🕋 تفسير سورة النساء
(An-Nisa) • المصدر: BN-TAFISR-FATHUL-MAJID
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
📘 নামকরণ ও অবতীর্ণের সময়কাল:
(النِّسَاءُ) নিসা শব্দের অর্থ নারীগণ, মহিলাগণ। এ সূরায় মহিলাদের সাথে বিবাহ বন্ধন, ওয়ারিশসহ তাদের সার্বিক অধিকার ও ইসলাম ধর্মে তাদের মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে বিধায় অত্র সূরার নাম সূরা আন্ নিসা (বা নারীগণ) করা হয়েছে। এ সূরা সম্পূর্ণই মদীনায় অবতীর্ণ হয়।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: একটি আয়াত মক্কা বিজয়ের দিন মক্কাতে অবতীর্ণ হয়েছে তা হল:
(إِنَّ اللّٰهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمٰنٰتِ إِلٰٓي أَهْلِهَا)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে।” এছাড়াও নাযিলের সময়কালের ব্যাপারে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: সঠিক কথা হল সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসীর কুরতুবী ৫/৩)
আয়িশাহ (রাঃ) বলেন: সূরা নিসা অবতীর্ণকালীন সময়ে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। অর্থাৎ তিনি আমাকে বিবাহ করে তাঁর ঘরে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯৯৩) আর এ বিষয়ে সকলে একমত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়িশার (রাঃ) সাথে মদীনায় বাসর করেছেন। (ফাতহুল কাদীর, অত্র সূরার তাফসীর)
সূরা নিসার ফযীলত:
এটি বিধি-বিধান সম্বলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরাতে ইয়াতীমের অধিকার, বিবাহের সর্বোচ্চ সংখ্যা, উত্তরাধিকার, যে সকল নারীদের বিবাহ করা হারাম তাদের বর্ণনা, পুরুষদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা, শির্ক বর্জিত এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও তার নিয়ম-পদ্ধতি, মুশরিকদের ইহলৌকিক ও পরলৌকিক বিধান, শরীয়তে সুন্নাতে রাসূলের গুরুত্বসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: সূরা নিসায় পাঁচটি আয়াত রয়েছে, যদি আমি সারা দুনিয়া পেতাম তাহলে তত খুশি হতাম না যত খুশি হয়েছি এ আয়াতগুলো পেয়ে।
আয়াত পাঁচটি হল:
১. (إِنَّ اللّٰهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ)
“আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না।”(সূরা নিসা ৪:৪০)
২. (إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَا۬ئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ.. )
“তোমাদেরকে যে সকল কবীরা গুনাহ থেকে নিষেধ করা হয়েছে তা হতে বিরত থাকলে ...” (সূরা নিসা ৪:৩১)
৩. (إِنَّ اللّٰهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِه۪ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ يَّشَا۬ءُ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” (সূরা নিসা ৪:৪৮)
৪. (وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَّلَمُوْآ أَنْفُسَهُمْ جَا۬ءُوْكَ)
“যখন তারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল তখন যদি তারা তোমার নিকট আসত।” (সূরা নিসা ৪:৬৪)
৫. (وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوْ۬ءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَه۫ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ)
“যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি জুলুম পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (সূরা নিসা ৪:১১০)। (হাকিম ২/৩০৫, মুরসাল সহীহ)
১ নং আয়াতের তাফসীর:
সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা সারা জাহানের মানুষকে তাক্বওয়া তথা তাঁকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিচ্ছেন। তাক্বওয়া হল, আল্লাহ তা‘আলার আদেশসমূহ মেনে চলা, নিষেধসমূহ বর্জন করা, একমাত্র তাঁর ইবাদত করা এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করা। যে জাতি তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলবে সে জাতি দুনিয়াতে সফলতা ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে। তাক্বওয়ার ফলাফল সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহান কুদরতের ব্যাপারে অবগত করে বলছেন, তিনি সমস্ত মানুষকে একজন মাত্র ব্যক্তি আদম (আঃ) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়াকেও তাঁর থেকে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ এ একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার সুদৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছেন। পারস্পরিক এ সহানুভূতি ও সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই একে অন্যের অধিকারের প্রতি সজাগ থাকে এবং উঁচু-নীচু, ধনী-গরীব, ইতর-ভদ্রের ব্যবধান ভুলে গিয়ে একই মানদণ্ডে সম্পর্ক তৈরি করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: মহিলাদেরকে পাঁজর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সবচেয়ে উঁচু পাঁজর হচ্ছে বেশি বক্র। সুতরাং তুমি যদি তাকে সম্পূর্ণ সোজা করতে চাও তবে তাকে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি তার মধ্যে কিছু বক্রতা রেখে দিয়ে উপকার লাভ করতে চাও তাহলে উপকার নিতে পারবে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৩১)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ দু’জন (আদম ও হাওয়া ‘আলাইহিমাস সালাম) ব্যক্তি থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রং ও ভাষা-ভাষী করে নারী-পুরুষে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সে দুজন ব্যক্তি থেকে মানুষ দিনান্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়াগায় ছড়িয়ে বসবাস করছে যেখানে পূর্বে কখনো বসবাস ছিল না।
تَسَا۬ءَلُوْنَ ‘তোমরা একে অপরের কাছে আবেদন কর’ অর্থাৎ সেই আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর, যে আল্লাহ তা‘আলার নামে একে অপরের কাছে চেয়ে থাক, যেমন বলা হয়: আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার কাছে চাচ্ছি।
وَالْأَرْحَامَ ‘আত্মীয়তাকে (সম্পর্ক ছিন্ন করাকে) ভয় কর’ অর্থাৎ আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাক। বরং আত্মীয়তা সম্পর্ক বহাল রাখ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ যাবতীয় সৃষ্টিকে সৃষ্টি করলেন। এমনকি যখন তাঁর সৃষ্টি কাজ শেষ করলেন, তখন আত্মীয়তা সম্পর্ক বলে উঠলো: সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে আপনার আশ্রয় লাভকারীদের এটাই যথাযোগ্য স্থান। তিনি (আল্লাহ) বললেন: হ্যাঁ, তুমি কি এতে খুশি নও যে, তোমার সাথে যে ব্যক্তি সুসম্পর্ক রাখবে আমিও তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব? সে (রক্ত সম্পর্ক) বলল: হ্যাঁ, সন্তুষ্ট হে আমার রব। আল্লাহ বললেন: তাহলে এ মর্যাদা তোমাকে দেয়া হল। (সহীহ বুখারী হা: ৫৯৮৭) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لَيْسَ الوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ، وَلَكِنِ الوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا
কেউ কিছু প্রদান করে, ফলে আমিও প্রদান করি এটা আত্মীয়তায় সম্পর্ক বহাল রাখা নয়। বরং আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখা হল, কেউ যদি সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে বহাল রাখা। (সহীহ বুখারী হা: ৫৯৯১)
যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৫৯৮৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা এবং তাঁর নির্দেশাবলী পালন করা ও নিষেধাজ্ঞা বর্জন করে চলা প্রত্যেক মু’মিনের দায়িত্ব। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ঈমানী দায়িত্ব।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পৃথিবীর সকল মানুষ একজন নর ও নারী থেকে সৃষ্ট।
২. তাক্বওয়ার গুরুত্ব জানতে পারলাম।
৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখা ওয়াজিব।
৪. আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।
وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا
📘 ১০১ নং আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরকে সফরে থাকাকালীন সালাত কসর (চার রাকআতবিশিষ্ট সালাত দু‘রাকআত করে আদায়) করার অনুমতি প্রদান করেছেন। তবে অবশ্যই সফর কোন শরীয়তসম্মত বা বৈধ কাজের জন্য হতে হবে। এটাই অধিকাংশ আলেমদের অভিমত।
তাই শরীয়ত অবাধ্য কোন কাজে সফর করলে তাতে কসর করা বৈধ হবে না। যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি কাজের জন্য বের হওয়া।
(إِنْ خِفْتُمْ) “যদি তোমাদের ভয় হয়”। এ কথা অবস্থার দিকে লক্ষ করে বলা হয়েছে। কেননা তখন সারা আরব-ভূমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কোন অবস্থাতেই সফর বিপদ মুক্ত ছিল না। কুরআনের এরূপ অনেক বিধান অধিকাংশ অবস্থার দিকে লক্ষ করে নাযিল হয়েছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(لَا تَاْكُلُوا الرِّبَا اَضَعَافًأ مُّضَاعَفًا)
তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। তার মানে কি এই- চক্রবৃদ্ধি না হলে সুদ খাওয়া যাবে? না বরং তখন আরবরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেত, তাই এভাবে বলা হয়েছে।
অনুরূপ:
(تُكْرِهُوْا فَتَيٰتِكُمْ عَلَي الْبِغَا۬ءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّنًا)
তোমাদের দাসীগণ সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে পার্থিব জীবনের ধন-লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারিণী হতে বাধ্য কর না”(সূরা নূর ২৪:৩৩)
এর অর্থ কি এই যে, তারা ব্যভিচার করতে চাইলে অনুমতি দিয়ে দাও। বরং তারা সতিত্ব রক্ষা করতে চাইতো তাই আল্লাহ তা‘আলা এ কথা বলেছেন। তাই ভয় না থাকলেও যে কোন বৈধ সফরে সালাত কসর করা যাবে। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইয়ালা বিন উমাইয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
(فَلَیْسَ عَلَیْکُمْ جُنَاحٌ اَنْ تَقْصُرُوْا مِنَ الصَّلٰوةِﺣ اِنْ خِفْتُمْ)
‘যদি তোমাদের আশঙ্কা হয়, কাফিররা তোমাদের জন্য ফেতনা সৃষ্টি করবে, তবে সালাত সংক্ষিপ্ত করলে তোমাদের কোন দোষ নেই’ এখন কি আল্লাহ তা‘আলা মানুষদের নিরাপত্তা দেননি? (তাহলে কসর করতে হবে কেন?)
উমার (রাঃ) বললেন: তুমি যাতে আশ্চর্য হয়েছো আমিও তাতে আশ্চর্য হয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন: এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দান। অতএব আল্লাহ তা‘আলার দান কবূল কর। (মুসনাদ আহমাদ হা: ১৭৪, সহীহ)
সফরের দূরত্ব: কতদূর গেলে সফর হবে এবং কসরের সালাত বৈধ হবে এরূপ কোন সীমা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্ধারণ করে দেননি। বরং কুরআনে ও সহীহ হাদীসে শুধু সফরের কথা এসেছে। তাই মানুষের কাছে সফর বলে মনে হয় এমন দূরত্বে গেলেই কসরের সালাত পড়তে পারবে। (জাদুল মাআদ ১/৪৬, সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ: ১/৪৮১)
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের যুগে তিন মাইল, পাঁচ মাইল, দশ মাইল ইত্যাদি দূরত্বে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে ও সাহাবীগণ কসর সালাত আদায় করতেন। (ইরওয়াউল গালীল ৩/১৫-১৮)
কারণ উক্ত দূরত্ব সে সময়ে সফর বলে তাদের নিকট গণ্য হত।
কতদিনের সফরে গেলে সালাত কসর করে আদায় করতে পারবে এ বিষয়েও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন সময়সীমা নির্ধারণ করে দেননি। তাই এ নিয়ে বেশ মতভিন্নতা পাওয়া যায়। সেহেতু কোন ব্যক্তি কোথাও স্থায়ী বসবাস বা দীর্ঘদিন অবস্থানের উদ্দেশ্য ছাড়া যতদিনের জন্যই সফর করুক না কেন তার জন্য মুসাফিরের হুকুম প্রযোজ্য হবে। (ইরওয়াউল গালীল ৩/২৮, সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/৪৯৭)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বৈধ সফরে সালাত কসর করার বিধান জানতে পারলাম।
২. কসরের জন্য ভয় থাকা আবশ্যক না।
৩. কসরের জন্য নির্ধারিত কোন দূরত্ব ও সময়সীমা নেই।
وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَىٰ لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ ۗ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِنْ مَطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَرْضَىٰ أَنْ تَضَعُوا أَسْلِحَتَكُمْ ۖ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا
📘 ১০২ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
আবূ আইয়াশ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: উসফান নামক স্থানে আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম, আমরা মুশরিকদের মুখোমুখি হয়েছিলাম। তখন খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিল মুশরিকদের নেতা। তারা আমাদের ও কেবলার মাঝে অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিয়ে যোহর সালাত আদায় করলেন। তখন মুশরিকরা বলল: তারা এমন এক অবস্থায় ছিল আমরা হামলা করতে পারতাম। তারপর তারা বলল: তাদের কাছে (মুসলিমদের) এমনটি সালাত আসবে যা তাদের সন্তান সন্ততি ও নিজেদের থেকে অধিক প্রিয়। তখন এ আয়াত নিয়ে জিবরীল (আঃ) যোহর ও আসর সালাতের মাঝে আসেন। (নাসাঈ হা: ১৫৪৯, ১৫৫০, সহীহ।
অত্র আয়াতে সালাতুল খাওফের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সহীহ হাদীসে সালাতুল খাওফের কয়েকটি নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে এ আয়াতে বর্ণিত নিয়মটি হল দু’দলের এক দল ইমামের সাথে অস্ত্রসহ এক রাকআত সালাত আদায় করে নেবে, অন্য দল শত্র“দের পাহারায় নিযুক্ত থাকবে। এ দল রাকআত আদায় করে নিলে পাহারারত দল এসে এক রাকাত আদায় করে নেবে। পরে আবার রেওয়াজ বদল করে উভয় দলের বাকি এক রাকআত আদায় করে প্রথম দল সালাম ফিরিয়ে চলে যাবে, ইমাম সালাম না ফিরিয়ে বসে থাকবে পরের দলের সাথে একত্রে সালাম ফেরাবেন।
(وَدَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ تَغْفُلُوْنَ)
‘কাফিররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও’ অর্থাৎ তোমরা জিহাদ করা ও শত্র“দের বিরুদ্ধে সরঞ্জামাদী তৈরি করতে গাফেল থাক আর দুনিয়ার ভোগ সামগ্রী নিয়ে ব্যস্ত থাক যাতে শত্র“রা অতর্কিত হামলা চালিয়ে তোমাদের শেষ করে দিতে পারে। এটাই তাদের কামনা।
(وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ)
‘তোমাদের কোন দোষ নেই’ অর্থাৎ যদি বৃষ্টি, অসুস্থতা ও অন্য কোন শরয়ী কারণে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি নিতে হয় তাহলে কোন গুনাহ নেই। তবে যেন কোন অবস্থাতেই সতর্কতা থেকে গাফেল হওয়া চলবেনা। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এ আয়াতটি আবদুর রহমান আতিকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫৯৯)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সালাতুল খাওফ শরীয়তসিদ্ধ।
২. সালাতুল খাওফের নিয়ম-বিধি।
৩. শত্র“দের বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।
৪. এ আয়াতের অন্যতম শিক্ষা হল জামা‘আতে সালাত আদায় করা আবশ্যক।
وَيَسْتَفْتُونَكَ فِي النِّسَاءِ ۖ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِيهِنَّ وَمَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ فِي يَتَامَى النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا تُؤْتُونَهُنَّ مَا كُتِبَ لَهُنَّ وَتَرْغَبُونَ أَنْ تَنْكِحُوهُنَّ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الْوِلْدَانِ وَأَنْ تَقُومُوا لِلْيَتَامَىٰ بِالْقِسْطِ ۚ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِهِ عَلِيمًا
📘 ১২৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি এ আয়াতের ব্যাপারে বলেন: কোন ব্যক্তির নিকট কোন ইয়াতীম মেয়ে থাকলে সে তাকে লালন-পালন করত, তার সম্পদে উত্তরাধিকারী হয়ে যেত এমনকি বাগানেও শরীক হত। তখন মেয়েকে বিবাহ করার প্রতি উৎসাহিত হত এবং অন্যত্র বিবাহ দিত না এই ভয়ে যে, অন্য পুরুষ তার সম্পদে ভাগ বসাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৪)
(وَمَا يُتْلٰي عَلَيْكُمْ)
‘যা পাঠ করে শুনানো হয়েছে’বলতে এ সূরার শুরুর আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেখানে ইয়াতীম মেয়েদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
لَا تُؤْتُوْنَهُنَّ
‘তোমরা প্রদান কর না’ অর্থাৎ তোমরা ইয়াতীম মেয়েদের সম্পদ হরণ করার জন্য বিবাহ কর কিন্তু বিবাহের মোহরানা প্রদান কর না। এবং নিজেরা বিবাহ না করলেও সম্পদ চলে যাবে বলে অন্যত্র বিবাহ দাও না।
এখানে দু’ভাবে পড়া যায় (১) في অব্যয় উহ্য ধরে, তখন অর্থ হবে: তাদেরকে তোমরা বিবাহ করতে আগ্রহী হলেও মোহরানা প্রদান কর না। عن অব্যয় উহ্য ধরে, তখন অর্থ হবে: তাদেরকে তোমরা বিবাহ করতে আগ্রহী নও। অর্থাৎ ইয়াতীম মেয়ে সুন্দর সুশ্রী হলে অভিভাবকরা বিবাহ করে নিত, আর কুশ্রী হলে অন্যত্র বিবাহ দিত না এই ভয়ে যে, অন্যজন সম্পদে ভাগ বসাবে। এখানে উভয় প্রকার জুলুম থেকেই নিষেধ করা হয়েছে।
(وَالْمُسْتَضْعَفِيْنَ مِنَ...)
‘অসহায় শিশুদের সম্বন্ধে’ আর আল্লাহ তা‘আলা দুর্বল তথা ছোট শিশু ও নারীদের ব্যাপারেও ফাতওয়া দেবেন। তোমরা তোদের প্রাপ্ত অধিকার দিয়ে দাও। জাহিলী যুগের মত বঞ্চিত কর না। ইয়াতীমদের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রেখ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইসলামই সর্বপ্রথম মহিলা ও শিশুদের মীরাসের অধিকার প্রদান করেছে।
২. কারো প্রতি জুলুম না করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের নির্দেশ।
۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ ۚ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللَّهُ أَوْلَىٰ بِهِمَا ۖ فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَىٰ أَنْ تَعْدِلُوا ۚ وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
📘 ১৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা এখানে মু’মিনদেরকে ন্যায়ের ওপর সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকতে নির্দেশ দিচ্ছেন। কোন অবস্থাতেই যেন ন্যায় থেকে বিচ্যুত হয়ে ডান-বামে সরে না যায় এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে যেন কোন ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনা প্রভাবিত না করে।
(شُھَدَا۬ئَ لِلہِ)
‘আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ’ অর্থাৎ ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা ও ন্যায় সাক্ষ্য প্রদান করা যেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে খুশি করার জন্য হয়। যদিও এ ন্যায় সাক্ষ্য নিজের পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে যায়।
(فَاللّٰهُ أَوْلٰي بِهِمَا)
‘আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর’অর্থাৎ কোন ধনভাণ্ডারের ধন ও কোন দরিদ্রের দারিদ্রতার ভয় যেন তোমাদেরকে সত্য কথা বলার পথে বাঁধা না দেয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের তত্ত্বাবধায়ক, তাদের কল্যাণের ব্যাপারে তিনি ভাল জানেন।
(فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوٰٓي)
‘সুতরাং তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না’প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না অর্থাৎ প্রবৃত্তির অনুসরণ যেন তোমাদেরকে পক্ষপাতিত্ব বা বিদ্বেষ করতে বাধ্য না করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يیٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللہَ وَاٰمِنُوْا بِرَسُوْلِھ۪ یُؤْتِکُمْ کِفْلَیْنِ مِنْ رَّحْمَتِھ۪ وَیَجْعَلْ لَّکُمْ نُوْرًا تَمْشُوْنَ بِھ۪ وَیَغْفِرْ لَکُمْﺚ وَاللہُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌﭫ)
“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন এবং তিনি তোমাদেরকে দেবেন আলো, যার সাহায্যে তোমরা চলবে এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(সূরা হাদীদ ৫৭:২৮)
আর যদি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে সাক্ষ্য বিকৃতি ও পরিবর্তন কর তাহলে জেনে রেখ তোমরা যা কর আল্লাহ তা‘আলা সব জানেন। অতএব সাক্ষ্য ও বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সর্বস্তরের মু’মিনদের জন্যই আবশ্যক।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিচার ফায়সালা ও সাক্ষ্য দানে ন্যায়ের অনুসরণ করা ওয়াজিব।
২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হারাম।
৩. সাক্ষ্য নিজের বিপক্ষে গেলেও সত্য কথা বলা উচিত।
৪. কোন কিছুর লোভ বা ভয় যেন সত্য সাক্ষ্য প্রদান থেকে বিচ্যুত না করে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَىٰ رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ ۚ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا
📘 ১৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে পরিপূর্ণভাবে ঈমানে প্রবেশ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। এর অর্থ এ নয় যে, ঈমান আনয়নকারীদেরকে পুনরায় ঈমান আনতে হবে বরং ঈমান আনয়নকারী ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নেবে। আর যারা ঈমান আনবে না তারাই পথভ্রষ্ট।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে অথবা (বলেছেন) ষাটের কিছু বেশি শাখা আছে। এর সর্বোত্তম শাখা হচ্ছে: লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ ‘আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সত্যিকার ইলাহ নেই’ বলা এবং সাধারণ অর্থাৎ নিম্নস্তরের শাখা হচ্ছে চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি বিশেষ শাখা। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৫)
الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ۚ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا
📘 ১৪১ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে মুনাফিকদের কথা বলা হচ্ছে। যদি মু’মিনদের কোন বিজয় হত মুনাফিকরা বলত আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। আর যদি কাফিরদের বিজয় হত তারা কাফিরদেরকে বলত, আমরা কি তোমাদেরকে মু’মিনদের হাত থেকে রক্ষা করিনি। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাদের ফায়সালা করবেন তাদেরকে এ দ্বিমুখীতার পরিণতি জানিয়ে দেবেন।
(وَلَنْ يَّجْعَلَ اللّٰهُ لِلْكٰفِرِيْنَ عَلَي الْمُؤْمِنِيْنَ سَبِيْلًا)
“এবং আল্লাহ কখনই মু’মিনদের বিরুদ্ধে কাফিরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।”
এ আয়াতের কয়েকটি দিক আলেমগণ বর্ণনা করেছেন:
১. আলী বিন আবূ তালেব ও ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: কিয়ামতের দিন মু’মিনদের ওপর কাফিররা বিজয় লাভ করতে পারবে না।
২. হুজ্জত ও প্রমাণাদির দিক দিয়ে কাফিররা মুসলিমদের ওপর জয়লাভ করতে পারবে না।
৩. কাফিরদের এমন বিজয় আসবে না যাতে মুসলিমদের রাজত্ব ও প্রতিপত্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ মতের সমর্থনে হাদীস এসেছে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৮৯)
৪. যতদিন মুসলিমরা নিজেদের দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে বাতিলের সাথে আপোষ করবে না এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে ততদিন পর্যন্ত কাফিররা তাদের ওপর জয়লাভ করতে পারবে না। ইবনুল আরাবী বলেন: এটি সব থেকে উত্তম কথা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْكُمْ وَيَعْفُوْا عَنْ كَثِيْرٍ )
“তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদেরই হাতের কামাইয়ের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।”(সূরা শুরা ৪২:৩০, তাফসীর কুরতুবী ৫/৩১৬)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুনাফিকদের দ্বিমুখী নীতি সম্পর্কে অবগত হলাম।
২. মুনাফিকরা সুবিধাবাদী।
৩. মুসলিমরা যতদিন সঠিক দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ও বাতিলের সাথে আপোষ করবে না ততদিন বিজয়ী থাকবে।
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ ۚ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۖ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ ۚ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ ۚ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ ۘ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا
📘 ১৭১ নং আয়াতের তাফসীর:
غلو (অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করা) শব্দের তাৎপর্য হল, কোন বস্তুকে তার নির্ধারিত সীমা থেকে বাড়িয়ে দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদেরকে ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন। এ অপরাধ খ্রিস্টানদের মধ্যে বেশি বিদ্যমান। যেমন তারা ঈসা (আঃ)-এর সত্যতার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছে। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যে মর্যাদা দান করেছেন তারা তার ঊর্ধ্বে তুলে দিয়েছিল।
তারা ঈসা (আঃ)-কে নাবীর মর্যাদা থেকে ইলাহের মর্যাদায় তুলে দিয়েছে। তারা ধর্ম যাজকদেরকে মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اِتَّخَذُوْآ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ)
“তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগিগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।”(সূরা তাওবাহ ৯:৩১)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খ্রিস্টানদের বাড়াবাড়ি দেখে উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন: তোমরা আমার ব্যাপারে তেমন বাড়াবাড়ি করো না যেমন খ্রিস্টানরা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে করেছে। আমি কেবল একজন আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল, সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল বলে সম্বোধন কর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৪৫)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষদেরকে সর্তক করে বলেন: তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে সত্য ছাড়া আর কিছু বলবে না। আয়াতের এ অংশ তিনটি জিনিস শামিল করে:
(১) আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে মিথ্যারোপ করা যাবে না।
(২) বিনা জ্ঞানে আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী, নাম কাজ ও শরীয়াতের ব্যাপারে মুখ খোলা যাবে না।
(৩) আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে যা বলবে সত্য বলবে।
তাই আল্লাহ তা‘আলা খ্রিস্টানদেরকে বলছেন, তোমরা যে বলে থাক আল্লাহ তা‘আলা তিনজনের একজন, ঈসা আল্লাহ তা‘আলার সন্তান, মারইয়াম আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী ইত্যাদি সব মিথ্যা এবং এসব আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে অপবাদ মাত্র।
(إِنَّمَا الْمَسِيْحُ عِيْسٰي)
‘মারইয়ামের ছেলে ‘ঈসা মসীহ’ঈসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার একজন বান্দা, তিনি আল্লাহ তা‘আলার সন্তান নন। একটি মাত্র কথা ‘কুন’(হয়ে যাও) দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মারইয়ামের গর্ভে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। এবং যেসকল রূহ দ্বারা তিনি মানুষ সৃষ্টি করেন তার মধ্যে ঈসা (আঃ) অন্যতম একটি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّتِيْٓ أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيْهَا مِنْ رُّوْحِنَا وَجَعَلْنٰهَا وَابْنَهَآ اٰيَةً لِّلْعٰلَمِيْنَ)
“এবং স্মরণ কর সে নারী (মারইয়াম)-কে, যে নিজ সতীত্বকে রক্ষা করেছিল, অতঃপর তার মধ্যে আমি আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে করেছিলাম বিশ্ববাসীর জন্য এক নিদর্শন। (সূরা আম্বিয়া ২১:৯১)
এরূপ ঘটনা সূরা মায়িদার ৭৫ নং, সূরা আল ইমরানের ৫৯ নং, সূরা তাহরীমের ১২ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিল আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই, তার কোন শরীক নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল, ঈসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল, তিনি আল্লাহ তা‘আলার একটি কথা যা মারইয়ামের প্রতি ফুঁকে দিয়েছেলেন, তিনি আল্লাহ তা‘আলার রূহসমূহের অন্যতম একটি রূহ, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, তার যে আমলই থাকুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৩৫)
অতএব আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলগণের প্রতি যেভাবে ঈমান আনা দরকার সেভাবে ঈমান আন। আর “তিন বল না”। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তিনজন- এ কথা বল না। যারা এ কথা বলে তারা কাফির। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْآ إِنَّ اللّٰهَ ثَالِثُ ثَلٰثَةٍ م وَمَا مِنْ إلٰهٍ إِلَّآ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ)
“যারা বলে, ‘আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন, তারা কুফরী করেছে- এক ইলাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ সত্যিকার নেই।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৭৩)
তাই আমরাও যেন আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ কোন নাবী, ওলী-আওলিয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করি। আমরা প্রত্যেক নাবীকে তার উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করবো, মর্যাদার নামে সীমালংঘন করবো না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা হারাম।
২. বিনা জ্ঞানে আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে কথা বলা হারাম।
৩. ঈসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার একজন বান্দা ও রাসূল।
৪. তিনজন আল্লাহ- এ কথা যারা বলে তারা কাফির।
৫. নাবী ও ওলী আওলিয়াদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা নিষেধ।
يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ ۚ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ ۚ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ ۚ فَإِنْ كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ ۚ وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ ۗ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَنْ تَضِلُّوا ۗ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
📘 ১৭৬ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
জাবের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা আমি অসুস্থ হলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার নিকট আগমন করলেন। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি আমার বোনদের জন্য এক তৃতীয়াংশ সম্পদ অসীয়ত করব? তিনি বললেন: (আরো একটু বৃদ্ধি করে তাদের প্রতি) ইহসান কর, আমি বললাম: তাহলে অর্ধেক দেই? তিনি বললেন: (আরো একটু বৃদ্ধি করে তাদের প্রতি) ইহসান কর। জাবের (রাঃ) বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বের হলেন অতঃপর আমার কাছে আগমন করে বললেন, আমার মনে হয় এ অসুখে তুমি মারা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করে তোমার বোনদের অংশ বর্ণনা করে দিয়েছেন আর তা হল দুই তৃতীয়াংশ। এরপর জাবের (রাঃ) বলতেন:
(يَسْتَفْتُوْنَكَ قُلِ اللّٰهُ....)
এ আয়াতটি আমার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। (আবূ দাঊদ হা: ২৮৮৭, সহীহ)
এ আয়াতকে আয়াতুস সাইফ বা গ্রীস্মকালের আয়াত বলা হয় । কারণ তা গ্রীস্মকালে নাযিল হয়েছে। (মুসনাদ আহমাদ ১/২৬, সহীহ)
كَلَالَة ‘কালালাহ’ বলা হয় ঐ মৃত ব্যক্তিকে যার পিতা-মাতা নেই এবং সন্তান নেই। কেউ কেউ বলেছেন, যে মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র নেই। পুত্র বলতে পুত্র ও পৌত্র উভয়কে বলা হয়। আর বোন বলতে সহোদর বোন ও বৈমাত্রেয় উভয় বোনকে বলা হয়।
যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় আর যদি তার কোন সন্তান না থাকে কিন্তু বোন থাকে তাহলে বোন একাই সমস্ত সম্পদের অর্ধেক অংশ পাবে। আর দু’জন হলে দুই তৃতীয়াংশ পাবে। অনুরূপভাবে বোন মারা গেলে সে ভাই ওয়ারিশদার হবে তবে শর্ত হল যদি বোনের কোন সন্তান না থাকে। এবং যদি পিতা না থাকে। যেহেতু ভাইয়ের চেয়ে পিতা সম্পর্কের দিক দিয়ে নিকটতম। সুতরাং পিতার বর্তমানে ভাই উত্তরাধিকারী হবে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কোন বিষয় না জানা থাকলে জ্ঞানীদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া উচিত।
২. ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদেরকে উত্তরাধিকারের অংশ প্রদান করেছে।
৩. আল্লাহ তা‘আলা বিধি-বিধান প্রদান করেছেন যাতে মানুষ সঠিক পথ পায়।
۞ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۖ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ۚ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَٰلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ ۚ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُمْ بِهِ مِنْ بَعْدِ الْفَرِيضَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
📘 ২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
(المُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَا۬ءِ)
শানে নুযূল:
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আওতাসের যুদ্ধে কতকগুলো সধবা স্ত্রীলোক বন্দি হয়ে আসে। আমরা তাদের সাথে সহবাস করতে অপছন্দ করলাম কারণ তাদের স্বামী রয়েছে। আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৫৬) অর্থাৎ যে সকল নারীদের স্বামী রয়েছে তাদের বিবাহ করা হারাম যতক্ষণ সে স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে থাকবে। তবে যদি মুসলিমরা কাফির জাতির ওপর বিজয় লাভ করে, তাদের নারীদের হস্তগত করে নেয় তাহলে তাদের কাফির স্বামী থাকতেও তাদের বিবাহ করা দূষণীয় নয়।
আর কোন মুসলিম নারীর শরীয়তসম্মত বিবাহ বিচ্ছিন্ন না হলে তার সাথে বিবাহ বন্ধন হারাম। সুতরাং যে সকল নারী স্বামীদের ছেড়ে দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে অভিভাবক ছাড়া নিজে নিজেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের সে বিবাহ অবৈধ। বিবাহ শরীয়তসম্মত হবে না, যতদিন তারা এ অবস্থায় থাকবে ততদিন ব্যভিচারে লিপ্ত থাকবে। এ ছাড়া বাকিদেরকে বিবাহ করা বৈধ।
উল্লেখ্য: محصنات শব্দটি কুরআনে চারটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে-
১. সধবা স্ত্রী। যেমন অত্র সূরার ২৪ নং আয়াত:
(وَّالْمُحْصَنٰتُ مِنَ النِّسَا۬ءِ)
২. স্বাধীন মহিলা। যেমন:
(وَمَنْ لَّمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَّنْكِحَ الْمُحْصَنٰتِ)
৩. ব্যভিচার থেকে পবিত্র। যেমন:
(مُحْصَنٰتٍ غَيْرَ مُسٰفِحٰتٍ)
৪. মুসলিম নারী। যেমন: فإن أحصن (ফাতহুল কাদীর, ১/৫৯৯)
(مُّحْصِنِیْنَ غَیْرَ مُسٰفِحِیْنَ)
‘বিয়ে করার জন্য তোমরা তাদের কামনা করবে, ব্যভিচারের জন্য নয়’ অর্থাৎ অন্যান্য নারীদের হালাল করে দেয়া হয়েছে এ শর্তে যে, তোমরা মাহর দিয়ে বিবাহের মাধ্যমে গ্রহণ করবে। অর্থের বিনিময়ে উপপতœী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নয়। এ আয়াত দ্বারাও মুতা বিবাহর অবৈধতা বুঝা যাচ্ছে এবং অর্থ দিয়ে বিনা বিবাহে উপভোগ করাও হারাম।
(فِیْمَا تَرٰضَیْتُمْ بِھ۪ مِنْۭ بَعْدِ الْفَرِیْضَةِ)
‘মাহর ধার্য করার পর কোন বিষয়ে উভয়ে একমত হও’ অর্থাৎ মাহর ধার্য করার পর স্বামীর পক্ষ থেকে মাহর এর অতিরিক্ত কিছু দেয়া অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে সন্তুষ্টচিত্তে মাফ করে দেয়ার ব্যাপারে উভয়ে একমত হলে তাতে কোন গুনাহ হবে না।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জাহিলী যুগের সকল বিবাহ পদ্ধতি হারাম। তবে যা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য রাখে তা ব্যতীত।
২. বংশজাত, দুধ সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় যাদের বিবাহ করা হারাম তাদের ব্যাপারে জানতে পারলাম।
৩. পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ বৈধ। তাদের সাথে পর্দা ওয়াজিব।
৪. আপন দুই বোনকে একত্রে বিবাহ হারাম।
৫. অন্যের স্ত্রীকে বলপ্রয়োগপূর্বক বিবাহ হারাম।
৬. খবরে ওয়াহিদ দ্বারা কুরআনের ওপর বৃদ্ধি শরীয়তসিদ্ধ।
وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ فَتَيَاتِكُمُ الْمُؤْمِنَاتِ ۚ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَانِكُمْ ۚ بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ ۚ فَانْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ مُحْصَنَاتٍ غَيْرَ مُسَافِحَاتٍ وَلَا مُتَّخِذَاتِ أَخْدَانٍ ۚ فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ ۚ ذَٰلِكَ لِمَنْ خَشِيَ الْعَنَتَ مِنْكُمْ ۚ وَأَنْ تَصْبِرُوا خَيْرٌ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
📘 ২৫ নং আয়াতের তাফসীর:
যে সকল পুরুষ স্বাধীন মু’মিন নারীকে বিবাহ করতে আর্থিক সক্ষম নয় তবে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের জন্য বৈধ রয়েছে যে, তারা মু’মিন দাসীদেরকে তাদের মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে বিবাহ করতে পারবে।
তাদের মাহর দিতে হবে যেমন স্বাধীন মু’মিনা নারীকে দেয়া হয়। অবশ্যই যেন এসব দাসী ব্যভিচার থেকে পুত-পবিত্র থাকে এবং যাতে কোন পরকিয়ায় জড়িত না থাকে।
মোটকথা, একজন স্বাধীন মুসলিম ব্যক্তির একজন ক্রীতদাসীকে বিবাহ করা বৈধ চারটি শর্তে:
১. বাহ্যিক পবিত্র থাকতে হবে।
২. অভ্যন্তরীণ পবিত্র থাকতে হবে। অর্থাৎ প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কোন প্রকার ব্যভিচারে লিপ্ত থাকতে পারবে না।
৩. স্বাধীন মু’মিন নারীকে মাহর ও ভরণ পোষণ দিতে অক্ষম।
৪. যে ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করে।
যদি ক্রীতদাসীরা বিবাহিত হয়ে যায় বা ইসলাম কবুল করে নেয়, আর ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাহলে স্বাধীন ব্যক্তিকে যে ১০০ বেত্রাঘাত করা হয় তাদেরকে তার অর্ধেক চল্লিশটি বেত্রাঘাত করতে হবে।
আর অবিবাহিত হলে শিক্ষামূলক শাস্তি দিলেই হবে। এর পরেও যদি দাসীকে বিবাহ না করে ধৈর্য ধারণ করে তাহলে তাই উত্তম। (তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ১৫৬)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা স্বাধীন মু’মিনা নারীকে বিবাহ করতে অক্ষম তারা দাসীদের চারটি শর্তে বিবাহ করতে পারে। তবে এ থেকেও ধৈর্য ধারণ শ্রেয়।
২. দাসীদের শাস্তি স্বাধীনাদের অর্ধেক।
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا
📘 ৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
যারা কাবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে তাদের ফযীলত বর্ণনা করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্যান্য সকল গুনাহ ও মন্দ কাজ মোচন করে দেবেন এবং সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাবেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুমুআ থেকে আর এক জুমুআ ও এক রমাযান থেকে আর এক রমাযান এর মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের কাফফারাস্বরূপ, তবে যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৩৩)
কবীরা তথা মহাপাপসমূহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মুফাসসিরগণ অনেক মতামত প্রদান করেছেন। সকল মতামতের সারাংশ নিয়ে এসেছেন ইমাম তাহাবী তাঁর আকিদা তাহাবীয়াতে। সেখানেও প্রায় ১-১৪টি সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা হল;
(كُلُّ ذَنْبٍ مَا تَوَعَّدَ اللَّهُ عَلَيْهَ بِنَارٍ أَوْ عَذَابٍ أَوْ غَضَبٍ أَوْ لَعْنَةٍ)
প্রত্যেক ঐ সব অপরাধ যেগুলো করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম, শাস্তি, তাঁর ক্রোধ অথবা তাঁর লা’নতের ধমক দিয়েছেন। (আকীদা তাহাবীয়া)
কাবীরা গুনাহর সংখ্যা কত এ নিয়েও অনেক মতামত বিদ্যমান।
ইমাম যাহাবী (রহঃ) প্রণীত “কবীরা গুনাহ” কিতাবে সত্তরটির মত কবীরা গুনাহর বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে তাফসীর ইবনে কাসীরে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কবীরা গুনাহ থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব এবং নেকীর কাজ।
২. কবীরা গুনাহ ক্ষমার জন্য তাওবাহ করা শর্ত।
৩. কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে আল্লাহ তা‘আলা সাগীরাহ গুনাহ এমনিতেই মাফ করে দেবেন।
۞ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا
📘 ৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের উলুহিয়ার বা এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সাথে সাথে উলুহিয়া বিধ্বংসী আমল শির্ক করা থেকে নিষেধ করছেন।
একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুয়ায বিন জাবালকে বলেন, হে মুয়ায (রাঃ) তুমি কি জান! বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? এবং আল্লাহ তা‘আলার ওপর বান্দার হক কী? মুয়ায (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল অধিক জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল: বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর বান্দা যখন এ কাজ করবে তখন আল্লাহ তা‘আলার ওপর বান্দার হক হল: আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তি দেবেন না। (সহীহ বুখারী হা: ২৮৫৬)
আল্লাহ তা‘আলার হকের সাথে সাথে মানুষের মাঝে যারা সবচেয়ে বেশি সৎ আচরণ পাবার হকদার মাতা-পিতার কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানেই আল্লাহ তা‘আলা নিজের কথা বলেছেন সেখানেই পিতা-মাতার হকের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَضٰي رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْآ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا)
“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত কর না ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।”(সূরা ইসরা ১৭:২৩)
পিতা-মাতার সাথে সৎ আচরণের পরেই নিকট আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকিন, পাড়া-প্রতিবেশি, মুসাফির ও ক্রীতদাস-দাসীদের সাথেও সৎ আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتّٰي ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ
জিবরীল আমাকে সর্বদা প্রতিবেশীর ব্যাপারে অসীয়ত করতে থাকে এমনকি আমার মনে হল অচিরেই আমার ওয়ারিশ বানিয়ে দেবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬০১৫)
(وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبٰي وَالْجَارِ الْجُنُبِ)
‘নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী’ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন,
(وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبٰي)
হল এমন প্রতিবেশী যার সাথে আত্মীয়তা আছে। الجارالجنب হল যার সাথে আত্মীয়তা সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ বলেন, প্রথমটা হল মুসলিম, আর দ্বিতীয়টা হল অমুসলিম।
والصاحب بالجنب
কেউ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল: স্ত্রী, কেউ বলেছেন; সৎবন্ধু। আর কেউ বলেন, বাড়িতে অবস্থান ও ভ্রমণে যে বন্ধু।
(وَمَا مَلَکَتْ اَیْمَانُکُمْ)
‘দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়েছে’ অর্থাৎ ক্রীতদাস-দাসী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তুমি যা খাও তোমার দাস-দাসীকে তাই খাওয়াও। তুমি যা পর তোমার দাস-দাসীকেও তা-ই পরাও। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যদি তোমার কর্মচারী খাবার নিয়ে আসে তাহলে তাকে সাথে নিয়ে বসে খাও, না খেলে এক লোকমা বা দুই লোকমা দিয়ে দাও। কেননা সে আগুনের তাপ সহ্য করেছে। (সহীহ বুখারী হা: ৫৪৬০) তারপর আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে ভালবাসেন না তাদের আলোচনা উল্লেখ করেছেন।
মাতরাফ (রহঃ) বলেন: আমার নিকট আবূ যার (রাঃ)-এর একটি বর্ণনা পৌঁছে ছিল। আমার মনের আশা ছিল তার সাথে সাক্ষাত করার। একদিন তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়ে গেল। আমি বললাম: হে আবূ যার, আমার কাছে পৌঁছেছে যে, আপনি নাকি মনে করেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাদের এ হাদীস বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তিন প্রকার লোককে ভালবাসেন, আবার তিন প্রকার লোককে অপছন্দ করেন। তিনি বললেন: হ্যাঁ সত্য। তুমি কি মনে কর আমি আমার বন্ধুর ব্যাপারে মিথ্যা বলব! যে তিন প্রকার লোককে আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন না তারা হল, অহঙ্কারী দাম্ভিক। তোমরা কি কিতাবে পাওনি? তখন
(إِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে।’এ আয়াতটি পাঠ করেন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য করতে হবে।
২. ইবাদত বিধ্বংসী শির্ক থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে।
৩. পিতা-মাতাসহ অন্যান্যদের সাথে সদাচরণ করতে হবে।
৪. অহঙ্কারী ও দাম্ভিক লোকেদের আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন না।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَىٰ حَتَّىٰ تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّىٰ تَغْتَسِلُوا ۚ وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَىٰ أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا
📘 ৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাত ও সালাতের স্থান মাসজিদের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। এ বিধান ছিল মদ হারাম হবার পূর্বে। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি মদ তিনটি পর্যায়ে হারাম হয়েছে। এটি ছিল দ্বিতীয় পর্যায়।
এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ২১৯ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে অপবিত্র অবস্থায় সালাত ও মাসজিদের নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ যদি মাসজিদের এক দরজা থেকে অন্য দরজায় যেতে বাধ্য হয় মাসজিদে অবস্থান ব্যতীত তাহলে তার জন্য তা বৈধ।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা তায়াম্মুমের বিধান ও যাদের জন্য তা শরীয়তসিদ্ধ করে দিয়েছেন তাদের বর্ণনা দিচ্ছেন। শরীয়ত কর্তৃক তায়াম্মুমের অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নিম্নরূপ:
১. অসুস্থ ব্যক্তি, যিনি আশঙ্কা করেন যে, পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বৃদ্ধি পাবে।
২. মুসাফির, দূরে সফর করুক বা কাছেই সফর করুক যদি পানি না পায় তাহলে তিনি তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করতে পারেন।
যদি পানি না থাকে বাড়িতে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের জন্যও তায়াম্মুম শরীয়াতসিদ্ধ। এখানে রোগী ও মুসাফিরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল সাধারণত এদের প্রয়োজন বেশি দেখা দেয়।
৩. পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী পানি না পেলে তায়াম্মুম করবে।
৪. স্ত্রীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক করার পরও যদি সালাতের সময় হয়ে যায় কিন্তু পানি না পায় তাহলে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করবে। তারপরেও সালাত বিলম্ব করা বা ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই।
তারপর তায়াম্মুমের পদ্ধতি বলা হচ্ছে। প্রথমে উভয় হাত মাটিতে একবার মেরে মুখমণ্ডল মাসেহ করবে তারপর উভয় হাতের কব্জী পর্যন্ত মাসেহ করবে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমার জন্য এরূপ করাই যথেষ্ট ছিল- এই বলে তিনি দু’হাত মাটিতে মারলেন এবং উভয় হাতে ফুঁ দিলেন (যাতে বেশি বালু থাকলে পড়ে যায়) তারপর উভয় হাত দ্বারা তার চেহারা ও হাতের কব্জী পর্যন্ত মাসেহ করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৮)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবারই মাটিতে দু’হাত মেরেছেন, দু’বার না। দু’বার মাটিতে হাত মারা এবং কনুই পর্যন্ত মাসেহ করার হাদীস দুর্বল। (দারাকুতনী: ১/১৮০)
ইমাম বুখারী অধ্যায় রচনা করেছেন:
باب التيمم ضربة
“তায়াম্মুমের জন্য মাটিতে হাত মারা একবার”-এর অধ্যায়। صعيدا طيبا “পবিত্র মাটি” পৃথিবীর সমস্ত মাটি মুসলিমদের জন্য সালাত ও তায়াম্মুমের জন্য পবিত্র। তবে হাদীসে যে স্থানগুলোর কথা বাদ দেয়া হয়েছে সেগুলো ব্যতীত।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমার জন্য পৃথিবীর মাটি সালাতের জায়গা। অতএব পুরুষদের জন্য কোন অবস্থাতেই সালাত বর্জনের সুযোগ নেই, মহিলাদের জন্যও না, তবে বিশেষ কয়েক দিন ব্যতীত। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৫)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অপবিত্র অবস্থায় সালাত আদায় ও মাসজিদে অবস্থান হারাম। তবে কেউ মাসজিদের এক দরজা হতে অন্য দরজা দিয়ে গমন করতে বাধ্য হলে তা জায়েয।
২. তায়াম্মুমের বিধান জানতে পারলাম।
৩. তায়াম্মুমের জন্য হাত মাটিতে মারতে হবে মাত্র একবার।
৪. গোসল ফরয হলে যথাযসম্ভব তা তাড়াতাড়ি সেরে নেয়া উত্তম।
৫. পানি না পেলে অপবিত্র অবস্থাতেই তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করে নেয়া বৈধ।
۞ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ۚ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا
📘 ৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
অধিকাংশ মুফাসসিরে কিরামের মতে, এ আয়াত উসমান বিন তালহা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তিনি বংশগতভাবেই কাবা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক এবং তার চাবির রক্ষক ছিলেন। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাবাতে উপস্থিত হয়ে তাওয়াফসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে উসমান বিন তালহাকে ডেকে পাঠালেন। তারপর তাঁর হাতে কাবার চাবি হস্তান্তর করে দিয়ে বলেন, এগুলো তোমার চাবি। আজকের দিন অঙ্গীকার পূরণের দিন। (ইবনে কাসীর, ২/৩৭৯)
এ আয়াত বিশেষ কারণে অবতীর্ণ হলেও তা সকল প্রকার আমানতকে শামিল করে। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
أَدِّ الْأَمَانَةَ إِلٰي مَنِ ائْتَمَنَكَ، وَلَا تَخُنْ مَنْ خَانَكَ
যে তোমার কাছে আমানত রেখেছে তার কাছে আমানত ফিরিয়ে দাও। আর যে খিয়ানত করেছে তার সাথে খিয়ানত কর না। (আবূ দাঊদ হা: ৩৫৩৪, তিরমিযী হা: ১২৬৪, সহীহ)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা সকল শ্রেণির মানুষকে সম্বোধন করে ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচারকার্য সম্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إِنَّ اللّٰهَ مَعَ الْقَاضِي مَا لَمْ يَجُرْ فَإِذَا جَارَ وَكَّلَهُ إِلَي نَفْسِهِ
বিচারক যতক্ষণ পর্যন্ত জুলুম করে না ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তার সাথে থাকেন। অতঃপর সে যখন জুলুম শুরু করে দেয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার নিজের ওপর ছেড়ে দেন। (ইবনু মাযাহ হা: ২৩২১, হাসান)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন: কিয়ামতের দিন ন্যায়-বিচারকারীরা দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ডান পাশে নূরের মিন্বারের ওপর থাকবে। আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাত ডান হাত, যারা বিচারে, পরিবারে এবং যাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে (তারা সবাই এতে শামিল)। (সহীহ মুসলিম হা: ১৮২৭)
তাই আমানত ফিরিয়ে দেয়া, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার বজায় রাখা প্রতিটি মু’মিন মুসলিমের নৈতিক দায়িত্ব।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আমানত রক্ষা করা ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।
২. বিচার-ফায়সালায় ন্যায় পন্থা অবলম্বন করা ওয়াজিব।
৩. আল্লাহ তা‘আলার হাত রয়েছে, এমনকি তার উভয় হাত ডান হাত।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ۖ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
📘 ৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং একজন আনসারীকে নেতৃত্ব দান করেন। ইবনু আব্বাসের বর্ণনায় রয়েছে: তিনি হলেন আবদুল্লাহ বিন হুযাফাহ (রাঃ)। যখন তারা বের হলেন, হঠাৎ তিনি সেনা বাহিনীর ওপর কোন বিষয়ে রাগান্বিত হন। অতঃপর তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি? তারা বলল হ্যাঁ। তিনি বললেন: তোমরা জ্বালানী কাঠ জমা কর, তারপর আগুন এনে কাঠগুলো জ্বালিয়ে দাও। অতঃপর নির্দেশ দিয়ে বললেন: আমি তোমাদেরকে এ আগুনে প্রবেশ করার নির্দেশ দিচ্ছি। তখন সেনারা তাতে প্রবেশ করার উপক্রম করল। এমন সময় একজন যুবক বললেন: আপনারা আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার রাসূলের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কিছু না জানা পর্যন্ত তড়িঘড়ি করবেন না। তিনি যদি তাতে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন তাহলে প্রবেশ করবেন।
আলী (রাঃ) বলেন: সকলে রাসূলের নিকট ফিরে এসে ঘটনাটি বলল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমরা যদি তাতে প্রবেশ করতে তাহলে কোনদিন তথা হতে বের হতে পারতে না। আনুগত্য কেবল সৎ কাজে। (সহীহ বুখারী হা: ৭১৪৫, ৪৫৮৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৮৪০, ১৮৩৪)
(وَاُولِی الْاَمْرِ مِنْکُمْ)
(উলুল আমর) ‘যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন:
أُولُو الْأَمْرِ مِنْكُمْ
হল: আলেম ও দীনদার ব্যক্তিবর্গ।
তাফসীর মুয়াসসারে বলা হয়েছে:
(أُولُو الْأَمْرِ مِنْكُمْ)
উলুল আমর হল শাসক শ্রেণি।
ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা ভাল জানেন। আয়াতে শাসক ও আলেম সকল প্রকার ক্ষমতাধর ব্যক্তি শামিল। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের আনুগত্য ও রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নেতা ও শাসকদেরও।
আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় আনুগত্যের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য ওয়াজিব করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(أَطِيْعُوا اللّٰهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلَا تُبْطِلُوْآ أَعْمَالَكُمْ)
“আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর। আর নিজেদের আমল নষ্ট কর না।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩৩)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই আয়াতে أَطِيْعُوا (তোমরা আনুগত্য কর) শব্দটি আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু
(أُولُو الْأَمْرِ مِنْكُمْ)
নেতা, শাসকের) পূর্বে ব্যবহার করেননি। তার মানে হল- নেতা বা শাসকের আনুগত্য আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর ন্যস্ত। যদি শাসক বা আলেমের নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ মোতাবেক হয় তাহলে অবশ্যই আনুগত্য করতে হবে এবং এ আনুগত্য করা ওয়াজিব। কেননা এটা মূলত নেতার আনুগত্য নয়, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। আর যদি নেতা এমন আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে বা নির্দেশ দেয় যা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশের বিরুদ্ধে যেমন শানে নুযূলে জানলাম তাহলে নেতা কখনো আনুগত্যের পাত্র হবেন না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الخَالِقِ
খালেকের (আল্লাহ তা‘আলার) অবাধ্যে কোন মাখলুকের আনুগত্য নেই। (মিশকাত হা: ৩৬৯৬, সহীহ)
অন্যত্র নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: একজন মুসলিম ব্যক্তির আবশ্যক হল নেতার আনুগত্য করবে এবং তার কথা শুনবে, সে ব্যক্তি নেতার নির্দেশ পছন্দ করুক আর অপছন্দ করুক। যদি নেতা আল্লাহ তা’আলার অবাধ্য কোন কাজের নির্দেশ না দেয়, যদি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কোন কাজের নির্দেশ দেয় তাহলে তার অনুসরণ করা যাবে না এবং আনুগত্যও করা যাবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৭১৪৪, সহীহ বুখারী কিতাবুল ইমারাহ হা: ৩৮)
যদি কোন নেতা, শাসক, ইমাম, এবং আলেম-উলামাদের পথ নির্দেশনা ও তরিকা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের পথ নির্দেশনা ও তরিকা অনুযায়ী হয় তাহলে অবশ্যই মান্য করা আবশ্যক। অন্যথায় কখনো অনুসরণ করা যাবে না।
এরপরেও আলেম বা শাসকের আনুগত্য করতে গিয়ে যদি কোন বিষয়ে বিবাদ দেখা দেয় তাহলে ফায়সালার প্রত্যাবর্তনস্থল কী হবে তারও দিক-নির্দেশনা আল্লাহ তা‘আলা প্রদান করেছেন।
তা কোন ওয়ালী আওয়ালিয়া বুজুরগানে দীন বা মানব রচিত কিতাব নয়। তা হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাব কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ হাদীস।
যারা কোন বিষয়ে বিবাদ দেখা দিলে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাবে তারাই আল্লাহ তা‘আলা ও আখিরাতে বিশ্বাসী।
যারা আল্লাহ তা‘আলা ও আখিরাতে বিশ্বাসী না তারা কোন বিষয়ে বিবাদ দেখা দিলে কুরআন সুন্নাহ বাদ দিয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াবে। মীসাংসার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়া পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির আবশ্যক হলো আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করবে, সেই সাথে নেতার আনুগত্য করবে যদি নেতা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক নেতৃত্ব দেয়। অন্যথায় নেতা আনুগত্যের পাত্র হবে না। আর কোন বিষয়ে বিবাদ দেখা দিলে তার সমাধান নিব কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে মানব রচিত কোন বিধান বা মতামত থেকে নয়।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একচ্ছত্র আনুগত্য করা ওয়াজিব।
২. নেতার আনুগত্য আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল।
৩. ধর্মীয় সকল বিবাদের মীমাংসার প্রত্যাবর্তনস্থল একমাত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ।
৪. যাদের বিবাদের মীমাংসা স্থল কুরআন ও সুন্নাহ তাদের পরিণতি শুভ।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَتَبَيَّنُوا وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَىٰ إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فَعِنْدَ اللَّهِ مَغَانِمُ كَثِيرَةٌ ۚ كَذَٰلِكَ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلُ فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْكُمْ فَتَبَيَّنُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
📘 ৯৪ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের পাশ দিয়ে বানী সুলাইম গোত্রের এক লোক তার ছাগল নিয়ে যাচ্ছিল। সে সাহাবীদেরকে সালাম দিল। সাহাবীগণ বলল: সে আমাদের থেকে বাঁচার জন্য সালাম দিয়েছে। তাই সাহাবীগণ তাকে ধরে হত্যা করল, ছাগলগুলো নিয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আগমন করল। তখন
(أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِذَا ضَرَبْتُمْ... )
আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (তিরমিযী হা: ৩০৩০, আহমাদ হা: ২৪৬২, সহীহ)
(فَعِنْدَ اللّٰهِ مَغَانِمُ كَثِيْرَةٌ)
‘কারণ আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য প্রচুর গনীমত রয়েছে।’ অর্থাৎ এ কিছু ছাগল থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট অনেক উত্তম সম্পদ রয়েছে। যা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্যশীলদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তোমরাও তো পূর্বে এরূপ ছিলে। তোমরা ঈমান এনেছিলে কিন্তু প্রকাশ করতে পারনি। আজ তোমরা শক্তিশালী হয়েছ বলে যাচাই-বাছাই না করে যা ইচ্ছা তাই করবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন। অতএব তোমাদের দায়িত্ব হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেয়া।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যুদ্ধ ও জিহাদের জন্য ভ্রমণ করা শরীয়তসম্মত।
২. সকল কাজে যাচাই-বাছাই করা অবশ্যক।
৩. দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হওয়াকে নিন্দা করা হল।
৪. অন্যের অবস্থা দেখে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত।