slot qris slot gacor terbaru slot gacor terbaik slot dana link slot gacor slot deposit qris slot pulsa slot gacor situs slot gacor slot deposit qris
| uswah-academy
WhatsApp Book A Free Trial
القائمة

🕋 تفسير سورة البقرة

(Al-Baqarah) • المصدر: BN-TAFISR-FATHUL-MAJID

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الم

📘 নামকরণ ও অবতীর্ণের সময়কাল: اَلْبَقَرَةُ (আল-বাকারাহ) শব্দের অর্থ গাভী। এ সূরার ৬৭-৭১ নং আয়াতে বানী ইসরাঈলের সাথে সম্পৃক্ত গাভী সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকেই বাকারাহ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এটি মদীনায় অবতীর্ণ বিধি-বিধানসম্বলিত সূরাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সূরা। বিশিষ্ট তাবিঈ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা আল-বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনদের ব্যাপারে, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের ব্যাপারে এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। সূরা বাকারার ফযীলত: সূরা বাকারার ফযীলত সম্পর্কে অনেক সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়। ইমাম ইবনুল আরাবী (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারাহ এক হাজার সংবাদ, এক হাজার আদেশ ও এক হাজার নিষেধ সম্বলিত একটি সূরা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী, অত্র আয়াতের তাফসীর) সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ، وَإِنَّ البَيْتَ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ البَقَرَةُ لَا يَدْخُلُهُ الشَّيْطَانُ “তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত কর না। কেননা যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় তাতে শয়তান প্রবেশ করে না।”(তিরমিযী হা: ২৮৭৭, সহীহ) সহীহ মুসলিম এর বর্ণনায় রয়েছে: إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِيْ تُقْرَأُ فِيْهِ سُوْرَةُ الْبَقَرَةِ “যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয় সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।”(সহীহ মুসলিম হা: ৫৩৯) আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের মধ্যে কাউকে যেন এরূপ না পাই যে, সে এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে পড়তে থাকে, কিন্তু সে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করে না। জেনে রেখ, যে ঘরে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে ঘর থেকে শয়তান দ্রুত পালিয়ে যায়। সবচেয়ে খালি ও মূল্যহীন সেই ঘর, যে ঘরে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব (কুরআন) পাঠ করা হয় না। (নাসাঈ হা: ৯৬৩, হাদীসটি হাসান) উসাইদ বিন হুজাইর (রাঃ) একদা রাতে সূরা বাকারাহ পাঠ আরম্ভ করেন। তাঁর পাশেই বাঁধা ঘোড়াটি হঠাৎ করে লাফাতে শুরু করে। তিনি পাঠ বন্ধ করলে ঘোড়াও লাফানো বন্ধ করে দেয়। আবার তিনি পড়তে শুরু করেন এবং ঘোড়াও লাফাতে শুরু করে। তিনি পুনরায় পড়া বন্ধ করেন, ঘোড়াটিও স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃতীয়বারও এরূপ ঘটে। তাঁর শিশু পুত্র ইয়াহইয়া ঘোড়ার পাশে শুয়ে ছিল। কাজেই তিনি ভয় করলেন যে, হয়তো ছেলের গায়ে আঘাত লেগে যাবে। সুতরাং তিনি পড়া বন্ধ করে ছেলেকে উঠিয়ে নেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যে, ঘোড়ার চমকে ওঠার কারণ কী? সকালে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে হাযির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘটনা শুনে বললেন: উসাইদ! তুমি পড়েই যেতে। উসাইদ (রাঃ) বলেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তৃতীয় বারের পরে প্রিয় পুত্র ইয়াহইয়ার কারণে আমি পড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অতঃপর আমি মাথা আকাশের দিকে উঠালে ছায়ার ন্যায় একটি আলোকিত জিনিস দেখতে পাই এবং মুহূর্তেই তা ওপরের দিকে উঠে শূন্যে মিশে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন: তুমি কি জান সেটা কী ছিল? তাঁরা ছিলেন গগণবিহারী অগণিত জ্যোতির্ময় ফেরেশতা। তোমার (পড়ার) শব্দ শুনে তাঁরা নিকটে এসেছিলেন। যদি তুমি পড়া বন্ধ না করতে তাহলে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এরূপ থাকতেন এবং মদীনার সকল লোক তা দেখে চোখ জুড়াতো। একজন ফেরেশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হতেন না। (সহীহ বুখারী হা: ৫০১৮৮, সহীহ মুসলিম হা: ২১৯২) সূরা আল-বাকারাহ ও আলি-ইমরানের ফযীলত: আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন- তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে বসেছিলাম। অতঃপর তাঁকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে শুনলাম তোমরা সূরা বাকারাহ শিক্ষা গ্রহণ কর। কারণ এর শিক্ষা অতি কল্যাণকর এবং এর শিক্ষা বর্জন অতি বেদনাদায়ক। এমনকি বাতিল পন্থীরাও এর ক্ষমতা রাখে না। বর্ণনাকারী বলেন: এরপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন- সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান শিক্ষা কর। এ দু’টি জ্যোতির্ময় নূরবিশিষ্ট সূরা। এরা এদের তেলাওয়াতকারীর ওপর সামিয়ানা, মেঘমালা অথবা পাখির ঝাঁকের ন্যায় কিয়ামাতের দিন ছায়া দান করবে। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৩৪৮-৩৬১, মুসতাদরাকে হাকীম হা: ৫৬০, ইমাম হাকীম বলেন: হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্তে কিন্তু তিনি বর্ণনা করেননি) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামাতের দিন কুরআন তেলাওয়াতকারীদেরকে আহ্বান করা হবে। সূরা বাকারাহ ও সূরা আলি-ইমরান (তেলাওয়াতকারীদের) অগ্রে অগ্রে চলবে মেঘের ছায়া বা পাখির মত। এরা জোরালোভাবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৫৫৩) ১ নং আয়াতের তাফসীর: الم-(আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় অক্ষরগুলোকে الحروف المقطعات “হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সর্বমোট ঊনত্রিশটি সূরার শুরুতে এরূপ অক্ষর বা হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে সূরা বাকারার “الم”। এসবের মধ্যে কতকগুলো এক অক্ষর, আবার কতকগুলো দুই, তিন, চার এবং সর্বোচ্চ পাঁচ অক্ষরবিশিষ্ট। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে এ বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলোর কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীর পাওয়া যায় না। এ জন্য বলা হয় “اَللّٰهُ أَعْلَمُ بِمُرَادِهِ بِذَلِكَ” মহান আল্লাহই এগুলোর ব্যাপারে ভাল জানেন। (আইসারুত তাফাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) তবে এর ফযীলত প্রসঙ্গে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি এ কথা বলি না যে, আলিফ- লাম- মীম একটি অক্ষর। বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। প্রত্যেক অক্ষরে একটি করে নেকী দেয় হবে। আর একটি নেকীর প্রতিদান দশ গুণ করে দেয়া হবে। (তিরমিযী হা: ২৯১০, সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা: ১৪১৬, সহীহ) কেউ বলেছেন, এগুলোর অর্থ আছে, এগুলো সূরার নাম। কেউ বলেছেন, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার নাম। আবার কেউ বলেছেন এগুলোর কোন অর্থ নেই। কারণ আরবি ভাষায় এরূপ বিচ্ছিন্ন অক্ষরের কোন অর্থ হয় না। আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন (রহঃ) এ কথাই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এগুলো এমন বিষয় যার জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সুতরাং এগুলোর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত। (কুরতুবী, ইবনে কাসীর ) অতএব “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” যা সূরার শুরুতে রয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকাই সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার কাজ। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না, বরং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা এগুলো অনর্থক অবতীর্ণ করেননি। এগুলোর পেছনে হিকমত রয়েছে যা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। তাছাড়া তৎকালীন আরবরা সাহিত্যে ছিল বিশ্ব সেরা। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত কুরআন বিশেষ করে এ সকল বিচ্ছিন্ন অক্ষর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ কুরআনের মত একটি কুরআন অথবা একটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আসতে। এমনকি একটি আয়াত তৈরি করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করলেন, তারা তাতেও সক্ষম হয়নি। এ চ্যালেঞ্জ কিয়ামত অবধি বহাল থাকবে, কিন্তু কেউ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়নি এবং হবেও না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে কুরআন কোন গণক, জ্যোতিষী বা মানুষের তৈরি কিতাব নয়, বরং বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা‘আলার বাণী যা শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়ে একটি চিরস্থায়ী মু‘জিযাহ। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সূরা বাকারাহ অতীব ফযীলতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা। ২. যে বাড়িতে সূরা বাকারাহ তেলাওয়াত করা হয় সে বাড়িতে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না। তাই আমাদের বেশি বেশি এ সূরা তেলাওয়াত করা দরকার। ৩. “হুরূফুল মুক্বাত্বআত”বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরের সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছে। অতএব এর তাফসীর আল্লাহ তা‘আলার দিকেই সোপর্দ করা উচিত। ৪. কুরআনুল কারীমের একটি অক্ষর তেলাওয়াত করলে দশটি নেকী হয়, বুঝে তেলাওয়াত করুক আর না বুঝে তেলাওয়াত করুক। তবে অবশ্যই বুঝে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতে হবে। ৫. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ

📘 ১১৫ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। ইবনু কাসীর, তাবারী, কুরতুবীতে এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে একাধিক বর্ণনা বিদ্যমান। সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হল- ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে বাহনের ওপর নফল সালাত আদায় করছিলেন। আর বাহন তখন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকে মুখ ঘুরে চলছিল। অতঃপর ইবনু উমার (রাঃ) (وَلِلّٰهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ....) অত্র আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন এ ব্যাপারে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৬৪৪-৪৫, ১৬৫০) অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ব ও পশ্চিম দু’দিককে নির্দিষ্ট করে উল্লখ করেছেন যা উদয় ও অস্তাচল। তিনি এ দু’দিকসহ সকল দিকের মালিক। অতএব সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে যেদিকেই তোমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় সেদিকেই আল্লাহ তা‘আলা রয়েছেন। তাতে তোমরা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে না। তাই কেউ যদি আদিষ্ট কেবলা অনুসন্ধান করে না পায়, তাহলে তার কাছে যেটা কেবলার দিক বলে মনে হবে সেদিকে ফিরে সালাত আদায় করবে, তারপর যদি জানা যায় কেবলা নির্ণয়ে ভুল হয়েছে তাহলে সালাত পুনরায় আদায়ের প্রয়োজন নেই। (فَثَمَّ وَجْهُ اللّٰهِ) ‘সে দিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে’আয়াতের এ অংশ প্রমাণ করছে আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে। তাঁর জন্য যেমন উপযোগী তেমন তাঁর চেহারা, কোন কিছুর সাথে তাঁর চেহারার সাদৃশ্য নেই। অন্যত্র তিনি বলেন: (وَّيَبْقٰي وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ) ‏ “এবং অবশিষ্ট থাকবে শুধু তোমার প্রতিপালকের চেহারা, যিনি মহিমাময়, মহানুভব।” সুতরাং আমাদের ঈমান রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার জন্য যে সকল নাম ও সিফাত উল্লেখ করেছেন তা সত্য। তাঁর সিফাতের সাথে মাখলুকের সিফাতের কোন সাদৃশ্য নেই। তাই আমরা শাব্দিক ও আর্থিক কোন প্রকার পরিবর্তন করব না। বরং যেভাবে কুরআন ও সুন্নাহয় এসেছে সেভাবেই বিশ্বাস করব। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. পূর্ব-পশ্চিমসহ সারা জাহানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। ২. আরোহী অবস্থায় নফল সালাত আদায় করা যাবে, তাতে কেবলামুখী না হতে পারলে সমস্যা নেই। তবে ফরয সালাত কেবলামুখী হয়ে আদায় করা আবশ্যক। ৩. আল্লাহ তা‘আলার চেহারা রয়েছে, কোন ধরণ-গঠন জিজ্ঞাসা এবং বিকৃতি ও অস্বীকৃতি ছাড়াই এর ওপর ঈমান আনব।

وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى ۖ وَعَهِدْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

📘 ১২৫ নং আয়াতের তাফসীর: উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিনটি বিষয়ে আমার প্রতিপালক আমার সাথে একমত হয়েছেন। (তার মধ্যে ১টি হল: আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি “মাকামে ইবরাহীম”কে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করে নিতেন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী: ৪৪৮৩) এছাড়াও এ আয়াতের কয়েকটি শানে নুযূল পাওয়া যায়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল পৃঃ ৩০) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন একটি নিদর্শনের কথা তুলে ধরলেন যা ইবরাহীম (আঃ)-এর ইমামতের ওপর প্রমাণ বহন করে। তা হল বাইতুল্লাহ যা ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। এ ঘরকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষের প্রত্যাবর্তন স্থল বানিয়েছেন। মানুষ একবার আগমন করে পরিবারে ফিরে যাবে আবার আসবে। এরূপ বারবার মানুষের মন চাইবে আরো যাওয়ার। আরেকটি নিদর্শন হল এ ঘরকে নিরাপদ স্থান করেছেন। যত বড় অপরাধীই এখানে প্রবেশ করুক না কেন কোন প্রকার ঝগড়া, মারামারি, লুণ্ঠন এখানে করা যাবে না। এমনকি পশু পাখি ও বৃক্ষলতাও নিরাপদে থাকবে। জাহিলি যুগের মুশরিকরাও এ ঘরের সম্মান করত। ইসলাম এসে এ সম্মান আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছে। ‘মাকামে ইবরাহীম’দ্বারা কোন্ জায়গাকে বোঝোনো হয়েছে এ নিয়ে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ দু’টি বর্ণনা হল: ১. সে পাথর যার ওপর পা রেখে ইবরাহীম (আঃ) কাবা নির্মাণ করেছিলেন। (তাফসীর মুয়াসসার, পৃঃ ১৯) ২. হজ্জের সকল মাশ‘আর (স্থানসমূহ)। (তাফসীর সা‘দী পৃঃ ৪৬) তবে প্রথম মত-ই সঠিক। এ আয়াতটিকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে শিয়া ও বিদ‘আতী সম্প্রদায় বলে: ওলীদের কবরে সালাত আদায় করা যাবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বরকত লাভের জন্য মুসল্লী ও হাজীদেরকে মাকামে ইবরাহীমে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন । এ আয়াতকে ওলীদের কবরে সালাত আদায়ের সপক্ষে দলীল গ্রহণ করা প্রবৃত্তির মনগড়া চিন্তার অনুসরণ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ মাকামে ইবরাহীম কোন কবর নয় এবং কবর সংশ্লিষ্ট কোন স্থানও নয়। বরং তা বাইতুল্লাহ সংশ্লিষ্ট স্থান। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সে স্থানটি বরকতময়। অপরপক্ষে কোন ব্যক্তির কবর শরীয়তে বরকতময় বলে প্রমাণিত নয় এবং কবরকে কেন্দ্র করে সালাত বা অন্য কোন ইবাদতও শরীয়তসম্মত নয়। এমনকি কবরস্থানে সিজদা ও সালাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত প্রাপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইয়াহূদ ও খ্রিস্টানরা তাদের নাবীদের কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করায় তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত। (সহীহ বুখারী হা: ১৩৩০, সহীহ মুসলিম হা: ৫৩০) আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-কে ওয়াহী করেছেন এ ঘর অপবিত্রতা ও মূর্তি হতে পবিত্র রাখতে, যাতে সকল ইবাদত পালনে কোন প্রকার সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়। এখানে শুধু কাবা ঘর সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল মাসজিদ এ নির্দেশের শামিল। তাই প্রত্যেক মাসজিদ সকল প্রকার অপবিত্রতা ও মূর্তি থেকে পবিত্র রাখা ঈমানি দায়িত্ব। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর মর্যাদা জানা গেল। ২. উমার (রাঃ)-এর মর্যাদা জানতে পারলাম। ৩. সকল মাসজিদকে অপবিত্রতা ও মূর্তি হতে পবিত্র রাখতে হবে। ৪. কোন কবরে সালাত আদায় করা যাবে না, কবরবাসী যদিও নাবী বা ওলী হয়ে থাকেন।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُوا كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاءُ ۗ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَٰكِنْ لَا يَعْلَمُونَ

📘 ১৩ নং আয়াতের তাফসীর: যখন মুনাফিকদেরকে বলা হয় মানুষেরা তথা সাহাবীরা যেমন ঈমান এনেছে অনুরূপ ঈমান আন। তখন তারা জবাবে বলে আমরা কি নির্বোধদের মত ঈমান আনব? এখানে নির্বোধ দ্বারা সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কারণ অধিকাংশ সাহাবীরা সমাজের বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন না। যেমন রোম সম্রাট হিরাকল আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল: সমাজের সম্ভ্রান্ত ধনী ব্যক্তিরা কি তাঁর (মুহাম্মাদের) অনুসরণ করে, না দুর্বল গরীবরা? জবাবে তিনি বলবেন: গরীবরা। সে বলল: নাবীদের অনুসারী এরূপ ব্যক্তিরাই হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী হা: ০৭) বর্তমান সমাজের দিকেও তাকালে দেখা যায়, সমাজের অধিকাংশ দুর্বল-গরীবরাই ইসলামের অনুসারী, ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলার চেষ্টা করে থাকে। আর প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের অধিকাংশই ধর্মের পরওয়া করে না এবং ধর্মপ্রাণ মু’মিন মুসলিমদেরকে অবজ্ঞা করে চলে। যেমন চরিত্র ছিল তৎকালীন মুনাফিকদের। মূলতঃ ইসলাম হল অসহায় ও অসচ্ছল লোকেদের সহায়তা প্রদানকারী, নির্যাতিতদের আশ্রয় প্রদানকারী ধর্ম। এজন্য সর্বযুগে সুবিধা বঞ্চিত লোকেরাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তাই সাহাবী বা সহজ-সরল মু’মিনদেরকে বোকা ও মানহানিকর কথা বলা ঈমানদারদের কাজ নয় রবং এটা মুনাফিকদের কাজ। এরূপ করলে ঈমান বাতিল হয়ে যাবে। السفهاء শব্দটি سفيه শব্দের বহুবচন। অর্থ হল অজ্ঞ, নির্বোধ, দুর্বল। এজন্য মহিলা ও বাচ্চাদেরকে سفيه বা অবুঝ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَلَا تُؤْتُوا السُّفَهَا۬ءَ أَمْوَالَكُمُ) “তোমরা তোমাদের সম্পদ অবুঝ ব্যক্তিদেরকে দিও না।” (সূরা নিসা ৪:৫) অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবুঝ সন্তান ও নারীদের দিও না। এখান থেকে আরো জানতে পারলাম ঈমান আনতে হবে সাহাবীরা যেভাবে ঈমান এনেছেন। তাদের ঈমান হল পরবর্তী সকল মানুষের ঈমানের মাপকাঠি। সাহাবীদের ঈমানের মাঝে কোন তরীকা, পীর-ফকির ও ভায়া-মাধ্যম ছিল না। তারা সরাসরি আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সমাজের অধিকাংশ দুর্বল, গরীব সুবিধা বঞ্চিত ব্যক্তিরাই ইসলামের অনুসারী হয়। ২. সমাজের প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা দুর্বল ও গরীব মু’মিনদেরকে অনেকভাবে উপহাস করতে পারে। তাই বলে মনক্ষুন্ন হয়ে ইসলাম থেকে সরে যাওয়া যাবে না। তৎকালীন মক্কার প্রভাব ও বিত্তশালী কাফিররাও দুর্বল সাহাবীদেরকে বিভিন্ন কথা বলে উপহাস করত, তারপরও তারা ইসলাম থেকে এক চুলও সরে যায়নি।

وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آيَةٍ مَا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ ۚ وَمَا أَنْتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ ۚ وَمَا بَعْضُهُمْ بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ ۚ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ ۙ إِنَّكَ إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ

📘 ১৪৫ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের কুফরী, অবাধ্যতা ও জেনে-শুনে সত্য ত্যাগের কথা তুলে ধরছেন। তাদের বিষয়টি এমন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তা প্রমাণ করার জন্য সকল প্রকার দলিল নিয়ে এলেও তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মেনে নেবে না। এদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اِنَّ الَّذِیْنَ حَقَّتْ عَلَیْھِمْ کَلِمَةُ رَبِّکَ لَا یُؤْمِنُوْنَﮯﺫوَلَوْ جَا۬ءَتْھُمْ کُلُّ اٰیَةٍ حَتّٰی یَرَوُا الْعَذَابَ الْاَلِیْمَ) “নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাণী সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না। যদিও তাদের নিকট সকল নিদর্শন আসে যতক্ষণ না তারা মর্র্মন্তুদ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।”(সূরা ইউনুস ১০:৯৬-৯৭) (وَمَا بَعْضُهُمْ بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ) “আর তারা পরস্পর একজন অন্যজনের কেবলার অনুসারী নয়” তারপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিষেধ করছেন তাদের কেবলার অনুকরণ করতে, কারণ তারাই তো একে অপরের কেবলা অনসুরণ করে না। ইয়াহূদীদের কেবলা হল, বায়তুল মুকাদ্দাসের পাথর (যার ওপর গম্বুজ নির্মিত আছে)। আর খ্রিস্টানদের কেবলা হল, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্বদিক। আহলে কিতাবের এ দু’টি দল যখন আপোষে একটি কেবলার ওপর ঐক্যমত হতে পারে না তাহলে তাদের কাছ থেকে কিভাবে আশা করা যায় যে, তারা মুসলিমদের সাথে একমত হবে। তাই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হুশিয়ার করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন- তুমি যদি ওয়াহী আসার পরেও তাদের অনুসরণ কর তাহলে নিশ্চয় যালিমদের মধ্যে শামিল হবে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আহলে কিতাবের অধিকাংশ লোকই জেনেশুনে কুফরী করে। ২. যারা সঠিক পথ গ্রহণ করার তাদের জন্য অল্প বুঝই যথেষ্ট। ৩. অধিকাংশ মানুষ সঠিক পথ পরিত্যাগ করলেই আমিও ত্যাগ করব এ নীতি ভ্রান্ত নীতি।

وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا ۖ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ ۚ أَيْنَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

📘 ১৪৮ নং আয়াতের তাফসীর: (وَلِکُلٍّ وِّجْھَةٌ ھُوَ مُوَلِّیْھَا...) “প্রত্যেকের জন্য এক একটি লক্ষ্যস্থল রয়েছে সেদিকেই সে মুখ ফেরায়। এর প্রথম অর্থ হল: প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের পছন্দমত কেবলা বানিয়ে নিয়েছে যে দিকে তারা মুখ করে থাকে। এর দ্বিতীয় অর্থ হল: প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পন্থা ও তরীকা বানিয়ে নিয়েছে। যেমন কুরআনে এসেছে: (لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا ط وَلَوْ شَا۬ءَ اللّٰهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَّاحِدَةً وَّلٰكِنْ لِّيَبْلُوَكُمْ فِيْ مَآ اٰتَاكُمْ) “আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি একটি নির্দিষ্ট শরীয়ত ও একটি নির্দিষ্ট পথ। আর যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের সবাইকে এক সম্প্রদায় করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যাচাই করতে চান যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার মাধ্যমে।”(সূরা মায়িদা ৫:৪৮) আবূল আলিয়া (রহঃ) বলেন: ইয়াহূদীদের কেবলা রয়েছে যেদিকে ফিরে তারা ইবাদত করে। খ্রিস্টানদের কেবলা রয়েছে যেদিকে তারা অভিমুখী হয়। কিন্তু উম্মাতে মুহাম্মাদীকে আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃত কেবলার হিদায়াত দিয়েছেন। অতএব হে উম্মাতে মুহাম্মাদী! তোমরা কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী হও। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের সাফসীর) (فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرٰتِ) ‘অতএব তোমরা কল্যাণের দিকে ধাবিত হও’অর্থাৎ সকল কল্যাণময় কাজে যেমন সালাত, যাকাত ও সদাকা ইত্যাদি কাজে দ্রুত অগ্রসর হও। তাই সালাত প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা উত্তম। হাদীসেও প্রথম ওয়াক্তে সালাত আদায় করার তাগীদ এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোন্ আমল উত্তম? জবাবে বলেন: প্রথম ওয়াক্তে সালাত আদায় করা। (সহীহ, তিরমিযী হা: ১৭০) আল্লাহ তা‘আলা সকলকে অবশ্যই কিয়ামাতের দিন একত্রিত করবেন। যদিও তোমাদের শরীর, হাড়, মাংস ইত্যাদি ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সর্ববিষয়ে সক্ষম। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. প্রত্যেক জাতির কেবলা আছে। তবে আমরা মুসলিমরা সঠিক কেবলা প্রাপ্ত হয়েছি। ২. কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সকলকে একত্রিত করবেন, অতএব তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ৩. আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। ৪. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্য নাবী, এটা ইয়াহূদীরা ভালভাবেই জানত, কিন্তু অহংকারবশত মেনে নেয়নি। ৫. প্রথম ওয়াক্তে সালাত আদায় করা উত্তম।

۞ إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ ۖ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا ۚ وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ

📘 ১৫৮ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। দু’টি সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এবং একটি মুসতাদরাক হাকিমে রয়েছে। সাহাবী উরওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি আশিয়াহ (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি লক্ষ করেছেন- (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ ............أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْراً فَإِنَّ اللّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ) আমি এ আয়াত দ্বারা বুঝেছি, যদি কেউ তাওয়াফ না করে তাহলে তার কোন দোষ নেই। তখন আয়িশাহ (রাঃ) বললেন- হে আমার ভাগনে! তুমি কতই না খারাপ কথা বললে। তুমি যা বুঝেছ সেরূপ হলে আয়াতটি এমন হত فلا جناح عليه أن لا يطاف بها (ত াওয়াফ না করলে গুনাহ হবে না), কিন্তু বিষয়টি হল, আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে আনসারদের ব্যাপারে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তারা মানাতের (মূর্তি) পূজা করত। আর মানাত ছিল কুদায়েদের পথে অবস্থিত। আনসারগণ সাফা ও মারওয়াহর মাঝে সাঈ করা খারাপ জানত। ইসলাম আগমনের পর তারা এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলে এ আয়াত নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা: ১৬৪৩, ৪৪৯৫, সহীহ মুসলিম হা: ৩১৩৮, ৩১৪২) সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম নিদর্শন। شعائر শব্দটি شعيرة এর বহুবচন, অর্থ হল: নিদর্শন, প্রতীক। এখানে নিদর্শনসমূহ বলতে হজ্জ আদায়ের সময় ইবাদতের বিভিন্ন স্থান যেমন- মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, সাঈ ও কুরবানীর স্থান বুঝায়। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা এসব নিদর্শনকে সম্মান করতে বলেছেন: (وَمَنْ يَّعَظِّمْ شَعَا۬ئِرَ اللّٰهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَي الْقُلُوبِ) “আর কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটা তো তার হৃদয়ের তাক্বওয়ার পরিচয়।”(সূরা হজ্জ ২২:৩২) সাফা ও মারওয়া হজ্জের অন্যতম রুকন। যা বাদ পড়লে হজ্জ বা উমরা হবে না। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন সৎ আমল করবে এটা তার জন্য উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতিদান দেবেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সাফা ও মারওয়া সাঈ করা হজ্জ ও উমরার রুকন। ২. গীর্জা, পূজামণ্ডপ বা কাফিরদের ইবাদাতের স্থান মাসজিদে পরিণত হলে সেথায় সালাতসহ সকল ইবাদত পালন করতে কোন অসুবিধা নেই। ৩. কল্যাণকর কাজে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَالَةَ بِالْهُدَىٰ فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

📘 ১৬ নং আয়াতের তাফসীর: পূর্বের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার পর এ আয়াতে তাদের কর্মের ফলাফল বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা ইসলামকে কাছে থেকে দেখেছে এবং ইসলামের বিষয়গুলো ভালভাবে অনুধাবন করেছে আর কুফরীতে তো পূর্ব থেকেই লিপ্ত ছিল। অতঃপর ইসলাম ও কুফর উভয়কে দেখে-বুঝেও তাদের দুনিয়ার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ইসলামের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করেছে। তাদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করে জানানো হয়েছে যে, তাদের ব্যবসায়ের কোন যোগ্যতাই নেই। তারা উত্তম ও মূল্যবান বস্তু ‘ঈমানের’পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও মূল্যহীন বস্তু ‘কুফর’ক্রয় করেছে। ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-সহ কতক সাহাবী হতে বর্ণিত যে, তারা হিদায়াতকে ছেড়ে গোমরাহীকে গ্রহণ করেছে। অন্য বর্ণনায় ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ঈমানের পরিবর্তে কুফরীকে গ্রহণ করেছে। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: ওপরে উল্লিখিত মুফাসসিরদের কথার সারাংশ হল মুনাফিকরা হিদায়াত থেকে সরে গোমরাহীর পথ বেছে নিয়েছে। এটিই হল আয়াতের প্রকৃত অর্থ।

وَإِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَٰنُ الرَّحِيمُ

📘 ১৬৩ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের উলুহিয়াত সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন। তিনি তাঁর স্বত্ত্বা, নাম, গুণাবলী ও কার্যপ্রণালীসহ সকল দিক দিয়ে একক মা‘বূদ। তার কোন অংশীদার নেই, সাদৃশ্য নেই, উপমা নেই, সমতুল্য ও সমকক্ষ কেউ নেই। রহমান ও রহীম এ দু’টি নাম সম্পর্কে সূরা ফাতিহায় আলোচনা করা হয়েছে। আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: اسْمُ اللّٰهِ الْأَعْظَمُ فِي هَاتَيْنِ الْآيَتَيْنِ< আল্লাহ তা‘আলার ‘ইসমে আজম’বা মহান নাম এ দু’টি আয়াতে: ১. (وَاِلٰھُکُمْ اِلٰھٌ وَّاحِدٌﺆ لَآ اِلٰھَ اِلَّا ھُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِیْمُ) ২. (اللّٰهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ) (আবূ দাঊদ হা: ১৪৯৮, ইবনে মাযাহ হা: ৩৮৫৫, হাসান) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র মা‘বূদ। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদত পাওয়ার হকদার নয়। ২. আল্লাহ তা‘আলার ‘রহমান ও রহীম’দু’টি নাম এবং এর দ্বারা তাঁর দয়া গুণ সাব্যস্ত হয়।

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

📘 ১৬৪ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: ইবনু আবি হাতিম, আতা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর (وَاِلٰھُکُمْ اِلٰھٌ وَّاحِدٌﺆ لَآ اِلٰھَ اِلَّا ھُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِیْمُ) এ আয়াতটি নাযিল হয়। তখন মক্কার কাফির কুরাইশগণ বলতে লাগল, কিভাবে একজন মা‘বূদ সমগ্র বিশ্বের বন্দোবস্তু করবেন? তখন (إِنَّ فِيْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল, পৃঃ ৩৪, ইবনু কাসীর, ১/৪৩২) অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা একত্ববাদের প্রমাণস্বরূপ সাতটি নিদর্শনের আলোকপাত করেছেন। যা তাওহীদে রুবুবিয়্যার ওপর প্রমাণ বহন করে। এসব নিদর্শন কেবল তারাই ঝুঝতে পারবে যারা বিবেকসম্পন্ন। এরূপ অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اِنَّ فِیْ خَلْقِ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ وَاخْتِلَافِ الَّیْلِ وَالنَّھَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ) “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টির মধ্যে এবং দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।”(সূরা আলি-ইমরান ৩:১৯০) ১ম নিদর্শন: خَلْقُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির মধ্যে লক্ষণীয় দিকসমূহ: * আল্লাহ তা‘আলা আকাশকে সৃষ্টি করেছেন খুঁটি ছাড়া- (اَللہُ الَّذِیْ رَفَعَ السَّمٰوٰتِ بِغَیْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَھَا) “আল্লাহই ঊর্ধ্বদেশে আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত- তোমরা এটা দেখছ।”(সূরা রা‘দ ১৩:২) অনুরূপ সূরা লুকমানের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে। * সাতটি আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন- (الَّذِیْ خَلَقَ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا) “তিনি সাতটি আকাশ ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে।”(সূরা মুলক ৬৭:২) * দুনিয়ার আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেছেন- (وَلَقَدْ زَیَّنَّا السَّمَا۬ئَ الدُّنْیَا بِمَصَابِیْحَ) “আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা (তারকারাজী) দ্বারা।”(সূরা মুলক ৬৭:৫) * আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী আল্লাহ তা‘আলার আদেশে স্থির থাকা- (وَمِنْ اٰیٰتِھ۪ٓ اَنْ تَقُوْمَ السَّمَا۬ئُ وَالْاَرْضُ بِاَمْرِھ۪) “আর তার দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, তারই আদেশে আসমান ও জমিন স্থির আছে।”(সূরা রুম ৩০:২৫) * আকাশকে ছাদস্বরূপ ও সুউচ্চ করেছেন- (وَالسَّمَاء بِنَاء) “আকাশকে ছাদস্বরূপ করেছেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২) (وَإِلَي السَّمَآءِ كَيْفَ رُفِعَتْ) “এবং আকাশের দিকে যে, কিভাবে ওটাকে সমুচ্চ করা হয়েছে?” (সূরা গাশিয়াহ ৮৮:১৮) * জমিনকে বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন- (الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا) “যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা স্বরূপ করেছেন।”(সূরা বাকারাহ ২:২২) * জমিনকে চলার উপযোগী করে দিয়েছেন- (ھُوَ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ الْاَرْضَ ذَلُوْلًا فَامْشُوْا فِیْ مَنَاکِبِھَا وَکُلُوْا مِنْ رِّزْقِھ۪ﺚ وَاِلَیْھِ النُّشُوْرُ) “তিনিই তো তোমাদের জন্য জমিনকে চলাচলের উপযোগী করেছেন; অতএব তোমরা ওর দিক-দিগন্তে ও রাস্তাসমূহে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া রিযিক হতে আহার কর, তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।”(সূরা মুলক ৬৭:১৫) * মৃত জমিনকে বৃষ্টি দিয়ে সফল ফলানোর উপযোগী করেছেন- (وَاٰیَةٌ لَّھُمُ الْاَرْضُ الْمَیْتَةُﺊ اَحْیَیْنٰھَا وَاَخْرَجْنَا مِنْھَا حَبًّا فَمِنْھُ یَاْکُلُوْنَﭰوَجَعَلْنَا فِیْھَا جَنّٰتٍ مِّنْ نَّخِیْلٍ وَّاَعْنَابٍ وَّفَجَّرْنَا فِیْھَا مِنَ الْعُیُوْنِﭱﺫلِیَاْکُلُوْا مِنْ ثَمَرِھ۪ﺫ وَمَا عَمِلَتْھُ اَیْدِیْھِمْﺚ اَفَلَا یَشْکُرُوْنَ) “আর তাদের জন্য একটি নিদর্শন মৃত জমিন। আমি তাকে সজীব করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, ফলে তা থেকে তারা খেয়ে থাকে। আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং প্রবাহিত করি তাতে ঝরণাসমূহ।”(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৩৩-৩৪) ২য় নিদর্শন: وَاخْتِلَافُ الَّیْلِ وَالنَّھَارِ: রাত ও দিনের আবর্তন এবং লক্ষণীয় দিকসমূহ: * আল্লাহ তা‘আলা রাতকে করেছেন আরামের জন্য, দিনকে করেছেন কাজ করার জন্য- (وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا وَّجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا) “এবং রাত্রিকে করেছি আবরণ। আর আমিই দিবসকে জীবিকা অর্জনের সময় করে দিয়েছি।”(সূরা নাবা ৭৮:১০-১১) * আল্লাহ তা‘আলার দয়া শুধু রাত বা শুধু দিনকে কিয়ামত পর্যন্ত বহাল রাখেননি- (قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللّٰهُ عَلَيْكُمُ اللَّيْلَ سَرْمَدًا إِلَي يَوْمِ الْقِيَامَةِ) “বল, ‘তোমরা ভেবে দেখছ কি, আল্লাহ যদি রাতকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন।”(সূরা কাসাস ২৮:৭১) (قُلْ اَرَءَیْتُمْ اِنْ جَعَلَ اللہُ عَلَیْکُمُ النَّھَارَ سَرْمَدًا اِلٰی یَوْمِ الْقِیٰمَةِ مَنْ اِلٰھٌ غَیْرُ اللہِ یَاْتِیْکُمْ بِلَیْلٍ تَسْکُنُوْنَ فِیْھِﺚ اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ) “বল, ‘তোমরা ভেবে দেখছ কি, আল্লাহ যদি দিনকে কিয়ামাতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ ব্যতীত এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদের জন্য রাতের আবির্ভাব ঘটাবে যাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না?” (সূরা কাসাস ২৮:৭২) ৩য় নিদর্শন: মানুষের কল্যাণে সমুদ্র নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি চলাচলের উপযোগী করা: যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَللہُ الَّذِیْ سَخَّرَ لَکُمُ الْبَحْرَ لِتَجْرِیَ الْفُلْکُ فِیْھِ بِاَمْرِھ۪) “একমাত্র আল্লাহই তো সমুদ্রকে তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে তাতে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে।”(সূরা জাসিয়া ৪৫:১২) অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (اَلَمْ تَرَ اَنَّ الْفُلْکَ تَجْرِیْ فِی الْبَحْرِ بِنِعْمَةِ اللہِ لِیُرِیَکُمْ مِّنْ اٰیٰتِھ۪) “তুমি কি দেখ না যে, নৌযাহানসমূহ আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যেন তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলীর কিছু দেখান?” (সূরা লুকমান ৩১:৩১) ৪র্থ নিদর্শন: আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَنَزَّلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً مُبَارَكًا فَأَنْبَتْنَا بِهِ جَنَّاتٍ وَحَبَّ الْحَصِيدِ) “আকাশ হতে আমি কল্যাণকর বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং তদ্দ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি।”(সূরা ক্বাফ ৫০:৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: ( اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللہَ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئًﺑ فَتُصْبِحُ الْاَرْضُ مُخْضَرَّةًﺚ اِنَّ اللہَ لَطِیْفٌ خَبِیْرٌ) “তুমি কি লক্ষ করো না যে, আল্লাহ বারি বর্ষণ করেন আকাশ হতে যাতে সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে পৃথিবী? নিশ্চয়ই আল্লাহ সম্যক সূক্ষ্মদর্শী, পরিজ্ঞাত।”(সূরা হজ্জ ২২:৬৩) আল্লাহ তা‘আলা যে বৃষ্টিপাত করেন তা পবিত্র- (وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً طَهُورًا) “আমি আকাশ হতে পবিত্র পানি বর্ষণ করি।”(সূরা ফুরকান ২৫:৪৮) ৫ম নিদর্শন: প্রত্যেক জীব-জন্তুর বিচরণ বিভিন্ন আকার আকৃতি, রং, ছোট-বড় ইত্যাদি সকল জীব-জন্তু সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অবগত আছেন, তিনি তাদের রিযিক দেন- ( وَمَا مِنْ دَا۬بَّةٍ فِی الْاَرْضِ اِلَّا عَلَی اللہِ رِزْقُھَا وَیَعْلَمُ مُسْتَقَرَّھَا وَمُسْتَوْدَعَھَاﺚ کُلٌّ فِیْ کِتٰبٍ مُّبِیْنٍ ) “ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে।”(সূরা হুদ ১১:৬) জীব-জন্তুরাও আল্লাহ তা‘আলাকে সিজদা করে- ( وَلِلہِ یَسْجُدُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَمَا فِی الْاَرْضِ مِنْ دَا۬بَّةٍ وَّالْمَلٰ۬ئِکَةُ) “আল্লাহকেই সাজদাহ্ করে যা কিছু আছে আকাশসমূহে, পৃথিবীর সমস্ত জীবজন্তু এবং ফেরেশতাগণও।”(সূরা নাহল ১৬:৪৯) ৬ষ্ঠ নিদর্শন: বায়ূরাশির গতি পরিবর্তন: বাতাস কখনো রহমতের হয়, আবার কখনো আযাবের হয়। পবিত্র কুরআনে যেসকল স্থানে বাতাস বহু বচন হিসেবে এসেছে তা রহমতের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- (وَمِنْ اٰیٰتِھ۪ٓ اَنْ یُّرْسِلَ الرِّیَاحَ مُبَشِّرٰتٍ وَّلِیُذِیْقَکُمْ مِّنْ رَّحْمَتِھ۪) “আর তার দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে একটি এই যে, তিনি বাতাস পাঠান সুখবর দানকারীরূপে এবং যেন তোমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহের স্বাদ ভোগ করান।”(সূরা রূম ৩০:৪৬) এরূপ সূরা রূমের ৪৮ নং আয়াতে উল্লেখ আছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (وَاللہُ الَّذِیْٓ اَرْسَلَ الرِّیٰحَ فَتُثِیْرُ سَحَابًا فَسُقْنٰھُ اِلٰی بَلَدٍ مَّیِّتٍ) “আর তিনিই আল্লাহ যিনি বাতাস প্রেরণ করেন, তারপর তা মেঘমালাকে পরিচালিত করে। অতঃপর আমি তা পরিচালিত করি মৃত ভূখণ্ডের দিকে।”(সূরা ফাতির ৩৫:৯) আর যখন বাতাস শব্দটি একবচন হিসেবে এসেছে তখন আযাবের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَفِیْ عَادٍ اِذْ اَرْسَلْنَا عَلَیْھِمُ الرِّیْحَ الْعَقِیْمَ) “এবং (নিদর্শন রয়েছে) ‘আদ জাতির ঘটনায়, যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম অকল্যাণকর বাতাস।”(সূরা যারিয়াত ৫১:৪১) ( کَمَثَلِ رِیْحٍ فِیْھَا صِرٌّ اَصَابَتْ حَرْثَ قَوْمٍ ظَلَمُوْٓا اَنْفُسَھُمْ ) “উদাহরণ হচ্ছে- ঐ বাতাসের সাথে যাতে রয়েছে অতি ঠাণ্ডা তা আঘাত করল এমন এক কওমের শস্যক্ষেতে যারা নিজেদের ওপর অন্যায় করেছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:১১৮) ৭ম নিদর্শন: আকাশ ও পৃথিবীমধ্যস্থ নেয়ামত মেঘমালা এবং বৃষ্টি বর্ষণ- আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللہَ یُزْجِیْ سَحَابًا ثُمَّ یُؤَلِّفُ بَیْنَھ۫ ثُمَّ یَجْعَلُھ۫ رُکَامًا فَتَرَی الْوَدْقَ یَخْرُجُ مِنْ خِلٰلِھ۪) “তুমি কি দেখ না, আল্লাহ সঞ্চালিত করেন মেঘমালাকে, তৎপর তাদেরকে একত্র করেন এবং পরে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তুমি দেখতে পাও, সেটার মধ্য হতে নির্গত হয় বারিধারা।”(সূরা নূর ২৪:৪৩) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ( حثج اِذَآ اَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالًا سُقْنٰھُ لِبَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَنْزَلْنَا بِھِ الْمَا۬ئَ ) “যখন তা ঘন মেঘ বহন করে তখন আমি তা নির্জীব ভূখণ্ডের দিকে চালনা করি, পরে তা হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি।”(সূরা আ‘রাফ ৭:৫৭) এতসব নেয়ামত দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে ধন্য করেছেন। এসব কিছু প্রমাণ করে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র জাহানের একক রব বা প্রতিপালক। তিনি সবকিছুর প্রতিপালক হবার কারণে সবকিছুর মা‘বূদও এককভাবে তিনিই। কেননা, যিনি প্রতিপালক হবেন তিনি ব্যতীত আর কেউ মা‘বূদ হতে পারে না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র মা‘বূদ, তাঁর রুবুবিয়্যাতেও কোন শরীক নেই এবং উলূহিয়্যাতেও কোন শরীক নেই। তাই আমরা সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য সম্পাদন করব অন্য কারো জন্য নয়। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সব নিদর্শন আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়াহর ওপর প্রমাণ বহন করে এবং রুবুবিয়্যাহ উলূহিয়্যাহ এর প্রমাণ বহন করে। ২. নিদর্শনাবলী দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে চেনা যায়।

۞ لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

📘 ১৭৭ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াত কেবলা সংক্রান্ত ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়েছে। একদিকে ইয়াহূদীরা নিজেদের কেবলার (বাইতুল মুকাদ্দাসের পশ্চিম দিক) অন্যদিকে খ্রিস্টানরা তাদের কেবলার (বাইতুল মুকাদ্দাসের পূর্বদিক)-কে খুব গুরুত্ব দিচ্ছিল এবং তা নিয়ে গর্বও করছিল। আর অপরদিকে মুসলিমদের কেবলার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্ন রকমের মন্তব্য করছিল। যার কারণে অনেক মুসলিমও অনেক সময় আন্তরিক দুঃখবোধ করত। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন: প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম ও পূর্ব দিকে মুখ করাটাই নেকীর কাজ নয়- যদি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ ও শরীয়ত অনুপাতে না হয়। মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করেন কে তাঁর আনুগত্য করতঃ আদেশ বাস্তবায়ন করে, তিনি যেদিকেই মুখ ফিরিয়ে সালাত আদায় করতে বলেন সেদিকেই মুখ ফিরিয়ে সালাত আদায় করে এবং তিনি যা শরীয়ত সিদ্ধ করে দেন তার একান্ত অনুগত হয়। আর এটাই হল সৎ কাজ, তাকওয়া ও পরিপূর্ণ ঈমান। তারপর আল্লাহ তা‘আলা মৌলিক আকীদা ও আমলের বর্ণনা দিয়েছেন। আর তা হলো: আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা অর্থাৎ তাঁর রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যার এককত্বে বিশ্বাস রাখা ও সেই অনুপাতে আমল করা এবং কুরআন ও সহীহ সুন্নাহয় বর্ণিত নাম ও গুণাবলীর কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃতি করা হতে মুক্ত থেকে বিশ্বাস রাখা। পরকাল তথা মৃত্যু, পুনরুত্থান, হাশর, হিসাব, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাস করা, ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার মাখলুক ও তারা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়নে সর্বদা রত বিশ্বাস রাখা। সকল আসমানী কিতাবের ওপর ঈমান আনা। নাবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য না করে সকলের প্রতি ঈমান আনা। সম্পদের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও ব্যয় করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন্ দান উত্তম? তিনি বললেন: أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَي الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَي সর্বোত্তম দান হল- তুমি সুস্থ ও মালের প্রতি আসক্ত অবস্থায় দান করবে। যখন তুমি ধনী হবার আশা কর এবং দরিদ্র হবার আশঙ্কা কর। (সহীহ বুখারী হা: ১৪১৯) ইয়াতীম হল- প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পূর্বে যার পিতা মারা গেছে। মা মারা গেলে শরীয়ত তাকে ইয়াতীম বলে না। الْبَأْسَآءِ দ্বারা দরিদ্র এবং অতিব অভাবী বুঝানো হয়েছে। الضَرآءَ দ্বারা ক্ষতি ও রোগ আর البأس দ্বারা যুদ্ধ ও তার কাঠিন্যতাকে বুঝানো হয়েছে। এ তিন অবস্থায় ধৈর্য ধরা। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার বিধানাবলীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা বড় কঠিন কাজ, তাই এ তিনটি অবস্থাকে বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. নিজে যা নেকী বা গুনাহর কাজ মনে করব তাই নেকী বা গুনাহর কাজ এমনটা নয়। বরং নেকী ও গুনাহর কাজ কোন্টি তা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে সাব্যস্ত হবে। ২. ঈমানের রুকনের পরিচয় জানতে পারলাম। ৩. সালাত ও যাকাতের গুরুত্বের বর্ণনা জানলাম। ৪. অঙ্গীকার পূরণের গুরুত্ব অপরিসীম। ৫. তাক্বওয়া হল ইবাদতের মূল।

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

📘 ১৮৫ নং আয়াতের তাফসীর: রমাযান মাসের ফযীলত বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: এ রমাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে, পূর্ণ কুরআন কোন এক রমাযান মাসে পৃথিবীতে নাযিল করা হয়েছে। বরং এর অর্থ হল রমাযান মাসের কদরের রাতে পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফুয হতে প্রথম আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইজ্জতে” অবতীর্ণ করা হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (إِنَّآ أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ) আমি একে (কুরআনকে) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা কদর ৯৭:১) অন্যত্র বলেন: (إِنَّآ أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ) আমি একে (কুরআনকে) বরকতপূর্ণ রাতে অর্থাৎ কদরের রাতে নাযিল করেছি। (সূরা দুখান ৪৪:৩) তারপর “বাইতুল ইজ্জত” থেকে ২৩ বছর নবুওয়াতী জীবনে প্রয়োজন অনুপাতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। অতএব কুরআন কোন্ মাসে অবতীর্ণ হয়েছে, কোন্ রাতে অবতীর্ণ হয়েছে তা সুস্পট হয়ে গেল। তাই যারা বলে থাকেন ১৫ই শাবান বা তাদের ভাষায় শবে বরাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং এ রাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শরীয়ত গর্হিত আচার-অনুষ্ঠান করে থাকেন তা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত ও ভিত্তিহীন। কুরআন কেন অবতীর্ণ করেছেন তার কারণ এ আয়াতের শেষাংশে বলে দিয়েছেন। সূরার শুরুতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (فَمَنْ شَھِدَ مِنْکُمُ) ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে’। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সালাতের ন্যায় সিয়ামের তিনটি পরিবর্তন হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমন করার পর প্রত্যেক মাসে তিনটি এবং আশুরার সিয়াম পালন করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম ফরয করে এ আয়াতটি (يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَام) নাযিল করেন। আল্লাহ তা‘আলা চান তোমাদের জন্য সহজ করতে, কঠিন নয়। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (هُوَ اجْتَبٰكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّيْنِ مِنْ حَرَجٍ) “তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি।” (সূরা হজ্জ ২২:৭৮) অনুরূপ হাদীসে এসেছে- إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلَّا غَلَبَهُ দীন সহজ। দীনের ব্যাপারে যে কঠোরতা করবে দীন তার ওপর কঠোরতা প্রদানে জয়ী হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৯) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. রমাযান মাস ও কুরআনের ফযীলত জানতে পারলাম। ২. যে রমাযানে সিয়াম রাখতে সক্ষম হবে না অন্য সময় তার পক্ষে কাযা আদায় করা ওয়াজিব। ৩. দীনের বিধি-বিধান সহজ। ৪. ঈদের দিন ও রাতে তাকবীর পাঠ শরীয়তসিদ্ধ। ৫. কুরআন সঠিক পথের দিক নির্দেশক ও সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। ৬. কুরআন শবে কদরের রাতে নাযিল হয়েছে, শবে বরাতে নয়।

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

📘 ১৮৬ নং আয়াতের তাফসীর: রবকতময় রমাযান মাসের বিধি-বিধান আলোচনা করার পর দু‘আ বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে, কারণ রমাযান মাসে দু‘আর অনেক ফযীলত রয়েছে। তাই এ মাসে বেশি বেশি দু‘আর প্রতি যতœবান হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, আমার বান্দারা যদি আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে তাহলে বলে দাও আমি তাদের নিকটেই রয়েছি। যখন তারা আমাকে ডাকে আমি তাদের ডাকে সাড়া দেই। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ) “আমি তার ঘাড়ের শাহ রগ অপেক্ষাও নিকটতর।”(সূরা কাফ ৫০:১৬) আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) বলেন: আমরা এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। আমরা প্রত্যেক উঁচু স্থানে ওঠার সময় এবং উপত্যকায় অবতরণের সময়ে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে যাচ্ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিকট এসে বললেন- হে জনমণ্ডলী! নিজেদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। তোমরা শ্রবণশক্তিহীন ও দূরে অবস্থানকারী কাউকে (মা‘বূদকে) ডাকছ না। তোমরা ডাকছ একজন শ্রবণকারী ও সর্বদ্রষ্টাকে। নিশ্চয় তিনি তোমাদের বাহনের স্কন্ধ অপেক্ষা নিকটে রয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৯৯২) এরূপ অনেক আয়াত ও সহীহ হাদীস রয়েছে যাতে বলা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের খুবই নিকটে রয়েছেন। কিন্তু স্ব-স্বত্ত্বায় নন বরং শ্রবণ, দর্শন, ক্ষমতা ও জ্ঞানের দিক থেকে তিনি আমাদের অতি নিকটে রয়েছেন, আর স্ব-স্বত্ত্বায় আরশের ওপর রয়েছেন। তাফসীরে সা‘দীতে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার নিকটবর্তী হওয়াটা দু’প্রকার। যথা: ১. আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান, দর্শন, শ্রবণ ও বেষ্টন করার দিক দিয়ে সকল বান্দার নিকটে রয়েছেন। ২. বান্দার দু‘আ কবূল ও সাড়া দেয়ার দিক দিয়ে নিকট রয়েছে। তাই একজন বান্দা যখন একাগ্রচিত্তে শরয়ী পন্থায় দু‘আ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার ডাকে সাড়া দেয়ার অঙ্গিকার করেছেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপর থেকেই তাঁর বান্দার অতি নিকটে। তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন ও শোনেন। ২. উচ্চৈঃস্বরে শরীয়তসিদ্ধ ইবাদত ব্যতীত অন্যান্য ইবাদত নিরবে করাই উত্তম। ৩. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যে মুক্তি নিহিত। ৪. আল্লাহ তা‘আলার কাছে অবশ্যই দু‘আ করতে হবে, তবে শরীয়তসম্মত পদ্ধতি অনুযায়ী। ৫. উক্ত হাদীস থেকে এটাও জানতে পারলাম যে, উচ্চ আওয়াজে প্রচলিত হালকায়ে যিকির করা শরীয়তসম্মত নয়।

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَائِكُمْ ۚ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ ۗ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ ۖ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ ۚ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ۚ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

📘 ১৮৭ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: বারা বিন আযেব (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের মধ্যে থেকে যদি কোন ব্যক্তি সিয়াম পালন করত আর ইফতারের সময় ইফতার না করে ঘুমিয়ে যেত তাহলে পরদিন ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হত। একদিন কায়েস বিন সিরমা (রাঃ) সিয়াম অবস্থায় সারাদিন ক্ষেত-খামারে কাজ করে সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফিরে আসেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন- খাবার কিছু আছে কি? স্ত্রী বলল, কিছুই নেই। তবে আমি যাচ্ছি এবং কোথাও হতে কিছু নিয়ে আসছি এ কথা বলে তাঁর স্ত্রী গেলে তিনি ঘুমিয়ে যান। স্ত্রী ফিরে এসে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, এখন এ রাত্রি এবং পরবর্তী সারাদিন কিভাবে কাটবে? দিনের অর্ধভাগ অতিবাহিত হলে কায়েস (রাঃ) ক্ষুধার জ্বালায় চেতনা হারিয়ে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ কথা জানানো হলে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ১৯১৫) উক্ত আয়াত অবতীর্ণ করে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের কষ্টকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেন এবং ইফতারের সময় থেকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করার অনুমতি দান করেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেন: যখন রমাযানের সওমের হুকুম অবতীর্ণ হল তখন মুসলিমরা গোটা রমাযান মাস স্ত্রীদের নিকটে যেতেন না। আর কিছু সংখ্যক লোক এ ব্যাপারে নিজেদের ওপর (স্ত্রী-সম্ভোগ করে) অবিচার করে বসে। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন, (عَلِمَ اللہُ اَنَّکُمْ کُنْتُمْ تَخْتَانُوْنَ اَنْفُسَکُمْ فَتَابَ عَلَیْکُمْ وَعَفَا عَنْکُمْﺆ) (সহীহ বুখারী হা: ৫৪০৯, সহীহ মুসলিম হা:১০৯০) اِلٰی نِسَا۬ئِکُمْ) (الرَّفَثُ এখানে الرَّفَثُ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হল স্ত্রী সহবাস করা। (مَا کَتَبَ اللہُ لَکُمْ) ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিপিবদ্ধ করেছেন’এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল সন্তান। অর্থাৎ রমযানের রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে দৈহিক মিলন করতে পারো এবং সে মিলনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যে সন্তান নির্ধারণ করে রেখেছেন তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাও। সাহাল বিন সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: (وَکُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الْخَیْطُ الْاَبْیَضُ مِنَ الْخَیْطِ الْاَسْوَدِ) আয়াতটি যখন অবতীর্ণ হয় তখন (مِنَ الْفَجْرِ) অংশটুকু অবতীর্ণ হয়নি। এমতাবস্থায় কোন ব্যক্তি যদি সিয়াম পালন করার ইচ্ছা করত তখন সাদা সুতো ও কালো সুতো তার পায়ে বেঁধে নিত। সাদা সুতো ও কালো সুতো সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত খেতেই থাকত। তখন (مِنَ الْفَجْرِ) অংশটুকু অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ১৯১৭, ৪৫১১, সহীহ মুসলিম হা: ১০৯১) সুবহে সাদেক পর্যন্ত পানাহার শেষ করে রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করতে হবে। সূর্যাস্তের মাধ্যমে রাত শুরু হয়। তাই সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসেও এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: (لَا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ) মানুষ সর্বদা কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ (সূর্যাস্তের পর) তাড়াতাড়ি ইফতার করবে। (সহীহ বুখারী হা: ১৮৫৬, সহীহ মুসলিম হা: ১০৯৮) সূর্যাস্তের পর বিলম্ব করে অন্ধকার হবার পর ইফতার করা ইয়াহূদী ও শিয়াদের বৈশিষ্ট্য, সুতরাং তা অবশ্যই বর্জনীয়। (وَاَنْتُمْ عٰکِفُوْنَﺫ فِی الْمَسٰجِدِ) ‘আর তোমরা মাসজিদে ই‘তেকাফ করা অবস্থায়’অর্থাৎ ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রী সহবাস ও তার সাথে কোন প্রকার যৌনাচার করার অনুমতি নেই। হ্যাঁ, দেখা-সাক্ষাত ও সাধারণ কথাবর্তা জায়েয। الْمَسٰجِدُ দ্বারা বুঝা যায় ইতিকাফ মাসজিদে করতে হবে। পুরুষ হোক অথবা মহিলা হোক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও মাসজিদে ইতিকাফ করতেন (সহীহ বুখারী হা: ২০৩৩)। তাই মহিলাগণও মাসজিদে ইতিকাফ করবে তবে মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. রমাযানের রাতে ফজরের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার করা ও স্ত্রী সহবাস বৈধ। ২. সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত আর বিলম্ব করে ইফতার করা ইয়াহূদীদের স্বভাব। ৩. পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য মাসজিদে ইতিকাফ বৈধ। তবে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৪. স্ত্রী সহবাসের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে সন্তান নেয়া।

وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ

📘 ১৮৮ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে মানুষের স¤পদে স্বতন্ত্র অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একজন মানুষ অন্যায়ভাবে যেমন মিথ্যা শপথ, ডাকাতি, চুরি, ঘুষ নিয়ে ও সুদ খেয়ে অন্যের সম্পদ হরণ করবে তা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে বলেন, একজন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের মান-সম্মান, রক্ত, সম্পদ সব কিছু হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮, সহীহ মুসলিম হা:১৬৭৯) হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এখানে ঐ সব ব্যক্তিদের আলোচনা করা হচ্ছে, যাদের কাছে অপরের কোন প্রাপ্য থাকে কিন্তু প্রাপকের নিকট তার প্রাপ্য অধিকারের কোন প্রমাণ থাকে না, ফলে এ দুবর্লতার সুযোগ গ্রহণ করে সে আদালতের আশ্রয় নিয়ে বিচারকের মাধ্যমে নিজের পক্ষে ফায়সালা করিয়ে নেয় এবং এভাবে সে প্রাপকের অধিকার হরণ করে। এটা জুলুম ও হারাম। আদালতের ফায়সালা জুলুম ও হারামকে বৈধ ও হালাল করে দিতে পারে না। আদালত কেবল বাহ্যিক দিক অবলোকন করে বিচার করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি একজন মানুষ। লোকজন আমার নিকট বিবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকে। স্বভাবত একজন অপরজন অপেক্ষা বেশি যুক্তিতর্কে পারদর্শী হয়ে থাকে। তার যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি হয়তো তারই পক্ষে ফায়সালা দিয়ে থাকি (অথচ প্রকৃত ঘটনা এর বিপরীত)। তবে জেনে রেখ: যে ব্যক্তির পক্ষে এরূপ ফায়সালা দেয়ার ফলে কোন মুসলিমের হক আমি তাকে দিয়ে দেই, ওটা হবে তার জন্য জাহান্নামের আগুনের টুকরা। অতএব সেটা সে গ্রহণ করবে বা ছেড়ে দেবে। (সহীহ বুখারী হা: ২৬৮০) কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: হে আদম সন্তান! জেনে রেখ, বিচারকের মীমাংসা তোমার জন্য হারামকে হালাল এবং অন্যায়কে ন্যায় করে দিতে পারে না। বিচারক সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুসারে বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিচার করে। তাছাড়া তিনি মানুষ, তার দ্বারা ভুল হওয়াও সম্ভব। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়তের তাফসীর) অতএব এরূপ ধোঁকাবাজী ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করলে এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্পদ হরণ করা হারাম। ২. বিচার-ফায়সালায় অন্যায়ভাবে রায় প্রকাশে ঘুষ দেয়া ও নেয়া উভয়ই হারাম। ৩. বিচারক অজান্তে কারো জিনিস অন্যকে দিয়ে দিলেই হালাল হয়ে যাবে না। ৪. কোন মানুষ এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও মানুষের অন্তরের খবর জানেন না। বরং প্রকৃতপক্ষে শুধু আল্লাহ তা‘আলাই সকলের অন্তরের খবর জানেন।

۞ يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ ۖ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ ۗ وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَنْ تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ ظُهُورِهَا وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَىٰ ۗ وَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

📘 ১৮৯ নং আয়াতের তাফসীর: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা জবাব শিখিয়ে দেন- বল, তা মানুষের ও হজ্জের সময় নির্ধারক। এর দ্বারা মানুষ ইবাদত, মুয়ামালাত, গর্ভধারণ ও ইদ্দত ইত্যাদির সময়সীমা নির্ধারণ করবে। (ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (لِتَعْلَمُواْ عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ) “যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসেব জানতে পার।” (সূরা ইউনুস ১০:৫) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা এ চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন সময় নির্ধারক হিসেবে। এটা দেখে সওম রাখ ও এটা দেখেই সওম ছাড়। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ দিন গণনা পূর্ণ কর। (সহীহ ইবনু খুযায়মা হা: ১৯০৭, সহীহ) “এবং এ চাঁদ হজ্জের সময় নির্ধারক।” যেমন শাওয়াল, যুলকাদা ও যুলহজ্জ এ তিনটি হজ্জের মাস যা চাঁদের ওপর নির্ভরশীল। (وَلَیْسَ الْبِرُّ بِاَنْ تَاْتُوا الْبُیُوْتَ) আয়াতের শানে নুযূল: আবূ ইসহাক (রহঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বারা (রাঃ)-কে বলতে শনেছি, এ আয়াতটি আমাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। হজ্জ করে এসে আনসারগণ তাদের বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ না করে পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন। এক আনসার ফিরে এসে তার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে তাকে এ জন্য লজ্জা দেয়া হয়। তখনই নাযিল হল: ঘরের পশ্চাৎ দিক দিয়ে তোমাদের প্রবেশ করাতে কোন কল্যাণ নেই। বরং কল্যাণ আছে যে তাক্বওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং (সামনের) দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ কর। (সহীহ বুখারী হা: ১৮০৩, মুসিলম হা: ৩০২৬) বিশিষ্ট তাবেঈ হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: জাহিলী যুগে বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ প্রথা চালু ছিল যে, যখন তারা সফরের উদ্দেশ্যে বের হত তখন যদি কোন কারণবশত সফর থেকে পূর্বনির্ধারিত সময় সংক্ষিপ্ত করে অর্ধ-সমাপ্ত অবস্থায় ছেড়ে ফিরে আসতো, তবে তারা সামনের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করত না বরং পিছনের দিক দিয়ে আসতো। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, দেয়াল টপকিয়ে আসতো। এ আয়াত তাদের এ প্রথা বাতিল করে দেয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১ম খণ্ড, ৪৮৯) তাই ভাল কাজ মনে করে বাড়ির পিছন দিক থেকে আগমন করা আসলে নেকীর কাজ নয়। বরং নেকীর কাজ হল- আল্লাহ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধ মান্য করে তাঁকে ভয় করা। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ইসলামের অনেক বিধান চান্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত। ২. ইসলামে ইবাদতের নামে বিদআত তৈরি করা হারাম। যদিও তা নিজেদের কাছে খুব পছন্দনীয় হয়। ৩. সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা-কে ভয় করলে সফলতা অর্জন সম্ভব।

الشَّهْرُ الْحَرَامُ بِالشَّهْرِ الْحَرَامِ وَالْحُرُمَاتُ قِصَاصٌ ۚ فَمَنِ اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَىٰ عَلَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ

📘 ১৯৪ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: ইবনু জারীর আত-তাবারী (রহঃ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৬ষ্ঠ হিজরীতে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা করেন। সাথে ১৪০০ সাহাবী। হুদায়বিয়া নামক স্থানে মুশরিকরা মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়। এটা ছিল জুলকাদা মাস তথা যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ মাস। আপোসে ফায়সালা হল, আগামী বছর মুসলিমরা তিন দিনের জন্য উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে। পরের বছর চুক্তি অনুযায়ী মুসলিমরা যখন জুলকাদা মাসে উমরা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন, তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর ১/২৬৮) এ আয়াতে নির্দেশ করা হচ্ছে যদি এবারও মক্কার কাফিররা এ হারাম মাসের সম্মান রক্ষা না করে গত বছরের ন্যায় তোমাদেরকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দেয়, তাহলে তোমরাও এর মর্যাদা খেয়াল না করে তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ উদ্যমে মোকাবেলা কর। সকল নিষিদ্ধ (পবিত্র) জিনিসের জন্য এরূপ কিসাস বা বিনিময়। অর্থাৎ তারা যদি নিষিদ্ধ মাসের সম্মান রক্ষা করে, তাহলে তোমরাও তার সম্মান রক্ষা কর, আর যদি সম্মান নষ্ট করে তাহলে কাফিরদেরকে উপদেশমূলক উপরোক্ত শিক্ষা দাও। (তাফসীর ইবনে কাসীর, ১/৪৯৪) তারপর সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে যেন বাড়াবাড়ি না হয় সে দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তারা যেমন সীমালঙ্ঘন করবে তোমরাও তদ্রƒপ পরিমাণ করবে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, (وَاِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوْا بِمِثْلِ مَا عُوْقِبْتُمْ بِھ۪) “যদি তোমরা শাস্তি দাও, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে।”(সূরা নাহল ১৬:১২৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (وَجَزٰٓؤُا سَیِّئَةٍ سَیِّئَةٌ مِّثْلُھَا) “মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ।” (সূরা শুআরা ৪২:৪০) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে স্বীয় প্রভুর ব্যাপারে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়ে বলেন: তিনি মুক্তাকীদের (ভয়কারীদের) সাথে (সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে) সর্বদা রয়েছেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. হারাম মাসসহ সকল পবিত্র বস্তুর সম্মান রক্ষা করা মুসলিমদের কর্তব্য। ২. শত্র“রা হামলা করলে মোকাবেলা করার জন্য হারামে যুদ্ধ করা জায়েয। ৩. যেখানে শত্র“দের সাথে সীমালঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ সেখানে মুসলিমদের সাথে সীমালঙ্ঘন করা আরো বেশি গুরুতর অপরাধ। ৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা দ্বারা সর্বদা সৎ বান্দাদের সাথে থাকেন।

وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ وَأَحْسِنُوا ۛ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

📘 ১৯৫ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: ১ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন: এ আয়াতটি ব্যয় করার ব্যাপারে নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫১৬) ২. আবূ আইয়ূব আল আনসারী (রাঃ) বলেন: এ আয়াতটি আমাদের আনসারদের ব্যাপারে নাযিল হয়। যখন ইসলামের শক্তি সামর্থ্য ও সাহায্যকারী বেড়ে গেল তখন আমাদের কতক ব্যক্তি কতক ব্যক্তির নিকট গোপনে বলতে লাগল যে, আল্লাহ তা‘আলা তো ইসলামকে সম্মানিত ও শক্তিশালী করেছেন আর ইতোপূর্বে আমাদের অনেক সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যদি আমরা আমাদের সম্পদের পরিচর্যা করে বৃদ্ধি করে নিই। তখন তাদের প্রতিবাদস্বরূপ এ আয়াত নাযিল হয়। (তিরমিযী হা: ২৯৭২, আবূ দাঊদ হা: ২৫১২, সহীহ) এছাড়া আরো দু’টি বর্ণনা পাওয়া যায় (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল, পৃঃ ৪২) (وَلَا تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَي التَّهْلُكَةِ) “এবং নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ কর না” ১. আবূ আইয়ূব আনসারী (রাঃ) বলেন: নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করার অর্থ হলো জিহাদ ছেড়ে দিয়ে পরিবার ও সম্পদের কাছে অবস্থান করা। ২. হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: এখানে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হল, কৃপণতা করা। ৩. নুমান বিন বাশির বলেন: এটা হল, ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে গুনাহ করেছে অতঃপর এ বিশ্বাস করে যে, তাকে ক্ষমা করা হবে না, তখন সে আরো বেশি বেশি গুনাহ করে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) এ আয়াত প্রমাণ করে, এমন কিছু খাওয়া ও পান করা যা নিজের শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয় তা হারাম। যেমন ধূমপান করা ও অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য ইত্যাদি। وَأَحْسِنُوْا ‘তোমরা এহসান কর’এখানে সকল প্রকার ইহসান অন্তর্ভুক্ত। কেননা এটা বিশেষ কোন বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয়নি। অতএব সম্পদের ক্ষেত্রে ইহসান, সম্মানের ক্ষেত্রে ইহসান ও শাফায়াতের ক্ষেত্রে ইহসান সবই শামিল। (তাফসীর সা‘দী, পৃঃ ৭৪) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. যথাসাধ্য ইসলামী কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা উচিত। বিশেষ করে যখন শত্র“দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলবে তখন ব্যয় করা আবশ্যক। ২. যেকোন পন্থায় নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হারাম। তার মধ্যে অন্যতম হল নেশা জাতীয় বস্তু খাওয়া বা পান করা। ৩. ইহসানের ফযীলত জানলাম।

وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ ۚ فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۖ وَلَا تَحْلِقُوا رُءُوسَكُمْ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْهَدْيُ مَحِلَّهُ ۚ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِنْ رَأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِنْ صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ ۚ فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَمَنْ تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ۚ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ ۗ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ۗ ذَٰلِكَ لِمَنْ لَمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

📘 ১৯৬ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম ও জিহাদের বিধি-বিধান আলোচনা করার পর হজ্জের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। তিনি হজ্জ ও উমরা উভয়টি পরিপূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। শানে নুযূল: সফওয়ান বিন উমাইয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি জাফরান রঙ্গে রঞ্জিত জুুব্বা পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কিভাবে উমরা করার নির্দেশ দিচ্ছেন তখন এ আয়াত নাযিল হয়: (وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلّٰهِ....) তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: উমরা সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়? তিনি বললেন, এইতো আমি। তিনি [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, তোমার পোশাক খুলে ফেল। অতঃপর গোসল করে যথাসম্ভব অপবিত্রতা পরিস্কার কর। তারপর তোমার হজ্জ সম্পাদনে যা কর উমরা সম্পদানে তাই কর। (সহীহ মুসলিম হা: ১১৮০) আবদুল্লাহ বিন ‘মাকাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা কুফার মাসজিদে কাব বিন উজরার পাশে বসেছিলাম। তাঁকে আমি (فَفِدْیَةٌ مِّنْ صِیَامٍ) এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বললেন- আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট নিয়ে যাওয়া হল তখন আমার মুখের ওপর দিয়ে উকুন বয়ে পড়ছিল। আমাকে দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন- তোমার অবস্থা এতদূর পৌঁছে যাবে আমি তা ধারণাই করতে পারিনি। তুমি কি একটি ছাগল কুরবানী দিতে সক্ষম হবে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, যাও মাথা মুণ্ডন কর এবং তিনটি রোযা রাখ অথবা ছয়জন মিসকিনকে অর্ধ সা‘ করে খাদ্য দিয়ে দাও। আয়াতটি বিশেষ করে আমার ব্যাপারে অবতীর্ণ হলেও সকলের জন্য প্রযোজ্য। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫১৭) এছাড়া অত্র আয়াত অবতীর্ণের বিষয়ে আরো বর্ণনা পাওয়া যায়। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫০৪-৫) (وَاَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلہِ) ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরা সম্পূর্ণ কর’এ আয়াত দ্বারা অনেকে বলে থাকেন হজ্জের মত উমরা করাও ফরয। তবে সঠিক কথা হলো হজ্জ ও উমরার ইহরাম বেঁধে নেয়ার পর তা পূর্ণ করা ওয়াজিব, যদিও তা (হজ্জ ও উমরা) নফল হয়। اِحْصَارٌ - এর দু’টি অর্থ: ১. ইহরাম অবস্থায় শত্র“ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। ২. অসুস্থ ও এরূপ সমস্যায় বাধাগ্রস্ত হওয়া। আল্লামা শানকীতি (রহঃ) বলেন, পূর্বকার আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, এখানে শত্র“ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া উদ্দেশ্য। তবে অধিকাংশ আলেমগণ বলেন: শত্র“ ও অসুস্থতাসহ সকল সমস্যা এখানে শামিল। আর এটাই সঠিক মত। (আযওয়াউল বায়ান ১ম খণ্ড, পৃঃ ১১৫) যদি কেউ মক্কায় গিয়ে হজ্জ বা উমরা সম্পাদন করতে শত্র“ বা অসুস্থতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে যেখানে বাধাপ্রাপ্ত হবে সেখানেই সে গরু বা ছাগল বা ভেড়া বা উট যা তার জন্য সহজ হবে তা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলের জন্য জবেহ করবে। অতঃপর ইহরামের পোশাক খুলে মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম মুক্ত হয়ে যাবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদায়বিয়ার বছর শত্র“ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে মাথা মুণ্ডন করে হালাল হয়ে ছিলেন। যদি কারো নিকট হাদী বা কুরবানীর জন্তু না থাকে তাহলে ১০ দিন রোযা রাখবে যেমন হজ্জে তামাত্তুর ক্ষেত্রে করা হয়। (حَتّٰی یَبْلُغَ الْھَدْیُ مَحِلَّھ۫) ‘কুরবানীর জন্তুগুলো যথাস্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত’অর্থাৎ যদি কেউ কোন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি স্বস্থানে কুরবানীর হাদী জবেহ না করা পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করবে না। জবেহ করে পরে মাথা মুণ্ডন করবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেমন হুদায়বিয়ার বছর করেছেন। যদি বাধাপ্রাপ্ত না হয় তাহলে মক্কা ছাড়া অন্য কোথাও জবেহ করতে পারবে না। অবশ্য তা জবেহ করতে হবে ঈদের দিন ১০ই জুলহজ্জে ও তার পরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোর কোন একদিন। (فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا) ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোগাক্রান্ত হয়’অর্থাৎ যদি কেউ ইহরাম অবস্থায় অসুস্থ হয় বা কষ্টে পতিত হয় যার কারণে মাথা মুণ্ডন করতে বাধ্য হয়। তাহলে সে মাথা মুণ্ডন করে নেবে। আর তার ফিদইয়া বা বিনিময়স্বরূপ- ১. তিন দিন সিয়াম পালন করবে অথবা ২. ছয়জন মিসকীনকে খাওয়াবে অথবা ৩. হারামের ফকিরদের জন্য ১টি ছাগল জবেহ করে দেবে। যেমন এ আয়াতের শানে নুযূলে আলোচনা করা হয়েছে। এ তিনটির যেকোন একটি আদায় করলেই চলবে। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫০৬) (فَمَنْ تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ اِلَی الْحَجِّ) ‘যে ব্যক্তি হজ্জ্বের সাথে উমরাও করতে চায়’যদি শত্র“দের বাধা বা অসুস্থতার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে হজ্জ আদায় করতে সক্ষম হয় আর হজ্জে তামাত্তু আদায় করতে চায় তাহলে যথাসাধ্য একটি পশু কুরবানী করবে। উল্লেখ্য: হজ্জ তিন প্রকার: ১. হজ্জে ইফরাদ- বল হজ্জের নিয়তে ইহরাম বাঁধা ও হজ্জ সম্পন্ন করা। ২. হজ্জে কিরান: হজ্জ ও উমরার এক সাথে নিয়ত করে ইহরাম বাঁধা ও মাঝে হালাল না হয়ে হজ্জ ও ওমরা সম্পন্ন করা। এ উভয় অবস্থায় হজ্জের কার্যাবলী সুসম্পন্ন না করে ইহরাম খোলা বৈধ নয়। ৩. হজ্জে তামাত্তু: এতেও হজ্জ ও উমরার নিয়ত করবে তবে প্রথমে উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে উমরার কাজ সম্পূর্ণ করে ইহরাম খুলে ফেলবে। তারপর ৮ই যুলহজ্জ দ্বিতীয় বার হজ্জের জন্য ইহরাম বেঁধে হজ্জ সম্পাদন করবে। তিন প্রকারের মধ্যে এটা উত্তম ও সহজ। হজ্জে কিরান ও তামাত্তুর জন্য একটি হাদী (অর্থাৎ ছাগল বা ভেড়া বা উট বা গরু) একাকী বা উট ও গরুতে অংশীদারে কুরবানী করলেই হবে। যদি কেউ কুরবানী না করতে পারে তাহলে সে হজ্জের দিনগুলোতে তিনটি এবং বাড়ি ফিরে সাতটি রোযা রাখবে। হজ্জের দিনগুলোতে যে রোযা রাখবে তা অবশ্যই ৯ই যুলহজ্জের আগে অথবা আইয়ামে তাশরীকের পরে হতে হবে। (ذٰلِکَ لِمَنْ لَّمْ یَکُنْ اَھْلُھ۫ حَاضِرِی الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ) ‘এটা তারই জন্য যে মাসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়’হজ্জে তামাত্তু কাদের জন্য এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে সঠিক কথা হল, কেবল তাদের জন্য যাদের পরিবার মাসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) সবশেষে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করার নির্দেশ দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি শাস্তি দানে কঠোর। অতএব তার বিধান পালনে যেন কোন গাফলতি প্রকাশ না পায়। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. হজ্জ ও উমরার নিয়ত করলে তা আদায় ওয়াজিব। ২. হজ্জ আদায় করতে গিয়ে বাধাগ্রস্থ হলে কী করতে হবে তা জানা গেল। ৩. হজ্জে কোন নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হলে কি কাফফারা দিতে হবে তা জানলাম। ৪. তিন প্রকার হজ্জের মধ্যে তামাত্তু উত্তম।

الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ ۚ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللَّهُ ۗ وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ ۚ وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ

📘 ১৯৭ নং আয়াতের তাফসীর: হজ্জের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস রয়েছে। তা হল শাওয়াল, যুলকা‘দাহ ও যুলহিজ্জা-এর প্রথম ১০ দিন। (এটাই সঠিক মত) (তাফসীর সা‘দী পৃঃ ৭৫) তাই এ মাসগুলোতেই হজ্জের ইহরাম বেঁধে কাজ সম্পূর্ণ করা আবশ্যক। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: কোন ব্যক্তির উচিত নয়, হজ্জের মাস ছাড়া অন্য মাসে হজ্জের ইহরাম বাঁধা। অন্য বর্ণনায় তিনি (রাঃ) বলেন, সুন্নাত হল কেবল হজ্জের মাসেই ইহরাম বাঁধা। জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কোন ব্যক্তির উচিত নয় হজ্জের মাস ছাড়া অন্য মাসে হজ্জের ইহরাম বাঁধা। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) যে ব্যক্তি ইহরাম বেঁধে নিজের ওপর হজ্জ ফরয করে নেবে তার জন্য স্ত্রী সহবাস ও অনুরূপ কাজ এবং পাপ কাজ ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া হারাম। হজ্জের ফযীলত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: مَنْ حَجَّ للّٰه فَلَمْ يَرْفُثْ ، وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে হজ্জ করল এবং স্ত্রী সহবাস ও কোন পাপ কাজ করল না সে এমনভাবে ফিরে আসল যেন তার মা আজই তাকে ভূমিষ্ট করেছে। (সহীহ বুখারী হা: ১৮১৯, সহীহ মুসলিম হা: ১৩৫০) (وَتَزَوَّدُوْا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ.... ) অংশের শানে নুযূল: ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামানবাসী হজ্জ করতে আসত কিন্তু কোন পাথেয় সাথে আনত না। তারা বলত: আমরা আল্লাহ তা‘আলার ওপর নির্ভরশীল। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ১৫২৩) এছাড়াও এ আয়াত নাযিলের কতকগুলো প্রেক্ষাপট পাওয়া যায়। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) অতএব হে মু’মিনগণ! তোমরা নামকা ওয়াস্তে ভরসা না করে সফরের পাথেয়স্বরূপ খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু সঙ্গে নাও। তবে জেনে রেখ, সর্বোত্তম পাথেয় হল তাক্বওয়া। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস ও পাপ কাজ করা সম্পূর্ণ হারাম। যদিও অন্যান্য সময় পাপ কাজ হারাম কিন্তু এ সময় আরো বেশি অপরাধ। ২. উপযুক্ত পন্থা অবলম্বন না করে শুধু আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করার নাম প্রকৃত ভরসা নয়। বরং যে কোন কাজের যথাযথ বৈধ ব্যবস্থা গ্রহণ করত আল্লাহ তা‘আলার ওপর নির্ভর করার নাম ভরসা।

لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ ۚ فَإِذَا أَفَضْتُمْ مِنْ عَرَفَاتٍ فَاذْكُرُوا اللَّهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ۖ وَاذْكُرُوهُ كَمَا هَدَاكُمْ وَإِنْ كُنْتُمْ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الضَّالِّينَ

📘 ১৯৮ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলী যুগে উকায, মুজিন্না এবং যুল-মাজায নামে বাজার ছিল। (ইসলাম গ্রহণের পর হজ্জের সময়) এসব বাজারে ব্যবসা করা সাহাবীগণ পাপের কাজ মনে করল। ফলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তারা জিজ্ঞাসা করল। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫১৯) এছাড়াও এ আয়াতের কয়েকটি শানে নুযূল পাওয়া যায়। এটি সবচয়ে বেশি সহীহ। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫২০) আয়াতে فضل ‘অনুগ্রহ’অর্থ ব্যবসায় বাণিজ্য। যেমন সূরা জুমু‘আর ১০ নং আয়াতে এসেছে। হজ্জের মওসুমে ব্যবসা-বাণিজ্য করা বৈধ। তবে অবশ্যই যেন শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে হজ্জে গমন করা না হয়। বরং এটা হল অতিরিক্ত কাজ। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা হজ্জের অন্যতম একটি রুকনের কথা তুলে ধরেছেন। তা হল ৯ই যুলহজ্জ সূর্যাস্তের পর হাজীগণ আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করে মুযদালিফায় চলে আসবে এবং তথায় তাসবীহ তাহলীল ও দু‘আ করবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আরাফায় অবস্থানই হল মূল হজ্জ। যে ব্যক্তি ফজর হবার পূর্বেই আরাফায় অবস্থান পেল সে হজ্জ পেল। (সহীহ ইবুন খুযাইমা হা: ২৮২২, তিরমিযী হা: ৮৮৯, সহীহ) আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত হবে কিন্তু মাগরিবের সালাত পড়া যাবে না, বরং মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিবের তিন রাকাত ও এশার দু‘ রাকাত (কসর) এক সাথে এক আযানে ও দু’ইকামাতে পড়বে। মুযদালিফাকে ‘মাশআরে হারাম’বলা হয়। কেননা এটা হারামের অন্তর্ভুক্ত। এখানে হাজীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার যিকিরের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। ফজরের সালাত অন্ধকার থাকতেই অর্থাৎ প্রথম ওয়াক্তে আদায় করে যিকিরে ব্যস্ত থাকবে, অতঃপর ফর্সা হলে সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনা অভিমুখে যাত্রা করবে। হাজীগণ আরাফার দিন রোযা রাখবে না, যারা হজ্জ করতে যাবে না তারা রোযা রাখবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আরাফার দিন রোযা রাখলে আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের ও পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম হা: ১১৬২) অন্য হাদীসে এসেছে: সর্বোত্তম দু‘আ আরাফার দু‘আ, আর সর্বোত্তম কথা আমি যা বলেছি ও আমার পূর্বের নাবীরা যা বলেছেন: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللّٰهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰي كُلِّ شَئءٍ قَدِيرٌ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই, তাঁরই জন্য রাজত্ব, তাঁর জন্য সকল প্রশংসা এবং তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সহীহ মুসলিম হা: ১১৬২) অতএব আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ কর যেমন তিনি তোমাদের স্মরণ করতে বলেছেন। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মুযদালিফায় অবস্থান/রাত্রিযাপন ওয়াজিব। ২. হজ্জ আদায়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাতের প্রতি খেয়াল রাখা আবশ্যক। ৩. আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও যিকিরের মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করা উচিত। ৪. হজ্জ করতে গিয়ে ব্যবসা করা বৈধ তবে শুধু ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যেই যাওয়া যাবেনা।

ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ

📘 ২ নং আয়াতের তাফসীর : ذٰلِكَ - ‘ঐ’শব্দটি প্রকৃত অর্থে দূরের কোন কিছুকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হচ্ছে ‘ঐ’আবার কখনো নিকটবর্তী বস্তুর জন্যও ব্যবহৃত হয়। তখন এর অর্থ হবে ‘এই’। এ আয়াতে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)। ইবনু জুরাইজ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে ذٰلِكَ শব্দটি هٰذَا (এই) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবি ভাষায় এ দু’টি শব্দ অনেক সময় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হয়ে থাকে। কারণ আরবরা এতদুভয়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য করেন না। ইমাম বুখারী (রহঃ)ও আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে। ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য: ذٰلِكَ-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুফাসসিরদের বিভিন্ন অভিমত থাকলেও সঠিক কথা হল এখানে ذٰلِكَ দ্বারা উদ্দেশ্য: কুরআনুল কারীম যা আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিল করেছেন। (আইসারুত তাফাসীর, জাযায়েরী) كِتَابُ ‘গ্রন্থ’দ্বারা এখানে কুরআন মাজীদকে বুঝানো হয়েছে। যারা এর দ্বারা তাওরাত ও ইঞ্জিলকে উদ্দেশ্য করেছেন তাদের মতটি সঠিক নয়। (لَا رَيْبَ فِيْهِ) ‘কোনরূপ সন্দেহ নেই’অর্থাৎ এতে কোন সংশয়-সন্দেহ নেই। এখানে رَيْبَ শব্দটি সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَإِنْ كُنْتُمْ فِيْ رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلٰي عَبْدِنَا فَأْتُوْا بِسُوْرَةٍ مِّنْ مِثْلِه۪) “এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমরা যদি সন্দিহান হও, তবে তার সমতুল্য একটি ‘সূরা’তৈরি করে নিয়ে এসো।”(সূরা বাকারাহ ২:২৩) এ শব্দটি আবার কখনো কখনো অপবাদ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন আরবি কবি জামীল বলেন: بثينة قالت ياجميل أربتني فقلت كلا نا يابثينة مريب ‘অর্থাৎ বুসাইনা বলল, হে জামীল! তুমি আমাকে অপবাদ দিয়েছ? আমি বললাম: হে বুসাইনা! আমরা উভয়েই উভয়ের অপবাদ দানকারী। আয়াতে সন্দেহ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে; এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অনুরূপ এ কিতাবে আলোচিত বিষয়সমূহ শতভাগ নিশ্চিত সত্য, এতেও কোন সন্দেহ করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর মধ্যে কুরআন ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থ নেই যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যে, এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই (هُدًي لِّلْمُتَّقِيْنَ) ‘মুত্তাক্বীদের জন্য হিদায়াত’অর্থাৎ এ কুরআন মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরুদের জন্য হিদায়াত দানকারী। যারা কাফির-মুশরিক তাদেরকে হিদায়াত দানকারী নয়। এমনটিই আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে বলেছেন, যেহেতু মুত্তাকীরাই প্রকৃতপক্ষে কুরআনের মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (قُلْ ھُوَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ھُدًی وَّشِفَا۬ئٌﺚ وَالَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ فِیْٓ اٰذَانِھِمْ وَقْرٌ وَّھُوَ عَلَیْھِمْ عَمًیﺚ) “বলঃ মু’মিনদের জন্য এটা পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার; কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্য অন্ধত্ব।”(সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৪৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا ھُوَ شِفَا۬ئٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ) “আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমতস্বরূপ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৮২) এখানে হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- الهدي الخاص (বিশেষ হিদায়াত) অর্থাৎ দীন ইসলামের দিকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করা, এটা শুধু মু’মিনদের জন্য। তবে الهدي العام (সাধারণ হিদায়াত), যার উদ্দেশ্য হলো সত্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়া, তাতে মু’মিন ও কাফির তথা সকল মানুষ শামিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيْٓ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًي لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰي وَالْفُرْقَانِ) “রমযান তো সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক এবং হিদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী)।”(সূরা বাকারাহ ২:১৫৮) (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) সুতরাং যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে হিদায়াত গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত ও গবেষণা করবে আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তারাই হিদায়াত পাবে। অন্যথায় কেউ কুরআন তেলাওয়াত করে মুখস্ত ও গবেষণা করে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে কিন্তু হিদায়াত পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশে কুরআন নাযিল করেছেন তা গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. কুরআনুল কারীম সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহের ঊর্ধ্বে। ২. কুরআন শব্দ ও অর্থ উভয় দিক দিয়েই আল্লাহ তা‘আলার কালাম। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে আবার তাঁর কাছেই ফিরে যাবে। ৩. কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম গাইড ও জীবন বিধান। ৪. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিন-মুত্তাকীরা উপকৃত হয় বলে মুত্তাকীদের হিদায়াত দানকারী বলা হয়েছে। মূলত কুরআন সকলের জন্য পথ প্রদর্শক। মুত্তাকীদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য পরবর্তী তিনটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

۞ وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ ۚ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِي يَوْمَيْنِ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَأَخَّرَ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ لِمَنِ اتَّقَىٰ ۗ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

📘 ২০৩ নং আয়াতের তাফসীর: এখানে হজ্জের আরেকটি রুকন বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন- নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন অর্থাৎ আইয়ামে তাশরীক ১১, ১২, ১৩ই যুলহজ্জ তাসবীহ ও তাকবীর পাঠ করে আল্লাহ তা‘আলা-কে স্মরণ কর। যদি কেউ ১২ই যুলহজ্জ মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ করার পর সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা থেকে বের হয়ে যেতে চায় তাহলে তার কোন গুনাহ হবে না। আর যদি বিলম্ব করতঃ ১৩ তারিখে কঙ্কর মারে তাহলেও অপরাধ হবে না। আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলোতে উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর পড়া সুন্নাত। কেবল ফরয সালাতের পরই পড়া হবে তা নয়। বরং সব সময় এ তাকবীর “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ” পড়া বাঞ্ছণীয়। কঙ্কর নিক্ষেপের সময় “আল্লাহু আকবার” বলা সুন্নাত। (নায়নুল আওতার ৫/৪৬) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. দীন সহজ। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে এমন কিছু চাপিয়ে দেননি যা পালন করা সাধ্যাতীত। ২. মিনায় রাত যাপন ওয়াজিব। ৩. সকলকে আল্লাহ তা‘আলার কাছেই ফিরে যেতে হবে।

كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ ۚ وَمَا اخْتَلَفَ فِيهِ إِلَّا الَّذِينَ أُوتُوهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ۖ فَهَدَى اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ ۗ وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

📘 ২১৩ নং আয়াতের তাফসীর: ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: আদম ও নূহ (আঃ)-এর মাঝে পার্থক্য দশ শতাব্দি। এ সময়ের সকল মানুষ হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারপর তারা মতানৈক্য করল, তখন আল্লাহ তা‘আলা সুসংবাদ ও ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসেবে নাবী রাসূল প্রেরণ করেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) (كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَّاحِدَةً) “মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল” অর্থাৎ সবাই তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল- যে তাওহীদের দাওয়াত আদম (আঃ) দিয়েছিলেন। মুসলিম উম্মাহ যতদিন পর্যন্ত এ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল ততদিন তাদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়নি। যখন তাওহীদ থেকে সরে গেল তখন তাদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হল। (فَهَدَي اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا) “আল্লাহ ঈমানদারদের সৎ পথের হিদায়াত দিলেন” অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাবধারীরা যে-সকল বিষয়ে মতভেদ করেছে আল্লাহ তা‘আলা সে-সকল বিষয়ে মু’মিনদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। যেমন: জুমুআর দিনের ব্যাপারে আহলে কিতাবরা মতভেদ করেছে। ইয়াহূদীরা শনিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে গ্রহণ করেছে, আর খ্রিস্টানরা রবিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমরা দুনিয়াতে আগমনের দিক দিয়ে সর্বশেষ, কিন্তু কিয়ামতের দিন ফায়সালার দিক দিয়ে সর্বপ্রথম এবং আমরাই সর্বপ্রথম জা‎ন্নাতে প্রবেশ করব। যদিও অন্যান্য উম্মাতকে আমাদের পূর্বেই কিতাব দেয়া হয়েছে আর আমাদেরকে দেয়া হয়েছে পরে। সত্যের ব্যাপারে তারা যে মতভেদ করেছে আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সে ব্যাপারে হিদায়াত দান করেছেন, তারা এ দিনের (জুমুআবার) ব্যাপারে মতভেদ করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এ দিনের সঠিক নির্দেশনা দান করেছেন। সুতরাং মানুষ আমাদের অনুসারী। (সহীহ বুখারী হা: ৮৭৬) তারা ঈসা (আঃ)-এর ব্যাপারে বিরোধিতা করল। ইয়াহূদীরা তাঁকে মিথ্যা জানল এবং (অবৈধ সন্তান বলে) তাঁর মাতা মারইয়াম (আঃ)-এর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিল। এদিকে খ্রিস্টানরা ইয়াহূদীদের বিপরীত করল। তারা (ঈসাকে) আল্লাহ তা‘আলার পুত্র বানিয়ে নিল। মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে তাঁর (ঈসার) ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান দান করলেন। তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর একজন অনুগত বান্দা ছিলেন। ইবরাহীম (আঃ)-এর ব্যাপারেও মতভেদ করেছে, একদল তাঁকে ইয়াহূদী বলে; অপর দল তাকে খ্রিস্টান বলে। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে সঠিক জ্ঞান দান করে বলে দিলেন তিনি ইয়াহূদী ছিলেন না এবং খ্রিস্টানও ছিলেন না বরং তিনি একজন একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। মূলতঃ হিদায়াত কোন দল বা গোষ্ঠির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং হিদায়াত দানকারী হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা। তাই সঠিক পথ পাওয়ার জন্য কেবল আল্লাহ তা‘আলার কাছেই প্রার্থনা করতে হবে। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মানুষ মতভেদে লিপ্ত হবার আগে সবাই তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ২. আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জাতিকে সঠিক পথের দিশা দান করেছেন।

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ ۖ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّهِ ۗ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ

📘 ২১৪ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থের আলোকে বুঝা যায় যে, মদীনায় হিজরত করার পর মুসলিমরা যখন ইয়াহূদী, মুনাফিক এবং আরবের মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পীড়া ও কষ্ট পেতে লাগল, তখন কোন কোন মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অভিযোগ করল। তাই মুসলিমদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। খাব্বাব ইবনু আরাত্ত (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এমন এক সময় অভিযোগ করলাম যখন তিনি কাবা ঘরের ছায়ায় চাদরকে বালিশ বানিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম: আমাদের জন্য কি সাহায্য প্রার্থনা করবেন না, আমাদের জন্য কি দু‘আ করবেন না? তিনি বললেন: তোমাদের পূর্বেকার ঈমানদার লোকেদের ধরে এনে জমিনে গর্ত করে তাতে পুঁতে দেয়া হত। অতঃপর তাদের মাথা বরাবর করাত চালিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হত। লোহার চিরুনী দিয়ে শরীরের গোশত হাড় থেকে পৃথক করা হত। কিন্তু এ নির্মম অত্যাচারও তাদেরকে তাদের দীন থেকে বিরত করতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলার কসম এ দীন পূর্ণরূপে বিজয়ী হবে। এমন একদিন আসবে যখন কোন ভ্রমণকারী নির্বিঘেœ সানআ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সে কাউকে ভয় করবে না। আর মেষপালের জন্য বাঘের ভয় বাকি থাকবে। কিন্তু তোমরা খুব তাড়াহুড়ো করছ। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯৪৩) ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী “এমনকি যখন রাসূলগণ নিরাশ হয়ে পড়ল এবং ভাবতে লাগল যে, তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে”(সূরা ইউসুফ ১২:১১০)। তখন ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতসহ সূরা বাকারার আয়াতের শরণাপন্ন হন ও তেলাওয়াত করেন। যেমন: ‘এমনকি রাসূল এবং তার সঙ্গে ঈমান আনয়নকারীগণ বলে উঠেছিল, কখন আসবে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য? হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য নিকটেই।’(সহীহ বুখারী হা: ৪৫২৪) রাবী বলেন, এরপর আমি উরওয়াহ ইবনু যুবাইয়ের এর সঙ্গে সাক্ষাত করে তাকে এ সম্পর্কে জানালে তিনি বলেন যে, আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি, আল্লাহ তা‘আলার কসম! আল্লাহ তা‘আলা তাঁরপর রাসূলের নিকট যেসব অঙ্গীকার করেছেন, তিনি জানতেন যে, তা তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই বাস্তবে পরিণত হবে। কিন্তু রাসূলগণের প্রতি সমূহ বিপদাপদ আসতে থাকবে। এমনকি তারা (মু’মিনরা) আশঙ্কা করবে যে, সঙ্গী-সাথীরা তাঁদেরকে (রাসূলদেরকে) মিথ্যুক সাব্যস্ত করবে। এ প্রসঙ্গে আয়িশাহ (রাঃ) এ আয়াত পাঠ করতেন- (وَظَنُّوا أَنَّهُمْ قَدْ كُذِّبُوا) “ভাবল যে, তারা তাদেরকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করবে।”আয়িশাহ (রাঃ) كُذِّبُوا ‘যাল’হরফটি তাশদীদযুক্ত পড়তেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫২৫) আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জান্নাতে দেবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَمْ حَسِبْتُمْ اَنْ تُتْرَکُوْا وَلَمَّا یَعْلَمِ اللہُ الَّذِیْنَ جٰھَدُوْا مِنْکُمْ وَلَمْ یَتَّخِذُوْا مِنْ دُوْنِ اللہِ وَلَا رَسُوْلِھ۪ وَلَا الْمُؤْمِنِیْنَ وَلِیْجَةًﺚ وَاللہُ خَبِیْرٌۭ بِمَا تَعْمَلُوْنَ) “তোমরা কি মনে করো যে, তোমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে যে পর্যন্ত আল্লাহ প্রকাশ না করেন তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ এবং কারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ ব্যতীত অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নেয়? তোমরা যা করো, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।”(সূরা তাওবাহ ৯:১৬) আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّٰهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ) “তোমরা কি ধারণা করছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ যারা জিহাদ করে তোমাদের মধ্য হতে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ অবগত হবেন না? ও ধৈর্যশীলদের তিনি জানবেন না?” (সূরা আলি-ইমরান ৩:১৪২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ) “মানুষ কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি- এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে?” (সূরা আনকাবুত ২৯:২) তাই যে যত বেশি ঈমানদার তার পরীক্ষাও তত বেশি কঠিন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: أَشَدُّ النَّاسِ بَلَاءً الْأَنْبِيَاءُ মানুষের মাঝে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয় নাবীগণ। (সহীহ বুখারী ৫৬৪৮ নং হাদীসের বাব) নাবী-রাসূলগণ সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন কারণ সবচেয়ে বেশি ঈমানদার তাঁরাই। সুতরাং এত সহজেই জান্নাতে যাওয়া যাবেনা। জান্নাত একটি অতি মূল্যবান স্থান; তা পেতে হলে অনেক বালা-মসিবত, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে, বহু পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এসব পরীক্ষায় যারা সফল হবে তারাই জান্নাতের আশা করতে পারে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের বিভিন্ন বালা-মসিবত দ্বারা পরীক্ষা করেন যাতে দুনিয়াতেই গুনাহ মোচন করে সহজেই জান্নাতে যেতে পারে। ২. দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলে যারা আরো বেশি কষ্টে আছে তাদের কথা স্মরণ করা দরকার। ৩. সৎ ব্যক্তিদেরকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা দরকার। ৪. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে বালা মুসিবতে-সঙ্কটে সহযোগিতা করেন।

يَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ ۖ قُلْ مَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ خَيْرٍ فَلِلْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ ۗ وَمَا تَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ

📘 ২১৫ আয়াতের আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে।

كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

📘 ২১৬ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা জিহাদ ফরয করেছেন। ইমাম জুহুরী (রহঃ) বলেন: প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর জিহাদ ফরয। সে যুদ্ধ করুক বা বসে থাকুক। যে বসে থাকে তার কাছে যখন সাহায্য চাওয়া হয় তখন সাহায্য করবে, যখন সকলের সাথে ময়দানে বের হতে বলা হয়, তখন বের হবে আর বের হওয়ার যদি প্রয়োজন না থাকে তাহলে বসেই থাকবে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُو، وَلَمْ يُحَدِّثْ نَفْسهُ بِالْغَزْوِ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً যে ব্যক্তি মারা গেল কিন্তু যুদ্ধ করল না এবং যুদ্ধ করার বাসনাও মনে রাখল না সে জাহিলী যুগের মৃত্যু পেল। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯১০) জিহাদ ফরয হওয়া সত্ত্বেও অপছন্দীয়। কারণ, তাতে কষ্ট ও জীবননাশ রয়েছে। কিন্তু এতে রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: (فَاِنْ کَرِھْتُمُوْھُنَّ فَعَسٰٓی اَنْ تَکْرَھُوْا شَیْئًا وَّیَجْعَلَ اللہُ فِیْھِ خَیْرًا کَثِیْرًا) “কেননা হতে পারে তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করছ অথচ আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।”। (সূরা নিসা ৪:১২) অনেক কল্যাণ হল- শত্র“দের ওপর জয় লাভ, দেশ বিজয়, গনীমত লাভসহ আরো অনেক কিছু। আর অনেক বস্তু পছন্দ কর তা হয়তো তোমাদের জন্য খারাপ। যেমন জিহাদে না গিয়ে ঘরে বসে থাকা, এর ফলে তোমাদের ওপর শত্র“রা জয়যুক্ত হবে এবং তোমাদেরকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন কোনটি কল্যাণকর আর কোনটি অকল্যাণকর। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের বিধান বহাল থাকবে। ২. অজ্ঞতার কারণে মানুষ খারাপকে পছন্দ আর ভালকে অপছন্দ করে। ৩. আল্লাহ তা‘আলার সকল নির্দেশেই রয়েছে কল্যাণ। আর সকল নিষেধাজ্ঞাপূর্ণ কাজে রয়েছে অকল্যাণ।

۞ يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ ۖ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا ۗ وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ

📘 ২১৯ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: যখন মদ হারাম হওয়া প্রসঙ্গে আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন উমার (রাঃ) বললেন: হে আল্লাহ! মদের ব্যাপারে আমাদেরকে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিন। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তারপর উমার (রাঃ)-কে ডেকে আনা হয় এবং এ আয়াতটি পাঠ করে শোনান হয়। উমার (রাঃ) পুনরায় বললেন, হে আল্লাহ! মদের ব্যাপারে আমাদেরকে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিন। তখন সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। সালাতের সময় হলে মুয়াযযিন বলে দিত কেউ যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে সালাতে না আসে। উমার (রাঃ)-কে ডেকে আনা হল। তাঁর কাছে সূরা নিসার উক্ত আয়াত পাঠ করা হল। তখন তিনি পুনরায় সে কথাই বললেন। তখন সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। তারপর উমার (রাঃ)-কে ডেকে আনা হল এবং এ আয়াতটি পাঠ করা হল, এমনকি আয়াতের শেষাংশ “তোমরা কি বিরত থাকলে” এ পর্যন্ত পঠিত হল তখন উমার (রাঃ) বললেন: বিরত থাকলাম। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৭০, তিরমিযী হা: ৩০৪৯, সহীহ) শানে নুযূল থেকে বুঝা যায় মদ পর্যায়ক্রমে তিনবারে হারাম হয়েছে। শেষবারে সম্পূর্ণ হারাম হয়েছে সূরা মায়িদার ৯০ নং আয়াত দ্বারা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَیْسِرُ وَالْاَنْصَابُ وَالْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْھُ لَعَلَّکُمْ تُفْلِحُوْنَ) “হে মু’মিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর- যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৯০) (وَإِثْمُهُمَآ أَكْبَرُ مِنْ نَّفْعِهِمَا) ‘এ দু’টির মধ্যে বড় গুনাহ রয়েছে আর তা মানুষের জন্য কিছুটা উপকারী’অর্থাৎ মদপান শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মহাপাপ। যেহেতু এর ফলে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, গালি-গালাজ ও অশ্লীলতা সৃষ্টি হয়। ইবাদত পালনে বাধা সৃষ্টি হয়, অর্থের অপচয় ঘটে এবং বিদ্বেষ, দারিদ্র ও লাঞ্ছনার আগমন ঘটে। আর উপকারিতার সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে। যেমন মদপানে সাময়িকভাবে শরীরিক স্ফূর্তি-আনন্দ উদ্যম ও কারো কারো মস্তিষ্কে তেজস্ক্রিয়তাও আসে, যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে, বিক্রয় করে অনেক অর্থ উপার্জন করা যায়। এ ছাড়াও আরো কিছু উপকার রয়েছে। কিন্তু এ উপকার ক্ষতির তুলনায় অতি নগণ্য। যেহেতু এ আয়াত দ্বারা সর্বপ্রথম মদ হারাম হবার প্রক্রিয়া শুরু হয় তাই প্রথমেই সম্পূর্ণভাবে হারাম করা হয়নি। ফলে ভাল-মন্দ উভয়ের অবকাশ থাকে। সর্বশেষ সূরা মায়েদার ৯০ নং আয়াত দ্বারা মদ সম্পূর্ণভাবে হারাম হয়েছে। মদ নির্দিষ্ট কোন পানীয় বা নেশার নাম নয়, বরং প্রত্যেক ঐ বস্তু বা পানীয় যা জ্ঞানকে বিকৃত করে তাই মদ। তা কম হোক বা বেশি হোক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যা বেশি (খেলে বা পান করলে) নেশাগ্রস্থ হয় তার কমও হারাম। (আবূ দাঊদ হা: ৩৬৮১, তিরমিযী হা: ১৮৬৫, হাসান সহীহ) (مَاذَا یُنْفِقُوْنَ) ‘কী ব্যয় করবে?’অর্থাৎ তারা কী পরিমাণ ব্যয় করবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? বল: اَلْعَفْوُ এর অর্থ হল- প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তা ব্যয় কর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কী তার তাফসীর হাদীসে এসেছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সর্বোত্তম ব্যয় হলো যা সচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করা হয়। (সহীহ বুখারী হা: ১৪২৬) তবে এ ব্যয় নিকটাত্মীয়গণ পাওয়ার বেশি হকদার। যেমন হাদীসে এসেছে: এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে একটি দিনার আছে (আমি কোথায় ব্যয় করব)? তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমার নিজের জন্য ব্যয় কর। সে ব্যক্তি বলল: আরেকটি আছে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমার পরিবারের জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল: আমার কাছে আরেকটি আছে? তিনি বললেন: তোমার সন্তানের জন্য ব্যয় কর। লোকটি বলল: আমার কাছে আরেকটি দিনার আছে? তিনি বললেন: তুমি ভাল জান কোথায় ব্যয় করা প্রয়োজন। (আবু দাঊদ হা: ১৬৯১, হাসান) এভাবে আল্লাহ তা‘আলা বিধি-বিধান বিশদভাবে বর্ণনা করেন। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মদ, জুয়া এসব হারাম। এগুলো শয়তানের কাজ। ২. সচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করা উত্তম, এটাই হল প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ৩. শরীয়তের বিধান ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হবার হেকমত জানলাম।

فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۗ وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْيَتَامَىٰ ۖ قُلْ إِصْلَاحٌ لَهُمْ خَيْرٌ ۖ وَإِنْ تُخَالِطُوهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ الْمُفْسِدَ مِنَ الْمُصْلِحِ ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَعْنَتَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

📘 ২২০ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: সাহাবী ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন সূরা আনআমের ১৫২ ও সূরা নিসার ১০ নং আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ হয় তখন যারা ইয়াতিমের দায়িত্বশীল ছিল তারা ইয়াতীমদের খাবার পানীয় সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে দেয়। তখন ঐ ইয়াতীমদের রান্না করা খাবার বেঁচে গেলে অন্য সময় তাদেরকেই খেতে হত নয়তো নষ্ট হয়ে যেত। ফলে একদিকে যেমন ইয়াতীমদের ক্ষতি হত অন্যদিকে ইয়াতিমের দায়িত্বশীলদের সমস্যা হত। তাই তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বিষয়টি তুলে ধরল, তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আবূ দাঊদ হা: ২৮৭১, নাসাঈ হা: ৩৬৭১, হাসান, ইবনু কাসীর ১/৫৫৭) সমাজে ইয়াতীম বলতে সাধারণত তাদেরকে বুঝানো হয়ে থাকে যাদের পিতা-মাতা বা পিতা মারা গেছে, তারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গেলেও। মূলত ইয়াতীম বলা হয়- যে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের পিতা মারা গেছে। প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সে আর ইয়াতীম থাকবে না। ইয়াতীমদের প্রতিপালন একদিকে যেমন গুরুত্বের দাবীদার অন্যদিকে রয়েছে বিশেষ ফযীলত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি ও ইয়াতিমের দায়িত্ব বহনকারী ব্যক্তি জান্নাতে এরকম পাশাপাশি থাকব, এ কথা বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল উঁচু করে দেখালেন এবং একটু পার্থক্য করলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৩০৪) এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ইয়াদিমের দায়িত্বশীলরা তাদের সম্পদের সাথে ইয়াতীমদের সম্পদ মিশ্রণ করতে লাগল এবং কোন সংকোচ না রেখে আপন গতিতে জীবন-যাপন করতে লাগল। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তোমাদের ওপর কঠিন ও সঙ্কীর্ণতা আরোপ করতে পারতেন অর্থাৎ সংমিশ্রণ করার অনুমতি দিতেন না। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ইয়াতীমদের সম্পদ নিজের সম্পদের সাথে মিশ্রণ করা জায়েয আছে। তবে অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। ২. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন- এ গুণের প্রমাণ পেলাম।

وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّىٰ يُؤْمِنَّ ۚ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ ۗ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّىٰ يُؤْمِنُوا ۚ وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ ۗ أُولَٰئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ ۖ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ ۖ وَيُبَيِّنُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ

📘 ২২১ নং আয়াতের তাফসীর: এ আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য মুশরিক নারীদেরকে বিবাহ করা হারাম করে দিয়েছেন। এ আয়াতে সকল মুশরিক নারী শামিল। সে আহলে কিতাবের হোক বা মূর্তি পূজারী হোক। অন্য আয়াতে আহলে কিতাবের নারীদের বিবাহ করার বৈধতা দেয়া হয়েছে তবে শর্ত হল তাদের দীনের ওপর বহাল থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَالْمُحْصَنٰتُ مِنَ الْمُؤْمِنٰتِ وَالْمُحْصَنٰتُ مِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ مِنْ قَبْلِکُمْ اِذَآ اٰتَیْتُمُوْھُنَّ اُجُوْرَھُنَّ مُحْصِنِیْنَ غَیْرَ مُسٰفِحِیْنَ) “এবং মু’মিন সচ্চরিত্রা নারী ও তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হল যদি তোমরা বিবাহের জন্য তাদের মোহর প্রদান কর।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৫) অবশ্য উমার (রাঃ) সৎ উদ্দেশ্যেও আহলে কিতাব মহিলাদেরকে বিবাহ করা অপছন্দ করতেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৫৮) ইবনু উমার (রাঃ) আহলে কিতাব নারীদের বিবাহ করা অপছন্দ করতেন। কারণ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন: ইবনু উমার (রাঃ) বলেন: যারা বলে ঈসা (আঃ) হলেন আল্লাহ তা‘আলা- এর চেয়ে বড় কোন শির্ক আছে কিনা আমি জানি না। (সহীহ বুখারী হা: ৫২৮৫) মূলতঃ তাদেরকে বিবাহ না করাই ভাল। কারণ এতে সংসারে সমস্যা সৃষ্টি হবে ও সন্তান-সন্ততির সমস্যা হবে। সর্বপরি দীনের সমস্যা হবে। অনুরূপভাবে কোন মু’মিনা মহিলা কোন মুশরিক পুরুষকে বিবাহ করবে না ঈমান না আনা পর্যন্ত। মুশরিক মহিলাদেরকে বিবাহ করার চেয়ে বা মুশরিক পুরুষদেরকে বিবাহ করার চেয়ে মু’মিন দাস-দাসীদের বিবাহ করা উত্তম। যদিও মুশরিক মহিলা বা পুরুষের সম্পদ সৌন্দর্য তোমাদেরকে আকৃষ্ট করে এবং মু’মিন দাস-দাসী গরীব বা কদাকার হওয়ায় বাহ্যিক অপছন্দের হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মহিলাদেরকে সাধারণত তাদের সম্পদ, সৌন্দর্য, বংশ ও দীনদারীত্ব দেখে বিবাহ করা হয়। তোমরা দীনদার মহিলাদের বিবাহের জন্য নিবার্চন কর। (সহীহ বুখারী হা: ৫০৯০, সহীহ মুসলিম হা: ১৪৬৬) মূলত: দীনদারিত্বকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, কারণ দীন না থাকলে দাম্পত্য জীবন শান্তিময় হওয়া খুবই কঠিন। (وَلَا تُنْكِحُوا) ‘তোমরা বিবাহ দেবে না’এ অংশ প্রমাণ করে ওলী ছাড়া বিবাহ হবে না। হাদীসেও বিবাহের ক্ষেত্রে ওলীর ওপর খুব গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে: যে মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করল তার বিবাহ বাতিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একথা তিনবার বললেন। (সহীহুল জামে হা: ২৭০৯) অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে: যে মহিলা নিজেকে নিজেই বিবাহ দেয় সে ব্যভিচারিণী। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪২১) অতএব অভিভাকের অনুমতি ছাড়া মেয়েদের বিবাহ শুদ্ধ হবে না। মুশরিক পুরুষ-মহিলা সবাই জাহান্নামের দিকে ডাকে। আর আল্লাহ তা‘আলা তিনি জান্নাত ও ক্ষমার দিকে ডাকেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মুশরিক মহিলাদেরকে মু’মিন পুরুষের বিবাহ করা কিংবা মুশরিক পুরুষদের সাথে মু’মিনা নারীদের বিবাহ দেয়া হারাম। ২. মহিলাগণ অভিভাবক ছাড়া বিবাহ করতে পারবে না। ৩. মুশরিকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক বা ওঠাবসা থেকে বেঁচে থাকা উচিত। ৪. বিবাহের ক্ষেত্রে নারীদের দীনদারীত্বকে প্রাধান্য দেয়া উচিত।

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ ۚ وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَنْ يَكْتُمْنَ مَا خَلَقَ اللَّهُ فِي أَرْحَامِهِنَّ إِنْ كُنَّ يُؤْمِنَّ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَٰلِكَ إِنْ أَرَادُوا إِصْلَاحًا ۚ وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

📘 ২২৮ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের বংশধারা সংরক্ষণের জন্য একটি সুন্দর বিধান দিয়েছেন। আর তা হল- যদি কোন স্ত্রীকে তার স্বামী তালাক দেয় তাহলে সে তিন তুহুর বা তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, এর মাঝে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ বসবে না। যাতে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, তার গর্ভে কোন সন্তান আছে কিনা? কেননা যদি যাচাই-বাছাই না করে দ্বিতীয় স্বামীর সাথে বিবাহ বসে এমতাবস্থায় পূর্ব স্বামীর সন্তান তার গর্ভে, তাহলে সন্তান জন্ম নিল দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে অথচ সন্তান প্রথম স্বামীর। এতে মানুষের বংশনামায় সমস্যা সৃষ্টি হবে। সন্তান হল পূর্ব স্বামীর আর পিতা বলে ডাকবে মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে যেন এমনটি না হয়, এ জন্য তিন ঋতু অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। قروء শব্দ দ্বারা দু’টি অর্থ নেয়া হয়েছে: ১. ঋতু। অতএব তিন ঋতু অতিক্রম না হলে অন্যত্র বিবাহ বৈধ হবে না। এটা ইমাম আবূ হানিফার মত। ২. তুহুর বা ঋতু পরবর্তী পবিত্রতার সময়। এটা অন্যান্য ইমামদের মত। প্রথমটাই বেশি সঠিক। তবে দু’টি মতই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। (وَلَا يَحِلُّ لَهُنَّ أَنْ يَكْتُمْنَ) এ থেকে মাসিক ও গর্ভ উভয়টাই উদ্দেশ্য। মাসিক গোপন করার অর্থ হল তালাকের পর স্ত্রী বলবে, আমার একবার বা দু’বার মাসিক হয়েছে। আসলে তার তিন মাসিক পার হয়ে গেছে। এরূপ বলার কারণ হল, প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা। আর যদি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকে তাহলে বলবে, আমার তিন মাসিক চলে গেছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এ রকম হয়নি যাতে স্বামী ফিরিয়ে নিতে না পারে। অনুরূপভাবে গর্ভে যা আছে তা গোপন করা বৈধ নয়। কারণ এতে বংশের সংমিশ্রণ ঘটে যায়। (وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ) “তবে তাদের স্বামীরা ঐ সময়ের মধ্যে (ইদ্দতের মধ্যে) তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অধিক হকদার” অর্থাৎ স্বামীর ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্য যদি সংকীর্ণতা সৃষ্টি করা না হয়, তাহলে তার ফিরিয়ে নেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। স্ত্রীর অভিভাবকদের ঐ অধিকারে অন্তরায় সৃষ্টি করার অনুমতি নেই। (وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ) “মহিলাদের জন্যও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমন তাদের ওপর পুরুষদের অধিকার রয়েছে” অর্থাৎ উভয়ের অধিকারগুলো একে অপরের মতই। আর এগুলো আদায় করার ব্যাপারে উভয়েই শরীয়ত কর্তৃক বাধ্য। তবে মহিলাদের ওপর পুরুষের বেশি মর্যাদা রয়েছে। যেমন গঠনশক্তি, জিহাদের অনুমতি, দ্বিগুণ ওয়ারিস, অভিভাবকত্ব ও নেতৃত্ব এবং তালাক দেয়া ও ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার ইত্যাদির ব্যাপারে।

وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمْسِكُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ أَوْ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعْرُوفٍ ۚ وَلَا تُمْسِكُوهُنَّ ضِرَارًا لِتَعْتَدُوا ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ ۚ وَلَا تَتَّخِذُوا آيَاتِ اللَّهِ هُزُوًا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

📘 ২৩১ নং আয়াতের তাফসীর: (الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ) আয়াতে বলা হয়েছিল দু’বার তালাক দেয়ার পরেও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে। কেউ স্ত্রীকে দু’বার তালাক দিয়ে থাকলে এখন সে স্ত্রীকে ইদ্দত শেষের পূর্বে ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নেবে অথবা তৃতীয় তালাক দিয়ে বিদায় করে দেবে। তবে সাবধান স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার জন্য ফিরিয়ে নেবে না। যে ব্যক্তি এরূপ করে সে নিজের ওপর জুলুম করল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আয়াতকে ঠাট্টার পাত্র হিসেবে মনে করতে নিষেধ করেছেন। ঠাট্টা করে কেউ বলল, আমি স্ত্রী তালাক দিলাম বা বিবাহ করলাম বা ফিরিয়ে নিলাম। আর বলল, আমি ঠাট্টা করেছি, মহান আল্লাহ তা‘আলা এটাকে তাঁর আয়াতের সাথে ঠাট্টা বলে গণ্য করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ثَلاَثٌ جِدُّهُنَّ جِدٌّ وَهَزْلُهُنَّ جِدٌّ النِّكَاحُ وَالطَّلاَقُ وَالرَّجْعَةُ তিনটি কাজ সঠিক করে করলেও সঠিক এবং উপহাস করে করলেও সঠিক হয়। তালাক, বিবাহ এবং তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয়া। (আবূ দাঊদ হা: ১৯০৪, হাসান) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর ফিরিয়ে নেয়া হারাম। ২. শরঈ বিধান নিয়ে ঠাট্টা করা হারাম। ৩. প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা আবশ্যক।

وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنْكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ ۗ ذَٰلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۗ ذَٰلِكُمْ أَزْكَىٰ لَكُمْ وَأَطْهَرُ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

📘 ২৩২ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: মা‘কাল বিন ইয়াসার (রাঃ) বলেন: আমার নিকট আমার বোনের বিয়ের প্রস্তাব আসলে আমি বিবাহ দিয়ে দেই। তার স্বামী কিছুদিন পর তাকে তালাক দেয়। ইদ্দত অতিক্রান্ত হবার পরও সে তাকে ফিরিয়ে নেয়নি। পরে একে অপরের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আমার বোনকে সে স্বামী একজন প্রস্তাবকারী দ্বারা প্রস্তাব দেয়। তিনি (মা‘কাল) তখন তাকে বললেন: হে লোক! তোমার সাথে আমার বোনকে বিবাহ দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করেছিলাম। কিন্তু তুমি তালাক দিয়েছ। আল্লাহ তা‘আলার শপথ কখনো আমার বোন তোমার কাছে ফিরে যাবে না। তোমার কাছে যতদিন ছিল তাই শেষ। বর্ণনাকারী বলেন: আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, তারা একজন অন্যজনের প্রতি মুখাপেক্ষী। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। মা‘কাল এ আয়াত শুনে বলল, আমি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। অতঃপর তার ভগ্নিপতিকে ডেকে এনে পুনরায় তার সাথে বিবাহ দেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫১৩০) অত্র আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা মহিলার ব্যাপারে তৃতীয় আরেকটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে- তা হল ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তারা (প্রথম বা দ্বিতীয় তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রী) উভয়ই সন্তুষ্টচিত্তে পুনরায় যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় তাহলে তোমরা অভিভাবক হয়ে তাদেরকে বাধা দিও না। যেহেতু অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হয় না, তাই মহান আল্লাহ তা‘আলা অভিভাবকদেরকে তাদের অভিভাবকত্বের অধিকারকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস দ্বারা এ কথার আরো সমর্থন পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لاَ نِكَاحَ إِلاَّ بِوَلِيٍّ অভিভাবক ছাড়া বিবাহ হয় না। (আবূ দাঊদ হা: ২০৮৭, সহীহ) যারা আল্লাহ তা‘আলা ও পরকাল দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তাদের জন্য এটা উপদেশ। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা অবগত করেছেন যে, তালাক প্রাপ্তা নারীদেরকে তাদের স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বাধা না দেয়া তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে তার পূর্ব স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বাধা দেয়া নিষেধ। ২. অভিভাবক ছাড়া মহিলাদের বিবাহ বৈধ নয়। ৩. উপদেশ ঈমানদারদের উপকারে আসে।

۞ وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ ۖ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ ۚ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوْلُودٌ لَهُ بِوَلَدِهِ ۚ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَٰلِكَ ۗ فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَنْ تَرَاضٍ مِنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا ۗ وَإِنْ أَرَدْتُمْ أَنْ تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُمْ مَا آتَيْتُمْ بِالْمَعْرُوفِ ۗ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

📘 ২৩৩ নং আয়াতের তাফসীর: তালাকের বিধি-বিধান আলোচনার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা শিশুদের দুধপানের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে এসেছেন। কারণ অনেক সময় গর্ভবতী মহিলাকে তালাক দেয়া হয়। গর্ভবর্তী মহিলা তালাক প্রাপ্তা হলে প্রসবের পর বাচ্চার দায়-দায়িত্ব ও দুধপানের বিধান কী হবে, এখানে সে সম্পর্কে আলোচনা স্থান পেয়েছে। দুধ পান করার সর্বোচ্চ সময়সীমা দু’বছর। এর কম পান করালেও চলবে। তবে তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যতদিন দুধ পান করাবে ততদিন বাচ্চার পিতা ভালভাবে মহিলার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (لِیُنْفِقْ ذُوْ سَعَةٍ مِّنْ سَعَتِھ۪ﺚ وَمَنْ قُدِرَ عَلَیْھِ رِزْقُھ۫ فَلْیُنْفِقْ مِمَّآ اٰتٰٿھُ اللہُﺚ لَا یُکَلِّفُ اللہُ نَفْسًا اِلَّا مَآ اٰتٰٿھَاﺚ سَیَجْعَلُ اللہُ بَعْدَ عُسْرٍ یُّسْرًا)ا “সামর্থ্যবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা হতে ব্যয় করবে। আল্লাহ যাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন তদপেক্ষা অতিরিক্ত বোঝা তিনি তার ওপর চাপান না। আল্লাহ কষ্টের পর সহজ করে দেবেন।” (সূরা তালাক ৬৫:৭) (وَلَا مَوْلُوْدٌ لَّھ۫) ‘মাউলূদ লাহু’বলতে বাচ্চার পিতাকে বুঝানো হয়েছে। অতঃপর বলা হচ্ছে- পিতা-মাতা কাউকে সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। অর্থাৎ মাতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কষ্ট দেয়া। যেমন মা শিশুকে নিজের কাছে রাখতে চায় কিন্তু মায়ের মমতার কোন পরওয়া না করে শিশুকে জোর করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অথবা তার কোন ব্যয়ভার বহন না করে তাকে দুধ পান করাতে বাধ্য করা। আর পিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কষ্ট দেয়া যেমন মা দুধ পান করাতে অস্বীকার করা কিংবা (শিশুর পিতার) কাছ থেকে সাধ্যের বাইরে খরচ চাওয়া। যদি শিশুর পিতা মারা যায় তাহলে মায়ের অধিকার সঠিকভাবে আদায় করবে যাতে মায়ের কোন কষ্ট না হয় এবং শিশুর লালন-পালনেও যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে। আর যদি শিশুর মাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন মহিলা দ্বারা দুধ পান করানোর প্রয়োজন হয় তাহলে শরীয়তের অনুমতি রয়েছে। তবে শর্ত হল, মহিলাকে যথাযথ পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো আবশ্যক। ২. দুধ পান করানোর সর্বোচ্চ সময় অবগত হলাম। ৩. দুধ পান করার ফলে পারিশ্রমিক গ্রহণ জায়েয। ৪. তালাকপ্রাপ্তা মহিলা দুধ পান করালে তার ব্যয়ভার গ্রহণ করা শিশুর পিতার ওপর ওয়াজিব। ৫. দু’বছর পর দুধ পান করলে হারাম সাব্যস্ত হবে না।

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا ۖ فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

📘 ২৩৪ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে বিধবা নারীর ইদ্দত পালনের বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। একজন নারীর স্বামী মারা গেলে সে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে। এ চার মাস দশ দিন কোনরূপ সাজ-সজ্জা করা বা বাড়ি থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। তবে বিধবা নারী যদি গর্ভবতী হয় তাহলে সে প্রসব পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَأُوْلَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَن يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ) “গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব প্রর্যন্ত।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) এ চার মাস দশ দিন পর সাজ-সজ্জা করলে ও বাড়ির বাইরে গেলে এবং শরীয়তসম্মত পন্থায় বিয়ে করলে কোন অপরাধ নেই। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. বিধবা নারীর ইদ্দত চার মাস দশ দিন। ২. ইদ্দতকালীন সকল প্রকার সৌন্দর্য্য গ্রহণ ও বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। ৩. ইদ্দত পালনকারিণী মহিলাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হারাম।

وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُمْ بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنْتُمْ فِي أَنْفُسِكُمْ ۚ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَٰكِنْ لَا تُوَاعِدُوهُنَّ سِرًّا إِلَّا أَنْ تَقُولُوا قَوْلًا مَعْرُوفًا ۚ وَلَا تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّىٰ يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنْفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ

📘 ২৩৫ নং আয়াতের তাফসীর: এ আয়াতে বিধবা নারী বা তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীর বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এমন নারীদেরকে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে বিবাহের পয়গাম দেয়া যাবে। যেমন এরূপ বলা যে, আমার বিয়ে করার প্রয়োজন, আমি একজন সৎ নারী খুঁজছি, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে ইত্যাদি। তবে তার নিকট থেকে গোপনে কোন অঙ্গীকার নেবে না এবং ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পূর্বে বিয়ে সম্পন্ন করবে না। আর মহিলা যদি এক তালাক বা দু’তালাকপ্রাপ্তা হয় তাহলে তাকে ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে ইঙ্গিত দিয়ে বিয়ের পয়গাম দেয়া হারাম। কারণ এখনো সে প্রথম স্বামীর অধীনে আছে। জেনে রাখুন! আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের খবর জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَرَبُّكَ يَعْلَمُ مَا تُكِنُّ صُدُورُهُمْ وَمَا يُعْلِنُونَ) “আর তোমার প্রতিপালক জানেন এদের অন্তর যা গোপন করে এবং এরা যা প্রকাশ করে।”(সূরা কাসাস ২৮:৬৯) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ইদ্দত পালনকারিণীকে ইশারা ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া জায়েয। ২. ইদ্দত পালনকালীন বিবাহ সম্পন্ন করা হারাম। ৩. মানুষ মুখে প্রকাশ করুক আর না-ই করুক আল্লাহ তা‘আলা সব জানেন।

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِزْقًا ۙ قَالُوا هَٰذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِنْ قَبْلُ ۖ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا ۖ وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ ۖ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

📘 ২৫ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে কাফির ও ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি ও লাঞ্ছনার বর্ণনা দেয়ার পর এখানে মু’মিন ও সৎ লোকেদের প্রতিদান ও সম্মানের বর্ণনা দিচ্ছেন। কুরআনকে مثاني (মাসানী) নামকরণের এটাও একটি উল্লেখযোগ্য মত যে, এতে প্রত্যেক বিষয় জোড়া জোড়া উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ঈমানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে কুফরের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মু’মিনদের ভাল পরিণামের সাথে সাথে কাফির মুশরিকদের অশুভ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর: ১/১৬১) আবার কুরআনের প্রত্যেক স্থানে ঈমানের সাথে সাথে সৎ কর্ম তথা নেক আমলের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিস্কার করে দিয়েছেন যে, ঈমান এবং নেক আমল পরস্পর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেক আমল ব্যতীত ঈমান ফলপ্রসূ নয় এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ঈমান ছাড়া নেক আমলের কোন গুরুত্ব নেই। আর নেক আমল তখনই নেক আমল বলে গণ্য হবে যখন তা সুন্নাত মোতাবেক হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে করা হবে। সুন্নাত পরিপন্থী আমল গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপ খ্যাতি লাভ ও লোক দেখানোর জন্য কৃত আমলও প্রত্যাখ্যাত। তাই যারা ঈমানের সাথে সুন্নাত মোতাবেক আমল করবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। অত্র নদীসমূহের প্রকার উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (فِیْھَآ اَنْھٰرٌ مِّنْ مَّا۬ئٍ غَیْرِ اٰسِنٍﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ لَّبَنٍ لَّمْ یَتَغَیَّرْ طَعْمُھ۫ﺆ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشّٰرِبِیْنَﹰ وَاَنْھٰرٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّی) “যার মধ্যে বহমান থাকবে পরিস্কার পানির নহর, এমন দুধের নহর যার স্বাদ কখনও পরিবর্তন হয় না, এমন শরাবের নহর যারা পান করে তাদের জন্য সুস্বাদু এবং এমন মধুর নহর যা খাঁটি ও স্বচ্ছ।”(সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৫) জান্নাতের তলদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার বৃক্ষরাজী ও অট্টালিকার নিম্নদেশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়া। (ইবনু কাসির, তাফসীর অত্র আয়াত) অন্য হাদীসে এসেছে ‘‘হাওজে কাউসার”-এর দু’ধারে খাঁটি মুক্তার গম্বুজ থাকবে। তার মাটি হচ্ছে খাঁটি মৃগনাভী, তার কুচি পাথরগুলো হচ্ছে মণি-মুক্তা ও অতি মূল্যবান পাথর। (সহীহ বুখারী; কিতাবুত তাফসীর হা:৪৯৬৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৬২, ৪০০) (كُلَّمَا رُزِقُوْا مِنْهَا مِنْ ثَمَرَةٍ رِّزْقًا) ‘যখনই তা হতে তাদেরকে রিযিক হিসেবে ফলসমূহ প্রদান করা হবে’অর্থাৎ যখনই জান্নাতিদেরকে জান্নাত হতে জীবিকাস্বরূপ ফলমূল প্রদান করা হবে তখনই তারা বলবে- এটা তো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দুনিয়াতেও দেয়া হয়েছে। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য যে উদ্যান তৈরি করে রেখেছেন যখন তার গাছপালা থেকে তাদেরকে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে- এগুলো তো দুনিয়াতেও আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, জান্নাতবাসীদের এ কথা “ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছিল” এর অর্থ হচ্ছে যখনই তাদেরকে জান্নাতে ফলমূল প্রদান করা হবে তখন তারা বলবে, এগুলো তো দুনিয়ায় আমাদেরকে দেয়া হয়েছে (বর্ণনাটি হাসান)। (তাফসীর তবারী: ১/২৩৮-৯) ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, অন্যরা বলেছেন এর ব্যাখ্যা হল, জান্নাতীরা বলবে- ফলগুলো ইতোপূর্বে আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। একথা তাদের বলার কারণ হল তারা জান্নাতের ফলগুলো দুনিয়ার ফলের সদৃশ দেখতে পাবে। (তাফসীর তবারী: ১/২৮৯) যেমন ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: জান্নাতে যা কিছু আছে তা দুনিয়ার সাথে কেবল নামে সদৃশ। কারণ জান্নাতের নেয়ামতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে: (এমন নেয়ামত যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তার সঠিক ধারণার উদয় হয়নি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৭৯, ৪৭৮০) ইমাম আওযায়ী (রহঃ) ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর থেকে বর্ণনা করেন যে, জান্নাতীর কাছে এক পেয়ালা ভর্তি সরবত নিয়ে আসা হবে, সে তা খাবে। আরেক পেয়ালা ভর্তি নিয়ে আসা হলে সে বলবে এটা তো এখন পান করলাম। ফেরেশতারা বলবে, পান করতে থাকুন। কেননা এর রং অভিন্ন এবং স্বাদ ভিন্ন। তিনি আরো বলেন- জান্নাতের ঘাস হবে জাফরান, আর পাহাড়গুলো হবে মেশকে আম্বার। ছোট ছোট সুন্দর বালক ফলমূল নিয়ে জান্নাতিদের কাছে আসবে আর তারা খাবে। আবার নিয়ে আসবে তখন জান্নাতীরা বলবে এখনই তো খেলাম। তখন বালকরা বলবে- খেতে থাকুন, এর রং অভিন্ন কিন্তু স্বাদ ভিন্ন। (وَلَهُمْ فِيْهَآ أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ) “সেখানে তাদের জন্য থাকবে পুতঃপবিত্র সঙ্গিণী”জান্নাতীরা জান্নাতে যা কিছু পাবে তার অন্যতম হল পবিত্রা স্ত্রী। অন্যত্র জান্নাতী স্ত্রীদের গুণাবলী বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوْتُ وَالْمَرْجَانُ) ‏) “তারা (জান্নাতী স্ত্রীগণ) যেন হীরা ও মতি।”(সূরা রহমান ৫৫:৫৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (وَحُورٌ عِينٌ - كَأَمْثَالِ اللُّؤْلُؤِ الْمَكْنُون) “আর (তাদের জন্য থাকবে) সুন্দর আনতনয়না হূর, সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ, ” (সূরা ওয়াকিয়া ৫৬:২২-২৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا) “আরও আছে সমবয়স্কা, পূর্ণ যৌবনা তরুণী।” (সূরা নাবা ৭৮:৩৩) এছাড়াও অনেক আয়াত রয়েছে যাতে জান্নাতী নারীগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) এ জান্নাতী স্ত্রীগণ চরিত্রগত, গঠনগত, ভাষাগত ও সৃষ্টিগতভাবে সকল দিক দিয়ে পুতঃপবিত্র। চরিত্রগত পবিত্র হল- তারা হবে পূর্ণযৌবনা-কুমারী, স্বামী সোহাগিণী, উত্তম আচরণকারিণী ও স্বামীর পূর্ণ আনুগত্যশীলা। গঠনগত পবিত্র হল- মাসিক, নিফাস, বীর্য, প্রশ্রাব-পায়খানা, থুথু, নাকের ময়লা ও দুর্গন্ধ থেকে পবিত্র। পূর্ণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, তাদের কোন ত্র“টি ও কদর্যতা থাকবে না। ভাষাগত পবিত্র হল- তারা কোন কটুবাক্য বলবে না। সৃষ্টিগত পবিত্র হল- তারা হবে টানাটানা চোখবিশিষ্ট আনতনয়না, তারা স্বামী ছাড়া অন্য কারো দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাবে না। (وَّهُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ) ‘সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে।’অর্থাৎ জান্নাতীরা জান্নাতে চিরকাল থাকবে, কোন দিন সেখান থেকে বের হবে না। হাদীসে এসেছে: জান্নাতীরা জান্নাতে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাবার পর একজন ফেরেশতা ঘোষণা দেবে, হে জাহান্নামীরা! আর মৃত্যু নেই। হে জান্নাতীরা! আর মৃত্যু নেই। যারা যে অবস্থায় আছ, সব সময় ঐ অবস্থাতেই থাকবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫০) অত্র আয়াতে ৪টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে- ১. সুসংবাদ দাতা- তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে উম্মাতের ব্যক্তিবর্গ। ২. সুসংবাদ প্রাপ্ত- তারা হল সৎ আমলকারী মু’মিনগণ। ৩. যে জিনিসের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে তা হল নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত। ৪. এ সুসংবাদ পাওয়ার মাধ্যম- তা হল ঈমান ও সৎ আমল। (তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৩) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ঈমান ও আমল অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ঈমানের সাথে আমল অবশ্যই থাকতে হবে। ২. যারা ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত। ৩. জান্নাতী স্ত্রী ও খাদ্যের বৈশিষ্ট্য অবগত হলাম।

۞ تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۘ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ ۖ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ ۚ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ۗ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَٰكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُمْ مَنْ آمَنَ وَمِنْهُمْ مَنْ كَفَرَ ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ

📘 ২৫৩ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা কতক রাসূলকে কতক রাসূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সকল রাসূল মর্যাদার দিক দিয়ে সমান নয়। যেমন মূসা (আঃ)-এর সাথে সরাসরি কথা বলে ‘কালিমুল্লাহ’র মর্যাদা দিয়েছেন, অন্য কোন রাসূলের সাথে এরূপ সরাসরি কথা বলেননি। ঈসা (আঃ)-কে জিবরীল দ্বারা সহযোগিতা করেছেন এবং পিতা ছাড়া শুধু মায়ের মাধ্যমে দুনিয়াতে প্রেরণ করে ‘রূহুল্লাহ’র মর্যাদা দিয়েছেন, অন্য কোন রাসূল পিতা ছাড়া জন্ম লাভ করেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِیّ۪نَ عَلٰی بَعْضٍ وَّاٰتَیْنَا دَاو۫دَ زَبُوْرًا) “আমি নাবীগণের কতককে কতকের ওপর মর্যাদা দিয়েছি; দাঊদকে আমি যাবূর দিয়েছি।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৫৫) নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সকল নাবীর শেষ নাবী এবং সারা জাহানের জন্য প্রেরণ করে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন, অন্য কোন নাবীকে সারা জাহানের জন্য প্রেরণ করেননি। এছাড়াও তাঁকে অনেক দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: فُضِّلْتُ عَلَي الْأَنْبِيَاءِ بِسِتٍّ: أُعْطِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ، وَنُصِرْتُ بِالرُّعْبِ، وَأُحِلَّتْ لِيَ الْغَنَائِمُ ، وَجُعِلَتْ لِيَ الْأَرْضُ طَهُورًا وَمَسْجِدًا، وَأُرْسِلْتُ إِلَي الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ ‘আমাকে ছয়টি জিনিস দ্বারা অন্যান্য নাবীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে। ১. আমাকে অল্প কথায় অনেক কিছু প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করা হয়েছে। ২. শত্র“রা আমাকে ভয় করবে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়েছে। ৩. আমার জন্য গনীমত হালাল করা হয়েছে। ৪. সমস্ত জমিনকে আমার জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম ও সিজদার স্থানস্বরূপ করে দেয়া হয়েছে। ৫. আমি সকল সৃষ্টির জন্য রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি। ৬. আমার দ্বারা নবুওয়াত সমাপ্ত হয়েছে।’(সহীহ মুসলিম হা: ৫২৩) আল্লাহ তা‘আলা কতক রাসূলকে কতক রাসূলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কোন নাবী বা রাসূলকে অন্য কোন নির্দিষ্ট নাবী বা রাসূলের ওপর প্রাধান্য দিয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবেনা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: لَا يَنْبَغِي لِعَبْدٍ أَنْ يَقُولَ إِنَّهُ خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّي কোন ব্যক্তির উচিত নয় এ কথা বলা যে, আমি ইউনুস বিন মাত্তা (আঃ) থেকে উত্তম। (সহীহ বুখারী হা: ২৩৯৬) অন্য বর্ণনায় রয়েছে: তোমরা আমাকে মূসা (আঃ)-এর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিওনা। (সহীহ বুখারী হা: ২৪১১) অতএব আমরা বিশ্বাস করব কতক রাসূল কতকজনের ওপর শ্রেষ্ঠ কিন্তু কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করব না। (وَلَوْ شَآءَ اللّٰهُ مَا اقْتَتَلُوْا) ‘আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হত না’অর্থাৎ রাসূলগের মর্যাদায় তারতম্য থাকলেও সকলের দীন ছিল একটিই, তাদের দাওয়াত ছিল এক আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের দিকে। কিন্তু বিভিন্ন জাতির লোকেরা পরস্পরে মতনৈক্যের কারণে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। কেউ ঈমান এনেছে আবার কেউ কুফরী করেছে। এমনকি এ কারণে তাদের মাঝে মারামারি সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে তাদেরকে সঠিক পথে রাখতে পারতেন, তাদের মাঝে মতনৈক্য সৃষ্টি হতো না। তাদের ঝগড়া-বিবাদ, মতভেদ এসব কিছু আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে পূর্ব নির্ধারণ করা তাকদীরের আলোকে। অর্থাৎ তারা কী করবে এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা জানতেন, সে জ্ঞানানুযায়ী তাদের তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। অতএব তারা সে তাকদীর অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় সব কিছু করে থাকে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মর্যাদার ক্ষেত্রে রাসূলগণের মধ্যে তারতম্য রয়েছে, সকলের মর্যাদা সমান নয়। ২. রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনার ক্ষেত্রে কোন তারতম্য করা যাবে না। ৩. “আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেন” এ গুণ প্রমাণিত হল। ৪. “আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন” এ গুণ প্রমাণিত হল। ৫. দীনের মাঝে মতানৈক্য করা নিন্দনীয়। ৬. মানুষ যা কিছু করবে আল্লাহ তা‘আলা তা পূর্ব থেকে জানেন, সে জ্ঞানানুযায়ী মানুষের ভাল-মন্দ তাকদীর লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সে অনুযায়ী মানুষ আমল করে থাকে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ ۗ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

📘 ২৫৪ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের আহ্বান করে তিনি যে রিযিক দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করার কথা বলেছেন সেদিন আসার আগেই যেদিন কোন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও কোন সুপারিশ করার সুযোগ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَاَنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰکُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَکُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْلَآ اَخَّرْتَنِیْٓ اِلٰٓی اَجَلٍ قَرِیْبٍﺫ فَاَصَّدَّقَ وَاَکُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ) “আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা হতে ব্যয় করবে তোমাদের কারো মৃত্যু আসার পূর্বে; (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে,) হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য কেন অবকাশ দাও না, দিলে আমি সদাকাহ করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।”(সূরা মুনাফিকুন ৬৩:১০) তাই জীবদ্দশায় আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় যথাসাধ্য ব্যয় করা উচিত।

اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ

📘 ২৫৫ নং আয়াতের তাফসীর: এ আয়াতকে আয়াতুল কুরসী বলা হয়। এটাকে ইসমে আযমও বলা হয়। (তিরমিযী হা: ৩৪৭৮, আবূ দাঊদ হা: ১৪৬৯, হাসান) এ আয়াতের ফযীলাত সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। যেমন উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করা হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে কোন্ আয়াত সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন: আয়াতুল কুরসী। (সহীহ মুসলিম হা: ৮১০) যে ব্যক্তি সকাল বেলায় আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে। আবার সন্ধ্যায় পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত শয়তানের অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকবে। (হাকিম ১/৫৬২, সহীহ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীস থেকে জানা যায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি রাতে ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত তার নিকট কোন শয়তান আসতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২৩১১, সহীহ মুসলিম হা: ১৪২৫) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: مَنْ قَرَأَ آيَةَ الْكُرْسِيِّ فِيْ دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ مِكْتُوْبَةٍ لَمْ يَمْنَعْهُ مِنْ دُخُوْلِ الْجَنَّةِ اِلَّا اَنْ يَمُوْتَ< যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে তার জন্য জান্নাতে যেতে মৃত্যু ছাড়া কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। (সিলসিলা সহীহাহ হা: ৯৭২, মিশকাত হা: ৯৭৪, সহীহ) আয়াতুল কুরসীর এত ফযীলত ও মহত্ত্বের মূল কারণ হলো এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। শাব্দিক বিশ্লেষণ: কুরসী শব্দের অর্থ: চেয়ার, তবে এখানে কুরসী হল আল্লাহ তা‘আলার দু’টি পা রাখার জায়গা। (ইবনু খুযাইমাহ হা: ৭২, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন) এছাড়াও কুরসী অর্থ আল্লাহ তা‘আলার শক্তি জ্ঞান বা আরশ বলে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন যা সঠিক নয়। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার অনেকগুলো গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। যেমন তিনি একমাত্র মা‘বূদ। তিনি ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই। اَلْحَیُّ বা চিরঞ্জীব, এই গুণ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। এ গুণে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ গুণান্বিত নয়। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সবল প্রাণী মরণশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (کُلُّ نَفْسٍ ذَا۬ئِقَةُ الْمَوْتِﺤ ثُمَّ اِلَیْنَا تُرْجَعُوْنَ) “প্রতিটি প্রাণ মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; অতঃপর তোমরা আমারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।”(সূরা আনকাবূত ২৯:৫৭) সুতরাং যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হায়াতুন নাবী বলে থাকে তাদের দাবী এ আয়াত খণ্ডন করে দিচ্ছে। الْقَیُّوْمُ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোন কিছুর প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। খাওয়া, পান করা, বিশ্রাম, বান্দার ইবাদত, দান-সদাকাহ ইত্যাদি থেকে অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ اَنْتُمُ الْفُقَرَا۬ئُ اِلَی اللہِﺆ وَاللہُ ھُوَ الْغَنِیُّ الْحَمِیْدُ) “হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী, আর আল্লাহ হলেন অভাবমুক্ত প্রশংসিত।”(সূরা ফাতির ৩৫:১৫) (لَا تَأْخُذُه۫ سِنَةٌ وَّلَا نَوْمٌ) আাল্লাহ তা‘আলা ঘুমান না এমনকি তন্দ্রাচ্ছন্নও হন না। এটা আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণতার গুণ। (مَنْ ذَا الَّذِيْ يَشْفَعُ عِنْدَه) শাফায়াত ও তার প্রকার এবং কারা কাদের জন্য শাফা‘আত করতে পারবে তা অত্র সূরার ৪৫-৪৭ নং আয়াতের তাফসীরে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর জ্ঞান সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, সৃষ্টি জগত তা বেষ্টন করতে পারে না। তবে তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। তার কুরসী আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী পরিব্যাপ্ত। এ আকাশ ও পৃথিবী পরিচালনা করতে তিনি ক্লান্ত হন না। তিনি সুউচ্চ ও সুমহান। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. সকল ইবাদত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। ২. আল্লাহ তা‘আলা ঘুমান না এবং তন্দ্রাও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। ৩. আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। ৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান দ্বারা সবকিছু বেষ্টন করে আছেন। ৫. আল্লাহ তা‘আলার পা আছে- এ গুণ প্রমাণিত হল। ৬. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেন- এগুণ প্রমাণিত হল। ৭. আল্লাহ তা‘আলা স্ব-স্বত্তায় ওপরে আছেন- সর্বত্র বিরাজমান নন। ৮. আয়াতুল কুরসীর ফযীলত অবগত হলাম।

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انْفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

📘 ২৫৬ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: এ আয়াতের শানে নুযূলের ব্যাপারে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। (ফাতহুল বারী ১/৩৭৭) গ্রহণযোগ্য একটি বর্ণনা হল, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: জনৈকা মহিলার বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করে মারা যেত। সে মহিলা মানত করল, এবার তার বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করে জীবিত থাকলে তাকে ইয়াহূদী বানাবে। যখন বানী নাযীরকে দেশান্তর করে দেয়া হয় তখন তাদের মধ্যে কিছু আনসারদের সন্তান ছিল। আনসাররা বলল- আমরা আমাদের সন্তানদের যেতে দেব না। (বরং ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে এখানে রেখে দেব।) তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবাবে নুযূল, পৃঃ ৫৬, আবূ দাঊদ হা: ২৬৮২, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন) এ আয়াত দীনের পরিপূর্ণতার বর্ণনা। দীন ইসলাম তার সুস্পষ্ট দলীল ও উজ্জ্বল প্রমাণসহ একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَلْیَوْمَ اَکْمَلْتُ لَکُمْ دِیْنَکُمْ وَاَتْمَمْتُ عَلَیْکُمْ نِعْمَتِیْ وَرَضِیْتُ لَکُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا) “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পরিপূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৩) তাই বলা হয়েছে, কাউকে দীন ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে না। বরং আল্লাহ তা‘আলা যার অন্তরকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেবেন, সে সুস্পষ্ট প্রমাণের ওপরেই ইসলাম গ্রহণ করবে। আর যার অন্তর অন্ধ করে দেয়া হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিতে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে সে হতভাগা। তবে এ আয়াত বহাল আছে, না রহিত হয়ে গেছে তা নিয়ে ৭টি মত পাওয়া যায়। যা ইমাম শাওকানী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন। (ফাতহুল কাদীর, ১/৩৭৪) সঠিক কথা হল আয়াতটি রহিত হয়নি। (তাফসীরে সাদী) তাই ইসলাম কাউকে স্বীয় ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না। সেজন্য আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গেলে প্রথমে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতেন। দাওয়াত কবূল না করলে জিযিয়া দিতে বলতেন। জিযিয়া দিতে অবাধ্য হলে আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে যুদ্ধ করতেন। (সহীহ মুসলিম হা: ৪৭৩৯) তবে ইসলাম গ্রহণ করার পর কেউ মুরতাদ হলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না। (فَمَنْ یَّکْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ) ‘সুতরাং যে তাগুতকে অস্বীকার করবে’তাগুত শব্দটি (طغيان) তুগইয়ান থেকে গৃহীত, যার অর্থ হলো সীমা অতিক্রম করা। তাগুত বলা হয়: প্রত্যেক বানানো মা‘বূদ ও যার আনুগত্য করতঃ বান্দা সীমা অতিক্রম করে তাকে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন: তাগুত হল প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যার ইবাদত করা হয় এবং সে সেই ইবাদাতে খুশি। সুতরাং যে সকল ব্যক্তিদের ইবাদত করা হয় এবং তারা যদি সে ইবাদতের দিকে আহ্বান করে ও সন্তুষ্ট থাকে তাহলে এরা সবাই তাগুত। তাগুতের অনেক প্রকার রয়েছে; তবে প্রধান তাগুত পাঁচটি...........? তাই যে ব্যক্তি মুশরিকদেরকে কাফির বলবে না অথবা তারা কাফির এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে অথবা তাদের ধর্মকে সঠিক মনে করবে সে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল না। ঈমান দু’টি বিষয় ছাড়া অর্জিত হয় না, ১. তাগুতকে অস্বীকার করতে হবে। ২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনতে হবে। তাগুতকে অস্বীকার করার অর্থ হলো: আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা, তা অপছন্দ করা, অস্বীকার করা, তার সাথে শত্র“তা পোষণ করা এবং যারা গায়রুল্লাহর ইবাদত করে তাদের সাথে শত্র“তা পোষণ করা। এটাই হলো তাগুতকে অস্বীকার করার অর্থ। দ্বিতীয় বিষয়ঃ আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা। তাগুতকে অস্বীকার ও আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান এ দু’টি বিষয় মানলে একজন ব্যক্তি মুুওয়াহহিদ (তাওহীদ বা আল্লাহ তা‘আলার এককত্বে বিশ্বাসী) হবে। অতএব সকল প্রকার তাগুত অস্বীকার ও বর্জন না করা পর্যন্ত কোন ব্যক্তি ইমানদার হতে পারবে না। যদি কেউ তাগুতের ওপর বিশ্বাস করে এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতিও বিশ্বাস করে সে কখনো মু’মিন হতে পারে না। (بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقٰی) মজবুত রশি অর্থ কী? এ নিয়ে কয়েকটি বক্তব্য পাওয়া যায়: ১. ইবনু আব্বাস (রাঃ), সাঈদ বিন যুবাইর ও যাহহাক (রহঃ) বলেন: শক্ত রজ্জু হল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ২. আনাস (রাঃ) বলেন, শক্ত রজ্জু হল কুরআন। ৩. মুজাহিদ বলেন: শক্ত রজ্জু হল ঈমান। ৪. সুদ্দী বলেন: তা হল ইসলাম। এছাড়াও অনেক তাফসীর পাওয়া যায়। সকল তাফসীরের অর্থ একটি অর্থের দিকেই ফিরে যায় তা হল দীন ইসলাম। (তাফসীর কুরতুবী ২/২১৫) সুতরাং যে ব্যক্তি সকল প্রকার তাগুত বর্জন করে এক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনবে, মাঝে কোন মধ্যস্থতা অবলম্বন করবে না, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাসের সাথে তাগুতের প্রতি বিশ্বাস রাখবে না সে এমন এক মজবুত হাতল ধারণ করবে যা আল্লাহ তা‘আলা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, তা ছিঁড়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে না। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না, দাওয়াত দেয়ার পর কবূল না করলে মুসলিমদের অধীনে থেকে জিযিয়া দিতে হবে। ২. ইসলাম একমাত্র সঠিক ধর্ম যা সুপথের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ৩. তাগুত বর্জন করা ছাড়া মু’মিন হওয়া যায় না। ৪. সঠিক পথ ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র রজ্জু দীন ইসলাম, যা কেউ ধারণ করলে পথভ্রষ্ট হবার আশংকা নেই।

اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ ۗ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

📘 ২৫৭ নং আয়াতের তাফসীর: পূর্বের আয়াত হল আসল ও মূলভিত্তি। আর এ আয়াত তার ফলাফল। যারা সকল প্রকার তাগুতকে বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনবে এবং ঈমানের ওপর বহাল থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অভিভাবক। রাসূল ও মু’মিনগণ তাদের বন্ধু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللہُ وَرَسُوْلُھ۫ وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوا الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَیُؤْتُوْنَ الزَّکٰوةَ وَھُمْ رٰکِعُوْنَ) “তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনগণ- যারা বিনীত হয়ে সালাত কায়িম করে ও যাকাত দেয়।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৫৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন: (وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ) “মু’মিন নর ও মু’মিন নারী একে অপরের বন্ধু।”(সূরা তাওবা ৯:৭১) আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে অন্ধকার তথা কুফরী ও পথভ্রষ্টতা থেকে আলো তথা ইসলামের দিকে নিয়ে আসেন। যাদের অভিভাবক আল্লাহ তা‘আলা হবেন তাদের ফলাফল হল, তাদের কোন ভয় নেই, কোন দুশ্চিন্তা নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (أَلَآ إِنَّ أَوْلِيَآءَ اللّٰهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ) “জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”(সূরা ইউনুস ১০:৬২) পক্ষান্তরে যারা কাফির তাদের অভিভাবক হল তাগুত। অর্থাৎ শয়তান এবং মানুষ ও জিনদের মধ্যে যারা শয়তান তারাও। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের অভিভাকের সংখ্যা বুঝাতে বহুবচন ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ) “যারা মু’মিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে এবং যারা কাফির তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে।”(সূরা নিসা ৩:৭৬) যারা কাফির ও কাফিরদের অভিভাবক এবং বন্ধু সবাই জাহান্নামে চিরস্থায়ী থাকবে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ঈমানদারদের স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছেন। ২. আল্লাহ তা‘আলার অভিভাবকত্ব পেতে হলে সকল প্রকার তাগুত বর্জন করে এক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনতে হবে, ঈমানের সাথে কুফর মিশ্রিত থাকলে হবে না। ২. কাফিরদের অভিভাবক শয়তান, মানুষ ও জিনরূপী শয়তান।

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ ۖ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ ۗ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

📘 ২৫৮ নং আয়াতের তাফসীর: কুরআনুল কারীমের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল- পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও তাদের জাতির ঘটনা বর্ণনা করা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও ক্ষমতা, কুরআনের মু‘জিযাহ, ঐতিহাসিক সত্যতা, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা ও মুসলিমদের জন্য শিক্ষণীয় দিক বর্ণনা করা। এখানে ইবরাহীম (আঃ) ও নমরূদের মাঝে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে। ইবরাহীম (আঃ) পশ্চিম ইরাকের বাসরার নিকটবর্তী ‘বাবেল’শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এখানে তখন কালেডীয় (كلداني) জাতি বসবাস করত। তাদের একচ্ছত্র সম্রাট ছিল নমরূদ। সে তৎকালীন পৃথিবীতে অত্যন্ত উদ্ধ্যত ও অহংকারী সম্রাট ছিল। প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ‘উপাস্য’হবার দাবী করে। (তারীখুল আম্বিয়া পৃ:৬৮) এ বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে ইবরাহীম (আঃ) জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, পিতাকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছেন, মূর্তি ভেঙ্গেছেন। শেষ পর্যায় এসে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে এ বিতর্কে লিপ্ত হয়। নমরূদ ভেবেছিল ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম (আঃ) বললেন: আমার রব তিনি যিনি জীবন-মৃত্যু দান করেন। তখন নমরূদ বলল: আমিও তো জীবন ও মৃত্যু দান করি। এ বলে সে দু’জন জীবন্ত লোক আনতে বলল। একজনকে মেরে ফেলল অন্যজনকে ছেড়ে দিল। আর বলল এই যে, আমি যাকে ইচ্ছা জীবন ও মৃত্যু দেই। তারপর ইবরাহীম (আঃ) যখন সূর্যের উদয় ও অস্তের কথা বললেন, তখন সে কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। প্রমাণিত হলো যে, প্রকৃত রব হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। জাতির (সাধারণ) নেতারাই যেখানে পরাজয় মেনে নেয়নি সেখানে একচ্ছত্র সম্রাট কিভাবে পরাজয় মেনে নিতে পারে। তাই সে অহংকারে ফেটে ইবরাহীম (আঃ) কে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়, এমনকি নিক্ষেপও করা হয়। ইবরাহীম (আঃ)-এ অগ্নীপরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে সফলতা অর্জন করেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও তাদের জাতির ঘটনা বর্ণনা করে আমাদেরকে সতর্ক ও সাবধান করছেন। ২. দাওয়াত কৌশল ও হিকমতের সাথে প্রদান করা উচিত। ৩. প্রত্যেক নাবী ও রাসূলের শত্র“ ছিল, দীনের পথে থাকলে প্রত্যেক মু’মিনেরও থাকবে। ৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওলীদের সার্বিক সাহায্য করেন যেমন ইবরাহীম (আঃ)-কে করেছেন। ৫. জীবন-মৃত্যু, চন্দ্র-সূর্য সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَىٰ قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّىٰ يُحْيِي هَٰذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا ۖ فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِائَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ ۖ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ ۖ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ ۖ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِائَةَ عَامٍ فَانْظُرْ إِلَىٰ طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ ۖ وَانْظُرْ إِلَىٰ حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آيَةً لِلنَّاسِ ۖ وَانْظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا ۚ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

📘 ২৫৯ নং আয়াতের তাফসীর: (اَوْ کَالَّذِیْ) ‘অথবা ঐ ব্যক্তির মত’এর সম্পর্ক হল পূর্বের ঘটনার সাথে। অর্থ হল তুমি (পূর্ব ঘটনার ন্যায়) সেই ব্যক্তির কথা ভেবে দেখেছ! যে এমন ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের মধ্য দিয়ে গমন করেছিল যা বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়েছিল, শহরের মানুষ মরে গিয়েছিল, ইমারতগুলো চুরমার করে দেয়া হয়েছিল। এ লোকটি সংশয় ও অসম্ভব মনে করে বলল: ‘এই নগর মৃত্যুর পর আল্লাহ কিভাবে জীবিত করবেন?’এটা অসম্ভব, কখনো জীবিত করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা এ লোকটিকে তাঁর ক্ষমতা দেখানোর ইচ্ছা করলেন। গাধাসহ তাকে সেখানে মৃত্যু দিয়ে একশত বছর মৃত রাখলেন, তার সাথে রাখা খাবার-পানীয় নষ্ট করলেন না। একশত বছর পর জীবিত করে বললেন, ‘তুমি এ অবস্থায় কতদিন ছিলে?’লোকটি বলল: ‘একদিন অথবা একদিনের কিছু সময়।’সম্ভবত লোকটি যখন মারা গিয়েছিল তখন বেলা কিছুটা উঠে ছিল। আর যখন পুনরায় জীবিত হল তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার কাছাকাছি ছিল। তাই লোকটি ভাবছিল হয়তো দিনের মধ্যবর্তী সময়টুকু মৃতাবস্থায় ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিলেন, তুমি একশত বছর মৃত ছিলে এবং আল্লাহ তা‘আলা নিদর্শনগুলো দেখিয়ে দিলেন। তখন তার বিশ্বাস হল যে, আল্লাহ তা‘আলা সব বিষয়ে ক্ষমতাবান, তিনি ইচ্ছা করলে হাজার বছর পরেও মৃতকে জীবিত করতে পারেন, মানুষ মরে পচে গলে গেলেও পুনঃজীবিত করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়। এ লোকটি কে ছিল তা নিয়ে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে উযায়রের নাম বেশি প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। পূর্বে ইবরাহীম (আঃ) ও নমরূদের ঘটনা ছিল মহান আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাতের প্রমাণস্বরূপ। দ্বিতীয় এ ঘটনা হল আল্লাহ তা‘আলা মৃতকে জীবিত করার মালিক তার প্রমাণ। এটাও আল্লাহ তা‘আলার মহাশক্তি ও রুবুবিয়্যাহর ওপর প্রমাণ বহন করে। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা মৃত্যুর পর সকলকে জীবিত করতে সক্ষম এবং নির্ধারিত সময়ে করবেন। ২. যারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তাদের এত্থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।

۞ إِنَّ اللَّهَ لَا يَسْتَحْيِي أَنْ يَضْرِبَ مَثَلًا مَا بَعُوضَةً فَمَا فَوْقَهَا ۚ فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ ۖ وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلًا ۘ يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا ۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلَّا الْفَاسِقِينَ

📘 ২৬ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: এ আয়াতের ব্যাপারে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, তবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হল- ইবনু আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতে বর্ণিত যে, (مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا) “এদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্তের ন্যায় যে আগুন জ্বালালো” এ আয়াত ও (أَوْ كَصَيِّبٍ مِّنَ السَّمَا۬ءِ فِيْهِ ظُلُمَاتٌ) “অথবা তাদের দৃষ্টান্ত আকাশ হতে পানি বর্ষণের ন্যায় যাতে রয়েছে অন্ধকার” এ আয়াত দ্বারা মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হলে মুনাফিকরা বলতে লাগল, এরূপ উদাহরণ বর্ণনা করা থেকে আল্লাহ মহান ও সম্মানিত। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। কাতাদাহ (রহঃ) বর্ণনা করেন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করলেন, মুশরিকরা বলল- এ মাকড়সা ও মাছির কথা উল্লেখ করা কী দরকার? তখন এ আয়াত নাযিল হয়। (লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল পৃ. ১৮) (فَمَا فَوْقَهَا) ‘তদপেক্ষা ক্ষুদ্রতর’এর দু’টি অর্থ হতে পারে: একটি হল এই যে, ওর চেয়েও হালকা ও নগন্য জিনিস। যেমন কেউ কোন লোকের কৃপণতা ইত্যাদির কথা বর্ণনা করলে অন্যজন বলে যে, সে আরও ওপরে। তখন ভাবার্থ এই হয় যে, এ দোষে সে আরও নীচে নেমে গেছে। একটি হাদীসে এসেছে: لَوْ أَنَّ الدُّنْيَا تَزِنُ عِنْدَاللّٰهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقَي كَافِرًا مِنْهَا شُرْبَةً مِنْ مَاءٍ যদি দুনিয়ার কদর আল্লাহ তা‘আলার কাছে একটি মশার ডানার সমানও হত তাহলে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও পান করাতেন না। (তিরমিযী হা: ২৩২, হাকিম হা: ৩০৬, হাদীসটি দুর্বল) দ্বিতীয় অর্থ এই যে, এর চেয়ে বেশি বড়। কেননা মশার চেয়ে ছোট প্রাণী আর কী হতে পারে? সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, যদি কোন মুসলিম কাঁটাবিদ্ধ হয় বা তার চেয়েও বেশি কষ্ট পায়, এজন্য তার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং পাপ মোচন হয়। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯৯১) আয়াতের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যেমন এ ছোট-বড় জিনিসগুলো সৃষ্টি করতে আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেননি, তেমনই ওগুলোকে দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ও সংকোচ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (یٰٓاَیُّھَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَھ۫ﺚ اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ لَنْ یَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَھ۫ﺚ وَاِنْ یَّسْلُبْھُمُ الذُّبَابُ شَیْئًا لَّا یَسْتَنْقِذُوْھُ مِنْھُﺚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوْبُ) “হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগসহকারে সেটা শ্রবণ করো- তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও এবং মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট হতে, এটাও তারা তার নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই দুর্বল।”(সূরা হজ্জ ২২:৭৩) পূর্ব যুগের কোন মনীষী বলেছেন: “যখন আমি কুরআন মাজীদের কোন দৃষ্টান্ত শুনি এবং বুঝতে পারি না তখন আমার কান্না এসে যায়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, এ দৃষ্টান্তগুলো শুধু জ্ঞানিরাই বুঝে থাকে।” মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, দৃষ্টান্ত ছোট হোক আর বড় হোক ঈমানদারগণ এর ওপর ঈমান এনে থাকে, একে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং এর দ্বারা সুপথ পেয়ে থাকে। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: (فَأَمَّا الَّذِينَ اٰمَنُوا فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّهِمْ) এর অর্থ হচ্ছে: “মু’মিনরা জানে যে, এটা দয়াময় আল্লাহর কথা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।”(সূরা বাকারাহ ২:২৬) মুজাহিদ, হাসান বসরী, রাবী বিন আনাস এরূপ বর্ণনা করেছেন। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: উক্ত আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে- মু’মিনরা তা অনুধাবন করে এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। তারা যদি জানতে পারে এতে বিস্তারিত কিছু রয়েছে তাহলে তার মাধ্যমে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়। অন্যথায় অবগত হয় যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সত্য এবং যা কিছু বিস্তাতির রয়েছে তাও সত্য। আর যদি তাদের কাছে কিছু বোধগম্য না হয় তাহলে তারা এটাই বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন দৃষ্টান্ত অযথা বর্ণনা করেননি। (তাফসীরে সা‘দী: ২৪) আল্লাহ তা‘আলার বাণী: (وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا) “আর যারা কাফির- সর্বাবস্থায় তারা বলে এসব নগণ্য বস্তুর উপমা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যই বা কী? যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাদের ব্যাপারে সূরা মুদ্দাসসিরে বলেন: (وَمَا جَعَلْنَآ اَصْحٰبَ النَّارِ اِلَّا مَلٰ۬ئِکَةًﺕ وَّمَا جَعَلْنَا عِدَّتَھُمْ اِلَّا فِتْنَةً لِّلَّذِیْنَ کَفَرُوْاﺫ لِیَسْتَیْقِنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَیَزْدَادَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْٓا اِیْمَانًا وَّلَا یَرْتَابَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْکِتٰبَ وَالْمُؤْمِنُوْنَﺫ وَلِیَقُوْلَ الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ وَّالْکٰفِرُوْنَ مَاذَآ اَرَادَ اللہُ بِھٰذَا مَثَلًاﺚ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللہُ مَنْ یَّشَا۬ئُ وَیَھْدِیْ مَنْ یَّشَا۬ئُﺚ وَمَا یَعْلَمُ جُنُوْدَ رَبِّکَ اِلَّا ھُوَ) “আমি ফেরেশতাদেরকে জাহান্নামের প্রহরী করেছি কাফিরদের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে আহলে কিতাবের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, ঈমানদারদের ঈমান বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসী ও আহলে কিতাবগণ যেন সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে তারা ও কাফিররা বলবেঃ আল্লাহ্ এ বর্ণনা দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন? এভাবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন।”(সূরা মুদ্দাসসির ৭৪:৩১) আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এর ভাবার্থ হচ্ছে তারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফলে তাদের কুফরীর সাথে আরো কুফরী বৃদ্ধি পায় যেমন মু’মিনদের ঈমানের সাথে আরো ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (يُضِلُّ بِه۪ كَثِيرًا وَّيَهْدِي بِه۪ كَثِيرًا) “তিনি এর দ্বারা অনেককে বিপদগামী করে থাকেন এবং এর দ্বারা অনেককে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন।” এ হল কুরআন অবতীর্ণের সময় মু’মিন ও কাফিরদের অবস্থা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَاِذَا مَآ اُنْزِلَتْ سُوْرَةٌ فَمِنْھُمْ مَّنْ یَّقُوْلُ اَیُّکُمْ زَادَتْھُ ھٰذِھ۪ٓ اِیْمَانًاﺆ فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَزَادَتْھُمْ اِیْمَانًا وَّھُمْ یَسْتَبْشِرُوْنَ﯋وَاَمَّا الَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِھِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْھُمْ رِجْسًا اِلٰی رِجْسِھِمْ وَمَاتُوْا وَھُمْ کٰفِرُوْنَ) “যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের কেউ কেউ বলে ‘এটা তোমাদের মধ্যে কারো ঈমান বৃদ্ধি করলো?’যারা মু’মিন এটা তাদেরই ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারাই আনন্দিত হয়। এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, এটা তাদের কলুষের সাথে আরও কলুষ যুক্ত করে এবং তাদের মৃত্যু ঘটে কাফির অবস্থায়।”(সূরা তাওবাহ ৯:১২৪-১২৫) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পাপিষ্ঠদের পথভ্রষ্ট করার হিকমত ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَمَا يُضِلُّ بِه۪ إِلَّا الْفَاسِقِيْنَ) “তিনি এর দ্বারা কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।” অর্থাৎ যারা আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। অতএব আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি হল এটাই- যারা হিদায়াতের অযোগ্য, অনুপোযোগী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করা আর যারা ঈমানের গুণে গুণান্বিত ও সৎ আমলে অলঙ্কৃত তাদেরকে হিদায়াত প্রদান করা। “فاسق” ফাসিক অবাধ্য দু’প্রকার: ১. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। ২. এমন অবাধ্য হওয়া যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় না কিন্তু অপরাধী হয় এবং ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اِنْ جَا۬ءَکُمْ فَاسِقٌۭ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوْٓا) “যদি কোন ফাসিক লোক তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে তাহলে এর সত্যতা যাচাই করে নিও।” (সূরা হুজুরাত ৪৯:৬, তাফসীরে সা‘দী: পৃ. ২৪) ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, “يُضِلُّ بِه۪ كَثِيْرًا”এর দ্বারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেন অর্থাৎ মুনাফিকদেরকে। আবুল আলিয়াও এ রকম বলেছেন। ইবনু আবি হাতিম সা‘দ হতে বর্ণনা করেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল “খাওয়ারিজ”। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) সুতরাং কুরআনে যা কিছু উল্লেখ আছে প্রকৃত মু’মিনরা তা দ্বারা উপকৃত হয় এবং তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুনাফিক ও কাফিররা কুরআনের যে কোন বিষয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে, ফলে তাদের কুফরী আরো বৃদ্ধি পায়। যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন (نُوَلِّه۪ مَا تَوَلّٰي) “আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দেব যে দিক সে অবলম্বন করবে।”(সূরা নিসা ৪:১১৫) এবং হাদীসে এসেছে كُلُّ مُيَسَّرٍ لِمَا خُلِقَ لَهُ অর্থাৎ প্রত্যেকের জন্য সে জিনিস সহজ করা হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৯৪৯) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ছোট-বড় সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। তাই তিনি যেকোন সৃষ্টি দ্বারা উপমা দিতে লজ্জাবোধ করেন না। ২. কুরআন দ্বারা কেবল মু’মিনরা উপকৃত হয়, আর কুরআন কাফিরদের ক্ষতি ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করে না। ৩. কিছু কিছু অবাধ্য কর্ম আছে যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়; সেগুলো থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। ৪. এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার একটি পবিত্র সিফাত বা গুণ সাব্যস্ত হয় যে, “আল্লাহ তা‘আলা লজ্জাবোধ করেন”। আমরা আল্লাহ তা‘আলার এ সিফাত বা গুণ অবশ্যই তাঁর জন্য সাব্যস্ত করব যেহেতু তা কুরআনে এসেছে। তবে কোন মাখলুকের সাথে সাদৃশ্য করব না এবং কোন ধরণও জিজ্ঞাসা করব না, বরং মহান আল্লাহর জন্য যেমন শোভা পায় তেমনই বিশ্বাস করব।

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَىٰ ۖ قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ ۖ قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي ۖ قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَىٰ كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا ۚ وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

📘 ২৬০ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা যে মৃতকে জীবিত করেন তার এটি তৃতীয় উদাহরণ। পাখিগুলোর নাম কী আর কী রং ছিল? তার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। সে সম্পর্কে জানার কোন প্রয়োজন নেই এবং না জানলে কোন ক্ষতিও হবে না। আল্লাহ তা‘আলা যা কুরআনে উল্লেখ করেননি এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে বর্ণনা দেননি তা জানার জন্য পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। কেননা তা না জানলে দীন পালনে কোন ক্ষতি হবে না। যদি তাতে উপকার থাকত তাহলে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বর্ণনা করে দিতেন। বরং আমরা শিক্ষা নেব যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জীবন ও মরণের মালিক, মুত্যুর পর তিনি পুনরায় সকলকে জীবিত করে ভাল-মন্দ কর্মের হিসাব নিবেন। আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মানুষের স্বভাবই হল যা জানে না তা জানার চেষ্টা করা, তবে যা অহেতুক তা বর্জনীয়। ২. আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়।

الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

📘 ২৭নং আয়াতের তাফসীর: এ সমস্ত গুণাবলী হল কাফিরদের যা মু’মিনদের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তোমার প্রতিপালক হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে আর অন্ধ কি সমান? উপদেশ গ্রহণ করে শুধু বিবেকশক্তিসম্পন্নগণই, যারা আল্লাহ প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না, আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসেবকে, যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ধৈর্যধারণ করে, সালাত কায়িম করে, আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা ভাল দ্বারা মন্দ দূরীভূত করে, এদের জন্য শুভ পরিণাম- স্থায়ী জান্নাত, এতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সস্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎ কর্ম করেছে তারাও এবং ফেরেশতাগণ তাদের নিকট উপস্থিত হবে প্রত্যেক দ্বার দিয়ে এবং বলবে, ‘তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি; কত ভাল এ পরিণাম!’যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর সেটা ভঙ্গ করে এবং যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস।”(সূরা রা‘দ ১৩:১৯-২৫) অত্র আয়াতে “যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে” এ ওয়াদা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ১. একদল বলেন: এখানে অঙ্গীকারের অর্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার সম্পূর্ণ নির্দেশ মেনে চলা এবং সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। তা ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে তার ওপর আমল না করা। ২. কেউ বলেন: অঙ্গীকার ভঙ্গকারীরা হচ্ছে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিকরা। অঙ্গীকার হচ্ছে যা তাওরাতে তাদের কাছে নেয়া হয়েছিল, তারা তার সমস্ত কথা মেনে চলবে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর নবুওয়াতে বিশ্বাস করবে এবং তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য মনে করবে। আর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এই যে, জেনে-শুনে তারা তাঁর নবুওয়াত ও আনুগত্য অস্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও তারা তা গোপন করেছে, আর পার্থিব স্বার্থের কারণে তার উল্টোটা করেছে। ইমাম ইবনে জারীর ও মুকাতিল ইবনে হিব্বানও এ কথা বলেছেন। ৩. কারো মতে, এর ভাবার্থে কোন নির্দিষ্ট দলকে বুঝায় না, বরং সমস্ত কাফির-মুশরিক ও মুনাফিককে বুঝায়, অঙ্গীকারের ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও তাঁর নাবীর নবুওয়াতকে স্বীকার করা- যার প্রমাণে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী ও বড় বড় মু‘জিযাহ বিদ্যমান রয়েছে। আর তা ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অস্বীকার করা। এ কথাটিই অধিক মজবুত ও যুক্তিযুক্ত। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) আল্লামা সা‘দী বলেন, এখানে অঙ্গীকার দ্বারা সকল অঙ্গীকার শামিল। যা মানুষ ও তাদের রবের মাঝে এবং তাদের ও সৃষ্টি জীবের মাঝে (অঙ্গীকার) বিদ্যমান। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৪) আবার কেউ বলেন: আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে সকল সন্তানদের বের করার পর যে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَاِذْ اَخَذَ رَبُّکَ مِنْۭ بَنِیْٓ اٰدَمَ مِنْ ظُھُوْرِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَاَشْھَدَھُمْ عَلٰٓی اَنْفُسِھِمْﺆ اَلَسْتُ بِرَبِّکُمْﺚ قَالُوْا بَلٰیﹱ شَھِدْنَا) “স্মরণ কর! যখন তোমার প্রতিপালক আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’তারা বলল:‎ ‘হ্যাঁ অবশ্যই আমরা সাক্ষী রইলাম।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৭২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوآ أَرْحَامَكُمْ) “এখন তোমাদের কাছে এ ছাড়া আর কিছু কি আশা করা যায় যে, যদি তোমরা জনগণের শাসক হও তাহলে দুনিয়াতে ফাসাদ করবে এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করবে?” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২২) সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্যে অন্যতম একটি দিক হল- সকল রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা। তাই কতক রাসূলে প্রতি ঈমান আনা আর কতকের প্রতি ঈমান না আনা সম্পর্ক ছিন্ন করার শামিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللّٰهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا) “এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে তারতম্য করতে চায় এবং বলে ‘আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি’; আর তারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, এরাই প্রকৃত কাফির।”(সূরা নিসা ৪:১৫০-৫১) তবে আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: এতে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর ইবাদত করার মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলের প্রতি ঈমান, ভালবাসা, সম্মান প্রদর্শন ও তাঁর সকল অধিকার আদায় করার মাধ্যমে আমাদের তাঁর সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সমস্ত সৃষ্টি জীবের যথার্থ হক আদায় করে আমাদের ও তাদের সাথে সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। অতএব মু’মিনদের আল্লাহ তা‘আলা যে সকল সম্পর্ক বহাল রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তারা তা যথাযথ বহাল রাখে আর ফাসিকরা তা ক্ষুণ্ণ করে; এটাই হল জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা। তারাই হল দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। (তাফসীর সা‘দী পৃ: ২৪) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, যে সকল অন্যায়ের কথা আল্লাহ তা‘আলা অমুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, জালিম, পাপাচারী, ফাসিক ইত্যাদি- এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুফর। আর যা মুসলিমদের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তার দ্বারা উদ্দেশ্য হল নিন্দা করা। (ফাতহুল কাদীর ১/৯৫-৯৬) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মুনাফিক ও কাফিরদের বৈশিষ্ট্য। সেটা যেকোন প্রকার অঙ্গীকার হতে পারে। ২. কাফিররা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আর মু’মিনরা তা বহাল রাখে।

كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

📘 ২৮ নং আয়াতের তাফসীর: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অস্বীকারকারিদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে বলেন: তোমরা কিভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী কর? অথচ তিনি তোমাদেরকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (ھَلْ اَتٰی عَلَی الْاِنْسَانِ حِیْنٌ مِّنَ الدَّھْرِ لَمْ یَکُنْ شَیْئًا مَّذْکُوْرًا) “মানুষের এমন এক সময় কি অতিবাহিত হয়নি যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না?” (সূরা দাহর ৭৬:১) তোমরা ছিলে পিতার পৃষ্ঠদেশে শুক্রকিট ও মায়ের জরায়ুতে ডিম্বানু আকারে মৃত, আল্লাহ তা‘আলা সেখান থেকে জীবন দান করে বাচ্চা আকারে পৃথিবীতে নিয়ে আসলেন। অতঃপর বিভিন্ন নেয়ামত দ্বারা জীবিত রাখার পর বয়স পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মৃত্যু দান করলেন। তারপর কবরস্থ করলেন প্রতিদান দেয়ার জন্য, আবার পূর্ণ প্রতিদান দেয়ার জন্য পুনরুত্থিত করবেন। অতএব তোমরা সার্বক্ষণিক আল্লাহ তা‘আলার তত্ত্বাবধানাধীন, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করা কি সঙ্গত? না! বরং এটা বোকামী ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী না করে তোমাদের উচিত তাঁকে যথাযথ ভয় করা, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর আযাবকে ভয় করা এবং সওয়াবের আশা করা। (তাফসীর সা‘দী, পৃ. ২৫) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করে যেমন দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন তেমন হিসাব-নিকাশের জন্য আবার হাশরের ময়দানে উপস্থিত করবেন। ২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর নেয়ামতের কৃজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত কর্তব্য।

لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ ۖ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ ۗ وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

📘 ২৮৪ নং আয়াতের তাফসীর: শানে নুযূল: আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: (لِلّٰهِ ما فِي السَّمَاواتِ...... قَدِيرٌ) এ আয়াত নাযিল হলে বিষয়টি সাহাবীদের ওপর খুব কঠিন হয়ে যায়। তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসল এবং জানু ভরে বসে পড়ে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে সালাত, সিয়াম, জিহাদ এবং দানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এখন যে আয়াত নাযিল হয়েছে তা পালন করার শক্তি আমাদের নেই। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমরা কি ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের মত বলতে চাও আমরা শুনলাম আর মানলাম না? বরং তোমাদের বলা উচিত: আমরা শুনলাম ও মানলাম। হে আমাদের রব! আমাদের ক্ষমা করুন, আপনার কাছেই আমাদের প্রত্যাবর্তন। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান হা:১২৭) অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহর আলোচনা করা হয়েছে। তিনি যেমনি আকাশ ও জমিনের একচ্ছত্র মালিক। সকল কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও রাজত্ব তাঁর হাতে, তেমনি কাউকে ক্ষমা করা আর না করার কর্তৃত্বও তাঁর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত দিতে পারেন, এটা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ। আবার যাকে ইচ্ছা তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন, এতে তিনি জালিম হবেন না বরং তিনি ন্যায়পরায়ণ। কাউকে ক্ষমা করা আর না করার কর্তৃত্ব কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া ও পীর-বুযুর্গকে দেয়া হয়নি। ইবনু উমার (রাঃ) বলেন: (إنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ.... ) এ আয়াতটি তার পরের আয়াত তথা ২৮৬ নং আয়াত দ্বারা মানসূখ বা রহিত করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫৪৬) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতের অন্তরে উদীয়মান খেয়ালের কোন বিচার করবেন না, যে পর্যন্ত না তা কাজে পরিণত করবে অথবা মুখে উচ্চারণ করবে। (সহীহ বুখারী হা: ১৫১৮, সহীহ মুসলিম হা: ১২৭) এ থেকে বুঝা যায় যে, অন্তরে উদিত খেয়ালের কোন হিসেব হবে না। কেবল সেই খেয়ালের হিসেব হবে যা কাজে পরিণত করা হয়েছে। তবে অন্তরে ভাল চিন্তা জাগলে এর বিনিময়ে ছাওয়াব পাওয়া যাবে।

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَىٰ إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ ۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

📘 ২৯ নং আয়াতের তাফসীর: এখানে “لَكُمْ” ‘তোমাদের জন্য’এর দ্বারা পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের উপকার ও উপভোগের জন্য সৃষ্টি করা বুঝানো হয়েছে। এ আয়াত প্রমাণ করে সকল বস্তুর মূল অবস্থা বা বিধান হল হালাল বা বৈধ। কেননা তা অনুগ্রহের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা হারাম বস্তুগুলো বের হয়ে গেছে। এখানে আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারার্থে। অতএব যার ভিতরে ক্ষতি ও অপকার রয়েছে তা এর বাইরে। (ثُمَّ اسْتَوٰٓى إِلَي السَّمَآءِ) “অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেন” ইসতিওয়া শব্দটি কুরআনুল কারীমে তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে: ১. ইসতিওয়া শব্দটি যখন কোন অব্যয়-এর সাথে ব্যবহার হবে না তখন এর অর্থ হবে পরিপূর্ণতা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; ‏ (وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّه۫ وَاسْتَوٰي) “যখন মূসা পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল।”(সূরা কাসাস ২৮:১৮) ২. ইসতিওয়া শব্দটি যখন “علي”অব্যয়-এর সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ওপরে ওঠা, সমুন্নত হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (الرَّحْمٰنُ عَلَي الْعَرْشِ اسْتَوٰي) “দয়াময় (আল্লাহ) আরশের ওপর সমুন্নত।”(ত্বহা ২০:৫) ৩. যখন ইসতিওয়া শব্দটি “إلي” অব্যয়ের সাথে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হবে ইচ্ছা করা। যেমন এ আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তারপর আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন। (তাফসীরে সা‘দী, পৃ. ২৫) (وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ) ‘আর তিনি সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী।’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান সকল সৃষ্টি বস্তুকে বেষ্টন করে আছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (أَلَا يَعْلَمُ مَنْ خَلَقَ وَهُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُ) “যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, ভালোভাবে অবগত।” আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতের বিস্তারিত বর্ণনা সূরা হা-মীম সিজদায় দিয়েছেন: “বল: তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দু’দিনে এবং তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। তিনি ভূ-পৃষ্ঠে স্থাপন করেছেন (অটল) পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের, সমভাবে (এতে উত্তর) রয়েছে জিজ্ঞাসুদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধুম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেনঃ তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললোঃ আমরা এলাম অনুগত হয়ে। অতঃপর তিনি তাকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার বিধান ব্যক্ত করলেন এবং আমি দুনিয়ার আকাশকে বাতিসমূহ দিয়ে সুশোভিত ও সুরক্ষিত করলাম । এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।”(সূরা হা-মীম- সিজদাহ ৪১:৯-১২) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরেন অতঃপর বললেন: আল্লাহ তা‘আলা শনিবার মাটি সৃষ্টি করেছেন, পাহাড় সষ্টি করেছেন রবিবার এবং বৃক্ষরাজী সৃষ্টি করেছেন সোমবার এবং অপছন্দনীয় জিনিসগুলো সৃষ্টি করেছেন মঙ্গলবার, আলো সৃষ্টি করেছেন বুধবার, বৃহস্পতিবার জীবজন্তু ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং শুক্রবার আসরের পর রাতের পূর্বে শেষ সময়ে তিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২১৪৯-৫০) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. হারাম হওয়ার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত জাগতিক সকল বস্তু হালাল। ২. সকল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্বে।

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ

📘 ৩০ নং আয়াতের তাফসীর: এখান থেকে মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি ও তাঁর মর্যাদার আলোচনা সূচনা করা হয়েছে- خليفة (খলীফাহ) শব্দটি خلف থেকে গৃহীত। অর্থ: একজনের পর অপরজন আসা, একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (هُوَ الَّذِيْ جَعَلَكُمْ خَلَا۬ئِفَ فِي الْأَرْضِ) “তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত বানিয়েছেন।”(সূরা ফাতির ৩৫:৩৯) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (فَخَلَفَ مِنْۭ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ) “অতঃপর একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে উত্তরাধিকারী হয়।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৬৯, ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর ) মুফাসসিরগণ خليفة (খলীফাহ) শব্দের দু’টি ব্যখ্যা দিয়েছেন: ১. খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম (আঃ)। কেননা তিনি পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়নে তাঁর খলীফা। আবার বলা হয় পূর্বে যে সকল জিন জমিনে বসবাস করত তিনি তাদের খলীফা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে খলীফা দ্বারা আদম (আঃ) উদ্দেশ্য। ২. خليفة (খলীফাহ) শব্দটি একবচন হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বহুবচন অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতি। এ মতটি ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) প্রাধান্য দিয়েছেন। যদিও খলীফা শব্দটি উভয় তাফসীরের সম্ভাবনা রাখে, কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বিতীয় তাফসীরের মতকে সমর্থন করে। অর্থাৎ খলীফা দ্বারা উদ্দেশ্য আদম ও তাঁর বংশধর, শুধু আদম (আঃ) নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَا۬ءَ) আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে, তারা সেখানে বিবাদ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? এটা জানা কথা যে, আদম (আঃ) ফাসাদকারী নন এবং রক্তপাতকারীও নন। যেমন পূর্বের আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়। (আযওয়াউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ: ৭০) আল্লাহ তা‘আলা যখন ফেরেশতাদের কাছে খলীফা সৃষ্টির কথা বললেন তখন ফেরেশতাগণ বলল- আপনি এমন ব্যক্তিদের সৃষ্টি করবেন যারা ফাসাদ সৃষ্টি করবে, রক্তপাত ঘটাবে? তাদের এ প্রশ্নের অর্থ এটা নয় যে, তারা গায়েব জানে। বরং তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, তাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হবে। এজন্য তারা ঐ মন্তব্য করেছিল। অথবা খলীফা শব্দের অর্থ জেনেই তারা এটা বুঝেছিল যে, মানুষ হবে ন্যায়-অন্যায়ের ফায়সালাকারী, অনাচার প্রতিহতকারী, অবৈধ ও পাপ কাজের বাধাদানকারী; ফলে তাদের মাঝে ফাসাদ সৃষ্টি হবে এবং রক্তপাত ঘটবে। অথবা পূর্বে যারা পৃথিবীতে বসবাস করেছিল তাদের ক্রিয়াকলাপ দেখেই তারা মানুষের ব্যাপারেও এ মন্তব্য করেছিল। উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাদের এ আরয প্রতিবাদমূলক ছিল না এবং আদম (আঃ)-এর প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে বলেছিল তাও নয়। কারণ ফেরেশতাগণ এরূপ চরিত্র থেকে পবিত্র। ফেরেশতাদের আনুগত্য সম্পর্কে কুরআনে এসেছে- (لَّا يَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَآ أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُوْنَ مَا يُؤْمَرُوْنَ)‏ “তারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হন তাই করেন।”(সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাদের সামনে বিষয়টি উত্থাপনের উদ্দেশ্য হল, শুধু এর হিকমত জানাবার ও এর রহস্য প্রকাশ করার, যা ছিল তাদের বোধশক্তির ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা তো ভালভাবেই জানেন যে, এরা বিবাদ ও ঝগড়াটে হবে, কাজেই তারা আল্লাহ তা‘আলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, খলীফাসৃষ্টি করার পিছনে আপনার হিকমাত কী? যদি ইবাদত-ই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তবে আমরা তো আপনার ইবাদত করছি, আপনার প্রশংসা ও তাসবীহ পাঠে সর্বদা রত রয়েছি এবং আমরা ঝগড়া-বিবাদ হতেও পূতপবিত্র, তারপরও আল্লাহ তা‘আলার খলীফা সৃষ্টি করার পেছনে কী হিকমত রয়েছে? আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন: আমি যা জানি তোমরা তা জান না। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সবই আমি জানি যা তোমরা জানো না। আমি জানি তাদের মধ্যে নাবী-রাসূল, সত্যবাদী, শহীদ, সৎ বান্দা ইত্যাদি হবে। তারা এমন ইবাদত করবে যা তারা ছাড়া অন্যরা করবে না। যেমন জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদত। হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের নিকট দিনের ফেরেশতা ও রাতের ফেরেশতা পালাক্রমে আগমন করে। অতঃপর তারা উভয় দল ফজর ও আসরের সময় একত্রিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা (দিনের) ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করেন অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন্ অবস্থায় রেখে এসেছ? তারা বলে, আমরা যখন তাদের নিকট আগমন করেছি তখন তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায় এবং আমরা যখন তাদেরকে রেখে এসেছি তখনও তাদেরকে পেয়েছি সালাতরত অবস্থায়। (সহীহ বুখারী হা: ৬৯৯২, ৭০৪৮) আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে একমুষ্ঠি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যে মাটি তিনি সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ হতে নিয়েছিলেন। তাই আদম সন্তানও মাটির বিভিন্ন বর্ণ ও প্রকৃতি অনুসারে হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ লাল, কেউ সাদা, কেউ কালো এবং কেউ এ সকলের মধ্যবর্তী বর্ণের হয়ে থাকে। অনুরূপ কেউ কোমল, কেউ কঠোর এবং কেউ সৎ ও কেউ অসৎ প্রকৃতির হয়ে থাকে। (তিরমিযী, সিলসিলাতুস সহীহাহ হা: ১৬৩০) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন: এ আয়াতটি খলীফা বা ইমাম নিযুক্ত করার মূল দলীল। রাষ্ট্রের সকল মানুষ নিযুক্ত খলীফা বা ইমামের আনুগত্যশীল থাকবে, যাতে ইমামের মাধ্যমে সকলে ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং ইমাম শরয়ী বিধান কায়িম করতে পারেন। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। ইসলামী নেতা বা খলীফা নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতিসমূহঃ ১. পূর্ববর্তী ইমাম বা খলীফার ঘোষণার মাধ্যমে যেমন: অমুক পরবর্তী ইমাম হবে। তাহলে এ কথা দ্বারাই সে ব্যক্তি ইমাম নিযুক্ত হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে ওমার (রাঃ) খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। ২. কোন ব্যক্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের একমত হওয়া যে, তিনি আমাদের ইমামের উপযুক্ত, আমরা তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করব। কতক আলেম বলেন: আবূ বকর (রাঃ) এ পদ্ধতিতে ইমাম হয়েছেন। আনসার ও মুহাজির সকলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর ইমামতের ব্যাপারে একমত ছিলেন, যদিও প্রথম দিকে মতানৈক্য হয়েছিল। ৩. অনুরূপ খলীফা কয়েক সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে যাবেন, তারা নিজেদের মধ্যে বা বাইরে থেকে যাকে উপযুক্ত মনে করবেন সে খলীফা বলে বিবেচিত হবেন। ৪. জালিম শাসক থেকে জোর করে খেলাফতের দায়িত্ব কেড়ে নেয়া। যোগ্য ইমাম বা নেতার জন্য অনেক শর্ত রয়েছে, বিস্তারিত তাফসীর গ্রন্থগুলোতে রয়েছে। (তাফসীর কুরতুবী ১/২২৩-২২৮) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে তাঁর আকৃতিতেই সৃষ্টি করে বললেন, যাও ফেরেশতাদের ঐ দলটিকে সালাম কর। আর তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয় তা শ্রবণ কর। এটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তানদের সালাম। তখন তিনি গিয়ে বললেন, السلام عليكم তারা উত্তরে বলল, السلام عليك ورحمة اللّٰه তারা ورحمة اللّٰه অংশটি বেশি বলল। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা আদমের আকৃতিতে জান্নাতে যাবে এবং তার উচ্চতা হবে ষাট হাত। তখন হতে ক্রমান্বয়ে আদম সন্তানের উচ্চতা কমে আসছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩২৬, মুসলিম হা: ৭৩৪২, মিশকাত হা: ৪৪২৩) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মানব জাতির পিতা আদম (আঃ)-এর সূচনা ও সৃষ্টি রহস্য জানলাম। ২. ফেরেশতারাও গায়েব জানেনা, গায়েব জানা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার বৈশিষ্ট্য। ৩. ফেরশতাদের বৈশিষ্ট্য জানলাম। তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়না, যা নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে। ৪. মানুষ বিভিন্ন প্রকৃতি ও স্বভাবের হওয়ার কারণ অবগত হলাম। ৫. খলীফা নিযুক্তির হিকমত ও পদ্ধতি জানতে পারলাম।

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ

📘 ৩৪ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের আদম (আঃ)-কে যে সিজদাহ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিল আদম (আঃ)-এর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ এবং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতস্বরূপ। সকলেই সিজদাহ করল ইবলিস ব্যতীত। সে অমান্য করল এবং অহঙ্কার করল। (তাফসীর সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর) ইবলিসের অমান্য ও অহঙ্কারের কারণ অন্যত্র উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (قَالَ مَا مَنَعَکَ اَلَّا تَسْجُدَ اِذْ اَمَرْتُکَﺚ قَالَ اَنَا خَیْرٌ مِّنْھُﺆ خَلَقْتَنِیْ مِنْ نَّارٍ وَّخَلَقْتَھ۫ مِنْ طِیْنٍ) “তিনি বললেন, ‘আমি যখন তোমাকে আদেশ দিলাম তখন কী তোমাকে তা থেকে বিরত রাখল যে, তুমি সিজদাহ করবে না?’সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম; তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করেছ এবং তাকে কর্দম দ্বারা সৃষ্টি করেছ।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১২) সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার কোন নির্দেশকে অমান্য করা শয়তানের কাজ ও অহঙ্কারের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি কেউ তাচ্ছিল্য ও অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে অমান্য করলে মু’মিন থাকবে না। তাই একজন মু’মিন যখন জানতে পারবে এটা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের নির্দেশ তখন সে তা মাথা পেতে মেনে নেবে, চাই সেটা তার যুক্তি ও ইচ্ছানুযায়ী হোক আর না হোক। বরং যুক্তি দাঁড় করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ বর্জন করা ইবলিসের অনসুরণ এবং জাহান্নামে যাওয়ার কাজ। ফেরেশতা কর্তৃক আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করার ব্যাপারে মুফাসসিরদের বক্তব্য: ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ফেরেশতাগণ আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করেছিল আর এটা ছিল মূলত আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য (কারণ আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন)। হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে যে সম্মান দান করেছেন সে প্রদত্ত সম্মান স্বরূপ সিজদাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই ছিল আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য। কাতাদাহ (রহঃ)ও এরূপ বলেছেন। ইবরাহীম আল মুজানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা আদমকে কাবার ন্যায় করেছিলেন। অর্থাৎ আদমকে সামনে রেখে আল্লাহ তা‘আলাকেই সিজদাহ দেয়া। কেউ কেউ বলেছেন: এ সিজদাহটি ছিল সালাম ও সম্মানস্বরূপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَرَفَعَ اَبَوَیْھِ عَلَی الْعَرْشِ وَخَرُّوْا لَھ۫ سُجَّدًاﺆ وَقَالَ یٰٓاَبَتِ ھٰذَا تَاْوِیْلُ رُءْیَایَ مِنْ قَبْلُﺑ قَدْ جَعَلَھَا رَبِّیْ حَقًّا) “এবং ইউসুফ তার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাল এবং তারা সকলে তার সম্মানে সিজ্দায় লুটিয়ে পড়ল। সে বলল, ‘হে আমার পিতা! এটাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা; আমার প্রতিপালক সেটা সত্যে পরিণত করেছেন।”(সূরা ইউসূফ ১২:১০০) এরূপ সিজদাহ পূর্ববর্তী উম্মাতের মাঝে শরীয়তসম্মত ছিল, কিন্তু আমাদের শরীয়তে এটা নিষিদ্ধ। মু‘আয (রাঃ) বলেন: আমি সিরিয়াবাসীকে তাদের নেতৃবর্গ ও আলেমদের সামনে সিজদাহ করতে দেখেছিলাম। কাজেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল আপনি সিজদাহ পাবার বেশি হকদার। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: لَوْ كُنْتُ آمُرُ بَشَرًا أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْوَاجِهِنِّ আমি যদি কোন মানুষের জন্য সিজদাহ করার নির্দেশ প্রদান করতাম, তাহলে স্ত্রীদেরকে নির্দেশ প্রদান করতাম যে, তারা যেন তাদের স্বামীদেরকে সিজদাহ করে। (মু‘জামুল কাবীর: ৩৭৩) অতএব ইসলামী শরীয়তে কোন মানুষকে সিজদাহ দেয়ার বিধান নেই। সম্মানী সিজদাহ বা রূপক সিজদাহ সবই হারাম। অতএব কোন সম্রাট, পীর, বুজুর্গ ও আলেম মুর্শিদকেও সিজদাহ দেয়া হারাম ও শির্ক। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন আদমকে সিজদাহ দেয়ার জন্য তাঁর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। এটাই হল নির্দেশের বাস্তবায়ন। অধিকাংশ মুফাসসিরগণের মতামত এরূপ। (তাফসীর ইবনে কাসীর,অত্র আয়াতের তাফসীর) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. ফেরেশতারা আদম (আঃ)-কে সিজদাহ করেছিল তাঁর সম্মান ও মর্যাদাস্বরূপ। যা পালন করা ছিল আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত। ২. অহঙ্কার করে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ বর্জন করা শয়তানের কাজ। যা একজন মু’মিনকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। ৩. আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশকে কোন প্রকার যুক্তি দিয়ে বর্জন করা যাবে না। শরীয়ত যুক্তি দিয়ে চলে না, উক্তি দিয়ে চলে।

۞ أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

📘 ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আহলে কিতাবদের একটি ঘৃণিত আচরণের কথা তিরস্কারের সাথে বলেন: তোমরা নিজেরা মানুষদেরকে সৎ (ঈমান ও কল্যাণকর) কাজ করার নির্দেশ দাও অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে তা ছেড়ে দাও, তোমরা কি তা বুঝ না? এখানে মানুষের বোধশক্তিকে ‘আকল’বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে তার আকল বা বিবেক প্রথমেই তাকে ভাল কাজ করার প্রতি উৎসাহিত করে এবং খারাপ কাজের প্রতি নিরুৎসাহিত করে। অতএব যে ব্যক্তি অপরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজে করে না অথবা অপরকে খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করে কিন্তু সে বিরত থাকে না সে ব্যক্তি বিবেকবান নয়। আয়াতটি যদিও বানী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে কিন্তু তার বিধান সকলের জন্য প্রযোজ্য। (তাফসীরের সা‘দী, পৃ. ২৯) যারা মানুষদেরকে ভাল কাজের নির্দেশ দেয় কিন্তু নিজেরা জেনেশুনে তার বিপরীত করে তাদের ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে তিরস্কার ও শাস্তির কথা এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭑ کَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللہِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْنَﭒ) “হে মু’মিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? তোমরা যা কর না তোমাদের তা বলা আল্লাহর নিকট অতিশয় অসন্তোষজনক।”(সূরা সফ ৬১:২) আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: মি‘রাজের রাতে আমি দেখেছি যে, কতকগুলো লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? বল হল, এরা আপনার উম্মাতের বক্তা যারা মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ করত এবং নিজেরা করত না। তারা কিতাব পাঠ করত, কিন্তু তারা বুঝত না। (মুসনাদ আহমাদ হা: ১২৮৭৯ হাসান) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামাতের দিন একটি লোককে আনা হবে। যার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে এবং তার চারদিকে ঘুরতে থাকবে। অন্যান্য জাহান্নামীরা তাকে বলবে, জনাব আপনিতো আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করতেন, আপনার এ অবস্থা কেন? সে বলবে, আফসোস! আমি তোমাদেরকে ভাল কথা বলতাম কিন্তু নিজে আমল করতাম না। আমি তোমাদেরকে খারাপ হতে বিরত রাখতাম কিন্তু নিজে বিরত থাকতাম না। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৬৭, সহীহ মুসলিম হা: ২২৯০, ২২৯১) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. অন্যকে ভাল কাজের দিকনির্দেশনা দিয়ে নিজে তা না করা একটি ভয়াবহ অপরাধ।

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنْذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ تُنْذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

📘 ৬ নং আয়াতের তাফসীর: অত্র আয়াতে ও পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কাফিরদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (اِنَّ الَّذِیْنَ حَقَّتْ عَلَیْھِمْ کَلِمَةُ رَبِّکَ لَا یُؤْمِنُوْنَﮯ وَلَوْ جَا۬ءَتْھُمْ کُلُّ اٰیَةٍ حَتّٰی یَرَوُا الْعَذَابَ الْاَلِیْمَ) “নিশ্চয়ই যাদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিপালকের বাক্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের নিকট প্রত্যেকটি নিদর্শন আসে যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিুক শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।”(সূরা ইউনূস ১০:৯৬-৯৭) তাই বলে কাফিরদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না। কারণ আমাদের কাজ দাওয়াত দেয়া, হিদায়াত দেয়া নয়। হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আমরা তাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখানোর পর হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করব।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَىٰ وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

📘 ৬২ নং আয়াতের তাফসীর: যারা উম্মাতে মুহাম্মাদীর সৎ লোক, আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন করতঃ শরীয়ত মোতাবেক আমল করে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে প্রেরণের পূর্বে যে সকল ইয়াহূদী-খ্রিস্টান ও সাবিয়ী তাদের স্বীয় ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল ও তাওহীদভিত্তিক ঈমান এনেছিল, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী ছিল এবং আল্লাহ তা‘আলা যে সকল আমল পছন্দ করেন সে অনুপাতে আমল করেছিল, তাদের সকলকে আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ থেকে প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত প্রদান করবেন। তাদের কোন ভয় ও চিন্তা থাকবে না। কিন্তু নাবী (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাবী হিসেবে আগমনের পর কোন জাতির ধর্ম আল্লাহ তা‘আলা কবূল করবেন না। কেবল ইসলাম ছাড়া যা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে এসেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللّٰهِ الْإِسْلَامُ) “আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন (জীবন ব্যবস্থা) কেবল ইসলাম।”(সূরা আল-ইমরান ৩: ১৯) صابئين ‘সাবিয়ী’দ্বারা কাদের বুঝানো হয়েছে এ সম্পর্কে কয়েকটি মতামত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন: তারা ইয়াহূদীও নয়, খ্রিস্টানও নয়। অন্য একদল বলেন: তারা হল, যাদের কাছে নাবীর দাওয়াত পৌঁছেনি। আরেক দল বলেন: তারা কোন এক ধর্মের অনুসারী। তাদের কোন আমল, কোন কিতাব, কোন নাবী ছিল না কেবল এ কথা বলা ছাড়া যে, لا إله إلا اللّٰه আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর) সঠিক কথা হচ্ছে তারা হল খ্রিস্টানদের একটি দল। (তাফসীরে সা‘দী ৩২পৃঃ) এ আয়াতকে কেন্দ্র করে অনেকে বলে থাকে, সকল ধর্ম সমান। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা জরুরী নয়, যে কোন ধর্মের অনুসরণ করলেই চলবে। এ দর্শন বিভ্রান্তিকর দর্শন। বরং সঠিক কথা হল তা-ই যা পূর্বে উল্লেখ করেছি- নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আগমনের পর সকল ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মের অনুসরণ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِيْنًا فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ ج وَهُوَ فِي الْاٰخِرَةِ مِنَ الْخٰسِرِيْنَ) “আর যে কেউ ইসলাম বাদ দিয়ে অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা তালাশ করবে তার কাছ থেকে কিছুই কবূল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”(সূরা আলি-ইমরান ৩:৮৫) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. মুখের দাবি নয়, বরং প্রকৃত অবস্থা লক্ষণীয়। ইয়াহূদ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা যতই দাবি করুক যে তারা সঠিক ধর্মের অনুসারী তা কখনই সঠিক নয়। কারণ ইসলামের আগমনের পর সকল ধর্ম বাতিল। ২. যারা ইসলামে বিশ্বাসী হবে ও সৎ আমল করবে তাদের পরকালে রয়েছে মহাপুরষ্কার এবং তাদের কোন ভয়ও থাকবে না, কোন চিন্তাও থাকবে না।

وَإِذْ أَخَذْنَا مِيثَاقَكُمْ وَرَفَعْنَا فَوْقَكُمُ الطُّورَ خُذُوا مَا آتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

📘 ৬৩ নং আয়াতের তাফসীর: مِيْثَاقٌ বা অঙ্গীকার দ্বারা উদ্দেশ্য হল একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা, নিকটাত্মীয় ও পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করা, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (وَاِذْ اَخَذْنَا مِیْثَاقَ بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَ لَا تَعْبُدُوْنَ اِلَّا اللہَﺤ وَبِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا وَّذِی الْقُرْبٰی وَالْیَتٰمٰی وَالْمَسٰکِیْنِ وَقُوْلُوْا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَّاَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّکٰوةَﺚ ثُمَّ تَوَلَّیْتُمْ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْکُمْ وَاَنْتُمْ مُّعْرِضُوْنَﮢوَاِذْ اَخَذْنَا مِیْثَاقَکُمْ لَا تَسْفِکُوْنَ دِمَا۬ءَکُمْ وَلَا تُخْرِجُوْنَ اَنْفُسَکُمْ مِّنْ دِیَارِکُمْ ثُمَّ اَقْرَرْتُمْ وَاَنْتُمْ تَشْھَدُوْنَ) “আর যখন আমি বানী ইসরাঈল হতে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে ও আত্মীয়দের, অনাথদের ও মিসকিনদের সঙ্গেও (সদ্ব্যবহার করবে), আর তোমরা মানুষের সাথে উত্তমভাবে কথা বলবে এবং সালাত কায়িম করবে ও যাকাত প্রদান করবে; তৎপর তোমাদের মধ্য হতে অল্প সংখ্যক ব্যতীত তোমরা সকলেই বিমুখ হয়েছিলে যেহেতু তোমরা অগ্রাহ্যকারী ছিলে। এবং আমি যখন তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করছিলাম যে, পরস্পর রক্তপাত করবে না এবং স্বীয় বাসস্থান হতে আপন ব্যক্তিদেরকে বহিস্কৃত করবে না; তৎপর তোমরা স্বীকৃতি দিয়েছিলে এবং তোমরাই ওর সাক্ষী ছিলে।”(বাকারাহ ২:৮৩-৮৪) অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর পাহাড় তুলে ধরলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন: (وَاِذْ نَتَقْنَا الْجَبَلَ فَوْقَھُمْ کَاَنَّھ۫ ظُلَّةٌ وَّظَنُّوْٓا اَنَّھ۫ وَاقِعٌۭ بِھِمْﺆ خُذُوْا مَآ اٰتَیْنٰکُمْ بِقُوَّةٍ وَّاذْکُرُوْا مَا فِیْھِ لَعَلَّکُمْ تَتَّقُوْنَ) “স্মরণ কর, আমি পর্বতকে তাদের ঊর্ধ্বে উত্তোলন করি ছায়া সদৃশ। তারা মনে করল যে, সেটা তাদের ওপর পড়ে যাবে। বললাম, ‘আমি যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং তাতে যা আছে তা স্মরণ কর, যাতে তোমরা তাক্ওয়ার অধিকারী হও।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৭১) তারা আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার সঠিকভাবে পালন না করায় আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভীতিপ্রদর্শন মূলক তাদের মাথার ওপর পর্বত তুলে ধরে তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা সকল জাতির কাছ থেকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার অঙ্গীকার নিয়েছেন। ২. আমাদের উচিত নাবী ইসরাঈলের মত কিতাবকে ছেড়ে না দিয়ে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা, ফলে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করি।

خَتَمَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ ۖ وَعَلَىٰ أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

📘 ৭ নং আয়াতের তাফসীর: অর্থাৎ সত্য গ্রহণে কাফিরদের অন্তঃকরণ, শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তি আচ্ছাদিত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সত্য অনুধাবন করতে পারে না, শুনতে পায় না এবং দেখতেও পায় না। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এ ব্যাপারে উম্মাত ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, অন্তর মোহরাঙ্কিত করাও আল্লাহ তা‘আলা নিজের একটি বিশেষ গুণরূপে উল্লেখ করেছেন। মূলত কাফিরদের অন্তর ঈমান আনা থেকে মোহরাঙ্কিত হয়ে যায় তাদের কুফরীর প্রতিদানস্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (بَلْ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ) “বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন।”(সূরা নিসা ৪:১৫৫) হাদীসেও এসেছে আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের পরিবর্তনকারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করতেন: يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَي دِيْنِكَ হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী আমাদের অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখুন। (তিরমিযী হা: ২১৪০, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।) সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অন্তরে ফেতনা এমনভাবে উপস্থিত হয় যেমন একটি মাদুর। একটি একটি পাতা যুক্ত করে যেমন মাদুর তৈরি করা হয় ঠিক তেমনভাবে অন্তরে একটি একটি করে ফেতনা আসে। যে অন্তর তা গ্রহণ করে নেয় তাতে একটা কালোদাগ পড়ে যায়। সে অন্তরে কালো দাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষে সবটাই কালো করে দেয়। তখন তা উল্টানো কলসের মত হয়ে যায়; ভাল কথাও তার ভাল লাগে না এবং মন্দ কথাও খারাপ লাগে না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৪) হাদীসে এসেছে- মু’মিন যখন পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে ও বিরত থাকে তবে দাগটি মুছে যায় এবং অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ করতেই থাকে তখন সে কালো দাগ আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত অন্তরকে ছেয়ে ফেলে। এটাই সে মরিচা যার বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে- (كَلَّا بَلْ ﺒ رَانَ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ مَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ) “কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের ওপর মরিচারূপে জমে গেছে।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪)। (তিরমিযী হা: ৩৩৩৪, ইবনু মাযাহ হা: ৪২৪৪, ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।) সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা সত্য গ্রহণে সচেষ্ট থাকা। আর বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা: يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلٰي دِينِكَ “হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখ”। (তিরমিযী হা: ২১৪০, সিলসিলা সহীহাহ হা: ২০৯১) আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. জান্নাত পেতে হলে আমাদেরকে মু’মিন-মুত্তাকীদের গুণাবলী অর্জন করতে হবে, শুধু মৌখিক দাবি করে বসে থাকলে হবে না। ২. হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, আমাদের দায়িত্ব মানুষকে সঠিকভাবে দাওয়াত দেয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা। ৩. মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় তার কর্মের কারণে। কাফিররা তাদের কর্মের কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ৪. আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের মালিক, যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তাই আমাদের বেশি বেশি দু‘আ করা দরকার যেন তিনি আমাদের অন্তর দীনের ওপর অটল রাখেন।

ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُمْ مِنْ بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

📘 ৭৪ নং আয়াতের তাফসীর: বানী ইসরাঈলরা আল্লাহ তা‘আলার এতসব নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পরেও যখন আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি করল ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হল তখন তিনি তাদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে এ কথা বললেন। তাদের অন্তর কঠিন হবার কারণ এখানে বর্ণিত না হলেও আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বর্ণনা করে বলেন: (فَبِمَا نَقْضِھِمْ مِّیْثَاقَھُمْ لَعَنّٰھُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوْبَھُمْ قٰسِیَةًﺆ یُحَرِّفُوْنَ الْکَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِھ۪ﺫ وَنَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُکِّرُوْا بِھ۪ﺆ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلٰی خَا۬ئِنَةٍ مِّنْھُمْ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْھُمْ فَاعْفُ عَنْھُمْ وَاصْفَحْﺚ اِنَّ اللہَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَﭜ) “তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আমি তাদেরকে লা‘নত করেছি ও তাদের হৃদয়কে কঠিন করে দিয়েছি; তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করেছে এবং তারা যা আদিষ্ট হয়েছিল তার এক অংশ ভুলে গিয়েছে। তুমি সর্বদা তাদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলকেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখতে পাবে, সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা কর ও উপেক্ষা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদেরকে ভালবাসেন।”(সূরা মায়িদাহ ৫:১৩) এ ঘটনা তুলে ধরার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে এরূপ কঠোর হৃদয়ের মানুষ হতে নিষেধ করেছেন। অন্তরকে পাথরের চেয়ে কঠিন বলার কারণ হল, অনেক পাথর রয়েছে যা থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত হয়। আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তারা কাঁদে এমনকি আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহও তারা পাঠ করে। কিন্তু অন্তর যখন কঠিন হয় তখন আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে চক্ষু থেকে পানি ঝরে না, আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহও পাঠ করে না বরং আল্লাহ বিমুখ হয়ে যায়। অত্র আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, পাথর আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে, শুধু তাই নয় বরং আসমান ও জমিনের মাঝে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (تُسَبِّحُ لَھُ السَّمٰوٰتُ السَّبْعُ وَالْاَرْضُ وَمَنْ فِیْھِنَّﺚ وَاِنْ مِّنْ شَیْءٍ اِلَّا یُسَبِّحُ بِحَمْدِھ۪ وَلٰکِنْ لَّا تَفْقَھُوْنَ تَسْبِیْحَھُمْﺚ اِنَّھ۫ کَانَ حَلِیْمًا غَفُوْرًا) “সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।”(সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪৪) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: إِنِّى لأَعْرِفُ حَجَرًا بِمَكَّةَ كَانَ يُسَلِّمُ عَلَىَّ قَبْلَ أَنْ أُبْعَثَ إِنِّى لأَعْرِفُهُ الآنَ আমি মক্কার ঐ পাথরকে চিনি, যে আমার নবুওয়াতের পূর্বে আমাকে সালাম দিত। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৭৭, তিরমিযী হা: ৩৬২৪) উহুদ পাহাড় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: هَذَا جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ এ পাহাড়টি আমাদেরকে ভালবাসে এবং আমরাও তাকে ভালবাসি। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪২) আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলাকে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করার কারণে বানী ইসরাঈলের অন্তর কঠিন করে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের ওপর লা‘নত করা হয়েছিল। আমাদেরকে তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। ২. মু’মিনদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তারা কোমল হৃদয়ের অধিকারী। ৩. আসমান ও জমিনের মাঝে যা কিছু আছে সব আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে।

وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ ۖ وَآتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ۗ أَفَكُلَّمَا جَاءَكُمْ رَسُولٌ بِمَا لَا تَهْوَىٰ أَنْفُسُكُمُ اسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ

📘 ৮৭ নং আয়াতের তাফসীর: আল্লাহ তা‘আলা বানী ইসরাঈলের অবাধ্যতা, অহমিকা ও প্রবৃত্তি পূজার বর্ণনা তুলে ধরার পর যে সকল নেয়ামত তাদেরকে প্রদান করেছিলেন তার অন্যতম একটি এখানে উল্লেখ করে বলছেন যে, আমি মূসাকে কিতাব তথা তাওরাত দান করেছি। কিন্তু তারা (ইয়াহূদীরা) তাওরাতেও পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে এবং তার নির্দেশ অমান্য করেছে ও অপব্যাখ্যা করেছে। মূসা (আঃ)-এর পর বানী ইসরাঈলের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা ধারাবাহিকভাবে নাবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যেন তারা তাওরাতের বিধি-বিধান অনুপাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اِنَّآ اَنْزَلْنَا التَّوْرٰٿةَ فِیْھَا ھُدًی وَّنُوْرٌﺆ یَحْکُمُ بِھَا النَّبِیُّوْنَ الَّذِیْنَ اَسْلَمُوْا لِلَّذِیْنَ ھَادُوْا وَالرَّبّٰنِیُّوْنَ وَالْاَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوْا مِنْ کِتٰبِ اللہِ وَکَانُوْا عَلَیْھِ شُھَدَا۬ئَﺆ) “আমি তো অবতীর্ণ করেছিলাম তাওরাত যাতে ছিল হিদায়াত ও নূর। এ তাওরাতের মাধ্যমে ইয়াহূদীদের মীমাংসা দিত আল্লাহর অনুগত নাবী, দরবেশ ও ‘আলিমরা। কেননা তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের হিফাযাতের আদেশ প্রদান করা হয়েছিল আর তারা ছিল তার সাক্ষী।”(সূরা মায়িদাহ ৫:৪৪) কিন্তু বানী ইসরাঈলরা নাবীদের সাথে খুব অসদাচরণ করত। এসনদটি তারা কোন কোন নাবীদেরকে হত্যাও করেছে। আবার কোন কোন নাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। এর কারণ ছিল এটাই যে, নাবীরা যা কিছু নিয়ে আসত তা তাদের মনঃপুত হত না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (اَفَکُلَّمَا جَا۬ءَکُمْ رَسُوْلٌۭ بِمَا لَا تَھْوٰٓی اَنْفُسُکُمُ اسْتَکْبَرْتُمْﺆ فَفَرِیْقًا کَذَّبْتُمْﺑ وَفَرِیْقًا تَقْتُلُوْنَ) “কিন্তু পরে যখন তোমাদের নিকট কোন রাসূল তোমাদের প্রবৃত্তি যা ইচ্ছা করত না তা নিয়ে উপস্থিত হল, তখন তোমরা অহংকার করলে; অবশেষে একদলকে মিথ্যাবাদী বললে এবং একদলকে হত্যা করলে।”(সূরা বাকারাহ ২:৮৭) বানী ইসরাঈলের মাঝে নাবীদের আগমনের ধারাবাহিকতায় মূসা (আঃ)-র পর ঈসা (আঃ)- আগমন করেন। তিনি বানী ইসরাঈলের সর্বশেষ নাবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ইঞ্জিল প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর পর থেকে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত কোন নাবী আগমন করেননি। এ সময়টাকে فَتْرَةُ الرُّسُلِ বা রাসূল আগমনের বিরতিকাল বলা হয়। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে ঈসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরীয়ত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়িম করবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী প্রদান করেছিলেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (وَرَسُوْلًا اِلٰی بَنِیْٓ اِسْرَا۬ءِیْلَﺃ اَنِّیْ قَدْ جِئْتُکُمْ بِاٰیَةٍ مِّنْ رَّبِّکُمْﺫ اَنِّیْٓ اَخْلُقُ لَکُمْ مِّنَ الطِّیْنِ کَھَیْئَةِ الطَّیْرِ فَاَنْفُخُ فِیْھِ فَیَکُوْنُ طَیْرًۭا بِاِذْنِ اللہِﺆ وَاُبْرِیُٔ الْاَکْمَھَ وَالْاَبْرَصَ وَاُحْیِ الْمَوْتٰی بِاِذْنِ اللہِﺆ وَاُنَبِّئُکُمْ بِمَا تَاْکُلُوْنَ وَمَا تَدَّخِرُوْنَﺫ فِیْ بُیُوْتِکُمْﺚ) “আর তিনি হবেন বানী ইসরাঈলের একজন রাসূল। (তিনি কওমের কাছে গিয়ে বলবেন) আমি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে কিছু নিদর্শন নিয়ে এসেছি। যেমন আমি তোমাদের জন্য কাদামাটি দিয়ে পাখি আকৃতির ন্যায় তৈরী করব, তারপর তাতে ফুঁৎকার দেব, ফলে আল্লাহর নির্দেশে তা পাখিতে পরিণত হবে। আর আমি আল্লাহর নির্দেশে জন্মান্ধ ও শ্বেত রোগীকে ভাল করে দেব, মৃতকে জীবিত করব এবং তোমরা যা খাও এবং তোমাদের ঘরে যা জমা রাখ তাও বলে দেব।”(সূরা আলি-ইমরান ৩:৪৯) (وَاَیَّدْنٰھُ بِرُوْحِ الْقُدُسِ) ‘জিবরীল দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি’রুহুল কুদুস হলেন জিবরীল (আঃ)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: (نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ) জিব্রাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে। (সূরা শুআ‘রা ২৬:১৯৩) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: اللّٰهُمَّ أَيِّدْهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ ما نَافَحَ عن نَبِيِّكَ হে আল্লাহ! তুমি হাসানকে রুহুল কুদুস দ্বারা শক্তিশালী কর যতক্ষণ সে আপনার নাবীর পক্ষ থেকে উত্তর দিচ্ছে। (আবূ দাঊদ হা: ৫০১৫, তিরমিযী হা: ২৮৪৬, সহীহ) অতএব বুঝা যাচ্ছে রুহুল কুদুস দ্বারা উদ্দেশ্য হল জিবরীল (আঃ)। আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (আঃ)-কে জিবরীল দ্বারা সহযোগিতা করেছিলেন। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়: ১. আল্লাহ তা‘আলা নাবীদেরকে ফেরেশতার মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। ২. নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দেন তা মাথা পেতে মেনে নিতে হবে অন্যথায় মু’মিন হওয়া যাবে না, যেমন বানী ইসরাঈলের এক শ্রেণি নাবীদের পয়গাম মনঃপুত না হলে মেনে নিত না।