🕋 تفسير سورة الصافات
(As-Saffat) • المصدر: BN-TAFSIR-AHSANUL-BAYAAN
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ وَالصَّافَّاتِ صَفًّا
📘 তাদের শপথ যারা (যে ফিরিশতারা) সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান।
إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ
📘 তবে কেউ গোপনে হঠাৎ কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত ঊল্কাপিন্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে।
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
📘 হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান কর।’
فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ
📘 সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। [১]
[১] حَلِيْمٌ (ধৈর্যশীল) বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ ছেলে বড় হয়ে ধৈর্যশীল হবে।
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
📘 অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে চলা-ফেরার বয়সে উপনীত হল,[১] তখন ইব্রাহীম তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি বল।’[২] সে বলল, ‘আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।’
[১] অর্থাৎ, চলাফেরা করার মত বা সাবালক হওয়ার নিকটবর্তী হল। অনেকে বলেন, তাঁর বয়স যখন তেরো বছর হল।
[২] পয়গম্বরগণের স্বপ্নও প্রত্যাদেশ ও আল্লাহর আদেশই হয়। ফলে তাঁদের জন্য তা পালন করা জরুরী। পুত্র আল্লাহর আদেশ পালনে কতটা প্রস্তুত আছে, তা জানার উদ্দেশ্যে তিনি পুত্রের সাথে পরামর্শ করেন।
فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ
📘 অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্য অধোমুখে[১] শায়িত করল,
[১] সকল মানুষের মুখমন্ডলের (ডানে ও বামে) দুটো جَبِين (কপালের দুই পার্শ্ব) থাকে এবং মাঝে থাকে جَبهَة (কপাল)। অতএব আয়াতের সঠিক অর্থ হবে 'কাত করে শায়িত করল।' অর্থাৎ এমনভাবে কাত করে শুইয়ে দিলেন, যেমন পশুকে যবেহ করার সময় ক্বিবলা মুখে কাত করে শোয়ানো হয়। কপাল বা মুখমন্ডলের উপর (অধোমুখে) শোয়ানোর অর্থ করার কারণ হল, প্রসিদ্ধি আছে যে, ইসমাঈল (আঃ) নিজেই কাত করে শোয়ানোর জন্য বলেছিলেন। যাতে তাঁর মুখমন্ডল আব্বার সামনে না থাকে এবং পিতৃস্নেহ আল্লাহর আদেশের উপর প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।
وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ
📘 তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইব্রাহীম!
قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
📘 তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে।[১] নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
[১] অর্থাৎ, মনের পরিপূর্ণ ইচ্ছার সাথে সন্তানকে যবেহ করার উদ্দেশ্যে মাটির উপর শুইয়ে দেওয়াতেই তুমি নিজ স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে। কারণ এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহর আদেশের তুলনায় তোমার নিকট কোন বস্তুই প্রিয়তর নয়; এমনকি নিজের একমাত্র পুত্রও নয়।
إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ
📘 নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ [১]
[১] অর্থাৎ, স্নেহভাজন একমাত্র সন্তানকে যবেহ করার আদেশ একটা বড় পরীক্ষা ছিল; যাতে তুমি সফল হয়েছ।
وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
📘 আর আমি তার পরিবর্তে যবেহযোগ্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম।[১]
[১] 'যবেহযোগ্য মহান জন্তু' একটি দুম্বা ছিল, যা আল্লাহ তাআলা জান্নাত থেকে জিবরীল মারফত পাঠিয়েছিলেন।
(ইবনে কাসীর)
ইসমাঈল (আঃ)-এর পরিবর্তে সেই দুম্বাটি যবেহ করা হয়েছিল এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত সুন্নতকে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ ও ঈদুল আযহার সব থেকে পছন্দনীয় আমল বলে স্বীকৃতি দেওয়া হল।
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
📘 আর এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।
سَلَامٌ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ
📘 ০৯) ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
فَاسْتَفْتِهِمْ أَهُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمْ مَنْ خَلَقْنَا ۚ إِنَّا خَلَقْنَاهُمْ مِنْ طِينٍ لَازِبٍ
📘 অবিশ্বাসীদেরকে জিজ্ঞাসা কর, ওদেরকে সৃষ্টি করা কঠিনতর, নাকি আমি অবশিষ্ট যা কিছু সৃষ্টি করেছি তা সৃষ্টি করা কঠিনতর? [১] ওদেরকে আমি আঠাল মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। [২]
[১] অর্থাৎ, আমি যে পৃথিবী, ফিরিশতা এবং আকাশের মত বস্তু সৃষ্টি করেছি যা আকার ও আয়তনের দিক দিয়ে একেবারে অসাধারণ। সুতরাং মানুষ সৃষ্টি করা এবং মৃত্যুর পর তাদেরকে পুনর্জীবিত করা, সেই সকল বস্তু সৃষ্টি করার চাইতেও বেশী শক্ত ও কষ্টকর? কক্ষনই না।
[২] অর্থাৎ, তাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-কে তো আমি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। উদ্দেশ্য এই যে মানুষ পরকালের জীবনকে এত অসম্ভব ভাবছে কেন অথচ তারা একটি অতি নগণ্য ও দুর্বল বস্তু থেকে সৃষ্টি হয়েছে? অথচ সৃষ্টির দিক দিয়ে তাদের থেকে সবল, বিশাল ও মজবুত বস্তুর সৃষ্টি হওয়ার কথা তারা অস্বীকার করে না।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
📘 নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ
📘 সে ছিল আমার বিশ্বাসী দাসদের অন্যতম।
وَبَشَّرْنَاهُ بِإِسْحَاقَ نَبِيًّا مِنَ الصَّالِحِينَ
📘 আমি তাকে ইসহাকের সুসংবাদ দিয়েছিলাম, সে ছিল একজন নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। [১]
[১] উক্ত ঘটনার পর ইবরাহীম (আঃ)-কে আরো একটি সন্তান ইসহাক ও তাঁর নবী হওয়ার সুসংবাদ দানে বুঝা যাচ্ছে যে, এর পূর্বে যাঁকে যবেহ করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তিনি ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন। সেই সময় ইবরাহীম (আঃ)-এর তিনিই একমাত্র পুত্র ছিলেন, ইসহাক (আঃ) তাঁর পরে জন্মগ্রহণ করেন। 'যাবীহ' (যাঁকে যবেহ করতে যাওয়া হয়েছিল তিনি) কে ছিলেন, ইসমাঈল (আঃ) না ইসহাক (আঃ)? এ বিষয়ে মুফাসসিরগণের মাঝে মতভেদ আছে। ইমাম ইবনে জারীরের মতে, তিনি ইসহাক (আঃ)। কিন্তু ইবনে কাসীর ও অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতে, তিনি ইসমাঈল (আঃ)। আর এটাই সঠিক। ইমাম শাওকানী এই বিষয়ে নীরব।
(বিস্তারিত জানার জন্যে তাফসীর ফাতহুল ক্বাদীর ও তাফসীর ইবনে কাসীর দ্রষ্টব্য)
وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَىٰ إِسْحَاقَ ۚ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ
📘 তাকে এবং ইসহাককে আমি সমৃদ্ধি দান করেছিলাম;[১] তাদের উভয়ের বংশধরদের মধ্যে কিছু সৎকর্মপরায়ণ এবং কিছু নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী। [২]
[১] অর্থাৎ, তাঁদের উভয়ের বংশ বিস্তার করেছিলাম। অধিকাংশ আম্বিয়া ও রসূলদের আগমন তাঁদের বংশ থেকেই ঘটেছে। ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন, যাঁর বারটি সন্তান থেকে বানী ইস্রাঈলের বারটি গোত্র সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের বংশ থেকেই বানী ইস্রাঈল জাতি বিস্তার লাভ করে এবং অধিকাংশ আম্বিয়া তাঁদের মধ্য থেকেই আগমন করেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বিতীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ) থেকে আরবদের বংশ বিস্তার হয় এবং তাদের মধ্য হতে শেষ পয়গম্বর মুহাম্মাদ (সাঃ) জন্মগ্রহণ করেন।
[২] তারা শিরক, পাপাচার, অত্যাচার ও ফাসাদ করে। ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধরে বরকত থাকা সত্ত্বেও এখানে তাদের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণ ও অত্যাচারী বলে ইঙ্গিত করে দিয়েছেন যে, মর্যাদাসম্পন্ন বাপদাদা ও বংশের সম্পর্ক আল্লাহর নিকট কোন মূল্য রাখে না। সেখানে শুধু ঈমান ও নেক আমলের গুরুত্ব আছে। ইয়াহুদী ও নাসারাগণ যদিও ইসহাক (আঃ)-এর সন্তান, অনুরূপ আরবের মুশরিকরা ইসমাঈল (আঃ)-এর সন্তান, কিন্তু তাদের আমল যেহেতু স্পষ্ট ভ্রষ্টতা বা শিরক ও অবাধ্যতার উপর ছিল, সেহেতু উক্ত উচ্চ বংশ-মর্যাদা তাদের আমলের পরিবর্ত হতে পারে না।
وَلَقَدْ مَنَنَّا عَلَىٰ مُوسَىٰ وَهَارُونَ
📘 নিশ্চয় আমি অনুগ্রহ করেছিলাম মূসা ও হারূনের প্রতি[১]
[১] অর্থাৎ, তাদের উভয়কে নবুঅত ও রিসালাত এবং অন্যান্য নিয়ামতসমূহ দান করেছিলাম।
وَنَجَّيْنَاهُمَا وَقَوْمَهُمَا مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ
📘 এবং তাদের ও তাদের সম্প্রদায়কে আমি মহাসংকট হতে উদ্ধার করেছিলাম। [১]
[১] অর্থাৎ, ফিরআউনের দাসত্ব ও তার অত্যাচার থেকে।
وَنَصَرْنَاهُمْ فَكَانُوا هُمُ الْغَالِبِينَ
📘 আমি সাহায্য করেছিলাম তাদেরকে, ফলে তারাই বিজয়ী হয়েছিল।
وَآتَيْنَاهُمَا الْكِتَابَ الْمُسْتَبِينَ
📘 আমি উভয়কে বিশদ গ্রন্থ দিয়েছিলাম।
وَهَدَيْنَاهُمَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
📘 তাদেরকে আমি সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম।
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِمَا فِي الْآخِرِينَ
📘 আর তাদেরকে পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।
بَلْ عَجِبْتَ وَيَسْخَرُونَ
📘 তুমি তো বিস্ময়বোধ করছ, আর ওরা করছে বিদ্রূপ। [১]
[১] অর্থাৎ, তুমি তাদের পরকাল অস্বীকার করার কথা শুনে বিস্মিত হচ্ছ এই ভেবে যে, তার সংঘটন সম্ভব বরং সুনিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে এমন সুস্পষ্ট প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও তারা তা স্বীকার ও বিশ্বাস করছে না; বরং উল্টা তারা তোমার মুখে কিয়ামত ঘটার কথা শুনে বিদ্রূপ করে বলে যে, তা কিভাবে সম্ভব?
سَلَامٌ عَلَىٰ مُوسَىٰ وَهَارُونَ
📘 মূসা ও হারূনের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক,
إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
📘 নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
إِنَّهُمَا مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ
📘 নিশ্চয় এরা উভয়েই ছিল আমার বিশ্বাসী দাসদের অন্তর্ভুক্ত।
وَإِنَّ إِلْيَاسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ
📘 নিশ্চয় ইল্য়্যাসও ছিল রসূলদের একজন; [১]
[১] ইলিয়াস (আঃ) হারূন (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত বনী ইস্রাঈলের প্রতি প্রেরিত একজন নবী ছিলেন। তাঁকে বা'লাবাক্ক্ নামক এলাকায় প্রেরণ করা হয়েছিল। অনেকে সে জায়গার নাম সামেরা বলেছেন, যা ফিলিস্তীনের মধ্য পশ্চিমে অবস্থিত। সেখানের মানুষ বা'ল নামক এক মূর্তির উপাসনা করত। অনেকে বলেন, এটা একটি দেবী ছিল।
إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَلَا تَتَّقُونَ
📘 স্মরণ কর, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা কি ভয় করবে না? [১]
[১] অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর পাকড়াও ও শাস্তিকে ভয় করবে না যে, তিনি ছাড়া অন্যের ইবাদত করছ?
أَتَدْعُونَ بَعْلًا وَتَذَرُونَ أَحْسَنَ الْخَالِقِينَ
📘 তোমরা কি বা’ল (দেবতা)কে আহবান করবে এবং পরিত্যাগ করবে শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা--
اللَّهَ رَبَّكُمْ وَرَبَّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ
📘 আল্লাহকে, যিনি প্রতিপালক তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের?’ [১]
[১] অর্থাৎ, বা'ল দেবতার ইবাদত ও উপাসনা করবে, তার নামে নযর-নিয়ায পেশ করবে এবং তাকে প্রয়োজন পূরণকারী ভাববে, অথচ তা তো একটি পাথরের মূর্তি মাত্র। আর যিনি সকল বস্তুর স্রষ্টা ও অতীত-ভবিষ্যতের সকল কিছুর প্রভু, তাকে তোমরা ভুলে বসবে?
فَكَذَّبُوهُ فَإِنَّهُمْ لَمُحْضَرُونَ
📘 কিন্তু ওরা তাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল, কাজেই ওদেরকে (শাস্তির জন্য) অবশ্যই উপস্থিত করা হবে। [১]
[১] অর্থাৎ তাওহীদ ও ঈমানকে অস্বীকার করার জন্য জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে।
إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ
📘 তবে আল্লাহর বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের কথা স্বতন্ত্র।
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
📘 আমি এ পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।
وَإِذَا ذُكِّرُوا لَا يَذْكُرُونَ
📘 এবং যখন ওদেরকে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন ওরা তা গ্রহণ করে না;
سَلَامٌ عَلَىٰ إِلْ يَاسِينَ
📘 ইল্য়্যাসের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। [১]
[১] اِلْيَاسِيْنَ 'ইলয়াসীন' 'ইলয়াস' শব্দের রূপান্তর; যেমন রূপান্তরে ত্বুরে সাইনাকে ত্বুরে সীনীনও বলা হয়। ইলয়াস (আঃ)-কে কোন কোন কিতাবে ঈলিয়াও বলা হয়েছে।
إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
📘 নিশ্চয় আমি এইভাবে সৎকর্মপরায়ণদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ
📘 নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশ্বাসী দাসদের অন্যতম। [১]
[১] কুরআনে অধিকাংশ জায়গায় নবী ও রসূলদের বর্ণনা করার পর এ বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে যে, 'সে আমার মু'মিন বান্দা (বিশ্বাসী দাস)-দের একজন ছিল।' এর দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথম উদ্দেশ্য, তাঁর মহান চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, যা ঈমানের জরুরী অংশ। যাতে সেই সকল মানুষ, যারা অনেক পয়গম্বরদের চারিত্রিক দুর্বলতার কথা বলে থাকে, তাদের খন্ডন হয়ে যায়। যেমন বর্তমান তাওরাত ও ইঞ্জীলে অনেক পয়গম্বরদের বিষয়ে এরূপ মনগড়া কেচ্ছা-কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, ঐ সকল মানুষদের ধারণা খন্ডন, যারা অনেক নবীদের গুণাবলীতে অতিরঞ্জন করে তাঁদের মধ্যে আল্লাহর গুণ ও ক্ষমতা সাব্যস্ত করে। অর্থাৎ তাঁরা অবশ্যই পয়গম্বর ছিলেন, আর ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর দাস। তাঁরা না ছিলেন ইলাহ বা তাঁর অংশ, আর না ছিলেন তাঁর অংশীদার।
وَإِنَّ لُوطًا لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ
📘 নিশ্চয় লূতও ছিল রসূলদের একজন।
إِذْ نَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ أَجْمَعِينَ
📘 আমি তাকে এবং তার পরিবারের সকলকে উদ্ধার করেছিলাম;
إِلَّا عَجُوزًا فِي الْغَابِرِينَ
📘 কিন্তু উদ্ধার করিনি এক বৃদ্ধাকে, যে ছিল ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। [১]
[১] এর উদ্দেশ্য হল লূত (আঃ)-এর স্ত্রী, সে কাফের ছিল, সে ঈমানদারদের সাথে গ্রাম থেকে বাইরে যায়নি, কারণ নিজ কওমের সাথে ধ্বংস হওয়া তার ভাগ্যেও অবধারিত ছিল। সুতরাং তাকেও ধ্বংস করে দেওয়া হল।
ثُمَّ دَمَّرْنَا الْآخَرِينَ
📘 অতঃপর অবশিষ্টদেরকে আমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিলাম।
وَإِنَّكُمْ لَتَمُرُّونَ عَلَيْهِمْ مُصْبِحِينَ
📘 তোমরা তো ওদের ধ্বংসাবশেষগুলি অতিক্রম করে থাক সকালে
وَبِاللَّيْلِ ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
📘 এবং রাতে, তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না? [১]
[১] এখানে সেই মক্কাবাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, যারা ব্যবসার জন্য সফর করতে গিয়ে সেই বিধ্বস্ত এলাকার উপর দিয়ে যাতায়াত করত। তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা সকাল ও রাত্রে সেই এলাকা হয়ে অতিক্রম করছ, যেখানে বর্তমানে মৃত সাগর অবস্থিত, যা দেখতেও বড় বিশ্রী এবং পচা-সড়া ও দুর্গন্ধময়। (যার পানি অতিরিক্ত মোটা ও লবণাক্ত, তাতে কোন প্রাণী জীবন-ধারণ করতে পারে না এবং তাতে পড়লে ডুবে যায় না।) তোমরা কি তাদের এ অবস্থা দেখেও এ কথা অনুধাবন করতে পারছ না যে, রসূলদেরকে মিথ্যা মনে করার ফলে তাদের এই নিকৃষ্ট পরিণতি হয়েছে। তবে তোমাদের আচরণের ফলও তাদের থেকে পৃথক কেন হবে? তোমরাও সেই কর্মই সাধন করছ, যা তারা করেছে। তবে এর পরেও তোমরা আল্লাহর শাস্তি থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে?
وَإِنَّ يُونُسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ
📘 নিশ্চয় ইউনুসও ছিল রসূলদের একজন।
وَإِذَا رَأَوْا آيَةً يَسْتَسْخِرُونَ
📘 ওরা কোন নিদর্শন দেখলে উপহাস করে,
إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ
📘 স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করে বোঝাই জলযানে পৌঁছল,
فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنَ الْمُدْحَضِينَ
📘 অতঃপর লটারি হলে সে হেরে গেল।
فَالْتَقَمَهُ الْحُوتُ وَهُوَ مُلِيمٌ
📘 পরে (তাকে নৌকা হতে সমুদ্রে ঠেলে দেওয়া হলে) এক বিরাট মাছ তাকে গিলে ফেলল, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। [১]
[১] ইউনুস (আঃ)-কে ইরাকের নীনাওয়া (বর্তমান মাওসেল) নামক শহরে নবী করে প্রেরণ করা হয়েছিল। এখানে আশুরীদের শাসন ছিল, যারা এক লক্ষ বানী ইস্রাঈলকে বন্দী করে রেখেছিল, সুতরাং তাদের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট ইউনুস (আঃ)-কে প্রেরণ করলেন। কিন্তু তারা তাঁর উপর ঈমান আনল না। শেষে তিনি নিজ সম্প্রদায়কে এই বলে ভীতিপ্রদর্শন করলেন যে, তোমরা অতি সত্বর আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। শাস্তি আসতে বিলম্ব দেখে তিনি আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং সমুদ্রে গিয়ে এক নৌকায় সওয়ার হন। নিজের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়াকে এমন শব্দে ব্যবহার করা হয়েছে, যেন একজন দাস তার মনিব থেকে পালিয়ে যায়। কারণ তিনিও আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই নিজ সম্প্রদায়কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। যাত্রী ও মাল-সামানে নৌকা পরিপূর্ণ ছিল। নৌকা সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে পড়ে যায় ও দাঁড়িয়ে যায়। সুতরাং তার ভার কম করার জন্য এক ব্যক্তিকে নৌকা থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে নৌকার অন্য সব যাত্রীরা বেঁচে যায়। কিন্তু এই কুরবানী দেওয়ার জন্য কেউ তৈরী ছিল না, যার জন্য লটারী করতে হয়। সে লটারীতে ইউনুস (আঃ)-এর নাম আসে এবং তিনি অসহায়দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান; অর্থাৎ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পালিয়ে যাওয়া দাসের মত নিজেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হয়। এদিকে আল্লাহ তাআলা তিমি মাছকে আদেশ করেন যে, তাঁকে যেন পূর্ণ গিলে ফেলে। এই ভাবে ইউনুস (আঃ) আল্লাহর আদেশে মাছের পেটে চলে যান।
فَلَوْلَا أَنَّهُ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِينَ
📘 সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত,
لَلَبِثَ فِي بَطْنِهِ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ
📘 তাহলে সে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটে থেকে যেত। [১]
[১] অর্থাৎ তওবা ও ইস্তিগফার এবং আল্লাহর তাসবীহ পাঠ না করতেন, (যেমন তিনি {لاَ إِلَهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ} পাঠ করেছিলেন।) তবে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি মাছের পেটেই থেকে যেতেন।
۞ فَنَبَذْنَاهُ بِالْعَرَاءِ وَهُوَ سَقِيمٌ
📘 অতঃপর ইউনুসকে আমি গাছ-পালাহীন সৈকতে নিক্ষেপ করলাম। [১]
[১] যেরূপ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় মানুষ বা জন্তুর বাচ্চার অবস্থা হয়, সেইরূপ দুর্বল অবস্থায়।
وَأَنْبَتْنَا عَلَيْهِ شَجَرَةً مِنْ يَقْطِينٍ
📘 পরে আমি (তাকে ছায়া দেওয়ার জন্য) এক লাউগাছ উদগত করলাম; [১]
[১] يَقْطِين ঐ সকল লতা গাছকে বলা হয়, যা নিজ কান্ডের উপর দাঁড়াতে পারে না, যেমন লাউ, কুমড়া ইত্যাদির গাছ। অর্থাৎ, সেই বালুচরে, যেখানে না কোন গাছ-পালা ছিল আর না ছিল কোন ঘর-বাড়ী । সেখানে একটি ছায়াবিশিষ্ট বৃক্ষ উদগত করে তাকে রক্ষা করলাম।
وَأَرْسَلْنَاهُ إِلَىٰ مِائَةِ أَلْفٍ أَوْ يَزِيدُونَ
📘 তাকে আমি এক লাখ বা তার বেশী লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম।
فَآمَنُوا فَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَىٰ حِينٍ
📘 এবং তারা বিশ্বাস করেছিল;[১] ফলে তাদেরকে কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিলাম।
[১] তারা কিভাবে ঈমান এনেছিল তার বর্ণনা সূরা ইউনুসের ১০:৯৮ নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।
فَاسْتَفْتِهِمْ أَلِرَبِّكَ الْبَنَاتُ وَلَهُمُ الْبَنُونَ
📘 ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আল্লাহর জন্য কি কন্যাসন্তান এবং ওদের নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান?
وَقَالُوا إِنْ هَٰذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ
📘 এবং বলে, ‘এতো এক স্পষ্ট যাদু ছাড়া কিছু নয়। [১]
[১] অর্থাৎ, নসীহত গ্রহণ না করা তাদের স্বভাব। আর কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ বা মু'জেযা দেখানো হলে বিদ্রূপ করে এবং তা যাদু ভাবে।
أَمْ خَلَقْنَا الْمَلَائِكَةَ إِنَاثًا وَهُمْ شَاهِدُونَ
📘 অথবা ওরা কি উপস্থিত ছিল, যখন আমি ফিরিশতাদেরকে নারীরূপে সৃষ্টি করেছিলাম? [১]
[১] অর্থাৎ, এরা যে ফিরিশতাদিগকে আল্লাহর কন্যা বলে, তবে আমি যখন ফিরিশতা সৃষ্টি করেছিলাম, তখন কি তারা সে স্থানে উপস্থিত ছিল এবং তারা ফিরিশতাদের মধ্যে নারীত্বের কোন চিহ্ন লক্ষ্য করেছিল?
أَلَا إِنَّهُمْ مِنْ إِفْكِهِمْ لَيَقُولُونَ
📘 দেখ, ওরা মনগড়া কথা বলে থাকে; যখন বলে,
وَلَدَ اللَّهُ وَإِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ
📘 ‘আল্লাহ সন্তান জন্ম দিয়েছেন।’ নিশ্চয় ওরা মিথ্যাবাদী।
أَصْطَفَى الْبَنَاتِ عَلَى الْبَنِينَ
📘 তিনি কি পুত্রসন্তানের পরিবর্তে কন্যাসন্তান পছন্দ করেছেন? [১]
[১] অথচ তারা নিজেদের জন্য কন্যাসন্তান নয়; বরং পুত্রসন্তান পছন্দ করে।
مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
📘 তোমাদের কি হয়েছে, তোমাদের এ কেমন সিদ্ধান্ত?
أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
📘 তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? [১]
[১] যে, যদি আল্লাহর সন্তান হত তবে পুত্রসন্তান হত, যা তোমরাও পছন্দ কর এবং উত্তম মনে কর। কন্যাসন্তান নয়, যা তোমাদের চোখেও নগণ্য ও তুচ্ছ।
أَمْ لَكُمْ سُلْطَانٌ مُبِينٌ
📘 তোমাদের কি সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ আছে?
فَأْتُوا بِكِتَابِكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
📘 তোমরা সত্যবাদী হলে তোমাদের গ্রন্থ উপস্থিত কর। [১]
[১] অর্থাৎ, এই বিশ্বাসের শুদ্ধতা বিবেক মেনে নেয় না যে, আল্লাহর সন্তান আছে; তাতেও আবার কন্যাসন্তান। যদি তাই হয়, তাহলে কোন প্রমাণ দেখাও, আল্লাহর নাযিলকৃত কোন একটি কিতাব দেখাও, যাতে আল্লাহর সন্তানের স্বীকারোক্তি বা প্রমাণ আছে?
وَجَعَلُوا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجِنَّةِ نَسَبًا ۚ وَلَقَدْ عَلِمَتِ الْجِنَّةُ إِنَّهُمْ لَمُحْضَرُونَ
📘 ওরা আল্লাহ এবং জ্বিন জাতির মধ্যে বংশীয় সম্পর্ক স্থির করেছে,[১] অথচ জ্বিনেরা জানে যে, তাদেরকেও (শাস্তির জন্য) উপস্থিত করা হবে।[২]
[১] এখানে মুশরিকদের ঐ বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাতে তারা মনে করে যে, আল্লাহ ও জ্বিনদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল, যার ফলে কন্যাসন্তান জন্ম গ্রহণ করে। এরাই আল্লাহর মেয়ে, ফিরিশতা। এইভাবে আল্লাহ ও জ্বিনদের মাঝে (বৈবাহিক সম্বন্ধ ) আত্মীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়েছে!
[২] অথচ এই উক্তি কিভাবে সত্য হতে পারে? যদি তাই হতো, তাহলে জ্বিনদেরকে আল্লাহ তাআলা শাস্তি দিতেন কেন? তিনি কি আপন আত্মীয়তার খেয়াল রাখতেন না? আর যদি তা না হয়, বরং খোদ জ্বিনরাও ভালভাবে অবগত আছে যে, তাদেরকেও (অবাধ্যতার কারণে) আল্লাহর শাস্তি ভোগ করার জন্য অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে, তাহলে আল্লাহ এবং জ্বিনদের মাঝে আত্মীয়তা কিভাবে হতে পারে?
سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ
📘 ওরা যা বলে, তা হতে আল্লাহ পবিত্র, মহান।
أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ
📘 আমরা মরে গিয়ে মাটি ও হাড়ে পরিণত হলেও কি আমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে?
إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ
📘 আল্লাহর বিশুদ্ধ চিত্ত দাসগণ এর ব্যতিক্রম। [১]
[১] অর্থাৎ, তারা আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলে না, যা থেকে তিনি পবিত্র। এটা মুশরিকদেরই অভ্যাস। অথবা উদ্দেশ্য হল যে, জ্বিন ও মুশরিকদেরকেই জাহান্নামে উপস্থিত করা হবে, আল্লাহর বিশুদ্ধ ও মনোনীত বান্দাদেরকে নয়। তাদের জন্য তো আল্লাহ তাআলা জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন। এই অর্থে এ বাক্যটি لَمُحْضَرُوْنَ থেকে 'ইস্তিসনা' (ব্যতিক্রান্ত)। আর মাঝে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনামূলক বাক্য 'জুমলাহ মু'তারিযবাহ' (মাঝে সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন বাক্য)।
فَإِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ
📘 অবশ্যই তোমরা এবং তোমরা যাদের উপাসনা কর তারা;
مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ بِفَاتِنِينَ
📘 তোমরা (ওদেরকে) আল্লাহ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
إِلَّا مَنْ هُوَ صَالِ الْجَحِيمِ
📘 কেবল তাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে, যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [১]
[১] অর্থাৎ, তোমরা ও তোমাদের বাতিল উপাস্য, তাদেরকে ছাড়া কাউকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখো না, যারা আল্লাহর জ্ঞানে পূর্ব থেকেই জাহান্নামী এবং সে জন্যই তারা কুফর ও শিরকের উপর অটল আছে।
وَمَا مِنَّا إِلَّا لَهُ مَقَامٌ مَعْلُومٌ
📘 (জিবরীল বলেছিল), আমাদের প্রত্যেকের জন্যই নির্ধারিত স্থান রয়েছে; [১]
[১] অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদতের জন্য। এ কথাটি ফিরিশতাদের।
وَإِنَّا لَنَحْنُ الصَّافُّونَ
📘 আমরা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান,
وَإِنَّا لَنَحْنُ الْمُسَبِّحُونَ
📘 এবং আমরা অবশ্যই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণাকারী।[১]
[১] উদ্দেশ্য এই যে, ফিরিশতাগণও আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর খাস বান্দা, যাঁরা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে এবং তাঁর তসবীহ ও পবিত্রতা বর্ণনায় মগ্ন থাকেন, তাঁরা আল্লাহর কন্যা নন; যেমন মুশরিকরা ধারণা করে থাকে।
وَإِنْ كَانُوا لَيَقُولُونَ
📘 নিশ্চয় ওরা বলত,
لَوْ أَنَّ عِنْدَنَا ذِكْرًا مِنَ الْأَوَّلِينَ
📘 ‘পূর্ববর্তীদের গ্রন্থের মত যদি আমাদের কোন গ্রন্থ থাকত,
لَكُنَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ
📘 তাহলে আমরা অবশ্যই আল্লাহর বিশুদ্ধ-চিত্ত দাস হতাম।’[১]
[১] এখানে ذِكر -এর অর্থ হল, আল্লাহর কোন গ্রন্থ বা পয়গম্বর। অর্থাৎ কাফেররা কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে বলত যে, আমাদের নিকটেও যদি কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হত, যেমন পূর্বের মানুষদের প্রতি তাওরাত ইত্যাদি অবতীর্ণ হয়েছে অথবা কোন পথপ্রদর্শক ও সতর্ককারী আসত, তবে আমরাও আল্লাহর খাস বান্দা হয়ে যেতাম।
أَوَآبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ
📘 এবং আমাদের পিতৃপুরুষদেরকেও কি?’
فَكَفَرُوا بِهِ ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
📘 কিন্তু ওরা তা (কুরআন) প্রত্যাখ্যান করল[১] এবং শীঘ্রই ওরা এর পরিণাম জানতে পারবে।[২]
[১] অর্থাৎ, যখন তাদের মনের বাসনা অনুযায়ী নবী (সাঃ) পথপ্রদর্শক হিসাবে এসে গেলেন, কুরআন মাজীদও অবতীর্ণ করে দেওয়া হল, তখন তারা তাঁর প্রতি ঈমান না এনে তাঁকে অস্বীকার করে বসল!
[২] এটা তাদের জন্য ধমক যে, এই অস্বীকারের কুফল অতি তাড়াতাড়ি তারা জানতে পারবে।
وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِينَ
📘 আমার প্রেরিত দাসদের সম্পর্কে আমার এ বাক্য স্থির হয়েছে যে,
إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنْصُورُونَ
📘 অবশ্যই তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হবে,
وَإِنَّ جُنْدَنَا لَهُمُ الْغَالِبُونَ
📘 এবং নিঃসন্দেহে আমার বাহিনীই বিজয়ী হবে। [১]
[১] যেমন অন্য স্থানে বলেছেন, (كَتَبَ اللهُ لاَغْلِبَنَّ اَنَا وَرُسُلِيْ)
(সূরা মুজাদালাহ ৫৮:২১ আয়াত)
فَتَوَلَّ عَنْهُمْ حَتَّىٰ حِينٍ
📘 অতএব কিছু কালের জন্য তুমি ওদেরকে উপেক্ষা কর।[১]
[১] অর্থাৎ, তাদের কথা ও দেওয়া কষ্টের উপর ধৈর্য ধারণ কর।
وَأَبْصِرْهُمْ فَسَوْفَ يُبْصِرُونَ
📘 তুমি ওদেরকে পর্যবেক্ষণ কর,[১] শীঘ্রই ওরা (সত্য-প্রত্যাখ্যানের পরিণাম) প্রত্যক্ষ করবে।
[১] অর্থাৎ, দেখতে থাক যে, কখন তাদের উপর আল্লাহর আযাব আসছে?
أَفَبِعَذَابِنَا يَسْتَعْجِلُونَ
📘 ওরা কি তবে আমার শাস্তি তরান্বিত করতে চায়?
فَإِذَا نَزَلَ بِسَاحَتِهِمْ فَسَاءَ صَبَاحُ الْمُنْذَرِينَ
📘 যাদের সতর্ক করা হয়েছিল তাদের আঙিনায় যখন শাস্তি নেমে আসবে, তখন ওদের প্রভাত হবে কত মন্দ! [১]
[১] যখন মুসলিমগণ খায়বার আক্রমণ করতে গেলেন, তখন তাদেরকে দেখে ইয়াহুদীরা ঘাবড়ে গেল। যার কারণে নবী (সাঃ) 'আল্লাহু আকবার' বলে এই বাক্যাবলী উচ্চারণ করেন, خَرِبَتْ خَيْبَرُ إِنَّا إِذَا نَزَلْنَا بِسَاحَةِ قَوْمٍ {فَسَاءَ صَبَاحُ الْمُنْذَرِينَ} অর্থাৎ, খায়বার বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমরা যখন কোন সম্প্রদায়ের আঙিনায় অবতরণ করি, তখন যাদেরকে পূর্বে-সতর্ক করা হয়েছিল তাদের সকাল খুবই মন্দ হয়।
(বুখারী)
وَتَوَلَّ عَنْهُمْ حَتَّىٰ حِينٍ
📘 অতএব কিছু কালের জন্য তুমি ওদের উপেক্ষা কর।
وَأَبْصِرْ فَسَوْفَ يُبْصِرُونَ
📘 তুমি (ওদেরকে) পর্যবেক্ষণ কর, শীঘ্রই ওরা (সত্যপ্রত্যাখ্যানের পরিণাম) প্রত্যক্ষ করবে।[১]
[১] এ বাক্যটি তা'কীদ স্বরূপ পুনরুক্ত হয়েছে অথবা প্রথম বাক্যের উদ্দেশ্য পার্থিব ঐ সকল শাস্তি যা মক্কাবাসীর উপর বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে মুসলিমদের হাতে হত্যা ইত্যাদি রূপে এসেছিল। আর দ্বিতীয় বাক্যে পারলৌকিক ঐ শাস্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যা এ সকল কাফের ও মুশরিকরা পরকালে ভোগ করবে।
قُلْ نَعَمْ وَأَنْتُمْ دَاخِرُونَ
📘 বল, ‘হ্যাঁ। আর তোমরা হবে লাঞ্ছিত।’ [১]
[১] যেমন অন্য স্থানেও বলেছেন, {وَكُلٌّ أَتَوْهُ دَاخِرِينَ} অর্থাৎ, সকলেই তাঁর নিকট লাঞ্ছিত অবস্থায় আসবে।
(সূরা নামল ২৭:৮৭ আয়াত)
{إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ} অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে লাঞ্ছিত হয়ে প্রবেশ করবে।"
(সূরা মু'মিন ৪০:৬০ আয়াত)
سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ
📘 ওরা যা আরোপ করে, তা হতে তোমার প্রতিপালক পবিত্র ও মহান, যিনি সকল সম্মান (ও ক্ষমতা)র অধিকারী। [১]
[১] এখানে আল্লাহ তাআলার ঐ সকল কল্পিত ত্রুটি থেকে পবিত্রতার কথা ঘোষণা করা হয়েছে, যা মুশরিকরা আল্লাহর জন্য বর্ণনা করে থাকে, যেমন তাঁর সন্তান আছে, বা তাঁর কোন অংশীদার আছে। এরূপ ত্রুটি বান্দার মাঝে আছে এবং সন্তান বা অংশীদারের প্রয়োজন তাদেরই হয়। মহান আল্লাহ তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে ও তিনি পবিত্র। কারণ, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন যে, তাঁর সন্তান বা কোন অংশীদারের প্রয়োজন হবে।
وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ
📘 শান্তি বর্ষিত হোক রসূলদের প্রতি! [১]
[১] কারণ, তাঁরা আল্লাহর পয়গাম পৃথিবীর বাসিন্দাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁরা অবশ্যই সালাম ও বর্কতের অধিকারী।
وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
📘 আর সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। [১]
[১] এখানে বান্দাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন; পয়গম্বর পাঠিয়েছেন, কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং পয়গম্বরগণ তোমাদের নিকট আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। অতএব তোমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অনেকে বলেন যে, কাফেরদেরকে ধ্বংস করে ঈমানদার ব্যক্তিদের ও পয়গম্বরদেরকে বাঁচিয়েছেন, এর জন্য আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন কর। حَمد হাম্দ শব্দদের অর্থ হলঃ স্বেচ্ছায় মহত্ত্ব ও বড়ত্ব বর্ণনা করা, সুনাম ও প্রশংসা করা।
فَإِنَّمَا هِيَ زَجْرَةٌ وَاحِدَةٌ فَإِذَا هُمْ يَنْظُرُونَ
📘 মাত্র একটি প্রচন্ড শব্দ হবে;[১] তখন ওরা প্রত্যক্ষ করবে। [২]
[১] অর্থাৎ, তারা আল্লাহ তাআলার একই আদেশ এবং ইস্রাফীল (আঃ)-এর শৃঙ্গায় এক (দ্বিতীয়) ফুৎকারে কবর থেকে জীবিত হয়ে বের হয়ে আসবে।
[২] অর্থাৎ, তাদের সম্মুখে কিয়ামতের ভয়ানক দৃশ্য এবং হাশরের ময়দানের কঠিন অবস্থা হবে; যা তারা প্রত্যক্ষ করবে। زجرة এর আসল অর্থঃ ধমক। এখানে ফুৎকার বা বিকট আওয়াজকে زجرة বলা হয়েছে, কারণ এর উদ্দেশ্য হল ধমক দেওয়া।
فَالزَّاجِرَاتِ زَجْرًا
📘 ও যারা সজোরে ধমক দিয়ে থাকে,
وَقَالُوا يَا وَيْلَنَا هَٰذَا يَوْمُ الدِّينِ
📘 এবং ওরা বলবে, ‘হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটিই তো কর্মফল দিবস।’
هَٰذَا يَوْمُ الْفَصْلِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ
📘 (ওদের বলা হবে,) ‘এটিই সেই ফায়সালার দিন, যা তোমরা মিথ্যা মনে করতে।’ [১]
[১] ويل শব্দটি ধ্বংসের সময় বলা হয়। অর্থাৎ শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর তাদের নিজেদের ধ্বংস পরিষ্কার দেখতে পাবে। এ কথার উদ্দেশ্য হল, তাদের লাঞ্ছনার প্রকাশ এবং নিজেদের ত্রুটি ও অবহেলার স্বীকারোক্তি। কিন্তু সেই সময় লাঞ্ছনা প্রকাশ ও দোষ-স্বীকার করায় কোন লাভ হবে না। যার ফলে তাদের উত্তরে ফিরিশতা ও মু'মিনগণ বলবেন, এটা সেই ফায়সালার দিন যাকে তোমরা অস্বীকার করতে। এটাও হতে পারে যে, তারা আপোসে এই কথা একে অপরকে বলবে।
۞ احْشُرُوا الَّذِينَ ظَلَمُوا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوا يَعْبُدُونَ
📘 (ফিরিশতাদেরকে বলা হবে,) একত্র কর অত্যাচারীদেরকে,[১] ওদের সহচরদেরকে[২] এবং তাদেরকে যাদের ওরা উপাসনা করত;[৩]
[১] অর্থাৎ, যারা কুফর, শিরক এবং নাফরমানী করেছে। এটা হবে আল্লাহর আদেশ।
[২] এর অর্থ কুফর, শিরক এবং রসূলগণকে অস্বীকারকারীদের সহচর ও সাথিগণ থেকে উদ্দেশ্য অনেকের নিকট জ্বিন ও শয়তানগণ। আবার অনেকে বলেন যে, ঐ সকল স্ত্রীগণ যারা কুফর ও শিরক করাতে তাদের সাথী হয়েছিল।
[৩] ما (যাদের) শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহার করে সকল উপাস্যকে বুঝানো হয়েছে। সে উপাস্য মূর্তি হোক বা আল্লাহর কোন নেক বান্দা, সকলকে লজ্জিত করার জন্য একত্রিত করা হবে। নেক ব্যক্তিদের তো আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবেন, তবে অন্য উপাস্যগুলিকে তাদের সাথেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যাতে তারা দেখতে পায় যে, এরা কারো উপকার বা অপকার করতে অক্ষম।
مِنْ دُونِ اللَّهِ فَاهْدُوهُمْ إِلَىٰ صِرَاطِ الْجَحِيمِ
📘 আল্লাহর পরিবর্তে এবং ওদেরকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত কর।
وَقِفُوهُمْ ۖ إِنَّهُمْ مَسْئُولُونَ
📘 আর ওদেরকে থামাও,[১] কারণ ওদেরকে প্রশ্ন করা হবেঃ
[১] এই আদেশ জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই দেওয়া হবে, কারণ হিসাব-নিকাশের পরেই তারা জাহান্নামে চলে যাবে।
مَا لَكُمْ لَا تَنَاصَرُونَ
📘 ‘তোমাদের কি হল যে, তোমরা একে অপরের সাহায্য করছ না?’
بَلْ هُمُ الْيَوْمَ مُسْتَسْلِمُونَ
📘 বস্তুতঃ সেদিন ওরা আত্মসমর্পণ করবে,
وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ
📘 এবং ওরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে--
قَالُوا إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُونَنَا عَنِ الْيَمِينِ
📘 ওরা বলবে, ‘তোমরা তো ডান দিক হতে আমাদের নিকট আসতে।’ [১]
[১] এর অর্থ হল যে দ্বীন এবং হকের নাম দিয়ে আসত অর্থাৎ বলত যে, এটাই আসল দ্বীন এবং এটাই সত্য পথ। অনেকের নিকট এর অর্থ হল, চতুর্দিক থেকে আসত; এখানে والشِّمَالِ শব্দ ঊহ্য আছে। যেমন শয়তান বলেছিল, অতঃপর আমি অবশ্যই তাদের সম্মুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিক হতে (সর্বদিক হতে) তাদের নিকট আসব (এবং পথভ্রষ্ট করব)।
(সূরা আ'রাফ ৭:১৭ আয়াত)
قَالُوا بَلْ لَمْ تَكُونُوا مُؤْمِنِينَ
📘 এরা বলবে, ‘বরং তোমরা তো বিশ্বাসীই ছিলে না, [১]
[১] অর্থাৎ, নেতারা বলবে, তোমরা স্বেচ্ছায় ঈমান আনোনি। আর আজ আমাদের দোষ দিচ্ছ?
فَالتَّالِيَاتِ ذِكْرًا
📘 এবং যারা কুরআন আবৃত্তিতে রত--
وَمَا كَانَ لَنَا عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ ۖ بَلْ كُنْتُمْ قَوْمًا طَاغِينَ
📘 এবং তোমাদের ওপর আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না; বস্তুতঃ তোমরাই ছিলে সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। [১]
[১] দলপতি ও অনুগামী তথা গুরু ও চেলার এইরূপ আপোসের বচসা কুরআন কারীমে বেশ কিছু জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের এক অপরের এই বচসা হাশরের ময়দানেও চলবে এবং জাহান্নামী হওয়ার পরে জাহান্নামের ভিতরেও চলবে। দেখুনঃ সূরা মু'মিন ৪০:৪৭-৪৮, সূরা সাবা ৩৪:৩১-৩২, সূরা আহযাব ৩৩:৬৭-৬৮, সূরা আ'রাফ ৭:৩৮-৩৯ ইত্যাদি আয়াতসমূহ।
فَحَقَّ عَلَيْنَا قَوْلُ رَبِّنَا ۖ إِنَّا لَذَائِقُونَ
📘 সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিপালকের কথা সত্য হয়েছে; আমাদেরকে অবশ্যই (শাস্তি) আস্বাদন করতে হবে।
فَأَغْوَيْنَاكُمْ إِنَّا كُنَّا غَاوِينَ
📘 আমরা তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলাম; কারণ আমরা নিজেরাই ছিলাম বিভ্রান্ত।’ [১]
[১] অর্থাৎ, তারা পূর্বে যে কথা অস্বীকার করে বলেছিল যে, আমাদের তোমাদের উপর এমন কি জোর ছিল যে, তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। পরবর্তীতে তাই স্বীকার করবে এই বলে যে, হ্যাঁ সত্যই আমরা তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলাম। কিন্তু এই স্বীকারোক্তি এই সতর্কবাণীর সাথে হবে যে, এর জন্য আমাদেরকে দায়ী বা দোষী করবে না। কারণ আমরা নিজেরাও পথভ্রষ্টই ছিলাম, আমরা তোমাদেরকেও আমাদের মতই বানাতে চেয়েছিলাম এবং তোমরা সহজেই আমাদের পথ অবলম্বন করে নিয়েছিলে। যেমন শয়তানও সেই দিন বলবে, (وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلاَّ أَن دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلاَ تَلُومُونِي وَلُومُواْ أَنفُسَكُم) অর্থাৎ, আমার তো তোমাদের উপর কোন আধিপত্য ছিল না, আমি শুধু তোমাদেরকে আহবান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না, তোমরা তোমাদের নিজেদের প্রতিই দোষারোপ কর।
(সূরা ইবরাহীম ১৪:২২ আয়াত)
فَإِنَّهُمْ يَوْمَئِذٍ فِي الْعَذَابِ مُشْتَرِكُونَ
📘 সুতরাং নিশ্চয় ওরা সকলেই সেদিন শাস্তির শরীক হবে। [১]
[১] কারণ, তাদের গুনাহও শরীকানী ছিল; শিরক, পাপাচরণ এবং ফিতনা-ফাসাদ করা তাদের দৈনন্দিন কর্ম ছিল।
إِنَّا كَذَٰلِكَ نَفْعَلُ بِالْمُجْرِمِينَ
📘 অপরাধীদের প্রতি আমি এরূপই করে থাকি। [১]
[১] অর্থাৎ, সর্বপ্রকার পাপীষ্ঠদের সাথে এটাই আমার ব্যবহার। সুতরাং এখন তারা সকলে আমার শাস্তি ভোগ করতে থাকবে।
إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ
📘 ওদের নিকট ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই’ বলা হলে ওরা অহংকারে অগ্রাহ্য করত। [১]
[১] অর্থাৎ, পৃথিবীতে যখন তাদেরকে বলা হত যে, যেমন মুসলিমরা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' (আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই) কালেমা পড়ে শিরক ও পাপাচরণ থেকে ফিরে এসেছে, অনুরূপ তোমরাও পড়ে নাও, যাতে তোমরা পৃথিবীতে মুসলিমদের কোপ ও ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারো এবং আখেরাতেও তোমাদেরকে আল্লাহর শাস্তি ভোগ করতে না হয়, তখন তারা অহংকার ও অস্বীকার করত। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করি, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' না পড়ে। অতঃপর যে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' পড়ে নেবে, সে নিজ জান ও মালকে বাঁচিয়ে নেবে।"
(বুখারী, মুসলিম)
وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُو آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَجْنُونٍ
📘 এবং বলত, আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে বর্জন করব? [১]
[১] অর্থাৎ, তারা নবী (সাঃ)-কে কবি এবং জাদুকর বলত এবং তাঁর দাওয়াতকে পাগলের প্রলাপ ও কুরআনকে কাব্যগ্রন্থ বলে মনে করত এবং বলত যে, একজন পাগলের প্রলাপে আমরা নিজেদের উপাস্যদেরকে বর্জন করব কেন? অথচ কুরআন পাগলের প্রলাপ ছিল না; বরং জ্ঞান ও হিকমতে পরিপূর্ণ বাণী ছিল, কাব্য নয়; বরং সত্য বাণী ছিল এবং সেই দাওয়াত গ্রহণ করাতে তাদের ধ্বংস নয়; বরং পরিত্রাণ ছিল।
بَلْ جَاءَ بِالْحَقِّ وَصَدَّقَ الْمُرْسَلِينَ
📘 বরং সে (মুহাম্মাদ) তো সত্য নিয়ে এসেছে এবং সমস্ত রসূলদের সত্যতা স্বীকার করেছে। [১]
[১] অর্থাৎ, তোমরা আমার পয়গম্বরকে কবি ও পাগল বলছ, অথচ তিনি যা নিয়ে এসেছেন ও উপস্থাপন করছেন তা সত্য এবং তা তো সেই জিনিসই, যা তাঁর পূর্ববর্তী সকল পয়গম্বরগণ উপস্থাপন করেছেন। এরূপ মহৎ কাজ কি কোন পাগলের বা কোন কবির কল্পনার ফল হতে পারে?
إِنَّكُمْ لَذَائِقُو الْعَذَابِ الْأَلِيمِ
📘 তোমরা অবশ্যই মর্মন্তুদ শাস্তি আস্বাদন করবে,
وَمَا تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
📘 এবং তোমরা যা করতে কেবল তারই প্রতিফল ভোগ করবে,[১]
[১] যখন জাহান্নামীরা দাঁড়িয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করবে, তখন এই বাক্য তাদেরকে বলা হবে এবং সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হবে যে, এটা যুলম নয়; বরং প্রকৃত ইনসাফ। কারণ এসব তোমাদের কুকর্মের প্রতিফল।
إِنَّ إِلَٰهَكُمْ لَوَاحِدٌ
📘 নিশ্চয়ই তোমাদের উপাস্য এক। [১]
[১] صآفَّات , زاجرات , تاليات - এসব ফিরিশতাগণের গুণ। আকাশে আল্লাহর ইবাদতের জন্য সারিবদ্ধ অথবা আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান, ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে মানুষকে ডাঁট-ধমককারী অথবা মেঘমালাকে আল্লাহর আদেশক্রমে হাঁকিয়ে নিয়ে যায় এমন ফিরিশতা এবং আল্লাহর যিকর ও কুরআন তেলাঅতকারী; এই সকল ফিরিশতাগণের শপথ করে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করলেন যে, সকল মানুষের উপাস্য এক, একাধিক নয়; যেমন মুশরিকরা বানিয়ে রেখেছে। সাধারণতঃ তাকীদের জন্য এবং সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য কথায় শপথ করা হয়। এখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর একত্ব ও উপাস্য হওয়ার বিষয়ে মুশরিকদের যে সন্দেহ ছিল তা দূরীভূত করার জন্য শপথ করেছেন। এ ছাড়া সকল বস্তুই আল্লাহর সৃষ্টি ও মালিকানাধীন, ফলে যে কোন বস্তুকে সাক্ষী বানিয়ে তার শপথ করা (বা কসম খাওয়া) তাঁর জন্য বৈধ। কিন্তু মানুষের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও শপথ করা একেবারে অবৈধ ও হারাম। কারণ শপথে, যার শপথ করা হয় তাকে সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্য থাকে। আর গায়বী বিষয়ে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সাক্ষী হতে পারে না। কারণ একমাত্র 'আলেমুল গায়েব' তিনিই, তিনি ব্যতীত গায়বের খবর অন্য কেউ জানে না।
إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ
📘 তবে যারা আল্লাহর বিশুদ্ধ-চিত্ত দাস, তারা নয়। [১]
[১] অর্থাৎ, এরা শাস্তি থেকে নিরাপদে থাকবে। যদি তাদের কোন ত্রুটি ও অবহেলা থাকে, তবে তা মার্জনা করে দেওয়া হবে এবং প্রত্যেক পুণ্যের বদলা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে ।
أُولَٰئِكَ لَهُمْ رِزْقٌ مَعْلُومٌ
📘 তাদের জন্য আছে নির্ধারিত রুযী।
فَوَاكِهُ ۖ وَهُمْ مُكْرَمُونَ
📘 বহু ফলমূল এবং তারা হবে সম্মানিত,
فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ
📘 সুখময় বাগানসমূহে,
عَلَىٰ سُرُرٍ مُتَقَابِلِينَ
📘 তারা মুখোমুখি হয়ে পালঙ্কে আসীন হবে।
يُطَافُ عَلَيْهِمْ بِكَأْسٍ مِنْ مَعِينٍ
📘 তাদেরকে ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হবে প্রবাহিত (শারাবের) পানপাত্র, [১]
[১] كَأس মদ ভরতি পানপাত্রকে বলা হয়। আর قَدح খালি পানপাত্রকে বলা হয়। مَعِين এর অর্থ হল, প্রবাহিত ঝরনা। উদ্দ্যেশ্য হল, প্রবাহিত ঝরণার ন্যায় জান্নাতে সর্বদা মদ বা শারাব পাওয়া যাবে।
بَيْضَاءَ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ
📘 যা হবে শুভ্র উজ্জ্বল, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।[১]
[১] পৃথিবীর শারাবের রঙ সাধারণত অস্বচ্ছ বা ঘোলাটে হয়। কিন্তু জান্নাতের শারাব যেমন সুস্বাদু হবে, তেমনি তার রঙও হবে বড় সুন্দর (স্বচ্ছ ও অনাবিল)।
لَا فِيهَا غَوْلٌ وَلَا هُمْ عَنْهَا يُنْزَفُونَ
📘 ওতে ক্ষতিকর কিছুই থাকবে না এবং ওতে তারা নেশাগ্রস্তও হবে না, [১]
[১] অর্থাৎ পৃথিবীর শারাবের মত তা পান করে বমি, মাথা ব্যথা, মাতলামি ও মতিভ্রমের আশঙ্কা থাকবে না।
وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ عِينٌ
📘 তাদের সঙ্গে থাকবে আনতনয়না, আয়তলোচনা তরুণীগণ। [১]
[১] 'আয়ত' বা বড় ও ডাগর 'লোচন' বা চক্ষু হওয়া সৌন্দর্য্যের পরিচয়। অর্থাৎ বড় ও টানা চক্ষুবিশিষ্টা সুন্দরী তরুণী।
كَأَنَّهُنَّ بَيْضٌ مَكْنُونٌ
📘 যেন তারা গৌরবর্ণ সুরক্ষিত ডিম। [১]
[১] উটপাখী তার ডানার নিচে নিজ ডিমকে লুকিয়ে রাখে। যার ফলে তা হাওয়া এবং ধুলো-মাটি থেকে বেঁচে যায়। বলা হয় যে, উটপাখীর ডিমের রঙ খুব সুন্দর ও সুদর্শন হয়, যা হলুদ মিশ্রিত সাদা হয়। আর এই রঙকে মানুষের রূপ-জগতে সর্বোৎকৃষ্ট ভাবা হয়। পরন্তু সুরক্ষিত ডিমের সাথে এই সাদৃশ্য শুধু সাদা হওয়ার জন্য নয়; বরং (কাঁচা হলুদ বা সোনালী রঙ মিশ্রিত গৌরবর্ণ) সুন্দর রঙ এবং রূপ হওয়ার দিক দিয়েও।
رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَرَبُّ الْمَشَارِقِ
📘 যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছুর রক্ষক, রক্ষক পূর্বাচলের।[১]
[১] উদ্দ্যেশ্য হল, উদয়াচল ও অস্তাচলসমূহের প্রতিপালক ও রক্ষক। বহুবচন এই জন্য ব্যবহার করা হয়েছে যেমন অনেকে বলেন যে, বছরের দিনসমূহের সংখ্যা পরিমাণ উদয় ও অস্তস্থল আছে। সূর্য প্রতিদিন এক উদয়স্থল থেকে উদিত হয় এবং এক অস্তস্থলে অস্তমিত হয়। সূরা রাহমানে مشرقين এবং مغربين দ্বিবচন শব্দ ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ দুই উদয়াচল এবং দুই অস্তাচল। তার অর্থ সেই দুই উদয়াচল ও অস্তাচল যেখান থেকে সূর্য গ্রীষ্ম ও শীতকালে উদিত ও অস্তমিত হয়। অর্থাৎ প্রথমটি দূরবর্তী শেষ উদয়াচল ও অস্তাচল এবং দ্বিতীয়টি নিকটবর্তী শুরুর উদয়াচল ও অস্তাচল। আর যেখানে মাশরিক ও মাগরিব একবচন বর্ণনা করা হয়েছে তার অর্থ হল দিক; যেদিক থেকে সূর্য উদিত ও যে দিকে অস্তমিত হয়।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
فَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ
📘 তারা একে অপরের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। [১]
[১] জান্নাতী ব্যক্তিগণ জান্নাতে আপোসে বসে পৃথিবীর ঘটনাসমূহ স্মরণ করবে এবং একে অপরকে শোনাবে।
قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ إِنِّي كَانَ لِي قَرِينٌ
📘 তাদের কেউ বলবে, আমার এক সঙ্গী ছিল;
يَقُولُ أَإِنَّكَ لَمِنَ الْمُصَدِّقِينَ
📘 সে বলত, ‘তুমি কি এতে বিশ্বাসী যে, [১]
[১] অর্থাৎ, সে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে উক্ত কথা বলত, তার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, এটা তো অসম্ভব। যা ঘটা অসম্ভব তার প্রতি তুমি কি বিশ্বাস রাখ?
أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَدِينُونَ
📘 আমাদের মৃত্যু হলে এবং আমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হলেও আমাদেরকে প্রতিফল দেওয়া হবে?’ [১]
[১] অর্থাৎ, আমাদেরকে জীবিত করে আমাদের হিসাব নেওয়া হবে এবং হিসাব অনুযায়ী প্রতিফল দেওয়া হবে?
قَالَ هَلْ أَنْتُمْ مُطَّلِعُونَ
📘 (আল্লাহ) বলবেন, ‘তোমরা কি তাকে উঁকি মেরে দেখতে চাও?’ [১]
[১] অর্থাৎ, ঐ জান্নাতী ব্যক্তি জান্নাতের নিজ সাথীদেরকে বলবে, তোমরা কি জাহান্নামে উঁকি দিয়ে দেখবে? সম্ভবতঃ সেই লোক আমার দৃষ্টিগোচর হবে এবং আমি তোমাদেরকে বলে দেব যে, ঐ ব্যক্তি এই রকম কথাবার্তা বলত। অনেকের মতে ঐ কথার বক্তা মহান আল্লাহ অথবা ফিরিশতা।
فَاطَّلَعَ فَرَآهُ فِي سَوَاءِ الْجَحِيمِ
📘 অতঃপর সে উঁকি মেরে দেখবে এবং ওকে জাহান্নামের মধ্যস্থলে দেখতে পাবে ;
قَالَ تَاللَّهِ إِنْ كِدْتَ لَتُرْدِينِ
📘 বলবে, ‘আল্লাহর কসম! তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করেছিলে,
وَلَوْلَا نِعْمَةُ رَبِّي لَكُنْتُ مِنَ الْمُحْضَرِينَ
📘 আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ না থাকলে আমাকেও (তোমাদের মাঝে) উপস্থিত করা হত। [১]
[১] অর্থাৎ, উঁকি দিতেই তারা ঐ ব্যক্তিকে জাহান্নামের মাঝে দেখতে পাবে এবং তাকে ঐ জান্নাতী ব্যক্তি বলবে, তুমি আমাকেও পথভ্রষ্ট করে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে চেয়েছিলে। আমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ছিল। তা না হলে আজ আমিও তোমার সাথে জাহান্নামবাসী হতাম।
أَفَمَا نَحْنُ بِمَيِّتِينَ
📘 (সত্যই) কি আমাদের আর মৃত্যু হবে না, [১]
[১] জাহান্নামীদের এই অবস্থা দেখে জান্নাতীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলবে, আমরা যে জান্নাতী জীবন ও তার নিয়ামত পেয়েছি, তা কি চিরকালের জন্য নয়? সত্যই কি এখন আর আমাদের মৃত্যু আসবে না? এটা স্বীকৃতিসূচক জিজ্ঞাসা। অর্থাৎ এখন আমাদের এই জীবন চিরকালের জন্য। আমরা চিরকাল জান্নাতে এবং তোমরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। না তোমাদের মৃত্যু হবে যে, জাহান্নামের শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। আর না আমাদের মৃত্যু হবে যে, আমরা জান্নাতের নিয়ামতসমূহ থেকে বঞ্চিত হব। যেমন হাদীসে বর্ণনা হয়েছে যে, "মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকৃতিতে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে যবেহ করে দেওয়া হবে। ফলে আর কারোর মৃত্যু হবে না।"
(বুখারী, মুসলিম)
إِلَّا مَوْتَتَنَا الْأُولَىٰ وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ
📘 প্রথম মৃত্যুর পর[১] এবং আমাদেরকে শাস্তিও দেওয়া হবে না?’
[১] যা পৃথিবীতে (মৃত্যু)রূপে এসে গেছে। এখন আমাদের জন্য না মৃত্যু আছে আর না শাস্তি।
إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ
📘 আমি তোমাদের নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুশোভিত করেছি,
إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
📘 নিশ্চয়ই এ মহাসাফল্য। [১]
[১] কারণ, জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ ও জান্নাতের নিয়ামতের অধিকারী হওয়া থেকে বড় কৃতকার্যতা আর কি আছে?
لِمِثْلِ هَٰذَا فَلْيَعْمَلِ الْعَامِلُونَ
📘 এরূপ সাফল্যের জন্য সাধকদের সাধনা করা উচিত, [১]
[১] অর্থাৎ, এরূপ নিয়ামত ও এরূপ মহা অনুগ্রহের জন্যই মেহনতকারীদের মেহনত করা দরকার। কারণ এটাই সব থেকে বেশী লাভদায়ক ব্যবসা। ঐ ব্যবসা নয়; যা পৃথিবীর জন্য ক্ষণেকের এবং নোকসানের সওদা।
أَذَٰلِكَ خَيْرٌ نُزُلًا أَمْ شَجَرَةُ الزَّقُّومِ
📘 আপ্যায়নের জন্য কি এটিই উত্তম, না যাক্কুম বৃক্ষ?[১]
[১] زَقُّوْمٌ ,تَزَقُّمٌ থেকে উৎপত্তি যার অর্থঃ দুর্গন্ধময় ও ঘৃণিত বস্তু গিলে খাওয়া। 'যাক্কুম' বৃক্ষের ফল খাওয়াও জাহান্নামীদের জন্য বড় কঠিন হবে। কারণ তা বড় দুর্গন্ধময়, তেঁতো এবং অতি ঘৃণ্য হবে। অনেকে বলেন যে, এটা পৃথিবীর একটি গাছ এবং তা আরবে পরিচিত। ক্বুত্বরব বলেন, এটি এক প্রকার তেঁতো গাছ, যা তিহামা নামক এলাকায় পাওয়া যায়। আর অনেকে বলেন যে, এটা পৃথিবীর কোন গাছ নয়, পৃথিবীর মানুষের নিকট তা অপরিচিত।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
আরবী-উর্দু অভিধানে 'যাক্কুম'-এর অর্থ থুহার (কাঁটাদার বিষাক্ত গাছ) করা হয়েছে।
إِنَّا جَعَلْنَاهَا فِتْنَةً لِلظَّالِمِينَ
📘 সীমালংঘনকারীদের জন্য আমি এ সৃষ্টি করেছি পরীক্ষাস্বরূপ; [১]
[১] পরীক্ষাস্বরূপ, কারণ সে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করাই বড় পরীক্ষা। অনেকে এই কারণে পরীক্ষা বলেছেন যে, তারা তার অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে বলেছিল যে, জাহান্নামে যেখানে সর্বদিকে আগুন আর আগুন হবে, সেখানে গাছ কিভাবে থাকতে পারে? এখানে 'যালেম' (সীমালংঘনকারী) বলতে সেই সকল জাহান্নামীদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের উপর জাহান্নাম ওয়াজেব হবে।
إِنَّهَا شَجَرَةٌ تَخْرُجُ فِي أَصْلِ الْجَحِيمِ
📘 এ বৃক্ষ জাহান্নামের তলদেশ হতে উদগত হয়, [১]
[১] অর্থাৎ, তার মূল ও শিকড় জাহান্নামের তলদেশে হবে, তবে তার ডালপালা সব দিকে ছড়িয়ে থাকবে।
طَلْعُهَا كَأَنَّهُ رُءُوسُ الشَّيَاطِينِ
📘 এর মোচা শয়তানের মাথার মত। [১]
[১] এটি দেখতে এত নিকৃষ্ট ও কুশ্রী যে, একে শয়তানের মাথার সাথে তুলনা করা হয়েছে; যেমন কোন ভাল লোকের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, 'ঠিক যেন সে ফিরিশতা।'
فَإِنَّهُمْ لَآكِلُونَ مِنْهَا فَمَالِئُونَ مِنْهَا الْبُطُونَ
📘 সীমালংঘনকারীরা তা ভক্ষণ করবে এবং তা দিয়ে উদর পূর্ণ করবে। [১]
[১] তা তাদেরকে জোর করে খাইয়ে পেট পূর্ণ করা হবে। (অথবা ক্ষুধার তাড়নায় তাই দিয়ে তারা পেট পূর্ণ করবে।)
ثُمَّ إِنَّ لَهُمْ عَلَيْهَا لَشَوْبًا مِنْ حَمِيمٍ
📘 তার উপর অবশ্যই ওদের জন্য ফুটন্ত পানির মিশ্রণ থাকবে, [১]
[১] অর্থাৎ, খাওয়ার পর (গলায় আটকে গেলে) তাদের পানির প্রয়োজন হলে তাদেরকে ফুটন্ত গরম পানি দেওয়া হবে, যা পান করার ফলে তাদের নাড়ী-ভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৫ আয়াত দ্রষ্টব্য)
ثُمَّ إِنَّ مَرْجِعَهُمْ لَإِلَى الْجَحِيمِ
📘 অতঃপর অবশ্যই ওদের প্রত্যাবর্তন হবে জাহান্নামের দিকে। [১]
[১] অর্থাৎ, যাক্কুম ও গরম পানি খাওয়ার পর তাদেরকে পুনরায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
إِنَّهُمْ أَلْفَوْا آبَاءَهُمْ ضَالِّينَ
📘 নিশ্চয় ওরা ওদের পিতৃপুরুষদেরকে বিপথগামী হিসেবে পেয়েছিল
وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ
📘 এবং একে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান হতে রক্ষা করেছি।[১]
[১] অর্থাৎ, পৃথিবীর নিকটতম আকাশে, সৌন্দর্য ছাড়াও তারকারাজি সৃষ্টির আরও একটি উদ্দেশ্য এই যে, বিদ্রোহী শয়তানদল থেকে তার হিফাযত। শয়তান আকাশে (অহীর) কোন কথাবার্তা শোনার জন্য উপস্থিত হয়, তখন তাদের উপর তারকা (উল্কা) নিক্ষেপ করা হয়, যাতে অধিকাংশ সময়ে অনেক শয়তান পুড়ে যায়। যেমন এ কথা পরবর্তী আয়াতে এবং হাদীসে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তারকারাজি সৃষ্টির তৃতীয় উদ্দেশ্য রাত্রের অন্ধকারে পথ প্রদর্শনও; যেমন কুরআনের অন্য স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত তিন প্রকার উদ্দেশ্য ছাড়া তারকারাজির অন্য আর কোন উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়নি।
فَهُمْ عَلَىٰ آثَارِهِمْ يُهْرَعُونَ
📘 এবং নির্বিচারে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। [১]
[১] এখানে জাহান্নামের উল্লিখিত শাস্তির কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা আপন বাপ-দাদাদেরকে ভ্রষ্টতার উপর পেয়েও তাদের অন্ধানুকরণ করে চলেছিল এবং প্রমাণ ও স্পষ্ট দলীল ছেড়ে 'তাকলীদ' (অন্ধ-বিশ্বাস) এর পথ বেছে নিয়েছিল। إهراعٌ , إسراعٌ এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ শীঘ্রতা করা, দৌড়ানো, অতি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করা বা লুফে নেওয়া।
وَلَقَدْ ضَلَّ قَبْلَهُمْ أَكْثَرُ الْأَوَّلِينَ
📘 ওদের পূর্বেও অধিকাংশ পূর্ববর্তীরা বিপথগামী হয়েছিল, [১]
[১] অর্থাৎ, শুধু এরাই পথভ্রষ্ট হয়নি, বরং তাদের পূর্ববর্তী অধিকাংশ মানুষই পথভ্রষ্ট ছিল।
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا فِيهِمْ مُنْذِرِينَ
📘 এবং আমি অবশ্যই ওদের মধ্যে সতর্ককারী প্রেরণ করেছিলাম। [১]
[১] অর্থাৎ, তাদের পূর্ববর্তী মানুষদের নিকট সতর্ককারী পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা সত্যের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা গ্রহণ না করলে তাদেরকে আল্লাহর শাস্তির ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু তাদের উপর কোন প্রভাব পড়েনি; পরিণামে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যেমন পরবর্তী আয়াতে তাদের শিক্ষামূলক পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُنْذَرِينَ
📘 সুতরাং লক্ষ্য কর, যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল, তাদের পরিণাম কি হয়েছিল?
إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ
📘 তবে আল্লাহর বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের কথা স্বতন্ত্র। [১]
[১] অর্থাৎ, শিক্ষামূলক পরিণতি থেকে শুধু তারাই নিষ্কৃতি পেয়েছিল যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ঈমান ও তাওহীদ গ্রহণ করার তাওফীক দান করে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। مُخْلَصِينَ (বিশুদ্ধচিত্ত) ঐ সকল মানুষ যারা শাস্তি থেকে বেঁচেছিল। এক্ষণে مُنْذَرِينَ (যে দলকে সতর্ক ও ধ্বংস করা হয়েছিল তাদের) বর্ণনার পর কিছু مُنْذِرِيْنَ (সতর্ককারী পয়গম্বর)-দের বর্ণনা করা হচ্ছে।
وَلَقَدْ نَادَانَا نُوحٌ فَلَنِعْمَ الْمُجِيبُونَ
📘 নূহ আমাকে আহবান করেছিল এবং আমি কত উত্তমরূপে সাড়া দিয়েছিলাম। [১]
[১] অর্থাৎ, সাড়ে নয়শ' বছর তাবলীগ করার পরেও যখন কওমের অধিকাংশ লোকেরাই তাঁকে মিথ্যাজ্ঞান করল এবং তিনি অনুভব করলেন যে, এদের ঈমান আনার কোন আশা নেই, তখন নিজ প্রভুর নিকট দু'আ করে বললেন, (فَدَعَا رَبَّهُ اَنِّيْ مَغْلُوْبٌ فَانْتَصِرْ) "হে আল্লাহ আমি অসহায়, তুমি আমার প্রতিশোধ নাও।
(সূরা ক্বামার ৫৪:১০ আয়াত)
সুতরাং আল্লাহ নূহ (আঃ)-এর দু'আ কবুল করলেন এবং তাঁর কওমকে তুফান দিয়ে ধ্বংস করে দিলেন।
وَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ
📘 তাকে এবং তার পরিবারবর্গকে[১] আমি মহাসঙ্কট হতে রক্ষা করেছিলাম।
[১] أَهْلٌ এর অর্থ নূহ (আঃ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী, তাঁর বাড়ির মু'মিন ব্যক্তিরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কোন কোন মুফাসসির তাদের মোট সংখা ৮০ জন বলেছেন। তাঁর স্ত্রী ও একজন ছেলে (কিনআন) তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ তারা মু'মিন ছিল না। তারাও তুফানে ডুবে গিয়েছিল। 'মহাসঙ্কট' বলতে সেই মহা প্লাবনকে বুঝানো হয়েছে, যাতে ঐ সম্প্রদায় ডুবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ
📘 তার বংশধরদেরকেই আমি অবশিষ্ট রেখেছি; [১]
[১] অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে নূহ (আঃ)-এর অবশিষ্ট বংশধর বলতে তাঁর তিনটি সন্তান ছিল; হাম, সাম ও ইয়াফেস। মানুষের পরবর্তী জন্মধারা তাদের থেকেই চলে আসছে। যার জন্য নূহ (আঃ)-কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। অর্থাৎ আদম (আঃ)-এর মত, আদম (আঃ)-এর পর তিনি দ্বিতীয় মানব-পিতা। সামের বংশ থেকে আরব, পারসীক, রোম এবং ইয়াহুদী ও নাসারার জন্ম। হামের বংশ থেকে সুডান (পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত) অর্থাৎ সিন্ধী, ভারতীয়, (দক্ষিণ মিসরের) নূবী, (আফ্রিকার) নিগ্রো, হাবশী, ক্বিবত্বী এবং বর্বর ইত্যাদি হয়েছে এবং ইয়াফেসের বংশ থেকে (বুলগারিয়ার) স্বাক্বালিবা, (তুর্কিস্তানের) তুর্কী, খাযার এবং ইয়া'জুজ-মা'জুজ ইত্যাদি জাতির জন্ম হয়েছে।
(ফাতহুল ক্বাদীর)
(এ ব্যাপারে কোন সঠিক প্রমাণ নেই।) والله أعلم।
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ
📘 আমি তা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি, [১]
[১] অর্থাৎ, কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী মু'মিনদের মাঝে আমি নূহ (আঃ)-এর সুনাম বাকী রেখেছি। তারা নূহ (আঃ)-এর প্রতি সালাম পাঠ করছে ও করবে।
سَلَامٌ عَلَىٰ نُوحٍ فِي الْعَالَمِينَ
📘 সমগ্র বিশ্বের মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক!
لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَىٰ وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ
📘 ফলে, শয়তানরা ঊর্ধ্ব জগতের কিছু শ্রবণ করতে পারে না। ওদের ওপর সকল দিক হতে (উল্কা) নিক্ষিপ্ত হয়;
إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ
📘 এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি; [১]
[১] অর্থাৎ, যেরূপ নূহ (আঃ)-এর দু'আ কবুল করে তার বংশধরকে বাকী রেখে এবং পরবর্তী প্রজন্মে তার সুনাম বাকী রেখে আমি নূহ (আঃ)-কে সম্মানিত করেছি, অনূরূপ যে কেউ নিজ কথা ও কর্মে সৎপরায়ণ হবে এবং তাতে সে সুদৃঢ় ও প্রসিদ্ধ হবে, তার সাথেও আমি ঐ ব্যবহার করব।
إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ
📘 সে ছিল আমার বিশ্বাসী দাসদের অন্যতম।
ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآخَرِينَ
📘 অবশিষ্ট সকলকে আমি নিমজ্জিত করেছিলাম;
۞ وَإِنَّ مِنْ شِيعَتِهِ لَإِبْرَاهِيمَ
📘 নিশ্চয় ইব্রাহীম তার অনুসারীদের একজন। [১]
[১] شيعةٌ এর অর্থ দল ও স্বমতাবলম্বী, অনুসরণকারী। অর্থাৎ ইবরাহীম জ দ্বীনদার ও তাওহীদবাদীদের সেই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাঁরা নূহ (আঃ)-এর মতই আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ তাওফীক পেয়েছিলেন।
إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
📘 স্মরণ কর, সে তার প্রতিপালকের নিকট সুস্থ হৃদয়ে উপস্থিত হয়েছিল;
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَاذَا تَعْبُدُونَ
📘 সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমরা কিসের পূজা করছ?
أَئِفْكًا آلِهَةً دُونَ اللَّهِ تُرِيدُونَ
📘 তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক উপাস্য চাও? [১]
[১] অর্থাৎ, নিজেদের পক্ষ থেকে মিথ্যাভাবে উপাস্য বানিয়ে নিয়ে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত তাদের ইবাদত করছ, অথচ তা পাথর ও মূর্তি বৈ কিছুই নয়।
فَمَا ظَنُّكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِينَ
📘 বিশ্বজগতের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কি?’ [১]
[১] অর্থাৎ, এই শ্রেণীর জঘন্য আচরণ করার পরেও তিনি তোমাদের প্রতি কি অসন্তুষ্ট হবেন না এবং তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন না?
فَنَظَرَ نَظْرَةً فِي النُّجُومِ
📘 অতঃপর ইব্রাহীম তারকারাজির দিকে একবার তাকাল
فَقَالَ إِنِّي سَقِيمٌ
📘 এবং বলল, ‘আমি অসুস্থ।’[১]
[১] তিনি চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন; যেমন অনেকে এরূপ করে থাকে। অথবা নিজ সম্প্রদায় যারা জগতের কাজ-কারবারে তারকারাজির পরিভ্রমণকে প্রভাবশালী মনে করত, তাদেরকে ভুল ধারণা দেওয়ার জন্য এরূপ (হেত্বাভাস ব্যবহার) করেছিলেন। এ ঘটনাটি ঐ দিনের যেদিন তাঁর জাতি শহর ছেড়ে বাইরে গিয়ে খুশী ও জাতীয় উৎসব পালন করত। জাতির মানুষ তাঁকেও সাথে যাওয়ার জন্য বলল। কিন্তু ইবরাহীম (আঃ) একাকী হওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন, যাতে তাদের মূর্তির ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং তিনি এটিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে করলেন যে, আগামী কাল সম্প্রদায়ের সমস্ত লোক বাইরে উৎসবে চলে গেলে আমি আমার ইচ্ছা পূরণ করেই ছাড়ব। সুতরাং ওজর পেশ করে তিনি বললেন, 'আমি অসুস্থ।' অথবা আকাশের (তারকারাজির) রাশিচক্র বলছে যে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। তাঁর এই কথা মিথ্যা ছিল না, কারণ প্রায় সময়ে প্রত্যেক মানুষের কোন না কোন অসুখ থেকেই থাকে। তাছাড়া সম্প্রদায়ের শিরকী কর্মকান্ড ইবরাহীম (আঃ)-এর মানসিক পীড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যা দেখে তিনি বড় কষ্ট পেতেন। আসলে ইবরাহীম (আঃ) 'তাওরিয়া' ব্যবহার করেছিলেন। (তাওরিয়া হল, এমন দ্ব্যর্থবোধক বাক্যে কথা বলা, যার বাহ্যিক অর্থ বাস্তবের প্রতিকূল এবং বক্তার উদ্দিষ্ট অর্থ বাস্তবের অনুকূল হয়।) যা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা নয়, কিন্তু যার উদ্দেশ্যে বলা হয়, সে বাহ্যিক আকারে ভুল ধারণার শিকার হয়। যার ফলে তিন মিথ্যা কথার যে হাদীস, তাতে এই কথাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা আম্বিয়ার ২১:৬৩ নং আয়াতের টীকায় করা হয়েছে।
دُحُورًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ
📘 ওদেরকে বিতাড়নের জন্য। আর ওদের জন্য আছে অবিরাম শাস্তি।
فَتَوَلَّوْا عَنْهُ مُدْبِرِينَ
📘 অতঃপর ওরা তাকে পশ্চাতে রেখে চলে গেল।
فَرَاغَ إِلَىٰ آلِهَتِهِمْ فَقَالَ أَلَا تَأْكُلُونَ
📘 পরে সে সংগোপনে ওদের দেবতাগুলির নিকট গেল এবং বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন? [১]
[১] অর্থাৎ, তাবার্রুক অর্জনের নিমিত্তে নিয়ে যাওয়া যে সকল মিষ্টান্ন সেখানে পড়ে ছিল, তিনি তাদেরকে খাওয়ার জন্য দিলেন। আর এ কথা স্পষ্ট যে, তাদের না খাওয়ার দরকার ছিল, আর না তারা খেয়েছিল; বরং তাদের উত্তর দেওয়ারও ক্ষমতা ছিল না, ফলে কোন উত্তরও দিল না।
مَا لَكُمْ لَا تَنْطِقُونَ
📘 তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা কথা বল না?’
فَرَاغَ عَلَيْهِمْ ضَرْبًا بِالْيَمِينِ
📘 অতঃপর সে ওদের ওপর ঝুঁকে সজোরে আঘাত হানল। [১]
[১] رَاغَ , مَالَ, ذََهَبَ, أَقْبَلَ এ সবের অর্থ প্রায় একই। আর তা হল, তাদের দিকে ঝুঁকল বা মুখ করল,ضَرْبٌ بِالْيَمِيْنِ এর উদ্দেশ্য হল, সজোরে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলা।
فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَزِفُّونَ
📘 তখন তারা তার দিকে ছুটে এল। [১]
[১] يَزِفُّوْنَ , يُسْرِعُوْنَ এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। অর্থঃ দৌড়ে এল। অর্থাৎ, যখন তারা মেলা থেকে ফিরে এসে দেখল যে, তাদের উপাস্যগুলি ভেঙ্গে-চুরে পড়ে আছে, তখন সাথে সাথে তারা ভাবল যে, এ কাজ ইবরাহীমই করেছে। যেমন সূরা আম্বিয়াতে (২১:৫১-৭০ আয়াতে) তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। সুতরাং তারা তাঁকে ধরে জনসাধারণের বিচার-সভায় নিয়ে এল। সেখানে ইবরাহীম (আঃ) তাদের অজ্ঞানতা ও তাদের উপাস্যের অক্ষমতা প্রকাশ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন।
قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ
📘 সে বলল, ‘তোমরা নিজেরা যাদেরকে পাথর খোদাই করে নির্মাণ কর তোমরা কি তাদেরই পূজা কর?
وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ
📘 প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা তৈরী কর তা-ও।’ [১]
[১] অর্থাৎ, ঐ সকল মূর্তি (এবং ছবিও) যা তোমরা নিজ হস্তে তৈরী কর এবং তাদেরকে উপাস্য মনে কর, তাও তিনি সৃষ্টি করেছেন। অথবা তোমরা যে সব কর্ম কর, সেসবের স্রষ্টাও একমাত্র আল্লাহ তাআলা। এতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বান্দার আমল বা কর্মের স্রষ্টাও আল্লাহ তাআলা। এটাই হল আহলে সুন্নতের আকীদা।
قَالُوا ابْنُوا لَهُ بُنْيَانًا فَأَلْقُوهُ فِي الْجَحِيمِ
📘 তারা বলল, ‘এর জন্য এক অগ্নিকুন্ড তৈরী কর, অতঃপর একে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর।’
فَأَرَادُوا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ
📘 ওরা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার ইচ্ছা করেছিল, কিন্তু আমি ওদেরকে হীন করে দিলাম। [১]
[১] অর্থাৎ, আগুনকে স্বাভাবিক ঠান্ডা বানিয়ে দিয়ে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিলাম। পবিত্র সেই আল্লাহ যিনি নিজ বান্দার সাহায্য করেন। আর পরীক্ষাকে দানরূপে এবং অকল্যাণকে কল্যাণরূপে পরিবর্তন করে দেন।
وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَىٰ رَبِّي سَيَهْدِينِ
📘 ইব্রাহীম বলল, ‘আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম,[১] তিনি আমাকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করবেন;
[১] ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত ঘটনা ইরাকের ব্যাবিলন শহরে ঘটেছিল। শেষে তিনি সেখান থেকে হিজরত করে শামে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে সন্তানের জন্য দু'আ করেন।
(ফাতহুল ক্বাদীর)