿آمَنْتُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرائيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ﴾ "যে কথায় বানী ইস্রাঈল বিশ্বাস করেছে, আমিও তাতে বিশ্বাস করলাম যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন (সত্য) মাবূদ নেই এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।" (সূরা ইউনুস ১০:৯০ আয়াত) অন্য কাফেরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তারা যখন আমার আযাব দেখল, তখন বলল, "আমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করলাম এবং যাদের শরীক করতাম, তাদেরকে পরিহার করলাম"। (সূরা মু'মিন ৪০:৮৪) যদি الولاية এর و অক্ষরে জের (الوِلاية) হয়, তাহলে তার অর্থ হবে, শাসন ও এখতিয়ার। (ইবনে কাসীর) [২] তিনি তাঁর বন্ধুদের উৎকৃষ্ট প্রতিদান দেবেন এবং উত্তম পরিণাম দানে ধন্য করবেন।

وَاضْرِبْ لَهُمْ مَثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنْزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُقْتَدِرًا

📘 তাদের কাছে পেশ কর উপমা পার্থিব জীবনের; এটা পানির ন্যায় যা আমি বর্ষণ করি আকাশ হতে, যার দ্বারা ভূমির উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে উদগত হয়। অতঃপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। [১] [১] এই আয়াতে দুনিয়া যে অস্থায়ী এবং ক্ষণস্থায়ী সে কথা ক্ষেতের একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ক্ষেতের ফসলাদি ও গাছ-পালার উপর যখন আসমান থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে, তখন তা গ্রহণ করে ক্ষেত শ্যামল-সবুজ হয়ে ওঠে। ফসলাদি ও গাছপালা নতুন জীবনে মেতে ওঠে। কিন্তু এক সময় আবার এমন আসে, যখন পানি না পাওয়ার অথবা ফসল পেকে যাওয়ার কারণে ক্ষেত শুকিয়ে যায়। অতঃপর বাতাস তা উড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বাতাসের এক ঝটকা কখনও তাকে ডান দিকে আবার কখনও বাম দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। পার্থিব জীবনও বাতাসের এক ঝটকা অথবা পানির বুদ্বুদের অথবা ক্ষেতের মত, যা কিছু কাল মনোহারিত্ব দেখিয়ে ধ্বংসের কোলে ঢলে পড়ে। আর এই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ সেই সত্তার হাতে, যিনি একক এবং প্রতিটি জিনিসের উপর সর্বশক্তিমান। মহান আল্লাহ দুনিয়ার এই দৃষ্টান্ত কুরআন মাজীদের কয়েক স্থানে বর্ণনা করেছেন। যেমন, সূরা ইউনুসের ১০:২৪ নং, সূরা যুমারের ৩৯:২১ নং এবং সূরা হাদীদের ৫৭:২০ নং আয়াত সহ আরো বিভিন্ন আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে।

الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا

📘 ধনোশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা।[১] আর সৎকার্য, যার ফল স্থায়ী[২] ওটা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা প্রাপ্তির ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট। [১] এতে সেই সব দুনিয়াদার লোকদের খন্ডন করা হয়েছে, যারা পার্থিব ধন-মাল, উপায়-উপকরণ এবং গোত্র ও সন্তান-সন্ততির জন্য গর্ব করে। মহান আল্লাহ বললেন, এই জিনিসগুলো হল ধ্বংসশীল এবং পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য। আখেরাতে এগুলো কোন কাজে আসবে না। এই জন্য পরে বলা হয়েছে যে, আখেরাতে কাজে আসবে স্থায়ী সৎকর্মসমূহ। [২] بَاقِيَات صَالِحَات (স্থায়ী নেকীসমূহ) কোনটি বা কি কি? কেউ নামাযকে, কেউ তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) এবং তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু) বলাকে এবং কেউ আরো অন্যান্য সৎকর্মাদিকে বুঝিয়েছেন। তবে সঠিক কথা হল, এটা ব্যাপক; যাতে সকল প্রকার নেক কাজ শামিল। যাবতীয় ফরয ও ওয়াজেব এবং সুন্নত ও নফল কাজই হল স্থায়ী নেকীসমূহ। এমন কি নিষিদ্ধ কার্যাদি থেকে বিরত থাকাও এক প্রকার নেক কাজ; এতেও আল্লাহর কাছে নেকী পাওয়া যাবে।

وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا

📘 (স্মরণ কর,) যেদিন আমি পর্বতকে করব সঞ্চালিত[১] এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে একটি শূন্য প্রান্তর; সেদিন মানুষকে আমি একত্রিত করব এবং তাদের কাউকেও অব্যাহতি দেব না। [২] [১] এখানে কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং তার বড় বড় ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। পর্বতকে সঞ্চালিত করার অর্থ, পাহাড় তার স্থান থেকে সরে যাবে এবং তা ধূনিত পশমের মত উড়তে থাকবে। ﴿وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ﴾ "এবং পাহাড়গুলো ধূনিত রঙিন পশমের মত হয়ে যাবে।" (সূরা ক্বারেআহ ১০১:৫ আয়াত) আরো দেখুন, সূরা তূরের ৫২:৯-১০, সূরা নাম্লের ২৭:৮৮ এবং সূরা ত্বহা র ২০:১০৫-১০৭ নং আয়াতগুলো। যমীন থেকে এই শক্তিশালী পাহাড়গুলো যখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন ঘর-বাড়ী, গাছপালা এবং এই ধরনের অন্যান্য জিনিসগুলো কিভাবে সব সব অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে? এই জন্যই পরে বলা হয়েছে, "তুমি যমীনকে দেখবে একটি শূন্য প্রান্তর।"[২] অর্থাৎ, পূর্বের ও পরের, ছোট ও বড় এবং কাফের ও মু'মিন সকলকেই একত্রিত করব। কেউ যমীনের তলায় পড়ে থাকবে না এবং কবর থেকে বেরিয়ে কোথাও লুকাতে পারবে না।

وَعُرِضُوا عَلَىٰ رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مَوْعِدًا

📘 আর তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধভাবে[১] (এবং বলা হবে), ‘তোমাদেরকে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবেই তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হয়েছ; অথচ তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত সময় আমি উপস্থিত করব না?’ [১] এর অর্থ হল, একই সারিতে আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে অথবা সারিবদ্ধভাবে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হবে।

وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَٰذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا ۚ وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا ۗ وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا

📘 সেদিন (প্রত্যেকের হাতে) রাখা হবে আমলনামা এবং তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে ভীত-সন্ত্রস্ত; তারা বলবে, ‘হায় দুর্ভোগ আমাদের! এ কেমন গ্রন্থ! এ তো ছোট-বড় কিছুই বাদ দেয়নি; বরং এ সমস্ত হিসাব রেখেছে!’ তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে; আর তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি যুলুম করেন না ।

مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ وَلَا لِآبَائِهِمْ ۚ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ ۚ إِنْ يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا

📘 এই বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না; তাদের মুখনিঃসৃত বাক্য[১] কি সাংঘাতিক! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে। [১] সেই 'বাক্য' এই যে, আল্লাহর সন্তান-সন্ততি আছে। যা একেবারে মনগড়া মিথ্যা।

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ ۗ أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ ۚ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلًا

📘 (স্মরণ কর,) আমি যখন ফিরিশতাদেরকে বলেছিলাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’, তখন ইবলীস ছাড়া সবাই সিজদা করল; সে ছিল জীনদের একজন।[১] সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল;[২] তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে; অথচ তারা তোমাদের শত্রু?[৩] সীমালংঘনকারীদের পরিবর্ত কত নিকৃষ্ট![৪] [১] কুরআনের স্পষ্ট এই বর্ণনা থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, শয়তান ফিরিশতা ছিল না। ফিরিশতা হলে আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করার তার কোনই উপায় থাকত না। কেননা, ফিরিশতাদের গুণ মহান আল্লাহ এইভাবে বর্ণনা করেছেন, ﴿ لا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ﴾ "তাঁরা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন তা অমান্য করেন না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাঁরা তা-ই করেন।" (সূরা তাহরীম ৬৬:৬ আয়াত) এখানে একটি জটিলতা এই থেকে যায় যে, যদি সে ফিরিশতা হয়ে না থাকে, তবে তো সে আল্লাহর সম্বোধনের আওতাভুক্ত ছিল না। কেননা, সম্বোধন তো ফিরিশতাদের করা হয়েছিল। তাঁদেরকেই সিজদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। 'রূহুল মাআনী'র লেখক বলেছেন যে, সে অবশ্যই ফিরিশতা ছিল না, কিন্তু ফিরিশতাদের সাথেই থাকত এবং তাঁদেরই মধ্যে গণ্য হত। কাজেই সেও اسْجُدُوا لِآدَمَ এই আদেশের আওতাভুক্ত ছিল। আদম (আঃ)-কে সিজদা করার নির্দেশে তাকেও যে সম্বোধন করা হয়েছিল এ কথা সুনিশ্চিত। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, ﴿مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ﴾ অর্থাৎ, আমি যখন আদেশ করলাম, তখন তোকে কিসে সিজদা করতে বারণ করল? (সূরা আ'রাফ ৭:১২ আয়াত) [২] فِسْقٌ এর অর্থ হয় বেরিয়ে যাওয়া। ইঁদুর তার গর্ত থেকে বেরিয়ে গেলে বলা হয়, فَسَقَتِ الْفأْرَةُ مِنْ جُحْرِهَا শয়তানও সম্মান ও সম্ভাষণের সিজদাকে অস্বীকার করে প্রতিপালকের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।[৩] অর্থাৎ, তোমাদের জন্য কি এটা ঠিক যে, তোমরা এমন ব্যক্তি ও তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, যে তোমাদের পিতা আদম (আঃ)-এর শত্রু, তোমাদের শত্রু ও আল্লাহর শত্রু এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে এই শয়তানের আনুগত্য করবে?[৪] দ্বিতীয় একটি অর্থ এই করা হয়েছে যে, "অত্যাচারীরা কতই নিকৃষ্ট পরিবর্ত নির্বাচন করেছে।" অর্থাৎ, আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন না করে, শয়তানের আনুগত্য ও তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে। আর এটা হল অতি নিকৃষ্টতম পরিবর্ত; যা এই যালেমরা গ্রহণ করেছে।

۞ مَا أَشْهَدْتُهُمْ خَلْقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَا خَلْقَ أَنْفُسِهِمْ وَمَا كُنْتُ مُتَّخِذَ الْمُضِلِّينَ عَضُدًا

📘 আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকালে আমি তাদেরকে (উপস্থিত) সাক্ষী রাখিনি এবং তাদের সৃজনকালেও নয়।[১] আর আমি এমনও নই যে, বিভ্রান্তকারীদেরকে সহায়করূপে গ্রহণ করব। [২] [১] অর্থাৎ, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি ও তার পরিচালনার ব্যাপারে, এমন কি এই শয়তানদের সৃষ্টি করার ব্যাপারেও আমি তাদের থেকে বা তাদের মধ্যে হতে কোন একজনের থেকেও কোন সাহায্য গ্রহণ করিনি। এদের তো তখন অস্তিত্বই ছিল না। তাহলে তোমরা এই শয়তান এবং তার বংশধরের পূজা অথবা আনুগত্য কেন কর? পক্ষান্তরে আমার ইবাদত ও আনুগত্য থেকে তোমরা বিমুখ কেন? অথচ এরা সৃষ্টি, আর আমি এদের সকলের স্রষ্টা। [২] অসম্ভব সত্ত্বেও যদি আমি কাউকে সাহায্যকারী বানাতামও, তবে এদেরকে কেন, যারা আমার বান্দাদেরকে ভ্রষ্ট করে আমার জান্নাত ও আমার সন্তুষ্টির পথে বাধা সৃষ্টি করে।

وَيَوْمَ يَقُولُ نَادُوا شُرَكَائِيَ الَّذِينَ زَعَمْتُمْ فَدَعَوْهُمْ فَلَمْ يَسْتَجِيبُوا لَهُمْ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ مَوْبِقًا

📘 আর (স্মরণ কর,) যেদিন তিনি বলবেন, ‘তোমরা যাদেরকে আমার শরীক মনে করতে তাদেরকে আহবান কর!’ তারা তখন তাদেরকে আহবান করবে; কিন্তু তারা তাদের আহবানে সাড়া দেবে না এবং আমি তাদের উভয়ের মধ্যস্থলে রেখে দেব এক ধ্বংস-গহ্বর। [১] [১] مَوْبِقٌ এর একটি অর্থ হল, পর্দা ও আড়। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে পর্দা ও ব্যবধান করে দেওয়া হবে। কেননা, তাদের মধ্যে আপোসে শত্রুতা হবে। অনুরূপ ব্যবধান এ জন্যও হবে যে, হাশর প্রান্তে পরস্পর সাক্ষাৎ করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেছেন, এটা (موبق) হল জাহান্নামের রক্ত ও পুঁজবিশিষ্ট একটি বিশেষ উপত্যকা। আবার কেউ কেউ এর তরজমা করেছেন, ধ্বংস-গহ্বর; যা তরজমাতে এখতিয়ার করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই মুশরিক এবং তাদের মনগড়া উপাস্যরা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না। কারণ, তাদের মাঝে সর্বনাশী সামগ্রী এবং অনেক ভয়াবহ জিনিস থাকবে।

وَرَأَى الْمُجْرِمُونَ النَّارَ فَظَنُّوا أَنَّهُمْ مُوَاقِعُوهَا وَلَمْ يَجِدُوا عَنْهَا مَصْرِفًا

📘 অপরাধীরা জাহান্নাম দেখে বুঝবে যে, তারা সেখানে পতিত হবে এবং তারা ওটা হতে কোন পরিত্রাণ স্থল পাবে না। [১] [১] যেমন, হাদীসে আছে যে, কাফের এমন স্থান থেকেই নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তার ঠিকানা হল জাহান্নাম, যার দূরত্ব হল চল্লিশ বছরের পথ। (আহমাদ ৩/৭৫)

وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ لِلنَّاسِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ أَكْثَرَ شَيْءٍ جَدَلًا

📘 আমি অবশ্যই মানুষের জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, কিন্তু মানুষ সর্বাধিক বিতর্ক-প্রিয়। [১] [১] অর্থাৎ, মানুষদেরকে সত্য পথ বুঝানোর জন্য কুরআনে আমি সব রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। ওয়ায-নসীহত করেছি। দৃষ্টান্ত, ঘটনাবলী এবং দলীলাদি পেশ করেছি। আর এগুলো বারংবার বিভিন্ন আকারে বর্ণনা করেছি। কিন্তু যেহেতু মানুষ কঠিন বিতর্ক-প্রিয়, তাই না ওয়ায-নসীহতের তার উপর কোন প্রভাব পড়ে, আর না দলীল-প্রমাণ তার জন্য ফলপ্রসূ হয়।

وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَىٰ وَيَسْتَغْفِرُوا رَبَّهُمْ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ أَوْ يَأْتِيَهُمُ الْعَذَابُ قُبُلًا

📘 যখন মানুষের কাছে পথ-নির্দেশ আসে, তখন এই প্রতীক্ষাই তাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন হতে ও তাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা হতে বিরত রাখে যে, তাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা তাদের নিকট উপস্থিত হবে[১] অথবা উপস্থিত হবে (সরাসরি) বিবিধ শাস্তি। [২] [১] অর্থাৎ, মিথ্যা ভাবার কারণে এদের উপরও ঐরূপ আযাব আসবে, যেমন পূর্বের লোকদের উপর এসেছে। [২] অর্থাৎ, মক্কাবাসী ঈমান আনার জন্য এই দু'টি জিনিসের মধ্যে কোন একটির অপেক্ষায় আছে। কিন্তু জ্ঞান-অন্ধদের জানা নেই যে, এর পর ঈমানের কোনই মূল্য নেই অথবা এর পর ঈমান আনার কোন সুযোগই নেই।

وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ ۚ وَيُجَادِلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ ۖ وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَمَا أُنْذِرُوا هُزُوًا

📘 আমি শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই রসূলদেরকে পাঠিয়ে থাকি, কিন্তু সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা মিথ্যা অবলম্বনে বিতন্ডা করে; যাতে তার দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়। আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যার দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে, সে সবকে বিদ্রূপের বিষয়রূপে গ্রহণ করে থাকে। [১] [১] আল্লাহর আয়াতের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হল, তা মিথ্যাজ্ঞান করার অতীব নিকৃষ্টতম প্রকার। অনুরূপ মিথ্যা ও বাতিল দ্বারা বিতর্ক (অর্থাৎ, বাতিল তরীকা অবলম্বন) করে সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা করাও অতি ঘৃণিত আচরণ। আর এই বাতিল পন্থায় বিতর্ক করার একটি প্রকার হল, কাফেরদের এই বলে রসূলদের রিসালাতকে অস্বীকার করে দেওয়া যে, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। ﴿ مَا أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا﴾ (يـس: ১৫) অতএব আমরা তোমাদেরকে রসূল কিভাবে মেনে নিতে পারি? دَحَضَ এর প্রকৃত অর্থ হল, স্খলন ঘটা, পিছল কাটা। যেমন বলা হয়, دَحَضَتْ رِجْلُهُ (তার পদস্খলন ঘটেছে)। এখান থেকেই এ শব্দটি কোন জিনিস থেকে সরে যাওয়ার এবং ব্যর্থ হওয়ার অর্থে ব্যবহার হতে লেগেছে। বলা হয় যে, دَحَضَتْ حُجَّتُهُ دُحُوْضًا أي بَطَلَتْ (তার হুজ্জত বাতিল গণ্য হয়েছে।) এই দিক দিয়ে أدْحَضَ يُدْحِضُ এর অর্থ হবে, বাতিল বা ব্যর্থ করা। (ফাতহুল কাদীর)

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآيَاتِ رَبِّهِ فَأَعْرَضَ عَنْهَا وَنَسِيَ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ ۚ إِنَّا جَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا ۖ وَإِنْ تَدْعُهُمْ إِلَى الْهُدَىٰ فَلَنْ يَهْتَدُوا إِذًا أَبَدًا

📘 কোন ব্যক্তিকে তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর সে যদি তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়, তবে তার অপেক্ষা অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি; যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা সৃষ্টি করেছি। তুমি তাদেরকে সৎপথে আহবান করলেও তারা কখনো সৎপথ পাবে না। [১] [১] অর্থাৎ, প্রতিপালকের আয়াতসমূহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মত মহা অন্যায় করার এবং নিজেদের কার্যকলাপ ভুলে থাকার কারণে তাদের অন্তঃকরণের উপর পর্দা রেখে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বধিরতার বোঝা। যার ফলে কুরআন বুঝা, শোনা এবং তা থেকে হিদায়াত গ্রহণ করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। তাদেরকে যতই তুমি হিদায়াতের প্রতি আহবান কর, তারা কখনই হিদায়াতের পথ অবলম্বন করতে প্রস্তুত হবে না।

وَرَبُّكَ الْغَفُورُ ذُو الرَّحْمَةِ ۖ لَوْ يُؤَاخِذُهُمْ بِمَا كَسَبُوا لَعَجَّلَ لَهُمُ الْعَذَابَ ۚ بَلْ لَهُمْ مَوْعِدٌ لَنْ يَجِدُوا مِنْ دُونِهِ مَوْئِلًا

📘 তোমার প্রতিপালক পরম ক্ষমাশীল, দয়াবান। তাদের কৃতকর্মের জন্য তিনি তাদেরকে পাকড়াও করলে তিনি তাদের শাস্তি ত্বরান্বিত করতেন; কিন্তু তাদের জন্য রয়েছে এক প্রতিশ্রুত মুহূর্ত; যা হতে তাদের কোন আশ্রয়স্থল নেই। [১] [১] অর্থাৎ এটা তো ক্ষমাশীল রবের দয়া যে, তিনি পাপের দরুন সত্ত্বর পাকড়াও করেন না, বরং অবকাশ দেন। যদি এ রকম না হত, তবে (বদ)আমলের কারণে প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর আযাবের শিকলে আবদ্ধ থাকত। হ্যাঁ, এ কথা বাস্তব যে, যখন অবকাশ শেষ হয়ে যায় এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ধ্বংসের সময় এসে যায়, তখন আর পলায়ন করার কোন পথ এবং নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় তাদের জন্য থাকে না। مَوْئِلٌ এর অর্থ, আশ্রয়স্থল, পলায়ন পথ।

وَتِلْكَ الْقُرَىٰ أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوا وَجَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِمْ مَوْعِدًا

📘 ঐসব জনপদ; তাদের অধিবাসীবৃন্দকে আমি ধ্বংস করেছিলাম, যখন তারা সীমালংঘন করেছিল এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমি স্থির করেছিলাম এক নির্দিষ্ট ক্ষণ। [১] [১] এ থেকে আ'দ, সামুদ এবং শুআইব ও লূত عليهما السلام প্রভৃতিদের সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে। যারা হিজাযবাসীদের সন্নিকটে এবং তাদের পথের ধারে আবাদ ছিল। তাদেরকেও তাদের যুলুমের কারণে ধ্বংস করা হয়েছে। তবে ধ্বংস সাধনের পূর্বে তাদেরকে পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যখন এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তাদের যুলুম ও অবাধ্যতা এমন সীমায় পৌঁছে গেছে, যে সীমায় পৌঁছে যাওয়ার পর হিদায়াতের সমস্ত পথ একেবারে বন্ধ এবং তাদের নিকট থেকে আর কোন কল্যাণের আশা অবর্তমান, তখন তাদের আমলের অবকাশ শেষ হয়ে গেল এবং ধ্বংস আরম্ভ হয়ে গেল। অতঃপর তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। আর এটাকে বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ গ্রহণের নমুনা বানিয়ে দিলেন। আসলে মক্কাবাসীদেরকে বুঝানো হচ্ছে যে, তোমরা আমার সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মিথ্যাবাদী মনে করছ, তা সত্ত্বেও তোমাদেরকে অবকাশ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করো না যে, তোমাদেরকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করার নেই, বরং এই অবকাশ ও ঢিল দেওয়া হল আল্লাহর একটি দস্তর। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তি, দল এবং জাতিকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। যখন সে সময় শেষ হয়ে যাবে এবং তোমরা কুফরী ও অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসবে না, তখন তোমাদের অবস্থাও তাদের থেকে ভিন্ন হবে না, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে।

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَىٰ آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَٰذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا

📘 তারা এই বাণী[১] বিশ্বাস না করলে তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে সম্ভবতঃ তুমি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে। [১] بِهَذَا الْحَدِيْثِ (এই বাণী) বলতে কুরআন করীম। কাফেরদের ঈমান আনার ব্যাপারে রসূল (সাঃ) যে অতীব উদগ্রীব ছিলেন এবং (ঈমান আনা থেকে) তাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে যে তিনি কঠিন কষ্ট বোধ করতেন, এই আয়াতে তাঁর সেই মানসিক অবস্থা ও অভিপ্রায়ের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّىٰ أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا

📘 (স্মরণ কর,) যখন মূসা তার সঙ্গীকে[১] বলেছিল, ‘দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে[২] না পৌঁছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব।’ [৩] [১] এই যুবক ছিল ইউশা' বিন নূন (আঃ) যিনি মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। [২] কোন নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ স্থানকে নির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে অনুমান ও লক্ষণাদির দাবী অনুযায়ী এটা হল সিনাই মরুভূমির দক্ষিণ মাথায়, যেখানে উকবাহ উপসাগর ও সুইজ উপসাগর এক সাথে একত্রিত হয়ে লোহিত সাগরে মিশে গেছে। অন্যান্য যেসব স্থানের কথা মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেছেন তাতে مجمع البحرين (দুই সাগরের মিলনস্থল) এর যে ব্যাখ্যা হয়, তার সাথে মোটেই খাপ খায় না। [৩] حُقُبٌ এর একটি অর্থ, ৭০ অথবা ৮০ বছর। দ্বিতীয় অর্থ, অনির্দিষ্ট সময়-কাল। এই দ্বিতীয় অর্থই এখানে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, যতক্ষণ না আমি مجمع البحرين (দুই সাগরের মিলনস্থল) পর্যন্ত পৌঁছব, ততক্ষণ পর্যন্ত চলতেই থাকব এবং সফর অব্যাহত রাখব। তাতে যতদিন লাগে লাগবে। মূসা (আঃ)-এর এই সফরের প্রয়োজন এই জন্য দেখা দিয়েছিল যে, তিনি একজন প্রশ্নকারীর উত্তরে বলেছিলেন, বর্তমানে আমার থেকে বড় জ্ঞানী আর কেউ নেই। তাঁর এই (গর্ব) কথা মহান আল্লাহর পছন্দ হল না। সুতরাং অহীর মাধ্যমে তাঁকে অবগত করলেন যে, আমার এক বান্দা (খায্বির) তোমার থেকেও বড় জ্ঞানী। মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহ! তাঁর সাথে সাক্ষাৎ কিভাবে হতে পারে? মহান আল্লাহ বললেন, যেখানে উভয় সাগর এক সাথে মিশে গেছে, সেখানেই আমার সেই বান্দা থাকবে। অনুরূপ এ কথাও বললেন যে, সাথে করে একটি মাছ নিও। যখন এ মাছ তোমার থলি থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে, তখন বুঝে নিও যে, এটাই তোমার গন্তব্যস্থল। (বুখারী, সূরা কাহ্ফ) এই নির্দেশ অনুযায়ী তিনি একটি মাছ নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে দিলেন।

فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ سَرَبًا

📘 তারা যখন উভয় (সমুদ্রে)র সঙ্গম স্থলে পৌঁছল, তখন নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেল; অথচ ওটা সুড়ঙ্গের মত পথ করে সমুদ্রে নেমে গেল।

فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَاهُ آتِنَا غَدَاءَنَا لَقَدْ لَقِينَا مِنْ سَفَرِنَا هَٰذَا نَصَبًا

📘 যখন তারা আরো অগ্রসর হল, তখন মূসা তার সঙ্গীকে বলল, ‘আমাদের নাশতা আনো, আমরা তো আমাদের এই সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’

قَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّي نَسِيتُ الْحُوتَ وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ ۚ وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا

📘 সে বলল, ‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমরা যখন শিলাখন্ডে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিয়েছিলাম? শয়তানই ওর কথা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল; মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে নিজের পথ করে সমুদ্রে নেমে গেল।’ [১] [১] অর্থাৎ, মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রের মধ্যে চলে যায় এবং তার জন্য মহান আল্লাহ সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ বানিয়ে দেন। ইউশা' (আঃ) মাছটিকে সমুদ্রে যেতে এবং পথ সৃষ্টি হতে দেখেছিলেন, কিন্তু মূসা (আঃ)-কে এ কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। এমন কি সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। এই দিন এবং দিনের পরে রাত সফর করে যখন দ্বিতীয় দিনে মূসা (আঃ) ক্লান্তি ও ক্ষুধা অনুভব করলেন, তখন তিনি তাঁর যুবক সাথীকে বললেন, চল খাবার খেয়ে নিই। তিনি বললেন, যেখানে পাথরে হেলান দিয়ে আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম, মাছটি সেখানে জীবিত হয়ে সমুদ্রে চলে গেছে এবং সেখানে বিস্ময়করভাবে সে তাঁর পথ বানিয়ে নিয়েছে। আর এ কথা আপনাকে বলতে আমি ভুলে গেছি। আসলে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।

قَالَ ذَٰلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ ۚ فَارْتَدَّا عَلَىٰ آثَارِهِمَا قَصَصًا

📘 মূসা বলল, ‘আমরা তো সেটারই অনুসন্ধান করছিলাম।’ অতঃপর তারা নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলতে লাগল। [১] [১] মূসা (আঃ) বললেন, আল্লাহর বান্দা! যেখানে মাছটি জীবিত হয়ে অদৃশ্য হয়েছে, সেটাই হচ্ছে আমাদের ঐ গন্তব্যস্থল, যার খোঁজে আমরা সফর করছি। তাই নিজেদের পায়ের চিহ্নকে অনুসরণ করে সেদিকেই প্রত্যাবর্তন করলেন, যেদিক থেকে এসেছিলেন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে ফিরে গেলেন। قَصَصًا এর অর্থ, পিছনে পড়া, পিছে পিছে চলা। অর্থাৎ, পায়ের চিহ্নকে অনুসরণ করে তার পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন।

فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا

📘 অতঃপর তারা সাক্ষাৎ পেল আমার দাসদের মধ্যে একজনের;[১] যাকে আমি আমার নিকট হতে অনুগ্রহ[২] দান করেছিলাম ও যাকে আমি আমার নিকট হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। [৩] [১] এই দাস বা বান্দা হলেন খাযির। বহু সহীহ হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এটা বর্ণিত হয়েছে। 'খাযির'-এর অর্থ সবুজ-শ্যামল। তিনি একদা সাদা যমীনের উপর বসলে, যমীনের সেই অংশটুকু তাঁর নীচে দিয়ে সবুজ হয়ে উঠে। এই কারণেই তাঁর নাম হয়ে যায় 'খাযির'। (বুখারীঃ সূরা কাহ্ফের তাফসীর) [২] رَحْمَةٌ এর অর্থ কোন কোন মুফাসসির নিয়েছেন বিশেষ অনুগ্রহ যা আল্লাহ তাঁর এই বিশিষ্ট বান্দাকে প্রদান করেছিলেন। তবে অধিকাংশ মুফাস্সির এর অর্থ নিয়েছেন নবুঅত। [৩] এটা মূসা (আঃ)-এর কাছে যে জ্ঞান ছিল সেই নবুঅত ছাড়াও এমন সৃষ্টিগত বিষয়ের এমন জ্ঞান, যে জ্ঞান দানে মহান আল্লাহ কেবল খাযিরকেই ধন্য করেছিলেন এবং মূসা (আঃ)-এর কাছেও এ জ্ঞান ছিল না। এটাকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করে কোন কোন সুফিপন্থীরা দাবী করে যে, আল্লাহ তাআলা নবী নন এমন কোন কোন লোককে, 'ইলমে লাদুন্নী' (বিশেষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান) দানে ধন্য করেন। আর এ জ্ঞান কোন শিক্ষক ছাড়াই কেবল আল্লাহর অপার দয়া ও করুণায় লব্ধ হয় এবং এই 'বাতেনী ইলম' (গুপ্ত জ্ঞান) শরীয়তের বাহ্যিক জ্ঞান -- যা কুরআন ও হাদীস আকারে বিদ্যমান তা -- থেকে ভিন্ন হয়, বরং কখনো কখনো তার বিপরীত ও বিরোধীও হয়। কিন্তু এ দলীল এই জন্য সঠিক নয় যে, তাঁকে যে কিছু বিশেষ জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল, সে কথা মহান আল্লাহ নিজেই পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। অথচ অন্য কারো জন্য এ ধরনের কথা বলা হয়নি। যদি এটাকে ব্যাপক করে দেওয়া হয়, তবে প্রত্যেক যাদুকর-ভেল্কিবাজ এই ধরনের দাবী করতে পারে। তাই তো সুফিবাদীদের মাঝে এই দাবী ব্যাপকহারে বিদ্যমান। তবে এই ধরনের দাবীর কোনই মূল্য নেই।

قَالَ لَهُ مُوسَىٰ هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَىٰ أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا

📘 মূসা তাকে বলল, ‘সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হতে আমাকে শিক্ষা দেবেন -- এই শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করব কি?’

قَالَ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا

📘 সে বলল, ‘তুমি কিছুতেই আমার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবে না।

وَكَيْفَ تَصْبِرُ عَلَىٰ مَا لَمْ تُحِطْ بِهِ خُبْرًا

📘 যে বিষয় তোমার জ্ঞানায়ত্ত নয়,[১] সে বিষয়ে তুমি ধৈর্যধারণ করবে কেমন করে?’ [১] অর্থাৎ, যে ব্যাপারে তোমার পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই।

قَالَ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ صَابِرًا وَلَا أَعْصِي لَكَ أَمْرًا

📘 মূসা বলল, ‘ইন শাআল্লাহ (আল্লাহ চাইলে) আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না।’

إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا

📘 পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে[১] আমি সেগুলিকে ওর শোভা করেছি মানুষকে এই পরীক্ষা করবার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম। [১] ভূ-পৃষ্ঠে জীব-জন্তু, উদ্ভিদ, জড় ও খনিজপদার্থ এবং মটির নীচে লুক্কায়িত অন্যান্য গুপ্তধন, এ সবই হল দুনিয়ার শোভা-সৌন্দর্য ও তার চাকচিক্য।

قَالَ فَإِنِ اتَّبَعْتَنِي فَلَا تَسْأَلْنِي عَنْ شَيْءٍ حَتَّىٰ أُحْدِثَ لَكَ مِنْهُ ذِكْرًا

📘 সে বলল, আচ্ছা, ‘তুমি যদি আমার অনুসরণ কর-ই, তাহলে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করো না, যতক্ষণ না আমি সে সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলি।’

فَانْطَلَقَا حَتَّىٰ إِذَا رَكِبَا فِي السَّفِينَةِ خَرَقَهَا ۖ قَالَ أَخَرَقْتَهَا لِتُغْرِقَ أَهْلَهَا لَقَدْ جِئْتَ شَيْئًا إِمْرًا

📘 অতঃপর তারা যাত্রা শুরু করল। পরে যখন তারা নৌকায় আরোহণ করল, তখন সে তাতে ছিদ্র করে দিল। মূসা বলল, ‘আপনি কি আরোহীদেরকে ডুবিয়ে দেবার জন্য তাতে ছিদ্র করলেন?! আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।’ [১] [১] মূসা (আঃ) যেহেতু এই বিশেষ জ্ঞানের খবর রাখতেন না, যে জ্ঞানের ভিত্তিতে খাযির (আঃ) নৌকা ছিদ্র করে দিয়েছিলেন, তাই তিনি ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে নিজের জানা ও বুঝার আলোকে এটাকে একটি গুরুতর মন্দ কাজ গণ্য করেন। إِمْرًا এর অর্থ হল, الدَّاهِيَةُ الْعَظِيْمَةُ বড়ই ভয়াবহ কাজ।

قَالَ أَلَمْ أَقُلْ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا

📘 সে বলল, ‘আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সঙ্গে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করতে পারবে না?’

قَالَ لَا تُؤَاخِذْنِي بِمَا نَسِيتُ وَلَا تُرْهِقْنِي مِنْ أَمْرِي عُسْرًا

📘 মূসা বলল, ‘আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না ও আমার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করবেন না।’ [১] [১] অর্থাৎ, আমার সাথে সহজ পন্থা অবলম্বন করুন, কঠোরতা অবলম্বন করবেন না।

فَانْطَلَقَا حَتَّىٰ إِذَا لَقِيَا غُلَامًا فَقَتَلَهُ قَالَ أَقَتَلْتَ نَفْسًا زَكِيَّةً بِغَيْرِ نَفْسٍ لَقَدْ جِئْتَ شَيْئًا نُكْرًا

📘 অতঃপর তারা চলতে লাগল; চলতে চলতে তাদের সাথে এক বালকের[১] সাক্ষাৎ হলে সে তাকে হত্যা করল। তখন মূসা বলল, ‘আপিন কি এক নিষ্পাপ জীবন নাশ করলেন হত্যার অপরাধ ছাড়াই?! আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন।’ [২] [১] 'বালক' বলতে তরুণ, কিশোর অথবা শিশু হতে পারে। [২] نُكْرًا، فَظِيْعًا مُنْكَرًا لاَ يُعْرَفُ فِي الشَّرْعِ এত বড় অন্যায় কাজ, শরীয়তে যে কাজের কোন বৈধতা নেই। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ হল, أَنْكَرُ مِنَ الأَمْرِ الأَوَّلِ প্রথম কাজ (নৌকা ছিদ্র করার) থেকেও আরো বড় অন্যায়। কারণ, হত্যা এমন কাজ, যার ক্ষতিপূরণ ও সংশোধন সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া এমন ক্ষতিকর কাজ, যার ক্ষতিপূরণ ও সংশোধন হতে পারে। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, الأَوَّلِ أَقَلُّ مِنَ الأَمْرِ (প্রথম কাজের থেকেও কম অন্যায়) কারণ, একটি প্রাণকে হত্যা করা সমস্ত মানুষকে ডুবিয়ে দেওয়ার তুলনায় লঘু অন্যায়। (ফাতহুল কাদীর) তবে প্রথম অর্থই বেশী সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ, মূসা (আঃ) শরয়ী যে জ্ঞান রাখতেন, সেই জ্ঞানের আলোকে এ কাজ অবশ্যই শরীয়ত বিরোধী ছিল। তাই তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন এবং এই কাজগুলোকে অতি গুরুতর অন্যায় বলে গণ্য করেছিলেন।

۞ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكَ إِنَّكَ لَنْ تَسْتَطِيعَ مَعِيَ صَبْرًا

📘 সে বলল, ‘আমি কি তোমাকে বলিনি যে, তুমি আমার সাথে কিছুতেই ধৈর্যধারণ করতে পারবে না?’

قَالَ إِنْ سَأَلْتُكَ عَنْ شَيْءٍ بَعْدَهَا فَلَا تُصَاحِبْنِي ۖ قَدْ بَلَغْتَ مِنْ لَدُنِّي عُذْرًا

📘 মূসা বলল, এর পর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি, তাহলে আপনি আমাকে সঙ্গে রাখবেন না; আপনার কাছে আমার ওজর-আপত্তি চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে।’[১] [১] অর্থাৎ এবার যদি প্রশ্ন করি তাহলে আপনি আমাকে সাথে নেওয়ার মর্যাদা হতে বঞ্চিত করবেন; তাতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। যেহেতু এ ব্যাপারে তখন আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য অজুহাত থাকবে।

فَانْطَلَقَا حَتَّىٰ إِذَا أَتَيَا أَهْلَ قَرْيَةٍ اسْتَطْعَمَا أَهْلَهَا فَأَبَوْا أَنْ يُضَيِّفُوهُمَا فَوَجَدَا فِيهَا جِدَارًا يُرِيدُ أَنْ يَنْقَضَّ فَأَقَامَهُ ۖ قَالَ لَوْ شِئْتَ لَاتَّخَذْتَ عَلَيْهِ أَجْرًا

📘 অতঃপর উভয়ে চলতে লাগল; চলতে চলতে তারা এক জনপদের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে খাদ্য চাইল; কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল।[১] অতঃপর সেখানে তারা এক পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেল এবং সে ওটাকে সোজা খাড়া করে দিল। [২] মূসা বলল, ‘আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন।’ [৩] [১] এই গ্রামটি ছিল কৃপণ ও হীন লোকদের যারা অতিথিদের আপ্যায়ন করতে অস্বীকার করল। অথচ মুসাফিরদেরকে খাদ্য দান করা এবং অতিথিদের আতিথেয়তা করা প্রত্যেক ধর্মের সৎচরিত্রতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে পরিচিত। মহানবী (সাঃ)ও মেহমানদের আপ্যায়ন করা ও তাদের সম্মান করা ঈমানের দাবী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন নিজ মেহমানদের সম্মান করে।" (বুখারী, মুসলিম) [২] খাযির (আঃ) দেওয়ালটাতে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন আর আল্লাহর আদেশে অলৌকিকভাবে তা সোজা হয়ে গেল। যেমন সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এ কথা স্পষ্ট হয়। [৩] মূসা (আঃ) যিনি প্রথম থেকেই গ্রামের মানুষের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি খাযির (আঃ)-এর বিনা পারিশ্রমিকে কাজটি করে দেওয়ায় চুপ থাকতে পারলেন না; বরং বলে ফেললেন যে, যারা আমাদের মুসাফিরী অবস্থা, আহারের প্রয়োজনীয়তা, মান-সম্মান প্রভৃতি কিছুরই খেয়াল রাখল না তারা অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য হয় কি করে?

قَالَ هَٰذَا فِرَاقُ بَيْنِي وَبَيْنِكَ ۚ سَأُنَبِّئُكَ بِتَأْوِيلِ مَا لَمْ تَسْتَطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا

📘 সে বলল, ‘এখানেই তোমার ও আমার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হল;[১] (তবে) যে বিষয়ে তুমি ধৈর্যধারণ করতে পারনি আমি তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি; [২] [১] খাযির (আঃ) বললেন, মূসা তুমি তৃতীয়বারও ধৈর্য্য ধারণ করতে পারলে না, এবার তোমার কথামত তোমাকে আমি সাথে নিতে অপারগ। [২] কিন্তু খাযির (আঃ) পৃথক হওয়ার আগে উক্ত তিনটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা জরুরী মনে করলেন। যাতে মূসা (আঃ) বিভ্রান্তির শিকার না হন এবং বুঝতে পারেন যে, নবুঅতের জ্ঞান আলাদা যা তাঁকে দান করা হয়েছে এবং সৃষ্টিগত কিছু বিষয়ের জ্ঞান আলাদা যা আল্লাহর হিকমত ও ইচ্ছায় খাযিরকে দেওয়া হয়েছে। আর সেই অনুযায়ী তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয। যার কারণে মূসা (আঃ)ও চুপ থাকতে পারেননি। উক্ত প্রকার সৃষ্টিগত কর্ম সম্পাদনের কারণেই কিছু বিদ্বানদের ধারণা যে, খাযির মানুষ ছিলেন না। আর এই জন্যই তাঁরা এ বিতর্কের ঝামেলায় যান না, তিনি রসূল ছিলেন, নবী ছিলেন, নাকি ওলী ছিলেন। কারণ এ সকল মর্যাদা কেবল মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। তাঁরা বলেন, তিনি ফিরিশতা ছিলেন। কিন্তু যদি আল্লাহ কোন নবীকে সৃষ্টিগত কিছু বিষয়ের জ্ঞান দান করে ওই শ্রেণীর কোন কাজ করিয়ে নেন, তাহলে তা অসম্ভব কিছুই নয়। যখন অহীপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজেই তা পরিষ্কার করে দেন যে, আমি এটা আল্লাহর আদেশে করেছি। সুতরাং যদিও তা শরীয়ত-বিরোধী বলে মনে হয়, তবুও যেহেতু এর সম্পর্ক সৃষ্টিগত বিষয়ীভূত জ্ঞানের সাথে, সেহেতু জায়েয-নাজায়েযের বিতর্ক ওঠার কথা নয়। যেমন সৃষ্টিগত নিয়মানুসারে কেউ অসুস্থ হয়, কেউ মৃত্যু বরণ করে, কারো ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যায়, কোন জাতির উপর আযাব আসে; এ সবের মধ্যে কিছু কিছু কাজ কোন কোন সময় আল্লাহর আদেশে ফিরিশতারা করে থাকেন। যেভাবে এ সমস্ত কাজ আজ পর্যন্ত কারো শরীয়ত-বিরোধী বলে মনে হয়নি, সেইভাবে খাযির দ্বারা সংঘটিত কাজগুলো শরীয়তের দাঁড়িপাল্লায় মাপা উচিত নয়। তবে বর্তমানে নবুঅত ও অহীর পরম্পরা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কারো পক্ষে এ সমস্ত জিনিসের দাবী কোনক্রমেই সত্য বলে মেনে নেওয়ার মত নয়; যেমন খাযির কর্তৃক প্রমাণিত। কারণ খাযিরের কর্মসমূহ কুরআন হতে সাব্যস্ত; আর সেই কারণে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু এখন কেউ এ রকম কর্মকান্ড ঘটালে বা ঘটাবার দাবী করলে তার প্রতিবাদ করা জরুরী। কারণ তার দাবীর প্রমাণে সেই নিশ্চিত সত্য জ্ঞান আজ অবর্তমান; যার দ্বারা তার দাবীর বাস্তবিকতা প্রমাণ হতে পারে ।

أَمَّا السَّفِينَةُ فَكَانَتْ لِمَسَاكِينَ يَعْمَلُونَ فِي الْبَحْرِ فَأَرَدْتُ أَنْ أَعِيبَهَا وَكَانَ وَرَاءَهُمْ مَلِكٌ يَأْخُذُ كُلَّ سَفِينَةٍ غَصْبًا

📘 নৌকাটির ব্যাপারে (কথা এই যে,) ওটা ছিল কতিপয় দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে কাজ করত; আমি ইচ্ছা করলাম নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে, কারণ ওদের সম্মুখে ছিল এক রাজা, যে বল প্রয়োগে সকল (নিখুঁত) নৌকা ছিনিয়ে নিত।

وَإِنَّا لَجَاعِلُونَ مَا عَلَيْهَا صَعِيدًا جُرُزًا

📘 ওর উপর যা কিছু আছে তা অবশ্যই আমি উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত করব।[১] [১] صَعِيْدًا পরিষ্কার ময়দান। جُرُزٌ একেবারে সমতল, যাতে কোন গাছ-পালা থাকে না। অর্থাৎ, এমন এক দিন আসবে, যেদিন এ দুনিয়া তার যাবতীয় সৌন্দর্য ও চাকচিক্য সহ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ভূ-পৃষ্ঠ একটি গাছ-পালাহীন সমতল ময়দানে পরিণত হবে। অতঃপর আমি নেককার ও বদকারদেরকে তাদের আমল অনুযায়ী প্রতিদান দেব।

وَأَمَّا الْغُلَامُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤْمِنَيْنِ فَخَشِينَا أَنْ يُرْهِقَهُمَا طُغْيَانًا وَكُفْرًا

📘 আর বালকটির (কথা এই যে,) তার পিতা-মাতা ছিল বিশ্বাসী। আমি আশংকা করলাম যে, সে বিদ্রোহাচরণ ও অবিশ্বাস দ্বারা তাদেরকে বিব্রত করবে।

فَأَرَدْنَا أَنْ يُبْدِلَهُمَا رَبُّهُمَا خَيْرًا مِنْهُ زَكَاةً وَأَقْرَبَ رُحْمًا

📘 অতঃপর আমি চাইলাম যে, তাদের প্রতিপালক যেন তাদেরকে তার পরিবর্তে (এমন) এক সন্তান দান করেন; যে হবে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভক্তি-ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর ।

وَأَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيمَيْنِ فِي الْمَدِينَةِ وَكَانَ تَحْتَهُ كَنْزٌ لَهُمَا وَكَانَ أَبُوهُمَا صَالِحًا فَأَرَادَ رَبُّكَ أَنْ يَبْلُغَا أَشُدَّهُمَا وَيَسْتَخْرِجَا كَنْزَهُمَا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ ۚ وَمَا فَعَلْتُهُ عَنْ أَمْرِي ۚ ذَٰلِكَ تَأْوِيلُ مَا لَمْ تَسْطِعْ عَلَيْهِ صَبْرًا

📘 আর ঐ প্রাচীরটির (কথা এই যে,) ওটা ছিল নগরবাসী দুই এতীম বালকের, ওর নিম্নদেশে আছে তাদের গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং তোমার প্রতিপালক দয়াপূর্বক ইচ্ছা করলেন যে, তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং তারা তাদের ধনভান্ডার উদ্ধার করুক; আমি নিজের তরফ থেকে সেসব করিনি। [১] তুমি যে বিষয়ে ধৈর্য ধারণে অপারগ হয়েছিলে, এটাই তার ব্যাখ্যা।’ [১] খাযির (আঃ)-কে যাঁরা নবী বলেন তাঁদের এটি দ্বিতীয় দলীল যা দ্বারা তাঁরা তাঁর নবী হওয়া প্রমাণ করেন । কারণ নবী ব্যতীত কারো নিকট এই শ্রেণীর অহী আসে না, যিনি কোন গায়বী ইশারায় এত বড় বড় কাজ করতে পারেন। আর না নবী ব্যতীত অন্য কারো গায়বী ইঙ্গিতে এ ধরনের কাজ মেনে নেওয়ার মত। খাযির (আঃ)-এর নবুঅতের মত তাঁর জীবন বিষয়েও কিছু লোকের নিকট মত-পার্থক্য রয়েছে। যাঁরা মনে করেন খাযির (আঃ) এখনও জীবিত, তাঁরা বেশ কিছু লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ প্রমাণ করেন। কিন্তু যেভাবে খাযিরের আজ পর্যন্ত জীবিত থাকার ব্যাপারে শরীয়তের কোন দলীল নেই, ঠিক সেইভাবে খাযিরের সঙ্গে ধ্যানমগ্ন, নিদ্রিত বা জাগ্রত অবস্থায় কারো সাক্ষাৎ লাভের কথাও মানার যোগ্য নয়। যখন তার শরীরের হুলিয়া (গঠনাকৃতি) সঠিক দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, তখন তাঁকে কিভাবে চেনা সম্ভব? আর কি ভাবেই বা বিশ্বাস করা যায় যে, যাঁরা খাযিরের সাক্ষাৎ লাভের দাবী করেন তাঁরা সত্যি সত্যি মূসা (আঃ) এর সঙ্গী খাযির (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। যেহেতু এমনও হতে পারে যে, খাযিরের নামে তাঁদেরকে অন্য কেউ ধোঁকা দিয়েছে।

وَيَسْأَلُونَكَ عَنْ ذِي الْقَرْنَيْنِ ۖ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُمْ مِنْهُ ذِكْرًا

📘 আর তারা তোমাকে যুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে; [১] তুমি বলে দাও, ‘আমি তোমাদের নিকট তার বিষয়ে বর্ণনা করব।’ [১] ইয়াহুদীদের কথামত মুশরিকরা যে তিনটি প্রশ্ন নবী (সাঃ)-কে করেছিল তার মধ্যে এটি তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর। যুলক্বারনাইন এর শাব্দিক অর্থ হল দুই শিংবিশিষ্ট। আর তাঁর নামকরণের কারণঃ যেহেতু তাঁর মাথায় বাস্তবেই দুটি শিং ছিল। কিংবা কারণ এই যে, তিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে সূর্যের (উদয়-অস্তের সময় তার) শিং বা কিরণ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁর মাথায় শিঙের মত চুলের দুটি ঝুঁটি ছিল। পূর্ববর্তী মুফাসসিরগণের মতানুসারে তিনি হলেন রোমের আলেকজান্ডার, যাঁর রাজত্ব ছিল পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত। কিন্তু আধুনিক যুগের মুফাসসিরগণ অভিনব ঐতিহাসিক তত্তের আলোকেই তাঁদের সাথে একমত নন। বিশেষ করে মওলানা আবুল কালাম আজাদ যিনি যুলক্বারনাইনের স্বরূপ ও প্রকৃতত্ব উদ্ঘাটনের জন্য যে গবেষণা করেছেন তা প্রশংসাযোগ্য। তার গবেষণার সারমর্ম হলঃ (ক) যুলক্বারনাইন সম্বন্ধে কুরআন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, তিনি এমন এক বাদশাহ ছিলেন যাকে আল্লাহ প্রচুর পার্থিব উপকরণ ও উপাদান দান করেছিলেন। (খ) পূর্ব ও পশ্চিমের দেশসমূহকে জয় করে এমন এক পাহাড়ী রাস্তায় পৌছলেন যার অন্য দিকে য়্যা'জূজ-মা'জূজ জাতি বাস করে। (গ) সেখানে তিনি য়্যা'জূজ-মা'জুজের রাস্তা বন্ধ করার জন্য একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করেন। (ঘ) তিনি ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী সম্রাট ছিলেন। (ঙ) তিনি প্রবৃত্তিপূজারী ও ধন-সম্পদের লোভী ছিলেন না। মওলানা আজাদ বলেন, এই সমস্ত গুণের অধিকারী একমাত্র পারস্যের সেই সম্রাট যাকে ইউনানী (গ্রীস) ভাষায় সাইরাস, ইবরানী (হিব্রু) ভাষায় খুরাস এবং আরবী ভাষায় কাইখাসরু নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর রাজত্বকাল ৫৩৯ খ্রিষ্টপূর্ব। মওলানা আরো বলেন, ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সাইরাসের একটি মূর্তি পাওয়া গেছে, যাতে তাঁর দেহকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, তাঁর শরীরের দু দিকে ঈগলের মত দুটি ডানা এবং ভেড়ার মত মাথায় দুটি শিং রয়েছে। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্যঃ তুরজুমানুল কুরআন ১ম খন্ড ৩৯৯-৪৩০পৃঃ) আর আল্লাহই ভালো জানেন।

إِنَّا مَكَّنَّا لَهُ فِي الْأَرْضِ وَآتَيْنَاهُ مِنْ كُلِّ شَيْءٍ سَبَبًا

📘 আমি তাকে পৃথিবীতে আধিপত্য দান করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ[১] দিয়েছিলাম। [১] سَبَب এর প্রকৃত অর্থ দড়ি বা রশি। তবে এই শব্দের ব্যবহার ঐ সমস্ত মাধ্যম ও অসীলার জন্যও হয়, যার সাহায্যে মানুষ তার উদ্দেশ্য লাভ করতে পারে। এখানে অর্থ হল, আমি তাকে এমন মাধ্যম ও উপকরণ দান করেছিলাম, যার দ্বারা সে দেশসমূহ জয় করে। শত্রুদের অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দেয় এবং অত্যাচারী বাদশাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।

فَأَتْبَعَ سَبَبًا

📘 সে এক পথ অবলম্বন করল।[১] [১] দ্বিতীয়ত سَبَب এর অর্থঃ পথ করা হয়েছে। কিংবা এর অর্থ হল, আল্লাহ প্রদত্ত মাধ্যম থেকে অতিরিক্ত আরো কিছু মাধ্যম প্রস্তুত করল; যেমন আল্লাহর সৃষ্টি লোহা দিয়ে নানান রকমের অস্ত্র-শস্ত্র ও যন্ত্র তৈরী করা হয় এবং যেভাবে বিভিন্ন ধাতু দিয়ে বিভিন্ন জিনিস-পত্র তৈরী করা হয়।

حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ مَغْرِبَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَغْرُبُ فِي عَيْنٍ حَمِئَةٍ وَوَجَدَ عِنْدَهَا قَوْمًا ۗ قُلْنَا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِمَّا أَنْ تُعَذِّبَ وَإِمَّا أَنْ تَتَّخِذَ فِيهِمْ حُسْنًا

📘 চলতে চলতে যখন সে সূর্যের অস্তগমন স্থলে পৌঁছল, তখন সে সূর্যকে এক কর্দমাক্ত ঝরনায় অস্তগমন করতে দেখল[১] এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল; আমি বললাম,[২] ‘হে যুলকারনাইন! তুমি তাদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা তাদের ব্যাপারে সদুপায় অবলম্বন করতে পার।’ [৩] [১] عَين এর অর্থঃ ঝরনা বা সমুদ্র। حَمِئَة এর অর্থঃ কর্দম, কাদা বা দলদল। وَجَد অর্থঃ পেল, দেখল বা অনুভব করল। অর্থাৎ, যুলক্বারনাইন দেশের পর দেশ জয় করে যখন পশ্চিম প্রান্তে শেষ জনপদে পৌঁছলেন। সেখানে কাদাময় পানির ঝরনা বা সমুদ্র ছিল; যেটা নীচে থেকে কালো মনে হচ্ছিল। তাঁর মনে হল, যেন সূর্য ঐ পানিতে অস্ত যাচ্ছে। সমুদ্র-তীর থেকে বা দূর থেকে সেখানে পানি ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না, সেখানে যারা সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করবে তাদের মনে হবে যেন সূর্য সমুদ্রেই অস্ত যাচ্ছে অথচ সূর্য মহাকাশে স্বস্থানেই অবস্থান করে। [২] 'আমি বললাম---' অহীর মাধ্যমে। এর দ্বারা কিছু সংখ্যক উলামা তাঁর নবী হবার দলীল গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে যাঁরা তাঁকে নবী বলে স্বীকার করেন না, তাঁরা এর অর্থে বলেন, 'সেই সময়কার নবীর মাধ্যমে আমি তাকে বললাম।' [৩] অর্থাৎ, আমি তাকে ঐ জাতির উপর বিজয়ী করে পূর্ণ অধিকার দিলাম যে, ইচ্ছা হলে তুমি তাদেরকে হত্যা কর অথবা বন্দী কর অথবা মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে অনুগ্রহ করে মুক্ত করে দাও।

قَالَ أَمَّا مَنْ ظَلَمَ فَسَوْفَ نُعَذِّبُهُ ثُمَّ يُرَدُّ إِلَىٰ رَبِّهِ فَيُعَذِّبُهُ عَذَابًا نُكْرًا

📘 সে বলল, ‘যে কেউ সীমালংঘন করবে আমি তাকে শাস্তি দেব,[১] অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দেবেন। [১] অর্থাৎ, যারা কুফরী ও শিরকের উপর অটল থাকবে, আমি তাদেরকে শাস্তি দেব। অর্থাৎ, পূর্বেকার পাপগুলোর ব্যাপারে পাকড়াও করব না।

وَأَمَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُ جَزَاءً الْحُسْنَىٰ ۖ وَسَنَقُولُ لَهُ مِنْ أَمْرِنَا يُسْرًا

📘 তবে যে বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে, তার জন্য প্রতিদান স্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমি নম্র কথা বলব।’

ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا

📘 অতঃপর সে (আর) এক পথ অবলম্বন করল। [১] [১] অর্থাৎ, পশ্চিম হতে পূর্ব দিকে সফর শুরু করলেন।

أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا

📘 তুমি কি মনে কর যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর? [১] [১] অর্থাৎ, এই একটাই বৃহৎ ও বিস্ময়কর নিদর্শন নয়, বরং আমার প্রতিটি নিদর্শনই বিস্ময়কর। আসমান ও যমীনের এই সৃষ্টি, তার ব্যবস্থাপনা, সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রকে আয়ত্তাধীন করা এবং রাত ও দিনের পরিবর্তন ও অন্যান্য অসংখ্য নিদর্শন কি কম বিস্ময়কর? كَهْفٌ সেই গুহাকে বলা হয় যা পাহাড়ে থাকে। رَقِيم (রাকীম) কারো নিকট সেই গ্রামের নাম, যেখান থেকে এই যুবকরা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ বলেছেন, সেই পাহাড়ের নাম, যাতে ঐ গুহা ছিল। অনেকের মতে, رَقِيْمٌ মানে مَرْقُوْمٌ অর্থাৎ, লোহা অথবা সীসার তৈরী তক্তি যাতে গুহার অধিবাসীদের নাম অঙ্কিত ছিল। এটাকে رَقِيم (অঙ্কিত বা লিপিবদ্ধ)এ জন্য বলা হয় যে, এতে নাম লিপিবদ্ধ ছিল। বর্তমান তত্ত্ব-গবেষণা দ্বারা জানা যায় যে, প্রথম কথাটাই বেশী সঠিক। কারণ, যে পাহাড়ে এই গুহা রয়েছে, তার সন্নিকটেই রয়েছে একটি জনপদ, যেটাকে এখন الرقيب (আররাকীব) বলা হয়। বহুকাল অতিবাহিত হওয়ার কারণে الرقيم এর বিকৃত রূপ হয়েছে الرقيب (আররাক্বীব)।

حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ مَطْلِعَ الشَّمْسِ وَجَدَهَا تَطْلُعُ عَلَىٰ قَوْمٍ لَمْ نَجْعَلْ لَهُمْ مِنْ دُونِهَا سِتْرًا

📘 চলতে চলতে যখন সে সূর্যোদয় স্থলে পৌঁছল, তখন সে দেখল ওটা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদিত হচ্ছে, যাদের জন্য আমি সূর্য থেকে কোনরূপ অন্তরাল সৃষ্টি করিনি। [১] [১] অর্থাৎ, তিনি এমন জায়গায় পৌঁছলেন যেখানে পূর্ব প্রান্তের শেষ জনপদটি অবস্থিত; এটাকেই সূর্য উদয়ের স্থল বলা হয়েছে। সেখানে এমন এক জাতি প্রত্যক্ষ করলেন যারা ঘরে বাস না করে খোলা জায়গায় মরুভূমিতে বসবাস করছিল, শরীরে কোন পোশাকও ছিল না। এর অর্থ হল সূর্যের এবং তাদের মাঝে কোন বাধা ছিল না বরং সূর্য তাদের উলঙ্গ শরীরের উপর সরাসরি উদিত হত।

كَذَٰلِكَ وَقَدْ أَحَطْنَا بِمَا لَدَيْهِ خُبْرًا

📘 প্রকৃত ঘটনা এটাই, তার (আসল) বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি। [১] [১] অর্থাৎ যুলকারনাইন সম্পর্কে যা কিছু বর্ণনা করলাম তা এই যে, সে প্রথমে পশ্চিমে শেষ প্রান্তে ও পরে পূর্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছে। আমি তার যোগ্যতা, সামর্থ্য, উপকরণ ও মাধ্যম বা অন্য সকল কথা সম্পর্কে সম্যক অবহিত।

ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا

📘 আবার সে এক পথ অবলম্বন করল। [১] [১] অর্থাৎ, এবার তিনি অন্য দিকে যেতে প্রস্তুত হলেন।

حَتَّىٰ إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا

📘 চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত-প্রাচীরের[১] মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল, যারা তার কথা প্রায় বুঝতেই পারছিল না। [২] [১] এর অর্থ এমন দু'টি পাহাড়, যা এক অপরের পাশাপাশি যার মাঝে ছিল রাস্তা। সে রাস্তা দিয়ে য়্যা'জূজ-মা'জূজরা বসতি এলাকায় এসে হত্যা ও লুঠতরাজ চালাত। [২] অর্থাৎ নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্যের ভাষা তারা বুঝত না।

قَالُوا يَا ذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَىٰ أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا

📘 তারা বলল, ‘হে যুলকারনাইন![১] য়্যা’জূজ ও মা’জূজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; [২] আমরা কি আপনাকে কর দেব এই শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মাঝে এক প্রাচীর গড়ে দেবেন?’ [১] যুলকারনাইনের সাথে তাদের কথোপকথন কোন দোভাষী দ্বারা হয়েছিল। কিংবা আল্লাহ তাআলা তাঁকে যেসব বিশেষ উপকরণ ও মাধ্যম দান করেছিলেন, তার মধ্যে একটি বিভিন্ন ভাষা বুঝাও হতে পারে। সুতরাং তারা সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলেছিল। [২] য়্যা'জূজ ও মা'জূজ দুটি জাতি সহীহ হাদীস মোতাবেক এরা মনুষ্য জাতি। এদের সংখ্যা অন্যান্য জাতির তুলনায় অনেক বেশী হবে এবং তাদেরকে দিয়েই জাহান্নামের বেশী অংশ পূর্ণ করা হবে। (বুখারী, সূরা হাজ্জের তফসীর, মুসলিম ঈমান অধ্যায়)

قَالَ مَا مَكَّنِّي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا

📘 সে বলল, ‘আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই উৎকৃষ্ট; সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর, [১] আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে এক সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে দেব। [১] 'শ্রম দ্বারা সাহায্য কর' অর্থঃ তোমরা আমাকে নির্মাণ কাজে ব্যবহার্য সামগ্রী ও শ্রমিক দিয়ে সাহায্য কর।

آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ ۖ حَتَّىٰ إِذَا سَاوَىٰ بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انْفُخُوا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا

📘 তোমরা আমার নিকট লৌহপিন্ডসমূহ আনয়ন কর।’ অতঃপর মধ্যবর্তী শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তূপ দুই পর্বতের সমান হল,[১] তখন সে বলল, ‘তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো।’ পরিশেষে যখন ওটা অগ্নিবৎ উত্তপ্ত করল, তখন সে বলল, ‘তোমরা গলিত তামা আনয়ন কর, আমি ওটা ওর উপর ঢেলে দিই।’[২] [১] بين الصًّدَفَين অর্থাৎ, দুই পর্বত চূড়ার মধ্যবর্তী শূন্যস্থানকে লৌহস্তূপ বা পাত দিয়ে পূর্ণ করে বন্ধ করে দেওয়া হল। [২] قِطر গলিত সীসা বা লোহা বা তামা। অর্থাৎ লোহার পাতকে খুব গরম করে ওর উপর গলিত সীসা বা লোহা বা তামা ঢেলে দেওয়ায় সেই পাহাড়ী রাস্তার মাঝের প্রাচীর এত মজবুত হয়ে গেল যে, য়্যা'জূজ-মা'জূজের পক্ষে তা ভেঙ্গে অন্যান্য মানুষের বসতিতে আসা অসম্ভব হয়ে গেল।

فَمَا اسْطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا

📘 এরপর য়্যা’জূজ ও মা’জূজ তা অতিক্রম করতে পারল না এবং ছেদ করতেও পারল না।

قَالَ هَٰذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي ۖ فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ ۖ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا

📘 সে বলল, ‘এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ; অতঃপর যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি এসে পড়বে তখন তিনি ওটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন।[১] আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’ [১] এই প্রাচীর যদিও অত্যন্ত মজবুত করে বানানো হয়েছে; যার উপর চড়ে কিংবা যাতে ছিদ্র করে এদিকে আসা তাদের সম্ভবপর নয়, তবুও আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি যখন এসে যাবে, তখন তিনি সেটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটি বরাবর করে ফেলবেন। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি এসে পড়বে অর্থাৎ কিয়ামতের নিকটবর্তী য়্যা'জূজ-মা'জূজের বের হবার সময় এসে পড়বে; যেমন এ কথা হাদীসে উল্লেখ আছে। একটি হাদীসে এসেছে, নবী (সাঃ) ঐ প্রাচীরের সামান্য ছিদ্রকে ফিতনার নিকটবর্তী সময় বলে উল্লেখ করেছেন। (বুখারী ৩৩৪৬, মুসলিম ২২০৮নং) অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, তারা প্রতিদিন সেই প্রাচীর ভাঙ্গার চেষ্টা করে আর বাকী অংশ কাল ভাঙ্গব বলে ফেলে রাখে। অতঃপর যখন আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের বের হবার সময় হবে তখন তারা বলবে, ইন শাআল্লাহ বাকী অংশ আগামী কাল ভেঙ্গে ফেলব। সুতরাং তার পরের দিন তারা বের হতে সক্ষম হবে এবং পৃথিবীতে ধ্বংসলীলা চালাবে এমনকি ভয়ে মানুষ দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেবে। এরপর তারা আকাশে তীর ছুঁড়তে শুরু করবে যা রক্ত মাখা অবস্থায় তাদের কাছে ফিরে আসবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তাদের ঘাড়ে এক প্রকার কীট (পোকা) সৃষ্টি করবেন, যার ফলে তারা সকলেই প্রাণ হারাবে। (আহমাদ ১২/৫১১, তিরমিযী ৩১৫৩নং) সহীহ মুসলিমে নাওয়াস বিন সামআন (রাঃ)-এর হাদীসে আরও পরিষ্কারভাবে এসেছে যে, তারা বের হবে ঈসা (আঃ) অবর্তীণ হবার পর তাঁর বর্তমানে। (ফিতনাহ অধ্যায়) আর এই উক্তি দ্বারা ঐ সমস্ত লোকেদের ধারণার খন্ডন হয় যারা মনে করে যে, মুসলিমদের উপর আক্রমণকারী তাতার অথবা তুর্কী ও মুঘল সম্প্রদায়; যাদের মধ্যে চেঙ্গিস খান একজন, অথবা রুশ বা চীনা জাতিই হল য়্যা'জূজ-মা'জূজ; যাদের প্রকাশ ঘটে গেছে। অনেকের মতে য়্যা'জূজ-মা'জূজ হল পাশ্চাত্য জাতি, যারা আজ সারা পৃথিবীর উপর আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের জাল বিস্তার করে রেখেছে। এ সমস্ত ধারণা ভুল। কারণ য়্যা'জূজ-মা'জূজের আধিপত্য বলতে রাজনৈতিক আধিপত্য উদ্দেশ্য নয়; বরং তাদের হত্যা ও লুঠতরাজের এ জাতীয় সাময়িক আধিপত্য উদ্দেশ্য, মুসলিমরা যার মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। অতঃপর আল্লাহ-প্রেরিত মহামারী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সকলেই একই সময়ে মারা যাবে।

۞ وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ ۖ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا

📘 সেই দিন আমি তাদেরকে এক দল অপর দলের উপর তরঙ্গায়িত অবস্থায় ছেড়ে দেব। আর শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে; অতঃপর আমি তাদের সবাইকেই একত্রিত করব।