🕋 تفسير سورة الإسراء
(Al-Isra) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
📘 পবিত্র ও মহিমময় তিনি[১] যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি[২] ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম হতে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আকসায়,[৩] যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়,[৪] যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই; [৫] নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ।
[১] سُبْحَانَ হল, سَبَّحَ يُسْبِّحُ এর মাসদার (ক্রিয়া বিশেষ্য)। অর্থ হল, أُنَزِّهُ اللهَ تَنْزِيْهًا অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি থেকে আল্লাহর পবিত্র ও মুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করছি। সাধারণতঃ এর ব্যবহার তখনই করা হয়, যখন অতীব গুরুতত্ত্বপূর্ণ কোন ঘটনার উল্লেখ হয়। উদ্দেশ্য এই হয় যে, বাহ্যিক উপায়-উপকরণের দিক দিয়ে মানুষের কাছে এ ঘটনা যতই অসম্ভব হোক না কেন, আল্লাহর নিকট তা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কেননা, তিনি উপকরণসমূহের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তো كُنْ শব্দ দিয়ে নিমিষে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। উপায়-উপকরণের প্রয়োজন তো মানুষের। মহান আল্লাহ এই সব প্রতিবন্ধকতা ও দুর্বলতা থেকে পাক ও পবিত্র।[২] إِسْراءٌ শব্দের অর্থ হল, রাতে নিয়ে যাওয়া। পরে لَيْلًا উল্লেখ করে রাতের স্বল্পতার কথা পরিষ্কার করা হয়েছে। আর এরই জন্য لَيْلًا 'নাকেরাহ' (অনির্দিষ্ট) এসেছে। অর্থাৎ, রাতের এক অংশে অথবা সামান্য অংশে। অর্থাৎ, চল্লিশ রাতের এই সুদীর্ঘ সফর করতে সম্পূর্ণ রাত লাগেনি; বরং রাতের এক সামান্য অংশে তা সুসম্পন্ন হয়।[৩]أَقْصَى দূরত্বকে বলা হয়। 'আল-বাইতুল মুকাদ্দাস' বা 'বাইতুল মাকদিস' ফিলিস্তীন বা প্যালেষ্টাইনের কদস অথবা জেরুজালেম বা (পুরাতন নাম) ঈলীয়া শহরে অবস্থিত। মক্কা থেকে ক্বুদ্স চল্লিশ দিনের সফর। এই দিক দিয়ে মসজিদে হারামের তুলনায় বায়তুল মাকদিসকে 'মাসজিদুল আকসা' (দূরতম মসজিদ) বলা হয়েছে।[৪] এই অঞ্চল প্রাকৃতিক নদ-নদী, ফল-ফসলের প্রাচুর্য এবং নবীদের বাসস্থান ও কবরস্থান হওয়ার কারণে পৃথক বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। আর এই কারণে একে বরকতময় আখ্যা দেওয়া হয়েছে।[৫] এটাই হল এই সফরের উদ্দেশ্য। যাতে আমি আমার এই বান্দাকে বিস্ময়কর এবং বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। তার মধ্যে এই সফরও হল একটি নিদর্শন ও মু'জিযা। সুদীর্ঘ এই সফর রাতের সামান্য অংশে সুসম্পন্ন হয়ে যায়। এই রাতেই নবী (সাঃ)-এর মি'রাজ হয় অর্থাৎ, তাঁকে আসমানসমূহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন আসমানে নবীদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সপ্তাকাশের উপরে আরশের নীচে 'সিদরাতুল মুন্তাহা'য় মহান আল্লাহ অহীর মাধ্যমে নামায এবং অন্যান্য কিছু শরীয়তের বিধি-বিধান তাঁকে দান করেন। এ ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা বহু সহীহ হাদীসে রয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত উম্মতের অধিকাংশ উলামা ও ফুকহা এই মত পোষণ করে আসছেন যে, এই মি'রাজ মহানবী (সাঃ)-এর সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে। এটা স্বপ্নযোগে অথবা আত্মিক সফর ও পরিদর্শন ছিল না, বরং তা ছিল দেহাত্মার সফর ও চাক্ষুষ দর্শন। (তা না হলে এ ঘটনাকে অস্বীকারকারীরা অস্বীকার করবে কেন?) বলা বাহুল্য, এ ঘটনা মহান আল্লাহ (অলৌকিকভাবে) তাঁর পূর্ণ কুদরত দ্বারা ঘটিয়েছেন। এই মি'রাজের দু'টি অংশ। প্রথম অংশকে 'ইসরা' বলা হয়; যার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। আর তা হল, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফর করার নাম। এখানে পৌঁছে নবী (সাঃ) সমস্ত নবীদের ইমামতি করেন। বায়তুল মাকদিস থেকে তাঁকে আবার আসমানসমূহে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এটা হল এই সফরের দ্বিতীয় অংশ। যাকে 'মি'রাজ' বলা হয়েছে। এর কিঞ্চিৎ আলোচনা সূরা নাজমে করা হয়েছে এবং বাকী বিস্তারিত আলোচনা হাদীসসমূহে বর্ণিত রয়েছে। সাধারণভাবে সম্পূর্ণ এই সফরকে 'মি'রাজ' বলে আখ্যায়িত করা হয়। 'মি'রাজ' সিড়ি বা সোপানকে বলা হয়। আর এটা রসূল (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ-নিঃসৃত শব্দ عُرِجَ بِي إِلَى السَّمَاءِ (আমাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় বা আরোহণ করানো হয়) হতে গৃহীত। কেননা, এই দ্বিতীয় অংশটা প্রথম অংশের চেয়েও বেশী গুরুতত্ত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যাপার। আর এই কারণেই 'মি'রাজ' শব্দটাই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। মি'রাজের সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, তা হিজরতের পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এক বছর পূর্বে। আবার কেউ বলেছেন, কয়েক বছর পূর্বে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপ মাস ও তার তারীখের ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, রবিউল আওয়াল মাসের ১৭ অথবা ২৭ তারীখে হয়েছে। কেউ বলেছেন, রজব মাসের ২৭ তারীখ এবং কেউ অন্য মাস ও অন্য তারীখের কথাও উল্লেখ করেছেন।
(ফাতহুল কাদীর)
(মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবা (রাঃ)গণের নিকট তারীখের কোন গুরুতত্ত্ব অথবা এ দিনকে স্মরণ ও পালন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না বলেই, তা সংরক্ষিত হয়নি। -সম্পাদক)
وَأَنَّ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
📘 আর যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাদের জন্য আমি প্রস্তুত করে রেখেছি মর্মান্তিক শাস্তি।
قُلْ لَوْ أَنْتُمْ تَمْلِكُونَ خَزَائِنَ رَحْمَةِ رَبِّي إِذًا لَأَمْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الْإِنْفَاقِ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ قَتُورًا
📘 বল, ‘যদি তোমরা আমার প্রতিপালকের দয়ার ভান্ডারের অধিকারী হতে, তবুও তোমরা ব্যয় করে (নিঃস্ব) হয়ে যাবে এই আশংকায় তা ধরে রাখতে। আসলে মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।’ [১]
[১] خَشْيَةَ الإِنْفَاقِ এর অর্থ, خَشْيَةَ أَنْ يُنْفِقُوْا فَيَفْتَقِرُوْا "এই ভয়ে যে, দান করলে ধন শেষ হয়ে যাবে এবং পরিশেষে নিঃস্ব হয়ে যাবে।" অথচ, এটা আল্লাহর ধন-ভান্ডার যা শেষ হওয়ার নয়। কিন্তু মানুষ সংকীর্ণ চিত্তের অধিকারী হওয়ায় কার্পণ্য করে। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ﴿أَمْ لَهُمْ نَصِيبٌ مِنَ الْمُلْكِ فَإِذًا لا يُؤْتُونَ النَّاسَ نَقِيرًا﴾ অর্থাৎ, "এরা যদি আল্লাহর রাজত্বের কিছু অংশ পেয়ে যায়, তবে এরা মানুষদেরকে একটি তিল পরিমাণও কিছু দেবে না।"
(সূরা নিসা ৪:৫৩ আয়াত)
খেজুরের আঁটির পিঠে যে বিন্দু থাকে সেটাকে 'নাক্বীর' বলা হয়। অর্থাৎ, সামান্য পরিমাণও কিছুই দেবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া যে, তিনি তাঁর ধন-ভান্ডারের মুখ মানুষের জন্য খুলে রেখেছেন। যেমন, হাদীসে আছে, "আল্লাহর হাত পরিপূর্ণ। তিনি রাত-দিন ব্যয় করেন, তবুও তা থেকে কিছুই কমে না। লক্ষ্য কর, যখন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকে তিনি কতই না ব্যয় করেই যাচ্ছেন, তা সত্ত্বেও তাঁর হাতে যা কিছু আছে তা থেকে কিছুই কমে যায়নি।"
(বুখারীঃ কিতাবুত্ তাওহীদ, মুসলিমঃ কিতাবুয্ যাকাত)
وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَىٰ تِسْعَ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ ۖ فَاسْأَلْ بَنِي إِسْرَائِيلَ إِذْ جَاءَهُمْ فَقَالَ لَهُ فِرْعَوْنُ إِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا مُوسَىٰ مَسْحُورًا
📘 অবশ্যই আমি মূসাকে ন’টি স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম;[১] সুতরাং তুমি বানী ইসরাঈলকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। যখন সে তাদের নিকট এসেছিল, তখন ফিরআউন তাকে বলেছিল, ‘হে মূসা! আমি তো মনে করি, তুমি নিশ্চয়ই যাদুগ্রস্ত।’
[১] নয়টি মু'জিযা (অলৌকিক ঘটনা) হল; শুভ্র হাত, লাঠি, অনাবৃষ্টি, ফল-ফসলে কমি, তুফান, পঙ্গপাল, উকুন (ছারপোকা), ব্যাঙ এবং রক্ত। ইমাম হাসান বাসরী (রঃ) বলেন, অনাবৃষ্টি এবং ফল-ফসলে কমি একই জিনিস। আর নবম মু'জিযা ছিল লাঠির যাদুকরদের ভেল্কিকে গিলে ফেলা। এ ছাড়াও মূসা (আঃ)-কে আরো মু'জিযা দেওয়া হয়েছিল। যেমন, লাঠিকে পাথরে মারলে তা থেকে ১২টি ঝরনা প্রবাহিত হয়েছিল। মেঘের ছায়া করা এবং মান্ন্ ও সালওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এখানে ৯টি নিদর্শন বলতে কেবল সেই ৯টি মু'জিযাকেই বুঝানো হয়েছে, যেগুলো ফিরআউন ও তার সম্প্রদায় দর্শন করেছিল। এই জন্য ইবনে আব্বাস (রাঃ) সমূদ্র বিদীর্ণ হয়ে পথ তৈরী হয়ে যাওয়াকেও সেই ৯টি মু'জিযার অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন এবং অনাবৃষ্টি ও ফল-ফসলে কমি এই উভয়কে একটি গণ্য করেছেন। তিরমিযীর একটি বর্ণনায় নয়টি নিদর্শনের ব্যাখ্যা এর বিপরীত করা হয়েছে। তবে সনদের দিক দিয়ে এ হাদীস দুর্বল। অতএব ন'টি স্পষ্ট নিদর্শন বলতে উল্লিখিত মু'জিযাগুলিই উদ্দেশ্য।
قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنْزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا
📘 মূসা বলেছিল, ‘তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এই সমস্ত স্পষ্ট নিদর্শনাবলী আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণ স্বরূপ; হে ফিরআউন! আমি তো দেখছি যে, তুমি ধ্বংস হয়ে গেছ।’
فَأَرَادَ أَنْ يَسْتَفِزَّهُمْ مِنَ الْأَرْضِ فَأَغْرَقْنَاهُ وَمَنْ مَعَهُ جَمِيعًا
📘 অতঃপর ফিরআউন তাদেরকে দেশ হতে উচ্ছেদ করবার ইচ্ছা করল; তখন আমি ফিরআউন ও তার সঙ্গীগণ সকলকে নিমজ্জিত করলাম ।
وَقُلْنَا مِنْ بَعْدِهِ لِبَنِي إِسْرَائِيلَ اسْكُنُوا الْأَرْضَ فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ جِئْنَا بِكُمْ لَفِيفًا
📘 এরপর আমি বানী ইস্রাঈলকে বললাম, ‘তোমরা এই দেশে বসবাস কর।[১] অতঃপর যখন কিয়ামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে, তখন তোমাদের সকলকেই আমি একত্রিত করে উপস্থিত করব।’
[১] বাহ্যিকভাবে 'এই দেশে' বলতে মিসরই উদ্দেশ্য; যেখান থেকে ফিরআউন মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে বের করে দেওয়ার ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু বানী-ইস্রাঈলের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তারা মিসর থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় মিসর যায়নি। বরং চল্লিশ বছর 'তীহ' প্রান্তরে থাকার পর ফিলিস্তীনে প্রবেশ করে। আর এই সাক্ষ্য সূরা আ'রাফ ইত্যাদিতে কুরআনের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। কাজেই সঠিক উক্তি হল, এ দেশ থেকে ফিলিস্তীনকে বুঝানো হয়েছে।
وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ ۗ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا
📘 আমি সত্যসহই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং সত্যসহই তা অবতীর্ণ হয়েছে;[১] আমি তো তোমাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। [২]
[১] অর্থাৎ, সুরক্ষিত অবস্থায় তোমার কাছে পৌঁছে গেছে। পথে এর মধ্যে কোন প্রকারের কম-বেশী এবং কোন প্রকারের পরিবর্তন ও (এর সাথে) কোন কিছুর মিশ্রণ ঘটেনি। কারণ, এটাকে নিয়ে আগমনকারী ফিরিশতা হলেন, شَدِيْدُ الْقُوَى، الأَمِيْنُ، المَكِيْنُ، المُطَاعُ فِي الْمَلاءِ الأَعْلَى (অর্থাৎ, চরম শক্তিশালী বিশ্বস্ত-আমানতদার, মর্যাদাপ্রাপ্ত, ফিরিশতার মাঝে তাঁর আনুগত্য করা হয়। তিনি হলেন ফিরিশতাদের সর্দার ও মান্যবর) এগুলি এমন গুণাবলী, যা জিবরীল (আঃ)-এর ব্যাপারে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।
[২] সুসংবাদদাতা আনুগত্যশীল মু'মিনদের জন্য এবং সতর্ককারী অবাধ্যজনদের জন্য।
وَقُرْآنًا فَرَقْنَاهُ لِتَقْرَأَهُ عَلَى النَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَاهُ تَنْزِيلًا
📘 আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি খন্ড-খন্ডভাবে[১] যাতে তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে এবং আমি তা যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি।
[১] فَرَقْنَاهُ এর দ্বিতীয় এক অর্থ, بَيَّنَّاهُ وَأَوْضَحْنَاهُ (এটাকে আমি খুলে খুলে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি)ও করা হয়েছে।
قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا ۚ إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا
📘 তুমি বল, ‘তোমরা কুরআনে বিশ্বাস কর অথবা না কর, যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয়, তখনই তারা চেহারা লুটিয়ে সিজদায় পড়ে।[১]
[১] অর্থাৎ, সেই আলেমগণ যাঁরা কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে বিগত কিতাবগুলো পড়েছেন এবং তাঁরা অহীর প্রকৃতত্ব ও রিসালাতের নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে অবগত হয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সিজদায় পড়ে যান যে, তিনি তাঁদেরকে শেষ রসূল (সাঃ)-কে চেনার তওফীক দিয়েছেন এবং কুরআন ও রিসালাতের উপর ঈমান আনার সৌভাগ্য দান করেছেন।
وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا
📘 এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র, মহান! অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়েই থাকে। [১]
[১] অর্থাৎ, মক্কার এই কাফেররা যারা প্রত্যেক বিষয়ে অজ্ঞ, তারা যদি ঈমান না আনে, তবে তুমি কোন পরোয়া করো না। কারণ, যারা জ্ঞানী এবং অহী ও রিসালাতের প্রকৃতত্ব যারা বোঝে, তারা ঈমান এনেছে। এমন কি কুরআন শুনে আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে গেছে। আর তারা তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং প্রতিপালকের অঙ্গীকারসমূহের উপর পূর্ণ বিশ্বাসও রাখে।
وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ۩
📘 আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে চেহারা লুটিয়ে (সিজদা) দেয় এবং এ (কুরআন) তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।’ [১] (সিজদাহ-৪)
[১] চেহারা লুটিয়ে সিজদায় পড়ে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কারণ, প্রথম সিজদা ছিল আল্লাহর মাহাত্ম্য, তাঁর পবিত্রতার বর্ণনা এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এবং কুরআন শুনে যে ভীতি ও বিনয়ভাব তাদের মধ্যে জন্ম নেয় এবং কুরআনের আকর্ষণ ও চমৎকারিত্বে এত বেশী তারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে যে, তা পুনরায় তাদেরকে সিজদায় পতিত করে। (এই আয়াত পাঠ করার পর সিজদা করা মুস্তাহাব। সিজদার আহকাম জানতে সূরা আ'রাফের শেষ আয়াতের ৭:২০৬ টীকা দেখুন।)
وَيَدْعُ الْإِنْسَانُ بِالشَّرِّ دُعَاءَهُ بِالْخَيْرِ ۖ وَكَانَ الْإِنْسَانُ عَجُولًا
📘 মানুষ যেভাবে কল্যাণ কামনা করে, সেভাবেই অকল্যাণ কামনা করে; বস্তুতঃ মানুষ শীঘ্রতা-প্রিয়।[১]
[১] মানুষ যেহেতু দ্রুততা প্রিয় এবং দুর্বল মনের তাই যখন সে কোন কষ্টের শিকার হয়, তখন ধ্বংসের জন্য ঐভাবে বদ্দুআ করে, যেভাবে কল্যাণের জন্য স্বীয় প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে। এটা তো প্রতিপালকের দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি তাদের বদ্দুআ কবুল করেন না। এই বিষয়টাই সূরা ইউনুসের ১০:১১ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَٰنَ ۖ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا
📘 বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহবান কর অথবা ‘রহমান’ নামে আহবান কর, তোমরা যে নামেই আহবান কর, সকল সুন্দর নামাবলী তাঁরই।[১] আর তুমি নামাযে তোমার স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; বরং এই দুই-এর মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর।[২]
[১] যেমন পূর্বেও অতিবাহিত হয়েছে যে, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহর গুণবাচক নাম 'রাহমান' ও 'রাহীম'এর সাথে পরিচিত ছিল না। আর কোন 'আষার' (সাহাবীর উক্তি)-তে এসেছে যে, মুশরিকদের কেউ কেউ যখন নবী (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ থেকে 'ইয়া রাহমান, ইয়া রাহীম' শব্দ শুনল, তখন বলে উঠল যে, এই লোক তো আমাদেরকে বলে যে, কেবল এক আল্লাহকেই ডাক, আর সে নিজে দু'জন উপাস্যকে ডাকছে! তাদের এই কথার জবাবে এই আয়াত নাযিল হয়।
(ইবনে কাসীর)
[২] এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বর্ণনা করেন যে, মক্কায় রসূল (সাঃ) আত্মগোপন করে থাকতেন। যখন তিনি তাঁর সাহাবীদের নামায পড়াতেন, তখন শব্দ একটু উঁচু করতেন। মুশকিরা কুরআন শুনে কুরআনকে এবং আল্লাহকে গালি-গালাজ করত। তাই মহান আল্লাহ বললেন, তোমার আওয়াজ এতটা উঁচু করো না যে, মুশরিকরা তা শুনে কুরআনকে গালি-গালাজ করে। আর এত আস্তেও পড়ো না যে, সাহাবীগণ তা শুনতেই না পায়।
(বুখারীঃ তাওহীদ অধ্যায়, মুসলিমঃ নামায অধ্যায়)
স্বয়ং নবী (সাঃ)-এর ঘটনা যে, কোন এক রাতে তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) খুব মৃদু আওয়াজে নামায পড়ছেন। অতঃপর উমার (রাঃ)-কেও দেখলেন যে, তিনি উঁচু শব্দে নামায পড়ছেন। তিনি তাঁদের উভয়কে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আবূ বাকার (রাঃ) বললেন, আমি যাঁর সাথে মুনাজাতে ব্যস্ত ছিলাম, তিনি আমার শব্দ শুনছিলেন। আর উমার (রাঃ) উত্তরে বললেন, আমার উদ্দেশ্য ঘুমন্তদেরকে জাগানো এবং শয়তানকে ভাগানো। তিনি আবূ বাকার (রাঃ)-কে বললেন যে, তুমি তোমার শব্দ একটু উঁচু করে নিও এবং উমর (রাঃ)-কে বললেন যে, তুমি তোমার শব্দ একটু নীচু করে নিও।
(আবূ দাউদ ও তিরমিযী)
আয়েশা (রাঃ) বলেন, এই আয়াতটি দু'আ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।
(বুখারী ও মুসলিম- ফাতহুল কাদীর)
وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ وَلِيٌّ مِنَ الذُّلِّ ۖ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا
📘 বল, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন অংশীদার নেই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না; যে কারণে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন হতে পারে।’ আর সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর।
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ ۖ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ ۚ وَكُلَّ شَيْءٍ فَصَّلْنَاهُ تَفْصِيلًا
📘 আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দু’টি নিদর্শন ও রাত্রিকে করেছি আলোকহীন এবং দিবসকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বর্ষ সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার।[১] আর আমি সব কিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। [২]
[১] রাতকে আলোকহীন অর্থাৎ, অন্ধকার বানিয়েছি, যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পার এবং তোমাদের সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আর দিনকে বানিয়েছি আলোক-উজ্জ্বল যাতে তোমরা জীবিকা উপার্জন ও প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান কর। এ ছাড়াও রাত ও দিনের দ্বিতীয় আর এক লাভ হল, এইভাবে সপ্তাহ, মাস এবং বছরের হিসাব তোমরা গণনা করতে পারবে। আর এই হিসাবেরও রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা। যদি রাতের পরে দিন এবং দিনের পরে রাত না এসে সব সময়ই রাত অথবা দিন থাকত, তবে তোমরা আরাম ও স্বস্তি লাভের অথবা কাজকর্ম করার কোন সুযোগ পেতে না। অনুরূপ মাস ও বছরের হিসাব করাও সম্ভব হত না।
[২] অর্থাৎ, মানুষের জন্য দ্বীন এবং দুনিয়ার প্রয়োজনীয় সব কথা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি। যাতে মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হয়ে স্বীয় দুনিয়াকে সুন্দর করে এবং আখেরাতকে স্মরণে রেখে তার জন্যও প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ ۖ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا
📘 প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি[১] এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে উন্মুক্ত পাবে।
[১] طَائِرٌ এর অর্থ হল পাখী। আর عُنُقٌ এর অর্থ হল ঘাড়। ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) এখানে طَائِرٌ এর অর্থ নিয়েছেন, মানুষের আমল। আর فِي عُنُقِهِ বলতে তার সেই ভাল ও মন্দ আমল, যার ভাল অথবা মন্দ প্রতিদান তাকে দেওয়া হবে। গলার হারের মত তার সাথে থাকবে। অর্থাৎ, তার সমস্ত আমল লিখা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ এই লিখিত জিনিস সুরক্ষিত থাকবে। কিয়ামতের দিন এই অনুযায়ী তার বিচার-ফায়সালা হবে। আর ইমাম শাওকানী طَائِرٌ এর অর্থ করেছেন, মানুষের ভাগ্য। যা মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের আলোকে প্রথমেই লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। যার সৌভাগ্যবান ও আল্লাহর অনুগত হওয়ার ছিল, তা আল্লাহর জানা ছিল এবং যার অবাধ্য হওয়ার ছিল, তাও তাঁর জানা ছিল। এই ভাগ্যই (সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য) প্রত্যেক মানুষের সাথে গলার হারের মত লেগে আছে। সেই অনুযায়ী হবে তার আমল এবং কিয়ামতের দিন সেই অনুযায়ীই হবে তার ফায়সালা।
اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَىٰ بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا
📘 (তাকে বলা হবে,) ‘তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’
مَنِ اهْتَدَىٰ فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ ۖ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا ۚ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ۗ وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا
📘 যারা সৎপথ অবলম্বন করবে, তারা তো নিজেদেরই মঙ্গলের জন্যই সৎপথ অবলম্বন করবে এবং যারা পথভ্রষ্ট হবে, তারা নিজেদেরই ধ্বংসের জন্যই হবে এবং কেউ অন্য কারো ভার বহন করবে না।[১] আর আমি রসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না। [২]
[১] অবশ্য যে নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকেও ভ্রষ্ট করবে, সে নিজের ভ্রষ্টতার বোঝার সাথে সাথে যাদেরকে সে স্বীয় প্রচেষ্টায় ভ্রষ্ট করেছে, তাদের গুনাহের বোঝাও (তাদের গুনাহতে কোন কমতি না করেই) তাকে বহন করতে হবে। এ কথা কুরআনের অন্য কয়েকটি স্থানে এবং বহু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আর প্রকৃতপক্ষে এটা হবে তাদেরই গুনাহের বোঝা যা অন্যদেরকে ভ্রষ্ট করে তারা অর্জন করেছে।
[২] কোন কোন মুফাসসির এ থেকে কেবল পার্থিব শাস্তিকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, আখেরাতের আযাব থেকে স্বতন্ত্র হবে না। কিন্তু কুরআনে কারীমের অন্যান্য আয়াত থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, মহান আল্লাহ মানুষদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমাদের কাছে কি আমার রসূল আসেনি? তারা ইতিবাচক উত্তর দিবে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রসূল প্রেরণ এবং গ্রন্থ অবতরণ ছাড়া তিনি কাউকে আযাব দেবেন না। তবে কোন্ জাতি বা কোন্ ব্যক্তির কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছেনি, সে ফায়সালা কিয়ামতের দিন তিনিই করবেন। সেখানে অবশ্যই কারো সাথে অবিচার করা হবে না। বধির, পাগল, নির্বোধ এবং দুই নবীর মধ্যবর্তী যুগে মৃত্যুবরণকারী (যাদের নিকট দ্বীনের খবর একেবারেই অজানা সেই) ব্যক্তিদের ব্যাপারও অনুরূপ। এদের ব্যাপারে কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তাদের প্রতি ফিরিশতা পাঠাবেন এবং ফিরিশতারা তাদেরকে বলবেন যে, 'জাহান্নামে প্রবেশ কর।' অতএব তারা যদি আল্লাহর এই নির্দেশকে মেনে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করে যায়, তাহলে জাহান্নাম তাদের জন্য ফুল বাগান হয়ে যাবে। অন্যথা তাদেরকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
(মুসনাদ আহমদ ৪/২৪, ইবনে হিব্বান ৯/২২৬, সহীহুল জামে' ৮৮১নং)
মুসলিম শিশুরা জান্নাতে যাবে। তবে কাফের ও মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে নীরব থেকেছেন। কেউ কেউ জান্নাতে যাওয়ার এবং জাহান্নামে যাওয়ার অভিমত পেশ করেছেন। ইমাম ইবনে কাসীর বলেছেন, হাশরের মাঠে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে। যারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করবে, তারা জান্নাতে এবং যারা অবাধ্যতা করবে, তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তিনি (ইবনে কাসীর) এই উক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, এর ফলে পরস্পর বিরোধী বর্ণনাগুলোর মধ্যে সমবয় সাধন করা যায়।
(বিস্তারিত জানার জন্য তাফসীর ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য)
তবে সহীহ বুখারীর বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুশরিকদের শিশুরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(দ্রষ্টব্যঃ সহীহ বুখারী ৩/২৫৭, ১২/৩৪৮ ফাতহুল বারী সহ)
وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا
📘 যখন আমি কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন ওর সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিদেরকে (সৎকর্ম করতে) আদেশ করি, অতঃপর তারা সেথায় অসৎকর্ম করে; ফলে ওর প্রতি দন্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং ওটাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি। [১]
[১] এখানে সেই মূল নীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে, যার ভিত্তিতে জাতির বিনাশ সাধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর তা হল এই যে, তাদের সচ্ছল ও ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিরা আল্লাহর আদেশ লংঘন ও নির্দেশাবলী অমান্য করতে আরম্ভ করে এবং এদের দেখাদেখি অন্যরাও তা-ই করতে শুরু করে দেয়, আর এইভাবে এই জাতির মধ্যে আল্লাহর অবাধ্যতা ব্যাপক হয়ে যায়। ফলে তারা শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হয়।
وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنَ الْقُرُونِ مِنْ بَعْدِ نُوحٍ ۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ بِذُنُوبِ عِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا
📘 নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি।[১] তোমার প্রতিপালকই তাঁর দাসদের পাপাচরণের সংবাদ রাখা ও পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট।
[১] তারাও ধ্বংসের এই মূল নীতির আওতায় পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا
📘 কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি, পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায়। [১]
[১] অর্থাৎ, প্রত্যেক দুনিয়া কামনাকারী দুনিয়া পায় না। দুনিয়া কেবল সেই পায়, যাকে আমি দেওয়ার ইচ্ছা করি। আর সেও ততটা দুনিয়া পায় না, যতটা সে চায়, বরং ততটাই সে পায়, যতটা তাকে দেওয়ার ফায়সালা আমি করি। তবে (আখেরাত বর্জন করে) এই দুনিয়া কামনার ফল হবে জাহান্নামের চিরন্তন আযাব ও লাঞ্ছনা ভোগ।
وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا
📘 যারা বিশ্বাসী হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, তাদেরই চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। [১]
[১] মহান আল্লাহর কাছে মূল্যায়নের জন্য তিনটি জিনিস এখানে বর্ণিত হয়েছে। (ক) আখেরাত কামনা। অর্থাৎ, কর্মে ইখলাস থাকা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। (খ) যথাযথ প্রচেষ্টা করা। অর্থাৎ, সুন্নাহ অনুযায়ী কর্ম করা। (গ) ঈমান থাকা। কেননা, এ ছাড়া কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ, আমল কবুল হওয়ার জন্য ঈমানের সাথে সাথে তাতে ইখলাস থাকা এবং সুন্নাহ অনুযায়ী সে আমল সম্পাদিত হওয়া জরুরী। (অন্য কথায়, প্রত্যেক আমল কবুল হওয়ার ভিত্তি হল ঈমান এবং ইখলাস ও মুহাম্মাদী তরীকা হল তার শর্ত। -সম্পাদক)
وَآتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِبَنِي إِسْرَائِيلَ أَلَّا تَتَّخِذُوا مِنْ دُونِي وَكِيلًا
📘 আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ও তা(কে) করেছিলাম বানী ইস্রাঈলের জন্য পথ-নির্দেশক; (বলেছিলাম,) তোমরা আমাকে ব্যতীত অপর কাউকেও কর্মবিধায়ক রূপে গ্রহণ করো না ।
كُلًّا نُمِدُّ هَٰؤُلَاءِ وَهَٰؤُلَاءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ ۚ وَمَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُورًا
📘 তোমার প্রতিপালক তাঁর দান দ্বারা এদের ও ওদের (পরলোককামী ও ইহলোককামী উভয়কে) সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। [১]
[১] অর্থাৎ, দুনিয়ার রুযী ও তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কোন পার্থক্য ছাড়াই মু'মিন এবং কাফের উভয়কেই দিয়ে থাকি। যে দুনিয়া কামনা করে তাকেও দিই এবং যে আখেরাত কামনা করে তাকেও দিই। আল্লাহর (পার্থিব) নিয়ামত থেকে কাউকেও বঞ্চিত করা হয় না।
انْظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا
📘 লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের এক দলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। আর নিশ্চয়ই পরকাল মর্যাদায় বৃহত্তর ও মাহাত্ম্যেও শ্রেষ্ঠতর। [১]
[১] তবে দুনিয়ার এই ভোগ-সম্ভার কেউ কম পায়, কেউ বেশী। মহান আল্লাহ স্বীয় কৌশলের ভিত্তিতে এবং ভাল-মন্দের দিক বিবেচনা করে তা বণ্টন করে থাকেন। আখেরাতে কিন্তু মর্যাদার মধ্যে তফাৎ স্পষ্টরূপে বিকশিত হবে। আর তা হবে এইভাবে যে, ঈমানদাররা জান্নাতে এবং কাফেররা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولًا
📘 আল্লাহর সাথে অপর কোন উপাস্য স্থির করো না; করলে নিন্দিত ও নিঃসহায় হয়ে যাবে।
۞ وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
📘 তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের এক জন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে (বিরক্তিসূচক শব্দ) ‘উঃ’ বলো না এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করো না; বরং তাদের সাথে বলো সম্মানসূচক নম্র কথা। [১]
[১] এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও তাঁদের খেদমত করার এবং তাঁদের প্রতি আদব ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার কত যে গুরুত্ব তা পরিষ্কার হয়ে যায়। অর্থাৎ, প্রতিপালকের প্রতিপালকত্বের দাবীসমূহের সাথে সাথে পিতা-মাতার দাবীসমূহ পূরণ করাও অত্যাবশ্যক। হাদীসসমূহেও এর গুরুত্ব এবং এর প্রতি চরম তাকীদ করা হয়েছে। বিশেষ করে বার্ধক্যে তাঁদেরকে 'উঃ' শব্দটিও বলতে এবং তাঁদেরকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন। কেননা, বার্ধক্যে তাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে যান। পক্ষান্তরে সন্তানরা হয় সবল এবং উপার্জন-সক্ষম ও (সংসারের সব কিছুর) ব্যবস্থাপক। এ ছাড়া যৌবনের উন্মাদনাময় উদ্যম এবং বার্ধক্যের ভুক্তপূর্ব স্নিগ্ধ ও উষ্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই সব অবস্থায় পিতা-মাতার প্রতি আদব ও শ্রদ্ধার দাবীসমূহের খেয়াল রাখার মুহূর্তটা হয় অতীব কঠিন। তাই আল্লাহর কাছে সন্তোষভাজন সেই-ই হবে, যে তাঁদের শ্রদ্ধার দাবী পূরণ ও প্রাপ্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হবে।
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
📘 অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো[১] এবং বলো, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া কর; যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছে।’
[১] পাখী যখন তার বাচ্চাদেরকে নিজ করুণার ছায়ায় রাখতে চায়, তখন তাদের জন্য নিজের ডানাকে নত করে দেয়। অর্থাৎ, তুমিও পিতা-মাতার সাথে ঐরূপ উত্তম এবং করুণাসিক্ত আচরণ কর। আর তাঁদের ঐরূপ সেবাযত্ন কর, যেরূপ তাঁরা তোমার সেবাযত্ন করেছিলেন; যখন তুমি শিশু ছিলে। অথবা এর অর্থ হল, পাখী যখন উড়ার এবং ঊর্ধ্বে যাওয়ার ইচ্ছা করে, তখন তার ডানা দু'টিকে প্রসারিত করে দেয়। আর যখন নীচে অবতরণ করার ইচ্ছা করে, তখন ডানা দু'টি গুটিয়ে নেয়। এই দিক দিয়ে বাজু বিছিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে, পিতা-মাতার সামনে নম্র ও বিনয়ী হয়ে যাও।
رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ ۚ إِنْ تَكُونُوا صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِينَ غَفُورًا
📘 তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা তোমাদের প্রতিপালক অধিক জানেন; তোমরা সৎকর্মপরায়ণ হলে, যারা সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল।
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
📘 তুমি আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য প্রদান কর এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও।[১] আর কিছুতেই অপব্যয় করো না।
[১] কুরআন কারীমের এই শব্দগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন এবং অভাবী মুসাফিরদের সাহায্য করে তার উপর অনুগ্রহ প্রকাশ করা উচিত নয়। যেহেতু এটা তাদের প্রতি অনুগ্রহ নয়, বরং এটা হল মালের সেই অধিকার, যা মহান আল্লাহ ধনীদের ধন-সম্পদে উল্লিখিত অভাবীদের জন্য নির্ধারিত করেছেন। ধনী যদি এ অধিকার আদায় না করে, তবে সে আল্লাহর নিকট অপরাধী গণ্য হবে। অর্থাৎ, এটা হল অধিকার আদায় করা, কারো উপর অনুগ্রহ করা নয়। আর আত্মীয়-স্বজনদের কথা প্রথমে উল্লেখ করে এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের অধিকার বেশী ও প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য। আত্মীয়-স্বজনদের অধিকারসমূহ আদায় এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করাকে আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া (বা জ্ঞাতিবন্ধন বজায় রাখা) বলা হয়। এর উপর ইসলামের বড়ই তাকীদ রয়েছে।
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
📘 নিশ্চয় যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। [১]
[১] تَبْذِيْرٌ এর মূল ধাতু হল بِذْرٌ (বীজ)। যেমন যমীনে বীজ ফেলার সময় এটা লক্ষ্য করা হয় না যে, তা যথাস্থানে পড়ছে, না যেখানে সেখানে পড়ে যাচ্ছে। বরং চাষী বীজ ফেলেই চলে যায়। تَبْذِيْرٌ (অপব্যয়ে)ও এটাই হয়। মানুষ তার মাল বীজ ফেলার মত ছড়াতে থাকে এবং ব্যয় করার ব্যাপারে শরীয়তের সীমা অতিক্রম করে। কেউ কেউ বলেছেন, تَبْذِيْر হল, অবৈধ কার্যকলাপে ব্যয় করা, যদিও তা সামান্য হয়। আমাদের জানা মতে উভয় অবস্থাই تَبْذِيْر (অপব্যয়)এর পর্যায়ভুক্ত। আর এটা এত বড় জঘন্য কাজ যে, এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শয়তানের সাথে রয়েছে পূর্ণ সাদৃশ্য। অথচ শয়তানের সাদৃশ্য গ্রহণ করা থেকে দূরে থাকা মানুষের জন্য ওয়াজেব; যদি তা (শয়তানের) কোন একটি অভ্যাসেও হয়। এ ছাড়া শয়তানকে كَفُوْرٌ (অতিশয় অকৃতজ্ঞ) বলে তার মত না হতে আরো তাকীদ করা হয়েছে। অর্থাৎ, যদি তুমি শয়তানের সাদৃশ্য গ্রহণ কর, তাহলে (তুমি তার ভাই হবে এবং) তুমিও তার মত كَفُوْرٌ (অকৃতজ্ঞ) বিবেচিত হয়ে যাবে।
(ফাতহুল কাদীর)
وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِنْ رَبِّكَ تَرْجُوهَا فَقُلْ لَهُمْ قَوْلًا مَيْسُورًا
📘 তুমি নিজেই যখন তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন প্রত্যাশিত করুণা লাভের সন্ধানে থাকো, তখন তাদেরকে যদি বিমুখই কর, তাহলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো। [১]
[১] অর্থাৎ, আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে --যা দূরীভূত হওয়ার এবং রুযীর প্রসারতার তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে আশা রাখ-- যদি তোমাকে গরীব আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন এবং অভাবী ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় অর্থাৎ, (কিছু দিতে না পারার) ওজর পেশ করতে হয়, তবে তাও নরম ও উত্তম পন্থায় পেশ করবে। অর্থাৎ, (দিতে পারব না এ) উত্তরও যেন দেওয়া হয় মমতা ও ভালবাসাপূর্ণ ভঙ্গিমায়। কর্কশ ভাষায় ও অভদ্রতার সাথে নয়; যা সাধারণতঃ ধনীরা ভিক্ষুক ও অভাবী মানুষদের সাথে করে থাকে।
وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
📘 তুমি বদ্ধমুষ্টি হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না; হলে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত (নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।[১]
[১] পূর্বের আয়াতে ওজর পেশ করার আদবের কথা বলা হয়েছে। এই আয়াতে ব্যয় করার আদব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আর তা হল, মানুষ এমন কৃপণও হবে না যে, নিজের ও পরিবারবর্গের প্রয়োজনেও ব্যয় করবে না। আর এমন মুক্তহস্তও হবে না যে, নিজ শক্তি ও সামর্থ্যের দিকে লক্ষ্য না করে বেহিসাব ব্যয় করে অপব্যয় ও নিঃস্বতার শিকার হবে। কৃপণতার ফলে মানুষ তিরস্কৃত ও নিন্দিত গণ্য হবে এবং অপব্যয়ের ফলে অবসাদগ্রস্ত ও অনুতপ্ত হবে। محسور বলা হয় এমন পশুকে যে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। অপব্যয়কারীও পরিশেষে হাত শূন্য করে বসে যায়। 'বদ্ধমুষ্টি হয়ো না' বা 'নিজ হাতকে গর্দানের সাথে বেঁধে রেখো না' অর্থঃ ব্যয়কুণ্ঠ কৃপণ হয়ো না। আর 'একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না' অর্থঃ অপব্যয় করো না। مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا হল لَفُّ نَشْرٍ مُرَتَّبٌ অর্থাৎ, তিরস্কার হল কৃপণতার এবং অনুতাপ হল অপব্যয়ের কুফল।
ذُرِّيَّةَ مَنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ ۚ إِنَّهُ كَانَ عَبْدًا شَكُورًا
📘 তোমরাই তো তাদের বংশধর, যাদেরকে আমি নূহের সাথে (কিশতীতে) আরোহণ করিয়েছিলাম, নিশ্চয় সে ছিল পরম কৃতজ্ঞ দাস। [১]
[১] নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের পর মানব বংশের উৎপত্তি তাঁর (নূহ (আঃ)) সেই ছেলেদের থেকে হয়েছে, যারা নূহ (আঃ) এর কিশতীতে সওয়ার ছিল এবং প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই জন্য বানী-ইস্রাঈলকে সম্বোধন করে বলা হল যে, তোমাদের পিতা নূহ (আঃ) আল্লাহর বড়ই কৃতজ্ঞ বান্দা ছিলেন। অতএব তোমরাও তোমাদের পিতার ন্যায় কৃতজ্ঞতার পথ অবলম্বন কর এবং আমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে যে রসূল বানিয়ে প্রেরণ করেছি তাকে অস্বীকার করে সে নিয়ামতের কুফরী করো না।
إِنَّ رَبَّكَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ ۚ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا
📘 তোমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছা তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা হ্রাস করেন; [১] নিশ্চয় তিনি তাঁর দাসদেরকে ভালভাবে জানেন ও দেখেন।
[১] এতে ঈমানদারদের জন্য রয়েছে সান্তনা। তাঁদের কাছে রুযী ও বিলাস-উপকরণের প্রাচুর্য না থাকলেও তার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর নিকট তাঁদের সম্মান নেই, বরং রুযীতে প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতার সম্পর্ক তো আল্লাহর হিকমত ও কৌশলের সাথে; যার খবর কেবল তিনিই জানেন। তিনি তাঁর শত্রুদেরকে কারূন বানিয়ে দেন এবং তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে এতটাই দেন যে, কোন রকমে তাদের চলে যায়। এ সবই তাঁর ইচ্ছার ব্যাপার। অধিক সম্পদ-সম্পত্তির মালিক (ধনী) তাঁর প্রিয় নয় এবং জীবন ধারণের মত সামান্য উপকরণের মালিক (গরীব) তাঁর অপ্রিয় নয়।
(অনুরূপ এর বিপরীত হওয়াও জরুরী নয়। -সম্পাদক)
وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ ۖ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ ۚ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا
📘 তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা দারিদ্র্য-ভয়ে হত্যা করো না, আমিই তাদেরকে জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ। [১]
[১] এই নির্দেশ সূরা আনআম ৬:১৫১ নং আয়াতেও উল্লেখ হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সাঃ) শিরকের পর যে গুনাহকে সবচেয়ে বড় গণ্য করেছেন, তা হল এই ((أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ)) "তোমার নিজ সন্তানকে এই ভয়ে হত্যা করা যে, সে তোমার সাথে খাবে।"
(বুখারীঃ তাফসীর সূরা বাকারা, আদব অধ্যায়, মুসলিমঃ তাওহীদ অধ্যায়)
ইদানীং সন্তান হত্যার এই মহাপাপ অতীব সুশৃঙ্খল নিয়মে 'জন্মনিয়ন্ত্রণ'-এর সুন্দর নামে সারা পৃথিবীতে চলছে। পুরুষরা 'উত্তম শিক্ষা ও তরবিয়ত' (বা 'ছোট পরিবার, সুখী সংসার') এর নামে এবং মহিলারা তাদের দেহের 'সুষমা' অক্ষয় রাখার জন্য ব্যাপকহারে ('আমরা দুই আমাদের দুই' শ্লোগান দিয়ে) এই অপরাধ করে চলেছে। أَعَاذَنَا اللهُ مِنْهُ।
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا ۖ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
📘 তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। [১]
[১] ইসলামে ব্যভিচার যেহেতু বড়ই অপরাধমূলক কাজ; এত বড় অপরাধ যে, কোন বিবাহিত পুরুষ অথবা মহিলার দ্বারা এ কাজ হয়ে গেলে, ইসলামী সমাজে তার জীবিত থাকার অধিকার থাকে না। আবার তাকে তরবারির এক আঘাতে হত্যা করাও যথেষ্ট হয় না, বরং নির্দেশ হল, পাথর মেরে মেরে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। যাতে সে সমাজে (অন্যদের জন্য) শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে যায়। সেহেতু এখানে বলা হয়েছে, ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। অর্থাৎ, তাতে উদ্বুদ্ধকারী উপায়-উপকরণ থেকেও দূরে থাক। যেমন, 'গায়ের মাহরাম' (যার সাথে বিবাহ হারাম নয় এমন বেগানা) নারীকে দেখা-সাক্ষাৎ করা, তার সাথে অবাধ মেলামেশার ও কথা বলার পথ সুগম করা। অনুরূপ মহিলাদের সাজ-সজ্জা করে বেপর্দার সাথে বাড়ী থেকে বের হওয়া ইত্যাদি যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা জরুরী। যাতে এই ধরনের অশ্লীলতা থেকে বাঁচা যায়।
وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ۗ وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا فَلَا يُسْرِفْ فِي الْقَتْلِ ۖ إِنَّهُ كَانَ مَنْصُورًا
📘 আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না; [১] কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি। সুতরাং হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত। [২]
[১] যথার্থ কারণে হত্যাঃ যেমন হত্যার বদলে হত্যা করা। যাকে মানুষের জীবন এবং নিরাপত্তার ও শান্তির কারণ গণ্য করা হয়েছে। অনুরূপ বিবাহিত ব্যভিচারীকে এবং মুরতাদ (ধর্মত্যাগী)-কে হত্যা করার নির্দেশ আছে।
[২] অর্থাৎ, নিহতের উত্তরাধিকারীদের এ অধিকার বা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে, তারা হত্যাকারীকে ক্ষমতাসীন শাসক কর্তৃক শরীয়তী ফায়সালার পর খুনের বদলে খুন নিয়ে তাকে হত্যা করবে অথবা তার নিকট থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করবে কিংবা তাকে ক্ষমা করে দেবে। আর যদি খুনের বদলে খুনই করতে চায়, তবে তাতে যেন বাড়াবাড়ি না করে। অর্থাৎ, একজনের পরিবর্তে দু'জনকে যেন হত্যা না করে অথবা তার যেন অঙ্গবিকৃতি না ঘটায় অথবা নানা কষ্ট দিয়ে যেন তাকে হত্যা না করে। নিহতের ওয়ারেস 'সাহায্যপ্রাপ্ত' অর্থাৎ, নেতা ও শাসকদেরকে তার সাহায্য করার তাকীদ করা হয়েছে। কাজেই এর জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। বাড়াবাড়ি করে তাঁর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত নয়।
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۚ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا
📘 সাবালক না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্যে ছাড়া এতীমের সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না।[১] আর প্রতিশ্রুতি পালন করো; নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। [২]
[১] অবৈধভাবে কারো জান নষ্ট করতে নিষেধ করার পর এখানে মাল নষ্ট করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আর ইয়াতীমের মালের ব্যাপারটা যেহেতু বেশী গুরুতত্ত্বপূর্ণ তাই বললেন, ইয়াতীমের সাবালক হওয়া পর্যন্ত তার মালকে এমন কাজে লাগাও যাতে তার লাভ হয়। চিন্তা-ভাবনা না করেই এমন ব্যবসায় লাগিয়ে দিও না, যাতে তা (মাল) নষ্ট হয়ে যায় অথবা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিংবা সাবালক হওয়ার পূর্বেই তার মাল নিঃশেষ হয়ে যায়।
[২] 'প্রতিশ্রুতি' বা অঙ্গীকার বলতে সেই অঙ্গীকার যা আল্লাহ ও বান্দাদের মধ্যে রয়েছে এবং সেই অঙ্গীকারও যা বান্দাগণ আপোসে একে অপরের সাথে করে থাকে। উভয় অঙ্গীকার পূরণ করা জরুরী। পক্ষান্তরে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে কাল কিয়ামতে জিজ্ঞাসিত হতে হবে এবং সে ব্যাপারে কৈফিয়ত দিতে হবে।
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
📘 মেপে দেয়ার সময় পূর্ণরূপে মাপো এবং সঠিক দাঁড়ি-পাল্লায় ওজন কর, এটাই উত্তম[১] ও পরিণামে উৎকৃষ্টতম।
[১] নেকীর দিক দিয়ে উত্তম। এ ছাড়াও মানুষের মাঝে বিশ্বস্ততা জন্মানোর জন্য ওজন ও মাপে ঈমানদারী (ব্যবসার জন্য) বড়ই ফলপ্রসূ।
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا
📘 যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। [১] নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে। [২]
[১] قَفَا يَقْفُوْ এর অর্থ পিছনে পড়া। অর্থাৎ, যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়ো না। আন্দাজে কথা বলো না। অর্থাৎ, কারো প্রতি কুধারণা করো না। কারো ছিদ্রান্বেষণ করো না। অনুরূপ যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার উপর আমলও করো না।
[২] অর্থাৎ, যে জিনিসের পিছনে পড়বে, সে ব্যাপারে কানকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, সে কি শুনেছিল? চোখকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, সে কি দেখেছিল? এবং অন্তরকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, সে কি জেনেছিল? কারণ, এই তিনটিই হল জানার মাধ্যম। অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ এই অঙ্গগুলোকে বাকশক্তি দান করবেন এবং তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا
📘 ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি তো কখনোই পদভারে ভূ-পৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত-প্রমাণ হতে পারবে না। [১]
[১] অহংকার ও দাম্ভিকতার সাথে চলা আল্লাহর নিকট অতীব অপছন্দনীয়। এই অপরাধের কারণেই কারূনকে তার প্রাসাদ ও ধন-ভান্ডার সমেত যমীনে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
(সূরা কাসাস ২৮:৮১ আয়াত)
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি দু'টি চাদর পরিধান করে অহংকারের সাথে চলছিল। ফলে তাকে যমীনে ধসিয়ে দেওয়া হয় এবং সে কিয়ামত পর্যন্ত ধসেই যেতে থাকবে।
(মুসলিমঃ কিতাবুল লিবাস, পরিচ্ছেদঃ দম্ভভরে যমীনে চলা হারাম---)
মহান আল্লাহ বিনয় ও নম্রতা পছন্দ করেন।
كُلُّ ذَٰلِكَ كَانَ سَيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوهًا
📘 এ সবের মধ্যে যেগুলি মন্দ সেগুলি তোমার প্রতিপালকের নিকট ঘৃণ্য। [১]
[১] অর্থাৎ, যে কথাগুলো উল্লেখ করা হল, তার মধ্যে যেগুলো মন্দ ও নিষিদ্ধ তা অপছন্দনীয় ও ঘৃণ্য।
ذَٰلِكَ مِمَّا أَوْحَىٰ إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ ۗ وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتُلْقَىٰ فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا
📘 তোমার প্রতিপালক অহী (প্রত্যাদেশ) দ্বারা তোমাকে যে হিকমত দান করেছেন এগুলি তার অন্তর্ভুক্ত; তুমি আল্লাহর সাথে কোন উপাস্য স্থির করো না, করলে তুমি নিন্দিত ও আল্লাহর অনুগ্রহ হতে দূরীকৃত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
وَقَضَيْنَا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
📘 আর আমি (তাওরাত) কিতাবে বানী ইস্রাঈলকে জানিয়েছিলাম যে, নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দু-দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকারস্ফীত হবে ।
أَفَأَصْفَاكُمْ رَبُّكُمْ بِالْبَنِينَ وَاتَّخَذَ مِنَ الْمَلَائِكَةِ إِنَاثًا ۚ إِنَّكُمْ لَتَقُولُونَ قَوْلًا عَظِيمًا
📘 তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে পুত্র সন্তানের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং তিনি নিজে ফিরিশতাদেরকে কন্যারূপে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো নিশ্চয়ই বিরাট কথা বলে থাকো।
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ لِيَذَّكَّرُوا وَمَا يَزِيدُهُمْ إِلَّا نُفُورًا
📘 এই কুরআনে বহু কথাই আমি বারবার (বিভিন্নভাবে) বিবৃত করেছি,[১] যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে; কিন্তু তাতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।
[১] 'বারবার (বিভিন্নভাবে) বিবৃত' করার অর্থ, কখনো ওয়াজ ও নসীহত রূপে, কখনো প্রমাণাদি পেশ করে, আশা দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে এবং বহু দৃষ্টান্ত ও উপমা দিয়ে, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী উল্লেখ করে বিভিন্নভাবে একই কথা বারবার বিবৃত হয়েছে; যাতে মানুষ বুঝতে ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তারা কুফরী ও শিরকের অন্ধকারে এমনভাবে ডুবে আছে যে, তারা সত্যের নিকটবর্তী হওয়ার পরিবর্তে তা হতে আরো দূরে সরে গেছে। কারণ, তারা মনে করে যে, এই কুরআন যাদু, গণকের কথা এবং কবির কাব্যগ্রন্থ। অতএব এই কুরআন থেকে কিভাবে তারা সুপথ পেতে পারে? কেননা, কুরআনের দৃষ্টান্ত হল বৃষ্টির মত। যদি তা (বৃষ্টি) উর্বর ভূমিতে বর্ষায়, তবে তার দ্বারা শস্য-শ্যামল ভূমিতে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু যদি তা কোন নোংরা ভূমিতে পড়ে, তবে বৃষ্টির কারণে তার দুর্গন্ধ আরো বেড়ে যায়।
قُلْ لَوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ إِذًا لَابْتَغَوْا إِلَىٰ ذِي الْعَرْشِ سَبِيلًا
📘 বল, তাদের কথামত যদি তাঁর সাথে আরো উপাস্য থাকত, তবে তারা আরশ অধিপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার উপায় অন্বেষণ করত। [১]
[১] এর একটি অর্থ হল এই যে, যেভাবে একজন বাদশাহ অন্য বাদশাহর উপর সসৈন্যে আক্রমণ করে তার উপর বিজয় ও আধিপত্য অর্জন করার চেষ্টা করে, ঠিক এইভাবে এই দ্বিতীয় উপাস্যও আল্লাহর উপর জয়যুক্ত হওয়ার পথ অন্বেষণ করত। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ রকম হয়নি। অথচ বহু শতাব্দী ধরে এই উপাস্যগুলোর পূজা হয়ে আসছে। যার অর্থ এই হয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্যই নেই। কোন ক্ষমতাবান সত্তাই নেই। কোন ইষ্টানিষ্টের মালিক নেই। দ্বিতীয় অর্থ হল, তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে নিত এবং এই মুশরিকরা যারা এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, এদের মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবে, এদেরকেও এই উপাস্যগুলো আল্লাহর নৈকট্য দান করত।
سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يَقُولُونَ عُلُوًّا كَبِيرًا
📘 তিনি পবিত্র, মহিমার্নিত এবং তারা যা বলে, তা হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। [১]
[১] অর্থাৎ, প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, আল্লাহ সম্পর্কে এই লোকেরা যে বলে, তাঁর শরীক আছে, মহান আল্লাহ এই সমস্ত কথাবার্তা থেকে পাক-পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে।
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ ۚ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا
📘 সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু ওদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। [১] নিশ্চয় তিনি অতীব সহনশীল, অত্যন্ত ক্ষমাশীল।
[১] অর্থাৎ, সকলেই তাঁর অনুগত এবং তারা স্ব স্ব নিয়মে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণায় ও প্রশংসায় লিপ্ত আছে। যদিও আমরা তাদের পবিত্রতা ঘোষণা ও প্রশংসা করার কথা বুঝতে পারি না। এর সমর্থন কুরআনের আরো কিছু আয়াত দ্বারাও হয়। যেমন, দাঊদ (আঃ)-এর সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন,﴿إِنَّا سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَهُ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ﴾ অর্থাৎ, আমি পর্বতসমূহকে তাঁর অনুগামী করে দিয়েছিলাম, তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করত।
(সূরা সাদ ৩৮:১৮ আয়াত)
কোন কোন পাথরের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ﴾ অর্থাৎ, কোন কোন পাথর আল্লাহর ভয়ে খসে পড়ে।
(সূরা বাকারাহ ২:৭৪ আয়াত)
কোন কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা রসূল (সাঃ)-এর সাথে খাবার খাওয়ার সময় খাবার থেকে 'তসবীহ' পড়ার ধ্বনি শুনেছেন।
(বুখারী, কিতাবুল মানাকিব ৩৫৭৯ নং)
অপর একটি হাদীসে এসেছে যে, পিঁপড়েরাও আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে।
(বুখারী ৩০১৯, মুসলিম ১৭৫৯নং)
অনুরূপ খেজুর গাছের যে গুঁড়িতে হেলান দিয়ে রসূল (সাঃ) খুৎবা দিতেন, যখন কাঠের মিম্বর তৈরী হল এবং সেই গুঁড়িকে তিনি ত্যাগ করলেন, তখন তা থেকে শিশুর মত কান্নার শব্দ এসেছিল।
(বুখারী ৩৫৮৩ নং)
মক্কায় একটি পাথর ছিল, যে রসূল (সাঃ)-কে সালাম দিত।
(মুসলিম ১৭৮২ নং)
এই আয়াত এবং হাদীসসমূহ হতে স্পষ্ট হয় যে, জড় পদার্থ এবং উদ্ভিদ জিনিসের মধ্যেও এক বিশেষ ধরনের অনুভূতি (জীবন) আছে, যদিও তা আমরা বুঝতে পারি না। তারা কিন্তু এই অনুভূতির ভিত্তিতে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ, প্রামাণ্য তসবীহ। অর্থাৎ, এই জিনিসগুলো প্রমাণ করে যে, সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা এবং সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান কেবল মহান আল্লাহ। وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ * تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِدٌ 'প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে রয়েছে নিদর্শন, যা প্রমাণ করে যে, তিনি এক ও অদ্বিতীয়।
(শুআবুল ঈমান বাইহাকী
)
তবে সঠিক কথা এটাই যে, 'তসবীহ' তার প্রকৃত ও মূল অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
وَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ جَعَلْنَا بَيْنَكَ وَبَيْنَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ حِجَابًا مَسْتُورًا
📘 তুমি যখন কুরআন পাঠ কর, তখন তোমার ও যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাদের মধ্যে এক আবরক পর্দা করে দিই। [১]
[১] مَسْتُوْرٌ অর্থ হল سَاتِر (আবরক বা অন্তরাল) অথবা مستور عن الأبصار (চোখের অন্তরালে) তাই তারা তা দেখে না। এ ছাড়াও তাদের ও হিদায়াতের মধ্যে রয়েছে অন্তরায়।
وَجَعَلْنَا عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آذَانِهِمْ وَقْرًا ۚ وَإِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِي الْقُرْآنِ وَحْدَهُ وَلَّوْا عَلَىٰ أَدْبَارِهِمْ نُفُورًا
📘 আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি, যেন তারা উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা দিয়েছি। আর যখন তুমি তোমার প্রতিপালকের একত্বের কথা কুরআনে উল্লেখ কর, তখন তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে সরে পড়ে। [১]
[১] أَكِنَّةٌ হল, كِنَانٌ এর বহুবচন। এমন পর্দা, যা অন্তঃকরণে পড়ে। وَقْرٌ কানের এমন বোঝা বা ছিদ্র বন্ধ করার এমন জিনিস যা কুরআন শোনার পথে প্রতিবন্ধক হয়। অর্থাৎ, তাদের অন্তর কুরআন উপলব্ধি করতে অক্ষম এবং কান কুরআন শুনে হিদায়াত লাভ করতে অপারগ। আর আল্লাহর তাওহীদকে তারা এত ঘৃণা করে যে, তা শুনে পালিয়ে যায়। আল্লাহর সাথে এই কাজগুলোর সম্পর্ক কেবল সৃষ্টির দিক দিয়ে, অন্যথা হিদায়াত থেকে তাদের বঞ্চিত হওয়া তাদেরই অবাধ্যতার ফল।
نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَسْتَمِعُونَ بِهِ إِذْ يَسْتَمِعُونَ إِلَيْكَ وَإِذْ هُمْ نَجْوَىٰ إِذْ يَقُولُ الظَّالِمُونَ إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَسْحُورًا
📘 যখন তারা কান পেতে তোমার কথা শোনে, তখন তারা কেন কান পেতে তা শোনে তা আমি ভাল করে জানি এবং এটাও জানি যে, গোপনে আলোচনাকালে সীমালংঘনকারীরা বলে, ‘তোমরা তো এক যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ।’ [১]
[১] অর্থাৎ, নবী (সাঃ)-কে এরা যাদুগ্রস্ত মনে করে এবং এই মনে করেই কুরআন শোনে ও আপোসে গোপনে আলোচনা করে, ফলে হিদায়াত থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়।
انْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوا فَلَا يَسْتَطِيعُونَ سَبِيلًا
📘 দেখ, তারা তোমার কি উপমা দেয়! তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা পথ পাবে না। [১]
[১] কখনো যাদুকর, কখনো যাদুগ্রস্ত, কখনো উন্মাদ এবং কখনো জ্যোতিষী বলে আখ্যায়িত করে। আর এইভাবে তারা ভ্রষ্টতায় রয়েছে। সুতরাং হিদায়াতের পথ তারা কিভাবে পেতে পারে?
وَقَالُوا أَإِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا
📘 তারা বলে, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরুত্থিত হব?’
فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ أُولَاهُمَا بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَنَا أُولِي بَأْسٍ شَدِيدٍ فَجَاسُوا خِلَالَ الدِّيَارِ ۚ وَكَانَ وَعْدًا مَفْعُولًا
📘 অতঃপর এই দু-এর প্রথম প্রতিশ্রুত কাল যখন উপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলাম আমার কঠোর রণ-কুশলী বীর দাসদেরকে; যারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করল; আর এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হওয়ারই ছিল। [১]
[১] এখানে সেই লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা ব্যাবিলনের (অগ্নিপূজক) শাসক বুখতে নাসরের (বা বুখতে নাসসারের) হাতে খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ছয়শ' সালে জেরুজালেমে ইয়াহুদীদের উপর আপতিত হয়েছিল। সে নির্বিচারে ব্যাপকভাবে ইয়াহুদীদেরকে হত্যা করেছিল এবং বহু সংখ্যক ইয়াহুদীকে দাস বানিয়েছিল। আর এটা তখন হয়েছিল, যখন তারা আল্লাহর একজন নবী শা'য়া (আঃ)-কে হত্যা অথবা আরমিয়া (আঃ)-কে বন্দী করেছিল এবং তাওরাতের বিধি-বিধানকে অমান্য করে অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করার অপরাধ করেছিল। কেউ বলেন, বুখতে নাসরের পরিবর্তে মহান আল্লাহ জালূতকে শাস্তি স্বরূপ তাদের উপর আধিপত্য দান করেছিলেন। সে তাদের উপর সীমাহীন যুলুম ও অত্যাচারের রুলার চালিয়েছিল। পরে ত্বালূতের নেতৃত্বে দাউদ (আঃ) তাকে হত্যা করেছিলেন।
۞ قُلْ كُونُوا حِجَارَةً أَوْ حَدِيدًا
📘 বল, ‘তোমরা হয়ে যাও পাথর অথবা লোহা। [১]
[১] যা মাটি ও হাড় থেকেও শক্ত; যাতে জীবন সঞ্চার করা অতি কঠিন।
أَوْ خَلْقًا مِمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ ۚ فَسَيَقُولُونَ مَنْ يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ ۖ قُلْ عَسَىٰ أَنْ يَكُونَ قَرِيبًا
📘 অথবা এমন কোন সৃষ্টি যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন।’[১] তারা বলবে, ‘কে আমাদেরকে পুনরুত্থিত করবে?’ বল, ‘তিনিই যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন।’ অতঃপর তারা তোমার সামনে মাথা নাড়বে[২] ও বলবে, ‘ওটা কবে?’ বল, ‘সম্ভবতঃ তা নিকটেই।[৩]
[১] অর্থাৎ, তোমাদের জানা মতে এর থেকেও অধিক শক্ত জিনিস হয়ে যাও এবং তারপর জিজ্ঞাসা কর যে, কে জীবিত করবে?
[২] أَنْغَضَ يُنْغِضُ এর অর্থ হল, মাথা নাড়া। অর্থাৎ, বিদ্রূপ স্বরূপ মাথা নেড়ে তারা বলবে, পুনর্জীবন কখন হবে?
[৩] নিকটেই বলতে যা সংঘটিত হবেই। যেহেতু كُلُّ مَا هُوَ آتٍ فَهُوَ قَرِيْبٌ ঘটবে এমন প্রত্যেকটি জিনিসই নিকটে। عَسى (সম্ভবতঃ) শব্দটিও কুরআনে নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবীর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, কিয়ামত সংঘটন সুনিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী।
يَوْمَ يَدْعُوكُمْ فَتَسْتَجِيبُونَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّونَ إِنْ لَبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا
📘 যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন[১] এবং তোমরা প্রশংসার সাথে তাঁর আহবানে সাড়া দিবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে?’ [২]
[১] 'আহবান করবেন' এর অর্থ, কবর থেকে জীবিত করে তাঁর সমীপে উপস্থিত করবেন। তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে তাঁর আজ্ঞা পালন করবে অথবা তাঁকে তোমরা চিনে নিয়ে তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে যাবে।[২] সেখানে দুনিয়ার এই জীবন-কাল অতি অল্প মনে হবে। ﴿كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا﴾ "যেদিন তারা কিয়ামত দেখবে, সেদিন মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছিল।"
(সূরা নাযিআত ৭৯:৪৬)
এই বিষয়কে অন্যান্য আয়াতেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, সূরা ত্বহার ২০:১০২-১০৪ নং, সূরা রূমের ৩০:৫৫ নং এবং সূরা মু'মিনূনের ২৩:১১২-১১৪ নং আয়াতে। কেউ কেউ বলেছেন যে, প্রথমবার ফুঁ মারা হবে, তখন সমস্ত মৃত কবরসমূহে জীবিত হয়ে যাবে। অতঃপর দ্বিতীয় ফুঁ মারা হলে, হিসাব-নিকাশের জন্য হাশরের মাঠে একত্রিত হয়ে যাবে। উভয় ফুঁকের মধ্যে চল্লিশ বছরের ব্যবধান হবে। আর এই দিনগুলোতে তাদেরকে আযাব দেওয়া হবে না। তখন তারা ঘুমিয়ে থাকবে। দ্বিতীয় ফুঁকে উঠে বলবে, "হায় আমাদের দুর্ভোগ, কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল?
(সূরা ইয়াসীন ৩৬:৫২) (ফাতহুল কাদীর)
তবে প্রথম কথাটিই বেশী সঠিক।
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا
📘 আমার দাসদেরকে বল, তারা যেন সেই কথা বলে যা উত্তম।[১] নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; [২] নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শক্র ।
[১] অর্থাৎ, আপোসে কথোপকথনের সময় জিহ্বাকে যেন সাবধানে ব্যবহার করে। যেন ভালো কথা বলে। অনুরূপ কাফের, মুশরিক এবং কিতাবধারীদেরকে সম্বোধন করার প্রয়োজন দেখা দিলে, তাদের সাথে করুণাসিক্ত কণ্ঠে ও নরমভাবে কথা বলবে।
[২] তোমাদের প্রকাশ্য ও চিরশত্রু শয়তান তোমাদের জিভের সামান্যতম বিচ্যুতি দ্বারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করতে পারে অথবা কাফের ও মুশরিকদের অন্তরে তোমাদের প্রতি আরো বেশী বিদ্বেষ ও শত্রুতা ভরে দিতে পারে। হাদীসে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি যেন তার কোন ভাই (মুসলমান)এর প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইঙ্গিত না করে। কেননা, সে জানে না, হতে পারে শয়তান তার হাত দ্বারা সেই অস্ত্র চালিয়ে দেবে। (এবং তা সেই মুসলিম ভাইকে গিয়ে লাগবে এবং এতে তার মৃত্যু হয়ে যাবে।) আর এর কারণে সে জাহান্নামের গহ্বরে গিয়ে পড়বে।" (বুখারীঃ কিতাবুল ফিতান, মুসলিমঃ কিতাবুল বির্র্)
رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِكُمْ ۖ إِنْ يَشَأْ يَرْحَمْكُمْ أَوْ إِنْ يَشَأْ يُعَذِّبْكُمْ ۚ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا
📘 তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে ভালোভাবে জানেন; ইচ্ছা করলে তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন এবং ইচ্ছা করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন।[১] আর আমি তোমাকে তাদের উপর দায়িত্বশীল করে পাঠাইনি। [২]
[১] যদি সম্বোধন মুশরিকদেরকে করা হয়ে থাকে, তবে 'দয়া করা'র অর্থ হবে, ইসলাম গ্রহণের তওফীক দান। আর শাস্তি বলতে, মৃত্যু শিরকের উপর হওয়া, যার কারণে মানুষ শাস্তিযোগ্য গণ্য হয়। আর যদি সম্বোধন মু'মিনদের করা হয়ে থাকে, তাহলে 'দয়া করা'র অর্থ হবে, তিনি কাফেরদের থেকে তোমাদেরকে হিফাযত করবেন। আর শাস্তি দেওয়ার অর্থ হবে, কাফেরদেরকে মুসলিমদের উপর বিজয় ও আধিপত্য দান করা।
[২] যাতে তুমি তাদেরকে অবশ্যই কুফরীর পঙ্কিলতা থেকে বের করবে অথবা তাদের কুফরীর উপর অটল থাকার ফলে সে ব্যাপারে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِمَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَىٰ بَعْضٍ ۖ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا
📘 যারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তাদেরকে তোমার প্রতিপালক ভালভাবে জানেন। আমি তো নবীদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছি। [১] আর দাঊদকে আমি যাবূর দিয়েছি।
[১] এই বিষয়টা ﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ﴾ (البقرة: ২৫৩) আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এখানে মক্কার কাফেরদের উত্তরে বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তারা বলত যে, আল্লাহ কি তাঁর রিসালতের জন্য এই মুহাম্মাদকেই পেয়েছেন? তখন মহান আল্লাহ তাদের উত্তরে বললেন, কাউকে রিসালাতের জন্য নির্বাচন করা এবং কোন এক নবীকে অপর নবীর উপর প্রাধান্য দেওয়া এ সব কেবল তাঁরই এখতিয়ারাধীন।
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلَا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلَا تَحْوِيلًا
📘 বল, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহবান কর; করলে দেখবে তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করবার অথবা পরিবর্তন করবার শক্তি তাদের নেই।
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ ۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
📘 তারা যাদেরকে আহবান করে, তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে; [১] নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।
[১] উল্লিখিত আয়াতে مِنْ دُوْنِ اللهِ বলতে, ফিরিশতা এবং বড়দের সেই নির্মিত ও অঙ্কিত মূর্তি, যাদের তারা ইবাদত করত। অথবা উযায়ের ও ঈসা (আঃ) যাঁদেরকে ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরা আল্লাহর পুত্র ভাবত এবং তাঁদেরকে আল্লাহর গুণাবলীর অধিকারী মনে করত। কিংবা সেই জীনরা যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং মুশরিকরা যাদের পূজা করত। কারণ, এই আয়াতে বলা হচ্ছে যে, এরা নিজেরাই তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের খোঁজে থাকে, তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। আর এই গুণ জড়পদার্থের (পাথরের) হতে পারে না। এই আয়াত থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, مِنْ دُوْنِ اللهِ (আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করা হত) তারা কেবল পাথরের মূর্তিই ছিল না। বরং আল্লাহর বান্দারাও ছিল। তাদের মধ্যে কিছু ছিলেন ফিরিশতাগণ, কিছু সৎলোকগণ, কিছু নবীগণ এবং কিছু জীন। মহান আল্লাহ সকলের ব্যাপারে বললেন যে, তারা কিছুই করতে পারে না; না কারো কষ্ট দূর করতে পারে, আর না কারো অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। "তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে" অর্থাৎ, সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য খোঁজ করে। এটাই হল অসীলা (মাধ্যম), যা অনুসন্ধান করতে কুরআন আদেশ করেছে। সেটা অসীলা নয়, যা কবর পূজারীরা বয়ান করে যে, (পীর ধর, উকিল ধর), (মৃত) আওলিয়ার নামে নজরানা দাও, তাদের কবরে চাদর চড়াও, উরস কর, মেলা বসাও, তাদের কাছে সাহায্য চাও ও ফরিয়াদ কর। কেননা, এ সব অসীলা নয়, বরং তাদের ইবাদত যা শিরক। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুসলিমকে এ থেকে রক্ষা করুন!
وَإِنْ مِنْ قَرْيَةٍ إِلَّا نَحْنُ مُهْلِكُوهَا قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ أَوْ مُعَذِّبُوهَا عَذَابًا شَدِيدًا ۚ كَانَ ذَٰلِكَ فِي الْكِتَابِ مَسْطُورًا
📘 এমন কোন জনপদ নেই, যা আমি কিয়ামতের দিনের পূর্বে ধ্বংস করব না অথবা যাকে কঠোর শাস্তি দেব না; এটা তো কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। [১]
[১] 'কিতাব' বলতে লাওহে মাহফুযকে বুঝানো হয়েছে। অর্থ হল, আল্লাহর পক্ষ হতে এ কথা নির্ধারিত যা লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ যে, আমি কাফেরদের প্রত্যেক বস্তিকে মৃত্যুর মাধ্যমে ধ্বংস করব। আর 'জনপদ' বলতে জনপদবাসীরা উদ্দেশ্য। আর তাদের ধ্বংসের কারণ হবে তাদের কুফরী, শিরক, অত্যাচার ও সীমালঙ্ঘন। আর সে ধ্বংস সাধিত হবে কিয়ামতের পূর্বেই। নচেৎ কিয়ামতের দিন তো নির্বিশেষে প্রত্যেক বস্তিই ধ্বংসের শিকার হবে।
وَمَا مَنَعَنَا أَنْ نُرْسِلَ بِالْآيَاتِ إِلَّا أَنْ كَذَّبَ بِهَا الْأَوَّلُونَ ۚ وَآتَيْنَا ثَمُودَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوا بِهَا ۚ وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا
📘 পূর্ববর্তিগণ কর্তৃক নিদর্শন মিথ্যাজ্ঞান করাই আমাকে নিদর্শন প্রেরণ করা হতে বিরত রাখে।[১] আর আমি স্পষ্ট নিদর্শনস্বরূপ সামূদকে উটনী দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা তার প্রতি যুলুম করেছিল।[২] আসলে আমি ভীতি প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শন প্রেরণ করি।
[১] এই আয়াত তখন অবতীর্ণ হয়, যখন মক্কার কাফেররা দাবী করল যে, সাফা পাহাড়কে সোনার পাহাড় বানিয়ে দেওয়া হোক অথবা মক্কার পাহাড়গুলোকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক যাতে সেখানে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়। এরই উত্তরে মহান আল্লাহ জিবরীল (আঃ)-এর মাধ্যমে বার্তা পাঠালেন যে, আমি তাদের সমস্ত দাবী পূরণ করার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু এর পরও যদি তারা ঈমান না আনে, তবে তাদের ধ্বংস সুনিশ্চিত। এর পর তাদেরকে আর অবকাশ দেওয়া হবে না। নবী করীম (সাঃ) এ কথা পছন্দ করলেন যে, তাদের দাবীগুলো পূরণ না করা হোক। যাতে তারা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
(আহমাদ ১/২৫৮)
এই আয়াতেও আল্লাহ তাআলা এই বিষয়টাকেই বর্ণনা করে বলেন যে, তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিদর্শনসমূহ অবতীর্ণ করা আমার জন্য কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু আমি তা করা থেকে এই জন্য বিরত থাকি যে, পূর্বের জাতিরাও তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিদর্শনসমূহ দাবী করেছিল যা তাদেরকে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মিথ্যা ভেবে ঈমান আনেনি। যার ফলস্বরূপ তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
[২] সামুদ সম্প্রদায়কে দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, তাদের চাহিদা মোতাবেক শক্ত পাথর থেকে উটনী বের করে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু এই অত্যাচারীরা ঈমান আনার পরিবর্তে সেই উটনীকে হত্যা করে দেয়। যার কারণে তিনদিন পর তাদের উপর সর্বনাশী আযাব আসে।
ثُمَّ رَدَدْنَا لَكُمُ الْكَرَّةَ عَلَيْهِمْ وَأَمْدَدْنَاكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَجَعَلْنَاكُمْ أَكْثَرَ نَفِيرًا
📘 অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জন্য যুদ্ধের পালা ঘুরিয়ে (বিজয়) দিলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম এবং তোমাদেরকে করলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। [১]
[১] অর্থাৎ, বুখতে নাসর অথবা জালূতের হত্যার পর আমি পুনর্বার তোমাদেরকে মাল-ধন, সন্তান-সন্ততি এবং মান-সম্মান দানে ধন্য করলাম। অথচ এ সবই তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আর তোমাদেরকে আরো অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী করে দিলাম।
وَإِذْ قُلْنَا لَكَ إِنَّ رَبَّكَ أَحَاطَ بِالنَّاسِ ۚ وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلَّا فِتْنَةً لِلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ ۚ وَنُخَوِّفُهُمْ فَمَا يَزِيدُهُمْ إِلَّا طُغْيَانًا كَبِيرًا
📘 (স্মরণ কর,) যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন।[১] আর আমি যে দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত বৃক্ষ শুধু মানুষের পরীক্ষার জন্যই।[২] আমি তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করি, কিন্তু এটা তাদের তীব্র অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে। [৩]
[১] অর্থাৎ, মানুষ আল্লাহর আধিপত্য ও তাঁর আয়ত্তাধীনে রয়েছে এবং তিনি যা চাইবেন, তা-ই হবে। তারা যা চাইবে, তা নয়। অথবা এ থেকে মক্কাবাসীদেরকে বুঝানো হয়েছে যে, তারা আল্লাহর অধীনস্থ। তুমি কোন প্রকার ভয় না করে রিসালাতের দাওয়াত দিয়ে যাও। তারা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আমি তাদের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করব। কিংবা এখানে বদর যুদ্ধে এবং মক্কা বিজয়ের দিন মক্কার কাফেররা যে শিক্ষামূলক পরাজয়ের শিকার হয়েছিল, সেটাকেই তুলে ধরা হয়েছে।[২] সাহাবা ও তাবেঈনগণ এই দৃশ্যের ব্যাখ্যা করেছেন, চাক্ষুষ দর্শন এবং এ থেকে মি'রাজের ঘটনাকে বুঝানো হয়েছে। এ ঘটনা অনেক দুর্বল ঈমানের লোকদের জন্য ফিতনার কারণ হয়েছে এবং তারা মুরতাদ হয়ে গেছে। আর 'বৃক্ষ' বলতে যাক্কুম গাছ, যা মি'রাজের রাতে রসূল (সাঃ) জাহান্নামে দেখেছেন। المَلْعُوْنَةَ (অভিশপ্ত) বলতে, ভক্ষণকারী। অর্থাৎ, সেই গাছ যা অভিশপ্ত জাহান্নামীরা ভক্ষণ করবে। যেমন, অন্যত্র এসেছে, {إِنَّ شَجَرَةَ الزَّقُّومِ* طَعَامُ الْأَثِيمِ} "অবশ্যই যাক্কুম বৃক্ষ পাপীর খাদ্য হবে।"
(সূরা দুখান ৪৪:৪৩-৪৪ আয়াত)
[৩] অর্থাৎ, যেহেতু কাফেরদের অন্তরে কূটবুদ্ধি ও শত্রুতা রয়েছে, যার কারণে নিদর্শনসমূহ দেখা সত্ত্বেও ঈমান আনার পরিবর্তে তাদের অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘন আরো বেড়ে যায়।
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا
📘 (স্মরণ কর,) যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বললাম, ‘আদমের প্রতি সিজদাবনত হও’; তখন ইবলীস ছাড়া সবাই সিজদাবনত হল; সে বলল, ‘আমি কি তাকে সিজদা করব, যাকে তুমি কাদা-মাটি হতে সৃষ্টি করেছ?’
قَالَ أَرَأَيْتَكَ هَٰذَا الَّذِي كَرَّمْتَ عَلَيَّ لَئِنْ أَخَّرْتَنِ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَأَحْتَنِكَنَّ ذُرِّيَّتَهُ إِلَّا قَلِيلًا
📘 সে (আরো) বলল, ‘বল, এই যাকে তুমি আমার উপর মর্যাদা দান করলে, কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দাও, তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ছাড়া তার বংশধরকে অবশ্যই আয়ত্তে করে নেব।’ [১]
[১] অর্থাৎ, তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে নেব এবং যেভাবে চাইব তাদেরকে ভ্রষ্ট করব। অবশ্য কিছু লোক আমার ধোঁকা থেকে বেঁচে যাবে। (এর দ্বিতীয় অর্থঃ তাদেরকে সমূলে নষ্ট করে ফেলব।) আদম (আঃ) ও ইবলীসের এই ঘটনা ইতিপূর্বে সূরা বাকারাহ, আ'রাফ এবং সূরা হিজরে অতিবাহিত হয়েছে। এখানে চতুর্থবার সেটাকে উল্লেখ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সূরা কাহ্ফ, ত্বহা , এবং সূরা সা'দেও এর উল্লেখ হবে।
قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًا
📘 আল্লাহ বললেন, ‘যাও! তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদের ও তোমাদের সকলের জন্য জাহান্নামই হল পরিপূর্ণ শাস্তি।
وَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
📘 তোমার আওয়াজ দ্বারা তাদের মধ্যে যাকে পার সত্যচ্যুত কর, [১] তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দ্বারা তাদেরকে আক্রমণ কর[২] এবং তাদের ধনে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও[৩] ও তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দাও।[৪] আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র। [৫]
[১] 'আওয়াজ' বলতে প্রতারণামূলক আহবান অথবা গান-বাজনা ও রঙ-তামাশার আরো অন্যান্য শব্দ। যার মাধ্যমে শয়তান অধিকহারে লোকদেরকে ভ্রষ্ট করছে।
[২] এই বাহিনী বলতে, মানুষ ও জীনদের মধ্য থেকে সেই অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী যারা শয়তানের চেলা ও তার অনুসারী। এরাও শয়তানের মত মানুষকে ভ্রষ্ট করে। অথবা এর অর্থ, প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়-উপকরণ যা শয়তান ভ্রষ্ট করার কাজে ব্যবহার করে।
[৩] ধন-মালে শয়তানের অংশ গ্রহণের অর্থ হল, অবৈধ পন্থায় মাল উপার্জন করা এবং হারাম পথে তা ব্যয় করা। অনুরূপ মূর্তির নামে পশু উৎসর্গ করা। যেমন, বুহায়রা, সায়েবাহ ইত্যাদি। সন্তান-সন্ততিতে শরীক হওয়ার অর্থ, ব্যভিচার করা, আব্দুল লাত, আব্দুল উয্যা প্রভৃতি নাম রাখা, অনৈসলামী আদব-কায়দায় তাদের লালন-পালন করা, যাতে তারা দুশ্চরিত্র হয়, অভাবের ভয়ে তাদেরকে হত্যা করা অথবা জীবন্ত প্রোথিত করা, সন্তানদেরকে অগ্নিপূজক, ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান ইত্যাদি অমুসলিম (বা বেদ্বীন) বানানো এবং মাসনুন দু'আ না পড়েই স্ত্রী-সহবাস করা ইত্যাদি।
[৪] প্রতিশ্রুতি দাও যে, জান্নাত ও জাহান্নাম বলে কিছু নেই। অথবা মৃত্যুর পর পুনর্জীবন নেই ইত্যাদি।
[৫] غُرُوْرٌ (ছলনা) এর অর্থ হল, মন্দ কাজকে এমন চমৎকার শোভনীয় করে তুলে ধরা যে, দেখে তা ভাল মনে হয়।
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلًا
📘 আমার দাসদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই।[১] আর কর্মবিধায়ক হিসাবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।’ [২]
[১] বান্দাদেরকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রকাশের উদ্দেশ্যে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর বিশেষ বান্দাদেরকে শয়তান ধোকায় ফেলতে সফল হয় না।
[২] অর্থাৎ, যে প্রকৃতার্থে আল্লাহর বান্দা হয়ে যায়, তাঁরই উপর ভরসা ও আস্থা রাখে, আল্লাহও তার বন্ধু ও সাহায্যকারী হয়ে যান।
رَبُّكُمُ الَّذِي يُزْجِي لَكُمُ الْفُلْكَ فِي الْبَحْرِ لِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
📘 তোমাদের প্রতিপালক তিনিই, যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রে জলযান পরিচালিত করেন, যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার; তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। [১]
[১] এটা তাঁর দয়া ও রহমত যে, তিনি সমুদ্রকে মানুষের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন। তারা তার পৃষ্ঠে নৌকা ও জাহাজ চালিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। অনুরূপ তিনি এমন সব জিনিসের প্রতি (মানুষের) দিকনির্দেশনাও করেছেন, যাতে বান্দাদের জন্য আছে অজস্র লাভ ও উপকারিতা।
وَإِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَنْ تَدْعُونَ إِلَّا إِيَّاهُ ۖ فَلَمَّا نَجَّاكُمْ إِلَى الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ ۚ وَكَانَ الْإِنْسَانُ كَفُورًا
📘 সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে, তখন শুধু তিনি ছাড়া অপর যাদেরকে তোমরা আহবান করে থাক, তারা অদৃশ্য হয়ে যায়; অতঃপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তোমাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। আর মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।[১]
[১] এ বিষয়টা পূর্বেও কয়েক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে।
أَفَأَمِنْتُمْ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ جَانِبَ الْبَرِّ أَوْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا ثُمَّ لَا تَجِدُوا لَكُمْ وَكِيلًا
📘 তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, তিনি তোমাদেরকে স্থলে কোথাও ভূগর্ভস্থ করবেন না অথবা তোমাদের উপর পাথর বর্ষণকারী ঝড় পাঠাবেন না?[১] আর তখন তোমরা তোমাদের কোন কর্মবিধায়ক পাবে না।
[১] অর্থাৎ, সমুদ্র থেকে (নিরাপদে) উত্তীর্ণ হওয়ার পর তোমরা যে আল্লাহকে ভুলে যাও, তোমরা কি জান না যে, তিনি স্থলেও তোমাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন? তিনি তোমাদেরকে যমীনে ধসিয়ে দিতে পারেন অথবা পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করে তোমাদের বিনাশ সাধন করতে পারেন; যেভাবে পূর্বের কিছু জাতিকে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
أَمْ أَمِنْتُمْ أَنْ يُعِيدَكُمْ فِيهِ تَارَةً أُخْرَىٰ فَيُرْسِلَ عَلَيْكُمْ قَاصِفًا مِنَ الرِّيحِ فَيُغْرِقَكُمْ بِمَا كَفَرْتُمْ ۙ ثُمَّ لَا تَجِدُوا لَكُمْ عَلَيْنَا بِهِ تَبِيعًا
📘 অথবা তোমরা কি নিশ্চিত আছ যে, তোমাদেরকে আর একবার সমুদ্রে নিয়ে যাবেন না এবং তোমাদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝটিকা পাঠাবেন না, অতঃপর প্রত্যাখ্যান করার জন্য তোমাদেরকে নিমজ্জিত করবেন না? আর তখন তোমরা এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পাবে না। [১]
[১] قَاصِفٌ সমুদ্রের এমন প্রবল ঝটিকা যা জাহাজগুলোকে চুরমার করে ডুবিয়ে দেয়। تَبِيْعًا প্রতিশোধ গ্রহণকারী, কৈফিয়ত-তলবকারী বা সাহায্যকারী। অর্থাৎ, এমন কাউকে পাবে না, যে তোমাদের সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞেস করবে যে, তুমি আমার ভক্তদেরকে কেন ডুবালে? তাছাড়া একবার সমুদ্র থেকে ভালোর সাথে রক্ষা পাওয়ার পর পুনরায় সমুদ্রে সফর করার প্রয়োজন তোমাদের হবে না কি? এবং সেখানে তোমাদেরকে পানির ঘূর্ণাবর্তের বিপদে ফাঁসাতে পারবেন না কি?
إِنْ أَحْسَنْتُمْ أَحْسَنْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ ۖ وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا ۚ فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ الْآخِرَةِ لِيَسُوءُوا وُجُوهَكُمْ وَلِيَدْخُلُوا الْمَسْجِدَ كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَلِيُتَبِّرُوا مَا عَلَوْا تَتْبِيرًا
📘 তোমরা সৎকর্ম করলে সৎকর্ম নিজেদেরই জন্য করবে, আর মন্দকর্ম করলে তাও নিজেদের জন্য; অতঃপর পরবর্তী প্রতিশ্রুত কাল উপস্থিত হলে আমি আমার দাসদেরকে প্রেরণ করলাম তোমাদের মুখমন্ডল কালিমাচ্ছন্ন করবার জন্য, প্রথমবার তারা যেভাবে মসজিদে প্রবেশ করেছিল পুনরায় সেই ভাবেই তাতে প্রবেশ করবার জন্য এবং তারা যা অধিকার করেছিল তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবার জন্য।[১]
[১] দ্বিতীয়বার আবার তারা ফাসাদ সৃষ্টি করল। যাকারিয়া (আঃ)-কে হত্যা করল এবং ঈসা (আঃ)-কেও হত্যা করার প্রচেষ্টায় ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে বাঁচিয়ে নেন। এর ফলস্বরূপ রোমসম্রাট টিটাস (Titas)-কে আল্লাহ তাদের উপর আধিপত্য দান করেন। সে জেরুজালেমের উপর আক্রমণ করে তাদের লাশের গাদা লাগিয়ে দেয়, শত শত মানুষকে বন্দী করে, তাদের ধন-সম্পদ লুটে নেয় ধর্মপুস্তিকাগুলোকে পদতলে দলিত-মথিত করে, বায়তুল মাকদিস ও সুলাইমানী হাইকাল (উপাসনালয়)-কে ধ্বংস করে দেয় এবং তাদেরকে চিরদিনের জন্য বায়তুল মাকদিস থেকে বহিষ্কার করে দেয়। এইভাবে খুব করে তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়। আর এই সর্বনাশ তাদের উপর নেমে এসেছিল সন ৭০ খ্রীষ্টাব্দে।
۞ وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
📘 আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি,[১] স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি;[২] তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি[৩] এবং যাদেরকে আমি সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের উপর তাদেরকে যথেষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। [৪]
[১] এই মর্যাদা ও অনুগ্রহ মানুষ হিসাবে প্রত্যেক মানুষ পেয়েছে; তাতে সে মুমিন হোক অথবা কাফের। কেননা, এ মর্যাদা অন্য সৃষ্টিকুল, জীবজন্তু, জড়পদার্থ ও উদ্ভিদ ইত্যাদির তুলনায়। আর এ মর্যাদা বিভিন্ন দিক দিয়ে। যে আকার-আকৃতি, এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ শারীরিক গঠন ও ধরন মহান আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন, তা অন্য কোন সৃষ্টি পায়নি। যে জ্ঞান মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যার দ্বারা তারা নিজেদের আরাম ও আয়েশের জন্য অসংখ্য জিনিস আবিষ্কার করেছে, জীবজন্তু ইত্যাদি তা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া এই জ্ঞান দ্বারা তারা ঠিক-বেঠিক, উপকারী-অপকারী এবং ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। এই জ্ঞান দ্বারা তারা আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টিকুল থেকে উপকৃত হয় এবং তাদেরকে নিজেদের বশে রাখে। এই জ্ঞান ও মেধারই মাধ্যমে তারা এমন অট্টালিকা নির্মাণ করে, এমন পোশাক আবিষ্কার করে এবং এমন সব জিনিস বানায় যা তাদেরকে গ্রীষ্মের তাপ, শীতের ঠান্ডা এবং মৌসুমের অন্যান্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। অনুরূপ বিশ্বজাহানের সমস্ত জিনিসকে মহান আল্লাহ মানুষের সেবায় লাগিয়ে রেখেছেন। চাঁদ, সূর্য, হাওয়া, পানি এবং অন্যান্য অসংখ্য জিনিস রয়েছে যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
[২] স্থলে ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, উট এবং নিজেদের তৈরী করা (ট্রেন, মোটরগাড়ী, উড়োজাহাজ, সাইকেল এবং মোটর সাইকেল ইত্যাদি) বাহনে আরোহণ করে এবং সমুদ্রে রয়েছে নৌকা ও জলজাহাজ যাতে তারা আরোহণ করে এবং পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি করে।
[৩] মানুষের পানাহারের জন্য যেসব খাদ্য জাতীয় দ্রব্য শস্য ও ফল-মূলাদি তিনি উৎপন্ন করেছেন এবং তাতে যে স্বাদ, তৃপ্তি এবং শক্তি নিহিত রেখেছেন, রকমারি এই খাদ্য, সুস্বাদু ও মজাদার ফলমূল, শক্তিবর্ধক ও পরিতৃপ্তিকর উপাদেয় নানা যৌগিক খাদ্য ও পানীয়, চূর্ণিত, পিষ্ট ও খামির জাতীয় কত শত রকমের খাবার মানুষ ব্যতীত অন্য আর কোন্ সৃষ্টি পেয়েছে?
[৪] উল্লিখিত আলোচনা থেকে বহু সৃষ্টির উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা পরিষ্কার হয়ে যায়।
يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ۖ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَٰئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا
📘 (স্মরণ কর,) যখন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ[১] আহবান করব। যাদেরকে ডান হাতে তাদের আমলনামা দেওয়া হবে, তারা তাদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুরের আঁটির ফাটলে সুতো বরাবর (সামান্য পরিমাণ)ও যুলুম করা হবে না। [২]
[১] إِمَامٌ এর অর্থ, পথপ্রদর্শক, নেতা ও পরিচালক। এখানে ইমাম বলতে কি বুঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, এ থেকে পয়গম্বর বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, প্রত্যেক উম্মতকে তাদের নবীর মাধ্যমে ডাকা হবে। কেউ বলেন, এ থেকে আসমানী কিতাব বুঝানো হয়েছে যা নবীদের সাথে অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ, হে তাওরাতধারী! হে ইঞ্জীলধারী! হে কুরআনধারী! ইত্যাদি বলে ডাকা হবে। কেউ বলেন, এখানে 'ইমাম' অর্থ, আমলনামা। অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তিকে যখন ডাকা হবে, তখন তার আমলনামা তার সাথে থাকবে এবং সেই অনুযায়ী তার ফায়সালা হবে। এই উক্তিকে ইমাম ইবনে কাসীর এবং ইমাম শাওকানী প্রাধান্য দিয়েছেন।
[২] فَتِيْلٌ খেজুরের আঁটির ফাটলে অতি সূক্ষ্ণ ও পাতলা যে সুতো থাকে তাকেই 'ফাতীল' বলা হয়। উদ্দেশ্য, অণু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।
وَمَنْ كَانَ فِي هَٰذِهِ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًا
📘 যে লোক ইহলোকে অন্ধ, সে লোক পরলোকেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট। [১]
[১] أَعْمَى (অন্ধ) বলতে অন্তরের অন্ধ। অর্থাৎ, যে দুনিয়াতে সত্য দেখা হতে, বুঝা হতে এবং কবুল করা হতে বঞ্চিত থাকে, সে আখেরাতে অন্ধ হবে এবং প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া থেকে বঞ্চিত থাকবে।
وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ ۖ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا
📘 আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি, তা হতে তারা তোমার পদস্খলন প্রায় ঘটিয়েই ফেলেছিল, যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে ওর বিপরীত কিছু মিথ্যা উদ্ভাবন কর; আর তা করলে, তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করত।
وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا
📘 আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি তাদের দিকে কিছুটা প্রায় ঝুঁকে পড়তে। [১]
[১] এখানে সেই সুরক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লাহর পক্ষ হতে নবীগণ লাভ করে থাকেন। এ থেকে জানা গেল যে, মুশরিকরা যদিও নবী (সাঃ)-কে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল, কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে তাদের আকর্ষণ থেকে বাঁচিয়ে নেন। ফলে তিনি সামান্য পরিমাণও তাদের প্রতি ঝুঁকে যাননি।
إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا
📘 তাহলে আমি অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাতাম,[১] আর তখন আমার বিরুদ্ধে তোমার জন্য কোন সাহায্যকারী পেতে না।
[১] এ থেকে জানা গেল যে, শাস্তির ভারও মান-মর্যাদা অনুযায়ী অধিক হয়।
وَإِنْ كَادُوا لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ الْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا ۖ وَإِذًا لَا يَلْبَثُونَ خِلَافَكَ إِلَّا قَلِيلًا
📘 তারা তোমাকে স্বদেশ থেকে প্রায় উচ্ছেদ করেই ফেলেছিল সেথা হতে বহিস্কার করার জন্য; [১] তা করলে তোমার পর তারাও সেথায় অল্পকালই টিঁকে থাকত। [২]
[১] এতে সেই ষড়্যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা নবী (সাঃ)-কে মক্কা থেকে বহিষ্কার করার জন্য মক্কার কুরাইশরা করেছিল এবং যা থেকে মহান আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন।
[২] অর্থাৎ, নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি এরা তোমাকে মক্কা থেকে বের করে দিত, তবে এরাও তার পরে বেশী দিন (মক্কায়) থাকত না। অর্থাৎ, তারা সত্ত্বর আল্লাহর আযাবের হাতে ধরা খেত।
سُنَّةَ مَنْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُسُلِنَا ۖ وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا
📘 আমার রসূলদের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে আমি পাঠিয়েছিলাম, তাদের ক্ষেত্রেও ছিল অনুরূপ নিয়ম। [১] আর তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না। [২]
[১] অর্থাৎ, এই নিয়ম পূর্ব থেকেই চলে আসছে। তোমার পূর্ববর্তী রসূলদের ক্ষেত্রেও এই নিয়মই প্রয়োগ করা হয়েছে। যখন তাঁদের সম্প্রদায়রা তাঁদেরকে তাঁদের দেশ থেকে বের করে দিল অথবা বের হতে বাধ্য করল, তখন সেই জাতিরাও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পায়নি।
[২] সুতরাং মক্কাবাসীদের সাথেও এটাই হয়েছে। রসূল (সাঃ)-এর হিজরতের দেড় বছর পরেই বদর প্রান্তে তারা শিক্ষামূলক লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের শিকার হয় এবং ছয় বছর পর হিজরী ৮ম সনে মক্কাই বিজয় হয়ে যায়। আর এই লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের পর তাদের আর মাথা তোলার মত কোন ক্ষমতা থাকল না।
أَقِمِ الصَّلَاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَىٰ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنَ الْفَجْرِ ۖ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُودًا
📘 সূর্য হেলে পড়বার পর হতে রাত্রির ঘন অন্ধকার[১] পর্যন্ত নামায কায়েম কর এবং (কায়েম কর) ফজরের কুরআন (নামায); নিশ্চয় ফজরের কুরআন (নামায) পরিলক্ষিত হয় বিশেষভাবে। [২]
[১] دُلُوْكٌ এর অর্থ, ঢলা (সূর্যঢলা) এবং غسق এর অর্থ, অন্ধকার। সূর্য ঢলার পর যোহর ও আসরের নামায এবং রাতের অন্ধকার পর্যন্ত বলতে মাগরেব ও এশার নামায উদ্দেশ্য। আর قرآن الفجر বলতে ফজরের নামায। এখানে কুরআন অর্থ নামায। ফজরের নামাযকে কুরআন বলে এই জন্য আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, ফজরে কিরাআত পাঠ লম্বা হয়। এইভাবে এই আয়াতে পাঁচঅক্ত নামাযের কথা মোটামুটিভাবে এসে যায়। আর এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা হাদীসসমূহে পাওয়া যায় এবং তা বহুধাসূত্রে বর্ণিত উম্মতের পরম্পরাগত আমল দ্বারাও সাব্যস্ত।[২] অর্থাৎ, এই সময় ফিরিশতাগণ উপস্থিত হন; বরং (এ সময়) দিনের ও রাতের ফিরিশতাগণ একত্রে মিলিত হন। যেমন, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
(বুখারী, সূরা বনী ইস্রাইলের তাফসীর)
অন্য একটি হাদীসে রয়েছে যে, রাতের ফিরিশতাগণ যখন আল্লাহর নিকট যান, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন -- অথচ তিনি ভালভাবে তা জানেন -- "তোমরা আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ?" ফিরিশতাগণ বলেন, 'যখন আমরা তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখনও তারা নামাযে রত ছিল এবং যখন আমরা তাদের কাছ থেকে ফিরে এলাম, তখনও তারা নামাযে রত ছিল।'
(বুখারী, কিতাবুল মাওয়াকীত, মুসলিম, পরিচ্ছেদঃ আসর ও ফজরের নামাযের ফযীলত---)
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَىٰ أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا
📘 আর রাত্রির কিছু অংশে তা দিয়ে[১] তাহাজ্জুদ[২] পড়; এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য।[৩] আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। [৪]
[১] অর্থাৎ, কুরআন পড়ার মাধ্যমে।
[২] কেউ কেউ বলেন, تهجد শব্দটি সেই শ্রেণীভুক্ত শব্দ, যাতে বিপরীতমুখী দু' রকম অর্থ পাওয়া যায়। এর অর্থ ঘুমানোও হয়, আবার ঘুম থেকে জাগাও হয়। এখানে দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, রাতে ঘুম থেকে ওঠো এবং নফল নামায পড়। কেউ বলেন, هجود এর প্রকৃত অর্থই হল, রাতে ঘুমানো। কিন্তু باب تفعُّل এর ছাঁচে পড়ে তাতে تجنب (বেঁচে থাকা) এর অর্থ সৃষ্টি হয়ে যায়। যেমন, إثم মানে পাপ, কিন্তু ঐ ছাঁচে পড়ে تَأَثُّم এর অর্থ হয়, পাপ থেকে বিরত বা বেঁচে থাকা। অনুরূপ تهجد এর অর্থ হবে, ঘুম থেকে বিরত বা বেঁচে থাকা। আর مُتَهَجِّدٌ হবে সে, যে রাতে না ঘুমিয়ে কিয়াম করে। মোট কথা তাহাজ্জুদের অর্থ হল, রাতের শেষ প্রহরে উঠে নফল নামায পড়া। সারা রাত قيام الليل (নামায) পড়া সুন্নতের বিপরীত। নবী (সাঃ) রাতের প্রথমাংশে ঘুমাতেন এবং শেষাংশে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। আর এটাই হল সুন্নতী তরীকা।
[৩] কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, এটা একটি অতিরিক্ত ফরয, যা নবী (সাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এইভাবে তারা বলেন যে, নবী (সাঃ)-এর উপর তাহাজ্জুদের নামাযও ঐরূপ ফরয ছিল, যেমন পাঁচ অক্ত নামায ফরয ছিল। অবশ্য উম্মতের জন্য তাহাজ্জুদের নামায ফরয নয়। কেউ কেউ বলেন যে, نَافِلَةً (অতিরিক্ত) এর অর্থ হল, তাহাজ্জুদের এই নামায রসূল (সাঃ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত জিনিস। কারণ, তিনি হলেন, مغفور الذنب (পাপ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত)। পক্ষান্তরে উম্মতের জন্য উক্ত আমল এবং অন্যান্য সমস্ত নেক আমল পাপসমূহের কাফফারা হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, نَافِلَةً মানে নফলই। অর্থাৎ, এ নামায না রসূল (সাঃ)-এর উপর ফরয ছিল, আর না তাঁর উম্মতের উপর। এটি একটি অতিরিক্ত নফল ইবাদত, যার ফযীলত অবশ্যই অনেক। এই সময়ে আল্লাহ তাঁর ইবাদতে বড়ই সন্তুষ্ট হন। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, "রমযানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা হল আল্লাহর মাস মুহার্রমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হল রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।"
(মুসলিম ১১৬৩নং, আবু দাঊদ তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে খুযাইমাহ)
তিনি বলেন, "জান্নাতের মধ্যে এমন একটি কক্ষ আছে, যার বাহিরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে।" তা শুনে আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বললেন, 'সে কক্ষ কার জন্য হবে, হে আল্লাহর রসূল?' তিনি বললেন, "যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, অন্নদান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাযে রত হয়; তার জন্য।"
(ত্বা
বারানী, হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১১নং)
তিনি বলেন, "আল্লাহ তাআলা প্রত্যহ রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে নীচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, 'কে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার নিকট কিছু চাইবে? আমি তাকে দান করব। এবং কে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।"
(বুখারী, মুসলিম, সুনান আরবাআহ, মিশকাত ১২২৩নং)
তিনি বলেন, "তোমরা তাহাজ্জুদের নামাযে অভ্যাসী হও। কারণ, তা তোমাদের পূর্বতন নেক বান্দাদের অভ্যাস; তা তোমাদের প্রভুর নৈকট্যদানকারী ও পাপক্ষালনকারী এবং গোনাহ হতে বিরতকারী আমল।"
(তিরমিযী, ইবনে আবিদ্দুনয়্যা, ইবনে খুযাইমাহ, হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১৮ নং)
[৪] এটা হল সেই স্থান, যা কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ নবী (সাঃ)-কে দান করবেন এবং সেই স্থানে সিজদায় পড়ে আল্লাহর অসীম প্রশংসা বর্ণনা করবেন। অতঃপর আল্লাহ জাল্লা শানুহ বলবেন, 'হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল, কি চাও বল, তোমাকে দেওয়া হবে। তুমি সুপারিশ কর, মঞ্জুর করা হবে।' তখন তিনি সেই বড় সুপারিশটি করবেন, যার পর লোকদের হিসাব-নিকাশ আরম্ভ হবে। (আশা এখানে নিশ্চিতের অর্থে।)
عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَنْ يَرْحَمَكُمْ ۚ وَإِنْ عُدْتُمْ عُدْنَا ۘ وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ حَصِيرًا
📘 সম্ভবতঃ তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন; কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের পূর্ব আচরণের পুনরাবৃত্তি কর; তবে আমিও (আমার শাস্তির) পুনরাবৃত্তি করব।[১] আর জাহান্নামকে আমি করেছি সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য কারাগার।[২]
[১] এখানে তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, যদি তোমরা নিজেদেরকে সংশোধন করে নাও, তাহলে আল্লাহর রহমতের অধিকারী হবে। যার অর্থ হল, দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অর্জন করবে। আর যদি পুনরায় আল্লাহর অবাধ্যতার পথ অবলম্বন করে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করায় লিপ্ত হও, তাহলে আমি আবারও তোমাদেরকে লাঞ্ছনা ও অবমাননাগ্রস্ত করব; যেমন ইতিপূর্বে দুইবার আমি তোমাদের সাথে এই ধরনের আচরণ করেছি। আর হলও তা-ই। এই ইয়াহুদীরা নিজেদের মন্দ আচরণ থেকে ফিরে আসেনি। তারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅতের ব্যাপারে সেই আচরণই প্রদর্শন করে, যে আচরণ প্রদর্শন করেছিল মূসা (আঃ) এবং ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতের ব্যাপারে। যার ফলস্বরূপ তৃতীয়বার মুসলিমদের হাতে তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত হতে হয় এবং অত্যধিক লাঞ্ছনার সাথে তাদেরকে মদীনা ও খায়বার থেকে নির্বাসিত হতে হয়।
[২] অর্থাৎ, দুনিয়ার এই লাঞ্ছনার পর জাহান্নামে আরো পৃথক শাস্তি রয়েছে, যা সেখানে তারা ভোগ করবে।
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا
📘 বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কল্যাণ সহ প্রবেশ করাও এবং কল্যাণ সহ বের কর। আর তোমার নিকট হতে আমাকে দান কর সাহায্যকারী শক্তি।’ [১]
[১] কেউ কেউ বলেন, এটা হিজরতের সময় অবতীর্ণ হয়েছিল। যখন নবী (সাঃ)-এর মক্কা থেকে বের হওয়ার এবং মদীনাতে প্রবেশ করার সময় উপস্থিত হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হল, সত্যের উপর আমার মৃত্যু দিও এবং সত্যের উপর আমাকে কিয়ামতের দিন উত্থিত করো। আবার কেউ কেউ বলেন, সত্যতার সাথে আমাকে কবরে প্রবিষ্ট করো এবং কিয়ামতের দিন সত্যতার সাথে আমাকে কবর থেকে বের করো ইত্যাদি। ইমাম শাওকানী বলেন, এটা যেহেতু দু'আ, বিধায় এর ব্যাপকতায় উল্লিখিত সব কথাই এসে যায়।
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
📘 আর বল, ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলীন হয়েছে; নিশ্চয় মিথ্যা বিলীয়মান।’ [১]
[১] হাদীসে এসেছে যে, মক্কা বিজয়ের পর যখন নবী (সাঃ) কা'বাগৃহে প্রবেশ করেন, তখন সেখানে তিনশ' ষাটটি মূর্তি রাখা ছিল। নবী (সাঃ)-এর হাতে ছিল একটি কাষ্ঠখন্ড বা লাঠি। তিনি তার ডগা দিয়ে মূর্তিগুলোকে খোঁচা দিচ্ছিলেন আর ﴿جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ﴾..। এবং ﴿ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيدُ﴾ পড়ে যাচ্ছিলেন।
(বুখারীঃ কিতাবুল মাযালিম, মুসলিমঃ কিতাবুল জিহাদ)
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
📘 আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও করুণা, কিন্তু তা সীমালংঘনকারীদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। [১]
[১] এই অর্থই সূরা ইউনুসের ১০:৫৭ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। তার টীকা দ্রষ্টব্য।
وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَىٰ بِجَانِبِهِ ۖ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ يَئُوسًا
📘 যখন আমি মানুষকে সম্পদ দান করি, তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দূরে সরে যায়। আর তাকে অমঙ্গল স্পর্শ করলে সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে। [১]
[১] এতে মানুষের সেই বাস্তব অবস্থা ও পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তারা সাধারণতঃ সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতার সময় শিকার হয়ে থাকে। সচ্ছলতার সময় তারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং অসচ্ছল অবস্থায় তারা নিরাশ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে ঈমানদারদের ব্যাপার এই উভয় অবস্থাতেই তাদের থেকে একেবারে ভিন্ন হয়। সূরা হূদের ১১:৯-১১ নং আয়াতের টীকা দ্রষ্টব্য।
قُلْ كُلٌّ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَىٰ سَبِيلًا
📘 বল, ‘প্রত্যেকেই নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করে থাকে। অতঃপর যে পরিপূর্ণরূপে সৎপথপ্রাপ্ত তার সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক সম্যক্ অবগত আছেন।’ [১]
[১] এতে রয়েছে মুশরিকদের জন্য ধমক ও তিরস্কার। আর সূরা হূদের ১১:১২১-১২২ নং আয়াতের যে অর্থ, এরও সেই একই অর্থ। ﴿وَقُلْ لِلَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ اعْمَلُوا عَلَى مَكَانَتِكُمْ إِنَّا عَامِلُونَ﴾ আর شَاكِلَةٌ এর অর্থ, নিয়ত, দ্বীন, তরীকা, অভ্যাস, স্বভাব, প্রকৃতি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেন যে, এতে রয়েছে কাফেরদের নিন্দার এবং মু'মিনদের প্রশংসার দিক। কারণ, এর অর্থ হল, প্রত্যেক মানুষ তার স্বভাবগত অভ্যাস অনুযায়ী এমন কাজ করে, যার উপর গড়ে উঠে তার আখলাক-চরিত্র।
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ ۖ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
📘 তোমাকে তারা আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তুমি বল, ‘আত্মা আমার প্রতিপালকের আদেশ বিশেষ; আর তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।’ [১]
[১] روح (রূহ বা আত্মা) এমন অশরীরী বস্তু যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রূহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কি? তা কেউ জানে না। ইয়াহুদীরাও একদা নবী করীম (সাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।
(বুখারীঃ বনী ইস্রাঈলের তাফসীর, মুসলিমঃ কিতাবু সিফাতিল কিয়ামাহ--)
আয়াতের অর্থ হল, তোমাদের জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় অনেক কম। আর এই রূহ (আত্মা), যে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসা করছ, তার জ্ঞান আল্লাহ তাঁর আম্বিয়া সহ অন্য কাউকেও দেননি। কেবল এতটুকু জেনে নাও যে, এটা আমার প্রতিপালকের নির্দেশ মাত্র। অথবা এটা আমার প্রতিপালকেরই খাস ব্যাপার; যার প্রকৃতত্ব কেবল তিনিই জানেন।
وَلَئِنْ شِئْنَا لَنَذْهَبَنَّ بِالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ بِهِ عَلَيْنَا وَكِيلًا
📘 ইচ্ছা করলে আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি, তা অবশ্যই প্রত্যাহার করতে পারতাম;[১] অতঃপর তুমি এ বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে কোন কর্মবিধায়ক পেতে না।[২]
[১] অর্থাৎ, অহী মারফৎ সামান্য যে জ্ঞান তোমাকে দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে সেটুকুও ছিনিয়ে নিতে পারতেন। অর্থাৎ, তোমার অন্তর অথবা কিতাব থেকেই তা মিটিয়ে দিতে পারতেন।
[২] যে পুনরায় এই অহীকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিত।
إِلَّا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ ۚ إِنَّ فَضْلَهُ كَانَ عَلَيْكَ كَبِيرًا
📘 (এটা প্রত্যাহার না করা) তোমার প্রতিপালকের দয়ামাত্র;[১] নিশ্চয় তোমার প্রতি আছে তাঁর মহা অনুগ্রহ।
[১] যে, তিনি অবতীর্ণ অহীকে ছিনিয়ে নেননি অথবা তিনি তাঁর অহী দ্বারা তোমাকে সম্মানিত করেছেন।
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَىٰ أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَٰذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
📘 বল, ‘যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন আনয়নের জন্য মানুষ ও জীন সমবেত হয় ও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এর অনুরূপ কুরআন আনয়ন করতে পারবে না।’ [১]
[১] কুরআন মাজীদের ব্যাপারে এই ধরনের চ্যালেঞ্জ ইতিপূর্বেও কয়েকটি স্থানে উল্লিখিত হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ আজও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে এবং তার জবাবের পিপাসা আজও পর্যন্ত অনিবৃত্তই আছে।
وَلَقَدْ صَرَّفْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِنْ كُلِّ مَثَلٍ فَأَبَىٰ أَكْثَرُ النَّاسِ إِلَّا كُفُورًا
📘 আমি অবশ্যই মানুষের জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সত্য প্রত্যাখ্যান ব্যতীত ক্ষান্ত হল না। [১]
[১] এই অর্থ এই সূরার ১৭:৪১ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।
إِنَّ هَٰذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا
📘 নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথনির্দেশ করে, যা সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।
وَقَالُوا لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّىٰ تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنْبُوعًا
📘 আর তারা বলল,[১] ‘কখনই আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি হতে এক প্রস্রবণ উৎসারিত করবে ।
[১] ঈমান আনার জন্য মক্কার কুরাইশরা এই দাবীগুলো পেশ করেছিল।
أَوْ تَكُونَ لَكَ جَنَّةٌ مِنْ نَخِيلٍ وَعِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْأَنْهَارَ خِلَالَهَا تَفْجِيرًا
📘 অথবা তোমার খেজুরের কিংবা আঙ্গুরের এক বাগান হবে যার ফাঁকে ফাঁকে তুমি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করে দেবে নদী-নালা ।
أَوْ تُسْقِطَ السَّمَاءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا أَوْ تَأْتِيَ بِاللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ قَبِيلًا
📘 অথবা তুমি যেমন বলে থাকো, সেই অনুযায়ী আকাশকে খন্ড-বিখন্ড করে আমাদের উপর ফেলবে অথবা আল্লাহ ও ফিরিশতাদেরকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবে। [১]
[১] অর্থাৎ, আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবেন আর আমরা তাঁদেরকে স্বচক্ষে দেখে নিব।
أَوْ يَكُونَ لَكَ بَيْتٌ مِنْ زُخْرُفٍ أَوْ تَرْقَىٰ فِي السَّمَاءِ وَلَنْ نُؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتَّىٰ تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتَابًا نَقْرَؤُهُ ۗ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلَّا بَشَرًا رَسُولًا
📘 অথবা তোমার একটি স্বর্ণনির্মিত গৃহ হবে,[১] অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে; কিন্তু তোমার আকাশ আরোহণ আমরা কখনো বিশ্বাস করবো না, যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব অবতীর্ণ না করবে; যা আমরা পাঠ করব।’[২] বল, ‘পবিত্র মহান আমার প্রতিপালক! আমি তো শুধু একজন মানুষ, একজন রসূল মাত্র।’[৩]
[১] زُخْرُفٌ এর প্রকৃত অর্থ, সৌন্দর্য। مُزَخْرَفٌ সৌন্দর্যখচিত জিনিসকে বলা হয়। তবে এখানে তার অর্থ হল, স্বর্ণনির্মিত।
[২] অর্থাৎ, আমাদের প্রত্যেকেই তা পরিষ্কারভাবে পড়তে পারবে।
[৩] অর্থাৎ, আমার প্রতিপালকের আছে সব রকমের শক্তি। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সমূহ দাবীকে এক মুহূর্তে كُنْ (হও) শব্দ দ্বারা পূরণ করে দিবেন। কিন্তু আমার ব্যাপারটা হল, আমি (তোমাদেরই মত) একজন মানুষ। কোন মানুষ এ জিনিসগুলো করার শক্তি রাখে কি, যা আমার কাছে তোমরা দাবী করছ? হ্যাঁ, মানুষ হওয়ার সাথে সাথে আমি আল্লাহর একজন রসূলও বটি। তবে রসূলের কাজ শুধু আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়া। আর তা আমি পৌঁছে দিয়েছি এবং পৌঁছাতে আছি। মানুষের দাবী অনুযায়ী মু'জিযা প্রদর্শন করা রিসালাতের কোন অংশ নয়। অবশ্য আল্লাহর ইচ্ছায় রিসালাতের সত্যতা প্রমাণের জন্য এক-আধটা মু'জিযা প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু মানুষের চাহিদা মত মু'জিযা দেখানো শুরু করে দিলে এর গতি কোথাও গিয়ে থামবে না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ চাহিদা মোতাবেক নতুন মু'জিযা দেখার আকাঙ্ক্ষী হবে এবং এর ফলে রসূল কেবল এই কাজেই লেগে থাকবেন। তবলীগ ও দাওয়াতের আসল কাজেই মন্দা পড়ে যাবে। সুতরাং মু'জিযার বিকাশ কেবল আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটা সম্ভব। আর তাঁর ইচ্ছা সেই কৌশল ও ভাল-মন্দের দিক বিচার অনুযায়ী হয়, যার জ্ঞান তিনি ব্যতীত আর কারো কাছে নেই। আর আমার জন্যও তাঁর ইচ্ছার মধ্যে হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়।
وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَىٰ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَبَعَثَ اللَّهُ بَشَرًا رَسُولًا
📘 যখন মানুষের নিকট পথ-নির্দেশ এল, তখন তাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন হতে এই উক্তিই বিরত রাখল যে, ‘আল্লাহ কি একজন মানুষকে রসূল করে পাঠিয়েছেন?’[১]
[১] অর্থাৎ, কোন মানুষের রসূল হওয়া, কাফের ও মুশরিকদের জন্য বড়ই আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল। তারা মানতই না যে, আমাদের মত মানুষ; যে আমাদের মত চলাফেরা করে, আমাদের মতই পানাহার করে এবং আমাদের মতই আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়িত ব্যক্তি রসূল হতে পারেন। আর এই আশ্চর্যবোধই তাদের ঈমান আনার পথে বাধা ছিল।
قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولًا
📘 বল, ‘ফিরিশতারা যদি নিশ্চিত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করত, তাহলে অবশ্যই আমি আকাশ হতে ফিরিশতাকেই তাদের নিকট রসূল করে পাঠাতাম।’ [১]
[১] আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন পৃথিবীতে মানুষই বসবাস করে, তখন তাদের হিদায়াতের জন্য রসূলও মানুষ হবে। মানুষ ব্যতীত অন্য কেউ রসূল হলে মানুষের হিদায়াতের দায়িত্ব পালন করতেই পারবে না। হ্যাঁ, যদি পৃথিবীর বুকে ফিরিশতা বসবাস করত, তবে তাদের হিদায়াতের জন্য রসূল অবশ্যই ফিরিশতা হত।
قُلْ كَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ ۚ إِنَّهُ كَانَ بِعِبَادِهِ خَبِيرًا بَصِيرًا
📘 বল, ‘আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট,[১] নিশ্চয় তিনি তাঁর দাসদেরকে সবিশেষ জানেন ও দেখেন।’
[১] অর্থাৎ, দাওয়াত ও তবলীগের যে কাজ আমার দায়িত্বে ছিল, তা আমি পালন করেছি। এ ব্যাপারে আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হওয়ার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কারণ, প্রত্যেক জিনিসের ফায়সালা তিনিই করবেন।
وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ ۖ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِهِ ۖ وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا ۖ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا
📘 আল্লাহ যাদেরকে পথ-নির্দেশ করেন, তারা তো পথপ্রাপ্ত এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন, তুমি কখনই তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকেও তাদের অভিভাবক পাবে না।[১] আর কিয়ামতের দিন আমি তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায়; [২] কানা, বোবা ও কালা করে।[৩] তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম; যখনই তা স্তিমিত হবে, তখনই আমি তাদের জন্য অগ্নি বৃদ্ধি করে দেব।
[১] আমার দাওয়াত ও তবলীগে কে ঈমান আনবে, আর কে আনবে না, সেটাও আল্লাহরই এখতিয়ারাধীন। আমার কাজ কেবল পৌঁছে দেওয়া।
[২] হাদীসে এসেছে যে, একদা সাহাবাগণ আশ্চর্য হন যে, মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় কিভাবে হাশর হবে? নবী (সাঃ) বললেন, "যে আল্লাহ তাদেরকে পায়ে ভর দিয়ে চলার ক্ষমতা দান করেছেন, তিনি তাদেরকে মুখে ভর দিয়ে চলানোরও ক্ষমতা রাখেন।"
(বুখারীঃ সূরা ফুরকানের তফসীর, মুসলিমঃ কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ)
[৩] অর্থাৎ, যেভাবে তারা দুনিয়াতে সত্যের ব্যাপারে কানা, বোবা ও কালা হয়ে ছিল, কিয়ামতের দিনও শাস্তিস্বরূপ কানা, বোবা ও কালা হবে।
ذَٰلِكَ جَزَاؤُهُمْ بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِآيَاتِنَا وَقَالُوا أَإِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا
📘 এটাই তাদের প্রতিফল। কারণ তারা আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করেছিল ও বলেছিল, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরুত্থিত হব?’ [১]
[১] অর্থাৎ, জাহান্নামের এই আযাব তাদেরকে এই জন্য দেওয়া হবে যে, তারা আমার নাযিলকৃত আয়াতসমূহকে সত্য বলে স্বীকার করেনি এবং বিশ্বজাহানে ছড়িয়ে থাকা নিদর্শনাবলীর ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করেনি। যার কারণে তারা কিয়ামত সংঘটিত ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থিত হওয়াকে অসম্ভব মনে করেছিল এবং বলেছিল যে, অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর আমরা আবার নতুনভাবে কি করে সৃজিত হতে পারি?
۞ أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ قَادِرٌ عَلَىٰ أَنْ يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ وَجَعَلَ لَهُمْ أَجَلًا لَا رَيْبَ فِيهِ فَأَبَى الظَّالِمُونَ إِلَّا كُفُورًا
📘 তারা কি লক্ষ্য করে না যে, আল্লাহ; যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে ক্ষমতাবান?[১] তিনি তাদের জন্য স্থির করেছেন এক নির্দিষ্ট কাল, যাতে কোন সন্দেহ নেই।[২] তথাপি সীমালংঘনকারীরা সত্য প্রত্যাখ্যান করা ব্যতীত ক্ষান্ত হল না।
[১] আল্লাহ এদের উত্তরে বললেন, যে আল্লাহ আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তিনি এদের মত সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টি করার অথবা পুনরায় জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কেননা, এদেরকে সৃষ্টি করা আসমান ও যমীন সৃষ্টি করার চেয়ে সহজতর। ﴿لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ﴾ অর্থাৎ, আসমান ও যমীন সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টির তুলনায় কঠিনতর।
(সূরা মু'মিন ৪০:৫৭ আয়াত)
এই বিষয়টাকে আল্লাহ তাআলা সূরা আহক্বাফের ৪৬:৩৩ নং এবং সূরা ইয়াসীনের ৩৬:৮১-৮২ নং আয়াতেও উল্লেখ করেছেন।[২] এই أجل (নির্দিষ্ট কাল) বলতে মৃত্যু অথবা কিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে। এখানে প্রাসঙ্গিকতার দিকে লক্ষ্য করে কিয়ামত অর্থ নেওয়াই বেশী সঠিক। অর্থাৎ, আমি তাদেরকে পুনরায় জীবিত করে কবর থেকে উঠানোর জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছি। ﴿وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلَّا لِأَجَلٍ مَعْدُودٍ﴾ "আর আমি ওটা নির্দিষ্ট একটি কালের জন্যই বিলম্বিত করছি।"
(সূরা হূদ ১১:১০৪)