slot qris slot gacor terbaru slot gacor terbaik slot dana link slot gacor slot deposit qris slot pulsa slot gacor situs slot gacor slot deposit qris slot qris bokep indo
| uswah-academy
WhatsApp Book A Free Trial
القائمة

🕋 تفسير سورة طه

(Taha) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ طه

📘 ত্ব-হা-।

إِذْ رَأَىٰ نَارًا فَقَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آنَسْتُ نَارًا لَعَلِّي آتِيكُمْ مِنْهَا بِقَبَسٍ أَوْ أَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدًى

📘 সে যখন আগুন দেখল, তখন তার পরিবারবর্গকে বলল, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর। আমি আগুন দেখেছি; সম্ভবতঃ আমি তোমাদের জন্য তা হতে কিছু জ্বলন্ত অঙ্গার আনতে পারব অথবা ওর নিকট কোন পথ প্রদর্শক পাব।’ [১] [১] এ ঘটনা ঐ সময়কার যখন হযরত মূসা (আঃ) মাদয়্যান হতে আপন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে (একটি মতানুসারে যিনি শুআইব (আঃ)-এর কন্যা ছিলেন) নিজের মাতার নিকট ফিরে যাচ্ছিলেন। রাত্রি ছিল অন্ধকার এবং রাস্তাও ছিল অজানা। কোন কোন ব্যাখ্যাতার কথানুসারে স্ত্রীর প্রসবের সময় ছিল আসন্ন এবং তাঁর জন্য আগুনের প্রয়োজন ছিল। কিংবা শীতের কারণে তাপ তথা আগুনের প্রয়োজন বোধ হয়। এমতাবস্থায় দূর হতে তাঁরা আগুনের শিখা দেখতে পান। পরিবারকে অর্থাৎ স্ত্রীকে, (কেউ কেউ বলেন, সঙ্গে চাকর ও শিশুও সঙ্গে ছিল, যার কারণে বহুবচন শব্দ ব্যবহূত হয়েছে।) বললেন, 'তোমরা এখানে অপেক্ষা কর। আমি আশা করি সেখান হতে আগুন সংগ্রহ করব অথবা কমসে কম সেখান হতে পথের সন্ধান পাব।'

مَنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا

📘 যে কেউ এ হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে,[১] ফলতঃ সে কিয়ামতের দিন (মহাপাপের) বোঝা বহন করবে। [২] [১] অর্থাৎ এর প্রতি ঈমান আনবে না এবং এতে যা কিছু লিপিবদ্ধ রয়েছে তার উপর আমলও করবে না। [২] অর্থাৎ মহাপাপের বোঝা বহন করবে, কারণ তার আমলনামা পুণ্য থেকে খালি ও পাপে পরিপূর্ণ থাকবে।

خَالِدِينَ فِيهِ ۖ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا

📘 ঐ (পাপের শাস্তি)তে ওরা স্থায়ী হবে[১] এবং কিয়ামতের দিন এই বোঝা ওদের জন্য কত মন্দ হবে। [১] না ওরা তা হতে বাঁচতে পারবে আর না পালাতে।

يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ ۚ وَنَحْشُرُ الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا

📘 যেদিন শিঙ্গায়[১] ফুৎকার দেওয়া হবে সেদিন আমি অপরাধীদের (চক্ষু) নীল হয়ে যাওয়া অবস্থায় সমবেত করব। [১] صُور অর্থাৎ, শিংগা; যাতে ইস্রাফীল (আঃ) আল্লাহর আদেশে ফুঁ দেবেন এবং তখন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। (মুসনাদে আহমাদ ২/১৯১) অন্য একটি হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন যে, "ইস্রাফীল (আঃ) শিংগা মুখে ভরে দাঁড়িয়ে আছেন, মাথা নত করে প্রভুর আদেশের অপেক্ষায় আছেন যে, কখন তাঁকে আদেশ করা হবে এবং তিনি ফুঁ মারবেন।" (তিরমিযী, কিয়ামতের বিবরণ) ইস্রাফীল (আঃ)-এর প্রথম ফুঁতে সকলেই মারা যাবে। আর দ্বিতীয় ফুঁতে আল্লাহর আদেশে সকলেই জীবিত হবে এবং হাশরের মাঠে জমায়েত হবে। আলোচ্য আয়াতে দ্বিতীয় ফুঁকের কথাই বলা হয়েছে।

يَتَخَافَتُونَ بَيْنَهُمْ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا عَشْرًا

📘 ওরা নিজেদের মধ্যে চুপি চুপি বলাবলি করবে,[১] ‘তোমরা পৃথিবীতে মাত্র দশদিন অবস্থান করেছিলে।’ [১] ভীষণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার কারণে একে অপরের সঙ্গে চুপি চুপি কথা বলবে।

نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ إِذْ يَقُولُ أَمْثَلُهُمْ طَرِيقَةً إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا يَوْمًا

📘 ওরা কি বলবে তা আমি ভাল জানি। ওদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী উত্তম পথের অনুসারী[১] বলবে, ‘তোমরা মাত্র একদিন অবস্থান করেছিলে।’ [১] অর্থাৎ সবার থেকে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী। অর্থাৎ, দুনিয়ার জীবন তাদের কাছে কয়েক দিন বরং কয়েক ঘন্টা বলে মনে হবে। যেমন অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেছেন,{وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُونَ مَا لَبِثُوا غَيْرَ سَاعَةٍ} যে দিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা শপথ করে বলবে যে, তারা দুনিয়াতে মুহূর্তকালের বেশী অবস্থান করেনি। (সূরা রূম ৩০:৫৫) এই বিষয়টি আরো বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে; যেমন সূরা ফাতির ৩৫:৩৭, সূরা মু'মিনূন ২৩:১১২-১১৪, সূরা নাযিআত ৭৯:৪৬ ইত্যাদি। উদ্দেশ্য হল, অস্থায়ী জীবনকে যেন স্থায়ী জীবনের উপর প্রাধান্য না দেওয়া হয়।

وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا

📘 ওরা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, ‘আমার প্রতিপালক সে সবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দেবেন।

فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا

📘 অতঃপর তিনি ভূমিকে মসৃণ সমতল ভূমিতে পরিণত করবেন।

لَا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا

📘 যাতে তুমি উঁচু-নীচু দেখবে না।’

يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُ ۖ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَٰنِ فَلَا تَسْمَعُ إِلَّا هَمْسًا

📘 সেই দিন ওরা আহবানকারীর অনুসরণ করবে,[১] এই ব্যাপারে (তাদের) কোন বক্রতা থাকবে না।[২] আর পরম দয়াময়ের নিকট সকল শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং মৃদু পদধ্বনি ব্যতীত তুমি কিছুই শুনবে না। [৩] [১] যে দিন উঁচু-নিচু, পর্বত-উপত্যকা, আকাশ-ছোঁয়া অট্টালিকা, সব বরাবর ও সমতল হয়ে যাবে। সমুদ্র ও নদ-নদী শুকিয়ে যাবে, সমস্ত পৃথিবী সমতলভূমিতে পরিণত হবে। তারপর একজন আহবানকারীর শব্দ আসবে, যার পিছু পিছু সমস্ত লোক চলতে শুরু করবে। [২] অর্থাৎ, সেই আহবানকারী থেকে এদিক-ওদিক হবে না। [৩] সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করবে, মৃদু পদধ্বনি আর কানাকানি ছাড়া কিছুই শোনা যাবে না।

يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا

📘 পরম দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন, সে ব্যতীত কারো সুপারিশ সে দিন কোন কাজে আসবে না।[১] [১] আল্লাহ যাঁদেরকে সুপারিশের অনুমতি দেবেন, তাঁদের ছাড়া সেদিন কারো সুপারিশ কারো জন্য কোন কাজে লাগবে না। আর যারা অনুমতিপ্রাপ্ত হবেন তাঁরাও যে কোন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করতে পারবেন না। বরং সুপারিশ তাদেরই জন্য করা হবে যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকবেন। এরা কারা হবে? এরা হবে শুধুমাত্র তাওহীদপন্থী; যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন। এ বিষয়টি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে। যেমন সূরা নাজম ৫৩:২৬, সূরা আম্বিয়া ২১:২৮, সূরা সাবা ৩৪:২৩, সূরা নাবা ৭৮:৩৮ এবং আয়াতুল কুরসীতে ২:২৫৫।

فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَىٰ

📘 অতঃপর যখন সে আগুনের নিকট আসল, তখন আহবান করে বলা হল,[১] ‘হে মূসা! [১] মূসা (আঃ) যখন আগুনের নিকট পৌঁছলেন, তখন সেখানে একটি গাছ হতে আওয়াজ এল। (যেমন,সূরা কাসাস ২৮:৩০নং আয়াতে বিস্তারিত আছে।)

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا

📘 তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। কিন্তু ওরা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে আয়ত্ত করতে পারে না। [১] [১] পূর্বের আয়াতে সুপারিশ সম্পর্কে যে নিয়ম-নীতির কথা উল্লেখ হয়েছে এখানে তার কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে। আর তা হল আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো এ ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান নেই যে, কে কত বড় অপরাধী এবং সে সুপারিশ পাবার অধিকারী কিনা? সেই জন্য একমাত্র আল্লাহই এ ব্যাপারে ফায়সালা করবেন যে, কোন্ কোন্ ব্যক্তি নবী ও সৎলোকদের সুপারিশের অধিকারী? কারণ প্রত্যেক মানুষের অপরাধের প্রকারভেদ ও কেমনত্ব আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানে না, জানতে পারেও না।

۞ وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّومِ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا

📘 সকল মুখমন্ডলই সেই চিরঞ্জীব, সব কিছুর ধারক (আল্লাহর) জন্য অবনমিত হবে এবং সেই ব্যর্থ হবে, যে যুলুমের ভার বহন করবে।[১] [১] কারণ, সেদিন মহান আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে ইনসাফ করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রাপ্য অধিকার প্রাপ্ত হবে। এমনকি যদি কোন শিংবিশিষ্ট ছাগল কোন বিনা শিং-এর ছাগলের উপর অত্যাচার করে থাকে, তাহলে তারও বদলা দেওয়া হবে। (আহমাদ ২/২৩৫, মুসলিম) সেই জন্য ঐ হাদীসেই মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "প্রত্যেক হকদারকে তার হক আদায় করে দাও।" নচেৎ কিয়ামতের দিন তা দিতে বাধ্য হবে। এক অন্য হাদীসে তিনি বলেন, "তোমরা অত্যাচার করা হতে দূরে থাকো, কেননা অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণ হবে।" আর সবার থেকে বেশী ব্যর্থ হবে সেই ব্যক্তি, যে শিরকের বোঝা নিয়ে উপস্থিত হবে। কারণ শিরক হল বড় যুলম (মহা অন্যায়), যা ক্ষমার অযোগ্য।

وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَا يَخَافُ ظُلْمًا وَلَا هَضْمًا

📘 আর যে বিশ্বাসী হয়ে সৎকাজ করে তার কোন অবিচার ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চনার আশঙ্কা নেই। [১] [১] বে-ইনসাফি (অন্যায় বা অবিচার) এই যে, অন্যের পাপের বোঝা কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। আর অধিকার হনন বা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এই যে, নেকীর বদলা কম করে দেওয়া হবে। কিয়ামতে এ উভয় জিনিসই হবে না।

وَكَذَٰلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا

📘 এইরূপেই আমি কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি এবং ওতে সতর্কবাণী নানাভাবেই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা সংযত হয়[১] অথবা এটা তাদের জন্য উপদেশ হয়। [২] [১] অর্থাৎ, পাপাচার, হারাম ও কুকর্ম করা হতে বিরত হয়। [২] অর্থাৎ, আনুগত্য, নৈকট্য লাভ করার আকাঙ্ক্ষা অথবা পূর্ববর্তী উম্মতের অবস্থা ও ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার মত চিন্তা-ভাবনা ওদের ভিতর সৃষ্টি করে।

فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ ۗ وَلَا تَعْجَلْ بِالْقُرْآنِ مِنْ قَبْلِ أَنْ يُقْضَىٰ إِلَيْكَ وَحْيُهُ ۖ وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا

📘 আল্লাহ অতি মহান, সত্য অধীশ্বর।[১] তোমার প্রতি আল্লাহর অহী (প্রত্যাদেশ) সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তুমি কুরআন পাঠে তাড়াতাড়ি করো না। [২] আর বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।’[৩] [১] যাঁর সুখের প্রতিশ্রুতি ও শাস্তির ধমক সত্য, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য এবং তাঁর প্রতিটি কথা সত্য।[২] জিবরীল (আঃ) যখন অহী নিয়ে আসতেন ও শুনাতেন, তখন নবী (আঃ)ও তার কিছু ভুলে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি পড়তেন। আল্লাহ তাঁকে এ রকম করতে নিষেধ করে বললেন, প্রথমে অহী মনোযোগ দিয়ে শোনো, তা মুখস্থ করানো ও অন্তরে স্থান করে দেওয়া আমার কাজ; যেমন এ কথা সূরা কিয়ামাহ ৭৫:১৬-১৯ নং আয়াতে আসবে।[৩] অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে অধিক জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করতে থাকো। এ নির্দেশে উলামাদের জন্য উপদেশ রয়েছে যে, তাঁরা যেন ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ গবেষণা-বিবেচনা ও চিন্তা-ভাবনা করবেন। তাড়াহুড়ো থেকে দূরে থাকবেন এবং জ্ঞান বৃদ্ধি করার পথ অবলম্বন করতে কোন প্রকার আলস্য ও ক্রটি করবেন না। এখানে জ্ঞান বলতে কুরআন-হাদীসের জ্ঞান। কুরআনে এটিকেই 'ইলম' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর এর জ্ঞানীদেরকে উলামা বলা হয়েছে। অন্যান্য জ্ঞান যা মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য অর্জন করে থাকে তা হল, শিল্প, পেশা ও কারিগরী। নবী (সাঃ) যে জ্ঞানের জন্য প্রার্থনা করতেন, তা একমাত্র অহী ও রিসালাতের জ্ঞান; যা কুরআন ও হাদীসে বিদ্যমান। যার দ্বারা মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, চরিত্র ও ব্যবহারে সংস্কার সাধন হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কথা বুঝতে পারা যায়। এই শ্রেণীর দু'আর মধ্যে একটি দু'আ যা তিনি বলতেন তা এই, اَللّهُمَّ انْفَعْنِيْ بِمَا عَلَّمْتَنِيْ وَعَلِّمْنِيْ مَا يَنْفَعُنِيْ وَزِدْنِيْ عِلْمًا। অর্থাৎ, হে আল্লাহ! যা কিছু আমাকে শিখিয়েছ তার দ্বারা আমাকে উপকৃত কর এবং আমাকে সেই জ্ঞান দান কর, যা আমাকে উপকৃত করবে। আর আমার ইলম আরো বৃদ্ধি কর। (সঃ ইবনে মাজাহ ১/৪৭)

وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَىٰ آدَمَ مِنْ قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا

📘 আমি তো ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দান করেছিলাম। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল; আমি তাকে দৃঢ়সংকল্প পাইনি। [১] [১] ভুলে যাওয়াটা প্রতিটি মানুষের প্রকৃতিগত ব্যাপার। আর ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা ও সংকল্পের অদৃঢ়তাও সাধারণতঃ মানুষের প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। এই দুই দুর্বলতাই শয়তানের কুমন্ত্রণার ফাঁদে পড়ার কারণ হয়ে বসে। উক্ত দুর্বলতার মধ্যে যদি আল্লাহর আদেশের অবাধ্যাচরণ ও অন্যথাচরণের সংকল্প শামিল না থাকে, তাহলে ভুলে যাওয়া বা ইচ্ছার দুর্বলতার ফলে ঘটে যাওয়া ত্রুটি নবুঅতের নিষ্কলুষতা ও পূর্ণতার প্রতিকূল নয়। কারণ, ত্রুটির পর তড়িঘড়ি লজ্জিত হয়ে নবী আল্লাহর দরবারে মাথা নত করেন তথা তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনায় মশগুল হয়ে পড়েন। (যেমন আদম (আঃ) করেছিলেন।) আদম (আঃ)-কে আল্লাহ বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, শয়তান তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সে যেন তোমাদেরকে পাকে-প্রকারে জান্নাত হতে বের না করে দেয়। এই নির্দেশকেই মহান আল্লাহ এখানে عَهد বলে উল্লেখ করেছেন। আদম (আঃ) সে নির্দেশ ভুলে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-কে এক বৃক্ষের নিকট যেতে তথা সেই বৃক্ষ হতে কিছু খেতে নিষেধ করেছিলেন। আদম (আঃ)-এর অন্তরেও এ কথা ছিল যে, তিনি ঐ বৃক্ষের নিকট যাবেন না। কিন্তু যখন শয়তান আল্লাহর কসম খেয়ে এটা বুঝাতে চাইল যে, এই গাছে বা ফলে এমন প্রভাব আছে, যদি তা কেউ একবার খেয়ে নেয়, তাহলে সে অনন্তকালীন জীবন ও চিরস্থায়ী রাজত্ব লাভ করবে। তখন তিনি নিজ সংকল্পের উপর অটল থাকতে পারলেন না। আর সংকল্পে স্থির না থাকার ফলে শয়তানের চক্রান্তের শিকার হয়ে পড়লেন।

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ

📘 (স্মরণ কর,) যখন আমি ফিরিশতাগণকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদাহ কর’, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদাহ করল; সে অমান্য করল।

فَقُلْنَا يَا آدَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰ

📘 অতঃপর আমি বললাম, ‘হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা কষ্ট পাবে। [১] [১] এখানে شقى মেহনত পরিশ্রম ও কষ্টের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ জান্নাতে খাওয়া, পান করা, পরা ও থাকার যে সুযোগ-সুবিধা বিনা পরিশ্রমে ভোগ করছ, জান্নাত হতে বের হলে এই চারটি জিনিসের জন্য মেহনত ও পরিশ্রম করতে বাধ্য হবে। যেমন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে এই মূল জিনিসের প্রাপ্তির জন্য পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, মেহনত ও পরিশ্রমের কথা বলতে শুধু আদমকে সম্বোধন করা হয়েছে; স্বামী-স্ত্রী উভয়কে সম্বোধন করা হয়নি। অথচ নিষিদ্ধ ফল আদম ও হাওয়া উভয়েই ভক্ষণ করেছিলেন। এর কারণ প্রথমতঃ এই যে, মূল সম্বোধনযোগ্য আদমই ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ (পরিশ্রম ও কষ্ট করে) মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার দায়িত্ব কেবল পুরুষের; নারীর নয়। আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে এই মেহনত ও পরিশ্রম থেকে বাঁচিয়ে 'ঘরের রানী'র মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বর্তমানে সেই আল্লাহ প্রদত্ত এই সম্মানকে দাসত্বের বেড়ি মনে করা হচ্ছে। যার থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারা ব্যাকুল হয়ে আন্দোলনে নেমেছে। হায়! শয়তানের প্ররোচনা কতই না প্রভাবশালী এবং তার বিছানো জাল কতই না সুন্দর ও মনোলোভা!

إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ

📘 তোমার জন্য এটাই থাকল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না।

وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ

📘 সেখানে পিপাসার্ত হবে না এবং রোদ্র-ক্লিষ্ট ও হবে না।’

إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ ۖ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى

📘 নিশ্চয় আমিই তোমার প্রতিপালক, অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল,[১] কারণ তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় রয়েছ।’ [২] [১] জুতা খোলার আদেশ এই কারণেই দেওয়া হয়েছিল যে, এতে আছে বিনয়ের প্রকাশ ও অধিক সম্মান প্রদর্শন। কেউ কেউ বলেন, জুতাগুলি এমন গাধার চামড়া দিয়ে তৈরী ছিল, যা পাকা করা হয়নি। আর পশুর চামড়া বিশেষ পদ্ধতিতে পাকা করার পরই পবিত্র হয়। কিন্তু এ মত সুচিন্তিত নয়। কারণ, চামড়া পাকা করা ব্যতীত জুতা বানানো যায় কিভাবে? অথবা উপত্যকার পবিত্রতার কারণে জুতা খুলতে বলা হয়েছিল; যেমন কুরআনের শব্দে তা প্রকাশ। এ ছাড়াও এর দুটি দিক রয়েছে; আর তা হল, এ আদেশ উপত্যকার সম্মানার্থে ছিল অথবা যাতে উপত্যকার পবিত্রতার প্রভাব খালি পায়ে মূসা (আঃ)-এর অভ্যন্তরে বেশী শোষণ করতে পারে, তার জন্য ছিল। আর আল্লাহই ভালো জানেন। [২] طُوى (তুওয়া) ঐ উপত্যকার নাম।

فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَىٰ

📘 অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, ‘হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষ ও অক্ষয় রাজ্যের কথা?’

فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ ۚ وَعَصَىٰ آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَىٰ

📘 অতঃপর তারা তা হতে ভক্ষণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা বাগানের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হল; ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। [১] [১] অর্থাৎ, বৃক্ষ বা তার ফল খেয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করল; যার পরিণতিতে সে ভ্রষ্টতায় পতিত হল।

ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَىٰ

📘 এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন। সুতরাং তিনি তার তওবা কবুল করলেন ও তাকে পথ নির্দেশ করলেন। [১] [১] এখান থেকে কিছু লোক প্রমাণ করেন যে, আদমের উক্ত অবাধ্যাচরণ নবুঅতের আগের ঘটনা। পরবর্তীতে তাঁকে নবুঅত দান করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বিগত আলোচনায় অবাধ্যতার যে স্বরূপ ও বাস্তবিকতা বর্ণনা করেছি, তা নবুঅতের নিষ্কলুষতার প্রতিকূল নয়। কারণ এই প্রকার ভুল-ত্রুটি যার সম্বন্ধ আল্লাহর বার্তা পৌঁছানো ও শরীয়ত প্রচারের সাথে নয়; বরং তা ব্যক্তিগত কর্মের সাথে সম্পৃক্ত, তাও আবার তার কারণ ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা, তাহলে বাস্তবে তা অবাধ্যাচরণ বা পাপ নয়; যার কারণে মানুষ আল্লাহর শাস্তিযোগ্য গণ্য হয়। পরন্তু আদম (আঃ)-এর জন্য যে 'অবাধ্য' শব্দ ব্যবহার হয়েছে তা (আল্লাহর কাছে) তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও উন্নত স্থান থাকার কারণে। যেহেতু বড়দের সামান্য ভুলও বড় বলে ধরা হয়। এই কারণে আলোচ্য আয়াতে (তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন) এর অর্থ এই নয় যে, উক্ত ভুলের পর তাঁকে নবুঅতের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। বরং এর অর্থ হল, লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার পর আবার তাঁকে সেই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হল; যা তিনি আগেই লাভ করেছিলেন। তাঁকে পৃথিবীতে অবতরণের ফায়সালা আল্লাহর ইচ্ছা, হিকমত ও কল্যাণময় রহস্যের ভিত্তিতেই ছিল। এখানে এটা মনে করা উচিত নয় যে, এ ফায়সালা আদমের প্রতি আল্লাহর ক্রোধের ফলস্বরূপ হয়েছিল।

قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ

📘 তিনি বললেন, ‘তোমরা একে অপরের শত্রুরূপে একই সঙ্গে জান্নাত হতে নেমে যাও। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ এলে, যে আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুঃখ-কষ্টও পাবে না।

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ

📘 যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, অবশ্যই তার হবে সংকীর্ণতাময় জীবন[১] এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।’ [২] [১] এই 'সংকীর্ণতাময় জীবন' বলতে কেউ কেউ কবরের আযাব মনে করেন। আবার কেউ মনে করেন, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ও ব্যাকুলতাময় জীবন যা আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন বড় বড় ধনবান ব্যক্তিরা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। [২] এর অর্থ সত্যিকার চোখের অন্ধ অবস্থায়। অথবা জ্ঞান হতে বঞ্চিত অবস্থায়। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন এমন কোন প্রমাণ তার মাথায় আসবে না, যা পেশ করে সে আযাব হতে নিজেকে বাঁচাতে পারে।

قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا

📘 সে বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? অথচ আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম!’

قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا ۖ وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَىٰ

📘 তিনি বলবেন, ‘তুমি এইরূপ ছিলে, আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। সেইভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।

وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي مَنْ أَسْرَفَ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِآيَاتِ رَبِّهِ ۚ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبْقَىٰ

📘 আর এইভাবেই আমি তাকে প্রতিফল দেব, যে সীমালংঘন করেছে ও তার প্রতিপালকের নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। আর পরকালের শাস্তি অবশ্যই কঠোরতর ও চিরস্থায়ী।’

أَفَلَمْ يَهْدِ لَهُمْ كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِنَ الْقُرُونِ يَمْشُونَ فِي مَسَاكِنِهِمْ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِأُولِي النُّهَىٰ

📘 তবে কি এ কথা তাদেরকে পথনির্দেশ করে না যে, আমি তাদের পূর্বে এরূপ কত জনপদকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের বাসস্থান দিয়ে তারা অতিক্রম করে থাকে। অবশ্যই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন আছে।

وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ لَكَانَ لِزَامًا وَأَجَلٌ مُسَمًّى

📘 তোমার প্রতিপালকের পূর্ব-ঘোষণা না থাকলে এবং একটি কাল নির্ধারিত না হলে (শাস্তি) অবশ্যম্ভাবী হত। [১] [১] মক্কার মুশরিক ও মিথ্যাজ্ঞানকারীরা কি এটা চিন্তা করে না যে, তাদের আগে অনেক জাতি গুজরে গেছে যাদের এরা স্থলাভিষিক্ত এবং এরা তাদের বসতির উপর দিয়ে যাতায়াত করে, যাদেরকে আমি মিথ্যাজ্ঞান করার জন্যই ধ্বংস করেছি। যাদের ভয়ানক পরিণামে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে অনেক নির্দশন। কিন্তু এ মক্কাবাসীরা নিজেদের চক্ষু বন্ধ করে তাদেরই অনুকরণ করে যাচ্ছে। যদি আল্লাহ পূর্বেই এরূপ সিদ্ধান্ত না নিতেন যে, তিনি কোন প্রমাণ পূর্ণ হওয়া ছাড়া এবং ঐ সময় আসার আগে যা তিনি অবকাশ হিসাবে কোন জাতিকে (ঢিল) দিয়ে রেখেছেন কাউকে ও ধ্বংস করবেন না, তাহলে হঠাৎ আল্লাহর আযাব তাদের উপর এসে পড়ত এবং তারা ধ্বংস হয়ে যেত। অর্থ এই যে, নবীকে মিথ্যাজ্ঞান করা সত্ত্বেও তাদের উপর কোন আযাব না এলে তারা যেন এটা না মনে করে যে, আগামীতেও তা আসবে না। বরং আল্লাহ তাদেরকে এখন ঢিল দিয়ে রেখেছেন; যেমন তিনি প্রত্যেক জাতিকে দিয়ে থাকেন। ঢিল ও অবকাশের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর আযাব হতে তাদেরকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوحَىٰ

📘 আমি তোমাকে মনোনীত করেছি;[১] অতএব যে অহী (প্রত্যাদেশ) প্রেরণ করা হচ্ছে তুমি তা মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর। [১] অর্থাৎ, নবুঅত, রিসালত ও কথোপকথনের জন্য।

فَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا ۖ وَمِنْ آنَاءِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضَىٰ

📘 সুতরাং ওরা যা বলে সে বিষয়ে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সূর্যের উদয় ও অস্তের পূর্বে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর এবং রাত্রিকালে ও দিনের প্রান্তভাগসমূহে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর; [১] যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার।[২] [১] কোন কোন মুফাসসিরগণের মতে তসবীহ (প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা) বলতে নামায এবং এ আয়াত হতে পাঁচ অক্তের নামাযকে বুঝানো হয়েছে। সূর্য উঠার আগে ফজরের নামায, সূর্য ডোবার আগে আসরের নামায, 'রাত্রিকালে' বলতে মাগরিব ও এশার নামায এবং 'দিনের প্রান্তভাগসমূহ' বলতে যোহরের নামাযকে বুঝানো হয়েছে। কেননা যোহরের সময় দিনের প্রথম ভাগের শেষ প্রান্ত এবং দিনের শেষ ভাগের প্রথম প্রান্ত। আর কিছু উলামার মতে, এই সময় গুলোতে সাধারণভাবে আল্লাহর মহিমা তথা প্রশংসা বর্ণনার কথা বলা হয়েছে; যার মধ্যে নামায, কুরআন পাঠ, যিকর, দু'আ ও নফল ইবাদত সবই শামিল। অর্থ এই যে, তুমি মক্কার মুশরিকদের মিথ্যা ভাবার কারণে অধৈর্য ও মনঃক্ষুণ্ণ হবে না; বরং আল্লাহর মহিমা ও প্রশংসা বর্ণনা করতে থাকো। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করবেন তাদেরকে পাকড়াও করবেন।[২] এর সম্পর্ক 'পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর'-এর সাথে। অর্থাৎ উক্ত সময়গুলোতে আল্লাহর মহিমা বর্ণনা কর এই আশায় যে আল্লাহর নিকট এমন মর্যাদা ও সুউচ্চ স্থান প্রাপ্ত হবে, যাতে তুমি সন্তুষ্ট ও খোশ হয়ে যাবে।

وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ ۚ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ

📘 আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণীকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য-স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, তার প্রতি তুমি কখনোও তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না।[১] তোমার প্রতিপালকের জীবিকাই উৎকৃষ্টতর ও স্থায়ী। [২] [১] এটি সেই একই বিষয়ীভূত কথা, যা এর আগে সূরা আলে ইমরান ৩:১৯৬-১৯৭ আয়াতে, সূরা হিজর ১৫:৮৮ আয়াতে, সূরা কাহ্ফ ১৮:৭ আয়াতে আলোচিত হয়েছে।[২] এর অর্থ আখেরাতের প্রতিদান ও পুরস্কার যা দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও অন্যান্য উপভোগ্য জিনিস অপেক্ষা উত্তম ও স্থায়ী। 'ঈলা'র হাদীসে বর্ণিত আছে যে, উমার (রাঃ) নবী (সাঃ)-এর নিকট এসে দেখলেন, তিনি বিনা বিছানায় একটি চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছেন। আর তাঁর ঘরের আসবাব-পত্রের অবস্থা এই যে, শুধু দুটি চামড়ার জিনিস ছাড়া আর কিছুই নেই। উমার (রাঃ)-এর চক্ষু দিয়ে পানি এসে পড়ল। নবী (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, "উমার কি ব্যাপার? কাঁদছ কেন?" উত্তর দিলেন, 'হে আল্লাহর রসূল! রোম ও পারস্যের রাজারা কি সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করছে, আর আপনি সৃষ্টির সেরা হওয়া সত্ত্বেও আপনার জীবনের এই অবস্থা!' তিনি বললেন, "উমার! তুমি কি এখনও সন্দেহে আছ? ওরা তো তারা, যাদের সুখ-শান্তি পৃথিবীতেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।" অর্থাৎ, পরকালে ওদের জন্য কিছুই থাকবে না। (বুখারীঃ সূরা তাহরীমের তাফসীর, মুসলিমঃ ঈলা)

وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا ۖ لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا ۖ نَحْنُ نَرْزُقُكَ ۗ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَىٰ

📘 তুমি তোমার পরিবারবর্গকে নামাযের আদেশ দাও এবং ওতে অবিচলিত থাক।[১] আমি তোমার নিকট কোন জীবনোপকরণ চাই না। আমিই তোমাকে জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। আর সংযমীদের জন্য শুভ পরিণাম। [১] এই আদেশ নবী (সাঃ)-এর সাথে তাঁর সমস্ত উম্মতের জন্য। অর্থাৎ, মুসলিমদের জন্য জরুরী যে, তাঁরা নিজেদের নামাযের প্রতি যত্নবান হবে এবং পরিবারের লোকেদেরকেও নামাযের জন্য তাকীদ করবে।

وَقَالُوا لَوْلَا يَأْتِينَا بِآيَةٍ مِنْ رَبِّهِ ۚ أَوَلَمْ تَأْتِهِمْ بَيِّنَةُ مَا فِي الصُّحُفِ الْأُولَىٰ

📘 ওরা বলে, ‘সে তার প্রতিপালকের নিকট হতে আমাদের নিকট কোন নিদর্শন আনে না কেন?’[১] তাদের নিকট কি পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত হয়নি? [২] [১] অর্থাৎ, তাদের ইচ্ছামত কোন নিদর্শন; যেমন সামূদ জাতির জন্য উটনী আনা হয়েছিল। [২] 'পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহ' বলতে তাওরাত, ইঞ্জীল, যাবূর ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ঐগুলোতে কি নবী (সাঃ)-এর গুণাবলীর কথা উল্লেখ নেই, যার দ্বারা তাঁর নবী হওয়ার সত্যতা প্রমাণিত হয়? অথবা অর্থ এই যে, এদের কি পূর্ববর্তী জাতিদের অবস্থা জানা নেই যে, তারা যখন তাদের ইচ্ছামত মু'জিযা প্রদর্শনের দাবি করল এবং তাদেরকে তা দেখানো হল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ঈমান আনল না বলে তাদেরকে ধ্বংস করা হল?

وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُمْ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آيَاتِكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَذِلَّ وَنَخْزَىٰ

📘 যদি আমি ওদেরকে তার[১] পূর্বে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম তাহলে ওরা বলত, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের নিকট একজন রসূল প্রেরণ করলে না কেন? করলে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হওয়ার পূর্বেই তোমার নিদর্শন মেনে নিতাম।’ [১] এখানে 'তার' বলতে শেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে।

قُلْ كُلٌّ مُتَرَبِّصٌ فَتَرَبَّصُوا ۖ فَسَتَعْلَمُونَ مَنْ أَصْحَابُ الصِّرَاطِ السَّوِيِّ وَمَنِ اهْتَدَىٰ

📘 বল, ‘প্রত্যেকেই প্রতীক্ষা করছে[১] সুতরাং তোমরাও প্রতীক্ষা কর। অতঃপর তোমরা জানতে পারবে কারা আছে সরল পথে এবং কারা সৎপথ অবলম্বন করেছে।’ [২] [১] অর্থাৎ, কাফের ও মুসলিম প্রত্যেকেই এই অপেক্ষায় আছে যে, দেখা যাক, কুফর বিজয়ী হয়, না ইসলাম। [২] অর্থাৎ, সে জ্ঞান তোমাদের হয়ে যাবে যে, আল্লাহর সাহায্যে সফল ও কৃতকার্য কারা হবে। বলা বাহুল্য, এই সফলতা মুসলিমদের ভাগে এসেছিল। আর তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইসলামই সরল পথ এবং তার অনুসারীরাই সৎপথপ্রাপ্ত।

إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

📘 নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন (সত্য) উপাস্য নেই; অতএব আমারই উপাসনা কর[১] এবং আমাকে স্মরণের জন্য নামায কায়েম কর।[২] [১] এটি শরীয়তের ভারসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভার, যে ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তি ভারপ্রাপ্ত। এ ছাড়া তিনিই যখন একমাত্র উপাস্য হওয়ার যোগ্য, তখন তিনিই সমস্ত ইবাদতের একমাত্র অধিকারী। [২] ব্যাপকভাবে ইবাদতের নির্দেশ দেওয়ার পর বিশেষভাবে নামায পড়তে আদেশ করা হয়েছে; যদিও ইবাদতের মধ্যে নামাযও শামিল। যাতে তার যে বিশেষ গুরুত্ব আছে তা প্রকাশ পায়। لِذِكرِي এর একটি অর্থ হল যে, তুমি আমাকে স্মরণ কর। কারণ আমাকে স্মরণ করার মাধ্যম হল ইবাদত। আর ইবাদতের মধ্যে নামায এক বিশেষ গুরুতত্ত্বপূর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। দ্বিতীয় অর্থ হল, যখনই তোমার আমাকে স্মরণ হবে, তখনই তুমি নামায পড়। অর্থাৎ যদি কোন সময় ঔদাস্য, ভুল বা ঘুমের প্রভাবে আমাকে স্মরণ করতে না পার, তাহলে উক্ত অবস্থা পার হয়ে আমাকে স্মরণ হতেই তুমি নামায পড়। যেমন নবী (সাঃ) বলেছেন, "নিদ্রা অবস্থায় কোন শৈথিল্য নেই। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থায় হয়। সুতরাং যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোন নামায পড়তে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার উচিত, স্মরণ হওয়া মাত্র তা পড়ে নেওয়া। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন, "আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।" (মুসলিম, মিশকাত ৬০৪নং)

إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَىٰ

📘 কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, আমি এটা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে।

فَلَا يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لَا يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَىٰ

📘 সুতরাং যে ব্যক্তি কিয়ামতে বিশ্বাস করে না ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে তাতে বিশ্বাস স্থাপনে নিবৃত্ত না করে, নিবৃত্ত হলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। [১] [১] এই জন্য যে, আখেরাতের উপর বিশ্বাস করা হতে অথবা তার স্মরণ হতে বিমুখতা অবলম্বন উভয়ই ধ্বংসের কারণ।

وَمَا تِلْكَ بِيَمِينِكَ يَا مُوسَىٰ

📘 হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’

قَالَ هِيَ عَصَايَ أَتَوَكَّأُ عَلَيْهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَىٰ غَنَمِي وَلِيَ فِيهَا مَآرِبُ أُخْرَىٰ

📘 সে বলল, ‘এটা আমার লাঠি; আমি এতে ভর দিই এবং এটা দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষ পালের জন্য গাছের পাতা পেড়ে থাকি এবং এটা আমার অন্যান্য কাজেও লাগে।’

قَالَ أَلْقِهَا يَا مُوسَىٰ

📘 তিনি বললেন, ‘হে মূসা তুমি এটা নিক্ষেপ কর।’

مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ

📘 তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করিনি।[১] [১] এর অর্থ আমি কুরআন এই জন্য অবতীর্ণ করিনি যে, তুমি তাদের কুফরী করা ও ঈমান না আনার দুঃখে নিজেকে কষ্টে ফেলবে এবং আফসোস ও দুঃশ্চিন্তা করবে যেমন এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে,{فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا} অর্থাৎ, তারা এই বাণী বিশ্বাস না করলে তাদের পিছনে পিছনে ঘুরে সম্ভবতঃ তুমি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে। (সূরা কাহ্ফ ১৮:৬) বরং আমি তো কুরআনকে নসীহত ও স্মারকগ্রন্থ হিসাবে অবতীর্ণ করেছি; যাতে প্রত্যেক মানুষের অন্তরে তওহীদ (একতত্ত্ববাদ)এর যে প্রেরণা সুপ্ত আছে তা জাগ্রত হয়। এখানে شَقَاء এর অর্থঃ কষ্ট ও ক্লান্তি।

فَأَلْقَاهَا فَإِذَا هِيَ حَيَّةٌ تَسْعَىٰ

📘 অতঃপর সে তা নিক্ষেপ করল, আর সাথে সাথে তা সাপ হয়ে ছুটতে লাগল।

قَالَ خُذْهَا وَلَا تَخَفْ ۖ سَنُعِيدُهَا سِيرَتَهَا الْأُولَىٰ

📘 তিনি বললেন, ‘তুমি একে ধর এবং ভয় করো না, আমি একে এর পূর্ব রূপে ফিরিয়ে দেব। [১] [১] এটি মূসা (আঃ)-কে মু'জিযা রূপে দান করা হয়েছিল, যা 'মূসার লাঠি' নামেই প্রসিদ্ধ।

وَاضْمُمْ يَدَكَ إِلَىٰ جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوءٍ آيَةً أُخْرَىٰ

📘 এবং তুমি তোমার হাত বগলে রাখো, এটা বের হয়ে আসবে দোষমুক্ত[১] উজ্জ্বল হয়ে অপর এক নিদর্শন স্বরূপ। [১] 'দোষমুক্ত'-এর অর্থ, হাতের এই ভাবে শুভ্র ও উজ্জ্বল হয়ে বের হওয়াটা কোন রোগের কারণে নয়, যেমন কুষ্ঠরোগীদের চামড়া সাদা হয়ে থাকে। বরং এটি দ্বিতীয় মু'জিযা যা আমি তোমাকে দান করেছি। যেমন অন্য এক জায়গায় এই দুই মু'জিযার কথা একত্রে বর্ণনা করে বলেন,{فَذَانِكَ بُرْهَانَانِ مِن رَّبِّكَ إِلَى فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ} অর্থাৎ, এ দুটি ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের জন্য তোমার প্রতিপালক-প্রদত্ত প্রমাণ। (সূরা কাসাস ২৮:৩২)

لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى

📘 এটা এই জন্য যে, আমি তোমাকে দেখাব আমার মহা নিদর্শনগুলির কিছু।

اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ

📘 তুমি ফিরআউনের নিকট যাও, নিশ্চয় সে সীমালংঘন করেছে।’ [১] [১] ফিরআউনের উল্লেখ এই কারণে যে, মূসা (আঃ)-এর জাতি বানী ইস্রাঈলকে দাসে পরিণত করে রেখেছিল। তাদের উপর নানান প্রকার অত্যাচার চালাত। এ ছাড়া তার অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যও চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। এমনকি সে দাবী করে বসেছিল যে, {أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى} অর্থাৎ, আমিই তোমাদের উচ্চতম প্রতিপালক। (নাযিআতঃ ২৪)

قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي

📘 সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও।

وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي

📘 এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও।

وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي

📘 আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও।

يَفْقَهُوا قَوْلِي

📘 যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।

وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي

📘 আমার স্বজনবর্গের মধ্য হতে আমার জন্য একজন সহায়ক নিযুক্ত কর।

إِلَّا تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشَىٰ

📘 বরং এমন ব্যক্তিকে উপদেশ দেওয়ার জন্য যে (আল্লাহকে) ভয় করে।

هَارُونَ أَخِي

📘 আমার ভাই হারূনকে।

اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي

📘 তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় কর।

وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي

📘 এবং তাকে আমার কর্মে অংশী কর।[১] [১] কথিত আছে যে, মূসা (আঃ) যখন ফিরআউনের রাজ-প্রাসাদে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন তখন এক (পরীক্ষার) সময় তিনি খেজুর বা মুক্তার বদলে আগুনের অঙ্গারটুকরো মুখে ভরে নিয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর জিভ পুড়ে যায় এবং তিনি তোতলা হয়ে যান। (ইবনে কাসীর) যখন আল্লাহ তাঁকে আদেশ করলেন যে, তুমি ফিরআউনের কাছে যাও এবং আমার পয়গাম তাকে পৌঁছে দাও তখন মূসা (আঃ)-এর অন্তরে দুটি কথার উদ্রেক হয়; প্রথম এই যে, ফিরআউন অত্যন্ত দোর্দন্ড-প্রতাপ ও অহংকারী রাজা; বরং প্রতিপালক ও প্রভু হওয়ার পর্যন্ত দাবীদার। আর দ্বিতীয় এই যে, তাঁর হাতে ফিরআউনের জাতিভুক্ত একটি লোক (ভুলক্রমে) খুন হয়েছিল, যার কারণে তিনি নিজের জীবন রক্ষার্থে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ এক ফিরআউনের প্রতাপ ও পরাক্রমশালিতার, আর দুই নিজের হাতে ঘটে যাওয়া খুনের বদলার আশঙ্কা। অন্য একটি তৃতীয় জিনিস তা হল, তোতলামি বা জিহ্বার জড়তা। মূসা (আঃ) দু'আ করলেন, হে আল্লাহ! আমার হৃদয় উন্মুক্ত কর; যাতে আমি রিসালাতের বোঝা বইতে পারি। আমার কাজ সহজ করে দাও; অর্থাৎ যে গুরুদায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করেছ, তাতে আমার সাহায্য কর। আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে আমি ফিরআউনের সামনে তোমার পয়গাম পূর্ণভাবে পৌঁছাতে পারি এবং প্রয়োজনে জবানী প্রতিরক্ষা করতে পারি। সেই সাথে এই দু'আও করলেন যে, আমার ভাই হারূনকে (যিনি বয়সে মূসার চেয়ে বড় ছিলেন) আমার পৃষ্ঠপোষক ও সহায়ক হিসাবে আমার উজির ও সহকর্মী বানিয়ে দাও। وَزِير শব্দটি مُوَازِر এর অর্থে, অর্থাৎ অপরের বোঝা বহনকারী। যেরূপ একজন উজির (মন্ত্রী) রাজার বোঝা বহন করেন ও রাজ্য পরিচালনায় তাঁর উপদেষ্টা হন, সেইরূপ হারূন (আঃ) আমার উপদেষ্টা ও বোঝা বহনকারী সঙ্গী হোক।

كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا

📘 যাতে আমরা তোমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর।

وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا

📘 এবং তোমাকে স্মরণ করতে পারি অধিক।[১] [১] এখানে উক্ত দু'আ করার কারণ বলা হয়েছে। যাতে এইভাবে তোমার পয়গাম পৌঁছে দেওয়ার সাথে সাথে বেশী বেশী তোমার তসবীহ-যিকরও করতে পারি।

إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا

📘 তুমি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।’ [১] [১] অর্থাৎ, তুমি সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত। আর তুমি যেমন আমার বাল্যকালে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে, তেমনি এখনও তুমি তোমার অনুগ্রহ হতে আমাকে বঞ্চিত করো না।

قَالَ قَدْ أُوتِيتَ سُؤْلَكَ يَا مُوسَىٰ

📘 তিনি বললেন, হে মূসা! তুমি যা চেয়েছ তা তোমাকে দেওয়া হল। [১] [১] এখান হতে বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর তোতলামি ভাল করে দিয়েছিলেন। অতএব এটা বলা ঠিক নয় যে, মূসা (আঃ)-এর পুরো তোতলামি দূর হওয়ার দু'আ করেননি, সেই জন্য তা কিছুটা বাকী থেকে গিয়েছিল। থাকল ফিরআউনের এই উক্তি{وَلَا يَكَادُ يُبِينُ} (এ তো পরিষ্কার কথা বলতেও পারে না।) তা ছিল পূর্ব পরিস্থিতি হিসাবে মূসা (আঃ)-কে তাচ্ছিল্য করার জন্য। (আইসারুত তাফাসীর)

وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَيْكَ مَرَّةً أُخْرَىٰ

📘 আমি তো তোমার প্রতি আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম। [১] [১] দু'আ কবুল হওয়ার সুসংবাদের সাথে সাথে অধিক সান্ত্বনা ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাঁর বাল্যকালের সেই অনুগ্রহের কথাও স্মরণ করাচ্ছেন, যখন তাঁর মা হত্যার ভয়ে আল্লাহর আদেশে তাঁকে তাঁর দুধপানের বয়সে একটি কাঠের কফিনে রেখে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

إِذْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ أُمِّكَ مَا يُوحَىٰ

📘 যখন আমি তোমার মায়ের অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছিলাম যা ছিল নির্দেশ দেওয়ার।

أَنِ اقْذِفِيهِ فِي التَّابُوتِ فَاقْذِفِيهِ فِي الْيَمِّ فَلْيُلْقِهِ الْيَمُّ بِالسَّاحِلِ يَأْخُذْهُ عَدُوٌّ لِي وَعَدُوٌّ لَهُ ۚ وَأَلْقَيْتُ عَلَيْكَ مَحَبَّةً مِنِّي وَلِتُصْنَعَ عَلَىٰ عَيْنِي

📘 এই মর্মে যে, তুমি তাকে সিন্দুকের মধ্যে রাখো, অতঃপর তা (নীল) দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও যাতে দরিয়া ওকে তীরে ঠেলে দেয়, ওকে আমার ও ওর এক শত্রু তুলে নেবে।[১] আর আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম,[২] যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও।[৩] [১] 'শত্রু' বলে ফিরআউনকে বুঝানো হয়েছে। কারণ সেই ছিল আল্লাহ তথা মূসা (আঃ)-এর শত্রু। যখন কাঠের সেই শবাধার ঢেউয়ের সাথে রাজ-প্রাসাদের নিকট পৌঁছল, তখন তা তুলে এনে দেখা হল, যাতে একটি নিষ্পাপ শিশু ছিল। ফিরআউন তার স্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে রাজবাড়ীতে লালন-পালনের জন্য রেখে দিল। [২] অর্থাৎ, ফিরআউনের অন্তরে বা সর্বসাধারণের অন্তরে তোমার ভালবাসা ভরে দিয়েছিলাম। [৩] আল্লাহর মহাশক্তি তথা তার সুরক্ষা ও হিফাযতের নৈপুণ্য ও চমৎকারিত্ব দেখুন যে, যে শিশুটির জন্য ফিরআউন অসংখ্য শিশু-সন্তান হত্যা করিয়েছিল; যাতে সে জীবিত না থাকে, সেই শিশুকে ফিরআউনের কোলেই লালন-পালন করালেন, মা তাঁর নিজ শিশুকে দুধ দান করলেন এবং উপরন্তু শিশুর শত্রু ফিরআউনের কাছ হতে দুধপানের পারিশ্রমিকও আদায় করলেন! সুতরাং কত পবিত্র তিনি, যিনি প্রবলতা, সার্বভৌমত্ব, গর্ব ও মাহাত্ম্যের অধিকারী!

تَنْزِيلًا مِمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَى

📘 এটা তাঁর নিকট হতে অবতীর্ণ; যিনি সমুচ্চ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।

إِذْ تَمْشِي أُخْتُكَ فَتَقُولُ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ مَنْ يَكْفُلُهُ ۖ فَرَجَعْنَاكَ إِلَىٰ أُمِّكَ كَيْ تَقَرَّ عَيْنُهَا وَلَا تَحْزَنَ ۚ وَقَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُونًا ۚ فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِي أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَىٰ قَدَرٍ يَا مُوسَىٰ

📘 যখন তোমার ভগ্নী এসে বলল, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কে এই শিশুর লালন-ভার নেবে?’[১] তখন আমি তোমাকে তোমার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চক্ষু জুড়ায় এবং সে দুঃখ না পায়। আর তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে; [২] অতঃপর আমি তোমাকে দুশ্চিন্তা হতে মুক্তি দিই এবং আমি তোমাকে বহু পরীক্ষায় ফেলি।[৩] অতঃপর তুমি কয়েক বছর মাদ্‌য়্যানবাসীদের মধ্যে অবস্থান করেছিলে,[৪] হে মূসা! এর পরে তুমি নির্ধারিত সময়ে[৫] উপস্থিত হলে। [১] এটা ঐ সময়ের কথা যখন মূসা (আঃ)-এর মা কফিনটি সমুদ্রে ফেলে দিলেন এবং মেয়েকে বললেন, একটু লক্ষ্য রাখো যে, কোথায়, কোন তীরে গিয়ে পৌঁছে এবং ওর সাথে কি আচরণ করা হচ্ছে। আল্লাহর ইচ্ছায় যখন মূসা (আঃ) ফিরআউনের মহলে পৌঁছে গেলেন, তখন তিনি ছিলেন সবেমাত্র দুধ খাওয়ার শিশু। সাথে সাথে স্তন্যদাত্রী মহিলা ও আয়াদেরকে ডাকা হল; কিন্তু মূসা (আঃ) কারো স্তনবৃন্ত মুখে নিলেন না। এদিকে তাঁর বোন সব লক্ষ্য করছিলেন। পরিশেষে বললেন, 'আমি কি তোমাদেরকে এমন এক মহিলার কথা বলব, যে তোমাদের এই সমস্যা দূর করে দেবে?' তারা বলল, 'বল কে? নিয়ে এসো তাকে।' তৎক্ষণাৎ তিনি আপন মাকে (যিনি মূসা (আঃ)-এরও মা) ডেকে নিয়ে এলেন। যখন মা সন্তানকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন, তখন মূসা আল্লাহর কৌশল ও ইচ্ছায় দুধ পান করতে শুরু করলেন।[২] এখানে অন্য একটি অনুগ্রহের কথা বলা হচ্ছে। আর তা হল, যখন মূসা (আঃ) ভুলক্রমে এক কিবতীকে এক ঘুসি মারলে সে মারা যায়। যার আলোচনা সূরা কাসাস ২৮:১৫ নং আয়াতে আসবে।[৩] فُتُون শব্দটি دخول وخروج শব্দ দু'টির মত ক্রিয়ামূল, এর অর্থ ابتَلَينَاكَ ابتِلاَء অর্থাৎ, আমি তোমার খুব পরীক্ষা নিয়েছি। অথবা তা فِتنَة শব্দের বহুবচন। যেমন, حجرة এর বহুবচন حجور ও بدرة এর বহুবচন بدور এসে থাকে। আর এর অর্থ হবে আমি তোমাকে বহুবার পরীক্ষায় ফেলেছি। উদাহরণ স্বরূপ যে বছর ছিল সন্তান হত্যার বছর সেই বছর আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি। তোমার মা তোমাকে সমুদ্রের ঢেউয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। সমস্ত দুধদানকারিণী মহিলাদের দুধ তোমার জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। তুমি একদিন ফিরআউনের দাড়ি ধরে নেওয়ার কারণে সে তোমাকে হত্যার ইচ্ছা করেছিল। তোমার হাতে একজন কিবতী খুন হয়ে গিয়েছিল ইত্যাদি। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষায় আমি তোমাকে সাহায্য ও উত্তীর্ণ করেছি।[৪] একজন কিবতীকে অনিচ্ছাকৃত মারার পর তুমি সেখান হতে বের হয়ে মাদয়্যান চলে গেলে এবং সেখানে কয়েক বছর কাটালে।[৫] তুমি এমন সময়ে এসে উপস্থিত হলে যে সময়টি আমি তোমার সাথে কথা বলার ও তোমাকে নবুঅত দান করার জন্য নির্ধারিত করেছিলাম। অথবা এখানে قَدَر অর্থ বয়স। অর্থাৎ, বয়সের এমন এক পর্যায়ে তুমি এলে, যে বয়স নবুঅতের জন্য উপযুক্ত; আর তা হল চল্লিশ বছর।

وَاصْطَنَعْتُكَ لِنَفْسِي

📘 আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য প্রস্তুত করে (মনোনীত করে) নিয়েছি।

اذْهَبْ أَنْتَ وَأَخُوكَ بِآيَاتِي وَلَا تَنِيَا فِي ذِكْرِي

📘 তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনসমূহসহ যাত্রা শুরু কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না।[১] [১] এখানে আল্লাহর পথে আহবানকারীদের জন্য মহতী শিক্ষা রয়েছে, আর তা এই যে, তাঁরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করবেন।

اذْهَبَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَىٰ

📘 তোমরা দু’জন ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে।

فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَىٰ

📘 তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে,[১] হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে, অথবা ভয় করবে। [১] এই গুণটিও আল্লাহর দিকে আহবানকারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। কারণ, কঠোরতা অবলম্বনের ফলে বীতরাগ হয়ে মানুষ পালিয়ে যায়। পক্ষান্তরে নম্রতা অবলম্বনের ফলে নিকটবর্তী, প্রভাবিত ও সত্য গ্রহণকারী হয়।

قَالَا رَبَّنَا إِنَّنَا نَخَافُ أَنْ يَفْرُطَ عَلَيْنَا أَوْ أَنْ يَطْغَىٰ

📘 তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা অবশ্যই আশংকা করি যে, সে আমাদেরকে দ্রুত শাস্তি দিতে উদ্যত হবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালংঘন করবে।’

قَالَ لَا تَخَافَا ۖ إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَىٰ

📘 তিনি বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি; আমি শুনব ও দেখব।[১] [১] অর্থাৎ, তুমি ফিরআউনকে যা কিছু বলবে ও তার প্রত্যুত্তরে সে তোমাদেরকে যা কিছু বলবে, আমি তা শুনব ও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করব। আর সেই অনুযায়ী আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এবং তার সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিব। সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং দ্বিধা ও ভয় করো না।

فَأْتِيَاهُ فَقُولَا إِنَّا رَسُولَا رَبِّكَ فَأَرْسِلْ مَعَنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَا تُعَذِّبْهُمْ ۖ قَدْ جِئْنَاكَ بِآيَةٍ مِنْ رَبِّكَ ۖ وَالسَّلَامُ عَلَىٰ مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَىٰ

📘 সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল, অবশ্যই আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রসূল, সুতরাং আমাদের সাথে বানী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়ো না। আমরা তো তোমার নিকট এনেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে নিদর্শন এবং সালাম (শান্তি) তাদের প্রতি যারা সৎ পথের অনুসরণ করে।[১] [১] এ সালাম অভিবাদনের জন্য নয়; বরং শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি আমন্ত্রণ। যেমন মহানবী (সাঃ) রোমসম্রাট হিরাকলকে পত্রে লিখেছিলেন أَسلِم تَسلَم অর্থাৎ, ইসলাম গ্রহণ করে নাও, শান্তিতে বসবাস করবে। এভাবে তিনি পত্রের শুরুতে {وَالسَّلَامُ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى} (শান্তি তাদের প্রতি যারা সৎপথের অনুসরণ করে) এ কথাগুলো লিখতেন। (ইবনে কাসীর) এর অর্থ এই যে, কোন অমুসলিমকে পত্র লিখলে বা কোন সভায় সম্বোধন করতে হলে উক্ত শব্দাবলী দ্বারা সালাম দেওয়া যেতে পারে; যা সৎপথ গ্রহণের সাথে শর্ত-সাপেক্ষ।

إِنَّا قَدْ أُوحِيَ إِلَيْنَا أَنَّ الْعَذَابَ عَلَىٰ مَنْ كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ

📘 নিশ্চয় আমাদের প্রতি অহী (প্রত্যাদেশ) প্রেরণ করা হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য, যে মিথ্যা মনে করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।’

قَالَ فَمَنْ رَبُّكُمَا يَا مُوسَىٰ

📘 ফিরআউন বলল, ‘হে মূসা! কে তোমাদের প্রতিপালক?’

الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ

📘 পরম দয়াময় আরশে সমাসীন। [১] [১] তিনি আরশে সমাসীন; যেভাবে তাঁর মাহাত্ম্যের সাথে শোভনীয়। কিভাবে বা কিরূপে তা কারো জানা নেই। এই আরশ বা মহাসন আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। সর্বোচ্চ জান্নাত ফিরদাউসের উপরে বিদ্যমান। যার পায়া ও প্রান্ত আছে, ছায়া আছে।

قَالَ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىٰ

📘 মূসা বলল, ‘আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথ নির্দেশ করেছেন।’[১] [১] মানুষের জন্য যে আকার-আকৃতি যথোপযুক্ত ছিল তা মানুষকে এবং পশুদের জন্য যে আকার-আকৃতি যথোপযুক্ত ছিল তা তাদেরকে দান করেছেন। আর 'পথ-নির্দেশ' করার অর্থ হল প্রত্যেক সৃষ্টিকে তার প্রকৃতিগত আবশ্যকতা অনুসারে বসবাস, পানাহার ও আচার-আচরণের নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। আর সেই নিয়মানুসারে প্রত্যেক জীব নিজের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে এবং নিজ নিজ মেকী জীবনের দিন-রজনী অতিবাহিত করে থাকে।

قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَىٰ

📘 ফিরআউন বলল, ‘তা হলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি?’ [১] [১] ফিরআউন কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই প্রশ্নটি করেছিল। অর্থাৎ অতীত কালের লোকেরা যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করেই পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছে, তাদের অবস্থা কি হবে?

قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي فِي كِتَابٍ ۖ لَا يَضِلُّ رَبِّي وَلَا يَنْسَى

📘 মূসা বলল, ‘এর জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট লিপিবদ্ধ আছে; আমার প্রতিপালক বিভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না।’[১] [১] মূসা (আঃ) উত্তরে বলেছিলেন, সে জ্ঞান না আমার আছে, না তোমার। অবশ্য সে জ্ঞান আমার প্রতিপালকের আছে, যা তাঁর নিকট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। আর সেই অনুসারে তিনি তাদেরকে শাস্তি অথবা শান্তি দান করবেন। আল্লাহর জ্ঞান প্রতিটি জিনিসে এমনভাবে পরিব্যাপ্ত আছে যে, তাঁর দৃষ্টি হতে ছোট-বড় কোন জিনিসই লুক্কায়িত নয়; আর না তিনি কিছু বিস্মৃত হন। পক্ষান্তরে সৃষ্টির জ্ঞানে উক্ত দুই প্রকার ত্রুটিই বিদ্যমান। প্রথমতঃ তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ; যা সর্বব্যাপী নয়। আর দ্বিতীয়তঃ জ্ঞান লাভের পর তারা ভুলেও যায়। আমার প্রভু উক্ত উভয় শ্রেণীর ত্রুটি হতে পবিত্র। পরবর্তী আয়াতসমূহে প্রভুর আরো কিছু গুণাবলী বর্ণনা করা হচ্ছে।

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَسَلَكَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْ نَبَاتٍ شَتَّىٰ

📘 যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং তাতে করে দিয়েছেন তোমাদের চলবার পথ। তিনি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।

كُلُوا وَارْعَوْا أَنْعَامَكُمْ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِأُولِي النُّهَىٰ

📘 তোমরা আহার কর ও তোমাদের গবাদি পশু চরাও;[১] অবশ্যই এতে বহু নিদর্শন আছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য। [২] [১] অর্থাৎ, এই বিভিন্ন প্রকার উৎপন্ন ফল-ফসলের মধ্যে কিছু তোমাদের পানাহার ও বিলাস-ভোগের জন্য, আর কিছু তোমাদের জীব-জন্তুদের জন্য। [২] نُهَى শব্দটি نُهيَة এর বহুবচন যার অর্থঃ বিবেক, জ্ঞান। أولو النُّهى এর অর্থঃ বিবেকবান, জ্ঞানসম্পন্ন। ( نُهيَة এর মূল অর্থঃ শেষ, সমাপ্তি বা নিষেধ।) বিবেক বা জ্ঞানকে نُهيَة এবং বিবেকবান বা জ্ঞানীকে ذُو نُهيَة এই জন্য বলা হয় যে, তারই মতানুসারে কোন কাজ সম্পন্ন বা কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। অথবা এই কারণে যে, তা মানুষকে পাপ হতে নিষেধ করে। (ফাতহুল কাদীর)

۞ مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَىٰ

📘 আমি মাটি হতে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা হতে পুনর্বার বের করব। [১] [১] কোন কোন বর্ণনায় মাইয়েতকে কবরে রাখার পর তিন মুঠি মাটি দেওয়ার সময় এই আয়াত পাঠ করা নবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। তবে সূত্রের দিক দিয়ে হাদীসটি দুর্বল। পরন্তু আয়াত পাঠ ছাড়া তিনবার মাটি দেওয়ার বর্ণনা ইবনে মাজাহতে আছে, যা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত। সেই জন্য দাফনের সময় দুই হাত দিয়ে কবরে তিনবার মাটি দেওয়াকে উলামাগণ মুস্তাহাব বলেছেন। (দেখুন আহকামুল জানাইয ১৫২পৃঃ, ইরওয়াউল গালীল ৩/২০০, ২৫১নং, আলবানী)

وَلَقَدْ أَرَيْنَاهُ آيَاتِنَا كُلَّهَا فَكَذَّبَ وَأَبَىٰ

📘 আমি তো তাকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছিলাম; কিন্তু সে মিথ্যাজ্ঞান করেছে ও অমান্য করেছে।

قَالَ أَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ أَرْضِنَا بِسِحْرِكَ يَا مُوسَىٰ

📘 সে বলল, ‘হে মূসা! তুমি কি আমাদের নিকট এসেছ তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ হতে বহিস্কার করে দেওয়ার জন্য? [১] [১] যখন ফিরআউনকে স্পষ্ট প্রমাণাদির সাথে সাথে ঐ সমস্ত মু'জিযা যা লাঠি ও উজ্জ্বল হাত রূপে মূসা (আঃ)-কে দান করা হয়েছিল। ফিরআউন এ সবকে জাদুর কারসাজি মনে করল ও বলতে লাগল, তুমি কি আমাদেরকে জাদুর জোরে আমাদের দেশ (মিসর) হতে বিতাড়িত করতে চাচ্ছ?

فَلَنَأْتِيَنَّكَ بِسِحْرٍ مِثْلِهِ فَاجْعَلْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدًا لَا نُخْلِفُهُ نَحْنُ وَلَا أَنْتَ مَكَانًا سُوًى

📘 আমরাও অবশ্যই তোমার নিকট উপস্থিত করব এর অনুরূপ জাদু, সুতরাং আমাদের ও তোমার মাঝে নির্ধারণ কর এক নির্দিষ্ট সময় ও এক মধ্যবর্তী স্থান,[১] যার ব্যতিক্রম আমরাও করব না এবং তুমিও করবে না।’[২] [১] مَوعِد শব্দটি ক্রিয়ামূল। অথবা কাল ও স্থানবাচকও হতে পারে। অর্থাৎ, কোন জায়গা বা কোন দিন নির্ধারিত কর। [২] مكانًا سُوى পরিষ্কার সমতল ভূমি; যেখানে অনুষ্ঠিতব্য এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যেক ব্যক্তি সহজেই দেখতে পারে। অথবা এমন মধ্যবর্তী জায়গা যেখানে দুই দল সহজেই উপস্থিত হতে পারে।

قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَأَنْ يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى

📘 মূসা বলল, ‘তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন[১] এবং সেই দিন পুর্বাহ্নে জনগণকে সমবেত করা হবে।’ [১] অর্থাৎ, নওরোজ অথবা বাৎসরিক কোন মেলা বা অনুষ্ঠানের দিন; যাকে তারা ঈদরূপে পালন করত।

لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَىٰ

📘 যা আছে আকাশমন্ডলীতে, পৃথিবীতে, এই দুয়ের অন্তর্বর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে তা তাঁরই। [১] [১] ثَرَى ভূগর্ভঃ পৃথিবীর সর্বনিম্ন জায়গা, অর্থাৎ পাতাল।

فَتَوَلَّىٰ فِرْعَوْنُ فَجَمَعَ كَيْدَهُ ثُمَّ أَتَىٰ

📘 অতঃপর ফিরআউন প্রস্থান করল এবং পরে তার কৌশলসমূহ একত্রিত করল ও তারপর আসল। [১] [১] অর্থাৎ, বিভিন্ন শহর হতে সুদক্ষ জাদুকরদেরকে একত্রিত করে সমাবেশে উপস্থিত হল।

قَالَ لَهُمْ مُوسَىٰ وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَىٰ

📘 মূসা তাদেরকে বলল, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না, করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন; আর যে মিথ্যা উদ্ভাবন করবে সে অবশ্যই ব্যর্থ হবে।’ [১] [১] যখন ফিরআউন রাজসভায় জাদুকরদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসাহিত করছিল এবং তাদেরকে পুরস্কার ও বিশেষ নৈকট্য দানের কথা প্রকাশ করছিল, অনুরূপ মূসা (আঃ)ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বে তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং তাদের বর্তমান আচরণের ব্যাপারে আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখালেন।

فَتَنَازَعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ وَأَسَرُّوا النَّجْوَىٰ

📘 তারা আপোসে নিজেদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক করতে লাগল এবং তারা গোপনে পরামর্শ করল। [১] [১] মূসা (আঃ)-এর উপদেশে তাদের আপোসে কিছু মতভেদ দেখা দিল। কেউ কেউ চুপিসারে বলতে লাগল, ইনি সত্যিকারেই আল্লাহর নবী না হন। যেহেতু তাঁর কথাবার্তা তো জাদুকরদের মত নয়; বরং নবীদের মত মনে হচ্ছে। আর কেউ এর বিপরীত মত প্রকাশ করল।

قَالُوا إِنْ هَٰذَانِ لَسَاحِرَانِ يُرِيدَانِ أَنْ يُخْرِجَاكُمْ مِنْ أَرْضِكُمْ بِسِحْرِهِمَا وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَىٰ

📘 ওরা বলল, ‘এই দুইজন অবশ্যই জাদুকর, তারা তাদের জাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কার করতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন-ব্যবস্থা নস্যাৎ করতে চায়।[১] [১] مُثلى শব্দটি طَرِيقَة শব্দের বিশেষণ; আর এটি أَمثَل শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এর অর্থঃ উৎকৃষ্ট। অর্থ এই যে, যদি এরা দুই ভাই জাদু বলে বিজয়ী হয়ে যায়, তাহলে নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত লোকেরা তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। আর তাতে আমাদের ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবে ও তাদের ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আমাদের উৎকৃষ্ট জীবন-ব্যবস্থা বা উত্তম ধর্মমত ও মযহাবকেও নস্যাৎ করে ফেলবে। অর্থাৎ, ফিরআউনীরা তাদের শিরকীয় ধর্মমতকে উত্তম ধর্মমত বলে মনে করত; যেমন বর্তমানে প্রত্যেক বাতিল ধর্মমত ও দলের লোকেরা এই ভুল ধারণাই পোষণ করে থাকে। মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন, {كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ} অর্থাৎ, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল। (রূমঃ ৩২)

فَأَجْمِعُوا كَيْدَكُمْ ثُمَّ ائْتُوا صَفًّا ۚ وَقَدْ أَفْلَحَ الْيَوْمَ مَنِ اسْتَعْلَىٰ

📘 অতএব তোমরা তোমাদের কলা-কৌশল সুসংহত কর। তারপর সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও। আজকে যে জয়ী হবে সেই হবে সফল।’

قَالُوا يَا مُوسَىٰ إِمَّا أَنْ تُلْقِيَ وَإِمَّا أَنْ نَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَلْقَىٰ

📘 ওরা বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর অথবা প্রথমে আমরাই নিক্ষেপ করি।’

قَالَ بَلْ أَلْقُوا ۖ فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَىٰ

📘 মুসা বলল, ‘বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর।’[১] সুতরাং ওদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে হল, ওদের দড়ি ও লাঠিগুলো যেন ছুটাছুটি করছে।[২] [১] মূসা (আঃ) তাদেরকে প্রথমে নিজেদের খেলা দেখাতে বললেন, যাতে এটা তাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, জাদুকরের এতবড় একটি দল যাদেরকে ফিরআউন একত্রিত করে নিয়ে এসেছে তাদেরকে এবং অনুরূপ তাদের জাদুর নৈপুণ্যে ও ভেল্কিবাজিতে তিনি ভীত নন। দ্বিতীয়তঃ ওদের জাদুর ভেল্কি যখন আল্লাহর মু'জিযার সামনে চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন এর একটি সুন্দর প্রতিক্রিয়া হবে এবং জাদুকররা ভাবতে বাধ্য হবে যে, এটা জাদু নয়; বরং সত্যই তিনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত। নচেৎ ক্ষণিকের মধ্যে তাঁর একটি লাঠি আমাদের সমস্ত ভেল্কির জিনিসকে গিলে ফেলল কিভাবে? [২] কুরআনের শব্দাবলী দ্বারা জানা যায় যে, দড়ি ও লাঠিগুলো সত্য সত্যই সাপ হয়ে যায়নি। বরং তা জাদুর প্রভাবে এ রকম মনে হচ্ছিল। যেমন সম্মোহন বিদ্যা বা ইন্দ্রজালের সাহায্যে চোখে ধাঁধা বা ভেল্কি লাগিয়ে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও এর প্রভাব অবশ্যই হয়ে থাকে যে, সাময়িক ও অস্থায়ীভাবে দর্শকদেরকে অভিভূত করে ফেলে। যদিও সেই জিনিসের বাস্তবতায় কোন পরিবর্তন ঘটে না। দ্বিতীয় কথা এই জানা গেল যে, জাদু যত বড়ই হোক না কেন জিনিসের আসলত্ব বা প্রকৃততত্ব বদলাতে পারে না।

فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَىٰ

📘 মূসা তার অন্তরে কিছু ভয় অনুভব করল।

قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَىٰ

📘 আমি বললাম, ‘ভয় করো না; নিশ্চয় তুমিই প্রবল।[১] [১] এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে মূসা (আঃ)-এর মনে ভয়ের সঞ্চার হল। আর তা ছিল প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ব্যাপার; যা নবুঅত ও ত্রুটিহীনতার পরিপন্থী নয়। কারণ, নবী একজন মানুষই হয়ে থাকেন; যিনি মানবীয় স্বাভাবিক আচরণের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। এখান হতে এ কথা বুঝা যায় যে, যেমন নবীগণ অন্যান্য মানুষের মত বিপদগ্রস্ত হন, তেমনি তাঁরা জাদুর প্রভাবে প্রভাবিতও হতে পারেন। যেমন নবী (সাঃ)-এর উপর ইয়াহুদীরা জাদু করেছিল এবং তার প্রভাব তিনিও অনুভব করেছিলেন। এতে নবুঅতের কাজ প্রভাবিত হয় না। আল্লাহ তাআলা নবীকে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিয়ে থাকেন এবং জাদুর ফলে অহী ও রিসালতের কর্তব্য আদায়ে প্রভাব পড়তে দেন না। তাছাড়া এটাও হতে পারে যে, মূসা (আঃ)-এর এই ভয় হল যে, আমার লাঠি ফেলার আগে আগেই জনগণ যেন জাদু ও ভেল্কিবাজি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যায়। কিন্তু অধিকতর সম্ভাবনায় তাঁর ভয় এই কারণে হয়েছিল যে, জাদুকররা যে ভেল্কি দেখাল তা লাঠির দ্বারা। আর তাঁর হাতেও ছিল লাঠি, যা মাটিতে ফেলার অপেক্ষায় ছিলেন। মূসা (আঃ)-এর মনে হল যে, দর্শকরা যেন সন্দেহ ও সংশয়ে না পড়ে যায় এবং তারা যেন এটা ভেবে না নেয় যে, দু'দলই একই ধরনের জাদু প্রদর্শন করল। এই জন্য এ ফায়সালা ও নির্ণয় কিভাবে সম্ভব যে, কোনটা জাদু এবং কোনটা মু'জিযা? কে বিজয়ী এবং কে পরাজিত? অর্থাৎ, জাদুও মু'জিযার মধ্যে পার্থক্য সাধনের যে উদ্দেশ্য, সেটা বোধ হয় উপর্যুক্ত কারণে সম্ভব হবে না। এখান হতে বুঝা গেল যে, নবীর নিজ হতে মু'জিযা দেখানো তো অনেক দূরের কথা, অধিকাংশ সময়ে তাঁর এটাও জানা থাকে না যে, তাঁর হাত দ্বারা কোন্ শ্রেণীর মু'জিযা প্রকাশ পাবে। নবীদের হাতে মু'জিযা প্রকাশ করার কাজ একমাত্র আল্লাহর। যাই হোক, মূসা (আঃ)-এর এই সন্দেহ ও সংশয় দূর করে মহান আল্লাহ বললেন, 'হে মূসা! কোন প্রকার ভয় ও ভীতির কারণ নেই, তুমিই বিজয়ী হবে।' এই বাক্য দ্বারা প্রকৃতিগত ভয় এবং অন্যান্য আশংকা সবই দূর করে দিলেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত তাই হল, যা পরবর্তী আয়াতসমূহে বলা হয়েছে।

وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا ۖ إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ ۖ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ

📘 তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ কর, এটি ওরা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। ওরা যা করেছে তা তো জাদুকরের কৌশলমাত্র, এবং যেখান হতেই সে আগমন করুক, জাদুকর কখনই কৃতকার্য হবে না।’

وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفَى

📘 তুমি যদি উচ্চস্বরে কথা বল, তাহলে তিনি তো গুপ্ত ও অব্যক্ত সবই জানেন। [১] [১] অর্থাৎ, আল্লাহর যিকর অথবা তাঁর নিকট দু'আ ও প্রার্থনা উচ্চশব্দে করার প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি তো গোপন থেকে গোপনতর কথাও শুনেন ও জানেন। অথবা أَخفَى শব্দের অর্থ হল আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত কথা সম্পর্কেও অবহিত যা তিনি তকদীরে লিখে দিয়েছেন, কিন্তু মানুষের নিকট এখনও প্রকাশ করেননি। অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য সকল ঘটনা সম্পর্কে তিনি পরিজ্ঞাত।

فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَىٰ

📘 অতঃপর জাদুকররা সিজদায় পড়ল ও বলল, ‘আমরা হারূন ও মূসার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।’

قَالَ آمَنْتُمْ لَهُ قَبْلَ أَنْ آذَنَ لَكُمْ ۖ إِنَّهُ لَكَبِيرُكُمُ الَّذِي عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ ۖ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ مِنْ خِلَافٍ وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ فِي جُذُوعِ النَّخْلِ وَلَتَعْلَمُنَّ أَيُّنَا أَشَدُّ عَذَابًا وَأَبْقَىٰ

📘 ফিরআউন বলল, ‘তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়ার পূর্বেই কী তোমরা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রধান যে তোমাদের জাদু শিক্ষা দিয়েছে। অতএব নিশ্চয় আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীতভাবে[১] কেটে ফেলব এবং তোমাদেরকে খেজুর কান্ডে শূলবিদ্ধ করব। আর তখন তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে কার শক্তি কঠোরতর ও দীর্ঘস্থায়ী।’ [১] 'বিপরীতভাবে' এর অর্থ হল, ডান হাত ও বাম পা অথবা বাম হাত ও ডান পা।

قَالُوا لَنْ نُؤْثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَاءَنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالَّذِي فَطَرَنَا ۖ فَاقْضِ مَا أَنْتَ قَاضٍ ۖ إِنَّمَا تَقْضِي هَٰذِهِ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا

📘 তারা বলল, ‘আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসে গেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন[১] তাঁর উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি যা করতে চাও তাই কর। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবন সম্বন্ধে যা করবার করতে পারো। [২] [১] এই অনুবাদ ঐ সময় সঠিক হবে যখন وَالَّذِي فَطَرَنِي বাক্যের সংযোগ مَا جَاءنَا বাক্যের সাথে ধরা হবে। পক্ষান্তরে কিছু ব্যাখ্যাতা وَالَّذِي فَطَرَنِي বাক্যটিকে শপথ বাক্য বলেছেন। অর্থাৎ, সেই সত্তার শপথ যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন! আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসে গেছে, তার উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দেব না। [২] অর্থাৎ, তোমার যা করার ক্ষমতা আছে, তাই কর। আমরা জানি, তোমার ক্ষমতা শুধু এই পার্থিব জীবনেই চলতে পারে। পক্ষান্তরে আমরা ঈমান এনেছি সেই পালনকর্তার উপর যাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দুনিয়া ও আখেরাতে সমানভাবে চলে। মৃত্যুর পর আমরা তোমার শাসন ও অত্যাচার থেকে তো বেঁচে যাব। কারণ দেহ হতে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার পর আমাদের প্রতি তোমার এখতিয়ার শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি আল্লাহর অবাধ্য হয়ে থাকি, তাহলে মৃত্যুর পরও আল্লাহর এখতিয়ারের বাইরে বের হওয়া সম্ভব নয়। তিনি আমাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে সক্ষম। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর এক মু'মিনের জীবনে যে মহা পরিবর্তন আসা আবশ্যক, পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী ও আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের প্রতি যে দৃঢ়-বিশ্বাস হওয়া দরকার, অতঃপর এই আকীদা ও বিশ্বাসের উপর যে দুঃখ-কষ্ট আসে তা যে উদ্যম, ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার সাথে বরণ করার প্রয়োজন, জাদুকররা তার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা পেশ করেছে। ঈমান আনার পূর্বে কেমন তারা ফিরআউনের নিকট থেকে পুরস্কার ও পার্থিব পদ-মর্যাদার আকাঙ্ক্ষী ছিল, কিন্তু ঈমান আনার পরে কোন প্রলোভন ও প্ররোচনা তাদেরকে বিচলিত করতে পারেনি এবং দন্ড ও শাস্তির হুমকিও তাদেরকে ঈমান হতে বিমুখ করতে সফল হয়নি।

إِنَّا آمَنَّا بِرَبِّنَا لِيَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا وَمَا أَكْرَهْتَنَا عَلَيْهِ مِنَ السِّحْرِ ۗ وَاللَّهُ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ

📘 আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস করেছি; যাতে তিনি আমাদের পাপরাশি এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছিলে (তার পাপ) ক্ষমা করে দেন। আর আল্লাহই শ্রেষ্ঠতম ও অবিনশ্বর।’[১] [১] এটি ফিরআউনের উক্তি, 'তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে কার শক্তি কঠোরতর ও দীর্ঘস্থায়ী'-এর উত্তর। অর্থাৎ, হে ফিরআউন! তুমি আমাদেরকে যে কঠিন শাস্তি দেওয়ার ধমক দিচ্ছ, তার তুলনায় আল্লাহর নিকট যে প্রতিদান পাব, তা অত্যধিক শ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী।

إِنَّهُ مَنْ يَأْتِ رَبَّهُ مُجْرِمًا فَإِنَّ لَهُ جَهَنَّمَ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَىٰ

📘 নিশ্চয় যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য আছে জাহান্নাম; সেখানে সে মরবেও না এবং বাঁচবেও না।[১] [১] অর্থাৎ, আমার আযাবে অতিষ্ঠ হয়ে তারা মরণ কামনা করবে, কিন্তু তাদের মরণ আসবে না। আর দিবারাত্রি আযাবের কষ্ট ভোগ করতে থাকা, পানাহারের জন্য যাক্কুমের মত অতি তিক্ত গাছ, জাহান্নামীদের দেহ হতে নির্গত রক্ত-পুঁজ পেতে থাকা, এটা কি কোন জীবন হল? হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব হতে বাঁচাও।

وَمَنْ يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَىٰ

📘 আর যারা তাঁর নিকট বিশ্বাসী হয়ে ও সৎকর্ম করে উপস্থিত হবে, তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদাসমূহ।

جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ جَزَاءُ مَنْ تَزَكَّىٰ

📘 স্থায়ী জান্নাত যার নিচে নদীমালা প্রবাহিত; সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আর এই পুরস্কার তাদেরই যারা পবিত্র।[১] [১] জাহান্নামীদের বিপরীত ঈমানদারদেরকে জান্নাতে যে সুখময় বিলাস-জীবন দেওয়া হবে মহান আল্লাহ এখানে তার উল্লেখ করেছেন এবং পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এর উপযুক্ত তারাই হবে যারা ঈমান আনার পর ঈমানের চাহিদাও পূরণ করে। অর্থাৎ, তারা সৎকর্ম করে ও নিজের আত্মাকে পাপাচার হতে পবিত্র রাখে। মুখে কিছু বাক্য পাঠ করার নাম ঈমান নয়, বরং বিশ্বাস, স্বীকার ও আমলের সমষ্টির নাম হল ঈমান।

وَلَقَدْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ مُوسَىٰ أَنْ أَسْرِ بِعِبَادِي فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقًا فِي الْبَحْرِ يَبَسًا لَا تَخَافُ دَرَكًا وَلَا تَخْشَىٰ

📘 আমি অবশ্যই মূসার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলাম এই মর্মে যে, আমার দাসদের নিয়ে রাতারাতি বের হয়ে যাও[১] এবং ওদের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এক শুষ্ক পথ নির্মাণ কর।[২] পশ্চাৎ হতে এসে তোমাকে ধরে ফেলবে, এ আশঙ্কা করো না এবং ভয়ও করো না।[৩] [১] যখন ফিরআউন ঈমান আনল না এবং বানী ইস্রাঈলদেরকে মুক্তও করল না, তখন মহান আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে এই আদেশ করলেন। [২] এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা শুআরাতে আসবে। মূসা (আঃ) আল্লাহর আদেশে সমুদ্রে লাঠি মারলেন যার কারণে সমুদ্র পার করার জন্য শুকনো রাস্তা তৈরী হয়ে গেল। [৩] আশঙ্কা ফিরআউন ও তার সৈন্যদলের, আর ভয় পানিতে ডুবে মরার।

فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُمْ مِنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ

📘 অতঃপর ফিরআউন তার সেনাবাহিনীসহ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলে সমুদ্র ওদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করল।[১] [১] যখন সেই শুকনো রাস্তা দিয়ে ফিরআউন তার সৈন্য সামন্তরা চলতে শুরু করল, তখন আল্লাহ সমুদ্রকে আদেশ করলেন, 'তুমি আগের অবস্থায় ফিরে যাও।' আর তা সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে শুকনো রাস্তা সমুদ্রের ঢেউয়ে পরিণত হল এবং ফিরআউন তথা তার সৈন্য-সামন্ত সবই সমুদ্রে ডুবে মরল। غَشِيَهم এর অর্থ عَلاهُم وأصَابَهُم অর্থাৎ, সমুদ্রের পানি তাদের উপরে এসে তাদেরকে ঢেকে নিল। مَا غَشِيَهم এর পুনরাবৃত্তি ভয়ঙ্করতা বর্ণনার জন্য।

وَأَضَلَّ فِرْعَوْنُ قَوْمَهُ وَمَا هَدَىٰ

📘 ফিরআউন তার সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্ট করেছিল, সৎপথ দেখায়নি। [১] [১] যার ফলে সমুদ্রে ডুবে মরা তাদের ভাগ্য ছিল।

اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ

📘 আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সমস্ত উত্তম নাম তাঁরই। [১] [১] অর্থাৎ, উপাস্য (ইবাদতের যোগ্য) তিনিই, যিনি উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী। আর তাঁর সুন্দর নামাবলীও আছে, যা দ্বারা তাঁকে আহবান করা হয়। উপাস্য তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নয়, না তাঁর মত সুন্দর নাম কারো আছে। অতএব তাঁকে সঠিকভাবে জানা, তাঁকেই ভয় করা উচিত, তাঁকেই ভালবাসা উচিত, তাঁকেই বিশ্বাস করা উচিত এবং তাঁরই আজ্ঞা পালন করা উচিত। যাতে মানুষ যেদিন তাঁর নিকট ফিরে যাবে সেদিন লজ্জিত না হয়; বরং তাঁর কৃপা ও ক্ষমা লাভ করে আনন্দিত এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করে সৌভাগ্যবান ও সুখী হয়।

يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ قَدْ أَنْجَيْنَاكُمْ مِنْ عَدُوِّكُمْ وَوَاعَدْنَاكُمْ جَانِبَ الطُّورِ الْأَيْمَنَ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكُمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَىٰ

📘 হে বানী ইস্রাঈল! নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে তোমাদের শত্রু হতে উদ্ধার করলাম, আমি তোমাদেরকে ত্বুর পাহাড়ের ডান পাশে (তাওরাত) দানের প্রতিশ্রুতি দিলাম[১] এবং তোমাদের নিকট ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ প্রেরণ করলাম। [২] [১] ووَاعَدنَاكُم "আমি তোমাদেরকে তূর পাহাড়ের ডান পাশে (তাওরাত) দানের প্রতিশ্রুতি দিলাম।" এখানে 'তোমাদের' সর্বনাম বহুবচন ব্যবহারের অর্থ হল যে, মূসা ত্বুর পাহাড়ে তোমাদেরকে প্রতিনিধিরূপে নিয়ে আসবে, যাতে আমি তোমাদের সামনেই তার সঙ্গে কথোপকথন করতে পারি। অথবা বহুবচন সর্বনাম এই কারণে ব্যবহার করা হয়েছে, যেহেতু মূসা (আঃ)-কে ত্বুর পাহাড়ে আহবান করা হয়েছিল বানী ইস্রাঈলদের স্বার্থেই তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যই।[২] 'মান্ন্ ও সালওয়া' অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা সূরা বাক্বারাহ ২:৫৭ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। 'মান্ন্' ছিল কোন মিষ্টি খাদ্য যা আকাশ হতে অবতীর্ণ হত। আর 'সালওয়া' হল এক জাতীয় পাখি যা অধিক সংখ্যায় তাদের কাছে আসত এবং তারা তাদের প্রয়োজন মত তা ধরত ও রান্না করে খেত। (ইবনে কাসীর)

كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَا تَطْغَوْا فِيهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِي ۖ وَمَنْ يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِي فَقَدْ هَوَىٰ

📘 তোমাদের যে উপজীবিকা দান করলাম তা হতে পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং এ বিষয়ে সীমালংঘন করো না। [১] করলে তোমাদের উপর আমার ক্রোধ পতিত হবে। আর যার উপরে আমার ক্রোধ পতিত হবে সে অবশ্যই ধ্বংস হবে। [২] [১] طُغيَان এর অর্থঃ সীমালংঘন করা। অর্থাৎ হালাল ও পবিত্র জিনিসের সীমা ছেড়ে হারাম ও অপবিত্র জিনিসের দিকে অতিক্রম করো না। অথবা আল্লাহর অনুগ্রহসমূহকে অস্বীকার করে বা অনুগ্রহকারীর অবাধ্য হয়ে সীমালংঘন করো না। এই সমস্ত ভাবার্থের উপর طُغيَان শব্দ ব্যবহার করা যায়। আর কেউ কেউ বলেন যে, এখানে طُغيَان এর অর্থ হল, তোমরা প্রয়োজন মত পাখি ধর এবং প্রয়োজনের বেশী ধরে সীমা অতিক্রম করো না। [২] এর অন্য এক অর্থ বর্ণনা করা হয়, আর তা হল, 'সে হাবিয়া তথা জাহান্নামে পতিত হবে।' হাবিয়া জাহান্নামের নিম্নস্তরকে বলা হয়। অর্থাৎ সে জাহান্নামের গভীর বিভাগের উপযুক্ত বাসিন্দা হবে।

وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدَىٰ

📘 নিশ্চয় আমি তার জন্য বড় ক্ষমাশীল যে তওবা করে, বিশ্বাস স্থাপন করে, সৎকাজ করে ও সৎপথে অবিচল থাকে। [১] [১] মহান আল্লাহর ক্ষমাযোগ্য হওয়ার জন্য চারটি জিনিস আবশ্যক; (ক) কুফর, শিরক ও পাপ হতে তওবা। (খ) ঈমান, (গ) সৎকর্ম ও (ঘ) সৎপথে অটল থাকা। অর্থাৎ উক্ত অবস্থায় অবিচল থাকা, যাতে ঈমানের অবস্থায় মৃত্যু আসে। অন্যথা স্পষ্ট যে, তওবা ও ঈমানের পর যদি কেউ কুফরী ও শিরকের রাস্তা অবলম্বন করে এবং সেই অবস্থায় তার মৃত্যু এসে যায়, তাহলে ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তির যোগ্য হতে হবে।

۞ وَمَا أَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ يَا مُوسَىٰ

📘 হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পশ্চাতে ফেলে তোমাকে ত্বরা করতে বাধ্য করল কিসে?

قَالَ هُمْ أُولَاءِ عَلَىٰ أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَىٰ

📘 সে বলল, ‘ওই তো ওরা আমার পশ্চাতে আসছে এবং হে আমার প্রতিপালক! আমি তাড়াতাড়ি তোমার নিকট এলাম, তুমি সন্তুষ্ট হবে এই জন্য।’ [১] [১] লোহিত সাগর পার করার পর মূসা (আঃ) বানী ইস্রাঈলের সম্মানিত লোকদেরকে সাথে নিয়ে ত্বুর পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হলেন। কিন্তু প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের তীব্র বাসনায় সাথীদেরকে পিছনে রেখে দ্রুত গতিতে পাহাড়ে পৌঁছে গেলেন। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, তোমার সন্তুষ্টি তাড়াতাড়ি পাবার আশায়। আর তারা আমার পিছনেই আসছে। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ এই নয় যে, তারা আমার পিছনে আসছে; বরং অর্থ হল, তারা আমার পিছনে ত্বুর পাহাড়ের নিকটেই রয়েছে এবং আমার ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

قَالَ فَإِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْ بَعْدِكَ وَأَضَلَّهُمُ السَّامِرِيُّ

📘 তিনি বললেন, ‘তুমি (চলে আসার) পর আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলেছি এবং সামেরী ওদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে।’ [১] [১] মূসার ত্বুর পাহাড়ে যাওয়ার পর সামেরী নামক এক ব্যক্তি বানী-ইস্রাঈলদেরকে বাছুর পূজায় লাগিয়ে দিল। যার সংবাদ আল্লাহ তাআলা মূসা (আঃ)-কে ত্বুর পাহাড়েই দিলেন যে, সামেরী তোমার জাতিকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে। ফিতনা বা পরীক্ষায় ফেলার সম্পর্ক আল্লাহ নিজের দিকেই করেছেন শুধু সৃষ্টিকর্তা হিসাবে। নচেৎ এই পথভ্রষ্টতার কারণ হল সামেরী; যেমন أَضَلَّهمُ السَّامري (সামেরী ওদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে) বাক্য দ্বারা পরিষ্কার।

فَرَجَعَ مُوسَىٰ إِلَىٰ قَوْمِهِ غَضْبَانَ أَسِفًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا ۚ أَفَطَالَ عَلَيْكُمُ الْعَهْدُ أَمْ أَرَدْتُمْ أَنْ يَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَخْلَفْتُمْ مَوْعِدِي

📘 অতঃপর মূসা তার সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে। সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে এক উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি?[১] তবে কি তোমাদের কাছে সেই সময় দীর্ঘ মনে হল?[২] অথবা তোমরা কি চাও যে, তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ নেমে আসুক? তাই তোমরা আমার সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে?’[৩] [১] এর অর্থ জান্নাত বা বিজয় বা সফলতার প্রতিশ্রুতি; যদি তারা ধর্মের উপর সুদৃঢ় থাকে। অথবা তাওরাত প্রদানের প্রতিশ্রুতি; যার জন্য তাদেরকে ত্বুর পাহাড়ে ডাকা হয়েছিল। [২] সেই প্রতিশ্রুতির কাল কি সুদীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল যে তোমরা ভুলে গেলে এবং বাছুর পূজা শুরু করে দিলে? [৩] মূসা (আঃ)-এর সম্প্রদায় তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তার ত্বুর পাহাড় হতে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে দৃঢ় থাকবে। অথবা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, আমরাও আপনার পিছু পিছু ত্বুর পাহাড়ে আসছি। কিন্তু রাস্তাতে থেমে গিয়ে তারা বাছুর পূজা শুরু করে দিল।

قَالُوا مَا أَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا وَلَٰكِنَّا حُمِّلْنَا أَوْزَارًا مِنْ زِينَةِ الْقَوْمِ فَقَذَفْنَاهَا فَكَذَٰلِكَ أَلْقَى السَّامِرِيُّ

📘 ওরা বলল, ‘আমরা তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকার স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি[১] বরং আমাদেরকে সম্প্রদায়ের অলঙ্কারের ভার বহন করতে দেওয়া হয়েছিল, পরে আমরা তা আগুনে নিক্ষেপ করেছিলাম; অতঃপর সামেরীও ঐরূপ নিক্ষেপ করেছিল। [১] অর্থাৎ, আমরা নিজ এখতিয়ারে এ কাজ করিনি। বরং এই ভুল আমাদের বিনা এখতিয়ারে হয়ে গেছে। পরবর্তীতে সে কারণ বলা হচ্ছে।

فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَٰذَا إِلَٰهُكُمْ وَإِلَٰهُ مُوسَىٰ فَنَسِيَ

📘 অতঃপর সে ওদের জন্য গড়ল এক গো-বৎস (বাছুর); এক অবয়ব, যা গরুর শব্দ করত। ওরা বলল, এই হল তোমাদের এবং মূসার উপাস্য;[১] কিন্তু মূসা ভুলে গেছে।’ [১] زِينَة বলে অলংকার এবং القَوم (সম্প্রদায়) বলে ফিরআউনের সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে। কথিত আছে যে, এই সমস্ত অলংকার তারা ফিরআউনীদের কাছ হতে সাময়িক ব্যবহারের জন্য চেয়ে নিয়েছিল। সেই কারণেই وِزر এর বহুবচন أَوزَار (বোঝা বা ভার) শব্দ ব্যবহার হয়েছে। কারণ এ সব তাদের জন্য বৈধ ছিল না। মোটকথা, ঐ সমস্ত অলংকার জমা করে একটি গর্তে রাখা হল। সামেরী -- যে মুসলিমদের কিছু ভ্রষ্ট দলের মত -- ভ্রষ্ট ছিল সেও কিছু মাটি রাখল; যেমন পরে সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তারপর সে সমস্ত অলংকারকে গলিয়ে একটি এমন ধরনের বাছুর বানাল, যার ভিতর হাওয়া প্রবেশ-বাহির হওয়ার কারণে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হত। আর সেই শব্দ দ্বারাই সে বানী-ইস্রাঈলকে বিভ্রান্ত করল। সে তাদেরকে বলল, মূসা তো ভুলে গেছেন। তিনি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য ত্বুর পাহাড়ে গেছেন, অথচ মূসা ও তোমাদের উপাস্য তো এটিই।

أَفَلَا يَرَوْنَ أَلَّا يَرْجِعُ إِلَيْهِمْ قَوْلًا وَلَا يَمْلِكُ لَهُمْ ضَرًّا وَلَا نَفْعًا

📘 তবে কি ওরা ভেবে দেখে না যে, তা তাদের কথায় সাড়া দেয় না এবং তাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতাও রাখে না? [১] [১] আল্লাহ তাআলা তাদের মূর্খতা স্পষ্ট করার জন্য বলেছেন, জ্ঞানান্ধরা কি এতটুকুও বুঝতে সক্ষম নয় যে, তাদের হাতে গড়া ঐ বাছুর দেবতা তাদের কোন কথার উত্তরও দিতে পারে না, তাদের কোন লাভ-নোকসানও করতে পারে না। অথচ মা'বুদ ও উপাস্য ঐ সত্তাই হতে পারেন, যিনি সকলের মিনতি শোনা, উপকার বা অপকার করা এবং প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা রাখেন।

وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ مُوسَىٰ

📘 মূসার বৃত্তান্ত তোমার কাছে পৌঁছেছে কি?

وَلَقَدْ قَالَ لَهُمْ هَارُونُ مِنْ قَبْلُ يَا قَوْمِ إِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهِ ۖ وَإِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمَٰنُ فَاتَّبِعُونِي وَأَطِيعُوا أَمْرِي

📘 হারূন ওদেরকে পূর্বেই বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! এর দ্বারা তোমাদের কেবল পরীক্ষা করা হয়েছে। নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক পরম দয়াময়। সুতরাং তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল।’ [১] [১] হারূন (আঃ) এ কথা তখনই বলেছিলেন, যখন এই লোকেরা সামেরীর কথা অনুসারে বাছুরের পূজা শুরু করে দিয়েছিল।

قَالُوا لَنْ نَبْرَحَ عَلَيْهِ عَاكِفِينَ حَتَّىٰ يَرْجِعَ إِلَيْنَا مُوسَىٰ

📘 ওরা বলেছিল, ‘আমাদের নিকট মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা কিছুতেই এর পূজা হতে বিরত হব না।’ [১] [১] ইস্রাঈলীদেরকে বাছুর পূজা এত ভাল লেগেছিল যে, তারা হারূন (আঃ)-এর কথায় কর্ণপাত করল না এবং তার সম্মান ও ইবাদত ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাল।

قَالَ يَا هَارُونُ مَا مَنَعَكَ إِذْ رَأَيْتَهُمْ ضَلُّوا

📘 মূসা বলল, ‘হে হারূন! তুমি যখন দেখলে ওরা পথ‎ভ্রষ্ট হয়েছে, তখন কিসে তোমাকে নিবৃত্ত করল,

أَلَّا تَتَّبِعَنِ ۖ أَفَعَصَيْتَ أَمْرِي

📘 আমার অনুসরণ করা হতে? তবে কি তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে?’ [১] [১] অর্থাৎ, যদি তারা তোমার নিষেধ পালন করতে অস্বীকার করেছিল, তাহলে তোমার উচিত ছিল, সাথে সাথে ত্বুর পাহাড়ে এসে আমাকে এর খবর দেওয়া। তুমিও আমার নির্দেশের পরোয়া করনি। অর্থাৎ, তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মর্যাদা রক্ষা করনি।

قَالَ يَا ابْنَ أُمَّ لَا تَأْخُذْ بِلِحْيَتِي وَلَا بِرَأْسِي ۖ إِنِّي خَشِيتُ أَنْ تَقُولَ فَرَّقْتَ بَيْنَ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَلَمْ تَرْقُبْ قَوْلِي

📘 হারূন বলল, ‘হে আমার সহোদর! আপনি আমার দাড়ি ও মাথা (চুল) ধরবেন না। আসলে আমি আশঙ্কা করলাম যে, আপনি বলবেন, তুমি বানী ইস্রাঈলদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছ[১] এবং তুমি আমার কথার অপেক্ষা করনি।’[২] [১] মূসা (আঃ) নিজ জাতিকে শিরকের পাপে ভ্রষ্ট হতে দেখে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত ছিলেন এবং এই বুঝেছিলেন যে, হয়তো বা তাঁর ভাই হারূন যাঁকে তিনি প্রতিনিধিরূপে রেখে গিয়েছিলেন তাঁরও কিছু অবহেলা ও শৈথিল্য আছে। যার কারণে অত্যন্ত ক্রোধের সাথে হারূন (আঃ)-এর দাড়ি ও চুল ধরে টান মেরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। যার ফলে তিনি মূসা (আঃ)-কে এত কঠোরতা প্রদর্শন না করতে আবেদন জানান।[২] সূরা আ'রাফ (৭:১৪২ আয়াত) এ হারূন (আঃ)-এর উত্তর এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, লোকেরা আমাকে দুর্বল ভেবেছিল এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। যার অর্থ হল, হারূন (আঃ) নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালন করেছিলেন এবং তাদেরকে বুঝানো ও বাছুর পূজা হতে বিরত করার ব্যাপারে কোন প্রকার ত্রুটি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। কিন্তু ব্যাপারটিকে তিনি এত বাড়তে দেননি, যাতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি না হয়ে যায়। কারণ হারূন (আঃ)-কে হত্যা মানেই তাঁর সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে আপোসে রক্তপাত শুরু হয়ে যেত এবং বানী ইস্রাঈলরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ত; যারা একে অপরের রক্ত-পিপাসু হত। যেহেতু মূসা (আঃ) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, সেহেতু তিনি এ স্পর্শকাতর পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি। আর সেই কারণেই তিনি হারূন (আঃ)-এর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটি পরিষ্কার হওয়ার পর তিনি আসল অপরাধীর দিকে ফিরলেন। সুতরাং হারূন (আঃ)-এর উক্তি, 'আসলে আমি আশঙ্কা করলাম যে, আপনি বলবেন, তুমি বানী ইস্রাঈলদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথার অপেক্ষা করনি' থেকে এই দলীল নেওয়া ঠিক নয় যে, মুসলিমদের মাঝে একতা ও সংহতি বজায় রাখার স্বার্থে শিরকী কর্মকান্ড ও অন্যায়কে মেনে নেওয়া উচিত। (যেমন কিছু লোক এ ধারণা রেখে থাকে।) কারণ হারূন (আঃ) না এমন করেছিলেন, আর না তাঁর উক্তির উদ্দেশ্য এমন ছিল।

قَالَ فَمَا خَطْبُكَ يَا سَامِرِيُّ

📘 মূসা বলল, ‘হে সামেরী! তোমার ব্যাপার কি?’

قَالَ بَصُرْتُ بِمَا لَمْ يَبْصُرُوا بِهِ فَقَبَضْتُ قَبْضَةً مِنْ أَثَرِ الرَّسُولِ فَنَبَذْتُهَا وَكَذَٰلِكَ سَوَّلَتْ لِي نَفْسِي

📘 সে বলল, ‘আমি দেখলাম যা ওরা দেখেনি। অতঃপর আমি দূত (জিবরীল)এর পদচিহ্ন হতে একমুষ্ঠি ধূলা নিলাম এবং তা আমি (বাছুরের উপর) নিক্ষেপ করলাম।[১] আমার মন আমার জন্য এরূপ করা শোভন করল।’ [১] অধিকাংশ মুফাসসিরগণ الرَّسُول (দূত) বলতে জিবরীল (আঃ)-কেই বুঝিয়েছেন। আর এর অর্থ বলেছেন যে, সামেরী জিবরীলের ঘোড়া পার হতে দেখল এবং তার পায়ের নিচের কিছু মাটি নিজের কাছে রেখে নিল। যার মধ্যে কিছু অলৌকিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সে সেই মাটিকে গলিত অলংকার বা বাছুর এর ভিতর ভরে দিল; যার ফলে ওর ভিতর হতে এক ধরনের আওয়াজ বের হতে শুরু হল। আর তা তাদের ভ্রষ্টতা ও ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়াল।

قَالَ فَاذْهَبْ فَإِنَّ لَكَ فِي الْحَيَاةِ أَنْ تَقُولَ لَا مِسَاسَ ۖ وَإِنَّ لَكَ مَوْعِدًا لَنْ تُخْلَفَهُ ۖ وَانْظُرْ إِلَىٰ إِلَٰهِكَ الَّذِي ظَلْتَ عَلَيْهِ عَاكِفًا ۖ لَنُحَرِّقَنَّهُ ثُمَّ لَنَنْسِفَنَّهُ فِي الْيَمِّ نَسْفًا

📘 মূসা বললেন, ‘দূর হও! তোমার জীবদ্দশায় তোমার জন্য এটিই থাকল যে, তুমি বলবে ‘‘আমি অস্পৃশ্য’’[১] এবং তোমার জন্য থাকল এক নির্দিষ্টকাল যার ব্যতিক্রম হবে না।[২] আর তুমি তোমার সেই উপাস্যের প্রতি লক্ষ্য কর, যার পূজায় তুমি রত ছিলে, আমরা অবশ্যই ওকে জ্বালিয়ে দেব অতঃপর ওকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সাগরে নিক্ষেপ করব। [৩] [১] অর্থাৎ, তুমি সারা জীবন এটি বলতে থাকবে যে, আমার নিকট হতে দূরে থাকো, আমাকে স্পর্শ করো না বা ছুঁয়ো না। কারণ তাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে (সামেরী ও স্পর্শকারী) উভয়েই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ত। সেই কারণে যখনই সে কোন মানুষকে দেখত, তখনই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠত, 'আমাকে ছুঁয়ো না।' কথিত আছে যে, পরবর্তীতে সে মানুষের বসতি এলাকা ছেড়ে জঙ্গলে চলে যায়। সেখানে জীব-জন্তুদের সাথে তার জীবন অতিবাহিত হয় এবং সে মানুষের জন্য শিক্ষার এক নমুনা হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য যে যত বেশী বাহানা, ছল-চাতুরি ও ধোঁকাবাজি করবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার শাস্তিও সেই হিসাবে তত বেশী কঠিন ও শিক্ষণীয় হবে। [২] অর্থাৎ, আখেরাতের শাস্তি এর ভিন্ন অতিরিক্ত; যা তাকে অবশ্য-অবশ্যই ভোগ করতে হবে। [৩] এখান হতে বুঝা গেল যে, শিরকের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া; বরং তার নাম-নিশান ও অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলা দরকার, চাহে তার সম্পর্ক যত বড়ই ব্যক্তিত্বের সাথে হোক না কেন। আর এটা তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমান নয়; যেমন বিদআতী, কবর ও তাজিয়া পূজারীরা মনে করে থাকে, বরং এটি তাওহীদের উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় আত্মচেতনাবোধের দাবী। যেমন এই ঘটনায় 'দূত (জিবরীল)এর পদচিহ্ন'-এর মাহাত্ম্য খেয়াল করা হয়নি; যাতে বাহ্য-দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক বরকত দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। বরং তা সত্ত্বেও তার পরোয়া করা হয়নি। কারণ তা শিরকের মাধ্যম ও অসীলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

إِنَّمَا إِلَٰهُكُمُ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ وَسِعَ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا

📘 তোমাদের উপাস্য কেবল আল্লাহই, যিনি ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই। সর্ব বিষয় তাঁর জ্ঞানায়ত্তে।’

كَذَٰلِكَ نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَاءِ مَا قَدْ سَبَقَ ۚ وَقَدْ آتَيْنَاكَ مِنْ لَدُنَّا ذِكْرًا

📘 পূর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ আমি এইভাবে তোমার নিকট বর্ণনা করি[১] এবং নিশ্চয় আমি তোমাকে আমার নিকট হতে উপদেশ (কুরআন) দান করেছি। [২] [১] অর্থাৎ, যেরূপ আমি ফিরআউন ও মূসার ঘটনা বর্ণনা করেছি, ঠিক অনুরূপ বিগত নবীদের ঘটনাও তোমার সামনে তুলে ধরছি; যাতে তুমি তাদের সম্পর্কে অবহিত হও এবং তার মধ্যে যে সব শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে তা লোকেদের সামনে প্রকাশ কর; যাতে লোকেরা তার আলোকে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে পারে। [২] ذِكر (উপদেশ বা স্মরণ) বলতে (কুরআন আযীম)-কে বুঝানো হয়েছে। যা দ্বারা বান্দা নিজের প্রভুকে স্মরণ করে সরল পথের অনুসরণ করে, (উপদেশ গ্রহণ করে) মুক্তি তথা সুখ-সৌভাগ্যের পথ অবলম্বন করে।